গ্লোরিয়ার নাগাল থেকে রোবট দূরে রাখতে মিসেস, ওয়েসটন তার সাধ্যের অতিরিক্ত প্রয়াস নেন।
বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি বিষয়ক জাদুঘরে অবশেষে এই অধ্যায়ের চুড়ান্ত পরিণতি ঘনিয়ে উঠে। জাদুঘর কর্তৃপক্ষ শিশুদের মনে বিজ্ঞানের সম্মোহনী শক্তির প্রভাব কতখানি তা বিশ্লেষণের জন্য একটা বিশেষ অনুষ্ঠান ‘শিশুদের জন্য বিজ্ঞান’ আয়োজন করে। ওয়েসটন দম্পতি সঙ্গত কারণেই অনুষ্ঠানটিকে অবশ্যই দ্রষ্টব্য তালিকায় রাখে।
অনুষ্ঠানের সময়ে বৈদ্যুতিক-চুম্বকের চমৎকার ক্রিয়াকলাপ দেখতে যখন ওয়েসটনরা মগ্ন তখনই মিসেস, ওয়েসটন খেয়াল করেন গ্লোরিয়া তার পাশে নেই। প্রারম্ভিক আতঙ্কের ধাক্কা সামলে নিয়ে ঠাণ্ডা মাখায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং উপস্থিত তিনজন সাহায্যকারী নিয়ে তার খোঁজ শুরু হয়।
গ্লোরিয়া অবশ্যই উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াবার মেয়ে না। তার বয়সের মেয়েদের তুলনায়, সে অস্বাভাবিক রকমের দৃঢ়প্রতিজ্ঞ আর স্থিরসংকল্প, বলতে গেলে সে মায়েরই মেয়ে। আসবার সময়ে তিনতলায় সে একটা বিশাল বিজ্ঞপ্তি দেখে যাতে লেখা ছিল, “কথা বলা রোবট এইদিকে।” বানান করে পড়ে মানে বুঝবার পরে সে যখন দেখে তার বাবা-মা কাজের জায়গায় যেতে মোটেই উৎসাহী না তখন বাধ্য হয়ে তাকেই যা করবার করতে হয়। বাবা-মা অন্যমনস্কতার একটা মোক্ষম মুহূর্তের জন্য সে অপেক্ষা করে, ব্রাহ্ম মুহূর্তে আলতো করে কেটে পরে তার অভীষ্ট গন্তব্যের উদ্দেশে রওয়ানা দেয়।
.
কথাবলা রোবট আদতে নৈপুণ্যের নিদর্শন, পুরোপুরি অবাস্তব একটা জিনিস, দেখনদারি আর প্রচারণা ছাড়া তার আর কোনো কাজ নেই। ঘণ্টায় একবার হয়তো সহচর সন্নিবেশিত দর্শনার্থীর দল তার সামনে এসে দাঁড়ায় এবং ফিসফিস করে তত্ত্বাবধানে থাকা রোবট ইঞ্জিনিয়ারকে প্রশ্ন করে। রোবট ইঞ্জিনিয়ার রোবটের সার্কিটের পক্ষে সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রশ্ন কথাবলা রোবটকে সম্প্রচার করতে দেয়।
পুরোটাই একটা আকাঠ ব্যাপার। চৌদ্দকে বর্গ করলে একশ ছিয়ানব্বই হয়, অথবা এই মুহূর্তে তাপমাত্রা ৭২ ডিগ্রী ফারেনহাইট এবং বাতাসের চাপ ৩০.০২ পারদ উচ্চতা, বা সোডিয়ামের আণবিক ওজন ২৩, জানা থাকা হয়তো ভালো কিন্তু সেজন্য রোবটের কোনো প্রয়োজন নেই। বিশেষ করে পঁচিশ গজ জায়গা নিয়ে। অবস্থিত অনড় অব্যবহৃত তার আর কয়েলের জঞ্জালের কারও দরকার নেই।
খুব কমসংখ্যক লোকই দ্বিতীয়বারের জন্য এখানে আসে, কিন্তু মধ্য কৈশোর উত্তীর্ণ একটা মেয়ে চুপচাপ একটা বেঞ্চে বসে তার তৃতীয় দফা প্রশ্ন করবার জন্য অপেক্ষা করছে। গ্লোরিয়া যখন প্রবেশ করে তখন সেই কেবল ঘরে আর একমাত্র দর্শনার্থী।
