ঔষধে কাজ হয় সাথে সাথে গ্লোরিয়ার কণ্ঠস্বর অমায়িক আদুরে, “রোব্বি এমন করে না, উঁকি দেবার কথাটা আমি সত্যি সত্যি বলিনি, বাবা। এবার খুশীতো। এবার তুমি ছোঁড়া হও।”
রোব্বি অবশ্য এত সহজে হার মানে না। গোবিন্দ গোঁয়ারের মতো সে আকাশের দিকে তাঁকিয়ে থাকে এবং আগের চেয়েও দৃঢ়ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে চলে।
“প্লিজ, রোব্বি আমি ঘোড়ায় চড়বো।” ধাতব-বান্ধবের গলা তার গোলাপি তুলতুলে হাতে শক্ত করে সে জড়িয়ে ধরে। তারপরে, কি মনে হতে, সে গলা থেকে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে সরে বসে। “তুমি যদি ঘোড়া না হও, আমি কিন্তু তাহলে কাঁদব,” কথাটা যে মিথ্যা না সেটা বোঝাতে সে তার মুখে কান্নার পূর্বাভাস ফুটিয়ে তোলে।
ইস্পাতহৃদয় রোব্বি ভয়াবহ সম্ভাবনাটাকে খুব একটা গুরুত্ব না দিয়ে ৩তীয়বারের মতো মাথা নাড়ে। গ্লোরিয়া এবার বাধ্য হয় তার শেষ আর মোক্ষম চা|ল দিতে।
“তুমি যদি ঘোড়া না হও,” প্রাণবন্ত কণ্ঠে সে ঘোষণা করে, “আমি আর (তামাকে কোনো গল্প শোনাব না, এটাই আমার শেষ কথা। একটা গল্পও-”
চরমপত্রে কাজ হয়, রোব্বি সাথে সাথে এবং নিঃশর্তে রাজি হয়, সবেগে মাথা নাড়তে থাকে, এবার অবশ্য অন্য উদ্দেশ্যে, যতক্ষণ না তার ধাতব ঘাড়ে গুঞ্জন শোনা না যায়। সাবধানে বাচ্চা মেয়েটাকে সে এবার তুলে নিয়ে তার চওড়া,সমান কাঁধে বসিয়ে দেয়।
গ্লোরিয়ার কান্না কোথায় উবে যায় এবং আনন্দে বাচ্চা মেয়েটা অস্থির হয়ে উঠে। শরীরের অভ্যন্তরে স্থাপিত কয়েলের সাহায্যে রোব্বির দেহের ধাতব বহিরাবরণের তাপমাত্রা সর্বদা সত্তরে স্থির রাখা হয়, গ্লোরিয়ার পায়ের জুতা তার ধাতব বুকে আঘাত করলে ছন্দোবদ্ধ একটা সুরের জন্ম হয়।
“তুমি একটা পঙ্খিরাজ ঘোড়া। বিশাল সাদা একটা পঙ্খিরাজ ঘোড়া। তোমার হাত দু’টো সোজা বাড়িয়ে রাখো।- হাত দুটো সোজা রাখতেই হবে রোব্বি, যদি তুমি আমার পঙ্খিরাজ ঘোড়া হতে চাও।”
একটা অমোঘ যুক্তি কাজ করে পুরো ব্যাপারটার পেছনে। রোব্বির হাত দুটো হল ডানা যার কাজ হল বাতাস কাটা আর রোব্বি নিজে হল পঙ্খিরাজ ঘোড়া।
লাগাম ধরে টানার মতো গ্লোরিয়া মাথাটা মোচড় দেয় এবং ডানদিকে ঘোরায়। পঙ্খিরোব্বি কাত হয়ে তীক্ষ্ণ বাঁক নেয়। গ্লোরিয়া তার যান্ত্রিক পঙ্খিরাজে একটা মোটর সংযুক্ত করে যা “ব্রা-ব্রার-ব্রাব্রার” আওয়াজ করে, এবং তারপরে “পোওও” আর “শশ-শশশশ” শব্দে অস্ত্র সজ্জিত করে। পঙ্খিরাজকে জলদস্যুরা তাড়া করতে সে ব্লাষ্টার বের করে। অঝোর বর্ষণে জলদস্যুদের দফারফা হয়ে যায়।
“ঐ একটাকে ঘায়েল করেছি।–আরো দুটো সাবাড়,” সে চিৎকার করতে থাকে।
তারপরে “আরো জোরে চল,” গ্লোরিয়া উৎফুল্ল কণ্ঠে বলে, “আমাদের গোলাবারুদ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে।” অদম্য সাহসে কাঁধের উপর দিয়ে সে হাতের অস্ত্র তাঁক করে এবং রোব্বি ভোতামুখো যান্ত্রিক পঙ্খিরাজ ধ্বংসযজ্ঞের উপর দিয়ে সর্বোচ্চ গতিতে উড়ে চলে।
লম্বা ঘাসের গালিচা লক্ষ্য করে খোলা মাঠের উপর দিয়ে সে উড়ে গিয়ে হঠাৎ থামতে তার উৎসাহী আরোহী আর্তনাদ করে উঠে এবং সে তাকে সবুজ ঘাসের নরম আস্তরণে টুপ করে ফেলে দেয়।
রুদ্ধশ্বাসে হাঁফাতে থাকে গ্লোরিয়া এবং তারই মাঝে হতবাক বিস্ময়ে গুনগুন করে, “অসাধারণ একটা ব্যাপার!”
