- বইয়ের নামঃ দি টেনটেড থ্রোন – এম্পায়ার অভ দা মোগল
- লেখকের নামঃ অ্যালেক্স রাদারফোর্ড
- প্রকাশনাঃ রোদেলা প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, উপন্যাস
দি টেনটেড থ্রোন – এম্পায়ার অভ দা মোগল
১.০১ বালিতে রক্তের দাগ
এম্পায়ার অভ দা মোগল – দি টেনটেড থ্রোন (কলঙ্কিত মসনদী কথা)
অ্যালেক্স রাদারফোর্ড / অনুবাদ: সাদেকুল আহসান কল্লোল
অনুবাদকের উৎসর্গ স্নেহস্পাদেষু রাকিবুল হাসান
প্রধান চরিত্রসমূহ:
জাহাঙ্গীরের পরিবারের সদস্যবৃন্দ
আকবর, জাহাঙ্গীরের পিতা এবং তৃতীয় মোগল সম্রাট
হুমায়ুন, জাহাঙ্গীরের দাদাজান এবং দ্বিতীয় মোগল সম্রাট
হামিদা, জাহাঙ্গীরের দাদিজান
কামরান, হুমায়ুনের সৎ-ভাই, জাহাঙ্গীরের দাদাজান।
আসকারি, হুমায়ুনের সৎ-ভাই, জাহাঙ্গীরের দাদাজান
হিন্দাল, হুমায়ুনের সৎ-ভাই, জাহাঙ্গীরের দাদাজান
মুরাদ, জাহাঙ্গীরের ভাই
দানিয়েল, জাহাঙ্গীরের ভাই।
খসরু, জাহাঙ্গীরের জ্যেষ্ঠ পুত্র
পারভেজ, জাহাঙ্গীরের দ্বিতীয় পুত্র
খুররম (পরবর্তীতে সম্রাট শাহজাহান), জাহাঙ্গীরের তৃতীয় পুত্র
শাহরিয়ার, জাহাঙ্গীরের কনিষ্ঠ পুত্র
মান বাঈ, জাহাঙ্গীরের স্ত্রী এবং খসরুর জন্মদাত্রী মাতা
জোধা বাঈ, জাহাঙ্গীরের স্ত্রী এবং খুররমের জন্মদাত্রী মাতা
শাহিব জামাল, জাহাঙ্গীরের স্ত্রী এবং পারভেজের জন্মদাত্রী মাতা।
মেহেরুন্নিসা (নূরজাহান এবং নূর মহল নামেও পরিচিত) জাহাঙ্গীরের শেষ স্ত্রী
মেহেরুন্নিসার পরিবার
লাডলি, শের আফগানের ঔরসে মেহেরুন্নিসার কন্যা
গিয়াস বেগ, রাজকোষাগারের আধিকারিক এবং মেহেরুন্নিসার পিতা
আসমত, মেহেরুন্নিসা আর তার ভাইদের জননী
আসফ খান, আগ্রা সেনানিবাসের দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিক এবং মেহেরুন্নিসার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা
মীর খান, মেহেরুন্নিসার কনিষ্ঠ ভ্রাতা।
আরজুমান্দ বানু, মেহেরুন্নিসার ভাস্তি, আসফ খানের কন্যা এবং খুররমের (শাহ জাহান) স্ত্রী।
শের আফগান, বাংলার গৌড়ে অবস্থিত সেনানিবাসের আধিকারিক এবং মেহেরুন্নিসার প্রথম স্বামী
জাহাঙ্গীরের অমাত্য, সেনাপতি আর সুবেদার
সুলেমান বেগ, জাহাঙ্গীরের দুধ-ভাই
আলী খান, মানডুর সুবেদার
ইকবাল বেগ, দাক্ষিণাত্যে অবস্থানরত একজন জ্যেষ্ঠ সেনাপতি
মহবত খান, পারস্য থেকে আগত আর জাহাঙ্গীরের সেরা সেনাপতিদের অন্যতম।
মাজিদ খান, জাহাঙ্গীরের উজির এবং ঘটনাপঞ্জির রচয়িতা
ইয়ার মহম্মদ, গোয়ালিয়রের সুবেদার
দারা শুকোহ, খুররমের (শাহ জাহান) জ্যেষ্ঠ পুত্র
শাহ শুজা, খুররমের (শাহ জাহান) দ্বিতীয় পুত্র
আওরঙ্গজেব, খুররমের (শাহ জাহান) তৃতীয় পুত্র
মুরাদ বকস্, খুররমের (শাহ জাহান) কনিষ্ঠ পুত্র
জাহানারা, খুররমের (শাহ জাহান) জ্যেষ্ঠ কন্যা
রওন্নারা, খুররমের (শাহ জাহান) কনিষ্ঠ কন্যা
বাদশাহীহারেমের অভ্যন্তরে
মালা, খাজাসরা, রাজকীয় হারেমের তত্ত্বাবধায়ক
ফাতিমা বেগম, সম্রাট আকবরের বিধবা স্ত্রী
নাদিয়া, ফাতিমা বেগমের পরিচারিকা
সাল্লা, মেহেরুন্নিসার আর্মেনীয় সহচর
খুররমের অন্তরঙ্গ সহচর
আজম বকস্, আকবরের একজন প্রাক্তন বৃদ্ধ সেনাপতি
কামরান ইকবাল, খুররমের একজন সেনাপতি।
ওয়ালিদ বেগ, খুররমের অন্যতম প্রধান তোপচি
অন্যান্য চরিত্র
আজিজ কোকা, খুসরুর সমর্থক
হাসান জামাল, খসরুর সমর্থক
মালিক আম্বার, মুক্তি লাভ করা আবিসিনীয় ক্রীতদাস এবং বর্তমানে মোগলদের বিরুদ্ধে দাক্ষিণাত্যের সালতানাতের সম্মিলিত বাহিনীর সেনাপতি
শেখ সেলিম চিশতি, সুফি সাধক, এবং নিজেও একজন সুফি সাধকের পুত্র।
মোগল দরবারে আগত বিদেশী
বার্থোলোমিউ হকিন্স, ইংরেজ সৈনিক এবং ভাগ্যান্বেষনকারী
ফাদার রোনাল্ডা, পর্তুগীজ পাদ্রী।
স্যার টমাস রো, মোগল দরবারে প্রেরিত ইংরেজ রাজদূত
নিকোলাস ব্যালেনটাইন, স্যার টমাস রো’র সহচর
.
প্রথম পর্ব – রমণীকুল মাঝে এক প্রভাকর
১.১ বালিতে রক্তের দাগ
উত্তরপশ্চিম ভারতবর্ষ ১৬০৬ সালের বসন্তকাল
জাহাঙ্গীর তার টকটকে লাল বর্ণের নিয়ন্ত্রক তাবুর চাঁদোয়ার নিচে দিয়ে মাথা নিচু করে বাইরে বের হয়ে আসে এবং আধো-আলোর ভিতরে উঁকি দিয়ে দূরের পর্বতের শৈলশিরাময় অংশের দিকে তাকায় যেখানে তার জ্যেষ্ঠপুত্র খুররমের সৈন্যবাহিনী শিবির স্থাপন করেছে। পরিষ্কার আকাশের নিচে প্রায় মরুভূমির মত এলাকাটার ভোরের বাতাসে শীতের প্রকোপ ভালোই টের পাওয়া যায়। জাহাঙ্গীর এতদূর থেকেও শিবিরের এদিক সেদিক চলাচল করতে থাকা অবয়ব ঠিকই লক্ষ্য করে, তাদের কারো কারো হাতে জ্বলন্ত মশাল রয়েছে। রান্নার জন্য এর মধ্যে বেশ কয়েক স্থানে অগ্নিকুণ্ড প্রজ্জ্বলিত হয়েছে। শৈলশিরার একেবারে শীর্ষদেশে একটা বিশাল তাবুর সামনে ভোরের আধো আলোর প্রেক্ষাপটে বেশ কয়েকটা নিশানকে উড়তে দেখা যায়, খুব সম্ভবত খুররমের ব্যক্তিগত আবাসস্থল। সহসা ভোরের বাতাসের মত শীতল একটা বিষণ্ণতাবোধ সামনের দিকে তাকিয়ে থাকার সময় জাহাঙ্গীরকে আপুত করে তুলে। পরিস্থিতির এমন পরিণতি কেন হল? কেন আজ তাকে যুদ্ধক্ষেত্রে আপন পুত্রের মোকাবেলা করতে হবে?
তার আব্বাজান আকবরের মৃত্যুর পরে, মাত্র পাঁচমাস আগেই, বহুদিন ধরে সে কামনা করেছিল এমন সবকিছুর উপরে শেষ পর্যন্ত তার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। রাজবংশের চতুর্থ মোঘল সম্রাট হিসাবে তার নাম ঘোষণা করা হয়। জাহাঙ্গীর, এই নামে সে রাজত্ব পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যার মানে পৃথিবীর সংরোধক। পশ্চিমে বেলুচিস্তানের পাহাড়ি এলাকা থেকে পূর্বে বাংলার নিম্নাঞ্চল এবং উত্তরে কাশ্মীরের জাফরানশোভিত ফসলের মাঠ থেকে দক্ষিণে দাক্ষিণাত্যের লাল মাটির শুষ্ক মালভূমি পর্যন্ত বিস্তৃত একটা সাম্রাজ্যের অধিশ্বর হবার অনুভূতিটাই দারুণ। দশ কোটি মানুষের প্রাণ তার অনুবর্তী কিন্তু সে কারো অনুবর্তী নয়।
সম্রাট হিসাবে প্রথমবারের মত নিজের প্রজাদের সামনে নিজেকে উপস্থাপনের নিমিত্তে আগ্রা দূর্গের ইন্দ্রকোষ ঝরোকায় সে যখন পা রাখে, এবং নিচে যমুনার তীরে ভীড় করে থাকা মানুষের ভীড় থেকে সম্মতির সমর্থন ভেসে আসে, তাঁর আব্বাজান মৃত সেই বিষয়টাই তখন প্রত্যয়াতীত মনে হয়। আকবর সমৃদ্ধ আর জাক-জমকপূর্ণ একটা সাম্রাজ্য নির্মাণ করেছিলেন সমস্ত বিপদ আর প্রতিবন্ধকতাকে দূরে সরিয়ে রেখে। আকবর বেঁচে থাকার সময় জাহাঙ্গীরের যেমন প্রায়শই মনে হতো সে কখনও আকবরের ভালোবাসা পুরোপুরি অর্জন করতে পারে নি কিংবা তার প্রত্যাশা অনুযায়ী জীবন যাপন করতে পারে নি, আকবরের মৃত্যুর পরে তার মনে এখন সহসাই সন্দেহের মেঘ ঘনীভূত হয় যে এখন সেটা আদৌ তার পক্ষে অর্জন করা সম্ভব। কিন্তু সে চোখ বন্ধ করে এবং নিরবে একটা প্রতিজ্ঞা করে। আপনি আমাকে সম্পদ আর ক্ষমতা দান করেছেন। আপনার যোগ্য উত্তরসূরি হিসাবে আমি নিজেকে প্রমাণ করবো। আপনি আর আমার পূর্বপুরুষেরা যা নির্মাণ করেছেন আমি সেটা রক্ষা করবো এবং বর্ধিত করবো। নিজের কাছে নিজের এই প্রতিজ্ঞার ব্যাপারটা তাঁর আত্মবিশ্বাসকে শাণিত করে তুলে।
কিন্তু এই ঘটনার সপ্তাহখানেকের ভিতরেই প্রথম আঘাত আসে, কিন্তু কেএনা আগন্তুক নয় বরং তাঁর নিজের আঠারো বছরের ছেলেই সেই আঘাতটা হানে। বিশ্বাসঘাতকতা–এবং এর ফলে সৃষ্ট বাতাবরণ সবসময়েই একটা নোংরা ব্যাপার, কিন্তু নিজের সন্তানই যখন সেটার উদ্গাতা তখন এর চেয়ে জঘন্য আর কিছুই হতে পারে না। মোগলদের যখন একত্রিত থাকার কথা তখন পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াই করে মোঘলরা অনেক সময়ে নিজেরাই নিজেদের প্রবল শত্রুতে পরিণত হয়েছে। এই একই বিন্যাসের পুনরাবৃত্তি সে কখনও, কিছুতেই অনুমতি দিতে পারে না এবং এখন তাঁর রাজত্বের সূচনা লগ্নে সে সবাইকে দেখিয়ে দিতে চায় যে পারিবারিক অবাধ্যতার বিষয়টা সে ভীষণ ঐকান্তিকতার সাথে গ্রহণ করেছে এবং কত দ্রুত আর পুরোপুরি সে এই বিদ্রোহীদের দমন করবে।
বিগত কয়েকটা সপ্তাহ তাঁর নিজের বাহিনী আর তাঁর পুত্রের বাহিনীর মাঝে দূরত্ব হ্রাস করার অভিপ্রায় ছাড়া আর কিছুই তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। সে আর তার বাহিনী গতকাল সন্ধ্যাবেলা খসরুর নাগাল পায় এবং সে যেখানে শিবির স্থাপন করেছে সেই শৈলশিরাময় অংশটা ঘিরে ফেলে। আপন সন্তানের বিশ্বাসঘাতকতার বিষয়ে সে যতই চিন্তা করে ততই গা গুলিয়ে ওঠা ক্রোধের একটা ঢেউ তার উপরে এসে আছড়ে পড়ে এবং পায়ের গোড়ালী দিয়ে সে বালুকাময় মাটিতে সজোরে আঘাত করে। সে সহসা নিজের পাশে তার দুধ-ভাই সুলেমান বেগের উপস্থিতি সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠে। ‘এতক্ষণ কোথায় ছিলে?’ সে জানতে চায়, অবদমিত আবেগের কারণে তাঁর কণ্ঠস্বর রুক্ষ শোনায়।
রাতেরবেলা খসরুর শিবিরের কাছাকাছি আমাদের গুপ্তদূতদের যারা গিয়েছিল তাদের কাছ থেকে সর্বশেষ অগ্রগতি সম্পর্কে শুনছিলাম।
‘তারা তাহলে, কি বললো? আমার ছেলে কি অনুধাবন করতে পেরেছে যে সে আমাদের নাগাল থেকে পালাতে পারবে না এবং তাকে অবশ্যই নিজের বিদ্রোহের পরিণতি ভোগ করতে হবে?
“জ্বী। সে যুদ্ধের জন্য নিজের বাহিনীকে প্রস্তুত করছে।’
‘সে আর তাঁর সেনাপতিরা কীভাবে নিজেদের সৈন্যদের বিন্যস্ত করছে?
‘শৈলচূড়ায় বেলেপাথরের তৈরি হিন্দুদের কয়েকটা স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে। তাঁরা এগুলোর চারপাশে নিজেদের মালবাহী শকটগুলোকে উল্টে দিয়েছে এবং নিজেদের তবকী আর তিরন্দাজদের সুরক্ষিত রাখতে এবং তাঁদের কামানগুলোকে আড়াল করতে মাটির অবরোধক নির্মাণ করছে।
তার মানে আক্রমণ করার পরিবর্তে তারা আক্রমণ প্রতিহত করার প্রস্তুতি নিচ্ছে?’
‘জ্বী। তাঁরা জানে এটাই তাদের সাফল্যের শ্রেষ্ঠ সুযোগ। খসরু কিংবা তাঁর প্রধান সেনাপতি আজিজ কোকা কেউই নির্বোধ নয়।’
‘আমার কর্তৃত্ব অগ্রাহ্য করা ছাড়া, জাহাঙ্গীর তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে।
‘আমি কি আমাদের বাহিনীকে আসন্ন আক্রমণের জন্য এখনই বিন্যস্ত হবার আদেশ দেব?
‘আমি সিদ্ধান্ত নেবার পূর্বে, শৈলচূড়ার উপরে পানি কিংবা ঝর্ণার কোনো উৎসের ব্যাপারে আমরা কি কিছু জানি?
‘গতকাল সন্ধ্যাবেলা আমাদের সাথে কেবল একজন পশুপালকের দেখা হয়েছিল আমি তাকে প্রশ্ন করেছিলাম। সে বলেছে নেই কিন্তু বেচারা এতটাই আতঙ্কিত ছিল যে আমি যা শুনতে চাই বলে তার কাছে মনে হয়েছিল সে হয়ত সেটাই তখন বলেছিল। অবশ্য, চূড়াটার সর্বত্রই লাল ধূলো আর পাথর মাঝে মাঝে কেবল কয়েকটা মৃতপ্রায় গাছ আর বিক্ষিপ্তভাবে জন্মানো ঘাস রয়েছে।
‘পশুপালক লোকটা তাহলে হয়তো ঠিকই বলেছে। সেক্ষেত্রে, তাঁদের সাথে যৎসামান্য যতটুকু পানি রয়েছে সেটা নিঃশেষ করার জন্য আমরা বরং এখনই তাঁদের আক্রমণ করা থেকে আরো কিছুক্ষণ বিরত থাকি তারা এখন যুদ্ধক্ষেত্রে নিজেদের ভাগ্য নিয়ে চিন্তা করুক। খসরুর মতই, তাঁরা সবাই অল্পবয়সী আর যুদ্ধে অনভিজ্ঞ। এমনকি যুদ্ধের ভয়ঙ্কর বিভীষিকাও তাঁদের কল্পনাকে ছাপিয়ে যাবে।’
‘হয়ত, কিন্তু আমাদের দেয়া আত্মসমর্পণের প্রস্তাবে আমি যেমনটা আশা করেছিলাম তারা ঠিক সেভাবে সাড়া দেয়নি।
জাহাঙ্গীর চোখমুখ কুঁচকে কিছু একটা ভাবে। গত সন্ধ্যায় সে সুলেমান বেগের প্রস্তাবে সম্মতি দিয়েছিল খসরুর শিবির লক্ষ্য করে বার্তাবাহী তীর নিক্ষেপ করার ব্যাপারে যেখানে লেখা থাকবে যেকোনো নিম্নপদস্থ সেনাপতি কিংবা কোনো সৈন্য যারা সেই রাতে খসরুর শিবির ত্যাগ করে আত্মসমর্পণ করবে তাদের প্রাণ রক্ষা পাবে। দ্বিতীয় কোনো সুযোগ দেয়া হবে না। কেউ যেন মনে না করে যুদ্ধের পরে কারো প্রতি কোনো ধরনের করুণা প্রদর্শন করা হবে।’
কতজন আত্মসমর্পণ করেছে?
‘হাজারখানের চেয়ে সামান্য কিছু কম হবে, বেশিরভাগই অপ্রতুল অস্ত্র আর পোষাক পরিহিত পদাতিক সৈন্য। অনেকেই সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ হয়েছে যারা খসরুর বাহিনী অগ্রসর হবার সময় উত্তেজনা আর লুটের মালের বখরার আশায় তাঁর সাথে যোগ দিয়েছিল। স্বপক্ষত্যাগী একজন বলেছে কীভাবে পালাবার চেষ্টা করার সময় ধৃত এক কিশোর সৈন্যকে খসরুর আদেশে শিবিরের জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা হয়েছে এবং বর্শার সুতীক্ষ্ণ অগ্রভাগ দিয়ে তাকে অগ্নিশিখায় ঠেসে রাখা হয়েছিল যতক্ষণ না তার চিৎকার স্তব্ধ হয়ে যায়। তার অঙ্গার হয়ে যাওয়া দেহটা এরপরে শিবিরের। ভেতরে প্রদর্শিত করা হয় অন্যদের তারমত পালাবার প্রয়াস গ্রহণ করা থেকে বিরত রাখতে।
‘খসরুর সাথে এখন তাহলে কতজন লোক রয়েছে?
‘স্বপক্ষত্যাগী লোকটার বক্তব্য অনুযায়ী বারো হাজার। আমার মনে হয় সংখ্যাটা কমিয়ে বলা হয়েছে কিন্তু তাঁদের সংখ্যা নিশ্চিতভাবেই পনের হাজারের বেশি হবে না।’
‘তাঁদের চেয়ে এখনও আমাদের তিন কি চার হাজার লোক বেশি রয়েছে। নিজেদের প্রতিরক্ষা ব্যুহের পেছনে গুঁড়ি মেরে প্রতিক্ষারত খসরুর সৈন্যদের চেয়ে আক্রমণকারী হিসাবে, অনেকবেশি অরক্ষিত থাকার কারণে আমাদের সৈন্যদের সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার জন্য এই সংখ্যাটা যথেষ্ট।
জাহাঙ্গীর তার নিয়ন্ত্রক তাবুতে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হবার জন্য যখন তাঁর পরিচারক, তাঁর কর্চির জন্য অপেক্ষা করার সময় যখন পায়চারি করছে তার মনে একের পর এক প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে। সাফল্য নিশ্চিত করার জন্য সে কি সম্ভাব্য সবকিছু করেছে? একজন সেনাপতির জন্য আত্মবিশ্বাসে ঘাটতির মতই অতিরিক্ত-আত্মবিশ্বাসও বিশাল একটা হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে। গতকাল অনেক গভীর রাত পর্যন্ত তিনি আর সুলেইমান বেগ যে পরিকল্পনা করেছেন সেটা কি সম্রাট হিসাবে তার প্রথম যুদ্ধে তাকে বিজয়ী করার জন্য যথেষ্ট বলে প্রমাণিত হবে? খসরুর বিশ্বাসঘাতকতার বিষয়ে তিনি কেন পূর্বেই প্রস্তুত ছিলেন না? আকবর যখন বেঁচে ছিলেন খসরু তাঁর দাদাজানের অনুগ্রহভাজন হবার চেষ্টা করেছিল, তার উত্তরাধিকারী হিসাবে মনোনীত হবার আশায়। আকবর যখন তাঁর পরিবর্তে জাহাঙ্গীরকে নির্বাচিত করেন, খসরু আপাত দৃষ্টিতে সেটা মেনে নিলেও সে আসলে নিজের সুযোগের জন্য অপেক্ষা করছিল। আগ্রা থেকে পাঁচ মাইল দূরে সিকানদারায় তাঁর দাদাজানের বিশাল সমাধিসৌধ নির্মাণের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণের বাহানা দেখিয়ে সে তার পুরো বাহিনী নিয়ে আগ্রা দূর্গ থেকে বের হয়ে যায়। সিকানদারা অভিমুখে না গিয়ে সে উত্তর দিকে সোজা দিল্লির উদ্দেশ্যে ঘোড়া হাঁকায়, পথে যেতে যেতে নতুন সৈন্য নিয়োগ করে সে তার বাহিনীর সংখ্যা বৃদ্ধি করতে থাকে।
জাহাঙ্গীর যখন চূড়ান্ত আদেশ দেয়ার জন্য তাঁর বয়োজ্যেষ্ঠ সেনাপতিদের একত্রিত করে সূর্য তখন আকাশের অনেক উঁচুতে উঠে গিয়েছে। আবদুর রহমান, আপনি, অশ্বারোহী বকি আর তীরন্দাজদের একটা বাহিনীর সাথে আমাদের রণহস্তির দলকে নেতৃত্ব দিয়ে পশ্চিম দিকে নিয়ে যাবেন শৈলচূড়া যেখানে ধীরে ধীরে সমভূমির সাথে এসে মিশেছে। আপনি সেখানে অবস্থান গ্রহণের পরে, শৈলচূড়ার হলরেখা বরাবর অগ্রসর হয়ে, খসরুকে বিশ্বাস করতে বাধ্য করবেন যে এটাই হবে, যেমনটা প্রচলিত রণনীতিতে অনুসৃত হয়, আমাদের আক্রমণের প্রধান অভিমুখ।
‘কিন্তু এটা একটা ভাওতা। খসরুর সৈন্যদের যতবেশি সংখ্যায় সম্ভব নিবিষ্ট রাখার জন্য এটা একটা কৌশল। আমি আপনাকে শত্রুর সাথে পুরোপুরি নিবিষ্ট দেখার পরে, সুলেইমান বেগ আর আমি আমাদের আরেকদল অশ্বারোহী নিয়ে রওয়ানা দেব। প্রথমে, আপনাকে সহযোগিতা দেয়ার জন্য আমরা পশ্চিম দিকে যাবার ভান করবো কিন্তু তারপরেই আমরা ঘুরে গিয়ে সরাসরি আমাদের সামনে চূড়ার শীর্ষে অবস্থিত খসরুর তাবু অভিমুখে আক্রমণ করার জন্য পেয়ে যাব। ইসমাঈল আমল, এখানে অতিরিক্ত বাহিনীর নেতৃত্বে আপনি অবস্থান করবেন এবং লুটপাটের কোনো প্রয়াস থেকে আমাদের শিবিরকে রক্ষা করবেন। আপনারা সবাই কি নিজেদের ভূমিকা ঠিকমত বুঝতে পেরেছেন?
“জ্বী, সুলতান, সাথে সাথে প্রত্যুত্তর ভেসে আসে।
‘তাহলে আল্লাহতালা আমাদের সহায়। আমরা ন্যায়ের পক্ষে রয়েছি।
*
আধ ঘন্টা পরে, জাহাঙ্গীর পুরোদস্তুর যুদ্ধের সাজে সজ্জিত অবস্থায়, তাঁর ইস্পাতের শিরোস্ত্রাণের নিচে ঘামতে থাকে এবং ইস্পাতের কারুকাজ করা বক্ষ–এবং পৃষ্টরক্ষাকারী বর্ম তার দেহখাঁচা আবৃত করে রেখেছে। নিজের সাদা ঘোড়ায় উপবিষ্ট অবস্থায়, বিশাল প্রাণীটা খুর দিয়ে অস্থিরভাবে কেবলই মাটিতে আঘাত করছে যেন আসন্ন লড়াইয়ের আভাস আঁচ করতে পেরেছে, সে আবদুর রহমানের বাহিনীকে তূর্য ধ্বনি, ক্রমশ জোরালো হতে থাকা ঢোলের আওয়াজ আর মন্দ্র বাতাসে পতপত করে উড়তে থাকা সবুজ নিশানের মাঝে, সঙ্ঘবদ্ধভাবে অগ্রসর হতে দেখে। আগুয়ান বহরটা বিস্তৃত শৈলশিরার পাদদেশের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করতে খসরুর তোপচিরা নিকটবর্তী অবস্থান থেকে আক্রমণকারীদের লক্ষ্য করে নিজেদের অপেক্ষাকৃত বড় কামানগুলো থেকে গোলাবর্ষণ শুরু করলে বাতাসে সাদা ধোয়া ভাসতে দেখা যায়।
অবশ্য, স্পষ্টতই বোঝা যায় যে গোলন্দাজেরা সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে এবং তড়িঘড়ি করে আগেই কামান থেকে গোলাবর্ষণ করা থেকে নিজেদের তারা বিরত রাখতে পারে না কারণ আবদুর রহমানের অগ্রবর্তী দলের অনেক সামনে তাদের নিক্ষিপ্ত গোলাগুলো এসে আছড়ে পড়ে ঝর্ণার মত উপরের দিকে ধুলো নিক্ষেপ করে। কিন্তু তারপরেই জাহাঙ্গীরকে আতঙ্কিত করে তুলে তাঁর আগুয়ান একটা রণহস্তী ইস্পাতের বর্ম দিয়ে আবৃত থাকা সত্ত্বেও হুড়মুড় করে মাটিতে আছড়ে পড়ে, বিশাল প্রাণীটা ভূপাতিত হবার সময় পিঠের হাওদাটাকে একপাশে ছিটকে ফেলে দেয়। আরো একটা হাতি মাটিতে পড়ে যায়। জাহাঙ্গীরের কাছে মনে হয় আক্রমণ বুঝি ব্যর্থ হতে চলেছে কিন্তু তারপরেও বিশাল প্রাণীগুলোর কানের পেছনে বসে থাকা মাহুতের দল প্রাণীগুলোকে সামনের দিকে এগিয়ে যাবার আদেশ দিতে, অবশিষ্ট হাতিগুলো তাদের ভূপাতিত সঙ্গীদের পাশ কাটিয়ে তাদের দেহের তুলনায় বিস্ময়কর দ্রুতগতিতে পাহাড়ের চূড়ার দিকে উঠে যাওয়া পথ দিয়ে অগ্রসর হতে শুরু করে। মাঝে মাঝে ধোয়ার কুণ্ডলী সৃষ্টি হতে বোঝা যায় যে হাতিগুলোর হাওদায় স্থাপিত ছোট কামান, গজনলগুলো থেকে গোলা বর্ষণ করা হচ্ছে। জাহাঙ্গীর একই সময়ে লক্ষ্য করে তার অশ্বারোহী যোদ্ধারা পর্বত শিখরোপরি পথ দিয়ে আক্রমণ শুরু করেছে, তারা লাল মাটির জোড়াতালি দিয়ে তৈরি করা অবরোধক লাফিয়ে অতিক্রম করার সময় সবুজ নিশানগুলো উঁচুতে তুলে ধরে এবং বর্শার ফলা সামনের দিকে বাড়িয়ে রাখে এবং খসরুর অশ্বারোহীদের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। উভয়পক্ষেই প্রচুর হতাহত হয় এবং যুদ্ধক্ষেত্র থেকে দুলকি চালে আরোহীবিহীন ঘোড়াগুলো ছুটে যায় আবার কিছু ঘোড়া আক্রমণকারীদের অগ্রসর হবার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। জাহাঙ্গীরের দৃষ্টি ক্রমেই যুদ্ধক্ষেত্রের উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়া সাদা ধোয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায় কিন্তু তার আগেই সে একদল অশ্বারোহীকে দেখতে পায়, মধ্যাহ্নের সূর্যকিরণে তাঁদের বক্ষস্থল আবৃতকারী বর্ম চিকচিক করছে, খসরুর তাবুর সামনে নিজেদের অবস্থান ত্যাগ করে দ্রুত আবদুর রহমানের আক্রমণের মুখে তাঁদের সহযোদ্ধাদের অবস্থান মজবুত করতে পশ্চিম দিকে এগিয়ে যায়। তার উপরেই যুদ্ধের সন্ধিক্ষণ নির্ভর করছে।
‘আমাদের এবার যাবার সময় হয়েছে, জাহাঙ্গীর ময়ান থেকে তাঁর পূর্বপুরুষের ব্যবহৃত ঈগলের মাথাযুক্ত হাতল বিশিষ্ট তরবারি আলমগীর টেনে বের করার মাঝে সুলেইমান বেগের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলে রেকাবের উপরে দাঁড়িয়ে নিজের তূর্যবাদকের উদ্দেশ্যে সেটা আন্দোলিত করে তাঁদের অগ্রসর হবার সংকেত ঘোষণা করতে বলে। জাহাঙ্গীরের সাদা ঘোড়া অচিরেই আস্কন্দিত বেগে ছুটতে শুরু করে, আবদুর রহমানকে সহায়তা দানে পূর্বে পরিকল্পিত মেকী যুদ্ধের ঢঙে ছোটার সময় জন্তুটার খুরের আঘাতে মাটিতে থেকে ধুলো উড়তে থাকে।
যুদ্ধের সমূহ সম্ভাবনায় জাহাঙ্গীরের নাড়ীর স্পন্দন দ্রুততর হতে থাকে। তার বয়স ছত্রিশ বছর হতে চলেছে কিন্তু তাঁর পূর্বপুরুষেরা এই বয়সে যত যুদ্ধের অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন সে তার তুলনায় অনেক কম যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছে, তাকে সামরিক নেতৃত্ব প্রদানে তাঁর আব্বাজানের অস্বীকৃতি এর জন্য আংশিক দায়ী এবং আংশিক দায়ী রাজ্য পরিচালনায় আকবরের সাফল্য যার ফলে মোগলদের খুব কমই যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত হতে হয়েছে। সাম্রাজ্য যেহেতু তার সেই কারণে নেতৃত্বও তার এবং সে সমস্ত প্রতিদ্বন্দ্বীকে আজ গুঁড়িয়ে দেবে।
জাহাঙ্গীর তার সাদা ঘোড়া নিয়ে নিজের দেহরক্ষীদের মাঝ থেকে সামনে এগিয়ে যায় এবং তারপরে তাঁদের ইঙ্গিত করে ঘুরে গিয়ে পর্বতের শীর্ষে অবস্থিত শৈলশিরা বরাবর উঠে গিয়ে সামনের দিকে আক্রমণ করতে। তারা সবাই যখন আক্রমণ করতে ব্যস্ত, জাহাঙ্গীর পর্যাণের উপর মোড় দিয়ে পিছনে তাকিয়ে একজন অশ্বারোহী যোদ্ধা আর তাঁর খয়েরী রঙের ঘোড়াকে মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়তে দেখে, স্পষ্টতই বোঝা যায় খুব দ্রুত আর তীক্ষ্ণ বাঁক নিতে গিয়ে তাদের এই অবস্থা। মাটিতে পড়ে থাকা খয়েরী ঘোড়ার গায়ে আরেকটা ঘোড়া হোঁচট খায়, পাগুলো বাতাসে অক্ষম আক্রোশে আঘাত করে বিশাল জটা প্রাণপনে উঠার চেষ্টা করে। নিমেষের ভিতরে ভূপাতিত জন্তু আর তাঁদের আরোহীরা শৈলশিরার ক্রমশ খাড়া হয়ে উপরের দিকে উঠে যাওয়া পথ দিয়ে আক্রমণের বেগ ধীরে ধীরে জোরালো করতে আরম্ভ করলে তাদের পায়ের নিচে হারিয়ে যায়।
জাহাঙ্গীর তার হাতের তরবারি আলমগীর সামনে দিকে বাড়িয়ে ধরে, দূর্ঘটনা এড়াতে নিজের সাদা ঘোড়াটার গলার কাছে নিচু হয়ে ঝুঁকে এসে, পাহাড়ী ঢালটার গায়ে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য ছোটবড় পাথরের টুকরো এড়িয়ে যেতে মনোনিবেশ করে। সে তারপরেই পটকা ফাটার মত কড়কড় একটা শব্দ শুনতে পায় এবং একটা হিস শব্দ তুলে তার কানের পাশ দিয়ে গাদাবন্দুকের গোলা অতিক্রম করে। সে মাটির তৈরি প্রতিবন্ধকতার প্রথম সারির প্রায় কাছে চলে এসেছে। সে তার হাতে ধরা লাগাম আলগা করে দিয়ে ঘোড়র কানের কাছে ঝুঁকে এসে ফিসফিস করে। সামনের প্রতিবন্ধকতা লাফিয়ে অতিক্রম করতে সাহস দেয়, যা খুব বেশি হলে ফুট তিনেক লম্বা হবে। ঘোড়াটা যেন এই আদেশের অপেক্ষায় ছিল এবং সাথে সাথে লাফ দেয়। প্রতিবন্ধকতার উপর দিয়ে লাফিয়ে অতিক্রম করার সময় সেটার পিছনে লুকিয়ে থাকা শত্রুপক্ষের এক দীর্ঘদেহী তবকিকে লক্ষ্য করে জাহাঙ্গীর তরবারি চালায় বেচারা তখন মরীয়া হয়ে নিজের গাদাবন্দুকের লম্বা নল দিয়ে সীসার একটা নতুন গুলি ঠেসে ঢুকিয়ে দিয়ে সেটাকে পুনরায় গুলিবর্ষণের উপযোগী করার চেষ্টা করছে। লোকটা নিজের অভীষ্ট উদ্দেশ্য কখনই অর্জন করতে পারবে না, জাহাঙ্গীরের তরবারির প্রচণ্ড আঘাত লোকটার অরক্ষিত ঘাড়ের পেছনের অংশে কামড় বসায়, হাড়ের ভিতর দিয়ে একটা বীভৎস মড়মড় শব্দ করে এবং হতভাগ্য লোকটার কাঁধের উপর থেকে মাথাটা বিচ্ছিন্ন করে ফেলে।
জাহাঙ্গীর হাপড়ের মত শ্বাস নিতে নিতে শৈলশিখরের চূড়ার দিকে আস্কন্দিত বেগে ঘোড়া হাঁকায় এবং যে তাবুটাকে খসরুর নিয়ন্ত্রক তাবু হিসাবে সে করেছে, সেটা তখনও আধমাইলের মত দূরে, এমন সময় সহসাই তার বাহনের গতি মন্থর হতে আরম্ভ করে। সে পেছনের দিকে তাকিয়ে দেখে প্রাণীটার বামপাশ ফুড়ে দুটো তীরের ফলা বাইরে বের হয়ে রয়েছে। ক্ষতস্থান থেকে গাঢ় লাল বর্ণের রক্ত ইতিমধ্যেই কুলকুল করে গড়াতে আরম্ভ করে প্রাণীটার সাদা চামড়ায় একটা দাগের জন্ম দিয়েছে। জাহাঙ্গীরের তখন নিজের সৌভাগ্য নিয়ে চিন্তা করার মত বিলাসিতার সময় নেই–তার বাম হাঁটু থেকে মাত্র এক কি দুই ইঞ্চি দূরে একটা তীর বিদ্ধ হয়েছে–তার আগেই ঘোড়াটা হুড়মুড় করে মাটিতে আছড়ে পড়তে আরম্ভ করে এবং বিশাল জন্তুটা মাটিতে ভূপাতিত হবার সময় এর নিচে চাপা পড়ার হাত থেকে বাঁচতে সে লাফিয়ে উঠে পর্যাণ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়। মাটিতে আছড়ে পড়ার সময় জাহাঙ্গীর তাঁর শিরোস্ত্রাণ আর তরবারি দুটোই খোয়ায় এবং পাথুরে মাটিতে বেকায়দায় অবতরণ করায় তার বুক থেকে সব বাতাস বের হয়ে যায়।
জাহাঙ্গীর মাটিতে বার বার গড়াতে গড়াতে নিজেকে কুকড়ে ফেলে একটা বলে পরিণত করতে চেষ্টা করে এবং সে তার দস্তানা আবৃত হাত দিয়ে পেছনের অশ্বারোহী যোদ্ধাদের ঘোড়ার খুরের আঘাত থেকে নিজের মাথা বাঁচাতে চেষ্টা করে যারা তাকে অনুসরণ করে আক্রমণে উদ্যত হয়েছে। ধাবমান ঘোড়ার পাল আর খণ্ডযুদ্ধের মূল এলাকা থেকে বেশ খানিকটা দূরে ঢাল বরাবর নিচের দিকে বেশ খানিকটা দূরত্ব অতিক্রম করার পরে ঢালের পাশে অবস্থিত পাথরের একটা স্তূপের সাথে ধাক্কা লেগে তার যন্ত্রণাদায়ক পতনের বেগ স্তব্ধ হয় কিন্তু তা সত্ত্বেও, দুদ্দাড় ভঙ্গিতে ধাবমান একটা খুর তার পিঠের ইস্পাতের বর্মে আঘাত করে। বিমূঢ় আর বিভ্রান্ত এবং কানের ভিতরে হাজারো ঘন্টা ধ্বনি আর চোখে অস্পষ্ট দৃষ্টি নিয়ে সে টলমল করে নিজের পায়ে দাঁড়াবার সময় সে কাছাকাছি অবস্থিত কালো পাথরের আরেকটা স্তূপের পেছন থেকে একজন লোককে উঠে দাঁড়াতে দেখে এবং একটা তরবারি বাতাসে আন্দোলিত করতে করতে তাঁর দিকে ধেয়ে আসে, স্পষ্টতই তাকে চিনতে পেরেছে এবং তাকে হত্যা কিংবা বন্দি করতে পারলে প্রাপ্য সম্মান আর সম্পদ অর্জনে একচিত্ত।
জাহাঙ্গীর সহজাত প্রবৃত্তির বশে তাঁর পরিকরের দিকে হাত বাড়ায় যেখানে রত্নখচিত ময়ানে তার খঞ্জরটা রয়েছে। সে পরম স্বস্তিতে আবিষ্কার করে সেটা এখনও সেখানেই রয়েছে এবং চাপদাড়ি আর কালো পাগড়ি পরিহিত রুক্ষ-দর্শন এবং স্থূলকায়–লোকটা তার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগেই সে সময়মত খঞ্জরটা ময়ান থেকে বের করে। জাহাঙ্গীর লোকটার প্রথম আক্রমণের ঝাপটা কৌশলে এড়িয়ে যায় কিন্তু সেটা করতে গিয়ে তার পা পিছলে যায় এবং আবারও মাটিতে আছড়ে পড়ে। তাঁর হামলাকারী সুযোগ বুঝতে পেরে এবার দু’হাতে নিজের ভারি দুধারী তরবারি আঁকড়ে ধরে গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে সেটা জাহাঙ্গীরের গলায় নামিয়ে আনতে চেষ্টা করে কিন্তু সে আঘাত করতে গিয়ে বড় তাড়াহুড়ো করায় জাহাঙ্গীরের বক্ষস্থল রক্ষাকারী বর্মে লেগে লোকটার আনাড়ি অভিঘাত পিছলে গেলে, লোকটা নিজেই নিজেকে ভারসাম্যহীন করে তোলে। জাহাঙ্গীর তার নাগরা পরিহিত পা দিয়ে প্রাণপনে লাথি হাঁকায় এবং তার প্রতিপক্ষের দু’পায়ের সংযোগস্থলে লাথিটা মোক্ষমভাবে আঘাত করলে সে নরম পেশীতন্তুর একটা তৃপ্তিকর স্পর্শ অনুভব করে। লোকটা তাঁর হাতের অস্ত্র ফেলে দিয়ে নিজের থেতলে যাওয়া অণ্ডকোষ খামচে ধরে, চরাচর স্তব্ধকারী ব্যাথায় হাঁটুর উপর কুকড়ে দু’ভাঁজ হয়ে আসে।
জাহাঙ্গীর নিজের সুবিধাজনক অবস্থার সুযোগ নিয়ে, তাঁর আক্রমণকারীর অরক্ষিত পায়ের গুলের শক্ত মাংসপেশীতে হাতের খঞ্জর দিয়ে দ্রুত দু’বার আঘাত করায়, লোকটা টলমল পায়ে একপাশে সরে গিয়ে মাটিতে পড়ে যায়। জাহাঙ্গীর ধুলি আচ্ছাদিত মাটির উপর দিয়ে হাচড়পাঁচড় করে এগিয়ে এসে নিজেকে লোকটার উপরে আছড়ে ফেলে এবং লোকটার কণ্ঠার হাড়ের ঠিক উপরের অরক্ষিত কণ্ঠনালীতে খঞ্জরের লম্বা ফলাটা আমূল গেঁথে দেয়। ফিনকি দিয়ে কিছুক্ষণ রক্ত উৎক্ষিপ্ত হয় আর তারপরে লোকটা নিথর ভঙ্গিতে মাটিতে পড়ে থাকে।
প্রাণহানির ঝুঁকি থেকে ভারমুক্ত হয়ে জাহাঙ্গীর যখন তার চারপাশে তাকায় তখনও সে চার হাতপায়ের উপর ভর দিয়ে রয়েছে এবং ঘন ঘন শ্বাস টানছে। সে তার ঘোড়র উপর থেকে মাটিতে আছড়ে পড়ার পরে অনেকটা সময় অতিক্রান্ত হয়েছে মনে হলেও আসলে পাঁচ মিনিটও অতিবাহিত হয়নি। মূল লড়াইটা বোধহয় শৈলচূড়ার বেশ খানিকটা উপরের দিকে সংঘটিত হচ্ছে। সে যদিও তখনও চোখে ঝাপসা দেখছে তার ভেতরেই সে বেশ কিছুটা দূরে অশ্বারোহী একটা অবয়বকে লক্ষ্য করে দ্রুত এগিয়ে আসছে এবং, ঝাপসা চোখে সে যতটা বুঝতে পারে, লোকটার সাথে আরেকটা অতিরিক্ত ঘোড়া রয়েছে। জাহাঙ্গীর টলমল করতে করতে নিজের পায়ে উঠে দাঁড়ায় এবং নতুন কোনো আক্রমণের বিরুদ্ধে নিজেকে প্রস্তুত করতে চেষ্টা করে কিন্তু তারপরেই সে একটা পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনতে পায়। জাহাঙ্গীর, আপনি কি সুস্থ আছেন?’ সুলেইমান বেগের কণ্ঠস্বর।
‘হ্যাঁ, আমার তো তাই মনে হয়… আপনার সাথে কি পানি আছে?
