লম্বা করিডোরের অভ্যন্তরে কয়েক প্রস্থ সিঁড়ি টপকে তাদের তিন জনকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবার সময় পুরোটা পথ পারতপক্ষে সে কম কথা বলে। তারপরে, তারা যখন উজ্জ্বলভাবে আলোকিত একটা ঘরে প্রবেশ করে যার দরজাটা একটা ধাতব গুঞ্জন তুলে খুলে যেতেই আবার শুরু হয় ব্যাখ্যানের ঢল।
“এই যে আমরা এসে গেছি!” বলার সময়ে তার গলায় প্রচ্ছন্ন গর্ব ঠিকই টের পাওয়া যায়। “শুধুই রোবট! তদারককারী হিসাবে পাঁচ জন লোক রয়েছে অবশ্য তারা এই ঘরে অবস্থান করে না। আজ পাঁচ বছর, মানে প্রকল্পটা শুরু করার সময় থেকে, আজ পর্যন্ত একটাও দুর্ঘটনা ঘটেনি। যদিও এখানে যেসব রোবট সংযোজিত করা হয় গঠনের দিক থেকে তারা বেশ, কিন্তু…”
গ্লোরিয়ার কানে অবশ্য জেনারেল ম্যানেজারের কণ্ঠস্বর কোনো হেলদোল তুলে না। পুরো সফরটাই তার কাছে অর্থহীন বেকার মনে হয়, যদিও চোখের সামনে সে অনেক রোবটই দেখতে পায়। রোব্বির সাথে কোনোটার সামান্যতম মিলও নেই, এবং বিতৃষ্ণা লুকাবার সামান্যতম চেষ্টাও করে না।
সে লক্ষ্য করে দেখে, ঘরের ভিতরে, সেখানে একজন লোকও নেই। তখনই ঘরের প্রায় মধ্যেখানে একটা গোল টেবিলের চারপাশে ব্যস্ত ছয় সাতটা রোবটের উপরে তার নজর আটকে যায়। অবিশ্বাসের বাতাস তার চোখ দুটোকে বেলুনের মতো ফুলিয়ে দেয়। ঘরটা বিশাল। সে ঠিক নিশ্চিত হতে পারে না, কিন্তু রোবটগুলোর ভিতরে একটা রোবট দেখতে দেখতে অনেকটা না পুরোটাই!
“রোব্বি!” তার তীক্ষ্ণ চিৎকারে ঘরের বাতাসে চিড় ধরে এবং টেবিলের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা একটা রোবট চমকে উঠে তার হাতের জিনিসটা ফেলে দেয়। আনন্দে গ্লোরিয়ার পাগল হতে বাকি থাকে। ওয়েসটন দম্পতি কিছু বুঝে উঠবার আগেই, রেলিংএর ফাঁক গলে সে ঝুপ করে কয়েক ফিট নিচে অবস্থিত মেঝেতে লাফ দিয়ে নামে এবং হাত নাড়তে নাড়তে তার রোব্বির দিকে দৌড়ে যায় বাতাসে মেয়েটার চুল নিশানের মতো আন্দোলিত হতে থাকে।
এবং আতঙ্কিত তিন প্রাপ্তবয়স্ক, তারা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানেই জমে যায়, অবাক হয়ে তারা দেখে উৎফুল্ল মেয়েটা–একটা বিশাল ট্রাক্টর কর্কশ শব্দ করতে করতে অন্ধের মতো তার পূর্ব নির্ধারিত পথে এগিয়ে চলেছে- সেটা লক্ষ্যই করেনি।
সংবিৎ ফিরে পেতে ওয়েসটন দম্পতির কয়েক মুহূর্ত সময় লাগে এবং সেই কয়েক মুহূর্তেই নির্ধারিত হয়ে যায় গ্লোরিয়াকে আর ধরা সম্ভব না। ওয়েসটন ___ মতো রেলিং টপকায় কিন্তু বৃথা চেষ্টা। স্ট্রথার্স হঠাৎ ক্ষেপে গিয়ে তদারককারীদের ট্রাক্টর বন্ধ করতে বলে, কিন্তু তদারককারীরাও মানুষ এবং প্রতিক্রিয়াও সময়সাপেক্ষ।
