ছোট ছোট ঠোঁট দুটো শক্ত করে চেপে বসে এবং ভ্রুকুটির কারণে কোঁচকানো কপালে সে ধুপধাপ পা ফেলে ড্রাইভওয়ে অতিক্রম করে দোতলা বাসাটার দিকে হাঁটা ধরে।
হাঁটামাত্র পেছন থেকে ভেসে আসা মড়মড় শব্দ সাথে রোব্বির ধাতব পায়ের ছন্দোবদ্ধ আর যান্ত্রিক থপথপে সে টের পায় বড্ড দেরী হয়ে গেছে। দ্রুতবেগে ঘুরে দাঁড়াতেই সে তার বিজয়ী বান্ধবকে গুপ্ত স্থান থেকে বের হয়ে পূর্ণদ্যোমে বুড়ি ছুতে ছুটে যেতে দেখে।
হতাশ গ্লোরিয়া তীক্ষ্ণ কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠে। “রোব্বি দাঁড়াও! রোব্বি এটা মোটেই ঠিক হচ্ছে না! তুমি প্রতিজ্ঞা করেছিলে আমি তোমাকে খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত তুমি দৌড়াবে না।” বেচারীর ছোট ছোট পায়ের ধাপ রোব্বির দানবীয় ধাপের সাথে এটে উঠতে পারে না। তারপরে, বুড়ি ছোঁয়ার মাত্র দশফিট আগে দানবটার গতি পিঁপড়েকেও হার মানাবে এমন শ্লথ হয়ে যায়, আর গ্লোরিয়া, পড়িমড়ি করে সাধ্যের শেষ দমটুকু জুটিয়ে নিয়ে ছুট দেয় আর হাঁফাতে হাঁফাতে তাকে অতিক্রম করে বুড়ি ছোবার প্রথম উফুল্ল চিৎকারটুকু নিজের করে নেয়।
আনন্দে চোখমুখ ঝালিয়ে নিয়ে, সে তার চিরবিশ্বস্ত রোব্বির দিকে এবার ঘুরে তাকায়, এবং তার আত্মত্যাগকে পুরস্কৃত করে তার দৌড়াবার অক্ষমতাকে নিষ্ঠুরভাবে উত্যক্ত করে, সাথে যুক্ত হয় অকৃতজ্ঞ শব্দযুক্ত আরও অনেক বাক্য।
“ছিঃ ছিঃ রোব্বি দৌড়াতে পারে না,” আট বছরের কণ্ঠকে তীক্ষ্ণতার সপ্তমে নিয়ে গিয়ে সে বলে। “আমি যখন খুশি তোমাকে হারাতে পারবো। আমি যখন তখন তোমাকে হারাতে পারবো।” কর্কশ কর্ণবিদারী ছন্দে সে শব্দগুলো আওড়াতে থাকে।
রোব্বি কোনো উত্তর দেয় না, অবশ্যই শোনা যায় এমন কোনো শব্দ বা শব্দাংশ সে ব্যবহার করে না। তার বদলে নির্বাক ভাঁড়ামিপূর্ণ ভঙ্গিতে সে গ্লোরিয়ার ঠিক নাগালের বাইরে দৌড়াতে দৌড়াতে সাবলীল ভঙ্গিতে প্রতিবারই তার নাগালের বাইরে থাকলে একটা সময়ে গ্লোরিয়া দেখে সেও তার পেছন পেছন অসহায়ভাবে বৃত্তাকারে দৌড়াচ্ছে, ছোট ছোট হাত দুটো প্রসারিত এবং বাতাসে আন্দোলিত হতে থাকে।
“রোব্বি,” সে তীব্র অভিযোগের কণ্ঠে বলে, “চুপটি করে দাঁড়াও বলছি!”–এবং বাতাসের অভাবে খাবি খেলে হাসি আপনাআপনি বন্ধ হয়ে যায়।
-যতক্ষণ না সে সহসা ঘুরে দাঁড়ায় এবং তাকে তুলে নিয়ে শূন্যে ঘোরাতে থাকে ফলে এক মুহূর্তের জন্য চারপাশের পৃথিবী নভোনীলের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে এবং সবুজ বৃক্ষরাজি ক্ষুধার্ত ভঙ্গিতে বিস্তারিত হয়ে নিচের শূন্যতায় মিলিয়ে যায়। পরমুহূর্তে সে নিজেকে ঘাসের উপরে বসে থাকতে দেখে, দানবটার যান্ত্রিক পায়ের কাছে ঝুঁকে রয়েছে, এবং তখনও সে তার একটা ধাতব আঙ্গুল আঁকড়ে রয়েছে।
কয়েক মুহূর্ত পরে তার নিঃশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে আসে। মাকে নকল করে মাথার এলোমেলো চুলগুলোকে খামোখাই হাত দিয়ে পিছনে ঠেলে দেয় এবং পরমুহূর্তে ঘাড় বাঁকিয়ে দেখতে চেষ্টা করে কাপড় ছিঁড়েছে কিনা। রোব্বির বুকে সে হাত দিয়ে আঘাত করে, “পচা ছেলে! আমি তোমাকে মারব!”
