অবচেতনেই সামনে বাড়ার জন্য তাগাদা দিলেন নিজের ঘোড়াকে, হাত আর পা দিয়ে তাড়া করলেন। নিজের সর্বোচ্চ গতি নিয়ে ছুটতে শুরু করল প্রাণীটা, কিন্তু কানের মাঝে ঘণ্টাধ্বনি আর চোখের সামনে আলোর নৃত্য বেড়ে গেল যেন। নিজের ঘোড়ার গলা জাপটে পড়ে গেলেন শাহজাহান…
*
কী তাঁকে এমন করে ধাক্কা দিচ্ছে? তিনি এবং মমতাজ যেন তারার রাজ্যে ভেসে চলেছেন। কিন্তু কিছু একটা যা কেউ একজন টেনে পত্নীর কাছের থেকে নিয়ে যাচ্ছে তাঁকে। মমতাজের বিবর্ণ মুখে ভেসে উঠল ভয় আর আকুতি। এরপরই যেন বেগুনি অন্ধকারে হারিয়ে গেল মমতাজ। কিছুই বুঝতে পারলেন না শাহজাহান। তিনি মমতাজের কাছ থেকে দূরে সরে গিয়েছেন নাকি তাঁকেই শাহজাহানের কাছ থেকে টেনে নিয়ে যাওয়া হল? এটা হতে পারে না…তিনি কখনোই এটা হতে দেবেন না। চেষ্টা করলেন হাত বাড়িয়ে দিতে। কিন্তু মনে হল কাপড়ে বেঁধে আটকে গেল হাত। কেউ একজন বস্তুত সত্যিই তাঁর কাপড় ধরে টানছে, নিয়ে যাচ্ছে মমতাজের কাছ থেকে না, না। বিড়বিড় করে উঠলেন তিনি। মাথা নাড়াতে লাগলেন মমতাজ, আমি তোমার সাথেই থাকব। এরপরেই মনে হল যেন তীক্ষ্ণ নখের হাত চেপে ধরল গলা।
চোখ খুললেও তন্দ্রাচ্ছন্ন দৃষ্টিতে দেখতে পেলেন ইঞ্চিখানে দূরেই উজ্জ্বল চোখের একটা মুখ। বিস্ময়ের ভঙ্গিতে অর্ধ খোলা ঠোঁট, তারপরেও দেখা যাচ্ছে কালো দাঁত। সাদা লম্বা চুল পিছনে টেনে বাঁধা বুড়ো আঙুল ঘুরে বেড়াচ্ছে তাঁর গলায়, খুঁজে ফিরছে অ্যাডামস অ্যাপেল। এই উন্মাদ নিশ্চয়ই তাকে হত্যা করতে চাইছে। অভ্যাসবশেই শাহজাহান হাত তুলে সরিয়ে দিলেন এই হাড়সর্বস্ব আঙুলগুলো নিজের গলা থেকে। এরপর হাত দিয়ে ধাক্কা দিলেন শয়তানটার মুখে। বিস্মিত হয়ে খেয়াল করলেন যে বিশ্রি দেহটা বেশ গরম, নাকে এসে ধাক্কা মারল বোটকা গন্ধ। মাথা পিছনে নিয়ে ঝাঁকি দিলেন শাহজাহান। শুনতে পেলেন কিছু একটা ভাঙ্গার মত শব্দ হল, আর এই অপচ্ছায়টা যুদ্ধ করতে করতে শাহজাহানের উপর লাফ দিতে চাইলো, চেহারার উপর গড়িয়ে পড়তে লাগল গরম লালা। হালকা দেখালেও ওজনও আছে। ভূতটার।
ভারী বোঝার চাপ আর গাল বেয়ে গড়িয়ে নামতে থাকা তরলের প্রবাহে পুরোপুরি সচেতন হয়ে উঠলেন শাহজাহান। ধাক্কা দিয়ে গায়ের উপর থেকে সরিয়ে দিলেন দেহটাকে, মাথা পরিষ্কার হয়ে চোখের দৃষ্টিও ফিরে এলো। উঠে বসে চারপাশে তাকাতে লাগলেন। অসম্ভব তাপ ছড়িয়ে গনগন করছে মধ্যাহ্নের সূর্য, পাতাবিহীন গাছের নিচে তিনি সম্পূর্ণ একা। আস্তে করে তাকিয়ে দেখে ভয়ে জমে গেলেন সম্রাট। বুঝতে পারলেন অদ্ভুত ভঙ্গিতে বেঁকে যাওয়া মাথা ঝুলে যাওয়া জিহ্বা আর চোখ খুলে তাকিয়ে থাকা দেহটা একজন নারীর, বয়স্ক নারীর! বাতাসে উড়ছে লাল শাড়ির প্রান্ত। পাঁজরের হাড় আর শুকিয়ে যাওয়া চামড়ায় কোন এক সময় হয়তো পাকস্থলী ছিল, সব দেখা যাচ্ছে। বহুদিনের অনাহারী বোঝা গেল। শাহজাহান খুন করেছেন তাকে। কেন? আর তিনি একাই বা কেন?