সুলেইমান বেগ তাঁর দিকে পানিপূর্ণ একটা চামড়ার তৈরি মশক এগিয়ে দেয়। জাহাঙ্গীর দু’হাতে মশকটা আঁকড়ে ধরে, সেটা উপুড় করে ধরে ব্যগ্রভাবে পানি পান করে।
‘আক্রমণের সময় এতটা বেপরোয়া হয়ে উঠা আপনার মোটেই উচিত হয়নি। আপনি আমাকে আর আপনার দেহরক্ষীদের পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে গিয়েছিলেন। সম্রাট নিজেকে এভাবে অরক্ষিত করতে পারেন না।’
‘এটা আমার লড়াই। আমার নিজের ছেলে আমার শাসন অমান্য করে বিদ্রোহ করেছে এবং তাকে দমন করাটা আমার দায়িত্ব, জাহাঙ্গীর তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে, তারপরে জানতে চায়, ‘লড়াইয়ের কি খবর? অতিরিক্ত ঘোড়াটা আমাকে দাও। আরো একবার আক্রমণের নেতৃত্ব দিতে আমাকে অবশ্যই ফিরে যেতে হবে।’
‘আমি ঘোড়াটা আপনার জন্যই এনেছি–এবং আমি আপনার তরবারিও উদ্ধার করেছি, জাহাঙ্গীরের দিকে তরবারি আর ঘোড়ার লাগাম এগিয়ে দিয়ে, সুলেইমান বেগ বলে। কিন্তু আপনি কি নিশ্চিত যে আপনি সুস্থ রয়েছেন?
‘হ্যাঁ, জাহাঙ্গীর যতটা অনুভব করে কণ্ঠে তাঁর চেয়ে বেশি নিশ্চয়তা ফুটিয়ে বলে। অতঃপর সে তাঁর নতুন বাহন, খয়েরী রঙের উঁচু, ছিপছিপে ঘোড়ার পর্যাণে সুলেইমান বেগের সহায়তায় চার হাত পায়ের সাহায্যে বহু কষ্টে আরোহণ করে। সময় অতিবাহিত হবার সাথে সাথে তাঁর মাথা থেকে বিভ্রান্তির মেঘ অপসারিত হওয়ায় সে স্বস্তি বোধ করে, তারপরে সুলেমান বেগ আর নিজের কতিপয় দেহরক্ষী যারা ইতিমধ্যে তাঁর পাশে এসে অবস্থান গ্রহণ করেছে তাদের নিয়ে সে পুনরায় শৈলশিখরোপরি পথ দিয়ে উপরে উঠতে আরম্ভ করে যেখানে কয়েকটা তাবুর চারপাশে দারুণ লড়াই জমে উঠেছে। খসরুর অনুগত লোকেরা সেখানে দারুণ প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। সে দেখে দু’পক্ষের যোদ্ধাদের বহনকারী ঘোড়াগুলো দুই পায়ের উপর ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ায় তাদের আরোহীরা পরস্পরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হলে। খসরুর বেশ কয়েকজন অশ্বারোহী যোদ্ধা, সম্ভবত জাহাঙ্গীর আর সুলেইমান বেগকে চিনতে পেরে তাবুর চারপাশের লড়াই থেকে সরে আসে এবং তাঁদের আক্রমণ করতে আস্কন্দিত বেগে নিচের দিকে নামতে নামতে চিৎকার করে খসরু জিন্দাবাদ’, যুবরাজ খসরু দীর্ঘজীবি হোন!
একজন সরাসরি জাহাঙ্গীরের দিকে ধেয়ে আসে। হাত আর পা আন্দোলিত করে, উন্মত্তের ন্যায় ঘোড়া হাঁকিয়ে লোকটা ধেয়ে আসতে, জাহাঙ্গীর লক্ষ্য করে সে আর কেউ না আজিজ কোকার ছোট ভাই। তরুণ যোদ্ধা আরেকটু কাছাকাছি এসে জাহাঙ্গীরকে লক্ষ্য করে সে নিজের হাতের বাঁকানো তরবারি দিয়ে তাকেই লক্ষ্য গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে আঘাত হানতে সম্রাট মাথা নিচু করে আঘাতটা এড়িয়ে যান এবং তাঁর মাথার দুই ইঞ্চি উপর দিয়ে তরবারির ফলাটা বাতাসে শূন্যের ভিতর দিয়ে কক্ষপথে ঘুরে আসে। অশ্বারোহী আক্রমণকারী পাহাড়ের ঢাল দিয়ে নিচের দিকে আক্রমণের জন্য ধেয়ে আসার সময় গতিপ্রাবল্যের কারণে জাহাঙ্গীরকে অতিক্রম করে সামনের দিকে এগিয়ে গেলে, জাহাঙ্গীর পর্যাণের উপর কোমর থেকে দেহের উধ্বাংশ এক মোচড়ে ঘুরিয়ে নেয় এবং লোকটাকে বাধা দিতে তরবারির তীব্র বিপ্রতীপ আঘাত করতে তাঁর ঊর্ধ্ববাহুর হাড় মাংসের গভীরে তরবারির ফলা প্রবেশ করে, হাতটাই দেহ থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। আক্রমণকারী লোকটা তার বাহনের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে, তরুণ যোদ্ধা পাহাড়ের ঢাল দিয়ে দিগ্বিদিক শূন্য হয়ে জাহাঙ্গীরের শিবিরের দিকে ধেয়ে নামতে থাকে যতক্ষণ না শিবিরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে উল্টানো মালবাহী শকটের পেছনে ইসমাইল আমলের মোতায়েন করা জাহাঙ্গীরের তবকিদের একজনের নিশানা ভেদী দুর্দান্ত একটা গুলি তাকে পর্যাণ থেকে ছিটকে দেয়।
জাহাঙ্গীর নিজের চারপাশে তাঁর চিরাচরিত তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে যে অন্য আক্রমণকারীদের হয় তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে কিংবা পাহাড়ের ঢাল দিয়ে উপরের দিকে পশ্চাদপসারণে বাধ্য করা হয়েছে। অনেকগুলো নিথর দেহ মাটিতে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। ধুসর শ্মশ্রুমণ্ডিত, লাল আলখাল্লা পরিহিত দীর্ঘদেহী একটা লোক কাছেই পিঠের উপর ভর দিয়ে হাত পা ছড়িয়ে আকাশের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে পড়ে রয়েছে। তার উদরের ভেতর থেকে বর্শার একটা রক্তাক্ত ফলা বের হয়ে আছে। জাহাঙ্গীর লোকটাকে চিনতে পারে, তুহিন সিং, তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত দেহরক্ষীদের একজন–তাঁর আম্মাজানের মাতৃভূমি আম্বার থেকে আগত এক রাজপুত যোদ্ধা।লোকটা প্রায় সিকি শতাব্দি যাবত তাকে পাহারা দিয়েছে এবং এখন যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁর জন্য প্রাণ দিয়েছে। কয়েক গজ দূরেই, লাল ধুলির মাঝে ক্ষীণদর্শন একটা অবয়ব তীব্র যন্ত্রণায় মোচড় খায় এবং তাঁর দেহ আক্ষিপ্ত হয়, তাঁর পায়ের গোড়ালী মাটিতে পদাঘাত করছে এবং দৃঢ়মুষ্ঠিতে নিজের উদর আঁকড়ে রয়েছে যেখান থেকে লালচে-নীল রঙের নাড়িভূড়ি বের হয়ে আসতে চেষ্টা করছে। লোকটা অসহ্য যন্ত্রণায় চিৎকার করে নিজের মাকে ডাকছে। ইমরানের শুশ্রুবিহীন বিকৃত মুখটা, আজিজ কোকার একেবারেই অল্পবয়সী ভাই, চিনতে পেরে জাহাঙ্গীর আঁতকে উঠে জোরে শ্বাস নেয়। তার বয়স কোনোমতেই তের বছরের বেশি হবে না এবং নিশ্চিতভাবেই আগামীকালের সূর্যোদয় দেখার জন্য সে বেঁচে থাকবে না।
খসরু, আজিজ কোকা আর তাদের সহযোগী ষড়যন্ত্রকারীদের ক্ষমতার প্রতি অপরিণামদর্শী মোহের কারণে এতগুলো তাজা প্রাণের অকাল মৃত্যুতে তাঁদের প্রতি চরাচরগ্রাসী এটা ক্রোধ জাহাঙ্গীরকে আপুত করে তোলে। জাহাঙ্গীর তার খয়েরী ঘোড়াটার পাজরে গুঁতো দিয়ে ঢাল দিয়ে উপরের দিকে উঠতে শুরু করার আগে সুলেইমান বেগ আর নিজের দেহরক্ষীদের চিৎকার করে আদেশ দেয় তাকে অনুসরণ করতে। সে অচিরেই খণ্ডযুদ্ধের নিয়ামক স্থানে পৌঁছে, তার চারপাশে ইস্পাতের ফলা মৃত্যুর সিদ্ধান্ত করছে। জাহাঙ্গীরের তরবারি আলমগীর প্রতিপক্ষের এক অশ্বারোহীর গলায় একটা মোক্ষম ক্ষতচিহ্ন এঁকে দিতে সেখান থেকে ছিটকে উঠা রক্তে তাঁর মুখ ভিজে যেতে সে কয়েক মুহূর্ত চোখে কিছুই দেখতে পায় না। সে দ্রুত হাতের আস্তিনে চোখ মুছে নিয়ে, ইস্পাতের ফলার প্রতিদ্বন্দ্বীতা, চিৎকার আর আর্তনাদে মুখরিত এলোপাথাড়ি লড়াইয়ের দিকে ধেয়ে যায়।
ঘাম আর বারুদের ঝাঁঝালো গন্ধ তাঁর নাসারন্ধ্রে নিজেদের উপস্থিতি জানান দেয় আর বাতাসে আধিপত্য বিস্তারকারী লাল ধুলো তাঁর চোখে ক্রমাগত গুল ফোঁটাতে থাকলে তার কাছে শত্রু মিত্রে প্রভেদকারী সীমান্ত প্রায় বিলীন হয়ে আসে। কিন্তু সে সুলেইমান বেগ আর দেহরক্ষীদের বেষ্টনীর মাঝে অবস্থান করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। আলমগীরের চূড়ান্ত একটা আঘাত যা খসরুর এক লোকের হাঁটুর উপর মোক্ষমভাবে ছোবল দিয়ে, পেশীত আর অস্থিসন্ধির গভীরে কেটে বসে যায় এবং আঘাতে প্রচণ্ডতায় আরো একবার জাহাঙ্গীরের হাত থেকে তরবারির হাতল প্রায় ছুটে যাবার দশা হয়, আর সেই সাথে জাহাঙ্গীর যুদ্ধক্ষেত্রের প্রথম ব্যুহ অতিক্রম করে। সে উপরের দিকে তাকিয়ে দেখে যে মাত্র চারশ গজ দূরে পর্বত শৃঙ্গের চূড়ায় খসরুর তাবুগুলোর অবস্থান। অবশ্য, সে যখন তাকিয়ে রয়েছে, দেখতে পায় বিশাল একদল অশ্বারোহী তাবুগুলো পরিত্যাগ করে শৈলচূড়ার অপর পাশে হারিয়ে যায়। অশ্বারোহীদের দলটা যখন চলে যাচ্ছে সে দেখে–বা তার মনে হয় সে দেখেছে–খসরু তাদের মাঝখানে অবস্থান করছে।
‘ওদের ধাওয়া কর। কাপুরুষগুলো পালিয়ে যাচ্ছে, সে নিজের খয়েরী ঘোড়ার পাঁজরে গুঁতো দিয়ে সুলেমান বেগ আর নিজের দেহরক্ষীদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলে। বিশাল জটা ইতিমধ্যে অবশ্য, কিছুক্ষণ আগে সংঘটিত যুদ্ধের ধকল সামলাতে নাকের পাটা প্রসারিত করে, ভীষণভাবে হাঁপাতে শুরু করেছে, এবং এই ঘোড়াটা যার স্থান নিয়েছে তাঁর আগের সেই সাদা ঘোড়ার মত স্বাস্থ্যবান আর তেজী এটা না। সে যখন পর্বত শীর্ষের চূড়ায় পৌঁছে, জাহাঙ্গীর শৈল শিখরের পাদদেশে মোতায়েন করা তাঁর যোদ্ধাদের একটা প্রতিরক্ষা ব্যুহের সাথে পলায়নকারী দলটাকে সংঘর্ষে লিপ্ত অবস্থায় দেখে। কিছুক্ষণের ভিতরেই মরিয়া দলটা প্রতিরক্ষা ব্যুহ ভেদ করে বের হয়ে আসে, তাদের মাত্র একজন যোদ্ধা হত হয়েছে যার আরোহীবিহীন ঘোড়াটা লাগাম মাটিতে পরা অবস্থায়, মূল দলটার পেছন পেছন দৌড়াতে থাকে, সমভূমির উপর দিয়ে খুব কাছাকাছি অবস্থানে বিন্যস্ত হয়ে উত্তরের দিকে এগিয়ে যায়।
জাহাঙ্গীর খয়েরী ঘোড়াটার পাঁজরে পুনরায় গুতো দিয়ে ধাওয়া শুরু করলেও সে মনে মনে ঠিকই বুঝতে পারে পুরো প্রয়াসটাই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। তার কুলাঙ্গার সন্তান নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। পলায়নের যে কোনো প্রয়াস বাধাগ্রস্থ করতে সে কেন আরো বেশি সংখ্যক অতিরিক্ত সৈন্য মোতায়েন করে নি? তাকে তারপরেই পরম স্বস্তিতে ভাসিয়ে মোগলদের সবুজ নিশান–খসরুর নিজের প্রতীকচিহ্ন হিসাবে দাবি করা বেগুনী নয়–উড়িয়ে সে দেখে একদল অশ্বারোহী পশ্চিম দিক থেকে অনিবার্য মুখোমুখি সংঘর্ষের অনিবার্য পথ বরাবর আবির্ভূত হয়। আবদুল রহমানও নিশ্চয়ই আগেই দলটার গতিবিধি দেখতে পেয়েছিল এবং তাঁদের পাঠিয়েছে। তারা খুব দ্রুত পলায়নপর দলটার সাথে নিজেদের দূরত্ব হ্রাস করতে থাকে। জাহাঙ্গীর তার দেহরক্ষী আর সুলেইমান বেগকে সাথে নিয়ে নিজের ক্লান্ত ঘোড়াটাকে পর্বত শিখরের শৈল শিরার দূরবর্তী প্রান্তের ঢালের দিকে ছোটার জন্য তাড়া দেয়। কিন্তু সে শৈল শিরার পাদদেশে পৌঁছাবার পূর্বেই, খসরুর লোকেরা তাদের পশ্চাদ্ধাবনকারীদের নিকট হতে চক্রাকারে ঘুরতে শুরু করে এবং তাঁদের পেছনে ধুলার একটা মেঘের সৃষ্টি করে, উত্তরপূর্ব দিকে আস্কন্দিত বেগে ছুটতে থাকে। জাহাঙ্গীর তখন খসরুর চার বা পাঁচজন পশ্চাদ্রক্ষীকে ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে উদ্যত তরবারি মাথার উপরে আন্দোলিত করে আবদুর রহমানের বাহিনীর দিকে ছুটে যায় উদ্দেশ্য একটাই নিজেদের জীবনের বিনিময়ে পলায়নের জন্য তাদের সহযোদ্ধাদের কিছুটা সময় করে দেয়া।
সে কয়েক গজ দূরত্ব অতিক্রম করার পূবেই এই সাহসী লোকগুলোর একজন, হাত দুপাশে ছড়িয়ে, তাঁর কালোর ঘোড়র উপর থেকে মাটিতে আছড়ে পড়ে, ধাওয়াকারীদের দলে আবদুর রহমানের বিচক্ষণতার কারণে প্রেরিত অশ্বারোহী তীরন্দাজদের কোনো একজনের নিক্ষিপ্ত তীরের আঘাতে এবং জাহাঙ্গীর কেবল বুঝতে পারে রেকাবের উপরে দাঁড়িয়ে তাঁরা তাঁদের আয়ুধ শূন্যে ছুড়ছে। খসরুর আরেক অনুগত যোদ্ধার বাহন কিছুক্ষণ পরেই আরোহীকে মাথার উপর দিয়ে ছিটকে দিয়ে, ভূপাতিত হয়। অন্য যোদ্ধারা তাঁদের আক্রমণের অভিপ্রায়ে নিজেদের ছুটে চলা অব্যাহত রাখে এবং আবদুর রহমানের অগ্রবর্তী অশ্বারোহীদের মাঝে আছড়ে পড়তে তারা নিজেদের সারির ভিতরে একটা শূন্যস্থানের সৃষ্টি করে তাদের মোকাবেলা করতে এবং ঘিরে ফেলে, তাঁদের অগ্রসর হবার গতি এর ফলে শ্লথ হয় কি হয় না। জাহাঙ্গীরের লোকেরা এক মিনিটেরও কম সময়ের ভিতরে ঘোড়ার গলার কাছে মাথা নিচু করে রেখে আবারও বল্পিত বেগে ছুটতে শুরু করে বিদ্রোহীদের বেশ কয়েকজনের মৃতদেহ আর ঘোড়া এলোমেলোভাবে তাঁদের পেছনে পড়ে থাকে। খুসরুর অনুগত যোদ্ধারা তাদের শত্রুদের কমপক্ষে দু’জনকে নিজেদের সাথে মৃত্যুর ছায়ায় টেনে নিয়েছে, কিন্তু তাঁদের সাহসিকতা খসরুকে বাঁচাতে পারবে না। আবদুর রহমানের বাহিনী পালাতে থাকা দলটার এখন প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে এবং আরো দু’জন পশ্চাদ্ক্ষীর, একজনের ঘোড়ার সাথে সংযুক্ত দণ্ডে খসরুর বেগুনী নিশান উড়ছে, ভবলীলার সমাপ্তি ঘটে, সম্ভবত অশ্বারোহী তীরন্দাজদের নৈপূণ্যের শিকার। নিশান-বাহকের পা তার ঘোড়ার রেকাবে আটকে যায় এবং সে লাল ধুলার উপর দিয়ে প্রায় একশ গজ হেঁচড়ে যাবার সময় বেগুনী নিশানটা তার পেছনে উড়তে থাকে। রেকাবের চামড়ার বাঁধন এরপরে ছিঁড়ে যেতে হতভাগ্য লোকটা আর তার বহন করা নিশানা দোমড়ানো মোচড়ানো অবস্থায় নিথর হয়ে পড়ে থাকে।
জাহাঙ্গীর তার খয়েরী রঙের ঘোড়াটাকে যখন তাড়া দেয়, যা পশ্চাদ্ধাবনের প্রয়াসের কারণে আরো জোরে জোরে শ্বাস নেয়, সরু পাজর হাপরের মত উঠানামা করে, সে দেখে খসরুর লোকেরা আবারও একপাশে সরে যায় কিন্তু তারপরেই করকটে বৃক্ষাদির একটা ঝাড়ের কাছে থমকে দাঁড়িয়ে যায়। সে প্রথমে ভাবে প্রতিপক্ষ বোধহয় সেখানে অবস্থান নিয়ে লড়াই করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কিন্তু তারপরে তাঁদের চারপাশে বিক্ষুব্ধ তরঙ্গের ন্যায় আন্দোলিত হতে থাকা ধুলোর মাঝে সে মাটিতে পরে থাকা পরিত্যক্ত অস্ত্রশস্ত্রের ঝিলিক দেখতে পায়। আজিজ কোকার নিষ্পাপ কিশোর ভাই আর আবদুর রহমানের অগ্রবর্তী বাহিনীকে যারা আক্রমণ করেছিল সেইসব সাহসী লোকদেরমত, আরো অনেককে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে তারা এখন নিজেদের মূল্যহীন জীবন বাঁচাতে আত্মসমর্পণ করতে চাইছে। জাহাঙ্গীর চোখে মুখে একটা ভয়াবহ অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলে নিজের খয়েরী ঘোড়াটা থেকে এর প্রাণশক্তির শেষ নির্যাসটুকু নিংড়ে নিতে পায়ের গোড়ালী দিয়ে নির্মমভাবে পরিশ্রান্ত জন্তুটার পাঁজরে গুতো দিয়ে ভাবে অপদার্থগুলো যুদ্ধক্ষেত্রে সত্যিকারের পুরুষের মত মৃত্যুবরণ না করার সিদ্ধান্তের জন্য ভীষণ আফসোস করবে।
*
‘আমার সামনে তাঁদের হাজির করো।’
জাহাঙ্গীরের দেহে লড়াইয়ের স্বেদবারি তখনও উষ্ণতা হারায়নি এবং হৃৎপিণ্ড ক্রোধে উদ্বেল, সে বৃক্ষাদির ঝাড়ের নিচের ছায়া থেকে দেখে যে তাঁর সৈন্যরা খসরু, তাঁর প্রধান সেনাপতি, আজিজ কোকা এবং তাঁর অশ্বপালের আধিকারিক, হাসান জামালকে টেনে হেঁচড়ে সামনের দিকে নিয়ে আসে এবং তাঁর সামনে ধাক্কা দিয়ে তাঁদের হাঁটু মুড়ে বসিয়ে দেয়। সম্রাটের দিকে বাকি দু’জন যদিও চোখ তুলে তাকাবার সাহস দেখায় না, খসরু তার আব্বাজানের দিকে সানুনয়ে তাকিয়ে থাকে। তাদের পেছনে, খসরুর ত্রিশজনের মত লোক যারা তাঁর সাথে আত্মসমর্পণ করেছিল, তাঁদের পরনের কাপড় থেকে ছিঁড়ে নেয়া টুকরো কিংবা পর্যাণে ব্যবহৃত কম্বলের ফালি দিয়ে ইতিমধ্যে তাদের হাত পিছমোড়া করে বাঁধা হয়েছে। জাহাঙ্গীরের সৈন্যরা নির্মমভাবে ধাক্কা দিয়ে তাঁদের মাটিতে বসিয়ে দেয়। জাহাঙ্গীর বন্দিদের ভেতর সহসা দীর্ঘকায়, পেশল দেহের অধিকারী একজন লোককে চিনতে পারে, লোকটার দাড়ি মেহেদী দিয়ে লাল রঙ করা। তার মনে পড়ে যুদ্ধক্ষেত্রে লোকটাকে নিমেষের জন্য দেখেছিল, মুখে নির্মম হাসি ফুটিয়ে, নিজের ঘোড়া থেকে মাটিতে পড়ে যাওয়া অল্প বয়সী এক তরুণ যোদ্ধার উদর বর্শা দিয়ে এফোঁড়ওফোঁড় করে দেয়ার আগে, যে তাঁর সামনে আতঙ্কিত আর অসহায় অবস্থায় পড়ে ছিল, হাতের বর্শা দিয়ে বিদ্রুপাত্মক ভঙ্গিতে খোঁচা দিচ্ছে।
চরাচরগ্রাসী এমন একটা ক্রোধ জাহাঙ্গীরকে আপুত করে যে সে কিছুক্ষণের জন্য ঠিকমত কিছুই চিন্তা করতে পারে না। সে যখন নিজের উপর পুনরায় নিয়ন্ত্রণ ফিরে পায় তখন তার মাথা জুড়ে কেবল একটাই বিষয় কীভাবে এমন নিশ্চেতন বিদ্রোহীকে যথাযুক্ত নির্মমতার সাথে শাস্তি দেবে। তারপরে সে যথাযথ শাস্তি খুঁজে পায়। মোগলরা পুরুষানুক্রমে জঘন্যতম অপরাধীদের শিশু হত্যাকারী, ধর্ষণের মত অন্যান্য অপরাধকারী–শূলে দিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে। প্রথম মোগল সম্রাট, বাবর, তাঁর প্রপিতামহ, বিদ্রোহী আর দস্যুদেরও এই শাস্তি দিতেন–এই লোকগুলোরও ঠিক একই রকম শাস্তি প্রাপ্য। আত্মসমর্পণের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তারা তাদের বিদ্রোহ চালিয়ে গিয়েছে, তাঁদের বর্শার ফলায় সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ সেইসব অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেদের বিদ্ধ করেছে। তাদের এবার বুঝতে দেয়া হোক শূলবিদ্ধ হবার অনুভূতি। একই আতঙ্ক আর যন্ত্রণা তাঁরাও সহ্য করুক। একমাত্র এভাবেই ন্যায়বিচার সম্ভব। সে বিষয়টা নিয়ে আর চিন্তাভাবনা না করে ক্রোধে কর্কশ হয়ে থাকা কণ্ঠে তার সৈন্যদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলে, এই গাছগুলো থেকে তোমাদের রণকুঠার আর তরবারি ব্যবহার করে শক্ত কাষ্ঠ দণ্ড প্রস্তুত কর। দণ্ডগুলো মাটিতে ভালোমত পুঁতে দাও। তোমাদের পক্ষে যতটা সম্ভব সেগুলোকে সূচালো করো কিংবা দণ্ডগুলোর অগ্রভাগে বর্শার ফলা সংযুক্ত করে নরকের কীট এই বিদ্রোহীদের সেইসব দণ্ডে বিদ্ধ কর। কাজটা করতে হবে এবং এখনই সেটা করতে হবে। আমার পুত্র আর তাদের, তার দুই প্রধান সহযোগীকে কেবল রেখে যাও। নিজেদের নিয়তি সম্পর্কে তারা অবহিত হবার পূর্বে নিজেদের লোকদের যন্ত্রণা তাদের দেখতে দেয়া হোক। তারা অন্যদের কেমন দুর্ভোগের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে সে বিষয়ে তারা সামান্য হলেও অনুধাবন করবে ভবিষ্যতের গর্ভে তাঁদের জন্য কি অপেক্ষা করছে তার পূর্বাভাষ।’
তার সৈন্যরা আদেশ পালনে দ্রুত ব্যস্ত হয়ে উঠে, রণকুঠার দিয়ে কেউ গাছ কাটতে আরম্ভ করে, অন্যরা তাৎক্ষণিকভাবে হাতের কাছে যা কিছু খুঁজে পায় এমনকি কেউ শিয়োস্ত্রাণ দিয়েই শূলের জন্য গর্ত তৈরি করতে মাটি খুড়তে আরম্ভ করলে বাকিরা তখন বন্দিদের শক্ত করে ধরে মাঠের উপর দিয়ে তাঁদের সবলে টেনে নিয়ে যায়, জাহাঙ্গীর তার বাহুর উপরে সুলেইমান বেগের হাত অনুভব করে। জাহাঙ্গীরের দুধ-ভাই কোনো কিছু বলার আগেই সে বলে, না, সুলেইমান বেগ, এটা কার্যকর করতেই হবে। তারা নিজেরাই শাস্তিটা বয়ে এনেছে। তাঁরা কোসো ধরনেরই করুণা প্রদর্শন করে নি। আমিও করবো না। আমি অবশ্যই একটা দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করবো।’
জাহাঙ্গীর তাকিয়ে দেখে খসরু, তখনও হাঁটু ভেঙে বসে রয়েছে, কাপুরুষোচিত আতঙ্কের একটা অভিব্যক্তি নিয়ে তাকিয়ে রয়েছে। নিজের সন্তানের বিশ্বাসঘাতকতা, এত বিপুল সংখ্যক সৎ লোকের অনর্থক আত্মত্যাগের কথা চিন্তা করে, সে বহু কষ্টে খালি হাতে তার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়া থেকে নিজেকে সংযত রাখে। পাঁচ মিনিটের মত কেবল প্রায় অতিক্রান্ত হয়েছে তারপরেই জাহাঙ্গীরের চারজন তোক উন্মত্তের মত ধ্বস্তাধ্বস্তি আর লাথি ছুঁড়তে থাকা বন্দিদের প্রথমজনকে–গাট্টাগোট্টা, রোমশ দেহের এক লোক যার পরনের কাপড়ের অধিকাংশই তাঁরা ছিঁড়ে ফেলেছে–শূন্যে অনেক উঁচুতে তুলে ধরে। তারা তারপরে তাদের পুরো শক্তি প্রয়োগ করে বর্শা আর কাঠের দণ্ডের সাহায্যে তড়িঘড়ি করে নির্মিত শূলগুলোর একটার উপরে তার দেহটা নিয়ে আসে। লোকটার মলদ্বারের কাছের নরম মাংসে যখন শক্ত তীক্ষ্ণ অংশটা প্রবিষ্ট হয়, তাঁর চিৎকারে–মানুষের চেয়ে পশুর সাথেই বেশি মিল–চারপাশের বাতাস বিদীর্ণ হয়। জাহাঙ্গীরের লোকেরা যখন হতভাগ্য বন্দির পা ধরে নিচের দিকে টানতে শুরু করে, সবেগে নির্গত রক্তে নিচের মাটি লাল করে, দণ্ডটা লোকটার কণ্ঠার হাড়ের কাছ দিয়ে দেহের বাইরে বের হয়ে আসে। তারপরে আরো বেশি সংখ্যক বিদ্রোহীদের যখন শূলবিদ্ধ করা হলে নাড়িভূঁড়ির বিদারণের এবং আতঙ্কিত মানুষজনের বিষ্ঠার, যারা মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজেদের নাড়িভূঁড়ির উপরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে, দুর্গন্ধ বাড়তে আরম্ভ করে। কিন্তু জাহাঙ্গীর, সে তখনও আপন ক্রোধে অধীর হয়ে রয়েছে এবং নিষ্ঠুর ন্যায়পরায়ণতা বিষয়ে একচিত্ত, এসব কিছুই লক্ষ্য করে না।
খসরুর এবার বিভীষিকা খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করার পালা যার জন্য তাঁর মাত্রাছাড়া উচ্চাকাঙ্খ দায়ী। জাহাঙ্গীর সামনের দিকে হেঁটে আসে এবং নিজের হাঁটু গেড়ে বসে থাকা সন্তানকে কাঁধ ধরে টেনে তুলে নিজের পায়ের উপরে তাকে জোর করে দাঁড় করিয়ে দেয়। দেখো, তোমার কারণে সবার কি দুর্গতি। কেবল তোমার কারণেই এই লোকগুলো কষ্ট পাচ্ছে। দণ্ডগুলোর মাঝ দিয়ে হেঁটে যাও… হাঁটতে শুরু কর,’ খসরুর মুখের একেবারে সামনে নিজের মুখ নিয়ে এসে, সে চিৎকার করে। তারপরে, নিজের সন্তানকে ছেড়ে দিয়ে, শূলের অভিমুখে সে তাকে একটা ধাক্কা দেয়। কিন্তু খসরু, তাঁর বাহুদ্বয় শক্ত করে আঁকড়ে ধরে রাখে এবং দুচোখ প্রাণপনে বন্ধ করে রাখা, ঘুরে দাঁড়াতে চেষ্টা করে। জাহাঙ্গীর সাথে সাথে নিজের দেহরক্ষীদের কয়েকজনকে চিৎকার করে ডাকে। সবগুলো শূলের পাশ দিয়ে তাকে হেঁটে যেতে এবং পুনরায় ফিরে আসতে বাধ্য কর। সময় নিয়ে ধীরে সুস্থে কাজটা করবে। সবগুলো মৃতদেহের দিকে তাঁর তাকাবার বিষয়ে নিশ্চিত হবে…’
দু’জন প্রহরী সাথে সাথে দু’পাশ থেকে খসরুর হাত শক্ত করে ধরে এবং শূলের দিকে তাকে নিয়ে যায়। খসরুর মাথা প্রতি পদক্ষেপের সাথে নিচের দিকে ঝুঁকে আসে কিন্তু প্রতিবারই কয়েক পা হাঁটার পরে তাঁর প্রহরীরা শূলের উপর যন্ত্রণায় মোচড়াতে আর পা ছুঁড়তে থাকা এবং এটা করার কারণে নিজেকে আরো বেশি করে শূলবিদ্ধ করতে থাকা, তাঁর মৃত্যু পথযাত্রী সমর্থকদের কোনো একজনের ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে যায়, এবং সৈন্যদের একজন খসরুর মাথা চুল ধরে পেছনের দিকে টেনে এনে, তাকে দেখতে বাধ্য করে। কিন্তু স্পষ্টতই বোঝা যায় খসরুর যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে। জাহাঙ্গীর তাঁর সন্তানকে প্রহরীদের বাহুর মাঝে ঝুলে পড়তে এবং তারপরে মাটিতে লুটিয়ে পড়তে দেখে। সে অনুমান করে খসরু জ্ঞান হারিয়েছে। যথেষ্ট হয়েছে। আমার ছেলেকে এখানে ফিরিয়ে নিয়ে এসো, সেই সঙ্গে আজিজ কোকা আর হাসান জামালকে।
জাহাঙ্গীর কিছুক্ষণ পরে, তাঁর সামনে পুনরায় নতজানু হয়ে থাকা তিনজনকে খুটিয়ে দেখে। খসরুকে চাঙ্গা করতে প্রহরীদের একজন পানির মশকে রক্ষিত উপাদান তার উপরে নিক্ষেপ করায় তার লম্বা কালো চুল ভেজা। সে মড়ার মতো ধুসর আর থরথর করে কাঁপছে এবং দেখে মনে হয় যে কোনো মুহূর্তে বমি করবে। চারপাশের শূল থেকে ভেসে আসা যন্ত্রণার তীক্ষ্ণ আর্তনাদ, যেখানে অবশিষ্ট বিদ্রোহীদের তখনও শূলবিদ্ধ করা অব্যাহত রয়েছে, ছাপিয়ে তাঁর কথা সবার কাছে পৌঁছে দিতে জাহাঙ্গীর নিজের কণ্ঠস্বর একটু উঁচু করে বলে, তোমরা সবাই একজন প্রজা তাঁর জমিদারের বিরুদ্ধে সবচেয়ে জঘন্য অপরাধের দোষে দোষী–সশস্ত্র বিদ্রোহ। তুমি
‘আমি কেবল একজন প্রজা না… আমি আপনার পুত্র…’ খসরু মিনতি জানায়, তাঁর একদা সুদর্শন তারুণ্যদীপ্ত মুখাবয়বে বিভীষিকার একটা অবিমিশ্র মুখোশ।
‘খামোশ! সন্তানের অধিকার দাবি করার পূর্বে নিজেকে প্রশ্ন করো তুমি কি সন্তানের যোগ্য আচরণ করেছে। তুমি কোনোভাবেই নরকের ঐ কীটগুলোর চেয়ে সহনশীল আচরণের উপযুক্ত নও যাদের নিদারুণ যন্ত্রণার জন্য আমি নই, বা তোমার পাশে যে দু’জন দাঁড়িয়ে রয়েছে তারা দায়ী, কেবল তুমি দায়ী। আজিজ কোকা, হাসান জামাল, আপনারা একসময়ে আমার প্রতি আনুগত্যের শপথ নিয়েছিলেন কিন্তু আপনাদের সেই অঙ্গীকার আপনারা ভঙ্গ করেছেন। তার দিকে অসহায়ভাবে তারা তাকিয়ে থাকে, সে কথা বলা বজায় রাখলে তাদের চোখে ভয় খেলা করতে থাকে, কোনো ধরনের করুণার প্রত্যাশা করবেন না, কারণ আমার কাছে প্রদর্শনের মত কোনো অজুহাত নেই। বিশ্বাসঘাতক আর অনবধান উচ্চাকাঙ্খী মানুষের পাশাপাশি পশুর অন্ধ মূঢ়তা আপনাদের ভিতরে কাজ করেছে। আপনাদের কুৎসিত পশু প্রবৃত্তি প্রতীকায়িত করতে আপনাদের লাহোর নিয়ে গিয়ে সেখানে বাজারে আপনাদের উলঙ্গ করা হবে এবং একটা ষাড় বা গাধার সদ্য ছাড়ানো চামড়ার ভিতরে ঢুকিয়ে সেলাই করা হবে। তারপরে গাধার পিঠে উল্টো করে বসিয়ে দিনের খরতাপে তোমাদের শহরের প্রধান সড়ক দিয়ে প্রদক্ষিণ করানো হবে আমার অনুগত প্রজারা যেন তোমাদের অপমানের সাক্ষী হতে পারে এবং অনুধাবন করতে পারে আমাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে তোমাদের অভিপ্রায় কতটা হাস্যকর ছিল।
জাহাঙ্গীর দু’জনকে আঁতকে উঠতে শুনে। তাদের শাস্তি দেয়ার ধারণাটা সে কথা শুরু করার ঠিক আগ মুহূর্তে আকস্মিক প্রেরণার একটা ঝলকের মত তার কাছে প্রতিভাত হয়েছে। সে জানে তার দাদাজান হুমায়ুন অপরাধের উপযুক্ত শাস্তিবিধান করতে অভিনব এবং কখনও উদ্ভট উপায় খুঁজে বের করতে পারার জন্য নিজেকে নিয়ে গর্ব বোধ করতেন। সেও এখন সেটা পারে। সে অবশ্য অপকর্মের সহযোগীদের নিয়ে আর কোনো সময় নষ্ট করতে আগ্রহী নয় আর তাই ঘুরে খুসরুর দিকে তাকায় যে দু’হাত অনুনয়ের ভঙ্গিতে জোড়া করে, বিপদে মিহমান লোকের মত ফুঁপিয়ে কাঁদছে এবং বিড়বিড় করে কিছু বলছে জাহাঙ্গীর ঠিক বুঝতে পারে না কিন্তু যা শুনে দুর্বোধ্য মনে হয়। সে নিজেকে সংযত করে উঠে দাঁড়িয়ে, তার সন্তানকে তাঁর অনিবার্য বিপর্যয়ের মাঝে প্রেরণ করবে যে শব্দগুলো সেগুলো উচ্চারণ করতে নিজেকে প্রস্তুত করে।
‘খসরু, তুমি বৈরী বিশ্বাসঘাতকদের নিয়ে একটা বাহিনী গঠন করেছিলে যাদের একমাত্র উদ্দেশ্য আমাকে–তোমার আব্বাজান এবং ন্যায়সঙ্গত মোগল সম্রাট ক্ষমতাচ্যুত করা এবং তোমার জন্য আমার সিংহাসন জবরদখল করা। রক্তপাত ঘটাবার জন্য তুমিই দায়ী এবং ন্যায়পরায়ণতার স্বার্থে তোমাকে রক্তেই এর মূল্য পরিশোধ করতে হবে। তার কণ্ঠস্বরের রুক্ষতার অকৃত্রিমতা নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই এবং তাঁর উচ্চারিত প্রতিটা শব্দ তাঁর সংকল্প ব্যক্ত করে। খসরু নিজেও সেটা ভালো করেই জানে এবং ভয়ে সে নিজের মূত্রথলির উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। জাহাঙ্গীর তাকিয়ে দেখে খসরুর পরনের সুতির পাজামায় একটা গাঢ় দাগ ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে এবং টপটপ করে পড়তে থাকা প্রস্রাব মাটিতে জমে হলুদ একটা ডোবার সৃষ্টি করে।
খসরু যে মানসিক অবস্থায় নিজেকে নিয়ে এসেছে সেজন্য করুণার একটা স্রোতধারা তাকে জারিত করে। যদিও কিছুক্ষণ আগেও খসরুর শিরোচ্ছেদের আদেশ দেয়ার পুরো অভিপ্রায় তার মাঝে বিরাজ করছিল, সহসাই সে আর তার মৃত্যু কামনা করে না। ইতিমধ্যে যথেষ্ট রক্তপাত আর দুর্ভোগ সহ্য করতে হয়েছে… কিন্তু আমি তোমার জান বখশ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, সে নিজেকে বলতে শুনে। তুমি আমার সন্তান এবং আমি তোমাকে হত্যা করবো না। তোমাকে এর পরিবর্তে কারাগারে বন্দি করে রাখা হবে যেখানে অনাগত মাস বছরের গণনায় তুমি সীমালঙ্নের ব্যাপারে চিন্তা ভাবনার প্রচুর সময় পাবে যা তোমাকে তোমার স্বাধীনতা আর সম্মান খোয়াতে বাধ্য করেছে।’
খসরু, আজিজ কোকা আর হাসান জামালকে সরিয়ে নিয়ে যাবার পরে জাহাঙ্গীর তার দুধ-ভাইয়ের দিকে ঘুরে তাকায়, যে তখনও পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। সুলেইমান বেগ, শূলবিদ্ধ বন্দিদের যারা এখনও বেঁচে রয়েছে, আমার সৈন্যদের আদেশ দাও তাঁদের কণ্ঠনালী কেটে দিতে। তাঁরা যথেষ্ট যন্ত্রণা সহ্য করেছে। তাদের মৃতদেহগুলোকে একটা সাধারণ কবরে দাফন করে, শূলগুলো তুলে ফেলে তার উপরে তাজা মাটি ছড়িয়ে দাও। যুদ্ধে যারা আহত হয়েছে–শত্রু কিংবা মিত্র নির্বিশেষে আমাদের হেকিমদের তাঁদের চিকিৎসা করতে বলো। আজ কি পরিমাণ রক্তপাত হয়েছে তাঁর কথা আমি ভুলে যেতে চাই।’
