ইউ.এস রোবটসের অফিস আর কারখানা নিজেই একটা ছোটখাটো শহর, পরিকল্পিত আর ছিমছাম। পুরোটা একটা এরিয়াল ফটোগ্রাফের মতো বিছিয়ে রয়েছে।
‘আমি প্রথম যখন এখানে আসি,’ সে বলে, এখন যেখানে অগ্নিনির্বাপকের অফিস সেখানে একটা ভবনের ছোট্ট কামরায় ছিল আমার অফিস?’ সে আঙ্গুল দিয়ে জায়গাটা দেখায়। ‘তোমার জন্মের আগেই সেটাকে ভেঙে ফেলা হয়েছে। আমার সাথে তখন আয়ো তিনজন ছিল সেই কামরায়। একটা ডেস্কের অর্ধেকটা আমি ভাগে পেতাম। আমরা আমাদের সব রোবটই তখন একটা ভবনেই তৈরী করতাম। সপ্তাহে তিনটা রোবট। আর আজ আমাদের দেখ।’
‘পঞ্চাশ বছর,’ নাছোড়বান্দার মতো আমি বলি, অনেক দীর্ঘ সময়।
‘পিছনে তাকিয়ে আজ কিন্তু আমার তা মনে হচ্ছে না,’ মৃদু কণ্ঠে সে বলে। ‘তুমি অবাক হচ্ছে কিভাবে এত দ্রুত তারা হারিয়ে গেল ভেবে।’
সে আবার তার ডেস্কের কাছে ফিরে আসে এবং চেয়ারে বসে। কোনোভাবে, চেহারায় বিষণ্ণতা ফুটিয়ে না তুলেও সে নিজের মনোভাব ব্যক্ত করতে পারে।
‘তোমার বয়স কত?’ সে আমার কাছে জানতে চায়।
‘বত্রিশ চলছে,’ আমি বলি।
‘তাহলে রোবটবিহীন পৃথিবীর কোনো স্মৃতি তোমার নেই। একটা সময় ছিল যখন মানুষ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের দিকে একাকী তাকিয়ে থাকতো নিঃসঙ্গ বন্ধুহীন। এখন তাকে সাহায্য করার জন্য কেউ রয়েছে, তার চেয়ে শক্তিশালী, অনেক বিশ্বস্ত অনেক বেশী কার্যকর আর পুরোপুরি তার প্রতি সমর্পিত। মানুষ এখন আর একা না। এভাবে কখনও ব্যাপারটা ভেবে দেখেছ?’
‘সত্যি বলতে কি না। আমি কি আপনার কথাটা উদ্ধৃত করতে পারি?
‘তোমার ইচ্ছা। তোমার কাছে রোবট কেবলই একটা রোবট। গিয়ার আর ধাতু; বিদ্যুৎ আর পজিট্রনের সমাহার– মন আর ইস্পাতের সমন্বয়! মানুষের সৃষ্টি! প্রয়োজন হলে, মানুষের দ্বারা ধ্বংস হবে! কিন্তু তুমি কখনও তাদের সাথে কাজ করনি, তাই তুমি তাদের জানো না। তারা আমাদের চাইতে অনেক পরিচ্ছন্ন একটা জাত।’
আমি তাকে ধীরে ধীরে কথার দ্বারা উত্তেজিত করতে চেষ্টা করি, ‘আমি আপনার কাছে আপনার অভিজ্ঞতার কথা শুনতে চাই; রোবট সম্পর্কে আপনার মনোভাবের কথা জানতে চাই। পুরো সৌর-জগতে আন্তঃগ্রহ প্রেস তারাবার্তা পৌঁছে দিতে আজ, সক্ষম। সম্ভাব্য পাঠকের সংখ্যা তিনশো কোটি। রোবট সম্পর্কে তারা আপনার মতামত শুনতে আগ্রহী।’
তাকে উত্তেজিত করার আসলে কোনো প্রয়োজন ছিল না। আমার কথা সে শুনতেই পায়নি কিন্তু ঠিক দিকেই সে চলেছে।
.