রোব্বিই কেবল সাথেসাথে আর যথাযথ পদক্ষেপ নেয়।
নিজের আর তার খুদে মনিবকন্যার মাঝের দূরত্ব ধাতব পায়ের সাহায্যে নিমেষে অতিক্রম করে সে বিপরীত দিক থেকে ছুটে আসে। সবকিছু যেন এক মুহূর্তের ভিতরে ঘটে যায়। গতিবেগ অণুপরিমাণ শ্লথ না করেই, রোব্বি একহাতের ঝাঁপটায় গ্লোরিয়াকে তুলে নেয়, যার ফলে মেয়েটা বাতাসের অভাবে খাবি খায়। ওয়েসটন ঠিক বুঝতে পারে না কি ঘটছে, চোখে দেখার চাইতে সে বরং অনুভব করে, রোব্বি তাকে অতিক্রম করে এবং হতভম্ভ হয়ে সে সটান থেমে যায়। রোব্বি অতিক্রম করার আধ সেকেন্ড পরে ট্রাক্টর সেখানে পৌঁছে যেখানে গ্লোরিয়া দাঁড়িয়ে ছিল, আরও দশফিট দূরত্ব অতিক্রম করার পরে সশব্দে থেমে যায়।
গ্লোরিয়া দম ফিরে পেতে, বাবা মার আবেগতাড়িত আলিঙ্গনের পালা শেষ হলে সে তুমুল আগ্রহে রোব্বির দিকে তাকায়। কি ঘটেছে সে বিষয়ে সে মোটেই ওয়াকিবহাল না সে কেবল ধর্তব্যের মধ্যে ধরে যে সে তার বন্ধুকে ফিরে পেয়েছে।
ওদিকে মিসেস.ওয়েসটনের অভিব্যক্তি স্বস্তি থেকে সন্দিগ্ধতায় রূপান্তরিত হয়। সে তার স্বামীর দিকে তাকায়, নিজের বিপর্যস্ত আলুথালু বেশভূষা সত্ত্বেও তাকে ব্যক্তিত্বপূর্ণই দেখায়, “পুরোটাই তোমার সাজানো নাটক, তাই না?”
রুমাল দিয়ে জর্জ ওয়েসটন কপালের ঘাম মুছে। তার হাত কাঁপে এবং ঠোঁটের কোণে খুবই দূর্বল কম্পিত হাসি ফুটে উঠে।
মিসেস. ওয়েসটন তার ভাবনার জট ছাড়াতে থাকেন, “নির্মাণ কিংবা কারিগরি কাজের উপযোগী করে রোব্বিকে তৈরী করা হয়নি তাদের কাছে তার কোনো মূল্যই নেই। তুমি তাকে ইচ্ছা করেই তাদের মাঝে রেখেছো যাতে তোমার সোহাগিনী মেয়ে তাকে খুঁজে পায়। তুমিই করেছো তোমারই কাজ।”
“বেশ মানলাম আমি করেছি,” ওয়েসটন উত্তর দেয়। “কিন্তু গ্রেস, আমি কিভাবে জানব যে তাদের পূনর্মিলনে এত হাঙ্গামা হবে? আর তাছাড়া রোব্বি তোমার মেয়ের জীবন বাঁচিয়েছে; তোমাকে এটা মানতেই হবে। তুমি আর জঞ্জালটাকে বিদায় করতে পারবে না।”
গ্রেস ওয়েসটন ব্যাপারটা নিয়ে কিছুক্ষণ ভাবে। সে গ্লোরিয়া আর রোব্বির দিকে বিমূর্তভাবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। গ্লোরিয়া এমন ভাবে রোবটটার গলা জড়িয়ে রয়েছে যে, ধাতুর তৈরী না হলে এতক্ষণে সে অক্কা পেত, আর বিড়বিড় করে উন্মত্তের মতো কি যেন বকে যাচ্ছে। রোব্বির ক্রোম ইস্পাতের তৈরী বাহু (দুই ইঞ্চি ব্যাসের ইস্পাতের পাত বাদামের খোসার মতো দুমড়ে দিতে পারে) মেয়েটাকে আলতো করে সোহাগ ভরে জড়িয়ে রেখেছে আর তার চোখের লাল সংকেত যেন পাগল হয়ে গেছে।