*
এক সপ্তাহ পরে, বারগাত দূর্গে অবস্থানের সময় যে স্থানটা, সে তার বাহিনীকে যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে পুনর্গঠিত হবার সময় দিতে, অস্থায়ী সদরদপ্তর করেছে, জাহাঙ্গীর লাহোরের শাসনকর্তার কাছ থেকে সদ্য প্রাপ্ত দীর্ঘ চিঠিটা মনোযোগ দিয়ে পাঠ করে যেখানে আজিজ কোকা আর হাসান জামালের ভাগ্যে কি ঘটেছে সেটার বিবরণ রয়েছে। জাহাঙ্গীর চিঠিটা পড়ার সময়ে, পুরো দৃশ্যপটটা মানসচক্ষে দেখতে পায়–নিজেদের আভিজাত্য ভুলে ধ্বস্তাধ্বস্তি করতে থাকা দু’জন লোক, যাদের কাছ থেকে তাদের সমস্ত মর্যাদা কেড়ে নেয়া হয়েছে, সদ্য ছাল ছাড়ান তীব্র দুর্গন্ধযুক্ত রক্তাক্ত পশুচামড়ার ভিতরে তাঁদের ঢুকিয়ে সেলাই করে দেয়া হয়েছে। প্রদেশের শাসককর্তা জানিয়েছেন, পশুর মাথাটা তখনও চামড়ার সাথে যুক্ত ছিল এবং তাঁদের শহরের ভিতর দিয়ে প্রদক্ষিণ করাবার সময় উপস্থিত লোকজন যখন বিদ্রূপ করে আর পঁচা তরকারি আর পাথর তাঁদের দিকে ছুঁড়ে মারে তখন চামড়ার ভিতরে বন্দিদের প্রতিটা ব্যর্থ বেপরোয়া প্রয়াসের সাথে সাথে পশুর মাথাগুলো উদ্ভট ভঙ্গিতে আঁকি খায়। আজিজ কোকা, গাধার চামড়া দিয়ে তাকে মুড়ে দেয়া হয়েছিল, প্রচণ্ড গরমে চামড়াটা শুকিয়ে সংকুচিত হলে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যান। মোষের চামড়ার ভিতর থেকে হাসান জামালকে টেনে বের করার সময় তিনি বেঁচে থাকলেও প্রায় সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছিলেন। তিনি এখন লাহোরের ভূগর্ভস্থ কারাপ্রকোষ্ঠে রয়েছেন। শাসনকর্তা, তার চিঠির একেবারে শেষে, জানতে চেয়েছে জাহাঙ্গীর কি হাসান জামিলকে প্রাণদণ্ড দিতে আগ্রহী।
জাহাঙ্গীর মন্থর পায়ে জানালার দিকে হেঁটে যায় এবং বালুকাময়, নিরানন্দ দৃশ্যপটের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার এখন পুরো ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তাভাবনা করার সময় আছে, নিজের আরোপিত শাস্তির নৃশংসতায় সে খানিকটা লজ্জিত বোধ করে যদিও তাঁরা এই শাস্তির উপযুক্ত এবং অন্যান্য বিদ্রোহীদের বিদ্রোহ প্রয়াস থেকে বিরত রাখবে। সে যখন ক্রোধে উন্মত্ত তখন ক্ষণিকের উত্তেজনায় কাজটা হয়েছে। তার আবেগ এখন অনেক প্রশমিত তার কেবলই মনে হতে থাকে সে যদি ভিন্নভাবে ব্যাপারটা নিষ্পত্তি করতে পারতো। একজন দুর্বল শাসকই কেবল করুণা প্রদর্শনের ব্যাপারে ভীত হতে পারেন… সে হাসান জামালের মৃত্যু কামনা করেছিল। লোকটা যে প্রাণে বেঁচে গিয়েছে সেটা কেবল অলৌকিক কোনো কারণে সম্ভব হয়েছে কিন্তু এটা তাকে ক্ষমাশীলতা প্রদর্শনের একটা সুযোগ দিয়েছে যা খসরুর বিদ্রোহের কারণে তাঁর অমাত্যদের ভেতরে সৃষ্ট বিরোধ প্রশমিত করার কাজ শুরু করবে। সে তখনই একজন খুশনবিশকে ডেকে পাঠায় এবং লাহোরের শাসনকর্তার কাছে নিজের জবাব শব্দ করে পাঠ করতে থাকে। হাসান জামালকে যথেষ্ঠ শাস্তি দেয়া হয়েছে। তাকে বাঁচিয়ে রাখা হবে।’
জাহাঙ্গীর আবার কক্ষে একা হওয়া মাত্র সে গভীরভাবে চিন্তা করে, নিজের সন্তানকে সে কঠোর শিক্ষা দিয়েছে, কিন্তু খসরু কি বিষয়টা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবে? সে গোঁয়ার, স্বেচ্ছাচারী, আত্মদর্পী এবং সবচেয়ে বড় কথা উচ্চাভিলাষী। তার নিজেরই খুব ভালো করে জানা আছে যে উচ্চাকাঙ্খ সহজে গোপন করা যায় না। তার আব্বাজান আকবর তাকে হয়ত তাঁর আরাধ্য সিংহাসন থেকে বঞ্চিত করবেন এই ভয়ের কারণে নিজের জীবনের প্রায় বিশটা বছর কি সে যন্ত্রণায় দগ্ধ হয় নি? সে নিজে কি বিদ্রোহ করে নি? সে ঠিক যেমনটা করেছিল, খসরুকে জানার জন্য অপেক্ষা করতে হবে যে সে কি তাকে, তার জ্যেষ্ঠ সন্তানকে, বিদ্রোহী হওয়া সত্ত্বেও তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনীত করবে। এবং এমন সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য প্রচুর সময় পাওয়া যাবে। আল্লাহতা’লা সহায় থাকলে, সে এখনও আরও বহু বছর বেঁচে থাকবে।
কিন্তু তাঁর অন্য সন্তানদের কি মনোভাব? তাঁর আব্বাজানের সাথে তার বিরোধ দীর্ঘ সময়ের জন্য তাঁদের কাছ থেকে তাকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। আকবরের দরবারে তার প্রত্যাবর্তনের পরে একজন পিতা আর তার সন্তানদের ভিতরে সম্পর্ক যতটা ঘনিষ্ঠ হওয়া উচিত সেভাবে সম্পর্ক পুনর্গঠন করাটা তাঁর কাছে বেশ কঠিন বলে মনে হয়। বহু বছর পূর্বে মরমী সুফি সাধক শেখ সেলিম চিশৃতির, যিনি তাঁর নিজের জন্ম সম্পর্কে পূর্বেই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, জাহাঙ্গীরকে বলা কথাগুলো তাঁর মানসপটে ঝলসে যেতে সে ভ্রু কুঁচকে ফেলে। নিজের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে অনিশ্চিত এক যুবরাজ হিসাবে সে বৃদ্ধ লোকটার কাছে পরামর্শের জন্য গিয়েছিল। তোমার চারপাশে যারা রয়েছে তাদের লক্ষ্য করো। তুমি কারো উপরে নির্ভর করার ব্যাপারে খুব সতর্ক থাকবে এবং বিশ্বাসের উপর কোনোকিছু ছেড়ে দিবে না, রক্তের বন্ধনে তুমি যাদের সাথে সম্পর্কিত এমনকি তাঁদের কাছ থেকেও… এমনকি তোমার যারা সন্তান হবে,’ বিজ্ঞ সুফি সাধক বলেছিলেন। ‘উচ্চাকাঙ্খর সবসময়ে দুটো দিক রয়েছে। এটা মানুষকে মহত্বের দিকে ধাবিত করে কিন্তু তাদের আত্মাকে বিষাক্তও করতে পারে…’ তার এই সতর্কবাণীর প্রতি মনোযোগ দেয়া উচিত। সর্বোপরি, সুফি সাধক যা কিছু সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন সে সবের অধিকাংশই ইতিমধ্যে ঘটেছে। সে বাস্তবিকই সম্রাট হয়েছে এবং তাঁর সন্তানদের একজনকে উচ্চাকাঙ্খ আদতেই কলুষিত করেছে।
খসরুর প্রতি তাঁর ক্রোধের তীব্রতা সম্ভবত এ কারণেই এত বেশি তীব্র। তাঁর মনে আছে কীভাবে খসরুর সাথে যুদ্ধের মাত্র দু’দিন আগে, তাঁর সৈন্যরা একটা ছোট মাটির দেয়াল ঘেরা গ্রাম দখল করেছিল। সেই গ্রামের পলিত কেশ সর্দার জাহাঙ্গীরের সামনে প্রণত হবার পরে, তার পরনের খয়েরী রঙের অধধায়া আলখাল্লার একটা পকেট থেকে তিনটা তামার পয়সা বের করে দাবি করে সেগুলো তাকে খসরুর গুপ্তদুতের একটা বাহিনী দিয়েছে। সে নিজের আনুগত্যের স্মারক হিসাবে দৃশ্যত কম্পিত আঙুলে জিনিষগুলো ধরে জাহাঙ্গীরের হাতে তুলে দেয়। জাহাঙ্গীর মুদ্রাগুলো খুটিয়ে দেখতে খেয়াল করে যে আপাত ব্যস্ততায় তৈরি করা প্রতিটি মুদ্রায় খসরুর প্রতিকৃতি খোদাই করা রয়েছে এবং খসরুকে হিন্দুস্তানের সম্রাট ঘোষণা করে প্রতিকৃতির চারপাশে বৃত্তাকারে বাণী মুদ্রিত রয়েছে। জাহাঙ্গীর ক্রোধে এতটাই উন্মত্ত হয়ে উঠে যে মুদ্রাগুলো কাছে রাখা ধৃষ্টতা দেখাবার কারণে সর্দারকে চাবুক মারার আদেশ দেয়, কামারশালায় তখনই মুদ্রাগুলোর আকৃতিনাশ করতে আদেশ দেয় এবং একটা ফরমান জারি করতে বলে যে ভবিষ্যতে কারো কাছে এমন মুদ্রা পাওয়া গেলে সেগুলো রাখার দায়ে শাস্তি হিসাবে তার ডান হাতের আঙুলগুলো কেটে নেয়া হবে। সুলেইমান বেগ সদারকে ক্ষমা করার জন্য জাহাঙ্গীরকে রাজি করাবার আগেই সর্দারের হাড্ডিসার দেহ কোমর পর্যন্ত নগ্ন করে গ্রামের চৌহদ্দির ভিতরে অবস্থিত একমাত্র গাছের সাথে বাধা হয় আর জাহাঙ্গীরের সবচেয়ে শক্তিধর দেহরক্ষী হাতে সাত বেণীর চাবুক নিয়ে বাতাসে শিস তুলে কশাঘাতের মহড়া দিতে থাকে। সে খুবই ভাগ্যবান সুলেইমান বেগকে সে তার যৌবনের সময় থেকে পাশে পেয়েছে–একজন বিশ্বস্ত বন্ধু যে তার মেজাজ মর্জি সহজপ্রবৃত্তিতে আঁচ করতে পারে এবং এখন বিজ্ঞ পরামর্শদাতা হিসাবে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ রাখছেন।
কিন্তু পারভেজ আর খুররম–খসরুর চেয়ে খুব বেশি ছোট না খোল আর চৌদ্দ বছর বয়স–তাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে তাঁদের সৎ-ভাইয়ের প্রচেষ্টা এবং সেজন্য তাঁর প্রদত্ত শাস্তি সম্বন্ধে তারা কি চিন্তা করছে? পারভেজের জননী মোগলদের এক প্রাচীন গোত্রের মেয়ে হলেও খসরুর মত, খুররমের জননী রাজপুত রাজকন্যা এবং খুররম বড় হয়েছে আকবরের কাছে যিনি প্রকাশ্যে তাকে বিশেষ প্রশ্রয় দিতেন। দুই যুবরাজ বিশেষ করে খুররম, মনে করতেই পারে সিংহাসনে তাঁদের দাবি খসরুর মতই জোরালো। অন্ত ত তার সবচেয়ে ছোট ছেলে শাহরিয়ারের উচ্চাকাঙ্খ সম্বন্ধে তাঁর এখনই উদ্বিগ্ন হবার প্রয়োজন নেই এটাই যা স্বস্তির বিষয়, সে এখনও শাহী হারেমে তার জননী, জাহাঙ্গীরের উপপত্নির সাথে বাস করছে।
তাকে যত শীঘ্রি সম্ভব আগ্রায় নিজের অল্পবয়সী সন্তানদের কাছে ফিরে যেতে হবে। খসরু আর তাঁর অনুসারীদের প্রতি আপোষহীন আচরণের দ্বারা সে প্রতিপাদন করেছে যে সম্রাট হিসাবে সে কোনো ধরনের মতদ্বৈধ সহ্য করবে না। কিন্তু সেইসাথে সে এখনও যে একজন স্নেহময় পিতা সে অবশ্যই তাঁদের সেটাও দেখাবে আর খসরুর বিশ্বাসঘাতকতার কারণেই কেবল সে এমন নির্মম আচরণ করতে বাধ্য হয়েছিল…
১.০২ অতর্কিত আততায়ী
‘তুমি নিশ্চিত কি করতে হবে তুমি বুঝতে পেরেছো?’ জাহাঙ্গীর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ইংরেজ লোকটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। বার্থোলোমিউ হকিন্সের সাথে এটা কেবল তাঁর দ্বিতীয় মোলাকাত কিন্তু এটাই তার মাঝে প্রত্যয় উৎপাদনের জন্য যথেষ্ট যে লোকটা আততায়ীর ভূমিকায় ভালোই উতরে যায়। হকিন্স ভাঙা ভাঙা ভুলভালো পার্সীতে কথা বলে যা সে ইস্ফাহানে পারস্যের শাহের বাহিনীতে ভাড়াটে সৈন্য হিসাবে কাজ করার সময় রপ্ত করেছিল কিন্তু নিজের সন্তুষ্টির স্বার্থে তাকে পরীক্ষা করার জন্য জাহাঙ্গীরের কাছে সেটাই যথেষ্ট।
‘আমি এখন তোমাকে বাংলায় যাবার এবং ফিরে আসবার খরচ হিসাবে পাঁচশ সোনার মোহর দেবো। শের আফগান যখন মারা যাবে তখন আমি তোমাকে আরও এক হাজার মোহর দেবো।’
বার্থোলোমিউ হকিন্স মাথা নাড়ে। তার চওড়া মুখে, সূর্যের খরতাপে লাল, সন্তুষ্টির অভিব্যক্তি। লোকটা যদিও প্রায় দশ ফিট দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে জাহাঙ্গীর তার গায়ের প্রায় পশুর মত তীব্র দুর্গন্ধ তারপরেও টের পায়। এই ফিরিঙ্গিগুলো গোসল করে না কেন? আগ্রায় তাঁর দরবারে ক্রমশ আরো বেশি সংখ্যায় তাদের আগমন ঘটছে। এই লোকটার মত ইংরেজ, ফরাসী, পর্তুগীজ, এবং স্পেনীশ এবং ধর্মপ্রচারক, ব্যবসায়ী বা ভাড়াটে সৈন্য সে যেই হোক, তাদের সবাই যেন দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। সম্ভবত এর কারণ তাঁদের পরনের পোষাক। হকিন্সের ঘর্মাক্ত, চওড়া, দেহ কালো চামড়া দিয়ে তৈরি একটা আঁটসাট জামা, হাঁটুর ঠিক উপরে গাঢ় লাল ফিতে দিয়ে বাঁধা পাতলুন এবং পিঙ্গল বর্ণের পশমের মোজা দিয়ে আবৃত। তাঁর পায়ে রয়েছে ঘোড়ায় চড়ার উপযোগী বহু ব্যবহারে ক্ষয় হয়ে যাওয়া একজোড়া গুলফ পর্যন্ত পরিহিত বুটজুতা।
‘আমি তাকে কীভাবে হত্যা করবো সেটা নিশ্চয়ই আপনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ না?
‘না। একটা ব্যাপারই এখানে প্রধান যে সে মারা গিয়েছে। তুমি যদি তাকে কেবল আহত করো তাহলে আমার কাছে সেটার কোনো মূল্য নেই।
‘আমি গৌড়ে পৌঁছাবার পরে সেখানে কীভাবে আপনার এই শের আফগানকে খুঁজে পাবো?
‘সে শহরের শাসনকর্তা এবং গৌড় দূর্গের সেনাছাউনির অধিপতি। চোখ কান খোলা রেখে অপেক্ষা করলেই তাঁর প্রাত্যহিক জীবনযাপন কালে তুমি তাকে দেখতে পাবে। আর কোনো প্রশ্ন আছে?”
হকিন্স এক মুহূর্ত ইতস্তত করে। আপনি কি আমাকে একটা সনদপত্র দেবেন–সেটা আমার সীলমোহরযুক্ত একটা চিঠি হতে পারে–যেখানে বিবৃত থাকবে যে আমি আপনার অধীনে কর্মরত।
না। শের আফগানের মৃত্যুর সাথে আমাকে যেন কোনোভাবেই জড়িত করা না হয়। আমি তোমাকে তোমার উদ্ভাবনকুশলতার জন্য টাকা দিচ্ছি। তুমি আমাকে বলেছে যে শাহের পক্ষে তুমি এমন অনেক স্পর্শকাতর অভিযান পরিচালনা করেছে।
ইংরেজ লোকটা নিজের স্থূলকায় কাঁধ ঝাঁকায়। আমার তাহলে আর কিছু জিজ্ঞেস করার নেই। আমি আগামীকাল যাত্রা শুরু করবো।’
জাহাঙ্গীর যখন কামরায় একা হয় তখন সে ধীর পায়ে তাঁর ব্যক্তিগত কক্ষের ঝুল বারান্দার দিকে এগিয়ে যায় যেখান থেকে যমুনা নদী দেখা যায়। বার্থোলোমিউ হকিন্স কি সফল হবে? তাকে দেখে যথেষ্ট কঠোর বলেই মনে হয় এবং দরবারের বেশিরভাগ ইউরোপীয়দের মত না, সে ভাঙা ভাঙা ফার্সী বলতে পারে। কিন্তু তার তাকে পছন্দ করার অন্যতম। প্রধান কারণ একটাই-লোকটা একজন ভিনদেশী। সে যদি নিজের লোকদের কাউকে পাঠাতো তাঁরা তাহলে হয়তো বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করতো, যদিও সেটা কেবল বন্ধু বা কোনো আত্মীয় এবং সে কি পরিকল্পনা করছে সেটার খবর হয়তো শের আফগানের কাছে পৌঁছে যায় এবং তাকে পলায়ন করার জন্য যথেষ্ট সময় দেয়। বার্থোলোমিউ হকিন্সের সাথে এমন ভুল হবার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ এবং হিন্দুস্তানে কোনো গোত্র কিংবা কোনো পরিবারের সাথে তাঁর আত্মীয় সম্পর্কে সংবাদ নেই। হিন্দুস্তানে কোনো পরিবার বা গোত্রের আনুগত্য এবং কোনো মানুষ তাঁর কাছে কিছু পায় না। জাহাঙ্গীর কেন শের আফগানকে মৃত্যু কামনা করে সে বিষয়ে লোকটা কোনো কিছু প্রশ্নই করে নি। এমন আগ্রহহীনতা একটা চমকপ্রদ বিষয়…’
ইংরেজ ভাড়াটে সৈন্যের সাথে তাঁর সাক্ষাৎকারের বিষয়ে জাহাঙ্গীর কাউকে কিছু বলেনি। সুলেইমান বেগকে বিশ্বাস করে তাকে কথাটা সে হয়তো বলতে কিন্তু তাঁর দুধ-ভাই টাইফয়েড রোগে কিছুদিন আগেই মারা গিয়েছে। খসরুর কিছু অনুসারীর বিরুদ্ধে যারা আগ্রার দক্ষিণপূর্বের জঙ্গলে পালিয়ে গিয়েছিল সংক্ষিপ্ত একটা অভিযান শেষ করে তারা একত্রে ফিরে আসবার পরেই সে মারা যায়। সেঁতসেঁতে, গুমোট একটা তাবুতে মাত্র বারো ঘন্টা আগে অসুস্থতায় আক্রান্ত হয়ে শায়িত সুলেইমান বেগের জীবনের অন্তিম সময়গুলোর কথা স্মরণ করলে যখন বাইরে সীসার ন্যায় আকাশ থেকে বর্ষার অবিরাম ধারা এর ছাদে ঝরে পড়ছে এখনও জাহাঙ্গীরের গা শিউরে উঠে। সে আক্রান্ত হবার পরে এত দ্রুত জ্বরবিকারের শিকার হয় যে জাহাঙ্গীরকেও চিনতে পারে না। তার চিৎকারের দ্যোতনায় টানটান হয়ে থাকা ঠোঁট সাদা থুথুর গেঁজলায় ভরা আর পাতলা একটা চাদরে ঢাকা অবস্থায় দেহটা বিরামহীনভাবে মোচড়ায় আর কাঁপতে থাকে। সে তারপরে একদম নিথর হয়ে যায়, তাকে শেষ বিদায় জানাবার বা নিজের পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পুরোটা সময় বা সম্প্রতি খসরুর বিদ্রোহকালীন অন্ধকার দিনগুলোতে তাঁর বিজ্ঞ এবং আবেগহীন পরামর্শ জাহাঙ্গীরের কাছে কতটা গুরত্বপূর্ণ ছিল সেটা বলার কোনো সুযোগ সে পায় না।
সবকিছু যখন একদম ঠিকভাবে চলছে তখন সে সবার চেয়ে বেশি যাকে বিশ্বাস করতো তাঁর মৃত্যুটা সত্যিই বড় বেদনাদায়ক মনে হয়। সুলেইমান বেগের মৃত্যুর পরে গত দশ মাসে কোথাও আর কোনো বিদ্রোহের ঘটনা ঘটেনি–এমনকি অসন্তোষের সামান্যতম আভাসও কোথাও দেখা যায় নি। তাঁর সাম্রাজ্য এখন সুরক্ষিত। পারস্যের যুদ্ধমান শাসক শাহ্ আব্বাসের কাছ থেকে কেবল হুমকির আশঙ্কা রয়েছে–যদি আবদুল রহমানের গুপ্তদূতদের আনীত বিবরণী সঠিক হয়–যিনি মোগলদের কাছ থেকে কান্দাহার পুনরায় দখল করার পরিকল্পনা করেছেন। জাহাঙ্গীর সাথে সাথে বিশটা ব্রোঞ্জের কামান আর দুইশ রণহস্তীসহ একটা শক্তিশালী বাহিনী উত্তরপশ্চিম দিকে প্রেরণ করায় নিজের পরিকল্পনা নিয়ে পুনরায় চিন্তা করতে শাহকে বাধ্য করেছে। জাহাঙ্গীরের সৈন্যরা কান্দাহারের উঁচু মাটির দেয়ালের কাছাকাছি পৌঁছাবার পূর্বেই তাঁর টকটকে লাল টুপি পরিহিত বাহিনী পশ্চাদপসারণ করে।
সে এখনও তার দুধ-ভাইয়ের অভাব খুবই অনুভব করে। তাঁর স্ত্রী এবং অবশিষ্ট সন্তানরা থাকার পরেও, তাঁর ক্ষমতা আর বিত্তবৈভব সত্ত্বেও, সে নিঃসঙ্গ বোধ করে–কখনও নিজেকে বিচ্ছিন্ন মনে হয়–সুলেইমান বেগ জীবিত থাকার সময় সে কখনও এমন অনুভব করে নি। তার ছেলেবেলায় সে একদিকে চেষ্টা করেছে তার আব্বাজান আকবরের, এমন একজন মানুষ যিনি জানেন না ব্যর্থতা কাকে বলে, প্রত্যাশা অনুযায়ী নিজেকে প্রমাণ করতে অন্যদিকে তার রাজপুত জননীর যিনি আকবরকে ঘৃণা করতেন তার জনগণের বর্বর নিগ্রহকারী হিসাবে প্রতি বিশ্বস্ত থাকার চেষ্টা করতে গিয়ে তার ছেলেবেলাটা ছিল এক ধরনের অনিশ্চয়তায় ভরা। তাঁর দাদীজান হামিদা যদি সবসময়ে তখন তাঁর কথা না শুনতো এবং তাকে সাহস না দিতো তাহলে অনেক আগেই সে হয়তো হঠকারী কিছু একটা করে ফেলতো। সুলেইমান বেগই কেবল আরেকজন মানুষ যিনি তাঁর জীবনে এমন একটা স্থান অধিকার করেছিলেন–বিশ্বস্ত আর বিজ্ঞ একজন বন্ধু, সে যার পরামর্শ যতই অপ্রীতিকর হোক, পদোন্নতি আর পুরষ্কারের জন্য মরীয়া, তাঁর অমাত্যদের নিজেদের স্বার্থ সম্পর্কিত পরামর্শের চেয়ে বেশি বিশ্বাস করতো।
সে আগ্রা দূর্গের কাছে সুলেমান বেগের জন্য বেলেপাথরের গম্বুজযুক্ত সমাধিসৌধ নির্মাণের আদেশ দিয়েছে সেটার নির্মাণ কাজের অগ্রগতি সে গতকালই গিয়েছিল পরিদর্শন করতে। সে নির্মাণ শ্রমিকদের বাটালি দিয়ে পাথরের চাই কাটতে দেখে নতুন করে নিজের বন্ধু বিয়োগের ঘটনা তাকে আপুত করে এবং সে একাকী পুরো সন্ধ্যাবেলাটা নিজের ভাবনায় মশগুল হয়ে থাকে। সুলেইমান বেগের মৃত্যুর মত অন্য কোনো কিছু তাকে জীবনের নশ্বরতা সম্বন্ধে এভাবে সজাগ করতে পারতো না। কোনো মানুষের বয়স যতই অল্পই হোক, বা যতই সুস্বাস্থ্যের অধিকারী কিংবা যতই প্রাণবন্ত হোক জানে না যে তার জীবনের আর কতদিন বাকি আছে। মৃত্যু এসে তাকে শরণ দেয়ার পূর্বেই নিজের জীবন উপভোগ করা ছাড়াও–জীবনের যত বেশি বা অল্প দিনই বাকি রয়েছে–তাকে তাঁর পক্ষে সম্ভব এমন সবকিছু অর্জন করতে হবে এবং সেটা করার জন্য সে নিজেকে কেন তার ক্ষমতা ব্যবহার করতে দেবে না? তার ভাবনা চিন্তা শেষ পর্যন্ত তাকে প্ররোচিত করে বার্থোলোমিউ হকিন্সকে ডেকে পাঠাতে এবং আর কোনো কালক্ষেপণ না করে সে গোপন দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে তাঁর উপরে আস্থা আরোপ করে।
জাহাঙ্গীর আকাশের দিকে তাকায় যেখানে প্রতিদিনই বৃষ্টিতে ভারি আর গাঢ় হয়ে থাকা মেঘ বৃদ্ধি পাচ্ছে। কয়েক সপ্তাহের ভিতরেই পুনরায় বর্ষার বৃষ্টি শুরু হবে। সে আশা করে প্রথমে যমুনা বরাবর তারপরে গঙ্গাকে অনুসরণ করে বাংলা অভিমুখে হকিন্সের যাত্রা এই বৃষ্টির কারণে বিঘ্নিত হবে না। নদীগুলো যদিও শীঘ্রই দু’কুল ছাপিয়ে ফুলেফেঁপে উঠে নৌকাগুলোকে দ্রুত অগ্রসর হতে সাহায্য করলেও নদীর স্রোত তখন আরো বেশি বিপদসঙ্কুল হয়ে উঠবে। সময়টা এমন একটা অভিযানের জন্য মোটেই উপযুক্ত নয় কিন্তু সে অধৈর্য হয়ে পড়েছে। বার্থোলোমিউ হকিন্স যদি অর্পিত দায়িত্ব পালনে সফল হয়, সে তাহলে একটা জিনিষের–বা বলা ভালো একজন লোকের–অধিকার গ্রহণ করতে পারবে যা তার জীবনকে সম্পূর্ণ করবে, এমনকি যদিও অভীষ্ট অর্জনে তাঁর গৃহীত পদ্ধতি নিয়ে সতর্ক সুলেইমান বেগ হয়তো প্রশ্ন তুলতেন।
*
বার্থোলোমিউ হকিন্স তাঁর চোয়ালের উপরে এইমাত্র হুল ফোঁটান মশাটাকে একটা থাপ্পড় মারে। নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে সে দেখে যে সেখানে কালচে লাল রক্তের দাগ লেগে রয়েছে। বেশ, হতভাগাটার রক্তের সাধ সে, চিরতরে ঘুচিয়ে দিয়েছে যদিও ঝক ঝক রক্তচোষা কীটপতঙ্গের একটার বিরুদ্ধে যারা তাঁর জীবনকে অতিষ্ট করে তুলেছে এটা একটা ক্ষুদ্র বিজয়। গৌড়ের উদ্দেশ্যে যাত্রার শেষ পর্যায়ে তার কেনা ঘোড়াটা বেশ বুড়ো, উটের মত এর পাঁজরের হাড় বাইরের দিকে বের হয়ে আছে, কিন্তু তারপরেও গিরিমাটির থকথকে কাদার ভিতরে স্বাস্থ্যবান কোনো প্রাণীর পক্ষেও এর বেশি অগ্রসর হওয়াটা কষ্টকর বলেই প্রতিয়মান হবে। মাথার পেছনে সহস্র মোহরের ভাবনাটাই তাকে এখনও এগিয়ে নিয়ে চলেছে। আগ্রা ত্যাগ করার পরে সে দু’দুবার দীর্ঘ সময়ের জন্য জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিল–তাঁর দেহ, পরনের কাপড় আর বিছানা পর্যন্ত ঘামে ভিজে গিয়েছিল–এবং একবার প্রচণ্ড হুল ফোঁটানোর মত ডায়রিয়া এবং সেই সাথে এমন যন্ত্রণাদায়ক পেট ব্যাথা যে সে শপথ করেছে–এবং সে সত্যিই সংকল্পবদ্ধ–সে উপকূলের কাছে পৌঁছে সে প্রথম যে জাহাজট খুঁজে পাবে সেটাতে চড়ে সে ইংল্যান্ডে স্বদেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করবে। কিন্তু সে যখন শেষবার জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিল তখন সে অন্তত নৌকায় ছিল এবং সাদা কাপড় পরিহিত, মাথায় সাদা চুলের মায়াবী খয়েরী চোখের অধিকারী একজন হিন্দু পুরোহিত তখন তাঁর সেবা শুশ্রূষা করেছিল। বার্থোলোমিউ পরে পুরোহিতের হাতে একটা মোহর গুঁজে দিতে চেষ্টা করতে লোকটা নিজেকে কেমন গুটিয়ে নেয়। এই দেশটা সে কখনও ভালো করে বুঝতে পারলো না।
ক্রমশ ধুসর হয়ে আসা আলোয় সামনের দিকে তাকিয়ে কোনোমতে গৌড় অভিমুখী খচ্চরের মালবাহী কাফেলার পেছনের অংশটুকু দেখতে পায় সে নিজেকে যার পেছনে সংশ্লিষ্ট করেছে। বিপদসঙ্কুল এলাকা দিয়ে বণিকেরা নিজেদের মালবাহী পশুগুলোকে এগিয়ে নিতে ব্যস্ত থাকায় তাঁর ব্যাপারে কেউ খুব একটা আগ্রহ দেখায়নি যা তাঁর জন্য স্বস্তিদায়ক যদিও সে নিজের জন্য একটা গল্প আগেই তৈরি করে রেখেছে–সে একজন পর্তুগীজ আধিকারিক গঙ্গার মোহনার কাছে হুগলিতে অবস্থিত বাণিজ্যিক উপনিবেশে যাবে নীল আর কেলিকোর ব্যবসা বৃদ্ধির সম্ভাবনা যাচাই করে দেখতে। তাকে দেখে কোনোভাবেই কুঠির কর্মকর্তা মনে হয় না–তার চেয়েও বড় কথা তার মাথার কোকড়ানো লালচে-সোনালী চুল আর ধুসর নীল চোখের কারণে তাকে পর্তুগীজও মনে হয় না–কিন্তু একটাই বাঁচোয়া এই লোকগুলো সেটা জানে না। বা তারা এটাও জানে না তার ঘোড়ার পর্যাণের ব্যাগে ইস্পাতের তৈরি চমৎকার দুটো ধারালো খঞ্জর রয়েছে একটা পারস্যে তৈরি যার ফলা এতই ধারালো যে সেটা দিয়ে ঘোড়ার লেজের চুল দ্বিখণ্ডিত করা সম্ভব এবং অন্যটা বাঁকানো ফলাযুক্ত আবরীতে খোদাই করা তূর্কী খঞ্জর–বা তাঁর কাছে এটা যে বিক্রি করেছে সেই তুর্কী অস্ত্র ব্যবসায়ী অন্তত তাই বলেছে–যেখানে লেখা রয়েছে আমি তোমাকে হত্যা করবো বটে কিন্তু তুমি বেহেশতে না দোযখে যাবে সেটা আল্লাহর মর্জির উপরে নির্ভরশীল।
সম্রাটের আচরণ দেখে বোঝা যায় শের আফগান দোযখে গেলেই তিনি খুশি হবেন কিন্তু তিনি কেন লোকটাকে হত্যা করতে চান সেবিষয়ে কিছুই খুলে বলেননি। বার্থোলোমিউ তার চামড়ার মশকের দিকে হাত বাড়ায় এবং এক ঢোক পানি খায়। মশকের পানি উষ্ণ হয়ে আছে আর পূতিগন্ধময় কিন্তু সে বহু পূর্বে এসব বিষয়ে মাথা ঘামান বন্ধ করেছে। সে এখন কেবল একটাই প্রার্থনা করে যে আরেকবার যেন সে পেটের ব্যামোয় আক্রান্ত না হয়। মশকের ছিপি বন্ধ করে সে আবারও জাহাঙ্গীরের কথা ভাবতে শুরু করে, বার্থোলোমিউকে সে তার আদেশ দেয়ার সময় কীভাবে তাঁর সুদর্শন মুখাবয়বের কালো চোখের দৃষ্টিতে একাগ্রতা ফুটে ছিল। তার পরনের বুটিদার রেশমি পোষাক আর হাতের সব আঙুলে আংটি চকচক করলেও, বার্থোলোমিউয়ের কিন্তু মনে হয় যে লোকটা হয়ত তারই মত অনেকটা… একজন যে জানে সে কি চায় এবং সেটা অর্জনে প্রয়োজনে নির্মম হতে হবে। সে সেই সাথে প্রায় মিলিয়ে যাওয়া ক্ষতচিহ্ন খেয়াল করে–একটা জাহাঙ্গীরের বাম হাতের পেছনের অংশে আর অন্যটা তার ডান দ্রুর উপর থেকে শুরু হয়ে কপালের যেখানে চুল শুরু হয়েছে সেখানে মিলিয়ে গিয়েছে। সম্রাট নিজের হত্যার রীতিনীতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল।
বার্থোলোমিউ সহসা সামনে থেকে কাফেলার লোকদের একে অন্যের উদ্দেশ্যে চিৎকার করতে শুনে। সে সহজাত প্রবৃত্তির বশে নিজের তরবারি স্পর্শ করে যদি লুটেরার দল–স্থানীয় লোকেরা যাদের ডাকাত বলে–হ্যামলা করে থাকে। লুটেরাদের আক্রমণগুলো সাধারণত সকালের দিকে হয়ে থাকে যখন শেষ মুহূর্তের জড়িয়ে থাকা অন্ধকার ডাকাতদের আড়াল দেয় এবং বণিকেরা সারা রাত পাহারা দিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তিন রাত্রি আগের ঘটনা বার্থোলোমিউ ঠিক এমন সময়েই এক দুর্বল গালিচা ব্যবসায়ীকে রক্ষা করেছিল। লোকটা টিপটিপ বৃষ্টির ভিতরে থেমে তার মালবাহী খচ্চরের পালে খোঁড়া হয়ে যাওয়া একটা খচ্চরের পিঠের বোঝা অন্য জন্তুর পিঠে পুনরায় চাপিয়ে দিচ্ছিলেন। লোকটা প্রায় নিজের সমান লম্বা একটা মোড়ানো গালিচা নিয়ে যখন হিমশিম খাচ্ছে তখনই অন্ধকারের আড়াল থেকে দু’জন ডাকাত দুলকি চালে তার দিকে এগিয়ে আসে। তারা তাদের টাটু ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফিয়ে মাটিতে নেমে, একজন গালিচা ব্যবসায়ীকে এক লাথিতে মাটিতে ফেলে দেয় এবং অন্যজন তাঁর খচ্চরের লাগামগুলো জড়ো করতে থাকে সেগুলোকে নিয়ে যাবে বলে। তারা দুজনেই নিজেদের কাজে এতই মশগুল ছিল তারা বার্থোলোমিউর গাঢ় অন্ধকারের ভিতর দিয়ে দুলকি চালে ঘোড়া ছুটিয়ে আসা খেয়ালই করে নি, যতক্ষণ না বড্ড দেরি গিয়েছে। সে তার ইস্পাতের তৈরি টোলেডো তরবারি বের করে একজন ডাকাতের কাঁধের উপর থেকে তার মাথাটা প্রায় আলাদা করে দেয় এবং পাকা তরমুজের মত অন্যজনের খুলি দ্বিখণ্ডিত করে। ছোটখাট দেখতে গালিটা ব্যবসায়ী কৃতজ্ঞতায় অস্থির হয়ে পড়ে এবং চেষ্টা করে জোর করে তাকে একটা গালিচা উপহার দিতে। কিন্তু বার্থোলোমিই ততক্ষণে নিজের কর্মকাণ্ডের জন্য আফসোস করতে শুরু করেছে। সে যদি নিজের অভিযান সফল করতে এবং পুরষ্কার লাভ করতে চায় কারো মনোযোগ আকর্ষণ করা তার উচিত হবে না।
কিন্তু এবারে ডাকাতদের কারণে হট্টগোলের সৃষ্টি হয়নি। চিৎকারটা ভয়ের না স্বস্তি আর আনন্দের চিৎকার। বার্থোলোমিউ তার সামনে সূর্যাস্তের আলো দিনের মত একেবারে মুছে যাবার আগেই নিজের সামনে পর্যবেক্ষণ গম্বুজ দেখতে পায়–তাঁরা গৌড়ে পৌঁছে গিয়েছে। বার্থোলোমিউ তাঁর তরবারির হাতল থেকে হাত সরিয়ে আনে এবং নিজের ঘর্মাক্ত ঘোড়াটার গলায় আলতো করে চাপড় দেয়। এখন আর বেশি দেরি নেই, বুড়ো ঘোড়া কোথাকার।
*
এই সময় আঙিনায় এহেন জটলার মানে কি? গৌড়ের প্রধান তোরণ দ্বারের পাশে প্রতিরক্ষা দেয়ালের ভিতরে একটা ছোট সরাইখানায় বার্থোলোমিউ তাঁর ভাড়া নেয়া ছোট কক্ষের খড়ের গদিতে শুয়ে বিরক্তির সাথে মনে মনে চিন্তা করে। সে বিছানায় উঠে বসে এবং প্রচণ্ডভাবে সারা দেহ চুলকায় তারপরে টলমল করে উঠে দাঁড়িয়ে জুতা পায়ে না দিয়েই বাইরে বের হয়ে আসে। যদিও মাত্র সকাল হয়েছে, বণিকেরা প্রাঙ্গণের ঠিক কেন্দ্রে অবস্থিত একটা বিশালাকৃতি পাথরের চাতালের উপরে নিজেদের পশরা: বস্তা ভর্তি মশলা, থলে ভর্তি চাল, বজরা আর ভূট্টা, সুতি কাপড়ের পিঙ্গল বর্ণের বাণ্ডিল আর ক্যাটক্যাটে ধরনের রেশমের কাপড় সাজিয়ে রাখছে তারা বেচা কেনা শুরু করতে প্রস্তুত। বার্থোলোমিউ কোনো ধরনের আগ্রহ ছাড়াই তাদের পর্যবেক্ষণ করে কিন্তু সে ঘুরে দাঁড়াবে এমন সময় সে খেয়াল করে যে গালিচা ব্যবসায়ীকে সে বিপদ থেকে রক্ষা করেছিল তাঁর দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
‘জনাব, গৌড় খুব চমৎকার একটা লোকালয়।
‘খুবই সুন্দর, বার্থোলোমিউ অনেকটা যান্ত্রিকভাবে উত্তর দেয়। সে তাঁর কক্ষে ফিরে যাবার জন্য যাত্রা করবে–সে অনায়াসে আরো এক কি দুই ঘন্টা দিব্যি ঘুমাতে পারে–কিন্তু তারপরে তার মনে একটা ভাবনার উদয় হয়। হাসান আলি–এটাই সম্ভবত আপনার নাম, তাই নয় কি?
লোকটা মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।
হাসান আলি, গৌড় আপনি কেমন চেনেন?