‘শুরু থেকেই তারা সেটা জানে। আমি এখানে যোগ দেবার আগে থেকে–পৃথিবীতে ব্যবহার উপযোগী রোবট আমরা বিক্রি করেছি। অবশ্য সে সময়ের রোবট কথা বলতে পারতো না। পরবর্তীকালে তারা অনেকাংশে মানবিক হয়ে উঠে আর তখনই শুরু হয় গোলমাল, বিতর্কের জন্ম হয়। মানুষের কাজের সাথে রোবটের প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিরুদ্ধে শ্রমিক সংঘগুলো জোরালো প্রতিবাদ শুরু করে এবং বিভিন্ন ধর্মীয় মতবাদ তাদের সংস্কারপূর্ণ প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠে। পুরোটাই ছিল হাস্যকর আর অপ্রয়োজনীয়। কিন্তু তারপরেও তারা করে।’
আমার পকেট রেকর্ডারে আমি মাছিমারা কেরানির মতো সব তুলে নিতে থাকি, আমার হাতের আঙ্গুলের নড়াচড়া যাতে চোখে না পড়ে সে দিকেও লক্ষ্য রাখি। একটু অভ্যেস করলেই পকেট থেকে বের না করেও যে কেউ দক্ষতার সাথে ছোট যন্ত্রটায় সবকিছু তুলতে পারবে।
‘রোব্বির কথাই ধর,’ সে বলে। ‘আমি তাকে চিনতাম না। আমি যোগ দেবার আগের বছরে তাকে বিযুক্ত করা হয়েছিল–কার্যকারিতার দিন শেষ হবার কারণে। কিন্তু জাদুঘরে সেই ছোট্ট মেয়েটাকে আমি দেখেছি–’
সে থামে, কিন্তু আমিও কোনো কথা বলি না। আমি দেখি তার চোখ বাষ্পরুদ্ধ হয়ে উঠেছে আর মনটা চলে গেছে স্মৃতির গভীরে। অনেকটা সময় পিছনে তাকে যেতে হয়েছে।
‘আমি পরে ব্যাপারটা সম্পর্কে শুনি এবং তখন তারা আমাদের ঈশ্বরদ্রোহী আর শয়তানের স্রষ্টা হিসাবে যখন অভিহিত করতে থাকে। আমার সব সময়ে তার কথা মনে হত। রোব্বি ছিল কণ্ঠস্বরহীন একটা রোবট। সে কথা বলতে পারতো না। তাকে ১৯৯৬ সালে তৈরী আর বিক্রি করা হয়েছিল। সেটা ছিল প্রকট বিশেষায়িত শ্রমের আগের দিনগুলো, তাকে তাই আয়া হিসাবে বিক্রি করা হয়েছিল–’
‘কি হিসাবে?’
‘আয়া বা তোমরা যাকে বুয়া বলে থাক–’
.
সূচিপত্র
প্রথম অধ্যায়
তুর্কিনাচ
কারণ-অকারণ
ফেরারী রোবট
মিথ্যেবাদী!
নিখোঁজ খুদে রোবট
পলায়ন
প্রত্যয়ন
অনিবার্য সংঘাত
.
১. প্রথম অধ্যায়
“আটানব্বই- নিরানব্বই- একশ।” চোখের সামনে থেকে গ্লোরিয়া তার নাদুসনুদুস হাত দু’টো সরিয়ে, এক মুহূর্ত একটু দাঁড়ায় এবং হাতের উল্টো পিঠে নাক ডলতে ডলতে সূর্যের আলোতে চোখ। পিটপিট করে। তারপরে যে গাছের গায়ে সে এতক্ষণ হেলান দিয়ে ছিল সেটার কাছ থেকে কয়েক পা সরে এসে চারপাশটা একবারে দেখে নিতে চেষ্টা করে।
ঘাড় উঁচু করে ডানপাশে একটা ঝোঁপের সম্ভাবনা যাচাই করে নিয়ে আরও কয়েক পা সরে আসে ভালো করে তার নিচে বিছিয়ে থাকা অন্ধকার পর্যবেক্ষণের অভিপ্রায়ে। ক্রমাগত ঝিল্লীর গুঞ্জন ছাড়া চারপাশে চাপচাপ নিরবতা এবং মধ্যাহ্নের প্রখর সূর্যালোকে মাঝে মাঝে পাখির কলরব শুনতে পাওয়া যায়।
ঠোঁট বেঁকিয়ে গ্লোরিয়া বলে, “আমি বাজি ধরে বলতে পারি সে বাসায় লুকিয়েছে আর অন্তত হাজারবার আমি তাকে বলেছি ব্যাপারটা চিট-এর পর্যায়ে পড়ে।”