- বইয়ের নামঃ ব্ল্যাক ফেয়ারি টেইল
- লেখকের নামঃ অৎসুইশি
- প্রকাশনাঃ রোদেলা প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী, গোয়েন্দা কাহিনী
ব্ল্যাক ফেয়ারি টেইল
০. চোখের স্মৃতি
ব্ল্যাক ফেয়ারি টেইল – অৎসুইশি / ভাষান্তর : সালমান হক
প্রথম প্রকাশ একুশে বইমেলা ২০২০
.
চোখের স্মৃতি
১
একটা অদ্ভুত দাঁড়কাকের গল্প বলছি শুনুন। শুরুতেই অদ্ভুত শব্দটা দেখে হয়তো বিরক্ত হতে পারেন। ভেবে নিতে পারেন গল্পের চমক বাড়াতে গল্পকার কোন ফন্দি আঁটছে। দাঁড়কাক আবার অদ্ভুত হয় কি করে? দাঁড়কাক তো দাঁড়কাকই! কিন্তু না, কোনরকম বাড়িয়ে বলছি না। এই গল্পের দাঁড়কাকটা অদ্ভুত, কারণ সে মানুষের ভাষায় কথা বলতে পারে। সেটারও উপযুক্ত ব্যাখ্যা আছে বৈকি। দাঁড়কাকটার বাবা মা বাসা বেঁধেছিল এক সিনেমা হলের দেয়ালের খুপড়িতে। সুতরাং একদম ছোটবেলা থেকেই দেয়ালের ফুটোটা দিয়ে সারাক্ষণ সিনেমা দেখেছে কাকটা। মা’র এনে দেয়া। খাবার খেতো আর সিনেমা দেখতে। তার ভাইবোনেরা অবশ্য কখনো সিনেমা দেখার প্রতি আগ্রহী ছিল না। আসলে সিনেমা দেখতে ভালো লাগতো কাকটার। সে সিনেমা দেখতে আর সংলাপগুলো আপনমনে বলতো, এভাবেই মানুষের ভাষায় কথা বলতে শিখে গেল সে।
মেয়েটার সাথে কাকটার দেখা সিনেমা হলটা গুঁড়িয়ে দেয়ার পর। এতদিনের থাকার জায়গা হারিয়ে কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে সে। তার বাবা মা আর ভাইবোনেরা আগেই শহরের অন্যান্য জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে, একমাত্র সে-ই রয়ে যায়। এখন সে পরিণত বয়স্ক; ডানা ঝাঁপটিয়ে উদ্দেশ্যহীনের মত ঘুরে বেড়াতে থাকে এখান থেকে ওখানে।
উড়তে উড়তেই নীল দেয়ালের ম্যানশনটা চোখে পড়ে তার। সামনে বিশাল বাগান, চারদিকে উঁচু বেড়া। বাড়িটার পাশেই একটা বড়সড় গাছ। ডালগুলোও প্রশস্ত, বিশ্রাম নেয়ার জন্যে একদম যথার্থ। তাই দাঁড়কাকটা নেমে এলো গাছটায়। অনেক ওড়াউড়ি হয়েছে, এবারে একটু বিশ্রাম দরকার।
ডালটার একদম কাছেই বাড়ির দোতলার জানালাটা। ডানা বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে। জানালার পাশে বসে থাকা মেয়েটাকে প্রথমে অবশ্য চোখে পড়েনি কাকটার। সাধারণত দেখা যায় যে মানুষের কাছাকাছি গেলেই দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়া হয়। কিন্তু এই মেয়েটা ব্যতিক্রম, মনে হচ্ছে যেন তার অস্তিত্ব চোখেই পড়েনি।
কিছুক্ষণ ডালটায় বসে থেকে মেয়েটাকে দেখলো কাকটা। এর আগে কখনো এত কাছ থেকে কোন মানুষকে দেখেনি সে। হালকা পাতলা গড়নের মেয়েটার ঠোঁট স্ট্রবেরির মতন লাল। জানালার পাশে একটা চেয়ারে বসে শূন্য দৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে আছে।
কাকটা একবার ভাবলো ডানা ঝাঁপটে মেয়েটার মনোযোগ আকর্ষণ করবে, কিন্তু বাতিল করে দিল বুদ্ধিটা। মানুষের মনোযোগ আকর্ষণের এর চেয়েও ভালো পদ্ধতি জানা আছে তার।
“আছেন কেমন?”
