সুমিদার কথা বলা শেষ হলেই কি আমার সময় ফুরিয়ে যাবে? হাত পা নাড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম যে আমার মধ্যে এখনও দৌড়ে পালানোর শক্তি অবশিষ্ট আছে কিনা।
“কিন্তু একটা ব্যাপার খুব বেশি অদ্ভুত,” বললাম আমি। “আপনি তো এক বছর ধরে এখানে নেই। তা সত্ত্বেও হিতোমিরা বেঁচে আছে কিভাবে?”
“ক্ষুধা বলে কিছু নেই ওদের। ক্ষতগুলো কখনো শুকাবে না। এরকমই থাকবে সারাজীবন। সময় থেমে গেছে এখানকার অধিবাসীদের। ইচ্ছেমতন গান গাইতে পারবে, কথা বলতে পারবে। তলকুঠুরির দরজার সামনে দেয়ালটা তোলার আগে একটা নতুন বাল্ব এনে এখানে লাগিয়ে দেই। আমি।
প্রায় নিভে যাওয়া বাটার দিকে একবার তাকালো সুমিদা।
“এভাবে কিছু না করে থাকা যায় নাকি,” হিতোমি বললো।
যা করার অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই করতে হবে আমাকে। এরপরে আর সুযোগ পাবো না। ভেতরে ভেতরে প্রার্থনা করতে লাগলাম।
“আর সাওরি? তার ব্যাপারে কি মন্তব্য আপনার? ঘটনার পরেও নিয়মিত মেলানকলি গ্রোভে কেন যেতেন? তাকে মনে ধরেছিল?”
ও আমার দিকে তাকালো সে। প্রশ্নগুলোর জবাব দিল না। কিন্তু সেই মুহূর্তে তার ব্যাপারে নতুন একটা জিনিস জানতে পারলাম।
আমার আরো কাছে চলে এলো সুমিদা। প্রচণ্ড ভয় লাগছে। আর সেই ভয় থেকেই কাজটা করলাম। কাঁধ দিয়ে জোরে ধাক্কা দিলাম সুমিদাকে। ঘরের পেছন থেকে অনেকগুলো কণ্ঠ একসাথে কথা বলে উঠলো যেন।
এত জোরে ধাক্কা দিয়েছি যে আমি নিজেও তাল হারিয়ে ফেললাম।
কিন্তু সুমিদার অবস্থা সঙ্গিন। পেছনে ঝুলানো বৰ্শিগুলো তার জামায় পেঁচিয়ে গেছে।
দৌড় দিলাম। জানি যে খুব দ্রুত পিছু নিবে সে।
সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলাম। নামার সময় খুব বেশি ধাপ মনে হয়নি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে অনন্তকাল পেরিয়ে যাবার পরেও সিঁড়ির মাথায় পৌঁছতে পারবো না। তবে এক সময় ঠিকই বেরিয়ে এলাম বাইরে। হয়তো আমার কাছে কয়েক সেকেন্ডকেই অনেক বেশি লম্বা মনে হচ্ছিল ভেতরে।
সামনের দরজার উদ্দেশ্যে দৌড় দিলাম। বেশি সময় লাগলো না কালো দরজাটার সামনে পৌঁছুতে। ওটার নব ধরে মোচড় দিলাম। কিন্তু খুব বেশিদূর খুললো না দরজাটা। বারবার চেষ্টা করেও কোন লাভ হলো না। এসময় খেয়াল করলাম একটা এক্সটেনশন কর্ড পেঁচিয়ে রাখা হয়েছে নবের সাথে। অনেক সময় লাগবে এটা খুলতে।
সুমিদার কাজ।
পেছনের দরজাটার কথা মনে হলো এসময়। আবারও হলওয়ে ধরে ছুটে চললাম। সিঁড়ি পেরিয়ে একটু সামনে গিয়েছি এসময় কিছু একটায় পা বেঝে পড়ে গেলাম। সুমিদা যে আড়াল থেকে পা বাড়িয়ে দিয়েছে তা টের পাইনি। একটা ঘরের খোলা দরজার সাথে ধাক্কা খেলাম, কিন্তু কোন ব্যথা পেলাম না। যেন বালিশের সাথে ধাক্কা লেগেছে।