‘জ্বী। আমি বছরে ছয়বার এখানে আসি এবং আমার দুইজন আত্মীয় সম্পর্কিত ভাই এখানে বেচাকেনা করে।’
তুমি বলেছিলে আমার সাহায্যের প্রতিদান তুমি আমায় দিতে চাও। আমার পথপ্রদর্শক হও। আমি এই এলাকাটা চিনি না এবং পর্তুগালে আমার নিয়োগকারীরা চায় এই এলাকার একটা সম্পূর্ণ বিবরণ আমি তাঁদের পাঠাই।
বার্থোলোমিউ এক ঘন্টা পরে সরাইখানার বর্গাকৃতি খোলা প্রাঙ্গণের উপর দিয়ে হাসান আলিকে অনুসরণ করে এর উঁচু খিলানাকৃতি তোরণদ্বারের নিচে দিয়ে বাইরে গৌড়ের ব্যস্ত সড়কে এসে দাঁড়ায়। প্রথম দর্শনে শহরের সংকীর্ণ, আবর্জনা পূর্ণ রাস্তা দেখে এলাকাটা সম্বন্ধে একটা বিশ্রী ধারণা জন্মে কিন্তু হাসান আলি, তাঁর মত ছোটখাট একটা লোকের তুলনায় বিস্ময়কর দ্রুতগতিতে হাঁটতে শুরু করলে, পথ দেখিয়ে তাকে শহরের কেন্দ্রস্থলের দিকে নিয়ে যেতে শুরু করলে রাস্তাগুলো ক্রমশ প্রশস্ত হতে থাকে এবং বাড়িগুলোও কোনো কোনোটা আবার দোতলা উঁচু–ক্রমশ আরো দর্শনীয় রূপ ধারণ করে। বার্থোলোমিউ সেইসাথে অবশ্য লক্ষ্য রাখে রাস্তায় তারা সৈন্যদের কতগুলো দল অতিক্রম করেছে। এই সৈন্যরা কোথায় যাচ্ছে?’ সে দুই সারিতে বিন্যস্ত সবুজ পরিকর আর সবুজ পাগড়ি পরিহিত বিশজন সৈন্য পাশ দিয়ে এগিয়ে যাবার সময় সেদিকে ইঙ্গিত করে।
তারা রাতের বেলা শহরের নিরাপত্তা প্রাচীরের প্রহরায় নিয়োজিত সৈন্যদল কিন্তু তাদের এখন পালাবদল হয়েছে এবং তারা এখন তাদের ছাউনিতে ফিরে যাচ্ছে।’
‘ছাউনিটা কোথায়?
‘বেশি দূরে না। আমি আপনাকে ছাউনিটা দেখাবো।
কয়েক মিনিট পরে বার্থোলোমিউ সামনে কুচকাওয়াজের ময়দান বিশিষ্ট অনেকটা দূর্গের মত একটা বর্গাকৃতি লম্বা দালান দেখতে পায়। মাটির ইট দিয়ে নির্মিত এর দেয়ালগুলো প্রায় পঞ্চাশ ফিট উঁচু। সে তাকিয়ে থাকার সময় অশ্বারোহীদের একটা দল, নিঃসন্দেহে তাদের ঘোড়াগুলোকে প্রাত্যহিক অনুশীলনের পরে ফিরে আসছে, দুলকি চালে ধাতব কীলকযুক্ত ভারি দরজার নিচে দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে যা ছাউনির একমাত্র প্রবেশ পথ। ছাউনিটা দেখতে চমৎকার।
হ্যাঁ। সম্রাট আকবর, তাঁর বাংলা বিজয়ের পরে–আল্লাহতা’লা তাঁর আত্মাকে বেহেশত নসীব করুন–দালানটা নির্মাণ করেছিলেন। তিনি শহরের প্রতিরক্ষা প্রাচীরও মজবুত করেছিলেন এবং আমাদের এখানে যে মনোরম সরাইখানাগুলো রয়েছে সেগুলোও নির্মাণ করেছিলেন। তিনি সত্যিই একজন মহান মানুষ ছিলেন।
‘আমি সে বিষয়ে নিশ্চিত। এখানে কে মোগল সৈন্যবাহিনীর সেনাপতি? সম্রাটের এত অনুগ্রহভাজন তিনি নিশ্চয়ই একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি।
‘আমি তাঁর নাম জানি না। আমি দুঃখিত।
‘সেটা খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ না। আমার কেবল জানবার কৌতূহল হয়েছিল এমন একটা কাজের দায়িত্ব কার উপর অর্পিত হয়েছে। আমার নিজের দেশের তুলনায় হিন্দুস্তান একটা বিশাল দেশ। আমাদের দেশে, একজন সম্রাটের পক্ষে তার নিজের ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণ করা এবং কোথায় কি ঘটছে জানাটা সহজ…’।
‘সেটা সত্যি কথা। সারা পৃথিবীতে আমাদের সাম্রাজ্যের কোনো তুলনা পাওয়া যাবে না।’ হাসান আলি আত্মতুষ্টির সাথে মাথা নাড়ে। এবার চলুন। সরাইখানার বাইরে যেখানে বেশির ভাগ বেচাকেনা হয় সেই বড় বাজার আমি আপনাকে দেখাতে চাই।’
তারা চলে যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে এমন সময় কর্কশ ধাতব তূর্যধ্বনি তাদের দাঁড়িয়ে পড়তে বাধ্য করে। কিছুক্ষণ পরেই বারোজন চৌকষ সৈন্য খয়েরী রঙের সুসজ্জিত ঘোড়ায় উপবিষ্ট হয়ে অর্ধবল্পিত বেগে পাশের একটা সড়ক দিয়ে বের হয়ে কুচকাওয়াজ ময়দানের উপর দিয়ে সেনাছাউনির দিকে এগিয়ে যায়। তাদের একজনের হাতে পিতলের একটা ছোট তূর্য রয়েছে তাঁদের আগমনের সংকেত সে এইমাত্র যেটা দিয়ে ঘোষিত করেছে। বারোজনের দলটাকে আরো তিনজন অশ্বারোহী অনুসরণ করছে–চূড়াকৃতি শিরোস্ত্ৰাণ পরিহিত দুজন দীর্ঘদেহী এক লোকের দুপাশে অবস্থান করছে যিনি ডানে বা বামে কোনো দিকেই না তাকিয়ে সোজা তাকিয়ে রয়েছেন এবং সাদা পালকযুক্ত শিয়োস্ত্রাণের নিচে তার লম্বা কালো চুল বাতাসে উড়ছে।
বার্থোলোমিউর নাড়ীর স্পন্দন দ্রুততর হয়ে উঠে। হাসান আলির খোঁজে সে চারপাশে তাকায় এবং ময়লা ধুতি পরিহিত একজন তরমুজ বিক্রেতার সাথে তাকে দর কষাকষি করতে দেখে। বার্থোলোমিউ কান খাড়া করে শুনতে চেষ্টা করে কিন্তু তাঁদের কথোপকথনের বিন্দুবিসর্গও বুঝতে পারে না। সে ভাবে, তারা নিশ্চয়ই স্থানীয় কোনো ভাষায় কথা বলছে। এটা কোনোমতেই পার্সী হতে পারে না। তরমুজ বিক্রেতাকে দেখে মনে হয় সে অনেক কিছু বলতে চায়। সে তার সবুজাভ-হলুদ সিলিন্ডারের মত দেখতে ফলের স্তূপের পেছন থেকে বের হয়ে আসে এবং সেনাছাউনির দিকে ইঙ্গিত করে উত্তেজিত ভঙ্গিতে কথা বলতে থাকে পালকযুক্ত শিরোস্ত্ৰাণ পরিহিত লোকটা তার দেহরক্ষীদের নিয়ে যার ভিতরে এখন অদৃশ্য হয়েছে।
‘মহাশয়, হাসান আলি বলে, ‘সেনাছাউনির আধিকারিকের নাম শের আফগান। আমরা এইমাত্র যাকে যেতে দেখলাম তিনিই সেই ব্যক্তি। তরমুজ বিক্রেতা আমাকে বলেছে সে একজন চৌকষ যোদ্ধা। দুই বছর পূর্বে আমাদের মরহুম সম্রাট এখান থেকে পূর্বদিকে অবস্থিত আরাকানের জলাভূমি আর বনেবাদাড়ে লুকিয়ে থাকা জলদস্যুদের শায়েস্তা করতে তাকে পাঠিয়েছিলেন। এলাকাটা, কুমীর ভর্তি, বিপদসঙ্কুল হলেও শের আফগান লক্ষ্য অর্জনে সফল হন। তিনি পাঁচশ জলদস্যুকে বন্দি করে করেন এবং মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে, তাদের জ্বলন্ত নৌকার চিতায় তাঁদের দেহগুলো নিক্ষেপ করেন।
তিনি কি সেনাছাউনিতেই বসবাস করেন?
না। শহরের উত্তর দিকে, অসিনির্মাতাদের তোরণের কাছে অবস্থিত একটা বিশাল উদ্যানের ভেতরে তাঁর হাভেলী অবস্থিত। এবার চলেন আমরা বাজারের দিকে যাই। সেখানে আপনাকে আগ্রহী করে তোলার মত অনেক কিছুই খুঁজে পাবেন… গতবার আমি এখানে এসে আমি কাঠের উপর অঙ্কিত আপনাদের এক পর্তুগীজ দেবতার প্রতিকৃতি দেখেছিলাম। প্রতিকৃতিটার সোনালী ডানা ছিল…’।
*
বার্থোলোমিউ অলস সময় অতিবাহিত করে। প্রতিদিন এখনও বৃষ্টি হয়, সরাইখানার শান বাধান আঙিনায় বৃষ্টির বড় আর ভারি ফোঁটাগুলো এসে ক্রমাগত আছড়ে পড়তে থাকে। বৃষ্টি পড়া মাঝে মাঝে কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ হলে সে মানুষের মাঝে নিজের উপস্থিতি বেশি দৃশ্যমান হওয়া থেকে বিরত রাখতে বাজার থেকে কেনা মস্তকাবরণীযুক্ত গাঢ় খয়েরী রঙের আলখাল্লাটা গায়ে দিয়ে গৌড়ের ভিতরে হেঁটে বেড়ায় যতক্ষণ না সেনাছাউনি আর শের আফগানের হাভেলীর মধ্যবর্তী এলাকার রাস্তার প্রতিটা বাঁক, প্রতিটা গলিপথের নক্সা তাঁর মানসপটে স্থায়ীভাবে বসে যায়। সে সেইসাথে তার সম্ভাব্য শিকারের চলাফেরা পর্যবেক্ষণ করে যা, আবহাওয়া যখন ভালো থাকে তখন মাঝে মাঝে শিকারে কিংবা বাজপাখি উড়াতে যাওয়া ছাড়া, বিস্ময়কর নিয়মিত বলে মনে হয়। শের আফগান প্রায় প্রতিদিনই দুপুরবেলা কয়েক ঘন্টা সেনাছাউনিতে অতিবাহিত করে। সোমবার ময়দানে সে তার বাহিনীর অনুশীলন পর্যালোচনা করে, তাঁদের নিশানাভেদের দক্ষতা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করে এবং বুধবার সে শহরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার নির্বাচিত অংশ তদারকিতে ব্যস্ত থাকে।
আগ্রা থেকে সুদীর্ঘ যাত্রাকালীন সময়ে বার্থোলোমিউ প্রায়শই শের আফগানকে হত্যার সবচেয়ে ভালো সুযোগ কীভাবে খুঁজে বের করবে সেটা নিয়ে ক্রমাগত চিন্তা করেছে। সে এমনকি তার সাথে পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া বাঁধাবার কথাও চিন্তা করেছিল যেন গৌড় কোনো ইংলিশ শহর যেখানে কোনো সরাইখানায় তাঁর এবং শের আফগানের সাথে দেখা হওয়া আর ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়া সম্ভব চিন্তা করেছিল ভেবে নিজের মনেই হেসে উঠে। সে এখন লোকটার শারীরিক শক্তির নমুনা প্রত্যক্ষ করা ছাড়াও লোকটা যেখানেই যায় সেখানেই তাঁর সাথে সার্বক্ষনিকভাবে একজন দেহরক্ষী থাকে লক্ষ্য করার পরে ধারণাটা খুব একটা গ্রহণীয় মনে হয় না। সে যাই করুক না কেন ব্যাপারটা গোপনীয় হতে হবে। একটা সুবিধাজনক স্থান হয়ত খুঁজে পাওয়া সম্ভব যেখান থেকে একটা তীর ছোঁড়া কিংবা একটা খঞ্জর নিক্ষেপ করা যাবে কিন্তু সেক্ষেত্রে তাকে সাথে সাথে হত্যা করার কথা বাদই দেয়া যাক, তাকে আহত করার সম্ভাবনাই খুবই সামান্য। জাহাঙ্গীর স্পষ্টই বলে দিয়েছে যে সে শের আফগানকে মৃত দেখতে চায়।
অবশেষে একটা মেঘমুক্ত পরিষ্কার দিনে যখন বৃষ্টিপাত সত্যিই থেমেছে বলে মনে হয় এবং বাতাসে একটা নতুন সতেজতা বিরাজ করছে, বার্থোলোমিউ সমাধানটা খুঁজে পায়। একটা সহজ সরল আর দারুণ স্পষ্ট সমাধান–যদিও এতে তাঁর নিজের বিপদের সম্ভাবনা রয়েছে–যে সে কেন এটা আগে ভাবেনি চিন্তা করার সময় সে মুচকি মুচকি হাসে।
*
দুই সপ্তাহ পরের কথা, রাত প্রায় এগারটা হবে–রাতের মত সরাইখানার দরজা বন্ধ হবার ঠিক এক ঘন্টা পূর্বে–ঘামের দাগযুক্ত খড়ের বিছানাটায় শেষবারের মত একটা লাথি মেরে যেখানে বহু অস্বস্তিকর রাত সে কাটিয়েছে, বার্থোলোমিউ তাঁর কামরা থেকে গোপনে বের হয়ে আসে। তার গাঢ় রঙের আলখাল্লার নিচে, তাঁর দুটো খঞ্জরের সাথে তাঁর কোষবদ্ধ তরবারিটা একটা ইস্পাতের শেকলের সাহায্যে তাঁর কোমর থেকে ঝুলছে, তাঁর ডান পাশে রয়েছে তূর্কী তরবারি আর বামপাশে ঝুলছে পারস্যের খঞ্জর। সে আলখাল্লার মোটা কাপড় এমনভাবে চিরে দিয়েছে যাতে প্রয়োজনের সময়ে সহজে সেগুলো সে বের করতে পারে।
বার্থোলোমিউ দ্রুত সরাইখানার সামনের খোলা প্রাঙ্গন অতিক্রম করে এবং এর তোরণাকৃতি প্রবেশদ্বারের নিচে ঘুমন্ত দ্বাররক্ষীকে পাশ কাটিয়ে বাইরে বের হয়ে আসে যার দায়িত্ব ছিল গভীর রাতে নিজেদের শোবার জন্য একটা বিছানা আর তাদের পশুর জন্য আস্তাবলের সন্ধানে আগত আগন্তুকদের প্রতি নজর রাখা। সে বাইরে এসেই দ্রুত চারপাশে একবার তাকিয়ে দেখে সে একাকী রয়েছে সেটা নিশ্চিত হতে। সে তারপরে সংকীর্ণ, নির্জন সড়ক দিয়ে এগিয়ে যায়। সে বহুবার এই নির্দিষ্ট পথ দিয়ে হেঁটে গিয়েছে এবং সে কুচকাওয়াজ ময়দান আর সেনাছাউনি অতিক্রম করে শহরের উত্তর দিকে এগিয়ে যাবার সময় খুব ভালো করেই জানে রাস্তাটা তাকে কোথায় নিয়ে যাবে। একটা ছোট হিন্দু মন্দিরের সামনে পৌঁছাবার পরে, যেখানে দেবতা গনেশের মূর্তির সামনে পিতলের একটা পাত্রে মোম লাগান সলতে জ্বলছে, বার্থোলোমিউ ঘুরে গিয়ে একটা গলিতে প্রবেশ করে যেখানে দুপাশের বাড়িগুলোর বাইরের দিকে ঝুলে থাকা উপরিতলগুলো এত কাছাকাছি তারা পরস্পরকে প্রায় স্পর্শ করেছে। একটা বাসা থেকে সে একজন মহিলার গুনগুন গানের শব্দ এবং অন্য আরেকটা থেকে একটা বাচ্চার কান্নার আওয়াজ ভেসে আসতে শুনে। এখানে সেখানে জানালা ঢেকে রাখা নক্সা করা কাঠের জালির ভিতর দিয়ে তেলের প্রদীপের কমলা আলো দপদপ করে।
বার্থোলোমিউর পায়ে সহসা নরম কিছু একটা আটকে যায়। একটা কুকুর যার করুণ আর্তনাদ সে আয়েশী ভঙ্গিতে এগিয়ে যাওয়া বজায় রাখলে তাকে অনুসরণ করতে থাকে। তাড়াহুড়ো করার কোনো দরকার নেই আর তাছাড়া একজন ব্যস্ত মানুষ সবসময়ে অধিকতর মনোযোগ আকর্ষণ করে। গলিপথটা চওড়া হতে শুরু করেছে এবং এটা যতই বৃত্তাকারে বামদিকে বাঁক নিতে থাকে এটা একটা বড় প্রাঙ্গণে এসে মিশে যায়। বার্থোলোমিট দিন আর রাতের প্রতিটা প্রহরে এটা দেখেছে। সে জানে দিনের বেলা গরমের সময় নিজেদের দ্রব্যসামগ্রী বিক্রয়রত ছোট দোকানদারের দোকানে কতগুলো নিমগাছ ছায়া দেয়, কতগুলো অন্য গলিপথ আর রাস্তা এখানে এসে মিশেছে এবং প্রাঙ্গণের শেষ প্রান্তে তার ঠিক বিপরীত দিকে অবস্থিত লম্বা দালানটা ঠিক কতজন লোক পাহারা দেবে। বার্থোলোমিউ মস্তকাবরণী আরও ভালো করে মুখের উপরে টেনে দিয়ে গলির বাঁক থেকে সতর্কতার সাথে প্রাঙ্গণের দিকে তাকায়। অমাবস্যার পরে সদ্য নতুন চাঁদ উঠায় চারপাশ একেবারেই অন্ধকার কিন্তু তার অভীষ্ট বাড়ির ধাতু দিয়ে বাঁধান দরজার দু’পাশে জ্বলন্ত কয়লাদানির আভায় দেখা যায় যে–ঠিক অন্যান্য রাতের মতই–চারজন প্রহরী পাহারায় রয়েছে। আবছা আলোয় আরো দেখা যায় যে প্রবেশপথের উপরে একটা গিল্টি করা দণ্ড থেকে একটা সবুজ নিশান উড়ছে–সে হাসান আলির কাছ থেকে যেমনটা জেনেছে যে এটা সেনাপতির গৃহে অবস্থান করার একটা নিশানা। সবকিছু কেমন নির্জন দেখায়। কোনো ধরনের ভোজসভা বা সমাবেশ যদি আয়োজিত হয়ে থাকে তাহলে তাকে তাঁর পরিকল্পনা আজকের মত বাতিল করতে হবে…
বার্থোলোমিউ যা দেখতে চেয়েছিল দেখার পরে, সে গলির ছায়ার ভেতরে পিছিয়ে আসে এবং ঘুরে দাঁড়িয়ে, যেদিন থেকে এসেছে সেদিকে তার পায়ের ধাপগুণে এগিয়ে যেতে থাকে। একশ কদমের মত যাবার পরে সে বামদিকে একটা ছোট রাস্তার মুখে এসে দাঁড়ায়। দিনের বেলা রাস্তাটা সজিবিক্রেতায় গিজগিজ করে কর্কশ কণ্ঠে সাগ্রহে পথচারীদের তাঁরা নিজেদের সজির গুণগান করে এবং তাঁদের প্রতিযোগীদের সজির বদনাম করতে থাকে, কিন্তু রাস্তাটা এখন নির্জন আর জনমানবহীন। বার্থোলোমিউ রাস্তা বরাবর হেঁটে যায়, তাঁর পায়ের নিচে সজির পঁচতে শুরু করা পাতায় পিচ্ছিল হয়ে আছে এবং তাদের পচন ক্রিয়ার তীব্র দুর্গন্ধ বাতাসে কিন্তু তাঁর মনে অন্য বিষয় খেলা করছে। এই রাস্তাটা প্রাঙ্গণের পেছন দিয়ে বৃত্তাকারে বেঁকে গিয়েছে। কয়েকশ গজ পরেই শের আফগানের বাড়ির পেছনে একটা মনোরম উদ্যানের পশ্চিম পাশের দেয়ালের কাছ দিয়ে রাস্তাটা অতিক্রম করেছে।
দেয়ালটা বেশ উঁচু–কমপক্ষে বিশ ফিট হবে–কিন্তু সে জানে দেয়ালের ইটের গাঁথুনিতে হাত আর পা-রাখার অজস্র জায়গা থাকায় দেয়ালটা বেয়ে উপরে উঠা সম্ভব। গত দুই রাত্রি সে দেয়ালের উপরে নিজেকে টেনে তুলেছে, একটা স্থান পছন্দ করেছে যেখানে দেয়ালের অন্য পাশে লম্বা একটা বাশের ঝাড় থাকায়, ঘন গাছপালার ভিতরে লাফিয়ে নামা যাবে। পাতাবহুল বাঁশের ভিতর দিয়ে গুঁড়ি মেরে এগিয়ে যাবার সময় সে চোখ কান সজাগ রাখে। বৃক্ষের আন্দোলিত কাণ্ডের ভিতর দিয়ে সে বুদ্বুদ নিঃসরণকারী ঝর্ণাবিশিষ্ট একটা উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ আর তারপরে বাড়ির অন্ধকার দেয়াল দেখতে পায়। বাড়ির ভিতরে প্রবেশের জন্য সামনে অবস্থিত ধাতব দরজার মত অবিকল এখানেও আছে কিন্তু দুটো গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য রয়েছে। দরজার পাল্লাগুলো খোলা থাকে–যাঁদের পেছনে সে ভেতরের একটা আঙিনার খানিকটা দেখতে পেয়েছে–এবং সেইসাথে দরজায় পাহারার ব্যবস্থাও সামান্য। রাতের বেলা একজন প্রহরী–তার হালকা পাতলা অবয়ব দেখে বার্থোলোমিউ যত দূর বুঝতে পেরেছে একজন যুবকের চেয়ে বেশি বয়স হবে না–দরজার ঠিক ভেতরে একটা কাঠের তেপায়ার উপরে বসে থাকে। তাঁর কাছে কোনো অস্ত্র থাকে বলে মনে হয় না–কেবল একটা ছোট ঢোল থাকে বিপদ বুঝতে পারলে সেটা বাজিয়ে বাড়ির লোকদের সতর্ক করতে।
কিন্তু শের আফগান কি ধরনের বিপদ আশঙ্কা করছেন? তিনি শক্তিশালী আর শান্তিপূর্ণ একটা সাম্রাজ্যের এক শান্ত অঞ্চলে–যদিও সেটা দূরবর্তী–অবস্থিত একটা সেনানিবাসের আধিকারিক। সামনের দরজায় পাহারারত সৈন্যরা অন্য কোনো কিছু না সম্ভবত প্রদর্শনীর জন্য মোতায়েন রয়েছে। সম্রাট এই লোককে কেন মৃত দেখতে চান এবং কেন তিনি–সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী একজন–তাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেবার জন্য এই পন্থার আশ্রয় নিয়েছেন বার্থোলোমিউ আরো একবার নিজেকে এই ভাবনায় ব্যপৃত দেখতে পায়। শের আফগান যদি কোনো অপরাধ করে থাকে তাহলে জাহাঙ্গীর কেন তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করছেন না? সবচেয়ে বড় কথা তিনি একজন সম্রাট। কিন্তু যাই হোক এটা নিয়ে তাঁর মাথা না ঘামালেও চলবে। সহস্র মোহর এখানে মূল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
কোনো অঘটন ছাড়াই দেয়ালের কাছে পৌঁছাবার পরে, বার্থোলোমিউ নিশ্চিত হবার জন্য তার চারপাশে আরো একবার তাকিয়ে দেখে যে কেউ আশেপাশে নেই। সে সন্তুষ্ট হয়ে নিজের কালো আলখাল্লাটা তুলে ধরে দেয়াল বেয়ে উঠতে আরম্ভ করে। সে এইবার কোনো কারণে, সম্ভবত কাজ শেষ করার জন্য অধৈর্য হয়ে উঠায় বা উত্তেজনার বশে, হাত রাখার জায়গা ভালো করে বাছাই করতে পারে না। সে যখন প্রায় পনের ফিট উপরে উঠে গেছে, তার ডান হাত দিয়ে আঁকড়ে রাখা একটা ইটের কোণ গুঁড়িয়ে যায় এবং তার প্রায় চিৎ হয়ে মাটিতে পড়ার দশা হয়। ইটের মাঝে বিদ্যমান ফাঁকে পায়ের আঙুল শক্ত করে গুঁজে দিয়ে এবং বাম হাতে ঝুলে থেকে–সে টের পায় নখের নিচে দিয়ে টপটপ করে রক্ত পড়ছে–সে কোনো মতে নিজের অবস্থান সংহত করে। সে ডান হাত বাড়িয়ে উঁচুতে রুক্ষ উপরিভাগে হাতড়াতে থাকে যতক্ষণ না সে নিরাপদ মনে হয় এমন একটা জায়গা খুঁজে পায়। সে শেষ একটা ঝাঁকি দিয়ে নিজেকে দেয়ালের উপরে তুলে আনে।
সে মুখ থেকে ঘাম মুছে সতর্কতার সাথে দেয়ালের অপর পাশে নিজেকে নিচু করে, বাঁশ ঝাড়ের মাঝে তাঁর খুঁজে পাওয়া ফাঁকা স্থানে মাটি থেকে যখন দশ ফিট উপরে রয়েছে সে হাত ছেড়ে দেয়। সে উবু হয়ে বসে, হৃৎপিণ্ডের ধকধক শব্দের ভিতরে, শুনতে চেষ্টা করে। কোনো শব্দ নেই, সব চুপচাপ। এটা ভালো লক্ষণ। এখন নিশ্চিতভাবেই মধ্যরাত্রি অতিক্রান্ত হয়েছে কিন্তু এখনও তার পরিকল্পনামাফিক কাজ শুরু করার জন্য অনেক সময় বাকি আছে। সে সামান্য নড়েচড়ে নিজের অবস্থানকে একটু আরামদায়ক করে। সে টের পায় একটা ছোট জম্ভ–একটা ইঁদুর বা টিকটিকি হবে–তাঁর পায়ের উপর দিয়ে দৌড়ে যায় এবং মশার চির পরিচিত ভনভন শুনতে পায়। খানিকটা কুচকে, সে সামনের কাজটায় মনোসংযোগের চেষ্টা করে।
রাত যখন প্রায় একটার কাছাকাছি, বার্থোলোমিউ তখন ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে, প্রথমে বাঁশের ঝাড়ের এবং পরে একটা ছড়ান ডালপালাযুক্ত পাতাবহুল আমগাছের আড়াল ব্যবহার করে। চাঁদের আলোয়, সে দেখতে পায় প্রহরীর তরুণ মাথাটা তাঁর বুকের উপরে ঝুঁকে এসেছে এবং সে স্পষ্টতই নিজের তেপায়ার উপরে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তার পেছনে বাড়ির ভেতরের আঙিনা, দেয়ালের কুলঙ্গিতে রক্ষিত কয়েকটা ক্ষুদ্রাকতি মশালের আলোয় আধো আলোকিত, নিরব আর শান্ত। বার্থোলোমিউ বাগানের উপর দিয়ে দ্রুত বেগে দৌড়ে পানি নির্গত হতে থাকা ঝর্ণার পাশ দিয়ে বাড়ির দেয়ালের দিকে এগিয়ে গিয়ে, দরজার বাম পাশে ঝুল বারান্দার কারণে অন্ধকার হয়ে থাকা একটা জায়গা বেছে নেয়। সে দেয়ালের সাথে পিঠ সোজা করে রেখে এক মুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করে সে নিজের শ্বাসপ্রশ্বাসের গতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে।
সে তারপরে গুটি গুটি পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করে। দরজার কাছে পৌঁছে সে দাঁড়িয়ে ভেতরে উঁকি দেয়। সে দ্বাররক্ষীর এতটাই কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে যে তার মৃদু নাক ডাকার শব্দ অব্দি সে শুনতে পায়। কিন্তু কোথাও আর কোনো শব্দ নেই। সে মাংসপেশী টানটান করে, দরজার ভিতর দিয়ে সে লাফ দিয়ে সামনে এগিয়ে গিয়ে, তরুণ প্রহরীকে দু’হাতে আঁকড়ে ধরে তাকে তুলে বাগানে নিয়ে আসে এবং ডান হাতে শক্ত করে তাঁর মুখ চেপে রেখেছে। একটা শব্দ তুমি করেছছা তো জানে মেরে ফেলবো, সে ফার্সী ভাষায় কথাটা বলে। আমার কথা বুঝতে পেরেছো? সে যখন মাথা নাড়ে তার তরুণ চোখ ভয়ে বিস্ফারিত হয়ে রয়েছে। বেশ এখন তাহলে তোমার মনিব শের আফগান যেখানে ঘুমিয়ে আছে আমাকে সেখানে নিয়ে চলো।’
তরুণ প্রহরী আবার মাথা নাড়ে। সে বাম হাতে অসহায় তরুণের গলার পেছনের দিক এত জোরে আঁকড়ে ধরে যে তার নখ বেচারার মাংসের গভীর প্রবেশ করে, এবং ডান হাতে মোষের চামড়ার ময়ান থেকে বাকান ফলার তুর্কী খঞ্জরটা বের করে, বার্থোলোমিউ ভেতরের আঙিনার উপর দিয়ে তাকে অনুসরণ করে কোণায় অবস্থিত একটা দরজার নিচে দিয়ে এগিয়ে যায় এবং কয়েক ধাপ পাথুরে সিঁড়ি অতিক্রম করে একটা লম্বা করিডোরে এসে উপস্থিত হয়। সে টের পায় তার আঁকড়ে ধরা হাতের ভিতরে ভয় পাওয়া ভীত কুকুরছানার মত তরুণ প্রহরী কাঁপছে।
‘মহাশয়, এখানেই। এটাই সেই কামরা।’ পিতলের ব্যাঘ্র বসান কালো কোনো কাঠের তৈরি ভীষণ চকচকে দরজাবিশিষ্ট একটা কক্ষের বাইরে ছেলেটা এসে থামে। বার্থোলোমিউর মনে হয় সে মশলাযুক্ত কোনো সুগন্ধ। তাঁর নাকে পেয়েছে–সম্ভবত কুন্দু–এবং সে তরুণ ছেলেটাকে আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরতে, আতঙ্কিত খয়েরী চোখে, সে ঘুরে তাকায়। সে কোনো হুশিয়ারি না দিয়েই চিৎকার করে বিপদসঙ্কেত দিতে মুখ হাঁ করে।
বার্থোলোমিউ বিন্দুমাত্র ইতস্তত করে না। সে চোখের পলকে দু’বার হাত চালিয়ে বাম হাতে ছেলেটার মাথা পেছনের দিকে টেনে আনে এবং একই সাথে তার উজ্জ্বল ফলাযুক্ত তূর্কী খঞ্জর ধরা ডান হাতটা উঁচু করে আর মসৃণ ত্বকযুক্ত গলায় চালিয়ে দেয়। উন্মুক্ত ক্ষতস্থান দিয়ে তরুণ প্রহরীর শেষ নিঃশ্বাস বুদ্বুদের মত বের হতে সে নিথর দেহটা মাটিতে নামিয়ে রাখে। পরিস্থিতি ভিন্ন হলে, সে হয়ত তাকে প্রাণে বাঁচিয়ে রাখতো, কিন্তু এখানে সেই উদারতা দেখাবার কোনো স্থান নেই যেখানে নিজের কোনো ভুলের খেসারত তাকে নিজের জীবন দিয়ে দিতে হতে পারে। সহজাত প্রবৃত্তির বশে সে খঞ্জরের ফলাটা নিজের আলখাল্লায় মুছে নেয়। তার সমস্ত চিন্তা জুড়ে এখন কেবল একটাই ভাবনা দরজার চকচক করতে থাকা ব্যাঘ্রখচিত পাল্লার অপর পাশে সে কি দেখতে পাবে। সে শুনেছে যে ‘শের’ মানে ব্যাঘ–যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে সে ঠিক জায়গায় পৌঁছেছে এবং শের আফগান মাত্র কয়েক ফিট দূরে রয়েছে।
তার ডান হাতে তখনও খঞ্জর ধরে রেখে, বার্থোলোমিউ বামহাতে ডানপাশের পাল্লার–এটাও আবার বাঘের মতই দেখতে–কারুকার্যখচিত ধাতব অর্গলটা সতর্কতার সাথে নামিয়ে আলতো করে কৌতূহলী একটা ধাক্কা দেয়। দরজার পাল্লাটা নিরবে আর মসৃণভাবে খুলে যেতে সে দারুণ। স্বস্তি পায়। পাল্লাটা যখন ছয় ইঞ্চির মত ফাঁক হয়েছে সে ধাক্কা দেয়া বন্ধ করে। ধুসর সোনালী আলোর একটা স্রোত তাকে জানায় সে যেমনটা আশা করেছিল তেমন অন্ধকার একটা কক্ষে সে প্রবেশ করতে যাচ্ছে না। শের আফগান সম্ভবত দরজার পাল্লাটা ইতিমধ্যেই খুলে যেতে দেখেছে এবং এখন নিজের তরবারি হয়ত কোষমুক্ত করছে…
বার্থোলোমিউ আর বেশিক্ষণ ইতস্তত না করে দরজার পাল্লা ধাক্কা দিয়ে খুলে দিয়ে কক্ষের ভেতর পা দেয়। সোনালী জরির কারুকাজ করা লাল রেশমের পর্দা শোভিত বিশাল একটা কামরা। তাঁর পায়ের নিচে নরম পুরু গালিচা এবং কলাই করা ধূপদানিতে জ্বলন্ত একটা স্ফটিক থেকে ঘোয়ার কুণ্ডলী বাতাসে ভেসে উঠছে। তেল পূর্ণ ব্রোঞ্জের দিয়ায় সলতেগুলো মিটমিট করে জ্বলছে। কিন্তু বার্থোলোমিউয়ের দৃষ্টিতে এসব কিছুই ধরা পড়ে না। সে কক্ষের মাঝামাঝি পর্দা টেনে এটাকে দুই ভাগকারী প্রায় স্বচ্ছ ধুসর গোলাপি মসলিনের পর্দা ভিতর দিয়ে সরাসরি তাকিয়ে রয়েছে। কাপড়ের ভিতর দিয়ে সে একটা নিচু বিছানা এবং সেটার উপরে একজন নারী আর একজন পুরুষের, পরস্পরগ্রন্থিত দুটো নগ্ন দেহ, দেখতে পায়। পুরুষটা নিজের রমণক্রিয়ায় এতটাই আবিষ্ট যে বার্থোলোমিউ যদি লাথি মেরেও দরজার পাল্লাটা খুলতে সে ব্যাপারটা খেয়ালই করতো না। মেয়েটা তাঁর পিঠের উপর ভর দিয়ে শুয়ে, সুগঠিত পা দুটো দিয়ে সঙ্গী পুরুষের পেষল কোমর জড়িয়ে রেখেছে যখন সে রমণের মাত্রা বৃদ্ধিতে বিভোর এবং তাঁর প্রেমিকের দেহ দরজার প্রতি তাঁর দৃষ্টিতে ব্যাহত করেছে।
ভাগ্য তাকে এরচেয়ে ভালো আর কোনো সুযোগ দিতে পারতো না। বার্থোলোমিউ কাছে এগিয়ে যাবার সময় ভাবে। সতর্কতার সাথে সে মসলিনের পর্দা অতিক্রম করে এবং পা টিপে টিপে সন্তর্পণে বিছানার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। সে এখন বিছানার এত কাছাকাছি চলে এসেছে যে সে পুরুষ লোকটার দেহের ঘামের চকচকে আভা দেখতে পায় এবং এর ঝাঁঝালো নোতা গন্ধ তাঁর নাকে ভেসে আসে কিন্তু বিছানায় ব্যস্ত পুরুষ আর নারী, যার মাথাটা একপাশে কাত হয়ে আছে, তার চোখ দুটোও বন্ধ, এখনও তার উপস্থিতি সম্বন্ধে একেবারে বেখেয়াল। রমণের মাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে তুঙ্গস্পর্শী অনুভূতির কাছাকাছি পৌঁছে গিয়ে শের আফগান উৎফুল্ল ভঙ্গিতে নিজের মাথা পেছনের দিকে হেলিয়ে দেয়। সে মাথা এমন করতেই, বার্থোলোমিউ লাফিয়ে সামনে এগিয়ে আসে, তার মাথার ঘন কালো চুল আঁকড়ে তাকে ধরে তাঁর মাথাটা আরো পিছনের দিকে টেনে আনে এবং গলার শ্বাস নালী একটানে নিখুঁতভাবে দুই ভাগ করে দেয়। বার্থোলোমিউ একজন দক্ষ আততায়ী। গলার মুখ ব্যাদান করে থাকা ক্ষতস্থান থেকে তাঁর উষ্ণ লাল রক্ত ছিটকে আসলে শের আফগান, ঠিক তোরণ রক্ষীর মত, একটা শব্দও করে না।
বার্থোলোমিউ ভারি দেহটা শক্ত করে ধরে, মুহূর্তের জন্য তখন খোলা চোখের দিকে তাকায় নিজেকে নিশ্চিত করতে যে লোকটা আসলেই শের আফগান তারপরে দেহটা ধাক্কা দিয়ে মেঝেতে ফেলে দেয় এবং সঙ্গিনী মেয়েটার দিকে মনোযোগ দেয় যে এখন চোখ খুলে রক্ষণাত্মক ভঙ্গিতে হাঁটু বুকের কাছে নিয়ে এসে বিছানায় উঠে বসেছে। তাঁর প্রেমিকের রক্ত তাঁর নিটোল স্তনের মাঝে দিয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে এবং তার কালো চোখের দৃষ্টি বার্থোলোমিউয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে যেন বুঝতে চেষ্টা করছে সে এরপর কি করবে। কোনো শব্দ করবেন না এবং আমিও তাহলে আপনার কোনো ক্ষতি করবো না, সে বলে। তাঁর মুখ থেকে একবারের জন্যও দৃষ্টি না সরিয়ে, সে ধীরে ধীরে একটা চাদর নিজের দেহের উপর টেনে নেয় কিন্তু কোনো কথা বলে না।
সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে–একজন মহিলাকে হত্যা করার চেয়ে সে কিছুতেই তরুণ প্রহরীকে হত্যা করতে বেশি আগ্রহী ছিল না–কিন্তু একই সাথে বলতেই হবে সে বিস্মিত হয়েছে। সে আশা করেছিল মেয়েটার মত এমন পরিস্থিতিতে যে কেউ উন্মত্তের মত চিৎকার করবে বা গালিগালাজ করবে কিন্তু যে লোকটা কিছুক্ষণ পূর্বেও পরম আবেগ আর প্রাণবন্ত ভঙ্গিতে আদিম খেলায় মেতে উঠেছিল এখন সেই মেঝেতে জমাট বাধা রক্তের মাঝে নিথর পড়ে রয়েছে দেখে তাঁর যতটা বিপর্যস্ত হওয়া উচিত ছিল তাকে ঠিক ততটা বিপর্যস্ত দেখায় না। তার চোখে মুখে বরং কৌতূহলের একটা অভিব্যক্তি ফুটে রয়েছে। সে টের পায় মেয়েটা তার পরনের গাঢ় রঙের, নোংরা আলখাল্লা এবং রক্ত রঞ্জিত হাত থেকে শুরু করে তাঁর মাথায় পেচানো পিঙ্গল বর্ণের কাপড়ের নিচে দিয়ে বের হয়ে আসা লালচে-সোনালী চুলের বিক্ষিপ্ত গোছা সবকিছু খুটিয়ে লক্ষ্য করছে।
সে চলে যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়ায়। সে ইতিমধ্যেই প্রয়োজনের চেয়ে বেশিক্ষণ অবস্থান করে ফেলেছে। মেয়েটার কাছে কোনো লুকান অস্ত্র থাকতে পারে ভেবে সে উল্টো হেঁটে দরজার কাছে পৌঁছে, প্রহরীদের উদ্দেশ্যে তার চিৎকারের শব্দ যেকোনো মুহূর্তে শুনবে বলে সে প্রস্তুত। কিন্তু সে দরজা দিয়ে বের হয়ে এসে, করিডোর দিয়ে নিচে নেমে পাথুরে সিঁড়ি দিয়ে নিচের নির্জন আর জনমানব শূন্য আঙিনায় পা রাখার পরেই সে কেবল একজন মহিলার তীক্ষ্ণ কণ্ঠের চিৎকার শুনতে পায় ‘খুন! সে অন্ধকার উদ্যানের ভিতর দিয়ে দৌড়ে যাবার সময় নিজের পেছনে একটা শশারগোল শুরু হবার আভাস শুনতে পায়–লোকের উত্তেজিত গলার আওয়াজ, দ্রুতগামী পায়ের শব্দ–কিন্তু সে এখন প্রায় দেয়ালের কাছে পৌঁছে গিয়েছে। বাঁশের ঝাড়ের ভিতর দিয়ে গায়ের জোরে এগিয়ে, সে নিজের কাটা ছেঁড়া নিয়ে কোনো চিন্তাই করে না, সে নিজেকে দেয়ালের উপর ছুঁড়ে দেয় এবং এই বার কোনো অসুবিধা ছাড়াই দেয়াল বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করে।
শহরের রাস্তায় পৌঁছাবার পরে সে মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়ায়। সে শের আফগানের জমাট রক্ত রঞ্জিত নিজের তূর্কী খঞ্জরটা তুলে নিয়ে সেটায় আলতো করে চুমু দেয়। সে এখন সহস্র মোহরের অধিকারী।
১.০৩ এক বিধবা নারী
‘আপনার স্বামীর মৃতদেহ গোসল করিয়ে আমরা তাকে দাফনের জন্য প্রস্তুত করেছি, হেকিম এসে বলেন। আমি ভেবেছিলাম যে আমরা তাকে কফিনে শোয়াবার পূর্বে আপনার আদেশ অনুযায়ী সবকিছু যে ঠিকমত পালিত হয়েছে আপনি সে বিষয়ে নিজেকে নিশ্চিত করতে চাইবেন।’
‘ধন্যবাদ।’ মেহেরুন্নিসা সামনে এগিয়ে আসেন এবং তাঁর স্বামীর মৃতদেহের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন। অনুগ্রহ করে আমাকে একটু একা থাকতে দিন…’ তাকে যখন সবাই একা রেখে যায় সে মৃতদেহের উপর ঝুঁকে আসে এবং শের আফগানের মুখটা খুটিয়ে দেখে, যা এমন নৃশংসভাবে মৃত্যুবরণ করা একজন লোকের তুলনায় বেশ প্রশান্ত দেখায়। হেকিম আর তার সহকারীরা মৃতদেহ পরিষ্কার করার সময় কর্পূর দেয়া যে পানি ব্যবহার করেছে মেহেরুন্নিসা তাঁর রুক্ষ গন্ধ টের পায়।
‘আপনাকে এভাবে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে বলে আমি সত্যিই দুঃখিত, সে ফিসফিস করে আপন মনে বলে, কিন্তু আমি মোটেই দুঃখিত নই আপনার কবল থেকে আমি মুক্তি পেয়েছি। আততায়ী যদি আপনার বদলে আমায় হত্যা করতো আপনি হয়তো ব্যাপারটা পরোয়া করতেন না। সে এক মুহূর্তের জন্য তার স্বামীর গালে আঙুলের অগ্রভাগ দিয়ে স্পর্শ করে। ‘আপনার ত্বক এখন শীতল কিন্তু আপনি সবসময়ে আমার এবং আমার কন্যার প্রতি শীতল অভিব্যক্তি প্রদর্শন করেছেন, ছেলে না হয়ে জন্মাবার জন্য আপনার কাছে যার কোনো গুরুত্বই ছিল না…’
মেহেরুন্নিসা চোখের কোনে কান্নার রেশ অনুভব করে, কিন্তু এই কান্না শের আফগানের জন্য নয়। সে যদিও আত্ম-করুণা অপছন্দ করে তবুও অক্ষর উপস্থিতি তাঁর নিজের জন্য এবং এমন একজন লোকের সাথে অতিবাহিত জীবনের নষ্ট সময়ের জন্য যে তার দেয়া যৌতুক কুক্ষিগত করার পরে তাকে নিজের বাসনা আর ক্ষমতা প্রদর্শন করার একটা বস্তুতে পরিণত করেছিল। লোকটার সাথে যখন তাঁর বিয়ে হয়েছিল তখন তার বয়স মাত্র সতের বছর। তাঁর প্রতি বিয়ের পরে লোকটার নিশ্চেতন উদাসীনতা বা–সে যদি কখনও অভিযোগ করার স্পর্ধা দেখাত–তাঁর রীতিবিবর্জিত আর দুর্বিনীত নিষ্ঠুরতার জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। সে মুখ ঘুরিয়ে নেয়, তার মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে এবং সে অসুস্থবোধ করে। আততায়ীর হামলার পরে ছয় ঘন্টাও এখনও অতিবাহিত হয়নি। তাঁর মানসপটে পুরো দৃশ্যটা এখনও দগদগে আর প্রাণবন্ত হত্যাকারীর চোখ-পারস্যের মার্জারের মত ধুসর নীল রং–সে যখন তাঁর শয্যার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল, তার খঞ্জরের ফলার রূপালী ঝিলিক, শের আফগানের কণ্ঠনালীর ক্ষতস্থান থেকে তার নগ্ন দেহে ছিটকে আসা উষ্ণ লাল রক্ত, তাঁর জীবন প্রদীপ নিভে যাবার ঠিক আগ মুহূর্তে তার স্বামীর মুখে ফুটে উঠা নিখান বিস্ময়। পুরো ব্যাপারটা এত দ্রুত ঘটে গিয়েছিল যে সে তখন ভয় পাবার সময়ই পায়নি, কিন্তু এখন যখন তার মনে হয় যে খুনী ইচ্ছা করলেই নিজের রক্তাক্ত খঞ্জর তার দিকে তাক করতে পারতো সে শিহরিত হয়। তরুণ দ্বাররক্ষীকে হত্যা করার সময় আততায়ী ক্ষনিকেন জন্য দ্বিধা করে নি…
অনুগত সৈন্যরা ইতিমধ্যে শহর তন্ন তন্ন করে হত্যাকারীর সন্ধান করেছে। তাঁর বর্ণনা থেকে একটা বিষয় নিশ্চিত হওয়া গেছে যে হত্যাকারী যেই হোক লোকটা ভিনদেশী। একজন নীল চোখঅলা লোকের সন্ধান ইতিমধ্যেই পাওয়া গিয়েছে–কারও মতে লোকটা পর্তুগীজ-শহরের সরাইখানায় লোকটা গত বেশ কয়েকদিন ধরেই অবস্থান করছিল কিন্তু এখন একেবারে যেন বাতাসে মিলিয়ে গিয়েছে… গ্রীষ্মের নিদাঘ তপ্ত দিন হওয়া সত্ত্বেও মেহেরুন্নিসা উষ্ণতার জন্য নিজেকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে, সে তাঁর স্বামীর মৃতদেহের দিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়ায় এবং সে যখন কিছু চিন্তা করতে চায় তখন যেভাবে পায়চারি করে সেভাবে হাঁটতে থাকে। তার কাছে হত্যাকারীর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে তার অভিপ্রায়। হত্যাকাণ্ডটা কি বড় কোনো অভ্যুত্থানের পূর্বাভাষ? গৌড় কি অচিরেই আক্রমণের সম্মুখীন হবে? যদি তাই হয়, তাহলে তাঁর নিজের এবং তাঁর কন্যার জীবনও হয়তো হুমকির সম্মুখীন হবে।
বা এমনও হতে পারে শের আফগানের মৃত্যু কারো ব্যক্তিগত প্রতিহিংসার ফসল? তাঁর স্বামী প্রচুর শত্রু তৈরি করেছিলেন। সে প্রায়ই তার কাছে দম্ভোক্তি করতে কীভাবে সে নিজেকে ধনী করতে রাজকীয় অর্থ তছরূপ করার পাশাপাশি প্রজাদের কাছ থেকে নিজের এক্তিয়ারের বেশি খাজনা আদায় করেছে। সে তাকে আরও বলেছিল গৌড়ের উত্তরের ডাকাত সর্দারদের অবাধে ডাকাতির সুযোগ দিয়ে কীভাবে তাঁদের কাছ থেকে ঘুষ নিয়েছিল, এবং মেহেরুন্নিসা জানে যে গত বর্ষা মওসুমে বৃষ্টি শুরু হবার ঠিক আগ মুহূর্তে, বেশ কয়েকজন ধনী বণিক আগ্রায় অভিযোগ জানাতে তাঁদের চাপে পড়ে, সে তার কথার বরখেলাপ করে অবিশ্রান্তভাবে ডাকাতদের ধাওয়া করতে শুরু করেছিল এবং সে যাদের হত্যা করেছিল হুশিয়ারী হিসাবে তাদের ছিন্ন মস্তক শহর রক্ষাকারী প্রাচীরের উপরে গেঁথে রেখেছিল। শের আফগান নিহত হওয়ায় অনেক লোকই খুশি হয়েছে, কিন্তু তাকে তার নিজের শয়নকক্ষে হত্যা করার মত সাহস কার হতে পারে?