ধীরে ধীরে খাপছাড়া স্মৃতি–অস্ত্রের ঝনঝনানি, উৎসাহ আর বেদনার রণহুঙ্কার–ফিরে আসতে লাগল মনের মাঝে। মনে পড়ে গেল ঘোড়া ছুটিয়ে বিজাপুরের শিবিরের দিকে যাওয়া ঘোড়ার খুড়ের শব্দ, একটু পরেই সেনাপ্রধানের উপর হামলা, কিন্তু তারপর কী হল? অবশেষে মনে পড়ল নিজের মাথায় আঘাত পাবার কথা। সামনের দিকে পড়ে যাচ্ছেন তিনি…তার ঘোড় নিশ্চয় তাকে এখানে যুদ্ধক্ষেত্রে থেকে বহু মাইল দূরে নিয়ে এসেছে। চারপাশে তাকিয়ে না যুদ্ধ না নিজের ঘোড়া কিছুই দেখতে পেলেন না, কোন শব্দও পাচ্ছেন না। চারপাশের বালি পরীক্ষা করে কয়েকটা চিহ্ন দেখতে পেলেন খুরের নিচে। পড়ে যাবার পর নিশ্চয়ই তাঁকে ফেলে চলে গেছে ঘোড়া। কিন্তু এই নারী এলো কোথা থেকে? মৃতদেহটার দিকে তাকিয়ে শাহজাহান দেখতে পেলেন মাটিতে পড়ে আছে তার আংটি–বড় একটা বাঁকানো এমরান্ড–আর হ্যাঁ, তাঁর হালকা, পোশক রুপার বন্ধনী দ্বারা আটকানো ছিল, এখন পড়ে আছে বৃদ্ধার পাশে। হুম, তাহলে ঘটনাটা এই-ই–সম্রাটের দেহ তল্লাশী করে লুটপাটের চেষ্টা করেছিল। ধূসর পকূকেশ নারী, নড়ে উঠতেই তারপর খুন করার চেষ্টা করে।
পরিষ্কারভাবে বোঝা গেল যে টিকে থাকার চেষ্টায় ভুলে গেছে নারী দুর্লভ মমতা আর প্রতিরক্ষার বোধ। নিশ্চয়ই একা বেঁচে থাকতে গিয়েই এমন হয়েছে এই বৃদ্ধা। পরিবারের সদস্যদের মৃত্যুর পর কী গ্রাম ছেড়ে খাবারের সন্ধানে বের হয়েছে? নাকি তারা আশেপাশেই কোথায় পড়ে আছে কিন্তু এতটাই দূর্বল যে নড়াচড়া করতে পারছে না? নাকি তারা এই বৃদ্ধাকে পরিত্যাগ করেছে? যাই হোক, কোনমতে টিকে থাকাই মানুষের সবচেয়ে জরুরি প্রয়োজন এখন। একই কারণে শাহজাহানকেও খুন করতে চেয়েছে সে…কিন্তু তিনি কেন হত্যা করলেন…কেননা বস্তুত তিনিও তার সত্তাইদের হত্যা করিয়েছেন। এখন আরো একবার বাঁচার জন্য যুদ্ধ করলেন।
মৃতদেহের পাশ থেকে নিজের পোশাক তুলে নিয়ে কোনমতে মাথায় জড়িয়ে নিলেন, সূর্যের কড়া তাপের হাত থেকে বাঁচার জন্য। বুকের বর্মের উজ্জ্বলতা হয়তো শত্রুতাই করে বসবে শত্রু খুঁজতে, এছাড়া বহন করার পক্ষে বেশ ভারীও এটি। তাড়াতাড়ি খুলে ফেলে বালিতে হালকা গর্ত করে লুকিয়ে রাখলেন। এরপর তাকালেন দাগগুলোর দিকে, সেগুলোকে তিনি তাঁর ঘোড়ার খুরের দাগ বলে ভাবছেন। পড়ে যাওয়ার আগে মনে হল উত্তর-পশ্চিম দিকে থেকেই ছুটে এসেছেন, এরপর দাগগুলো চলে গেছে দক্ষিণ দিকে। তিনি এখন কী করবেন? ঘোড়ার খুরের দাগ অনুসরণ করে এটির পিছু নেবেন, নাকি পিছনে গিয়ে রণক্ষেত্রের দিকে যাবেন? ভেবে দেখলেন ঘোড়ার খোঁজেই যাওয়া উচিত। নিশ্চয়ই একটু এগিয়েই থেমে গেছে কোথাও। অন্যদিকে যুদ্ধের ফলাফল সম্পর্কেও কিছুই জানেন না তিনি। হতে পারে গিয়ে দেখবেন নিজের সৈন্যরা পরাজিত হয়েছে, মৃত্যু অথবা বন্দিত্বই তখন ললাট লিখন হবে।