দৌড়াতে পারবো ভেবে উঠতে যাবো এসময় চোখে পড়লো ব্যাপারটা। আমার ডান পাটা ঘুরে গেছে বিপরীত দিকে। কিন্তু ব্যথার বদলে এক ধরনের আরামদায়ক উষ্ণতা অনুভব করছি সেখানে।
আমার শরীরে কি ঘটছে বুঝে উঠতে পারলাম না। ভয়ের কারণে বোধহয় সাময়িক ব্যথার অনুভূতি লোপ পেয়েছে।
সুমিদা দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে। গালে কাটা দাগ। নিশ্চয়ই একটা বর্শি বিধে গেছিল সেখানে। পরনের জামাটাও কয়েক জায়গায় ছেঁড়া। হাচড়ে পাঁচড়ে নিজেকে ছাড়িয়ে এনেছে।
পকেট থেকে ছোট ছুরিটা বের করলাম। আমার হাত কাঁপছে। এত ছোট ছুরি দিয়ে কিছু হবে কিনা জানি না, কিন্তু এটা ছাড়া আর কোন অস্ত্র নেই আমার কাছে।
ছুরিটা খোলা মাত্র আমার হাতে জোরে লাথি কষালো সুমিদা। এবারেও কোন ব্যথা অনুভব করলাম না। মনে হলো কেউ আলতো করে সামনে থেকে সরিয়ে দিয়েছে হাতটা।
পড়ে যাওয়া ছুরিটা তুলে নিল সুমিদা। আমি বুঝছি যে পালানো উচিৎ কিন্তু নড়তে পারছি না।
এর পরের কয়েকটা মুহূর্তে কি ঘটলো ঠিক ধরতে পারলাম না। কিছুক্ষণ পর আবিষ্কার করলাম ছুরি ধরা হাতটা আমার পেটের কাছে ঠেসে রেখেছে সুমিদা। হাত দিয়ে তাকে সরাতে গিয়ে বুঝলাম হাতটা নড়ছে না। একদৃষ্টিতে আমার পেটের দিকে তাকিয়ে আছে সুমিদা। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে এবার আমিও তাকালাম। শার্টটা ছিঁড়ে গেছে। ছুরির ফলাটা ঢুকে আছে আমার পেটের ভেতরে। ক্ষতস্থানের চারিদিকে লাল রক্ত, তবে পরিমাণ খুব বেশি না।
একটা অদ্ভুত জিনিস ঝুলছে ক্ষতস্থান থেকে। দেখতে অনেকটা সদ্য জন্মানো বাচ্চাদের নাড়ির মতন।
সুমিদার হাতের দিকে তাকালাম। লাল হয়ে আছে ওদুটো। আমার পেটের ভেতর হাত ঢুকিয়ে দিল সে। নাড়িটা টেনে বের করার জন্যে বোধহয়।
সেই মুহূর্তে চিন্তা চেতনা লোপ পায়নি এর একমাত্র কারণ আমার মনে হচ্ছিল অন্য কারো পেটের দিকে তাকিয়ে আছি। পেট থেকে যে জিনিসটা বেরিয়ে আছে, সেটা অন্য কারো। ডান হাত দিয়ে নাড়িটা ধরলাম, এখনও উষ্ণ।
হাতের স্পর্শ পাওয়া মাত্র এক অবর্ণনীয় সুখে ছেয়ে উঠলো গোটা শরীর। তলকুঠুরির বাসিন্দারা কেন সুমিদাকে ভয় পায় না এটা পরিষ্কার এখন। মনে হচ্ছে যেন আরামদায়ক উষ্ণ পানিতে সাঁতার কেটে বেড়াচ্ছি।
দূর থেকে সুমিদার কণ্ঠস্বর ভেসে এলো।
পালাবার পথ নেই।
ক্ষতস্থান থেকে থকথকে কি যেন বেরিয়ে এলো। হাত সরিয়ে নিলাম দ্রুত। আমার ভেতরের একটা অংশ এই নিগূঢ় আনন্দের বিরোধীতা করছে অনেকক্ষণ যাবত।