হাসপাতালের রিলিজ ফর্মে সই করার জন্যে বাইরে বেরুলো মা।
বিছানায় উঠে বসে আবারো ক্যালেন্ডারটার দিকে তাকালাম। মনে হচ্ছে আমার মস্তিষ্ক আর বাম চোখের অপটিক নার্ভের সংযোগ ঠিকঠাকই হয়েছে। তবুও ক্যালেন্ডারটা ঝাপসা দেখাচ্ছে। আসলে কাঁদছি আমি। পাশের টেবিল থেকে একটা টিস্যু তুলে নিয়ে খুব সাবধানে চোখ মুছলাম।
বুকে ভারি হয়ে চেপে বসে রাজ্যের সব কষ্ট। যেন দশ মণী একটা পাথর বাঁধা। মা আর আমার সহপাঠীদের বলা কথাগুলো অনবরত কানে বাজে। পুরনো আমিকে খুব ভালোবাসততা তারা। কিন্তু নতুন আমি তো কিছুই করতে পারে না ঠিকমতো। বেশিরভাগ সময়েই যখন আমার সাথে কেউ কথা বলতে আসে, খুঁজে পাই না যে কি বলবো।
জানি, যখন আমি আমতা আমতা করে কিছু একটা বলার চেষ্টা করি, তখন কল্পনায় পুরনো নামির ছবি ভাসে তাদের। সবসময় তুলনা করে। চাইলেও ব্যাপারটা খেয়াল না করে পারি না। এরপর মনে হয় যে সেখানে আমার জায়গায় পুরনো নামি থাকলে কতই না ভালো হতো।
ক্যালেন্ডারের দোলনাটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে এসব কথা ভাবতে লাগলাম। একটা বাচ্চা মেয়ে বসে আছে দোলনায়।
সবকিছু গোছগাছ করে ফেলতে হবে মা ফিরে আসার আগে। সেই লক্ষ্যে ক্যালেন্ডারটার দিক থেকে চোখ ফেরাতে গিয়ে থমকে গেলাম। প্রথম প্রথম বুঝতে পারলাম না যে কেন থমকে গিয়েছি, কিন্তু যখন বুঝলাম, ভয়ের একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল মেরুদণ্ডের মাঝ বরাবর।
ক্যালেন্ডারের দোলনাটা তো খালি ছিল। কিন্তু এখন দেখছি একটা মেয়ে বসে আছে সেখানে।
গুঙিয়ে উঠে মুখের বাম দিকে হাত দিলাম। স্বাভাবিকের চেয়ে গরম ঠেকলো জায়গাটা। বাম চোখের ওপর দিকটা থেকে থেকে লাফাচ্ছে।
ক্যালেন্ডারের দোলনাটা নড়ে উঠলো এসময়। নিজেকে বোঝানোনার চেষ্টা করছি যে ব্যাপারটা অসম্ভব, এসময় আবারো নড়ে উঠলো ওটা।
বিস্ময়ে চোখ বন্ধ করে ফেললাম, ভেবেছিলাম অন্ধকার নেমে আসবে চোখে। কিন্তু ভুল ভেবেছিলাম। চোখ বন্ধ করার পরেও মেয়েটাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। বলা যায় এখন আরো পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। তবে আরেকটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে গেল। শুধু আমার বাম চোখই দেখতে পাচ্ছে দৃশ্যটা। ডান চোখ বন্ধ করে শুধু বাম চোখটা খুললাম; হ্যাঁ, দোলনার মেয়েটা আছে।
নিজেকে প্রবোধ দিলাম যে এটা হয়তো দিবাস্বপ্ন। কিন্তু কিসের কি! ছবিটা আরো পরিষ্কার, প্রাণবন্ত হতে শুরু করেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই নিজেকে আবিষ্কার করলাম একটা পার্কে।
হাত দিয়ে বিছানার চাদর চেপে ধরে নিশ্চিত হলাম যে এখনও হাসপাতালেই আছি। মেয়েটা ধীরে ধীরে নেমে পড়লো দোলনাটা থেকে। বয়স একদমই কম মেয়েটার, প্রাইমারি স্কুলেও পড়ার বয়স হয়নি বোধহয়। তবে চুলগুলো বেশ লম্বা।