চমকে উঠলো মেয়েটা। উৎকণ্ঠা আর বিভ্রান্তি ভর করেছে চেহারায়। “কে?” জিজ্ঞেস করলো সে।
কাকটা এতক্ষণে বুঝতে পারলো কেন চোখের সামনে থাকা সত্ত্বেও তাকে খেয়াল করেনি মেয়েটা। সে এখন মেয়েটা থেকে যত দূরে আছে, অন্য কেউ হলে অবশ্যই দেখতে পেতো। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, মেয়েটার চোখ আর দশজন স্বাভাবিক মানুষের চোখের চেয়ে আলাদা। চোখ নেই তার, সে জায়গায় শূন্য দু’টো কোটর। কিছু দেখতে পায় না।
এটাই আমার সুযোগ, কাকটা ভাবলো। মেয়েটা তো আমাকে দেখতে পাবে না, এই সুযোগে কথাবার্তা বলা যাবে। কথা বলতে শেখার পর থেকেই মানুষদের সাথে আলাপ করার ইচ্ছে হয়েছে তার বহুবার। কিন্তু অনেক মানুষেরই বদভ্যাস আছে তার জাতভাইদের ধরে ভেজে খেয়ে ফেলার, তাই আর সাহসে কুলোয়নি।
মেয়েটা যেহেতু দেখছে না যে কে কথা বলছে, সুতরাং এবার সুযোগ নেয়া যেতেই পারে। “কেমন আছেন মিস?” বললো সে খানিকটা গম্ভীর গলায়।
“কে কথা বলছে? কে?”
“ভাববেন না। ক্ষতি করার কোন উদ্দেশ্য নেই আমার। আমি শুধু আপনার সাথে কথা বলতে চাই।”
চেয়ার ছেড়ে উঠে ঘরের মাঝামাঝি গেল মেয়েটা। সামনে হাত বাড়িয়ে শব্দের উৎসের খোঁজ করার চেষ্টা করছে। “আপনি কোথায়?”
জানালাটা খোলাই ছিল। কয়েকবার ডানা ঝাঁপটাতেই ভেতরে পৌঁছে গেল কাকটা। খুবই সুন্দর, সাজানো গোছানো একটা ঘর। দেয়ালে ফ্লাওয়ার প্রিন্টের ওয়ালপেপার, একটা নরম বিছানা আর অগণিত পুতুল। মাঝখানটায় গোল একটা টেবিল। জানালার পাশের চেয়ারটায় বসলো কাকটা।
“আপনার কণ্ঠটা অদ্ভুত শোনাচ্ছে,” মেয়েটা বললল। “আগে কখনো এরকমটা শুনিনি। তবে দ্ৰতাজ্ঞান একদমই কম। মেয়েদের ঘরে প্রবেশের আগে যে দরজায় নক করাটা ভদ্রতা।”
“মাফ করবেন। মাঝে মাঝে এরকম অভদ্রের মতন কাজ করে বসি। আমি তো ছুরি কাঁটাচামচ ব্যবহার করে খেতেও পারি না।”
“তাহলে খান কিভাবে?”
“আমার ঠোঁট দিয়ে ঠুকরিয়ে।”
“ভারি অদ্ভুত তো আপনি,” হেসে বললো মেয়েটা। হাসলে গালে টোল পড়ে তার, ভীষণ মিষ্টি দেখায়। “যাইহোক, আপনার আগমনে খুশিই হয়েছি আমি। কথা বলার মানুষ খুঁজে পাই না, জানেন?”
সেদিন থেকে হাতে(বা ডানায়?) সময় পেলেই মেয়েটার সাথে দেখা করতে আসততা কাকটা। প্রথমদিকে কেবল সিনেমা দেখা শেখে সংলাপগুলো কপচানোর জন্যেই আসততা, কিন্তু কদিন পর আবিষ্কার করলো যে মেয়েটার সাথে কথা বলতে আসলে ভালো লাগে তার।