কক্ষের বাইরে থেকে বেশ কয়েকটা কণ্ঠস্বর ভেসে আসতে–শবাধারের নির্মাতারা সম্ভবত শবদেহের মাপ নিতে এসেছে–মেহেরুন্নিসা জোর করে এসব ভাবনা থেকে নিজেকে সরিয়ে আনে। আগামী দিনগুলোতে সে অবশ্যই তার নিজের এবং তাঁর মেয়ের প্রতি কোনো ধরনের হুমকির বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখবে কিন্তু এই মুহূর্তে তাকে একজন শোকাতুর বিধবার ভূমিকায় অভিনয় করতে হবে। তার পরিবারের সম্মানের বিষয়টা এর সাথে জড়িয়ে আছে। সে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার কৃত্যানুষ্ঠান একজন বিবেকবান স্ত্রীর মতই পালন করবে এবং তাকে দেখে কারো মনে কোনো ধরনের সন্দেহের উদ্রেক হবে না যে নিজের অন্তরে সে মুক্তির আনন্দ ছাড়া কোনো রকমের দুঃখ অনুভব করছে না।
*
জাহাঙ্গীরের নিভৃত কক্ষে ধুলিতে আচ্ছাদিত চুল নিয়ে ভ্রমণজীর্ণ বার্থোলোমিউ হকিন্স উপস্থিত হয়। যদিও মাঝরাত অতিক্রান্ত হতে চলেছে, ফিরিঙ্গি লোকটার আগমনের সংবাদ শুনে জাহাঙ্গীর তার খবরের জন্য অস্থির হয়ে রয়েছে।
‘বেশ, কি অবস্থা বলো?
‘সুলতান, কাজটা সম্পূর্ণ হয়েছে। আমি নিজ হাতে তার কণ্ঠনালী চিরে দিয়েছি।’
‘কেউ তোমাকে দেখে ফেলেনি তো?
‘তাঁর শয্যাসঙ্গী এক রমণী ছাড়া আর কেউ দেখতে পায়নি।’
জাহাঙ্গীর পলকহীন চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকে, মুখে সহসা ভীতিবিহ্বল অভিব্যক্তি ফুটে উঠেছে। তুমি তার কোনো ক্ষতি করোনি?
না, সুলতান।
‘তুমি পুরোপুরি নিশ্চিত?
‘আমি আমার জীবনের দিব্য করে বলতে পারি।’
বার্থোলোমিউর চেহারায় ফুটে উঠা বিমূঢ়তা জাহাঙ্গীরের দৃষ্টি এড়ায় না। স্পষ্টতই বোঝা যায় লোকটা সত্যি কথাই বলছে। সে ক্রমশ স্বস্তির সাথে শ্বাস নিতে আরম্ভ করে। তুমি তোমার দায়িত্ব ভালোমতই পালন করেছে। আগামীকাল সকালে আমার কচিদের একজন তোমাকে তোমার অর্থ পৌঁছে দেবে…’ তাঁর মনে সহসা অন্য একটা ভাবনা খেলা করতে সে কথা শেষ করে না। তুমি এখন কি করবে বলে ঠিক করেছো? নিজের দেশে ফিরে যাবে?
‘সুলতান, আমি ঠিক নিশ্চিত নই।’
‘তুমি যদি আমার দরবারে অবস্থান করো তাহলে আমি তোমাকে আরও অনেক কাজ দিতে পারি। তুমি যদি আমার অর্পিত দায়িত্ব ঠিকমত পালন করো যা তুমি ইতিমধ্যেই একবার করেছো, তুমি নিজের জাহাজ কিনে দেশে ফিরে যাবার মত ধনী আমি তোমায় করে দিতে পারি।’ বার্থোলোমিউ হকিন্সের রোদে পোড়া মুখ থেকে তার সমস্ত ক্লান্তি মুছে গিয়ে সহসা তাঁর চোখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠে। জাহাঙ্গীর মনে মনে ভাবে, সে একসময় যেমন বিশ্বাস করতো মানুষকে বুঝতে পারাটা আসলে ততটা কঠিন নয়।
*
শীতের প্রকোপ থেকে রক্ষা করতে পর্যাপ্ত সংখ্যক গালিচা আর পশমের কম্বল থাকা সত্ত্বেও, মেহেরুন্নিসাকে খাইবার গিরিপথের ভিতর দিয়ে কাবুল অভিমুখে বহনকারী গরুর গাড়িটা মোটেই আরামদায়ক ছিল না। সে বাংলা থেকে শুরু হওয়া এই দীর্ঘ যাত্রাটা কখন শেষ হবে সেই অপেক্ষা করছে। তাঁর মেয়ে লাডলী বেগম, ফারিশার কোলে মাথা রেখে, মেয়ের লালনপালনের জন্য নিয়োজিত পার্সী মহিলা, যে জন্মের সময় থেকে তাঁর তত্ত্বাবধায়নের দায়িত্বে রয়েছে, অঘোরে ঘুমিয়ে আছে। বাচ্চা মেয়েটা নদীপথে নৌকায় গঙ্গার উপর দিয়ে পশ্চিমমুখী এবং তারপরে যমুনা নদীর উপর দিয়ে উত্তরমুখী যাত্রা খুবই উপভোগ করেছিল, কিন্তু শেষ ছয়শ মাইল স্থলপথে ভ্রমণের জন্য তাঁরা দিল্লির কাছে নৌকা থেকে অবতরণের পর থেকেই মেয়েটা ক্রমশ খিটখিটে হয়ে উঠেছে। গরুর গাড়ির ছইয়ের অভ্যন্তরে চতুর্দিক মোটা পর্দা দিয়ে ঘেরা থাকায়, ভিতরটা শ্বাসরুদ্ধকর আর অন্ধকার। ছয় বছরের লাডলী বেগমের এখনও বোঝার বয়স হয়নি যে তাঁদের সাধারণের দৃষ্টির আড়ালে রাখতে অবশ্যই পর্দা টানা থাকতে হবে। দিনের শেষে যাত্রা বিরতি করতে যখন অস্থায়ী ছাউনি স্থাপন করা হয় মেয়েটা কেবল সেই সময়টুকু খানিকটা উপভোগ করে এবং কাঠের উঁচু অস্থায়ী কাঠামো দিয়ে মেয়েদের জন্য পৃথক করা স্থানে সে তখন কিছুক্ষণ দৌড়াদৌড়ি করতে পারে।
কিন্তু তারা অন্ততপক্ষে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে। তারা মওসুমের প্রথম তুষারপাতের পূর্বেই গিরিপথ অতিক্রম করবে। শীতের প্রকোপ কাবুলে ভীষণ তীব্র। মেহেরুন্নিসার তাঁর বাবার বাড়ির ছাদের প্রান্তদেশে মানুষের হাতের মত মোটা ঝুলন্ত তুষারিকার কথা এখনও মনে আছে এবং শহরের প্রতিরক্ষা প্রাচীরের বাইরে তুষার শুভ্র বিস্তৃর্ণ অঞ্চলে মাঝে মাঝে খাবারের সন্ধানে ক্ষুধার্ত নেকড়ে ছাড়া আর বেশি কিছু চলাফেরা করতো না। যদিও বাংলার উষ্ণ আর স্যাঁতসেঁতে বাতাসের মাঝে গালে কনকনে শীতল বাতাসের স্পর্শ পেতে এবং শ্বাস নেয়ার সময় হিমশীতল বাতাসের কুণ্ডলী দেখতে তার বহুবার ইচ্ছে হয়েছে।
সে যখন গৌড় ত্যাগ করে রওয়ানা হয়েছিল তখনও শের আফগানের হত্যাকারীর কোনো সন্ধান পাওয়া যায় নি এবং হত্যাকাণ্ডের পেছনের অভিপ্রায় সম্বন্ধেও কোনো কিছু জানা যায় নি। পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ থাকায় সে স্বস্তি পেয়েছিল এবং একই সাথে গৌড় এখন তাদের থেকে বহুদূরে থাকায় সে খুশি। তাঁর দীর্ঘ যাত্রার জন্য যাবতীয় প্রস্তুতি তাঁর আব্বাজানই গ্রহণ করবেন বলে সে আশা করেছিল এবং সে কারণেই তিনি যখন তাকে চিঠি লিখে জানান যে গৌড়ের পশ্চিমে গঙ্গার তীরে মুঙ্গের দূর্গ থেকে রাজকীয় সৈন্যের একটা বহর কাবুল পর্যন্ত পুরোটা পথ তার সাথে অবস্থান করবে সে তখন সত্যিই বিস্মিত হয়েছিল। মহামান্য সম্রাট তোমার দুঃখ ভারাক্রান্ত পরিস্থিতিতে তোমার জন্য শোক প্রকাশ করেছেন। তাঁর ইচ্ছা তুমি দ্রুত আর নিরাপদে তোমার পরিবারের কাছে ফিরে আসো, তার আব্বাজান চিঠিতে লিখেছিলেন। সম্রাট আমাকে আমার প্রত্যাশার অতীত অনুগ্রহ প্রদর্শন করেছেন। তোমার জন্য আমার আশীর্বাদ রইল। চিঠিতে গিয়াস বেগের দস্ত খত আর কাবুলের কোষাধ্যক্ষের বিশাল সীলমোহর দিয়ে সেটা বাঁধা ছিল।
মেহেরুন্নিসা, তাঁর দীর্ঘ যাত্রা পথে, প্রায়শই তাঁর আব্বাজানের কথাগুলো নিয়ে চিন্তা করেছে। তাঁদের পরিবারের প্রতি সম্রাটের এই উদারতার উৎস সম্ভবত কাবুলে বর্তমান সম্রাটের, তখন তিনি যুবরাজ, অতিবাহিত সেই মাসগুলোতে নিহিত যখন তার আব্বাজান সম্রাট আকবর-তাকে সেখানে নির্বাসিত করেছিলেন। যুবরাজের আগমনের বহু পূর্বেই গুজব ছড়িয়ে গিয়েছিল, আকবরকে ভীষণভাবে ক্রুদ্ধ করেছিলেন জাহাঙ্গীর। কাবুলের শাসনকর্তা, সাইফ খানের স্ত্রী মেহেরুন্নিসার আম্মিজানকে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে ছিল যে আসলেই কি ঘটেছিল–যুবরাজ তার আব্বাজানের একজন উপপত্নীর সাথে আপত্তিকর অবস্থায় ধরা পড়েছিলেন। তাকে নির্বাসিত করে শাস্তি দেয়া হলেও মেয়েটার কপালে জুটেছিল মৃত্যুদণ্ড…
তার আব্বাজানের বাড়ির নিয়মিত অতিথিতে পরিণত হয়েছিলেন যুবরাজ। শহরের দূর্গপ্রাসাদ থেকে যুবরাজের রওয়ানা হবার সংবাদ নিয়ে বার্তাবাহক যখন উপস্থিত হতো তখন তাঁদের প্রস্তুতির কথা এখনও তাঁর দিব্যি মনে আছে–কীভাবে তাঁর আম্মিজান ধূপদানিতে মূল্যবান ধূপ জ্বালাতে আদেশ দিতেন, কীভাবে তাঁর আব্বাজান নিজের দামী আলখাল্লাগুলোর একটা পরিধান করতেন এবং তাকে অভ্যর্থনা জানাতে দ্রুত প্রবেশ পথের দিকে এগিয়ে যেতেন। একটা রাতের কথা তাঁর বিশেষভাবে মনে আছে তার আব্বাজান–যিনি তাকে কোনো আভাসই দেননি তিনি কি চান সে সম্বন্ধে–তাদের সম্মানিত অতিথির জন্য পারস্যের ধ্রুপদী নাচের একটা প্রদর্শনের জন্য তাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। তাঁর পরিচারিকার দল তার চুল ভালো করে বেঁধে আর সুগন্ধি ধোয়া দিয়ে সুরভিত করলে সে বিচলিত বোধ করার সাথে সাথে উত্তেজিতও হয়েছিল। সে সোনালী বৃক্ষের নৃত্য প্রদর্শন করেছিল, তার দু’হাতে বাঁধা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সোনালী ঘন্টা, শরতে গাছ থেকে বনের মাটিতে ঝরে পড়া সোনালী পাতায় আসন্ন শীতের হিমশীতল বাতাসের দ্বারা সৃষ্ট আলোড়ন প্রতীকায়িত করেছিল।
সে নাচের মুদ্রা ঠিক করতে এতই মগ্ন ছিল–ভীষণ জটিল একটা নাচ যা নিখুঁত করতে সে তাঁর ওস্তাদজির কাছে ঘন্টার পর ঘন্টা অভ্যেস করেছে–যে নাচের শুরুতে সে সরাসরি যুবরাজের দিকে তাকায়নি। তারপরে যখন, নাচের আবেশ তাকে আচ্ছন্ন করতে আরম্ভ করে, সে যুবরাজের চোখের দিকে নিজের চোখ তুলে তাকায়, মেহেরুন্নিসা তার দৃষ্টির ঐকান্তিকতা অনুভব করতে পারে। সেই সময়ে সে কোনো কারণে বুঝতে পারে নি এবং এখন, এত বছর পরেও, ব্যাপারটা বোধগম্যতার বাইরেই রয়েছে, সে তার নেকাব ইচ্ছে করেই ফেলে দিয়েছিল। তিন বা চারবারের জন্য এর বেশি নয়–সে যুবরাজকে নিজের মুখ দেখতে দিয়েছিল এবং সে জানে তিনি এতে খুশিই হয়েছিলেন।
সম্রাট আকবর এর কিছু দিন পরেই, নিজের সন্তানকে আগ্রা ফিরে আসবার আদেশ দেন। মেহেরুন্নিসাও ততদিনে শের আফগানের সাথে তাঁর আসন্ন বিয়ের নানা ভাবনায় আপ্লুত হয়ে পড়েছে। মোগল রাজদরবারে কপর্দকশূন্য অবস্থায় আগত এক পার্সী অভিজাত ব্যক্তির মেয়ের জন্য এরচেয়ে উপযুক্ত সম্বন্ধ আর হতে পারে না। সম্রাটের অধীনে চাকরি এবং কাবুলের উপর দিয়ে অতিক্রমকারী বণিকদের সাথে বিভিন্ন ব্যবসায়ী উদ্যোগের কারণে তাঁর আব্বাজান যদিও যথেষ্ট সম্পদ অর্জন করেছিলেন, নিজের মেয়েকে তিনি বিশাল যৌতুক দিতে পারলেও–দশ সহস্র সোনার মোহর–তাঁর নিজের কোনো জমি, কোনো বিশাল মহল ছিল না। শের আফগান অন্য দিকে প্রাচীন এক মোগল অভিজাত বংশের সন্তান, তাঁর প্রপিতামহ বাবরের সাথে, প্রথম মোগল সম্রাট, তার হিন্দুস্তান অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন। মেহেরুন্নিসা তাঁর আসন্ন বিয়ের প্রস্তুতির জন্য সে যুবরাজকে–বা সম্রাটকে যা এখন তিনি–জোর করে নিজের মনের এক কোণে সরিয়ে দিয়েছিল: সত্যি হতে পারতো এমন এক মধুর বাঁধনহারা কল্পনা।
গরুর গাড়িটা সহসা সশব্দে কম্পিত হয়। মেহেরুন্নিসা ভাবে, গাড়ির সামনের কোনো একটা চাকা হয়ত বড় কোনো শিলাখণ্ডের সাথে ধাক্কা খেয়েছে। এই যাত্রাটা যখন শেষ হবে সে তখন আন্তরিকভাবেই খুশি হবে।
*
মেহেরুন্নিসা তাঁর আব্বাজান তার জন্য তাবরিজ থেকে সম্প্রতি আগত এক বণিকের কাছ থেকে পার্সী কবি ফেরদৌসের সংগৃহীত কবিতার যে খণ্ডটা ক্রয় করেছেন একপাশে সরিয়ে রাখে, উঠে দাঁড়ায় এবং আড়মোড়া ভাঙে। কোনো একটা কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে, সে তার আব্বাজানের বাসার সমতল ছাদে উঠতে শুরু করে, মেহেদী দেয়া নাঙা পায়ের নিচে পাথরের নিচু ধাপের উষ্ণতা সে দারুণ উপভোগ করে। সে ছাদে উঠে প্রথমেই উত্তরের দিকে তাকায়। তুষারাবৃত পাহাড়ের প্রেক্ষাপটে সেখানে শহরের তত্ত্বাবধায়নে পাহাড়ের রুক্ষ চূড়ায় স্থাপিত ভয়ালদর্শন দূর্গপ্রাসাদ অবস্থিত।
সে গৌড়ে থাকাকালীন সময়ে প্রায়ই এই স্থাপনাটার কথা ভাবতো–এর নিরেট শক্তিশালী দেয়ালের ক্ষুদ্রাকৃতি রন্ধগুলোর কাবুলের উপর সতর্ক দৃষ্টি রাখা চোখের সাথে কি ভীষণ মিল। দূর্গপ্রাসাদটা যদিও শাসনকর্তার বাসভূমি, তাঁর আব্বাজান তাকে বলেছে স্থাপনাটার কোথাও বিলাসিতার নামগন্ধও খুঁজে পাওয়া যাবে না–বাবরের আগমনের বহু পূর্বে নির্মিত পাথরের শীতল একটা দূর্গ যেখান থেকে বাবর তাঁর হিন্দুস্তান অভিযান সূচনা করেছিলেন। সে যাই হোক তার ইচ্ছা এমন বিশাল একটা উচ্চাকাঙ্খ যেখানে অঙ্কুরিত হয়েছিল সেই স্থানটার ভেতরটা সে যদি একবার ঘুরে দেখতে পেতো। বিজয়ের অভিপ্রায়ে আয়োজিত যুদ্ধযাত্রায় দূর্গপ্রাসাদের ভিতর থেকে মোগল সৈন্যের স্রোত বের হয়ে আসছে যা লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন বদলে দেবে নিশ্চয়ই সেটা দেখার মতই একটা দৃশ্য ছিল? নিজের উচ্চাকাঙ্খকে বাস্তবে রূপান্তরিত হতে দেখে বাবরের অভিব্যক্তি কেমন হয়েছিল?
এবং সে কি কখনও সত্যিই হুসটা বুঝতে পারবে? সে যদি তার বড়ভাই আসফ খানের মত, এখন শাহী সেনাবাহিনীতে একজন সেনাপতি এবং এখান থেকে হাজার মাইল দক্ষিণে দাক্ষিণাত্যে একটা অভিযানের দায়িত্ব পালন করছেন, বা তার ছোটভাই মীর খানের মত, গোয়ালিওরের শাহী সেনানিবাস যেখানে সম্রাটের সন্তান খসরুকে অন্তরীণ রাখা হয়েছে সেখানে দায়িত্ব পালন করছে, একজন পুরুষ হিসাবে জন্ম গ্রহণ করতো, সে তাহলে হয়তো পৃথিবীর আরো অনেক কিছু দেখতে পেতো, আরো অনেক বেশি কিছু বুঝতে পারতো… তার আব্বাজানও তাহলে সম্ভবত পারস্য থেকে আগ্রা অভিমুখে বিপদসঙ্কুল যাত্রাপথে জন্মের সাথে সাথে তাকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাতে পথের মাঝে পরিত্যাগ করতো না, কাজটা করতে তাঁর যতই অনিচ্ছা থাকুক, এবং ভাগ্য আর একজন বন্ধুবৎসল বণিক তাকে উদ্ধারের সুযোগ দিলে তিনি তখন যতই আনন্দিত হোন। তাঁর প্রতি আব্বাজানের ভালোবাসার চেয়ে তিনি সেই মুহূর্তে নিজের নিরাপত্তাকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন এই ভাবনাটা–এবং সে ভালো করেই জানে বাবা-মা দুজনেই তাকে ভীষণ ভালোবাসে–এমন একটা ব্যাপার যা সবসময়েই তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে। বাংলায় তার তিক্ত অভিজ্ঞতা এর সাথে যুক্ত হতে, সে জানে, মানুষ আর তাঁদের অভিপ্রায়ের বিষয়ে তাঁর মাঝে নৈরাশ্যবাদী একটা মনোভাবের জন্ম দিয়েছে। সঙ্কটকালে খুব কম মানুষই নিজেকে ছাড়া অন্য আর কিছু ভাববার সামর্থ্য রাখে।
আর তাছাড়া, একজন রমণীর জীবন, তাঁর নিজের জীবন, এখানে তাঁর আব্বাজানের বাসায় কিংবা পরবর্তীতে গৌড়ে অবস্থান কালে শের আফগানের হেরেমে, যেখানেই হোক ভীষণ সীমাবদ্ধ। সে যখন থেকে বুঝতে শিখেছে তখন থেকেই বিভিন্ন বিষয়ে তার দারুণ কৌতূহল… পশ্চিমে তাঁদের পরিবারের আদি বাসস্থান পারস্য সম্বন্ধে আর কীভাবে শাহ্ সেই সাম্রাজ্য শাসন করেন; উত্তর-পূর্বদিকে সমরকন্দের গম্বুজ আর মিনারগুলোয় আসলেই কি সে গল্পগাথায় যেমন শুনেছে নীল, সবুজ আর সোনালী রঙ ঝিলিক দেয়। তাঁর আব্বাজান–সে যখন তাকে জোর করে তার নথিপত্রের সামনে থেকে তুলে আনতে পারতো–তার প্রশ্নের যথাসাধ্য উত্তর দিতে চেষ্টা করতেন কিন্তু সে আরো অনেক বেশি কিছু জানতে চায়। পাঠাভ্যাস তার হতাশা প্রশমিত করতে সাহায্য করেছে। গৌড়ে স্বপ্নভঙ্গের প্রথম ধাক্কা সামলে নেয়ার পরে শের আফগানের সাথে জীবন অনেক সহনীয় করে তুলেছিল তাঁর সংগৃহীত পাণ্ডুলিপিগুলো। কিন্তু পাণ্ডুলিপিগুলো সেই সাথে তাঁর অস্থিরতা, তাঁর অসন্তোষও বাড়িয়ে দিয়েছিল। তার পঠিত সবকিছু–পর্যটকের রোজনামচা, এমনকি কবিতা–তার আগে থেকেই প্রাঞ্জল কল্পনাকে আরো উদ্দীপিত করে, ইঙ্গিত দেয় জীবন গৌড়ে সেনাপতির হারেমে ভালোবাসাহীন সহবাস কিংবা তার পৈতৃক বাড়িতে ঘরোয়া আনন্দফুর্তির চেয়েও অনেক বেশি সম্ভাবনায় উদ্বেল।
সে সহসা নিচের আঙিনায় একটা হৈচৈ এর শব্দ শুনতে পায়। মেহেরুন্নিসা ছাদের উপর দিয়ে লাল আর কমলা রঙের পর্দার দিকে দ্রুত হেঁটে গিয়ে যা পথচারীদের দৃষ্টি থেকে আঙিনা সংলগ্ন ছাদের অংশটা ঘিরে রেখেছে, উঁকি দিয়ে নিচে তাকায়। একজন সেনাপতি আর নিশানা-বাহকের নেতৃত্বে রাজকীয় অশ্বারোহীদের একটা বহর নিচের আঙিনায় প্রবেশ করছে। অশ্বারূঢ় সৈন্যরা ঘোড়া থেকে নামতেই তাঁর আব্বাজানের সহিসেরা বাড়ির ভেতর থেকে দ্রুত বের হয়ে এসে লাগামগুলো ধরে এবং কিছুক্ষণ পরেই স্বয়ং গিয়াস বেগের কৃশকায় দীর্ঘদেহী অবয়ব সেখানে উপস্থিত হয়। চকিতে মাথা নত করে এবং ডানহাতে নিজের বুক স্পর্শ করে সে সেনাপতিকে বাড়ির ভেতর নিয়ে যায়। লোকগুলো কেন এসেছে? সে মনে মনে ভাবে।
আগত অন্য সৈন্যরা আঙিনার চারপাশে হাঁটাহাঁটি শুরু করে, গল্পগুজব আর হাসি ঠাট্টায় মেতে উঠে আর বৃদ্ধ ফল বিক্রেতার কাছ থেকে কেনা আখরোট–তাঁর মুখের বলিরেখার মতই তাঁর বিক্রীত বাদামগুলো কোঁচকানো–ভেঙে খুঁটে খুঁটে খেতে থাকে, যে সচরাচর সেখানেই নিজের পসরা সাজিয়ে বসে। কিন্তু সে যতই কান খাড়া করে শুনতে চেষ্টা করুক তাদের কোনো কথাই বুঝতে পারে না। সময় অতিবাহিত হতে থাকায় এবং রাজকীয় সেনাপতি তাঁর আব্বাজানের সাথেই অবস্থান করায়, মেহেরুন্নিসা পুনরায় মেয়েদের আঙিনায় নেমে আসে এবং তাঁর তেপায়ার উপরে বসে পড়ার জন্য আরো একবার পাণ্ডুলিপিটা হাতে তুলে নেয়। আঙিনায় ছায়া ক্রমশ দীর্ঘ হতে শুরু করতে এবং দু’জন পরিচারিকা তেলের প্রদীপের সলতেয় আগুন জ্বালাতে শুরু করছে তখন মেহেরুন্নিসা তাঁর আব্বাজানের কণ্ঠস্বর শুনতে পায়। মুখ তুলে তাকাতে, সে দেখে তাকে ক্রুদ্ধ দেখাচ্ছে।
‘আব্বাজান, কি ব্যাপার?
তিনি পরিচারিকাদের চলে যাবার ইঙ্গিত করেন তারপরে লম্বা আঙুলগুলো দিয়ে নীলা বসান সোনার আঙুরীয়টি অস্থির ভঙ্গিতে ঘোরাবার মাঝে, তাঁর পাশে আসনসিঁড়ি হয়ে বসে পড়েন, সে তার জন্মের পর থেকেই তাকে বাম হাতের তৃতীয় আঙুলে অঙ্গুরীয়টি পরিধান করতে দেখে আসছে। সে পূর্বে কখনও তাঁর আব্বাজানকে–সাধারণত শান্ত আর সংযত–এমন অবস্থায় দেখেনি। তিনি কথা শুরু করার আগে কিছুক্ষণ ইতস্তত করেন, তারপরে এমন একটা স্বরে কথা বলতে শুরু করেন যা মোটেই তাঁর স্বাভাবিক কণ্ঠস্বর নয়। আমি তোমায় গৌড়ে যে চিঠিটা পাঠিয়েছিলাম তোমার কি সেটার কথা স্মরণ আছে? তোমায় বাসায় পৌঁছে দিতে নিরাপত্তা সহচর হিসাবে রাজকীয় সৈন্য প্রেরণ করায় সম্রাটের উদারতায় আমি যে বিস্মিত হয়েছিলাম…?
‘হ্যাঁ।
‘আমি তোমায় তখন পুরো বিষয়টা খুলে বলিনি…সম্রাটের সম্ভাব্য অভিপ্রায় কি হতে পারে সে সম্বন্ধে আমার একটা ধারণা ছিল।
‘আপনি কি বলতে চাইছেন?
‘এই কাবুল শহরে কয়েকবছর আগে একটা ঘটনা ঘটেছিল–যার সাথে তোমার একটা সম্পর্ক রয়েছে। আমি বিষয়টা তোমাকে কখনও বলিনি কারণ আমার মনে হয়েছিল বিষয়টা না জানাই তোমার জন্য উত্তম। ঘটনাপ্রবাহ যদি ভিন্ন হতো তাহলে আমি একাই বিষয়টা সম্বন্ধে অবহিত থাকার ব্যাপারটা আমার মৃত্যুর সাথে সাথে করে নিয়ে যেতাম… আমাদের বর্তমান সম্রাট তখনও কেবল একজন যুবরাজ, আমাদের এই কাবুলে নির্বাসিত, সে সময়ে আমি আর তিনি নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করতাম। আমি যদিও ছিলাম তাঁর আব্বাজানের একজন মামুলি কোষাধ্যক্ষ, আমার মনে হয়েছিল একজন শিক্ষিত ব্যক্তি হিসাবে তিনি আমার সঙ্গ উপভোগ করেন–আমাকে একজন বন্ধু হিসাবেও হয়ত বিবেচনা করেন। সেজন্যই একরাতে আমি তোমায়, আমার একমাত্র মেয়ে হিসাবে, তাঁর মনোরঞ্জনের জন্য নাচতে বলেছিলাম। আমার একমাত্র অভিপ্রায় ছিল আমার সাধ্যের শেষপ্রান্তে গিয়ে তাকে শুভেচ্ছাজ্ঞাপন করা। কিন্তু অচিরেই–খুব সম্ভবত পরের দিনই, আমি ঠিক নিশ্চিত নই–তিনি আমার সাথে দেখা করতে আসেন… তিনি কি দাবি করেছিলেন তুমি কি ধারণা করতে পারো? গিয়াস বেগের দৃষ্টিতে ক্ষুরধার তীক্ষ্ণতা।
না।
তিনি তাঁর স্ত্রী হিসাবে তোমায় পেতে চেয়েছিলেন।’
মেহেরুন্নিসা এত দ্রুত উঠে দাঁড়ায় যে তার তেপায়া একপাশে উল্টে যায়। তিনি আমায় বিয়ে করতে চেয়েছিলেন…?
‘হ্যাঁ। কিন্তু আমি তাকে বলেছিলাম তোমার সাথে ইতিমধ্যে শের আফগানের বাগদান সম্পন্ন হয়েছে–যে আমার পক্ষে কোনোমতেই এই অঙ্গীকারের অবমাননা করা অসম্ভব…’
মেহেরুন্নিসা দু’হাত আঁকড়ে ধরে, বাড়ির ভিতরের আঙিনায় অস্থির ভঙ্গিতে পায়চারি করতে থাকে। তার আব্বাজান জাহাঙ্গীরকে মুখের উপর না বলেছিলেন… বাংলার পূতিগন্ধময় উষ্ণ আবহাওয়ায় অনুভূতিহীন, নিষ্ঠুর শের আফগানের স্ত্রী হবার বদলে সে মোগল রাজদরবারের, সবকিছু যা গুরুত্বপূর্ণ তাঁর কেন্দ্রের কাছাকাছি, এক যুবরাজের স্ত্রী হতে পারতো। কেন? তিনি এটা কীভাবে করতে পারলেন? তাকে এমন নির্মমভাবে সবকিছু থেকে বঞ্চিত করার পেছনে তার কি অভিপ্রায় কাজ করেছিল? সমস্ত পরিবারের সাথে সাথে তিনি নিজেও এই সম্বন্ধের ফলে উপকৃত হতেন… ‘আমার উপরে তুমি রাগ করেছে এবং সম্ভবত তোমার রাগ করাটা সঙ্গত। আমি জানি শের আফগানের সাথে তোমার বিয়েতে তুমি সুখী হওনি, কিন্তু আমার পক্ষে সেটা আগে থেকে বোঝা সম্ভব ছিল না। আমার মনে হয়েছিল আমি যা করেছি সেটা করা ব্যতীত আমার সামনে আর কোনো পথ খোলা ছিল না। আর তাছাড়া, যুবরাজ নিজেও তখন তাঁর আব্বাজানের নির্দেশে নির্বাসিত। তোমায় বিয়ে করার জন্য তাকে তার আব্বাজানের অনুমতি নিতে হতো এবং তাঁর পক্ষে তখন অনুমতি লাভ করাটা অসম্ভব ছিল। সেই সময়ে ম্রাট হিসাবে অভিষিক্ত হবার বদলে তাঁর মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হবারই সমূহ সম্ভাবনা ছিল। সম্রাটের কাছে তার সাথে আত্মীয়তা করার বিষয়টা আমাদের পরিবারের জন্য সুখকর নাও হতে পারতো। গিয়াস বেগ দম নেয়ার জন্য থামেন।
মেহেরুন্নিসার কাছে তাঁর আব্বাজানের মুষলধারে এখনকার এই সাফাই দেয়ার ভিতরে একটা স্ববিরোধিতা চোখে পড়ে। যুবরাজ জাহাঙ্গীরের প্রস্তাব আব্বাজান ফিরিয়ে দিয়েছিলেন নিজের সম্মান বাঁচাতে নাকি নিজের স্বার্থে? কিন্তু সে বেশিক্ষণ ভাববার সময় পায় না তিনি আবার কথা শুরু করেন।
‘আমার অন্য আরো কিছু বলার আছে সেটা আগে শুনে নাও তারপরে তুমি হয়তো আমার প্রতি এত বিরূপ মনোভাব পোষণ করবে না। সম্রাট আমাকে তাঁর রাজকীয় খাজাঞ্চিখানার নিয়ন্ত্রক হিসাবে নিয়োগ দিয়ে, আগ্রা যাবার আদেশ দিয়েছেন। তাঁর আব্বাজানের চোখ সহসা অশ্রুসজল হয়ে উঠে–মেহেরুন্নিসা আগে কখনও তার আব্বাজানের চোখে অশ্রু দেখেনি। ‘গত বিশটা বছর এবং আরো বেশি সময়–আমরা সপরিবারে প্রথম এখানে আসবার পর থেকেই–আমি সবসময়ে সেই মুহূর্তটার কথা ভাবতাম যখন আমাকে আমার গুণাবলীর জন্য স্বীকৃতি দেয়া হবে এবং আমি গুরুত্বপূর্ণ কোনো পদে মনোনীত হবে। আমি সেই আশা ত্যাগ করেছিলাম এবং পরিস্থিতির সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে শিখেছিলাম… কিন্তু আরো বিষয় আছে। সম্রাট লিখেছেন যে তুমি রাজকীয় হেরেমে সম্রাট আকবরের একজন বিধবা পত্নীর সঙ্গিনী হবে। বাছা আমার, আমার মনে হয় না তোমায় তিনি ভুলতে পেরেছেন। এখন তুমি যখন বিধবা আর তিনি একজন সম্রাট, তিনি এখন সেই পদক্ষেপ নিতে পারেন যেটা তিনি যখন কেবল যুবরাজ আর তুমি অন্য আরেকজন লোকের প্রতি অঙ্গীকারবন্ধ থাকায় তখন করতে পারেন নি।
*
ছয়দিন পরের কথা, মেহেরুন্নিসা তাঁর পালকিতে শুয়ে রয়েছে যখন ভারতবর্ষের সমভূমিতে অবতরণের প্রথম পর্যায়ে সংকীর্ণ পাথুরে খুদ গিরিপথের ভিতর দিয়ে তাকে আর তার ঘুমন্ত মেয়ে লাডলী বেগমকে বহনকারী পালকিটা দ্রুত এগিয়ে চলেছে গিলজাই উপজাতির আটজন শক্তসমর্থ লোকের চওড়া নির্ভরযোগ্য কাঁধে পালকির বাঁশের দণ্ড অবস্থান করছে। তাকে ঘিরে রাখা বুটিদার গোলাপি পর্দা বাতাসে আলোড়িত হতে সে এক ঝলকের জন্য বাইরের খাড়াভাবে নেমে যাওয়া, নুড়িপাথরপূর্ণ ঢালে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত চিরহরিৎ ওকের ঝোঁপঝাড় দেখতে পায়। পালকিবাহকেরা প্রায় দৌড়াবার ভঙ্গিতে চলার সময় গান গাইতে গাইতে, তাঁরা পালকির দুলুনিতে একটা নিয়মিত ছন্দ বজায় রেখেছে। সে আশার করে জাহাঙ্গীরের অভিপ্রায়ের বিষয়ে তাঁর আব্বাজানের ধারণাই যেন সত্যি হয়। তার ধারণা সত্যি হোক সেটা সে নিজেও চায় কিন্তু তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে সে শিখেছে যে পুরুষমানুষ পরিবর্তনশীল। শের আফগানও তাঁদের বিয়ের প্রথম কয়েকমাস যতক্ষণ তাঁর প্রতি তার আগ্রহ ছিল একজন মনোযোগী স্বামী, স্নেহপরায়ন প্রেমিক ছিলেন… সে হয়তো জাহাঙ্গীরকেও আর মোহিত করতে পারবে না। পুরুষমানুষেরা অল্পবয়সী নারীদেহ পছন্দ করে। সে তখন ছিল ষোল বছরের এক কিশোরী; এখন চব্বিশ বছরের একজন রমণী।
তার ভাবনার জাল ছিন্ন করে তাকে বহনকারী বহরের পেছন থেকে বিপদসঙ্কেতজ্ঞাপক সনির্বন্ধ চিৎকার আর গাদা বন্দুকের গুলির শব্দ ভেসে আসে। তার বেহারারা গান গাওয়া বন্ধ করে তাঁদের অগ্রসর হবার গতি বৃদ্ধি করতে পালকিটা ভীষণভাবে দুলতে আরম্ভ করে। একহাতে লাডলিকে অভয়দানের ভঙ্গিতে জড়িয়ে ধরে সে পর্দার একটা ধার উঁচু করে বাইরে উঁকি দেয় কিন্তু ধুসর নুড়ি আর পাথর ছাড়া সে কিছুই দেখতে পায় না। পুরোটা সময় গাদা বন্দুকের শব্দ আর চিৎকার আরো প্রবল হয় এবং কাছে এগিয়ে আসতে থাকে। তারপরে বহরের পেছন থেকে একজন অশ্বারোহী তীব্রবেগে ঘোড়া হাঁকিয়ে পালকির পাশ দিয়ে অতিক্রম করে, এতই কাছ দিয়ে যে সে লোকটার ঘোড়ার ঘামের গন্ধ পায় এবং প্রাণীটার খুরের আঘাতে ছিটকে উঠা ধুলো তাঁর চোখে এসে পড়ে এবং সে কাশতে শুরু করে। লোকটা চিৎকার করছে, মালবাহী বহরে ডাকাতেরা হামলা করেছে। তিনজন মানুষ আর দুটো মালবাহী উট ভূপাতিত হয়েছে। সেখানে দ্রুত আরো সৈন্য প্রেরণ করো!’