এবং রোব্বি ভয়ে গুটিসুটি হয়ে, হাত দিয়ে মুখ ঢাকলে সে তখন আরও যোগ করে, “না, আমি মোটেই তা করবো না। না, আমি তোমাকে মারবো না। কিন্তু যাইহোক, এবার আমার লুকাবার পালা কারণ তোমার ঠ্যাঙগুলো বেজায় লম্বা আর তুমি প্রতিজ্ঞা করেছিলে আমি তোমাকে খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত তুমি দৌড় দেবে না।”
রোব্বি বাধ্য ছেলের মতো মাথা নাড়ে- মাথা বলতে ছয়তলবিশিষ্ট একটা ছোট প্রিজমাকৃতি বস্তু যার প্রান্তগুলো গোলাকার এবং যার কিনারাটা একটা ছোট নমনীয় সংযোগের দ্বারা বৃহদাকৃতি আরেকটা প্রিজমের সাথে সংযুক্ত যা দেখতে অনেকটা, মানবদেহের মতো এবং সুবোধ ছেলের মতো গাছের দিকে মুখ ফিরিয়ে রাখে। তার উজ্জ্বল চোখের উপরে একটা পাতলা ধাতব পর্দা নেমে আসে এবং দেহের অভ্যন্তর থেকে একটা নিয়মিত ধাতব প্রতিধ্বনি শোনা যায়।
“এখনই উঁকি দিও না আর কোনো সংখ্যা যেন বাদ না যায়,” সমঝে দিয়ে গ্লোরিয়া হন্তদন্ত হয়ে লুকাতে যায়।
কোন প্রকার ব্যতিক্রম ছাড়াই, সেকেন্ডের পলক পড়তে থাকে এবং একশ হবার সাথে সাথে রোব্বির চোখের উপর থেকে ঢাকনি উঠে গেলে সে তার চকচকে চোখে চারপাশের সম্ভাব্য স্থানগুলো রেকি করতে আরম্ভ করে। একটা পাথরের পেছন থেকে বের হয়ে থাকা রঙিন কাপড়ের উপরে তার দৃষ্টি সামান্য সময় থমকে থাকে। সে কয়েক পা এগিয়ে আসে এবং নিশ্চিত হয় যে গ্লোরিয়া সেটার পেছনে উবু হয়ে আছে।
গ্লোরিয়া আর বুড়ি-গাছের মাঝে সব সময় অবস্থান করে, ধীরে ধীরে সে গুপ্তস্থানের দিকে এগোতে থাকে এবং গ্লোরিয়া যখন দৃষ্টিসীমার ভেতরে চলে আসে এবং কোনো মতেই যখন আর নিজেকে প্রবোধ দেয়া সম্ভব না কেবল তখনই সে তার দিকে এক হাত বাড়িয়ে দেয়, অন্যহাত দিয়ে নিজের পায়ে আঘাত করে যাতে সেটা পুনরায় বেজে উঠে। গোমড়া মুখে গ্লোরিয়া বের হয়ে আসে।
“তুমি আগেই উঁকি দিয়েছো!” সে হতাশ কণ্ঠে বলে, গলায় তার অন্যায্য সুর। “আর তাছাড়া লুকোচুরি খেলতে খেলতে আমি হেঁদিয়ে গেছি, আমি ঘোড়ায় চড়বো।”
কিন্তু অন্যায়ভাবে অভিযুক্ত করায় রোব্বি কষ্ট পায়, সে সাবধানে বসে এবং অভিমানভরে মাথা নাড়তে থাকে।