দোলনাটা বেশ পুরনো। দুপাশের শেকলে মরিচা ধরতে শুরু করেছে। পার্কের পেছন দিকে বেশ ঘন একটা বন দেখা যাচ্ছে।
বাঁ চোখের স্বপ্নটা পাল্টে যেতে শুরু করলো এসময়, সেই সাথে স্বপ্নে আমার দেহাবয়বও পাল্টে গেল। যদিও আমি জানি যে সেটা সম্ভব না। হাসিমুখে আমার দিকে এগিয়ে এল মেয়েটা।
এরপর ঢেউ যেভাবে একসময় মিলিয়ে যায় নদীতে, ঠিক সেভাবে স্বপ্নটাও মিলিয়ে গেল। এখন আবারো আগের মত দেখাচ্ছে ক্যালেন্ডারটা। ফাঁকা একটা দোলনা শোভা পাচ্ছে সেখানে।
বমি বমি লাগছে। কি ছিল এটা? স্বপ্ন? ভ্রম? নাকি অন্যকিছু? যখনই ভাবলাম যে দোলনাটা একবার নড়ে উঠেছে, অমনি স্বপ্ন দেখতে শুরু করলো আমার বাঁ চোখ।
আবারো ক্যালেন্ডারটার দিকে তাকালাম। স্বপ্নে যা যা দেখেছি তার চেয়ে বেশ কিছু ফারাক চোখে পড়লো এবারের ক্যালেন্ডারে যে দোলনাটা আছে, সেটার শেকলে কোন মরিচা নেই। পেছনে সমুদ্র।
এসময় দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো মা।
অদ্ভুত সব চিন্তা মাথায় নিয়ে হাসপাতাল ছাড়লাম আমি। একবার মনে হয়েছিল ক্যালেন্ডারটা সাথে করে বাসায় নিয়ে আসবো, কিন্তু কিছু বলার সাহস হয়নি।
স্বপ্নে দেখা মেয়েটার হাসি এখনও ভাসছে মানসপটে। ভীষণ আন্তরিক একটা হাসি। খুব প্রিয়জনদের মুখে এ ধরনের হাসি দেখা যায়। এক অচেনা উষ্ণতায় ভরে উঠলো বুকটা। স্মৃতি হারানোর পর থেকে এই প্রথম এরকম অনুভূত হলো।
হাসপাতাল থেকে বেরুনোর সময় আমার চোখে পানি দেখে কিছুটা অবাক হয়ে গেল মা। “কাঁদছো কেন?” সন্দিহান কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো।
কি জবাব দেব ভেবে পেলাম না। ঐ অচেনা মেয়েটার হাসি আসলেও বেশ বড়সড় প্রভাব ফেলেছে আমার মনের পর। কিরকম খারাপ একটা অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি ভেবে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বুক চিড়ে।
*
হাসপাতাল থেকে ফিরে আবারো পুরনো রুটিনে অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। স্কুলে যাই, ক্লাস করি। কারো সাথে খুব একটা কথাবার্তা হয়না। মোটামুটি একাই সময় কাটে।
দুর্ঘটনার পর প্রথমবার যখন জ্ঞান ফেরে, সবকিছু বড় বিভ্রান্তিকর ঠেকছিল আমার কাছে। আশপাশের সবার আলাপচারিতা শুনে যাচ্ছিলাম কেবল। কিছু না ভেবে বা না অনুভব করেই মাথা নাড়ছিলাম। কিন্তু অপারেশনের পর সেটা বন্ধ করেছি। এখন মোটামুটি পরিস্থিতি বুঝে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছি।
ক্লাসে আমার ডেস্কে বসে পুরনো, আদর্শ নামির কথা জিজ্ঞেস করলাম। নতুন চোখ প্রতিস্থাপনের পরেও খুব একটা সুবিধে করতে পারছি না।