মেহেরুন্নিসা তার চোখ থেকে ধুলো ঘষে ফেলে পিছনের দিকে তাকায় কিন্তু তার দৃষ্টি থেকে মালবাহী বহরটা ফেলে আসা পথের একটা তীক্ষ্ণ বাকের আড়ালে অদৃশ্য হয়েছে। এই গিরিপথগুলো বর্বর আফ্রিদি উপজাতির কারণে কুখ্যাত যারা পর্যটকদের ছোট ছোট বহর লুণ্ঠন করে থাকে কিন্তু রাজকীয় সৈন্যবাহিনীর প্রহরায় সুরক্ষিত একটা বহরে হামলা করাটা নিঃসন্দেহে হঠকারী। তারা জানে না তারা কাদের উপরে হামলা করতে এসেছে… বা হয়তো তারা জানে। কাবুলের ধনী কোষাধ্যক্ষের ভ্রমণের সংবাদ সম্ভবত তাঁদের হামলায় প্ররোচিত করেছে। ছায়াগুলো দীর্ঘতর হতে শুরু করেছে। সূর্য আর এক কি দুই ঘন্টার ভিতরে চারপাশের পাহাড়ের চূড়ার নিচে হারিয়ে যাবে। তাদের বহরের পেছনে অবস্থিত মালবাহী শকটগুলোকে হয়ত আক্রমণ করা হয়েছে তাদের তাড়াহুড়ো করে সংকীর্ণ খুদ গিরিপথের আরো গভীরে নিয়ে যাবার অভিপ্রায়ে যেখানে অন্ধকারের ভিতরে হামলাকারীদের আরেকটা বিশাল দল ওত পেতে রয়েছে? লাডলী আর তাঁর নিজের এবং বহরের সাথে তাঁর সামনে ভ্রমণরত তাঁর পিতামাতার–বিপদের ভাবনা তাকে কিছুক্ষণের জন্য নিথর করে দেয় এবং তারপরে সে দ্রুত চিন্তা করতে শুরু করে। সে কীভাবে নিজেকে আর নিজের কন্যাকে রক্ষা করবে? তার সাথে কোনো অস্ত্র নেই। লাডলী ঘুম থেকে জেগে উঠলে সে মেয়েকে নিজের কাছে টেনে নেয়। লাডলী বিপদের সম্ভাবনায় কাঁটা হয়ে থাকা মায়ের উৎকণ্ঠা টের পাওয়া মাত্র ফোঁপাতে আরম্ভ করে। শান্ত হও, মেহেরুন্নিসা তার কণ্ঠে একটা উৎফুল্লভাব ফুটিয়ে বলে। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। আর তাছাড়া, কান্নায় কখনও কারো উপকার হয় নি।
ঠিক সেই মুহূর্তে চিৎকার করে কেউ একজন থামবার নির্দেশ দেয়। তার বেহারারা এত দ্রুত দাঁড়িয়ে পড়ে যে মেহেরুন্নিসা হুমড়ি খেয়ে সামনের দিকে উল্টে পড়ে। তাঁর হাত থেকে লাডলী ছিটকে যায় এবং পালকির কাঠামো গঠনকারী বাঁশের বাঁকানো চক্ৰবলয়ের একটার সাথে তার কপাল গিয়ে এত জোরে ধাক্কা খায় যে কিছুক্ষণের জন্য সে চোখে ঝাপসা দেখে। নিজেকে সুস্থির করে সে লাডলীকে জোর করে পালকির মেঝেতে শুইয়ে দেয়। এখানে চুপ করে শুয়ে থাকো!’ সে এরপরে পর্দার ভেতর থেকে সারসের মত মাথা বের করে বাইরে তাকিয়ে দেখে যে তাঁর সামনে পুরো বহরটা থমকে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তবকিরা ঘোড়া থেকে মাটিতে নামতে শুরু করেছে এবং বন্দুক পিঠের উপরে আড়াআড়িভাবে ঝুলিয়ে নিয়ে, নুড়িতে আবৃত ঢাল বেয়ে হুড়মুড় করে উপরে উঠার চেষ্টা করে, তাদের পায়ের আঘাতে পাথরের টুকরো আর বালু আলগা হতে থাকে, উপরের দিকে বিক্ষিপ্ত পড়ে থাকা কয়েকটা পাথর তাদের গন্তব্য যেখানে তারা খানিকটা হলেও আড়াল পাবে। রাজকীয় অশ্বারোহী বাহিনীর একটা দল এমন সময় তার পাশ দিয়ে দ্রুতবেগে তাঁদের বহরের পেছনের দিকে ছুটে যায় যেখানে লড়াইয়ের শব্দ প্রতি মুহূর্তে তীব্রতর হচ্ছে। পথটা এখানে এতই সংকীর্ণ যে তার পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় তারা এক সারিতে বিন্যস্ত হতে বাধ্য হয়। বিশাল একটা কালো ঘোড়ায় উপবিষ্ট হাতে ইতিমধ্যেই উদ্যত তরবারি আর উদ্বিগ্ন মুখাবয়বের এক তরুণ অশ্বারোহী দলটার একদম শেষে রয়েছে।
মেহেরুন্নিসা ভাবে, লাডলীকে সাথে নিয়ে পর্দার তোয়াক্কা না করে তাঁর কি। নিজের পিতামাতার গাড়ির দিকে দৌড়ে যাওয়া ঠিক হবে, কিন্তু পরমুহূর্তে সে ধারণাটা নাকচ করে দেয়। তাদের মাথার উপরে পাথরের আড়ালে লুকিয়ে থাকা কোনো নিশানাবাজের কাছে তারা এর ফলে নিজেদের কেবল অরক্ষিত প্রতিপন্ন করবে। লড়াইয়ের গতিপ্রকৃতি পরিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত নড়াচড়া করার কোনো মানেই হয় না। সে এর বদলে পালকির চারপাশের পর্দা পুনরায় ভালো করে টেনে দেয়। সময় গড়িয়ে ধীরে ধীরে আধো অন্ধকারের আবর্তে এগিয়ে যায়। পুরোটা সময় গাদা বন্দুকের শব্দ–কখনও মনে হয় কাছে এগিয়ে আসছে, কখনও মনে হয় দূরে সরে যাচ্ছে–এবং সৈন্যদের অগ্রসর আর পিছিয়ে আসবার তীক্ষ্ণ আদেশের ব্যাপারে কান খাড়া করে রাখার, সাথে যুক্ত হয় তার কপালের যন্ত্রণা যেখানে ইতিমধ্যে বিশাল মাপের একটা আলুর সৃষ্টি হয়েছে, সে নিজেকে বাধ্য করে লাডলিকে পারস্যের লোকগীতি জোর গেয়ে শোনাতে।
তাঁদের বহরের পেছন থেকে চিৎকার আর গুলিবর্ষণের শব্দ অবশেষে থিতিয়ে আসতে আরম্ভ করে, কিন্তু এর মানে কি? সে তারপরে শুনতে পায় নিজের পালকির কাছে ঘোড়ার খুরের শব্দ, বিজয়ীর হাঁকডাক এবং সেখানে অবস্থানরত বেহারা আর সৈন্যদের উল্লাসের জবাব দিতে দিতে এগিয়ে আসছে। হামলাকারী নিশ্চয়ই মেরে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে… সে আরো একবার পর্দার আড়াল থেকে বাইরে তাকিয়ে দেখে রাজকীয় অশ্বারোহীরা বিজয়ীর বেশে ফিরে আসছে। সে তাকিয়ে দেখে বেশ কয়েকজনের ঘোড়ার, যাঁদের ভিতরে সেই তরুণ আধিকারিকও রয়েছে, পর্যাণের উঁচু হয়ে থাকা বাঁকানো অংশে তাঁদের হাতে যারা নিহত হয়েছে তাদের ছিন্ন মস্তকগুলো চুল বাঁধা অবস্থায় ঝুলে রয়েছে, তাদের গলার কর্তিত অসমান অংশ থেকে টপটপ করে রক্ত পড়ছে। কিন্তু দলটার শেষ অশ্বারোহী যে তার পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় তাঁর মনোযোগ আকর্ষণ করে। লোকটা একটা ছোট আঁটসাট চামড়ার জ্যাকেটে অদ্ভুতভাবে সজ্জিত এবং তাঁর মাথায় চুড়াকৃতি মোগল শিরোস্ত্রাণের সাথে গলা রক্ষা করতে সংযুক্ত ধাতব শৃঙ্খলের বর্মের বদলে রয়েছে গোলাকৃতি একটা শিরোস্ত্রাণ। সে এগিয়ে তার পাশাপাশি আসতে, লোকটা মাথা ঘুরিয়ে তাকায়। একজোড়া ধুসর, মার্জার সদৃশ্য নীল চোখ তার দিকে সরাসরি তাকিয়ে রয়েছে।
১.০৪ রাজকীয় হেরেম
মালকিন, যাবার সময় হয়েছে। অধমের নাম মালা। আমি মহামান্য সম্রাটের খাজাসারা, তাঁর রাজকীয় হেরেমের তত্ত্বাবধায়ক এবং আপনাকে পথ দেখিয়ে ফাতেমা বেগমের আবাসন কক্ষে পৌঁছে দেয়ার জন্য এসেছি আপনি তাঁর খিদমত করবেন। মালা যৌবন প্রায় অতিক্রান্ত দীর্ঘদেহী, মর্যাদাপূর্ণ চেহারার অধিকারিনী এক রমণী। তার হাতের হাতির দাঁতের তৈরি রাজকীয় দফতরের কর্তৃত্বসূচক দণ্ডের শীর্ষদেশে খোদাই করা পদ্মফুলের আকৃতি তার চেহারায় বাড়তি আভিজাত্য যোগ করেছে। মেহেরুন্নিসা তাঁর স্মিত হাসির পেছনে দুর্দান্ত এক ব্যক্তিত্বের উপস্থিতি আঁচ করতে পারে।
সে এবার তাঁর পিতামাতার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে, আগ্রা দূর্গের নিরাপত্তা প্রাচীরের অভ্যন্তরে গিয়াস বেগের বসবাসের জন্য বরাদ্দকৃত প্রশস্ত আবাসন কক্ষসমূহের আঙিনায় তারা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাঁর আম্মিজান লাডলির হাত ধরে রেখেছে। মেহেরুন্নিসা হাঁটু ভেঙে বসে নিজের মেয়ের গালে চুমু দেয়। সে এই মুহূর্তটার জন্য বিপুল প্রত্যাশা নিয়ে প্রতীক্ষা করেছিল, কিন্তু এখন যখন সময়টা এসেছে, আগ্রা পৌঁছাবার তিন সপ্তাহ পরে, তার মাঝে কেমন একটা উদ্বেগ এমনকি এক ধরনের অনীহা কাজ করতে থাকে। নিজের সন্তানের কাছ থেকে আলাদা হওয়া যে ছিল তার একমাত্র সান্ত্বনা ভীষণ দুঃসহ একটা অভিজ্ঞতা, লাডলী যদিও তাঁর দাদা-দাদী আর আয়া ফারিশার কাছে যত্নেই থাকবে এবং হেরেমে তাঁর সাথে দেখা করার অনুমতি পাবে।
খাজাসারা তাকিয়ে রয়েছে বুঝতে পেরে, মেহেরুন্নিসা নিজেকে বাধ্য করে নিজের আবেগ গোপন করতে, শের আফগানের সাথে তাঁর অতিবাহিত জীবন যা ভালোভাবে করতে তাকে পারদর্শী করে তুলেছে, এবং মুখাবয়ব আবেগহীন রাখতে। লাডলীকে শেষবারের মত একবার আলিঙ্গন করে সে উঠে দাঁড়ায়, তাঁর পিতামাতার দিকে ঘুরে এবং তাঁদেরও আলিঙ্গন করে সে তাঁদের সান্নিধ্য থেকে পিছনে সরে আসবার সময়, গিয়াস বেগের মুখ গর্বে জ্বলজ্বল করতে থাকে। তোমার প্রতি আমাদের শুভকামনা রইলো। তোমার গৃহকত্রীকে ভালোভাবে খিদমত করবে,’ তিনি বলেন।
মেহেরুন্নিসা খাজাসারাকে অনুসরণ করে প্রাঙ্গণ থেকে বের হয়ে আসে এবং বেলেপাথরের একপ্রস্থ সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামে যা আগ্রা দূর্গের প্রাণকেন্দ্রের অভিমুখে খাড়াভাবে উঠে যাওয়া একটা ঢালের পাদদেশে এসে শেষ হয়েছে। কয়েক গজ দূরেই সবুজ রঙের পোষাক পরিহিত ছয়জন মহিলা পরিচারিকা রেশমের কাপড় দিয়ে সজ্জিত একটা পালকির পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাঁরা সবাই দেখতে লম্বা আর চওড়া। সে ইতিমধ্যে পেষল দেহের অধিকারিনী তুর্কি মেয়েদের কথা শুনেছে যারা হেরেম পাহারা দেয়, কিন্তু সে আরেকটু কাছাকাছি যেতে পরিচারিকার দলটা মেয়ে নয়, বরং বিশাল হাত পা বিশিষ্ট এবং না পুরুষ না মেয়েলী, আশ্চর্য ধরনের কোমল মুখের অধিকারী, খোঁজা দেখে সে চমকে উঠে সশব্দে শ্বাস টানে। তাদের সবারই পরনে দামী অলঙ্কার শোভা পায় এবং বেশ কয়েকজনের চোখে কাজল দেয়া রয়েছে। সে খোঁজা আগেও দেখেছে, গৃহপরিচারক হিসাবে নিয়োজিত বা বাজারে লোকদের মনোরঞ্জনের জন্য নাচ গান করে, কিন্তু মেয়েদের মত পোষাক পরিহিত এমনটা আগে কখনও দেখেনি।
মালিকা, এই পালকিটা আপনার জন্য পাঠান হয়েছে, খাজাসারা বলে। মেহেরুন্নিসা পালকিতে উঠে ভেতরের নিচু আসনে আড়াআড়িভাবে পা রেখে বসে। তার চারপাশে রেশমের পর্দাগুলোকে কয়েক জোড়া হাত জায়গা মত গুঁজে দেয় এবং খোঁজার দল পালকিটা নিজেদের কাঁধে তুলে নিতে সেটা শূন্যে ভেসে উঠে। তাকে নতুন একটা জীবনে বয়ে নিতে পালকিটা খাড়া ঢাল দিয়ে মৃদু দুলুনির সাথে উপরে উঠতে শুরু করতে, সে দেখে সে নিজের হাত মুঠো করে রেখেছে এবং তাঁর হৃৎপিণ্ড এত দ্রুত স্পন্দিত হয় যে তার কানে মনে হয় যেন তার দেহের রক্ত এসে আছড়ে পড়ছে। এত অল্প সময়ের ভিতরে কত কিছু ঘটে গিয়েছে… কাবুলে সে যখন তার সামনে নৃত্য প্রদর্শন করছিল তখন তিনি তাঁর দিকে যেভাবে তাকিয়ে ছিলেন, ছায়াময় আধো-আলোতে সে চেষ্টা করে জাহাঙ্গীরের সেই কৃশ কিন্তু সুদর্শন মুখমণ্ডল পুনরায় স্মরণ করতে… তাঁর আব্বাজান যেমন দাবি করেছেন এবং সে নিজেও যা প্রত্যাশা করে তিনি কি আসলেই সেভাবে তার ভবিষ্যত? সে শীঘ্রই সেটা জানতে পারবে।
*
‘সম্রাট, আপনি আমাকে কি কথা বলতে চান? আমি আপনার আদেশ লাভ করা মাত্র ফতেপুর শিক্রি থেকে যত দ্রুত সম্ভব এসেছি। সুফি বাবার কণ্ঠস্বর কোমল কিন্তু চোখে ক্ষুরধার দৃষ্টি। এখন যখন বহু প্রতীক্ষিত মুহূর্তটা এসে উপস্থিত হয়েছে, জাহাঙ্গীর কথা বলতে অনীহা বোধ করে। সুফি সাধক, যাকে ধার্মিক ব্যক্তি হিসাবে তার যশের কারণে শ্রদ্ধার বশবর্তী হয়ে সে তার নিজের নিভৃত কক্ষে নিজের আসনের পাশেই আরেকটা তেপায়ায় তাকে বসতে অনুরোধ করেছে, মনে হয় তাঁর নাজুক পরিস্থিতি আঁচ করতে পারেন এবং কথা চালিয়ে যান, আমি জানি যে আপনি যখন একেবারেই ছোট একটা বালক তখন আপনি আমার আব্বাজানের কাছে নিজের মনের কথা খুলে বলেছিলেন। আমার মনে হয় না যে আমার আব্বাজানের মত আমার ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষমতা আছে বা আমি তারমত অন্তদৃষ্টির অধিকারী, কিন্তু আপনি যদি আমার উপরে আস্থা রাখতে পারেন আমি আপনাকে সাহায্য করার চেষ্টা করতে পারি।’
ফতেপুর শিক্রির সেই উষ্ণ রাতে জাহাঙ্গীরের ভাবনা ফিরে যায় যখন সে তাঁর প্রশ্নের উত্তর পাবার আশায় প্রাসাদ থেকে দৌড়ে শেখ সেলিম চিশতির বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিল। আপনার আব্বাজান ছিলেন একজন মহান ব্যক্তি। তিনি আমাকে হতাশ হতে বারণ করেছিলেন, বলেছিলেন যে আমিই সম্রাট হবো। আমি প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত তাঁর কথাগুলো আমাকে অনেক কঠিন সময় অতিক্রান্ত করতে সাহায্য করেছে।’
‘আমার কথাও হয়তো আপনাকে খানিকটা স্বস্তি দিতে পারবে।’
জাহাঙ্গীর সুফি সাধকের দিকে তাকায়–তার রুগ্ন-দর্শন আব্বাজানের চেয়ে অনেক বিশালাকৃতি দেহের অধিকারী একজন লোক। সে প্রায় জাহাঙ্গীরের সমান লম্বা এবং একজন সৈন্যের মতই স্বাস্থ্যবান, কিন্তু জাহাঙ্গীর ভাবে শারীরিক শক্তি কোনোভাবেই তাকে নৈতিক দূর্বলতার প্রতি আরো বেশি ক্ষমাশীল করে তুলতে পারে নি… সে লম্বা একটা শ্বাস নেয় এবং যত্নের সাথে শব্দ চয়ন করে কথা বলতে শুরু করে। আমার আব্বাজান আমাকে যখন কাবুলে নির্বাসিত করেছিলেন আমি সেখানে একটা মেয়েকে দেখেছিলাম, আমার আব্বাজানের এক আধিকারিকের কন্যা। আমি সহজপ্রবৃত্তিতে বুঝতে পারি যে সেই আমার মানসকন্যা আমি যাকে খুঁজছি। আমি যদিও ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজনকে তখন বিয়ে করেছিলাম কিন্তু আমি সন্দেহাতীতভাবে নিশ্চিত যে সেই হতো আমার আত্মার সহচরী–আমার অবশ্যই তাকে বিয়ে করা উচিত। কিন্তু সেখানে একটা সমস্যা দেখা দিয়েছিল। আমার আব্বাজানের একজন সেনাপতির সাথে এর আগেই তার বাগদান সম্পন্ন হয়েছিল এবং আমি যদিও আব্বাজানের কাছে অনুনয় করেছিলাম তিনি আমার খাতিরে তাঁদের বাগদান ভাঙতে অস্বীকার করেছিলেন।
‘সম্রাট, আমরা জানি যে সম্রাট আকবর ছিলেন একজন ন্যায়পরায়ণ শাসক।
‘হ্যাঁ, কিন্তু সবসময়ে এটা বলা যাবে না বিশেষ করে যখন ঘটনার সাথে তার আপন পরিবারের সদস্যদের বিষয় জড়িত। তিনি একেবারেই বুঝতে চেষ্টা করেন নি যে আমার দাদাজান হুমায়ুন তাঁর স্ত্রী হামিদাকে প্রথমবার দেখার পর যেমন অনুভব করেছিলেন আমারও ঠিক একই অনুভূতি হয়েছিল। তিনি হামিদাকে আপন করে নিতে, নিজের ভাই হিন্দালের সাথে পর্যন্ত, তিনিও হামিদাকে ভালোবাসতেন, সম্পর্কছেদ করেছিলেন। হামিদার জন্য নিজের ভালোবাসার কারণে তিনি তাঁর সাম্রাজ্যকে পর্যন্ত বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছিলেন। অনেকেই হয়ত তাকে বোকা বলবে…’ জাহাঙ্গীর তাঁর পাশে হাঁটুর উপর হাত রেখে, সাদা পাগড়ি পরিহিত মাথা সামান্য নত করে বসে থাকা সুফি সাধকের দিকে আড়চোখে তাকায়, কিন্তু তিনি ঠিকই করেছিলেন। তাঁদের বিয়ে হয়ে যাবার পরে তিনি আর হামিদা খুব কম সময়ই পরস্পরের থেকে আলাদা হয়েছেন। তিনি শেষ পর্যন্ত মোগল সিংহাসন ফিরে পাবার আগে পর্যন্ত বিপদসঙ্কুল বছরগুলো তিনি নিরবিচ্ছিন্নভাবে হুমায়ুনের সাথে ছিলেন। তাঁর আকস্মিক মৃত্যুর পরে হামিদা সিংহাসনে আমার আব্বাজান আকবরের উত্তরাধিকার নিশ্চিত করার মত সাহসিকতা প্রদর্শন করেছিলেন।
‘আপনার দাদীজান ছিলেন একজন সাহসী মহিলা এবং গুনবতী সম্রাজ্ঞী। আপনার মনে হয়েছে যাকে আপনি বিয়ে করতে আগ্রহী হয়েছিলেন তিনি আপনার এমনই যোগ্য সহচর হতেন?
‘আমি এটা জানি। আমার আব্বাজান আমাকে বাধ্য করেছিলেন তাকে উৎসর্জন করতে কিন্তু আমি সম্রাট হিসাবে অভিষিক্ত হবার পরে আমি জানি সময় হয়েছে যখন আমি তার সাথে একত্রে থাকতে পারবো।
‘কিন্তু আপনি বলেছেন অন্য আরেকজনের সাথে তার বাগদান হয়েছিল।
সেই লোককে কি তিনি বিয়ে করেন নি?
‘হ্যাঁ।
‘কি এমন তাহলে পরিবর্তিত হয়েছে? তার স্বামী কি মৃত্যুবরণ করেছে?
‘হ্যাঁ, তিনি মারা গিয়েছেন। জাহাঙ্গীর কিছুক্ষণের জন্য চুপ করে থাকে তারপরে উঠে দাঁড়ায় এবং সুফি সাধকের মুখোমুখি ঘুরে দাঁড়াবার আগে কিছুক্ষণ অস্থিরভাবে পায়চারি করে। সে খোদাভীরু লোকটার মুখের দিকে তাকিয়েই বুঝতে যে সে যা বলতে চলেছে তিনি ইতিমধ্যেই সেটা জানেন। তার নাম শের আফগান। সে ছিল বাংলার গৌড়ে আমার সেনাপতি। আমার নির্দেশে তাকে হত্যা করা হয়েছে এবং তাঁর বিধবা পত্নীকে এখানে বাদশাহী হেরেমে নিয়ে আসবার আদেশ দিয়েছি।’
‘সম্রাট, একজন লোককে হত্যা করা যাতে করে আপনি তার স্ত্রীকে পেতে পারেন একটা গর্হিত পাপাচার। সুফি সাধক তার তেপায়ায় পিঠ খাড়া করে একদম সটান বসে রয়েছে এবং কঠোর একটা অভিব্যক্তি তার মুখাবয়বে।
‘এটা কি নরহত্যা? আমি একজন সম্রাট। আমার সমস্ত প্রজার জীবন আর মৃত্যুর উপরে আমার অধিকার আছে।
কিন্তু সম্রাট হিসাবে আপনি সেই সাথে ন্যায়বিচারের উৎসমুখ। আপনি খেয়ালের বশে বা আপনার সুবিধার জন্য হত্যা করতে পারেন না।
‘শের আফগান দুর্নীতিপরায়ন ছিল। তার স্থানে আমার মনোনীত সেনাপতি সে কি পরিমাণ বাদশাহী অর্থ আত্মসাৎ করেছিল তাঁর প্রচুর প্রমাণ আমাকে দিয়েছে। ঘোড়া আর অন্যান্য উপকরণ ক্রয়ের জন্য আমার কোষাগার থেকে প্রেরিত সহস্রাধিক মোহর তাঁর ব্যক্তিগত সিন্দুকে জমা হয়েছে। সে মিথ্যা অভিযোগে ধনী বণিকদের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে যাতে করে সে তাঁদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে পারে। শের আফগানকে দশ, বিশবার মৃত্যুদণ্ড দেবার মত প্রচুর প্রমাণ আমার কাছে আছে…
‘কিন্তু আপনি যখন তাকে হত্যা করার আদেশ দিয়েছিলেন তখন আপনি তার এসব অপরাধ সম্পর্কে কিছুই জানতেন না?
জাহাঙ্গীর ইতস্তত করে, তারপরে বলে, ‘না।’
‘সম্রাট, সেক্ষেত্রে–এবং কথাটা সরাসরি বলার জন্য আমার মার্জনা করবেন–নিজের স্বেচ্ছাচারীতাকে ন্যায্যতা প্রতিপাদন করার চেষ্টা করাটা আপনার উচিত হবে না। আত্মগ্ৰাহী আবেগের বশবর্তী হয়ে আপনি কাজটা করেছেন, এর বেশি কিছু না।
কিন্তু আমার দাদাজানের থেকে আমার কৃতকর্ম কি এতটাই আলাদা? আমার অপরাধ কি তার চেয়ে এতটাই নিকৃষ্ট? এক ভাইয়ের কাছ থেকে তিনি একজন রমণীকে-যে তাকে ভালোবাসতো এবং তাঁর প্রতি বিশ্বস্ত ছিল-ছিনিয়ে নিয়েছিলেন। হিন্দালকে তিনি যদি বৈরীভাবাপন্ন না করতেন, হিন্দাল নিজে কখনও খুন হতো না।
‘আপনার অপরাধ আরও নিকৃষ্ট কারণ আপনি নিজের স্বার্থে একজন লোককে হত্যা করেছেন। আপনি আল্লাহতালার চোখেই কেবল পাপ করেন নি সেইসাথে আপনার কাঙ্কি রমণীর পরিবারের বিরুদ্ধে এবং স্বয়ং সেই রমণীর প্রতিও আপনি পাপাচার করেছেন। আপনি আপনার অন্তরে এটা জানেন, নতুবা কেন আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন? তার মুখের দিকে সুফি সাধকের পরিষ্কার খয়েরী চোখ অপলক তাকিয়ে থাকে। জাহাঙ্গীর যখন কিছু বলে না তিনি বলতে থাকেন, আমি আপনাকে আপনার পাপবোধ থেকে মুক্তি দিতে পারবো না… আল্লাহতালাই কেবল আপনাকে মার্জনা করতে পারেন।’
জাহাঙ্গীর মনে মনে ভাবে, সুফি বাবার প্রতিটা কথাই অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। বিশ্বাস করে কারো কাছে মনের গোপন কথাটা বলার প্রয়োজনীয়তা ক্রমশ অসহনীয় হয়ে উঠছিল এবং সে খুশি যে অবশেষে সে এটা করতে পেরেছে, কিন্তু ধার্মিক লোকটা তার অপরাধ হয়ত না দেখার ভাণ করবেন এই আশা করে সে নিজে নিজেকেই প্রতারিত করেছিল। আমি আল্লাহতা’লার ক্ষমা লাভ করার চেষ্টা করবো। আমি দরিদ্রদের যা দান করি তাঁর পরিমাণ তিনগুণ বৃদ্ধি করবো। আমি দিল্লি, আগ্রা আর লাহোরে নতুন মসজিদ নির্মাণের আদেশ দেব।
আমি আদেশ দেব।’ সুফি বাবা নিজের হাত উঁচু করেন। সম্রাট, এসব যে যথেষ্ট নয়। আপনি বলেছেন আপনি বিধবা রমণীকে আপনার হেরেমে নিয়ে এসেছেন। তাঁর সাথে আপনি কি ইতিমধ্যে সহবাস করেছেন?
না। সে মোটেই সাধারণ কোনো উপপত্নী নয়। আমি আপনাকে যেমন বলেছি, আমি তাকে বিয়ে করতে ইচ্ছুক। সে বর্তমানে আমার এক সৎ-মায়ের খিদমতকারী হিসাবে রয়েছে এবং এসব বিষয়ে সে বিন্দুমাত্র অবহিত নয়। কিন্তু আমি শীঘ্রই তাকে ডেকে পাঠাব… আমার অনুভূতির কথা তাকে বলবো…’
না। আপনার প্রায়শ্চিত্তের কিছুটা অবশ্যই ব্যক্তিগত হতে হবে। আপনাকে অবশ্যই আত্ম-সংযমের পরিচয় দিতে হবে। এই রমণীকে এখন বিয়ে করলে আল্লাহতা’লা হয়ত ভয়ঙ্কর মূল্য আদায় করবেন। আপনাকে অবশ্যই নিজের বাসনা দমন করতে হবে এবং অপেক্ষা করতে হবে। আপনি অন্তত ছয়মাস তার সাথে সহবাস করবেন না এবং সেই সময়ে আপনি প্রতিদিন নামায আদায় করবেন আল্লাহতালার মার্জনা লাভ করতে।’ কথা বলে সুফি বাবা উঠে দাঁড়ায় এবং তাকে চলে যাবার জন্য জাহাঙ্গীরের আদেশের অপেক্ষা না করে কক্ষ থেকে বের হয়ে যায়।
*
ফাতিমা বেগমের চওড়া মুখটা পার্চমেন্টের মত শুষ্ক আর রেখাযুক্ত এবং তার থুতনির বাম পাশের একটা বিশালাকৃতি তিলে বেশ লম্বা তিনটা সাদা চুল বের হয়েছে। তিনি কি কখনও সুন্দরী ছিলেন–এতটাই সুন্দরী যে আকবর তাকে স্ত্রী করার জন্য উদগ্রীব হয়েছিলেন? মেহেরুন্নিসা, নিচু একটা বিছানায় স্তূপীকৃত কমলা রঙের সুডৌল তাকিয়ায় তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় শুয়ে থাকা বয়স্ক মহিলার দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবে। তার মনে হয় সে হয়ত উত্তরটা জানে। আকবর যদিও নিজের দৈহিক আনন্দের জন্য তাঁর উপপত্নীদের বাছাই করতেন, তিনি বিয়েকে রাজনৈতিক মৈত্রী সম্পাদনের একটা মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করতেন। সিন্ধের সীমান্ত এলাকায় একটা ছোট রাজ্যের শাসক ফাতিমা বেগমের পরিবার।
মেহেরুন্নিসা অস্থিরভাবে নড়াচড়া করে। তাঁর কোনো কিছু পাঠ করতে ইচ্ছে করে কিন্তু ফাতিমা বেগম নিজের কক্ষে আলো মৃদুতর রাখতে পছন্দ করেন। খিলানাকৃতি জানালায় ঝুলন্ত মসলিনের পর্দা সূর্যের আলো পরিশ্রুত করে। সে উঠে দাঁড়ায় এবং একটা জানালার দিকে এগিয়ে যায়। সে পর্দার ভিতর দিয়ে যমুনা নদীর হলুদাভ-বাদামি পানির স্রোত এক নজর দেখতে পায়। একদল লোক এর কর্দমাক্ত চওড়া তীর ধরে দুলকি চালে ঘোড়া নিয়ে যাচ্ছে, তাদের শিকারী কুকুরগুলো পিছনে দৌড়াচ্ছে। সে আবারও পুরুষদের তাদের স্বাধীনতার জন্য হিংসা করে। এখানে এই বাদশাহী হোরেমে মেয়েদের এই স্বয়ংসম্পূর্ণ বসবাসের এলাকায়-তাঁর জীবন কাবুলে যেমন ছিল তারচেয়ে বেশি দমবন্ধ করা মনে হয়। হেরেমের ফুলে ফুলে ছাওয়া বাগান আর চত্বরের সৌন্দর্য, এখানের বৃক্ষশোভিত সড়কগুলো এবং চিকচিক করতে থাকা সুগন্ধিযুক্ত পানির প্রস্রবন, বিলাসবহুল আসবাবপত্র–কোনো মেঝে কখনও খালি থাকে না, এবং দরজা আর জানালায় ঝলমলে রেশমের রঙিন পট্টি বাঁধা আর মখমলের দৃষ্টিনন্দন পর্দা থাকা সত্ত্বেও–হেরেমটা কেমন যেন বন্দিশালার মত মনে হয়। রাজপুত সৈন্যরা এখানে প্রবেশের বিশালাকৃতি তোরণগুলো সবসময়ে পাহারা দিচ্ছে এবং দেয়ালের ভেতরে মহিলা রক্ষী আর বৈশিষ্ট্যহীন-মুখাবয়ব এবং চতুর-দৃষ্টির খোঁজারা সবসময় টহল দেয় যাদের উপস্থিতি, এমনকি আট সপ্তাহ পরেও তাঁর কাছে অস্বস্তিকর মনে হয়।
সে এখনও সম্রাটের কাছ থেকে কোনো কিছু শুনতে না পাওয়ায় সেটা আরো বেশি অস্বস্তিকর মনে হয়… সে তাকে এমনকি এক ঝলকের জন্যও দেখতে পায়নি যদিও সে জানে তিনি দরবারেই রয়েছেন। তিনি কেন তাকে ডেকে পাঠান নি বা এমনকি ফাতিমা বেগমকেও দেখতে আসেন নি যেখানে আসলে তিনি নিশ্চিতভাবে জানেন যে তিনি অবশ্যই তাকে দেখতে পাবেন? ব্যাপারটা কি তাহলে এমন যে তাঁর আশাগুলো–এবং তাঁর আব্বাজানের আশাগুলোর–আসলে কোনো ভিত্তি নেই? মেহেরুন্নিসা জানালার কাছ থেকে সরে আসবার সময় নিজেই নিজেকে বলে, তাকে অবশ্যই ধৈর্য ধারণ করতে হবে। সে এছাড়া আর কিইবা করতে পারে? তাকে যদি এখানে সাফল্য লাভ করতে হয় সহজপ্রবৃত্তি তাকে বলে এই বিচিত্র নতুন পৃথিবী তাকে বুঝতে হবে। ফাতিমা বেগম তাকে যখনই কোনো কাজ দেবেন তাকে অবশ্যই হেরেম সম্বন্ধে জ্ঞান অর্জন করতে হবে। সে ইতিমধ্যে আবিষ্কার করেছে যে শান বাঁধানো বর্গাকার আঙিনার তিনদিকে মধুচক্রের মত নির্মিত ঘরগুলো যেখানে ফাতিমা বেগমের বাসস্থান অবস্থিত সেখানে আরো ডজনখানেক অন্য মহিলা বাস করেন যারা কোনো না কোনোভাবে রাজপরিবারের সাথে সম্পর্কিত–খালা, ফুপু, অন্যান্য দূর সম্পর্কের বোন।
সে সেই সাথে এমন অনেক কিছু প্রত্যক্ষ করেছে যা তাকে নিশ্চিত করেছে যে মালার গুরুত্ব আর চরিত্র সম্বন্ধে তাঁর আন্দাজ পুরোপুরি সঠিক। খাজাসারা সুগন্ধি আর প্রসাধনী প্রস্তুতি থেকে শুরু করে হিসাবপত্র পরীক্ষা করা, রান্নাঘর তদারকি আর বাজার করা পর্যন্ত হারেমের সবকিছু কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রণ করে। কর্তৃত্বপরায়ণ কিন্তু দক্ষ মালা তার সাহায্যকারীদের ক্ষুদ্র দলটার প্রত্যেক সদস্য আর ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গ যেখানে মলমূত্র জমা হয় সেসব পরিষ্কার করার জন্য নিয়োজিত মেয়ে খলুপদের নাম জানে। সেই মহিলা অতিথিদের হেরেমে প্রবেশের অনুমতি দেয়। খাজাসারার অনেক দায়িত্বের ভিতরে এটাও রয়েছে–মেহেরুন্নিসা অন্তত তাই শুনেছে– সম্রাটের সাথে সহবাস করা প্রতিটা মহিলার, যাঁদের ভিতরে তাঁর স্ত্রীরাও রয়েছেন, বিস্তারিত বিবরণী এবং ঘটনাচক্রে কেউ কেউ গর্ভবতী হলে সেই তারিখ সংরক্ষণ করা। সে এমনকি-প্রতিটা কক্ষের দেয়ালের উঁচুতে এই বিশেষ উদ্দেশ্যে স্থাপিত ক্ষুদ্রাকৃতি পর্দার ভিতর দিয়ে তাকিয়ে সহবাস সংখ্যাও লিখে রাখে।
জাহাঙ্গীরের স্ত্রীরা, মেহেরুন্নিসা জানতে পেরেছে যে, হেরেমের পৃথক একটা অংশে চমৎকার সব সুসজ্জিত কামরায় বাস করে যা সে এখনও দেখেনি। তার আব্বাজান কেবল যদি বহু বছর পূর্বেই জাহাঙ্গীরের প্রস্তাবে সম্মতি দিতেন তাহলে সে হয়তো তাদের একজন হতো। তারা সবাই কেমন রমণী এবং তিনি কি এখনও তাদের শয্যায় সঙ্গী হন? নবাগত হবার কারণে সরাসরি কিছু জানতে চাওয়াটা তার জন্য কঠিন কিন্তু হেরেমের প্রধান অবসর বিনোদন হল পরচর্চা এবং সে আলাপচারিতার গতিপথ সহজেই ইচ্ছামত পরিবর্তিত করতে পারে। সে ইতিমধ্যে শুনেছে যে যুবরাজ খুররমের মাতা, যোধা বাঈ একজন রসিক আর সদাশয় মহিলা এবং এটাও জেনেছে যে যুবরাজ পারভেজের পারস্যে জন্মগ্রহণকারী মাতা মিষ্টি খাবার কারণে যার প্রতি তাঁর ভীষণ দূর্বলতা রয়েছে প্রচণ্ড মোটা হয়ে গিয়েছেন কিন্তু নিজের রূপ সম্বন্ধে এখনও এতটাই গর্বিত যে তিনি এখনও বৃদ্ধাঙ্গুলের অঙ্গুরীয়তে স্থাপিত মুক্তাখচিত ক্ষুদ্রাকৃতি আয়নায় যা এখন কেতাদুরস্ত ঘন্টার পর ঘন্টা নিজের চেহারা বিভোর হয়ে দেখে কাটিয়ে দেন।
সে আরো জেনেছে যে যুবরাজ খসরুর বিদ্রোহের পর থেকে তাঁরা মা মান বাঈ নিজের কামরায় অতিবাহিত করেন এবং পর্যায়ক্রমে খসরু আর তার সন্তানকে অন্য যারা বিপথগামী করেছে তাদের অভিযুক্ত করে দোষারোপ করে সময় কাটান। জোর গুজব রয়েছে মান বাঈ সবসময়ে ভীষণ অস্থির হয়ে থাকেন। একজন মহিলা স্বামী আর সন্তানের বিরোধের মাঝে যার ভালোবাসা ক্ষতবিক্ষত হয়েছে চিন্তা করতেই খারাপ লাগে, কিন্তু মান বাঈয়ের আরো দৃঢ়তা প্রদর্শন করা উচিত ছিল… মেহেরুন্নিসা নিজের ভাবনায় তখনও এতটাই মগ্ন যে দরজার পাল্লা খুলে ফাতিমা বেগমের বছর চল্লিশের বিধবা ভ্রাতুস্পুত্রী সুলতানা, উত্তেজিত ভঙ্গিতে ভিতরে প্রবেশ করতে সে চমকে উঠে।
‘আমি দুঃখিত। ফাতিমা বেগম এখন ঘুমিয়ে আছেন, মেহেরুন্নিসা ফিসফিস করে বলে।
‘আমি সেটা দেখতেই পাচ্ছি। সে যখন ঘুম থেকে উঠবে তাকে বলবে যে আমি পরে আসবো। নীলের একটা চালান সম্বন্ধে জরুরি ব্যবসায়িক ব্যাপারে আমাকে তাঁর সাথে আলোচনা করতে হবে।’ সুলতানার কণ্ঠস্বর শীতল এবং অভিব্যক্তি বৈরীভাবাপন্ন যখন সে চলে যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়ায়।
মেহেরুন্নিসা হেরেমের বাসিন্দাদের কারো কারো তার প্রতি শীতল ব্যবহার, এমনকি বৈরিতার এবং তাদের কৌতূহলের সাথে ক্রমশ অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। আততায়ীর হাতে নিহত শের আফগানের বিধবা স্ত্রীকে কেন ফাতিমা বেগমের সঙ্গিনী করা হয়েছে সে বিষয়ে দু’জন বয়স্ক মহিলার আলাপচারিতা সে আড়াল থেকে শুনেছে। সে অল্পবয়সী এবং দেখতে যথেষ্ট সুন্দরী। সে এখানে কি করছে? তুমি নিশ্চয়ই ভেবেছো তারা তাকে পুনরায় বিয়ে দিয়েছে,’ একজন মহিলা মন্তব্য করে। এটা একটা ভালো প্রশ্ন। সে এখানে কি করছে? মেহেরুন্নিসা মনে মনে ভাবে। কামরার অন্য প্রান্তে, ফাতিমা বেগম ঘুমের ভিতরে অবস্থান পরিবর্তন করে নাক ডাকতে শুরু করেন।
*
‘খাজাসারা সবাইকে অবিলম্বে আঙিনায় সমবেত হতে বলেছে, নাদিয়া নামে কৃশকায়, তারের মত দেহের অধিকারী ছোটখাট দেখতে এক মহিলা ফাতিমা বেগমের পরিচারিকাদের একজন, বলে। মালকিন, এমনকি আপনাকেও অবশ্যই আসতে হবে, সে তার বয়স্ক গৃহকত্রীর দিকে শ্রদ্ধার সাথে মাথা নত করে পুনরায় যোগ করে।
‘কেন? কি হয়েছে? বিকেলের নাস্তার ব্যাপারটা বিঘ্নিত হওয়ায় ফাতিমা বেগমকে দেখতে মোটেই সুন্দরী মনে হচ্ছে না, মেহেরুন্নিসা ভাবে।
‘খোঁজাদের একজনের সাথে হাতে নাতে একজন উপপত্নীকে ধরা হয়েছে। অনেকেই বলাবলি করছে যেমনটা ভাব করে তার চেয়ে সে বেশি পুরুষ, অন্যদের ধারণা তারা কেবল চুমু দেয়া নেয়া করছিল। মেয়েটাকে চাবুকপেটা করা হবে।’
‘আমার যখন বয়স ছিল তখন এসব অপরাধের একমাত্র শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড। ফাতিমা বেগমের আপাত কোমল মুখাবয়বে অননুমোদনের ছাপ স্পষ্ট। খোঁজাটার কি হবে?