গ্লোরিয়া তার দিকে তাকায় না। তার কাছে সেই মুহূর্তে আরেকটা মানুষ ধর্তব্যের মধ্যেই পড়ে না। তার অখণ্ড মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু চাকাযুক্ত বিশালাকৃতির জিনিসটা। সে আগে কখনও এধরনের রোবট দেখেনি।
সন্দিহান আর সর্তকভাবে সে তার কণ্ঠস্বরের মাত্রা জোরালো করে, “অনুগ্রহ করে কি বলবেন যে আপনিই কথা বলা রোবট কি না?” সে ঠিক নিশ্চিত না কিন্তু তার কাছে মনে হয় যে একটা রোবট যে কিনা সত্যি সত্যি কথা বলে তার সাথে মার্জিত ভঙ্গিতে কথা বলাটাই বাঞ্ছনীয়।
(কিশোরী মেয়েটার রোগা ভোতা মুখে তীব্র মনোযোগী একটা দৃষ্টি ফুটে উঠে। সে একটা ছোট নোটবই বের করে দ্রুতগতিতে তাতে হিজিবিজি কি সব লেখতে আরম্ভ করে।)
নিয়মিত যত্ন নেয়া গিয়ারের যান্ত্রিক গুঞ্জন শুরু হয় এবং কোনো প্রকার। বাচনভঙ্গি বা স্বরভেদ রহিত একটা যান্ত্রিক কণ্ঠস্বরের উচ্চারিত শব্দে ঘরটা গমগম করে উঠে, “আমি-হলাম-কথা-বলা-রোবট।”
অনুতপ্ত দৃষ্টিতে গ্লোরিয়া জাম্বুবানটার দিকে তাকিয়ে থাকে। যন্ত্রটা কথা বলে বটে, কিন্তু শব্দটা ভেতর থেকে আসছে। কোনো মুখ নেই যার দিকে তাকিয়ে কথা বলা যায়। সে বলে, “রোবট মহাশয়, তুমি কি আমাকে সাহায্য করতে পার?”
প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্যই রোবটটা তৈরী করা হয়েছে আর তাতে সন্নিবেশিত করা হয়েছে এমন প্রশ্নেরই উত্তর বেচারা দিতে পারে। নিজের যোগ্যতা সম্পর্কে সে নিঃসন্দেহ, সে জন্য, “আমি-তোমাকে-সাহায্য-করবো।”
“ধন্যবাদ রোবট মহাশয়। তুমি কি রোব্বিকে দেখেছো?”
“রোব্বি-কে?”
“সেও একটা রোবট।” সে পায়ের আঙ্গুলের উপরে ভর দিয়ে দাঁড়ায়। “রোবট মহাশয়, সে এই এতখানি লম্বা, না আরো বেশী, আর সে খুব লক্ষ্মী। তুমি জানো, তার মাথাও আছে। মানে তোমার নেই, কিন্তু রোবট মহাশয়, তার আছে।”
কথাবলা রোবটের কেরানি শেষ, “একটা-রোবট?”
“হ্যাঁ, রোবট মহাশয়। ঠিক তোমার মতোই আরেকটা রোবট, অবশ্য সে কেবল কথা বলতে পারে না এবং দেখতে একেবারে মানুষের মতো।”
“আমার-মতো-একটা-রোবট?”
“হ্যাঁ রোবট মহাশয়।”
কথা বলা রোবট এর উত্তরে ভেসে আসে অনিয়মিত সো-সো শব্দ আর অসংলগ্ন আওয়াজ। এই মৌলিক সাধারণীকৃত ধারণা, যে সে কোনো বিশেষ বস্তু না, বরং একটা বিশেষ শ্রেণীর সদস্য, হজম করাটা তার পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। অনুগতভাবে, ধারণাটা পাশ কাটাতে গেলে তার ভিতরের ছয়টা কয়েলের দফারফা হয়ে যায়। সতর্ক সংকেতের মৃদু আওয়াজ ভেসে আসতে থাকে।
(এই সময়ে কিশোরী মেয়েটা ঘর ত্যাগ করে। পদার্থবিদ্যা প্রথম পত্রের ‘রোবটের ব্যবহারিক সম্ভাবনা প্রশ্ন বিষয়ে তার যথেষ্ট জানা হয়েছে। সুজান ক্যালভিন এই বিষয়ে পরে আরও অগণিত প্রবন্ধ রচনা করবে।)