মেয়েটা দম ফিরে পাওয়া পর্যন্ত রোব্বি অপেক্ষা করে এবং তার পরে আস্তে করে তার চুলের ঝুটি ধরে টান দেয়।
“তোমার কিছু লাগবে?” গ্লোরিয়া চোখে ভাজা মাছ উল্টাবার নিয়ম না জানা একটা ভাব ফুটিয়ে জিজ্ঞেস করে তবে তার “সেবকআয়া” তাতে মোটেই ভুলে না। সে এবার একটু জোরে চুল টানে।
“ওহ, আমি জানি। তুমি গল্প শুনতে চাও?”
রোব্বি যান্ত্রিক বেগে মাথা নাড়ে।
“কোনটা?”
এক আঙ্গুলে রোব্বি বাতাসে একটা অর্ধ-বৃত্ত আঁকে।
ছোট মেয়েটা প্রতিবাদ করে, “আবার? সিনডারেলার গল্প আর না হোক হাজারবার আমি বলেছি তোমাকে। তোমার কি একটুও ক্লান্ত লাগে না?- ওটা দুগ্ধপোষ্যদের গল্প।”
আরেকটা অর্ধ-বৃত্ত।
“ঠিক আছে,” গ্লোরিয়া গুছিয়ে বসে বলে, মনে মনে পুরো গল্পটা একবার ভেবে নেয় (তার নিজস্ব সংযোজিত অংশগুলোও, বেশ কয়েকটা জায়গায় সে নিজে সংযোজন করেছে) এবং শুরু করে :
“তুমি তৈরী? বেশ–কোনো এক সময়ে এলা নামে একটা সুন্দর ফুটফুটে মেয়ে ছিল। এবং তার ছিল এক ভয়ানক নিষ্ঠুর সৎ-মা আর তার চাইতেও কুৎসিত আর আরো বেশী নিষ্ঠুর দুটো সৎ-বোন এবং—”
.
গ্লোরিয়া গল্পের চরম পরিণতির কাছাকাছি পৌঁছায়- মধ্যরাত্রি প্রায় সমাগত এবং সবকিছু চোখের নিমেষে আবার তাদের জীর্ণ আদল ফিরে পায়, ধাতব চোখে যান্ত্রিক উত্তেজনা নিয়ে রোব্বি গোগ্রাসে গল্প শুনে- ঠিক তখনই সবকিছুতে ছেদ পড়ে।
“গ্লোরিয়া!”
একবার না বেশ কয়েকবার ডেকেছে এমন এক মহিলার তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর ভেসে আসে; এবং তার বিচলিত কণ্ঠস্বরই বলে দেয় অসহিষ্ণুতা উৎকণ্ঠার কাছে পরাভব মানছে।
“মা আমায় ডাকছে,” গ্লোরিয়া বলে, তার কণ্ঠে অসন্তোষ চাপা থাকেনা। “রোব্বি তুমি বরং আমায় বাসায় ফিরিয়ে নিয়ে চল।”
কোনোপ্রকার দ্বিধা না করেই, রোব্বি মিসেস.ওয়েসটনের আদেশ পালন করে কারণ কোনোভাবে তার মনে হয় সেটাই যুক্তিসঙ্গত হবে, তাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে সে তার ডাকে সাড়া দেয়। রবিবার ছাড়া গ্লোরিয়ার বাবা দিনের বেলা সাধারণত বাসায় থাকে না- আজ যেমন রবিবার এবং বাসায় সে একজন সহমর্মী আর আন্তরিক ব্যক্তি। অন্যদিকে গ্লোরিয়ার মাকে রোব্বি একটু সমঝে চলে এবং সবসময়ে সে চেষ্টা করে তার দৃষ্টির আড়ালে থাকতে।