‘তাকে হাতির পায়ের নিচে পিষে মারার জন্য ইতিমধ্যে কুচকাওয়াজের ময়দানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।’
‘ভালো, ফাতিমা বেগম বলেন। এটাই যথার্থ এমনটাই হওয়া উচিত।’
ফাতিমা বেগমকে অনুসরণ করতে, মেহেরুন্নিসা দেখে প্রাঙ্গণে ইতিমধ্যে গালগল্প করতে থাকা মহিলারা এসে ভীড় করেছে, তাদের কাউকে উদ্বিগ্ন মনে হয় বাকীদের যখন কৌতূহলী দেখায় এবং তারা বিভিন্ন কৌশলে প্রাঙ্গণের কেন্দ্রস্থলের দৃশ্য ভালোভাবে দেখার জন্য চেষ্টা করছে যেখানে হেরেমের পাঁচজন মহিলা রক্ষী ফাঁসিকাঠের মত দেখতে কাঠের তৈরি একটা কাঠামো স্থাপণ করছে। আমার পেছনে দাঁড়াও, ফাতিমা বেগম মেহেরুন্নিসাকে আদেশ দেন, এবং আমার রুমাল আর সুগন্ধির বোতল ধরে রাখো।
প্রহরীদের একজন এখন তার শক্তিশালী খালি হাতে শাস্তিদানের কাঠামোটা ধাক্কা দিয়ে, এর দৃঢ়তা পরীক্ষা করছে। সে সন্তুষ্ট হয়ে এক পা পিছিয়ে আসে এবং অন্য আরেকজন প্রহরীর দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়তে সে ব্রোঞ্জের একটা বিষাণ ঠোঁটে রেখে ফুঁ দিতে সেটা একটা কর্কশ ধাতব শব্দে বেজে উঠে। মেহেরুন্নিসা শব্দের রেশ মিলিয়ে যেতে না যেতেই আঙিনার ডানদিক থেকে আপাদমস্তক টকটকে লাল রঙের আলখাল্লায় আবৃত হয়ে নিজের স্বভাবজাত মন্থর আর গম্ভীর ভঙ্গিতে হেঁটে খাজাসারাকে প্রবেশ করতে দেখে, সমবেত মহিলারা দু’পাশে সরে গিয়ে তাকে সামনে এগোবার জায়গা করে দেয়। মালার পিছনে, নাদুসনুদুস দেখতে অল্পবয়সী এক মেয়েকে, দুইজন মহিলা প্রহরী দু’পাশ থেকে ধরে টেনে নিয়ে আসে, যার। দু’চোখ থেকে ইতিমধ্যেই অঝোরে অশ্রু ঝরছে এবং তাঁর শোচনীয় অঙ্গস্থিতিই বলে দেয় যে সে নিজেও জানে কোনো ধরনের করুণা তাকে দেখান হবে না। খাজাসারা কাঠের ভয়ঙ্কর দর্শন কাঠামোর দিকে এগিয়ে যাবার ফাঁকে সে আদেশের সুরে বলে, মেয়েটাকে নগ্ন কর। কশাঘাত শুরু করা যাক।
মেয়েটাকে যে প্রহরীরা ধরে রেখেছিল তারা সামনের দিকে ধাক্কা দিয়ে জোর করে তাকে হাঁটু ভেঙে বসতে বাধ্য করে এবং রুক্ষভাবে তাঁর রেশমের অন্তর্বাস খুলে নেয় এবং সূক্ষ মসলিনের তৈরি লম্বা চুড়িদার পাজামার কাপড় টেনে ছিঁড়ে ফেলে এবং পাজামা বাঁধার মুক্তাখচিত বেণী করা ফিতে ছিঁড়ে গিয়ে পুরো আঙিনায় সেগুলো ছড়িয়ে যায়। মেহেরুন্নিসার পায়ের কাছে এসে একটা থামে। প্রহরীরা নগ্ন অবস্থায় তাকে টেনে হিঁচড়ে কাঠের কাঠামোটার কাছে নিয়ে যেতে শুরু করতে মেয়েটা চিৎকার করতে শুরু করে, তার দেহ ধনুকের মত বাঁকা হয় আর টানটান হয়ে যায় এবং সে ধ্বস্তাধ্বস্তি করতে থাকলে তার ভারি স্তন আন্দোলিত হতে থাকে কিন্তু প্রহরীদের পেশী শক্তির সাথে তার তুলনায় চলে না এবং তাঁরা অনায়াসে কাঠামোর নিচের প্রান্তের সাথে তাঁর গোড়ালী আর উপরের প্রান্তের সাথে তাঁর দুই কব্জি জোড়া করে চামড়ার শক্ত সরু ফালি দিয়ে বেঁধে দেয়। মেয়েটার লম্বা চুলের গোছা তাঁর নিতম্বের বেশ নিচে পর্যন্ত বিস্তৃত। প্রহরীদের একজন তার কোমর থেকে খঞ্জর বের করে গলার কাছে ঘাড়ের ঠিক উপর থেকে কেটে দেয় এবং চকচক করতে থাকা পুরো গোছাটা মাটিতে কুণ্ডলীকৃত অবস্থায় পড়তে দেয়। মেহেরুন্নিসা তার চারপাশ থেকে একটা সম্মিলিত আঁতকে উঠার শব্দ শুনতে পায়। একজন মেয়ের কাছে তাঁর চুল পরিত্যাগ করাই–তাঁর শ্রেষ্ঠ সৌন্দর্যের মধ্যে অন্যতম–একটা ভয়ঙ্কর আর লজ্জাজনক বিষয়।
মহিলা প্রহরীদের দু’জন এবার সামনে এগিয়ে আসে, তাঁদের আঁটসাট জামার বাইরের অংশ তারা খুলে রেখেছে এবং কোমরের কারুকাজ করা চামড়ার চওড়া কোমরবন্ধনী থেকে ছোট হাতলযুক্ত গিট দেয়া দড়ির চাবুক বের করে। কাঠামোর দু’পাশে নিজেদের নির্ধারিত স্থানে দাঁড়িয়ে তারা নিজেদের হাত উঁচু করে এবং পর্যায়ক্রমে বন্দির ইতিমধ্যেই কাঁপতে শুরু করা শিহরিত দেহে কশাঘাত শুরু করে। প্রতিবার আঘাত করার সময় তারা উচ্চস্বরে–এক, দুই, তিন–সংখ্যা গুনতে থাকে এবং প্রথমদিকে প্রতিবার বাতাস কেটে হিসহিস শব্দে চাবুকের গিঁটঅলা দড়ি মেয়েটার নরম, মসৃণ ত্বকে কামড় দেয়ার সময় সে চিৎকার করে উঠে যতক্ষণ না সেটা একটানা একটা প্রায় পাশবিক গোড়ানিতে পরিণত হয়। সে বেপরোয়াভাবে কিন্তু বৃথাই মোচড়াবার চেষ্টা করে নিজের দেহকে চাবুকের নাগাল থেকে সরিয়ে নিতে চায়। শীঘ্রই তাজা রক্ত তার মেরুদণ্ড আর পিঠ বেয়ে পড়তে শুরু করে এবং নিতম্বের মাঝ দিয়ে গড়িয়ে তার পায়ের কাছে পাথরের উপরে চকচক করতে থাকে। মেহেরুন্নিসা টের পায় তাঁর চারপাশের প্রাঙ্গণে একটা থমথমে নিরবতা নেমে এসেছে।
‘উনিশ’, ‘বিশ’, প্রহরীরা গুনে চলে, তাঁদের নিজেদের দেহও এখন ঘামের জেল্লায় চিকচিক করছে। চাবুকের পনেরতম আঘাতের সাথে সাথে কড়িকাঠে ঝুলন্ত নিস্তেজ, রক্তাক্ত দেহটা ভয়ঙ্কর চিৎকার করা বন্ধ করেছে এবং অচেতন দেখায়। অনেক হয়েছে, খাজাসারা হাত তুলে বলেন। সে যেমন আছে সেভাবেই নগ্ন অবস্থায় তাকে যাও এবং বাইরের রাস্তায় তাকে ফেলে দাও। বাজারের বেশ্যাপল্লীতে সে নিজের স্বাভাবিক স্থান খুঁজে নেবে। তারপরে সে তার পদমর্যাদাসূচক দণ্ডটা সামনে ধরে আঙিনার ভিড়ের ভিতর দিয়ে এগিয়ে যেতে শুরু করলে তার পেছনে সম্মিলিত কণ্ঠের একটা দুর্বোধ্য শব্দের সৃষ্টি হয়।
মেহেরুন্নিসা কাঁপতে থাকে এবং সে সামান্য অসুস্থবোধও করতে থাকে। তাঁর তাজা বাতাস এবং ফাঁকা জায়গা দরকার। ফাতিমা বেগমকে কথাটা বলেই যে সে অসুস্থবোধ করছে, সে দ্রুত খালি হতে থাকা প্রাঙ্গণের একপ্রান্তে অবস্থিত ঝর্ণার কাছে প্রায় দৌড়ে যায় এবং ঝর্ণার মার্বেলের কিনারে বসে সে তার চোখে মুখে পানির ঝাপটা দেয়।
মালকিন, আপনি কি ঠিক আছেন?’ সে তাকিয়ে দেখে নাদিয়া দাঁড়িয়ে রয়েছে।
‘হ্যাঁ। ব্যাপারটা আসলে আমি জীবনে এমন কিছু কখনও দেখিনি। আমি জানতাম না যে হারেমের শাস্তি এমন ভয়ঙ্কর হতে পারে।
‘মেয়েটাকে ভাগ্যবান বলতে হবে। কশাঘাতের চেয়ে আরও ভয়ঙ্কর কিছু হতে পারতো। আপনি নিশ্চয়ই আনারকলির গল্প শুনেছেন।
মেহেরুন্নিসা তাঁর মাথা নাড়ে।
‘তাকে লাহোরের রাজকীয় প্রাসাদের ভূগর্ভস্থ কুঠরিতে জীবন্ত কবর দেয়া হয়েছিল। তাঁরা বলে যে রাতের বেলা আপনি যদি সেখান দিয়ে যান তাহলে তাকে বের হতে দেয়ার জন্য এখনও তার কান্নার শব্দ শুনতে পাবেন।’
“সে এমন কি করেছিল যেজন্য তাকে এভাবে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে?
‘সে ছিল সম্রাট আকবরের সবচেয়ে প্রিয় এবং কাঙ্খিত রক্ষিতা কিন্তু সে তাঁর সন্তান, আমাদের বর্তমান সম্রাট জাহাঙ্গীরকে, নিজের প্রেমিক হিসাবে বরণ করেছিল।
মেহেরুন্নিসা পরিচারিকার দিকে নিস্পলক চোখে তাকিয়ে থাকে। আনারকলি নিশ্চয়ই সেই রক্ষিতার নাম যার আলিঙ্গণের কারণেই জাহাঙ্গীরকে কাবুলে নির্বাসনে যেতে হয়েছিল। মুহূর্তের দুর্বলতার কারণে কি চরম মূল্যই না দিতে হয়েছে… ‘নাদিয়া, ঘটনাটা আসলে কি ঘটেছিল? গল্পের সুযোগ দেখে পরিচারিকার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠে। সে স্পষ্টতই গল্পটা বলতে পছন্দ করে। অন্যকারো চেয়ে আনারকলির জন্য আকবরের আকর্ষণটা বেশি ছিল। সে একবার আমাকে বলেছিল যে তারা দু’জনে যখন একলা থাকতো তখন তিনি তাকে নগ্ন অবস্থায় কেবল দেয়া অলঙ্কার পরিহিত হয়ে তাঁর নাচ দেখতে পছন্দ করতেন। গুরুত্বপূর্ণ নওরোজ উৎসবের একরাতে তিনি বিশাল এক ভোজসভার আয়োজন করে সেখানে তার এবং তাঁর অভিজাতদের সামনে আনারকলিকে তিনি নাচতে আদেশ করেন। আকবরের সন্তান যুবরাজ জাহাঙ্গীরও অতিথিদের একজন ছিলেন। তিনি আগে কখনও তাকে দেখেননি এবং আনারকলির সৌন্দর্য তাকে এতই মোহিত করে ফেলে যে সে তার আব্বাজানের রক্ষিতা হওয়া সত্ত্বেও তিনি তাকে পাবার জন্য মরীয়া হয়ে উঠেন। তিনি সেই সময়ের হেরেমের খাজাসারাকে ঘুষ দেন যে আকবর যখন দরবারে থেকে দূরে ছিলেন তখন আনারকলিকে তাঁর কাছে নিয়ে আসে।
‘আর তাদের কেউ দেখে ফেলেছিল। ‘প্রথম প্রথম কেউ দেখেনি, নাহ্। কিন্তু আনারকলির জন্য জাহাঙ্গীরের কামনা বৃদ্ধি পাবার সাথে সাথে তাঁর হঠকারিতাও বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। খাজাসারা সবকিছু দেখে ভয় পেয়ে গিয়ে সম্রাটের কাছে সবকিছু বলে দেয়। তিল তিল করে মৃত্যুর বদলে পুরষ্কার হিসাবে দ্রুত তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। সম্রাট তারপরে আনারকলি আর জাহাঙ্গীরকে তার সামনে হাজির করার আদেশ দেন। আকবরের দেহরক্ষীদের একজন ছিলেন আমার চাচাজান এবং তিনি সবকিছু দেখেছিলেন। তিনি আমাকে বলেছেন আনারকলি নিজের জীবন ভিক্ষা চেয়ে অনুনয় বিনয় করেছিল, অশ্রুতে তার চোখের কাজলে সারা মুখ লেপ্টে গিয়েছিল, কিন্তু তার ব্যাপারে আকবর চোখ কান বন্ধ করে ছিলেন। এমনকি জাহাঙ্গীর পর্যন্ত যখন চিৎকার করে বলে যে আনারকলি নয়, সেই দোষী সম্রাট তাকে চুপ করে থাকতে বলেন। তিনি আনারকলিকে একটা ভূগর্ভস্থ কক্ষে রেখে দেয়াল তুলে দিতে বলেন এবং সেখানেই ক্ষুধা তৃষ্ণায় মৃত্যুবরণ করার জন্য ফেলে রাখেন।
‘যুবরাজের ভাগ্যে আমার চাচাজান বলেছেন যে সম্রাটের অভিব্যক্তি দেখে সবাই ধরে নিয়েছিল যে আকবর তার মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেবেন। আনারকলিকে টেনেহিঁচড়ে সেখান থেকে সরিয়ে নেয়ার পরে উপস্থিত অমাত্যদের মাঝে একটা থমথমে নিরবতা বিরাজ করতে থাকে। কিন্তু তার আসল অভিপ্রায় যাই হোক, তাঁর ক্রোধ যতই প্রবল হোক, শেষ মুহূর্তে আকবর নিজের সন্তানকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া থেকে কোনো মতে নিজেকে বিরত রাখেন। তিনি এরবদলে যুবরাজকে নির্বাসিত করেন কেবল তার দুধ-ভাই তার সাথে সঙ্গী হিসাবে গমন করে।
মেহেরুন্নিসা মাথা নাড়ে। আমি জানি। আমার আব্বাজান যখন কাবুলের কোষাধ্যক্ষ ছিলেন তখন তাকে সেখানে পাঠান হয়েছিল।
‘কিন্তু আনারকলির গল্পের এখানেই সমাপ্তি নয়, অন্তত আমার মনে হয় না ব্যাপারটা এভাবে…’
‘তুমি কি বলতে চাও?
‘অন্তত হেরেমের ভিতরে একটা গুজব রয়েছে যে আনারকলির যন্ত্রণা লাঘব করতে জাহাঙ্গীর তার দাদিজান হামিদাকে রাজি করিয়ে ছিল এবং তাকে জীবন্ত সমাধিস্থ করতে দেয়ালের শেষ ইটটা গাঁথার আগে যেভাবেই হোক হামিদা তাঁর কাছে বিষের একটা শিশি পৌঁছে দেন যাতে করে সে দীর্ঘ আর যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুর বিভীষিকা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে।’
বিকেলের বাতাসের সমস্ত উষ্ণতা সত্ত্বেও মেহেরুন্নিসা কাঁপতে থাকে। প্রথমে কশাঘাত এবং তারপরে এই ভয়ঙ্কর গল্প। আমার ফাতিমা বেগমের কাছে ফিরে যাওয়া উচিত, সে বলে। সে যখন নাদিয়ার সাথে প্রাঙ্গণের উপর দিয়ে হেঁটে যায়, যেখানে স্থাপিত কড়িকাঠটা ততক্ষণে সরিয়ে ফেলে পাথরের উপর থেকে রক্তের চিহ্ন ধুয়ে ফেলা হয়েছে, তার মাথায় তখনও আনারকলির শোকাবহ ঘটনাই ঘুরপাক খায়। আকবর কি এতটাই উদাসীন আর নির্মম লোক ছিলেন? অন্যেরা তার সম্বন্ধে এমন কথা বলে না এবং নিশ্চিতভাবে তাঁর আব্বাজানও তাকে এভাবে মনে রাখেন নি। গিয়াস বেগ সবসময়ে মৃত সম্রাটের প্রশংসা করেন এবং বিশেষ করে শাসনকার্য পরিচালনার সময় তিনি যে ন্যায়পরায়ণতা আর ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন। আকবর ক্রোধের বশবর্তী হয়ে সম্ভবত আত্মবিস্মৃত হয়েছিলেন এবং একজন সম্রাট হিসাবে নিজের ভাগ্যের উপরে সামান্য নিয়ন্ত্রণের অধিকারী একজন দুর্বল নারীর উপরে এমন আক্রোশপূর্ণ প্রতিশোধ নেয়া থেকে বিরত থাকার বদলে আতে ঘা লাগা একজন সাধারণ মানুষের মত আচরণ করেছেন।
জাহাঙ্গীর… নিশ্চিতভাবে সেই এখানে সবচেয়ে বেশি দোষী? তাঁর চরিত্র সম্বন্ধে এই গল্পটা থেকে সে কি বুঝতে পারে? এটাই বলে যে সে একাধারে হঠকারী, আবেগপ্রবণ আর স্বার্থপর কিন্তু সেই সাথে সে অমিত সাহসী এবং শক্তিমান প্রেমিক। সে পুরো দোষ নিজের কাঁধে নিয়ে আনারকলিকে রক্ষা করতে চেষ্টা করেছিল। সে যখন সেটা করতে ব্যর্থ হয়েছে তখন তাকে আরও কষ্টের হাত থেকে বাঁচাতে তাঁর পক্ষে যা করা সম্ভব ছিল সে তাই করেছে। মেহেরুন্নিসা তাঁর চমৎকার দৈহসৌষ্ঠব তাঁর চোখের সেই আবেগঘন চাহনি যা তাঁর সামনে নাচার সময় তাকে বাধ্য করেছিল মুখের নেকাব ফেলে দিতে। পুরো ব্যাপারটাই অদ্ভূত, কিন্তু আনারকলির প্রতি তাঁর অভিশপ্ত ভালোবাসার গল্প কোনোভাবে তাকে তার দৃষ্টি ছোট করে না–বরং প্রায় উল্টো হয়। পৌরুষদীপ্ত শক্তিতে ভরপুর আর এত অমিত ক্ষমতার অধিকারী এমন একটা মানুষের সাথে জীবন কাটান কতটা রোমাঞ্চকর হতে পারে।
একান্ত অনাহূতভাবে অন্যান্য আরো সংযত ভাবনাগুলো প্রায় একই সাথে উঁকি দিতে শুরু করে। আনারকলির গল্প আর তাঁর নিজের ভিতরে কি মনোযোগ নষ্টকারী সাদৃশ্য নেই? জাহাঙ্গীর আনারকলিকে মাত্র একবার দেখেছিলেন এবং সেটাই আনারকলিকে নিজের করে পাবার জন্য তাকে মরীয়া করে ভোলার জন্য যথেষ্ট ছিল এবং তাকে পাবার জন্য তার প্রয়াস ছিল নির্মম। মেহেরুন্নিসাকেও তিনি কেবলই একবারই দেখেছিলেন এবং সেটা আনারকলির মৃত্যুর খুব বেশি দিন পরে নয় এবং তিনি তাকেও পেতে চেয়েছিলেন। সে নিজেকে বোঝাতে চেষ্টা করে যে দুটো ব্যাপার এক নয়। জাহাঙ্গীর প্রকাশ্যে এবং যথাযথ সম্মান প্রদর্শনপূর্বক তাঁর আব্বাজানের কাছে তার জন্য প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন। তাঁর আব্বাজান যখন সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল তিনি সেটা মেনেও নিয়েছিলেন। তিনি কি আসলেই মেনে নিয়েছিলেন?
মেহেরুন্নিসার মস্তিষ্ক এখন ঝড়ের বেগে কাজ করতে শুরু করে। কাবুল থেকে গিরিপথের ভিতর দিয়ে সমভূমিতে নামার সময় তার পাশ দিয়ে অতিক্রমকারী নীল-চোখের সেই অশ্বারোহীকে অনাদিষ্টভাবে সে তার চোখের সামনে আরো একবার দেখতে পায়। সেই সময়ে, সে লাডলির আয়া ফারিশাকে বলেছিল, একটা ভয়ঙ্কর আর ততদিনে ভুলে যাওয়া একটা গুজব, লোকটা কে খুঁজে বের করতে। মাত্র দুই দিন পরেই মেয়েটা তাকে উৎফুল্ল ভঙ্গিতে জানায় যে নীল চোখের অধিকারী একজন বিদেশী সৈন্য আদতেই দেহরক্ষীদের ভিতরে রয়েছে–একজন ইংরেজ যাকে সম্রাট সম্প্রতি নিয়োগ করেছেন। সেই সময়ে এই সংবাদটা শুনে মেহেরুন্নিসা নিজেকে বুঝিয়ে ছিলেন যে ফারিশার কোথাও ভুল হয়েছে। শের আফগানের কথিত আততায়ী একজন পর্তুগীজ। তাছাড়া, সে নিজেকে আরও বোঝাতে থাকে, এই ফিরিঙ্গিগুলোকে দেখতে প্রায়শই একইরকম লাগে এবং সে আধো আলোকে আর ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে কয়েক পলকের জন্য তার স্বামীর আততায়ীকে দেখেছিল। কিন্তু সে এখনও মনে মনে ব্যাপারটা নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারেনি। তাঁর স্বামীর গলায় খঞ্জর চালাবার সময় ধুসর চোখের সেই দৃষ্টি সে কীভাবে ভুলে যাবে বা সে যখন সেই চোখ আবার দেখবে তখন কীভাবে তার ভুল হবে?
কিন্তু মেহেরুন্নিসা এখন চিন্তা করে সে কি আসলেই সত্যের কাছাকাছি পৌঁছেছে। আনারকলিকে জাহাঙ্গীর কামনা করতেন এবং তাকে পাবার জন্য তিনি কোনো বাধাই মানেননি। তিনি যদি তাকে, মেহেরুন্নিসাকে, কামনা করে থাকেন, তাহলে তিনি কেন কম নির্দয় হবেন? মেহেরুন্নিসা দ্বিতীয়বারের মত কেঁপে উঠে কিন্তু এবার মৃত রক্ষিতার বদলে তাঁর নিজের কথা চিন্তা করে। জাহাঙ্গীর তাকে এতটাই কামনা করে ভাবতেই ব্যাপারটা তাঁর দেহে শিহরণ তোলে, কিন্তু আনারকলির ভাগ্য দেখে এটাও বুঝতে পারে যে রাজপরিবারের সাথে এত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক পুরষ্কারের পাশাপাশি বিপদও বয়ে আনতে পারে…
১.০৫ মীনা বাজার
জাহাঙ্গীর টের পায় প্রতিপক্ষের তরবারির বাঁকানো ফলা পিছলে গিয়ে তাঁর গিল্টি করা চামড়ার পর্যাণের গভীরে কেটে বসার পূর্বে উরু রক্ষাকারী ধাতব শৃঙ্খল নির্মিত বর্মের ইস্পাতের জালিতে ঘষা খায়। সে তার কালো ঘোড়ার লাগাম শক্ত হাতে টেনে ধরে সে শত্রুর হাত চিরে দেবার অভিপ্রায়ে তরবারি হাঁকায় লোকটা তখন নিজের অস্ত্র দিয়ে আরেকবার আঘাত করতে সেটা সরিয়ে আনতে চেষ্টা করছে। সে অবশ্য, অন্য অশ্বারোহী ভীষণ ভাবে নিজের ধুসর ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরায় জন্তুটা পিছনের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে যেতে, লক্ষ্যভেদে ব্যর্থ হয়। জটার হাচড়পাঁচড় করতে থাকা সামনের পায়ের খুর তার বাহনের উদরে এসে লাগে। অন্যটা তার পায়ের গুলের উপরের অংশে আঘাত করে। আঘাতটা যদিও পিছলে যায় কিন্তু এটা তাঁর পায়ের নিচের অংশ অবশ করে দেয় এবং তাঁর পা রেকাব থেকে ছিটকে আসে।
জাহাঙ্গীরের ঘোড়াটা যন্ত্রণায় চিহি শব্দ করে একপাশে সরে যেতে, সে ভারসাম্য হারায় কিন্তু দ্রুত সামলে নিয়ে, নিজের বাহনকে শান্ত করে এবং রেকাবে পুনরায় পা রাখতে সক্ষম হয়। অন্য লোকটা ততক্ষণে পুনরায় তাকে আবার আক্রমণ করতে এগিয়ে এসেছে। জাহাঙ্গীর তার কালো ঘোড়ার ঘামে ভেজা গলার কাছে নুয়ে আসতে তার প্রতিপক্ষের তরবারির ফলা বাতাসে ফণা তোলার মত শব্দ করে ঠিক তার শিরোস্ত্রাণের পালক স্পর্শ করে বের হয়ে যায়। জাহাঙ্গীর তার ঘোড়াটা বৃত্তাকালে ঘুরিয়ে নিয়ে পুনরায় শত্রুর মুখোমুখি হবার ফাঁকে চিন্তা করার খানিকটা অবসর পেতে ভাবে, রাজা বিদ্রোহী হলেও একজন সত্যিকারের যোদ্ধা যে হামলার সময় তাঁর মুখোমুখি হবার সাহস দেখিয়েছে। উভয় যোদ্ধাই নিজেদের বাহনের পাঁজরে তাদের গোড়ালি দিয়ে গুঁতো দেয় এবং একই সাথে সামনে এগিয়ে আসে আক্রমণ করতে। জাহাঙ্গীর এবার তার প্রতিপক্ষের গলা লক্ষ্য করে নিজের তরবারি হাঁকায়। আঘাতটা প্রথমে ইস্পাতের বক্ষাবরণীর প্রান্তে আটকে যায় কিন্তু তারপরে মাংসে এবং পেশীতন্তুতে কামড় বসায়। রাজার বাঁকানো তরবারির ফলা তার তরবারি ধরা হাতের লম্বা চামড়ার দাস্তানা চিরে ভেতরে ঢুকতে জাহাঙ্গীরও একই সময়ে হুল ফোঁটানর মত যন্ত্রণা অনুভব করে এবং সাথে সাথে তাঁর হাত বেয়ে রক্ত পড়তে শুরু করে। ঘোড়ার মুখ দ্রুত ঘুরিয়ে নিয়ে সে দেখে তার প্রতিপক্ষ ধীরে ধীরে নিজের পর্যাণ থেকে একপাশে কাত হয়ে যাচ্ছে এবং তারপরে ভোতা একটা শব্দ করে ধুলি আচ্ছাদিত মাটিতে আছড়ে পড়তে তার হাত থেকে তরবারির বাট ছিটকে যায়।
জাহাঙ্গীর নিজের পর্যাণ থেকে লাফিয়ে নিচে নামে এবং পায়ের আঘাতপ্রাপ্ত গুলের কারণে খানিকটা দৌড়ে, খানিকটা খুড়িয়ে ভূপাতিত লোকটার দিকে নিজেকে ধাবিত করে। তার ঘাড়ের ক্ষতস্থান থেকে যদিও টকটকে লাল রক্ত স্রোতের মত বের হয়ে তার ঘন, কালো কোঁকড়ানো দাড়ি এবং বুকের বর্ম সিক্ত করছে, সে তখনও নিজের পায়ে উঠে দাঁড়াতে আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে।
‘আত্মসমর্পণ করো, জাহাঙ্গীর আদেশের সুরে বলে।
‘আর তোমার প্রাসাদের ভূগর্ভস্থ কুঠুরিতে নিজের জানটা খোয়াই? কখনও না। আমি এই লাল মাটির বুকেই মৃত্যুবরণ করবো বহু পুরুষ ধরে যা আমার পরিবারের অধিকারে রয়েছে–আমাদের ভূমি দখলকারী তোমাদের লোকের চেয়ে তাদের সংখ্যা অনেক বেশি। শব্দগুলো রক্তের বুদ্বুদের সাথে মিশে তার ঠোঁট দিয়ে বের হতে সে তার দেহের শেষ শক্তিটুকু দিয়ে তার পায়ের ঘোড়সওয়াড়ীর জুতোর ভিতরে রক্ষিত একটা ময়ান থেকে খাঁজকাটা ফলাযুক্ত লম্বা একটা খঞ্জর টেনে বের করে আনে। সে আঘাত করার জন্য নিজের হাত পিছনে নেয়ার পূর্বেই জাহাঙ্গীরের তরবারি আরো একবার লোকটার গলায় আঘাত হানে, এবার তার কণ্ঠার হাড়ের ঠিক উপরে আঘাত করতে, তার দেহ থেকে তাঁর মাথাটা প্রায় আলাদা হয়ে যায়। লোকটা পিছনে শুয়ে পরলে, তার রক্ত ছিটকে এসে ধুলো লাল করে দিতে থাকে। তার দেহটা একবার কি দুইবার মোচড় খায় এবং তারপরে সে নিথর হয়ে পড়ে থাকে।
জাহাঙ্গীর প্রাণহীন শবদেহটার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। তার উধ্ববাহুর ক্ষতস্থান থেকে তাঁর নিজের উষ্ণ আর পিচ্ছিল রক্ত এখনও তার হাত বেয়ে গড়িয়ে তার দাস্তানার ভেতরের আঙুলের জমা হচ্ছে। সে গলা থেকে আহত হাত দিয়ে নিজের মুখ মোছার কাপড়টা টেনে নিয়ে পায়ের গুলুইয়ের ক্ষতস্থানে সেটা কোনোমতে হাল্কা করে জড়িয়ে রাখে যেখানে খুরের আঘাতে সেখানের ত্বকের সাথে নিচের চর্বির স্তর ভেদ করে তার পায়ের গোলাপি রঙের মাংসপেশী বের করে ফেলেছে।
সে আজ সহজেই নিহত হয়ে, তার উচ্চাকাঙ্খ পরিপূর্ণ করা শুরু করার আগেই, অনায়াসে প্রাণ হারাতে এবং সিংহাসন হারাতে পারতো। সে কেন। মির্জাপুরের রাজার বিরুদ্ধে অভিযানে যে এই মুহূর্তে তাঁর পায়ের কাছে হাত-পা ছড়িয়ে নিথর হয়ে পড়ে রয়েছে তার মন্ত্রণাদাতাদের পরামর্শ উপেক্ষা করে নিজে ব্যক্তিগতভাবে সেতৃত্ব দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল? খসরুর বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় সে যেমন করেছিল ঠিক তেমনই রাজার সৈন্যদের বিরুদ্ধে হামলা করার সময় নিজের দেহরক্ষীদের পিছনে ফেলে সে কেন দ্রুত সামনে এগিয়ে গিয়েছিল? মির্জাপুরের রাজা বস্তুতপক্ষে তার সিংহাসনের জন্য তেমন সত্যিকারের হুমকির কারণ ছিল না, সামান্য এক অবাধ্য জায়গীরদার, রাজস্থানের মরুভূমির সীমান্তে অবস্থিত একটা ছোট রাজ্যের শাসক যে রাজকীয় কোষাগারে বাৎসরিক খাজনা পরিশোধ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। সে তার মন্ত্রণাদাতাদের যা বলেছিল–সে দেখাতে চায় যে সে তার অধীনস্ত কারো কাছ থেকে কোনো ধরনের অবাধ্যতা সহ্য করবে না তাঁরা যতই ক্ষমতাধর কিংবা তুচ্ছ হোক এবং বিদ্রোহীদের শাস্তি দিতে সে কারো উপরে নির্ভরশীল হতে চায় না–সেটা ছিল আংশিক উত্তর।
অভিযানটায় তাঁর নিজের নেতৃত্ব দেয়ার পিছনে অবশ্য অতিরিক্ত আরো একটা কারণ রয়েছে সেটা সে নিজেই নিজের কাছে স্বীকার করে। অভিযানটা আগ্রা থেকে এবং সুফি বাবার নিষেধ সত্ত্বেও তাকে নিজের কাছে ডেকে পাঠাবার প্রায় অপ্রতিরোধ্য বাসনা থেকে তাকে সরিয়ে রেখে, তাঁর মেহেরুন্নিসার ভাবনায় চিত্তবিক্ষেপ ঘটাবে। রক্তক্ষরণ আর গরমের কারণে সহসা দুর্বলবোধ করায় জাহাঙ্গীর তার লোকদের পানি নিয়ে আসতে বলে। তারপরেই পৃথিবীটা তাঁর সামনে ঘুরতে শুরু করে।
কয়েক মিনিট পরে তার সংজ্ঞা ফিরে আসতে সে মাটিতে বিছানো একটা কম্বলের উপর নিজেকে শায়িত দেখতে পায় যখন দু’জন হেকিম উদ্বিগ্ন মুখে মরুভূমির সূর্যের নিচে তার ক্ষতস্থানের রক্তপাত বন্ধ আর সেলাই করছে। সংজ্ঞা ফিরে আসবার সাথে সাথে একটা আকষ্মিক ভাবনা তাকে পেয়ে বসে। রাজা এখন মৃত এবং অভিযান শেষ হওয়ায় সে এখন সহজেই নববর্ষ উদ্যাপনের জন্য আগ্রায় যথাসময়ে ফিরে যেতে পারবে। মেহেরুন্নিসার বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ না নেওয়ার জন্য সুফি বাবার কঠোর নির্দেশ ভঙ্গ না করেই উৎসবের আয়োজন তাকে নিশ্চিতভাবেই তার সাথে আবারও অন্তত দেখা করার সুযোগ দেবে। হেকিমদের একজনের হাতে ধরা সুই তাঁর ঊর্ধ্ববাহুর ত্বক ভেদ করতে লোকটা তার উন্মুক্ত ক্ষতস্থানের দুই পাশ সেলাই করতে শুরু করায় যন্ত্রণার তীক্ষ্ণ খোঁচা সত্ত্বেও জাহাঙ্গীর হাসি চেপে রাখতে পারে না।
*
‘আচ্ছা, আগ্রা দূর্গ সম্বন্ধে তোমার কি ধারণা?’ মেহেরুন্নিসা গিয়াস বেগের আবাসস্থলে বসে থাকার সময় তার ভ্রাতুস্পুত্রীকে জিজ্ঞেস করে। সে মনে মনে ভাবে, আরজুমান্দ বানু দেখতে কি রূপসী হয়েছে। কাবুলে খুব ছোটবেলায় দেখার পরে মেয়েটাকে সে আর দেখেনি। আরজুমান্দের বয়স এখন চৌদ্দ বছর কিন্তু তাঁর বয়সের অনেক মেয়ের মত কোনো বেমানান আনাড়িপনা তার ভিতরে নেই। তাঁর মুখটা কোমল ডিম্বাকৃতি, ভ্রু যুগল নিখুঁতভাবে বাঁকানো, এবং মাথার ঘন কালো চুল প্রায় তার কোমর ছুঁয়েছে। তার চেহারায় তার পার্সী মায়ের আদল স্পষ্ট যিনি তাঁর যখন মাত্র চার বছর বয়স তখন মারা গিয়েছেন কিন্তু তার চোখ আবার তাঁর বাবা, আসফ খানের মত, কালো রঙের।
‘আমি কখনও এরকম কিছু দেখিনি–এতো অসংখ্য পরিচারিকা, এত অগণিত আঙিনা, এতগুলো ঝর্ণা, এত এত রত্নপাথর। আমরা যখন দূর্গে প্রবেশ করছিলাম তারা আমার আব্বাজানের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে তোরণদ্বারে দামামা বাজিয়েছিল।’ সবকিছুর অভিনবত্ব দেখে উত্তেজনায় আরজুমান্দের চোখ মুখ জ্বলজ্বল করতে থাকে।
মেহেরুন্নিসা স্মিত হাসে। তার কেবল মনে হয় সে যদি আবার এই বয়সে যেতে পারতো… ‘আকবরের রাজত্বকালের সময় থেকে, বিজয়ী সেনাপতির আগমনকে সম্মান প্রদর্শন করতে দামামা বাজাবার রীতির প্রচলন হয়েছে। বাজনা শুনে আমিও যারপরনাই গর্বিত হয়েছি।’
মেহেরুন্নিসার আব্বাজান কয়েক সপ্তাহ পূর্বে তাকে পত্র মারফত জানিয়েছিলেন যে তাঁর বড় ভাই আসফ খান দক্ষিণে দাক্ষিণাত্যে লড়াইয়ের সময় নিজেকে এতটাই স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত করেছেন যে সম্রাট তাকে আগ্রায় ডেকে পাঠিয়েছেন এখানের সেনানিবাসের দায়িত্ব গ্রহণ করতে। দুই সপ্তাহ পূর্বে আসফ খান আগ্রা এসে পৌঁছেছেন। মেহেরুন্নিসার প্রথমে ফাতিমা বেগম এবং পরে কর্তৃত্বপরায়ণ খাজাসারার কাছ থেকে গিয়াস বেগের আবাসস্থলে আসবার জন্য ছুটি পেতেই এতদিন সময় লেগেছে এবং সে তার ভাইয়ের সাথে দেখা করার জন্য উদগ্রীব হয়ে রয়েছে।
‘তোমার আব্বাজান কোথায়? আমি এখানে কেবল সূর্যাস্ত পর্যন্ত থাকতে পারব।’
“তিনি সম্রাটের সাথে নতুন পরিখাপ্রাচীরাদিনির্মাউ বিষয়ে নতুন পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করছেন কিন্তু তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যত শীঘ্র সম্ভব তিনি আপনার সাথে দেখা করতে আসবেন।’
মেহেরুন্নিসা শুনতে পায় তার আম্মিজান লাডলিকে আঙিনার পাশেই একটা কামরায় গান গেয়ে শোনাচ্ছে। মেয়েটা খুব দ্রুত তার অনুপস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নিয়েছে এবং সে জানে যে তার ব্যাপারটা সম্বন্ধে কৃতজ্ঞ থাকা উচিত যদিও সেটা তাকে খানিকটা আহত করে যে তাঁর মেয়ে সত্যিই তার অনুপস্থিতি তেমনভাবে উপলব্ধি করে না। তার পরিবার শনৈ শনৈ উন্নতি লাভ করছে। সম্রাটের কোষাগারের দায়িত্ব নিয়ে গিয়াস বেগকে সবসময়ে ব্যস্ত থাকতে হয়, তাঁর আম্মিজান অন্তত তাকে তাই বলেছেন, তাছাড়া আসফ খানও স্পষ্টতই জাহাঙ্গীরের অনুগ্রহভাজনদের তালিকায় শীর্ষেই রয়েছে। সেই কেবল, মেহেরুন্নিসা, যে ব্যর্থ হয়েছে। সম্রাটের কাছ থেকে সে এখনও কোনো ইঙ্গিত পায় নি এবং ফাতিমা বেগমকে খিদমত করার একঘেয়েমি প্রতিদিনই আরো বিরক্তিকর হয়ে উঠছে।
‘ফুফুজান, কি ব্যাপার? আপনাকে বিষণ্ণ দেখাচ্ছে।
নাই কিছু না। আমি ভাবছিলাম কতদিন পরে আমরা সবাই আবার একত্রিত হয়েছি।’
‘আর সম্রাটের মহিষীদের কথা বলেন? তাঁর স্ত্রী, রক্ষিতা, তাঁরা সবাই কেমন দেখতে? আরজুমান্দ নাছোড়বান্দার মত জিজ্ঞেস করে।
মেহেরুন্নিসা তাঁর মাথা নাড়ে। আমি তাঁদের কখনও দেখিনি। তাঁরা হেরেমের একটা পৃথক অংশে বাস করে যেখানে সম্রাট আহার করেন আর নিদ্রা যান। আমি যেখানে বাস করি সেখানে প্রায় সব মহিলাই, আমার গৃহকত্রীর মত, বয়স্ক।
আরজুমান্দকে হতাশ দেখায়। রাজকীয় হেরেম আমি অন্যরকম ভেবেছিলাম।’
‘আমিও সেটাই ভেবেছিলাম-’ মেহেরুন্নিসা সেই সময়েই বাইরের করিডোরে পায়ের শব্দ শুনতে পায়, এবং প্রায় সাথে সাথেই আসফ খান ভেতরে প্রবেশ করেন।
‘আমার প্রিয় বোন! পরিচারিকাদের কাছে শুনলাম তোমাকে এখানেই পাওয়া যাবে। মেহেরুন্নিসা তাঁর আসন ছেড়ে পুরোপুরি উঠে দাঁড়াবার আগেই সে তাকে তার বাহুর মাঝে জাপটে ধরে মেঝে থেকে প্রায় শূন্যে তুলে নেয়। ভাইজান তাঁদের আব্বাজানের মতই লম্বা কিন্তু আরো চওড়া আর থুতনি চৌকা। সে তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। তুমি বদলে গিয়েছে। আমি তোমায় শেষবার যখন দেখেছিলাম তখন তুমি নিতান্তই একজন বালিকা–আরজুমান্দের চেয়ে বেশি বয়স হবে না, এবং অনেকবেশি লাজুক। কিন্তু এখন তোমায় দেখে…’
‘আসফ খান আপনার সাথে দেখা হয়েও খুব ভালো লাগছে। আমিও যখন শেষবার আপনাকে দেখেছিলাম তখন আপনি কৃশকায় লম্বা পা আর মুখে ফুস্কুড়িবিশিষ্ট একজন তরুন যোদ্ধা, সেও পাল্টা খোঁচা দেয়। আর এখন আপনি আগ্রা সেনানিবাসের দায়িত্বে রয়েছেন।
আসফ খান কাঁধ ঝাঁকায়। সম্রাট আমার প্রতি সদয়। আমি আশা করি আমার ভাইও আমার মতই ভাগ্যবান হবে। আমি যদি পারতাম তাহলে মীর খানকে গোয়ালিওর থেকে এখানে বদলি করে আনতাম তাহলে আমাদের পরিবার সত্যিই আবার একত্রিত হতে পারতো। আমাদের অভিভাবকদের, বিশেষ করে আম্মিজান এতে খুবই খুশি হতেন… কিন্তু আরো খবর রয়েছে। সম্রাট সামনের মাসে আগ্রা দূর্গে আয়োজিত রাজকীয় মিনা বাজারে অংশ নিতে আমাদের পরিবারকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।’
‘সেটা আবার কি? আরজুমান্দ বিভ্রান্ত চোখে তার আব্বাজানের দিকে তাকিয়ে থাকে কিন্তু মেহেরুন্নিসা তাঁর কৌতূহল নিবৃত্ত করতে উত্তর দেয়।
‘বাজারটা হলো নওরোজেরই একটা অংশ–রাশিচক্রের প্রথম রাশি মেষে সূর্যের প্রবেশ করা উপলক্ষ্যে সম্রাট আকবরের প্রবর্তন করা আঠারো দিনব্যাপী নববর্ষ উদযাপন অনুষ্ঠান। ফাতিমা বেগম সবসময়ে অভিযোগ করেন যে উৎসব শুরু হবার দুই সপ্তাহ আগে থেকে মিস্ত্রিরা দূর্গের উদ্যানে সুসজ্জিত শিবির স্থাপন করা আরম্ভ করলে হারেমে তখন কেবল তাদের হাতুড়ির আওয়াজ শোনা যায়।’
‘আর রাজকীয় মিনা বাজার?
‘অনুষ্ঠানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এটা অনেকটা সত্যিকারের বাজারের মতই পার্থক্য হল এখানে রাজপরিবারের সদস্য আর অভিজাতেরা কেবল ক্রেতা। দূর্গের উদ্যানে রাতের বেলা এটা আয়োজন করা হয়। অমাত্যদের –স্ত্রী আর কন্যারা–আমাদের মত মেয়েরা–টেবিলের উপরে পট্টি করে বাঁধা রেশম আর তুচ্ছ অলংকারের পসরা সাজিয়ে বসে এবং বিক্রেতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে তাঁদের সম্ভাব্য ক্রেতাদের রাজকুমারী আর রাজপরিবারের প্রবীণাদের আর সেই সঙ্গে সম্রাট আর তাঁর যুবরাজদের সাথে দর কষাকষি আর হাসি ঠাট্টায় মেতে উঠে। অনুষ্ঠানটা এতটাই ঘরোয়া যে সব মেয়েরা এদিন নেকাব ছাড়াই চলাফেরা করে।
‘আব্বাজান, আমি যেতে পারবো, আমি পারবো না?’ আরজুমান্দকে সহসা উদ্বিগ্ন দেখায়।
‘অবশ্যই। আমাকে এখন আবার তোমাদের ছেড়ে যেতে হচ্ছে। আমাকে আরো কিছু সামরিক সমস্যার তদারকি করতে হবে কিন্তু আমি শীঘ্রই ফিরে আসবো।’
আসফ খান চলে যেতে, মেহেরুন্নিসা আরজুমান্দ বানুর সাথে বসে তার উৎসুক সব প্রশ্নের উত্তর দিতে চেষ্টা করে। কিন্তু তার মনটা অন্য কোথায় পড়ে থাকে। ফাতিমা বেগম তাকে বাজারের সব কথাই বলেছেন কিন্তু সবকিছু তার পছন্দ হয়নি এবং এমন কিছু তিনি বলেছেন মেহেরুন্নিসা অবশ্যই যা তার ভাস্তির সামনে বলতে পারবে না। মিনা বাজার আসলে একটা মাংসের বাজার–এর বেশি কিছু না। আকবর এটা শুরু করেছিলেন কারণ তিনি নতুন শয্যাসঙ্গিনী পছন্দ করার একটা সুযোগ চেয়েছিলেন। কোনো কুমারী মেয়ে যদি তার চোখে ধরতো তাহলে তাঁর মনোরঞ্জনের জন্য মেয়েটাকে প্রস্তুত করতে তিনি খাজাসারাকে আদেশ দিতেন। বৃদ্ধার আপাত সহানুভূতিশীল চেহারায় ভ্রুকুটি দেখে মেহেরুন্নিসা আঁচ করে যে বহু দিন আগে বাজারে এমন কিছু একটা হয়েছিল যাতে তিনি আহত হয়েছেন। তিনি সম্ভবত আকবরের বাছবিচারহীন যৌন সংসর্গ অপছন্দ করেন। আরজুমান্দের মতই মেহেরুন্নিসাও অন্তরের গভীরে উত্তেজনা অনুভব করে–বাজারই একমাত্র স্থান যেখানে সে নিশ্চিতভাবেই সম্রাটকে দেখতে পাবে। কিন্তু ফাতিমা বেগম কি তাকে অংশগ্রহণের অনুমতি দেবেন?
*
এক সপ্তাহ পরের কথা ফাতিমা বেগমের দমবন্ধ করা আবাসস্থলে সন্ধ্যার মোমবাতি জ্বালানো হতে মেহেরুন্নিসা তাঁর প্রশ্নের উত্তর পায়। যেদিন থেকে সে বৃদ্ধাকে তার আমন্ত্রণের কথা বলেছে তিনি বাকচাতুরীর আশ্রয় নিতে শুরু করেছেন। মেহেরুন্নিসা এখন যদিও নিজেকে সবচেয়ে সুন্দর পোষাকে এবং মূল্যবান অলঙ্কারে সজ্জিত করেছে, তিনি তাঁর মুখাবয়বে একটা একগুয়ে অভিব্যক্তি ফুটিয়ে রাখেন মেহেরুন্নিসা যার অর্থ ভালোই বুঝে।
‘আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তুমি একজন বিধবা। বাজারে অংশগ্রহণ করাটা আপাত দৃষ্টিতে তোমার জন্য সমীচিত হবে না। আর এসব হাঙ্গামায় যাবার জন্য আমার যথেষ্ট বয়স হয়েছে। তুমি বরং আমাকে পার্সী কোনো কবিতা পড়ে শোনাও। আমাদের দুজনের জন্যই সেটা বাজারের হট্টগোল আর অশিষ্টতার চেয়ে আনন্দদায়ক হবে।
মেহেরুন্নিসা দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে কবিতার একটা খণ্ড তুলে নেয় এবং হতাশায় কম্পিত আঙুলি দিয়ে লাল রঙের সুগন্ধি কাঠের মলাটের রূপার বাকল ধীরে ধীরে খুলে।
*
আগ্রা দূর্গের বিশাল দূর্গপ্রাঙ্গন সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছে, খুররম ভাবে যখন সে, তিনবার তূর্যবাদনের সাথে, তাঁর বড় ভাই পারভেজের সাথে তাদের আব্বাজান জাহাঙ্গীরকে অনুসরণ করে সেখানে প্রবেশ করে, তাদের তিনজনেরই পরনে আজ সোনার জরির কারুকাজ করা পোষাক। গাছের ডাল আর ঝোঁপঝাড় থেকে ঝুলন্ত কাঁচের রঙিন গোলাকার পাত্রে মোমবাতি জ্বলছে এবং সোনা আর রূপার তৈরি কৃত্রিম গাছে রত্ন-উজ্জ্বল ছায়া–লাল, নীল, হলুদ, সবুজ-মৃদু বাতাসে আন্দোলিত হয়। দেয়ালের চারপাশে সে মখমল দিয়ে মোড়া ছোট ছোট উন্মুক্ত দোকানে পলকা অলঙ্কারের পসরা। সাজিয়ে মেয়েদের সেখানে অপেক্ষমান দেখে। তাঁর দাদাজানের সময়ের মতই পুরো ব্যাপারটা জমকালো দেখায়। সমস্ত নওরোজ উৎসবকালীন সময়ে আকবরের আনন্দ সে এখনও প্রাঞ্জলভাবে মনে করতে পারে। ‘সম্পদশালী হওয়াটা ভালো–বস্তুতপক্ষে এটা আবশ্যিক। কিন্তু একজন সম্রাটের জন্য সেটা প্রদর্শন করা যে তুমি সম্পদশালী সেটা আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’
জাঁকজমকপূর্ণ প্রদর্শনীর অর্থ আকবর ভালোই বুঝতেন। খুররমের ছেলেবেলার কিছু স্মৃতি রয়েছে যেখানে সে ঝলমলে হাওদার নিচে আকবরের পাশে বসে রয়েছে আর তারা আগ্রার সড়ক দিয়ে হাতির পিঠে চড়ে চলেছে। নিজের প্রজাদের কাছে নিজেকে দর্শন দেয়ার বিষয়ে বরাবরই আকবরের দুর্বলতা ছিল এবং তাঁরাও এজন্য তাকে ভালোবাসতো। আকবর ছিলেন সূর্যের মত এবং তার খানিকটা প্রভা খুররম ভাবে তাঁর নিজের উপরেও পড়েছে। তাঁর আব্বাজান জাহাঙ্গীর অবশ্য এই মুহূর্তে, যিনি হীরকসজ্জিত অবস্থায় জ্বলজ্বল করছেন, তাঁর অমাত্যদের পরিবেষ্টিত অবস্থায় এগিয়ে চলেছেন সবসময়ে ছায়াতেই অবস্থান করেছেন। খুররম যখন ছোট ছিল তখনও তার চারপাশে উৎকণ্ঠা আঁচ করতে পারতো–তার আব্বাজান আর দাদাজানের মাঝে, তার আব্বাজান আর তার সৎ-ভাইদের ভিতরে বড় যে সেই খসরুর মাঝে, যে তাঁদের আব্বাজানের রাজত্বকালে আয়োজিত প্রথম নওরোজের আনন্দ এখানে ভাগাভাগি করার বদলে গোয়ালিয়রে অজ্ঞাত কোনো ভূগর্ভস্থ কুঠরিতে বন্দি রয়েছে। খুররম প্রাঙ্গণের ঠিক মাঝখানে রূপার কারুকাজ করা চাঁদোয়ার নিচে একই কাপড় দিয়ে মোড়ানো বেদীর দিকে তাঁর আব্বাজানকে অনুসরণ করে এগিয়ে যাবার সময় ভাবে, খসরু অবাধ্য আর সেই সঙ্গে আহাম্মক, বেদীস্থলটা দুপাশে প্রজ্জ্বলিত মশালের আলোয় আলোকিত।
জাহাঙ্গীর বেদীতে আরোহণ করে এবং বক্তৃতা আরম্ভ করে। আজ রাতে আমাদের নওয়োজ উৎসবের যবনিকাপাত হবে যখন আমরা নতুন চন্দ্র বৎসরকে স্বাগত জানাব। আমার জ্যোতিষীরা আমাকে বলেছে যে আমাদের সাম্রাজ্যের জন্য আগামী বছরটা আরো সমৃদ্ধি বয়ে আনবে। আমার দরবারের মেয়েদের সম্মান জানাবার এখন সময় হয়েছে। রাতের তারা যতক্ষণ না আকাশ থেকে মিলিয়ে যায় তারাই, আমরা নই, এখানের। অধীশ্বর। তারা তাদের দ্রব্যের জন্য যা দাম চাইবে আমরা অবশ্যই সেটাই দিতে বাধ্য থাকবো যদি না আমরা তাঁদের অন্যভাবে ভুলাতে পারি। রাজকীয় মিনা বাজার শুরু হোক।’
জাহাঙ্গীর বেদী থেকে নেমে আসে। খুররমের কাছে মনে হয় যে তার আব্বাজান নামার সময় এম মুহূর্তের জন্য থমকে গিয়ে তার চারপাশে তাকিয়ে দেখেন যেন নির্দিষ্ট কাউকে তিনি খুঁজছেন, এবং তারপরে তাঁর মুখাবয়বে হতাশার একটা অভিব্যক্তি ফুটে উঠে। কিন্তু জাহাঙ্গীর সাথে সাথে নিজেকে সংযত করে নেন এবং হাসিমুখে মেরুন রঙের মখমল বিছানো একটা টেবিলের দিকে এগিয়ে যান খুররম চিনতে পারে পারভেজের দুধ-মায়ের একজন সেখানে বিক্রেতা সেজে স্মিত মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে। পারভেজ আব্বাজানের পিছনেই রয়েছে কিন্তু খুররম দাঁড়িয়ে যায়। পারভেজের এই দুধ-মা দারুণ বাঁচাল মহিলা এবং এই মুহূর্তে তার আর পারভেজের ছেলেবেলা সম্বন্ধে লম্বা গল্প শোনার মানসিকতা তার নেই। তার পরনের কোমর পর্যন্ত আঁটসাট কোটটা ভীষণ ভারি আর অস্বস্তিকর। সে শক্ত কাপড়ের নিচে নিজের চওড়া কাঁধ খানিকটা নমনীয় করতে চেষ্টা করলে টের পায় পিঠের চেটালো অস্থির মাঝ দিয়ে ঘামের একটা ধারা নিচের দিকে নামছে।
খুররম তাঁর আব্বাজানকে অনুসরণ করার চেয়ে আঙিনার নির্জন প্রান্তের দিকে এগিয়ে যায় যেখানে তাঁর ধারণা অপেক্ষাকৃত কমবয়সী মেয়েরা তাঁদের পসরা সাজিয়ে বসেছে। তাদের মাঝে হয়তো কোনো সুন্দরী রয়েছে যদিও এই মুহূর্তে আগ্রা বাজারের বর্তুলাকার নিতম্ব আর ভরাট বুকের এক নর্তকী তার সমস্ত মনোযোগ দখল করে রেখেছে। খুররম তারপরে খেয়াল করে প্রাঙ্গণের দেয়ালের কাছে সাদা জুই ফুলের একটা সুবিস্তৃত ঝাড়ের কাছে প্রায় অন্ধকারের ভিতরে একটা ছোট দোকানে মাটির কিছু জিনিষপত্র বিক্রির জন্য রাখা আছে। দোকানে দীর্ঘাঙ্গি, হালকা পাতলা দেখতে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সে মেয়েটার মুখটা দেখতে পায় না কিন্তু মেয়েটা যখন তার দোকানের পসরাগুলো সাজিয়ে রাখছে তখন সে তার চারপাশে আন্দোলিত লম্বা, ঘন চুলে হীরা আর মুক্তার ঝলক লক্ষ্য করে। খুররম আরো কাছে এগিয়ে যায়। মেয়েটা আপনমনে গান গাইছে এবং খুররম যখন দোকানটা থেকে মাত্র কয়েক কদম দূরে এসে দাঁড়ায় তখনই কেবল সে তার অস্তিত্ব টের পায়। বিস্ময়ে মেয়েটার কালো চোখ বড় দেখায়।
খুররম আগে কখনও এমন নিখুঁত মুখশ্রী দেখেনি। আমি তোমায় চমকে দিতে চাইনি। তুমি কি বিক্রি করছো?
মেয়েটা তার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে উজ্জ্বল নীল আর সবুজ রঙে চিত্রিত একটা ফুলদানি এগিয়ে দেয়। ফুলদানিটা মামুলি হলেও দেখতে খুবই সুন্দর। অবশ্য তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকা ঘন, দীপ্তিময় পাপড়িযুক্ত লাজুক চোখ দুটিকে কোনোভাবেই সাধারণ বলা যাবে না। খুররমের নিজেকে বেকুব মনে হয় এবং তাঁর কথা জড়িয়ে যায় আর সে ফুলদানির দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ভাবতে চেষ্টা করে কি বলা যায়।
‘আমি নিজে এটা রং করেছি। আপনার পছন্দ হয়েছে? মেয়েটা জানতে চায়। সে চোখ তুলে মেয়েটার দিকে আবার তাকালে সে দেখে মেয়েটা খানিকটা আমুদে ভঙ্গিতে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সে ভাবে, মেয়েটার বয়স কোনোমতেই চৌদ্দ কি পনের বছরের বেশি হবে না। দরবারে আরব বণিকদের আনা মুক্তার মত একটা দীপ্তি মেয়েটার কোমল ত্বকে এবং তাঁর পুরু ঠোঁট গোলাপি রঙের আর কোমল।
‘ফুলদানিটা আমার পছন্দ হয়েছে। তুমি এর দাম কত চাও?
‘আপনি কত দিতে চান? মেয়েটা নিজের মাথা একপাশে কাত করে।
‘তুমি যা চাইবে।
‘আপনি তাহলে একজন ধনবান ব্যক্তি?
খুররমের সবুজ চোখে বিস্ময় ঝলসে উঠে। মেয়েটা কি তাকে প্রাঙ্গণে প্রবেশ করতে এবং তার আব্বাজান যখন কথা বলছিলেন তখন বেদীর পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেনি? যদি নাও দেখে থাকে, তারপরেও সবাই নিশ্চিতভাবেই যুবরাজদের চেনে… ‘ঠিকই বলেছো আমি যথেষ্ট ধনী।
‘বেশ।
‘দরবারে তুমি কতদিন ধরে রয়েছে?
‘চার সপ্তাহ।’
‘তুমি এর আগে তাহলে কোথায় ছিলে?
‘সম্রাটের সেনাবাহিনীকে আমার আব্বাজান আসফ খান একজন সেনাপতি। সম্রাট তাকে আগ্রা সেনানিবাসের অধিনায়কত্ব দেয়ার পূর্বে তিনি দাক্ষিণাত্যে কর্মরত ছিলেন।
‘আরজুমান্দ… আমি তোমাকে এতক্ষণ একা রাখতে চাইনি…’ মধু-রঙা আলখাল্লায় মার্জিতভাবে সজ্জিত একজন মহিলা দ্রুত এগিয়ে আসে যার কাটা কাটা চেহারার সাথে মেয়েটার মুখের স্পষ্ট মিল রয়েছে। বয়স্ক মহিলাটা সামান্য হাপাচ্ছে কিন্তু খুররমকে দেখার সাথে সাথে তিনি সোজা হয়ে দাঁড়ান এবং মাথা সামান্য নত করেন এবং মৃদু কণ্ঠে বলেন, ‘মহামান্য যুবরাজকে ধন্যবাদ আমাদের দোকানে পদধুলি দেয়ার জন্য। আমাদের পসরাগুলো মামুলি হলেও আমার নাতি সবগুলো নিজের হাতে তৈরি করেছে।
‘সবগুলো জিনিষই দারুণ সুন্দর। আমি সবগুলোই কিনতে চাই। তুমি কেবল দামটা আমায় বলো।’
‘আরজুমান্দ, তোমার কাছে উনি জানতে চাইছেন?
আরজুমান্দকে, যে এতক্ষণ আন্তরিকতার সাথে খুররমকে পর্যবেক্ষণ করছিল, অনিশ্চিত দেখায়, তারপরে সে বলে, একটা সোনার মোহর।
‘আমি তোমায় দশটা দেবো। কর্চি আমার এখনই দশটা মোহর দরকার, খুররম তার কয়েক পা পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা সহকারীকে ডেকে বলে। কর্চি সামনে এগিয়ে আসে এবং আরজুমান্দের দিকে স্বর্ণমুদ্রাগুলো এগিয়ে ধরে। না, ওগুলো আমাকে দাও।’ তার সহকারী তার ডান হাতের তালুতে স্বর্ণমুদ্রার একটা স্রোত অর্পণ করে। খুররম ধীরে হাত তুলে ধরে এবং মেয়েটার দিকে মোহরগুলো বাড়িয়ে দেয়। বাতাসের বেগ বেড়েছে এবং
আরজুমান্দকে দেখে মনে হয় চারপাশে আন্দোলিত কাঁচের গোলক থেকে রংধনুর প্রতিটা রং বিচ্ছুরিত যেন তাকে জারিত করেছে। সে তার হাতের তালু থেকে স্বর্ণমুদ্রাগুলো একটা একটা করে তুলে নেয়। তার হাতের তালুর ত্বকে মেয়েটার আঙুলের স্পর্শ তাঁর এযাবতকালের অভিজ্ঞতার মাঝে সবচেয়ে ইন্দ্রিয়গ্রাহী অনুভূতি। চমকে উঠে, সে মেয়েটার মুখের দিকে তাকায় এবং মেয়েটার কালো চোখের তারায় তাকিয়ে নিশ্চিত প্রমাণ দেখে যে সেও একই অনুভূতিতে দগ্ধ। শেষ মুদ্রাটা তুলে নেয়া হতে সে পুনরায় হাত নামিয়ে নেয়। তাঁর কেবলই মনে হয় মেয়েটার ত্বক তাকে স্পর্শ করার যে অনুভূতি তার স্থায়িত্ব যেন অনন্তকালব্যাপী হয়… সহসা তাঁর এই অনুভূতির কারণে সে অনিশ্চিত, বিভ্রান্তবোধ করে।
“তোমাকে ধন্যবাদ।’ সে ঘুরে দাঁড়িয়ে, দ্রুত সেখান থেকে সরে আসে। প্রধান দোকানগুলোর চারপাশে ভিড় করে থাকা কোলাহলরত মানুষের চিৎকার চেঁচামেচির মাঝে ফিরে আসবার পরেই কেবল তার মনে হয় যে সে তার ক্রয় করা দ্রব্য সামগ্রী নিয়ে আসেনি এবং মেয়েটাও তাকে পেছন থেকে ডাকেনি।
*
খুররমের ঘামে ভেজা বুকে জামিলা ঠাট্টাচ্ছলে হাত বুলায়। আমার প্রভু, আজ রাতে আপনার দেহে বাঘের শক্তি ভর করেছিল। সে আলতো করে তার কানে ঠোকর দেয় এবং তার নিঃশ্বাসে সে এলাচের গন্ধ পায় মেয়েটা চিবাতে পছন্দ করে।
‘এসব বন্ধ করো।’ সে খানিকটা জোর করে তার হাত সরিয়ে দেয় এবং আলতো করে নিজেকে তার আলিঙ্গন থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। কাঠের নক্সা করা অন্তঃপট দিয়ে যদিও কক্ষটা, পাশের ঘর যেখানে মেয়েটা অন্যান্য নর্তকীদের সাথে আহার করে, আলাদা করে ঘেরা রয়েছে যেখানে সে রাতের বেলা ঘুমায় কিন্তু সে তারপরেও একজন বৃদ্ধাকে মেঝের এবড়োথেবড়ো হয়ে থাকা মাটিতে প্রবলভাবে শুকনো লতাপাতার তৈরি ঝাড় দিয়ে পরিষ্কার করতে দেখে। মেয়েরা তাদের খদ্দেরদের কাছ থেকে যা আদায় করে তাতে তার বেশ ভালোই দিন চলে যায়।
খুররম একটা ধাতব পাদানির উপরে রাখা মাটির পাত্র থেকে নিজের মুখে পানির ঝাপটা দেয়।
“কি ব্যাপার? আমি কি আপনাকে খুশি করতে ব্যর্থ হয়েছি? জামিলা কথাটা বললেও তার মুখের আত্মবিশ্বাসী হাসি বুঝিয়ে দেয় যে নিজের পারঙ্গমতার বিষয়ে তাঁর মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই।
নাহ্। অবশ্যই তুমি ব্যর্থ হওনি।
‘তাহলে কি ব্যাপার? জামিলা তার পার্শ্বদেশ ঘুরিয়ে নিয়ে দাঁড়ায়।
সে তার গোলাকৃতি সুন্দর মুখশ্রী, মেয়েটার নধর, ইন্দ্রিয়পরায়ণতার দিকে চোখ নামিয়ে আনে যে গত ছয়মাস ধরে তার আনন্দসঙ্গী। সে বাজারের পরুষ আবহাওয়া বেশ উপভোগ করে এবং মেয়েরা–এত মুক্ত আর সাবলীল মনে হয় আগ্রা দূর্গে খাজাসারা তার জন্য যেসব রক্ষিতাদের হাজির করতে পারবে তাদের চেয়ে অনেক কম ভীতিকর যেখানে সবসময়ে অসংখ্য চোখ তাকে লক্ষ্য করছে। জামিলা তাকে রতিকর্মের খুটিনাটি শিখিয়েছে। সে আগে ছিল অতিশয়-ব্যগ্র, এক আনাড়ি কিন্তু জামিলা তাকে শিখিয়েছে কীভাবে একজন নারীকে তৃপ্তি দিতে হয় এবং আনন্দদান কীভাবে তার নিজের তৃপ্তি বর্ধিত করতে পারে। মেয়েটার উষ্ণ সুনম্য দেহ, তাঁর উদ্ভাবন কুশলতা তাকে বিমুগ্ধ করতো। কিন্তু এখন সেসব অতীত। সে ভেবেছিল জামিলার সাথে সহবাস করলে হয়তো সে আরজুমান্দের প্রতি নিজের আবিষ্টতা থেকে মুক্তি পাবে কিন্তু সেরকম কিছুই হয়নি। এমনকি সে যখন জামিলার দেহ পরম আবেশে আঁকড়ে ধরেছিল তখনও সে আরজুমারে মুখ দেখতে পেয়েছে। রাজকীয় মিনা বাজার যদিও দুইমাস আগে শেষ হয়েছে, সে আসফ খানের মেয়ের কথা কিছুতেই নিজের মাথা থেকে দূর করতে পারছে না।
‘শয্যায় ফিরে চলেন। আপনার নিশ্চয়ই কিছু শক্তি এখনও অবশিষ্ট আছে এবং আমিও আপনাকে নতুন কিছু একটা দেখাতে চাই…’ জামিলা’র আদুরে কণ্ঠস্বর তাঁর ভাবনার জাল ছিন্ন করে। সে বিছানায় টানটান হয়ে বসে আছে, তার মেহেদী রাঙান স্তনবৃন্ত উদ্ধত, এবং সেও তার দু’পায়ের সংযোগস্থলে পরিচিত সক্রিয়তা অনুভব করে। কিন্তু এটা পুরোটাই হবে কেবল আরো একবার সহবাসের অভিজ্ঞতা। সে আর জামিলা অনেকটা যেন যৌনক্রিয়ায় মিলিত হওয়া দুটি পশু, শীর্ষ অনুভূতির জন্য ক্ষুধার্ত আর উদ্গ্রীব হলেও পরস্পরের প্রতি কারো কোনো আন্তরিক অনুভূতি কাজ করে না। সে যদি তার কাছে না আসতো মেয়েটা তাহলে অন্য কাউকে খুঁজে নিত, এবং সে আর তার নর্তকীর দল যখন আগ্রা ত্যাগ করবে তখন সে সহজেই তার বদলে অন্য কাউকে পেয়ে যাবে। তাদের এই ক্ষিপ্ত সহবাস, একে অন্যকে নিয়ন্ত্রণের উর্ধ্বে পৌঁছে দেয়া, একটা অস্থির বাসনাকে পরিতৃপ্ত করার আকাঙ্খ ছাড়া আর কিছুই নয়। আরজুমান্দের ভাবনা এখন যখন তার মনে সবসময়ে ঘুরপাক খাচ্ছে তখন এসব কিছু তার জন্য আর যথেষ্ট নয়।
*
‘আব্বাজান, আমি আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই।’
‘কি কথা?’ জাহাঙ্গীর নীলগাইয়ের অণুচিত্রটা সরিয়ে রাখে যা সে নিজের নিভৃত ব্যক্তিগত কক্ষে বসে পর্যবেক্ষণ করছিল। দরবারের পেশাদার শিল্পী প্রতিটা খুঁটিনাটি বিষয় সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলেছে, এমনকি কৃষ্ণসার মৃগের চামড়ার হালকা নীলাভ আভাস, এর চোখের জটিল আকৃতি… খুররম ইতস্তত করে। আমরা কি একা থাকতে পারি…
‘আমাদের একা থাকতে দাও, জাহাঙ্গীর তাঁর পরিচারকদের আদেশ দেয়। শেষ পরিচারকটার বের হয়ে যাবার পর দরজা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হবার আগেই, খুররম অনেকটা বোকার মত কথা শুরু করে। আমি একজনকে স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করতে চাই।’
জাহাঙ্গীর স্থির দৃষ্টিতে নিজের ছেলের দিকে তাকায়–তার এখন প্রায় ষোল বছর বয়স এবং ইতিমধ্যেই একজন প্রাপ্তবয়স্ক লোকের মতই লম্বা এবং পেষল দেহের অধিকারী হয়ে উঠেছে। তাঁর আধিকারিকদের ভেতরে খুব জনই তাকে কুস্তি কিংবা তরোয়ালবাজিতে পরাস্ত করার সামর্থ্য রাখে।
‘তুমি ঠিকই বলেছে, জাহাঙ্গীরকে চিন্তাকুল দেখায়। আমার প্রায় তোমার মতই বয়স ছিল যখন আমি আমার প্রথমা স্ত্রীকে গ্রহণ করি কিন্তু আমাদের তাড়াহুড়ো করার প্রয়োজন নেই। আমি বিবেচনা করে দেখবো কে তোমার জন্য যোগ্য পাত্রী হিসাবে বিবেচিত হতে পারে। জয়সলমিরের রাজপুত শাসকের বেশ কয়েকজন বিবাহযোগ্য কন্যা রয়েছে এবং তাঁর পরিবারের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থাপন আমার হিন্দু প্রজাদের প্রীত করবে। অথবা আমি আমাদের সাম্রাজ্যের সীমানার বাইরেও খুঁজে দেখতে পারি। পারস্যের শাহ পরিবারের কারো সাথে বিয়ে হলে মোগলদের কাছ থেকে কান্দাহার কেড়ে নেয়ার বাসনা ত্যাগ করতে তাকে হয়তো আরো বেশি আগ্রহী করে তুলবে…’ জাহাঙ্গীরের মন দ্রুত ভাবতে শুরু করে। সে তার উজির মাজিদ খানকে ডেকে পাঠাতে পারে এবং তাঁর অন্যান্য কয়েকজন পরামর্শদাতাকেও সম্ভবত ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনার জন্য ডেকে পাঠান যায়। আমি খুব খুশি হয়েছি খুররম, তুমি ব্যাপারটা নিয়ে সরাসরি আমার সাথে আলোচনা করেছো। তোমার প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে উঠার বিষয় এটা দৃশ্যমান করেছে এবং সেই সাথে তুমি আসলেই যে তোমার প্রথম স্ত্রীকে গ্রহণ করার উপযুক্ত হয়ে উঠেছে। আমার আবার এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করবো যখন আমি বিষয়টা নিয়ে আরো ভালোভাবে চিন্তা করবো–আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, সেটা খুব শীঘ্রই হবে।’
‘আমি আমার স্ত্রী হিসাবে আমার পছন্দের মেয়ে ইতিমধ্যে খুঁজে পেয়েছি।’ খুররমের কণ্ঠস্বর জোরালো শোনায় এবং তাঁর সবুজ চোখের মণিতে আন্তরিক অভিব্যক্তি খেলা করে।
বিস্ময়ে জাহাঙ্গীরের চোখের পাতা কেঁপে উঠে। কে সে?
‘আগ্রায় অবস্থিত আপনার সেনানিবাসের সেনাপতির কন্যা।
‘আসফ খানের মেয়ে? তুমি তাকে কোথায় দেখতে পেলে?
‘রাজকীয় মিনা বাজারে আমি তাকে দেখেছি। তার নাম আরজুমান্দ।
‘মেয়েটার বয়স কত হবে? একজন বিবাহযোগ্যা কন্যার পিতা হিসাবে আসফ খানের বয়স কমই বলতে হবে।
‘মেয়েটা আমার চেয়ে সম্ভবত সামান্য কয়েক বছরের ছোট হবে।
জাহাঙ্গীর ভ্রূকুটি করে। তার প্রথম প্রতিক্রিয়া হয় যে এটা কেবল এক ধরনের তারুণ্যপূর্ণ মোহ–সম্ভবত ব্যাপারটা তাই ছিল–কিন্তু ব্যাপারটা অদ্ভূত। খুররমের নজর কেড়েছে যে কিশোরী সে সম্ভবত মেহেরুন্নিসার ভাস্তি এবং সেই সাথে তাঁর কোষাধ্যক্ষ গিয়াস বেগের নাতনি। বহু বছর আগে গিয়াস বেগ যখন কপর্দকশূন্য অবস্থা আর হতাশা নিয়ে আকবরের দরবারে প্রথমবার আসে তখন তাঁর দাদিজান হামিদা তাকে যা কিছু কথা বলেছিলেন তার মনে পড়ে। কি বলেছিলেন যেন? কথাগুলো অনেকটা এমন ছিল, অনেক ঘটনাই ঘটে যা এলোমেলো মনে হবে, কিন্তু আমি প্রায়শই উপলব্ধি করি আমাদের অস্তিত্বের ভিতর দিয়ে একটা ছক প্রবাহিত হচ্ছে অনেকটা যেন কোনো দিব্য কারিগরের হাত তাঁতে বসে নক্সা বুনছে… একদিন এই গিয়াস বেগ আমাদের সাম্রাজ্যের জন্য হয়ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। তার দাদিজান হামিদার ভবিষ্যতের ঘটনাবলি প্রত্যক্ষবৎ দেখার ক্ষমতা ছিল। তার কথাগুলো কেবল একজন নির্বোধই খারিজ করবে।
‘খুররম। তোমার বয়স এখনও অনেক কম কিন্তু আমি দেখতে পাচ্ছি তুমি মনস্থির করে ফেলেছে। তোমার হৃদয় যদি এই মেয়েটাকে পাবার জন্য সংকল্পবদ্ধ হয়, আমি তাহলে আপত্তি করবো না এবং তার পরিবার আর আমাদের পরিবারের ভিতরে বৈবাহিকসূত্রে মৈত্রীবন্ধনে আবদ্ধ হবার ইঙ্গিত দিতে আমি নিজে তাঁর আঙুলে বাগদানের অঙ্গুরীয় পরিয়ে দেবো। আমি তোমায় কেবল একটা অনুরোধই করবো যে বিয়ে করার পূর্বে তুমি কিছুদিন একটু অপেক্ষা করো।
জাহাঙ্গীর নিজ সন্তানের চোখে বিস্ময় দেখতে পায়–স্পষ্টতই সে এত সহজে উদ্দেশ্য সাধনের ব্যাপারটা আশা করে নি–কিন্তু তারপরেই সেটা মিলিয়ে গিয়ে আনন্দের হাসিতে পরিণত হয় এবং খুররম তাকে আলিঙ্গণ করে। আমি অপেক্ষা করবো এবং আপনি আর যা কিছু বলবেন সব করবো…’
‘আমি আসফ খানকে ডেকে পাঠাবো। আমাকে তার সাথে অনেক কিছু নিয়ে আলোচনা করতে হবে। ততদিন পর্যন্ত বিষয়টা গোপন রাখবে। তোমার আম্মিজানকেও এ ব্যাপারে এখনই কিছু বলার প্রয়োজন নেই।
খুররম বিদায় নিতে জাহাঙ্গীর যখন কক্ষে আবার একা হয়, সে নিজের মাথায় হাত দিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে। খুররমের সাথে তার কথোপকথন অনেক ভাবনার স্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি করেছে। খুররম মোটেই খসরুর মত না, যার বিশ্বাসঘাতকতা সে এখনও ক্ষমা করতে পারে নি, সে সবসময়েই একজন অনুগত সন্তান যাকে নিয়ে যেকোনো লোক গর্ববোধ করতে পারে। তার ইচ্ছে করে যে খুররমের বয়সে সে যদি এমন আত্মবিশ্বাসী হতে পারতো এবং সেই সাথে নিজের সন্তানকে সে ভালো করে চিনতো, কিন্তু নিজের প্রিয় নাতির জন্য আকবরের চরম পক্ষপাতিত্ব পুরো ব্যাপারটাকে কঠিন করে তুলেছে। আকবরের সংসারে খুররম প্রতিপালিত হয়েছিল। তাঁর দাদাজানই ছিলেন সেই ব্যক্তি–তাঁর নিজের আব্বাজান নয়–যিনি প্রথমবারের মত যুবরাজকে পাঠশালায় নিয়ে যাবার মিছিলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু সেসবই এখন অতীতের কথা, এবং সাম্প্রতিক মাসগুলোতে পিতা আর পুত্র একত্রে প্রচুর সময় অতিবাহিত করার সুযোগ পেয়েছে।
সে যাই হোক, খুররমের অনুরোধে নির্দ্বিধায় রাজি হয়ে সে নিজেই নিজেকে বিস্মিত করেছে। মোগল সাম্রাজ্যের একজন যুবরাজ নিজেই তার স্ত্রী নির্বাচন করতে পারে। আরজুমান্দ যদিও অভিজাত এক পার্সী পরিবারের সন্তান কিন্তু তারপরেও তাঁর নিজের মনে এমন একটা সম্বন্ধের কথার কখনও উদয় হতো না। কিন্তু সে নিজেই খুব ভালো করেই জানে যে, পছন্দ এখানে সবসময়ে পরিণতি লাভ করে না। হুমায়ুন আর হামিদার ক্ষেত্রে এমনটা হয়নি। মেহেরুন্নিসার প্রতি সে যেমন অনুভব করে সেজন্য কেউ তাকে বাধ্য করে নি এজন্যই নিজের সন্তান এভাবে অতিক্ষিপ্ত ভঙ্গিতে প্রেমে পড়ায় সে তাকে কোনোভাবেই অভিযুক্ত করতে পারে না। গিয়াস বেগের পরিবারের মেয়েরা মনে হয় তাঁর মত লোকদের সম্মোহিত করার ক্ষমতা রাখে, কিন্তু খুররমের মত তাকেও অবশ্যই অপেক্ষা করতে হবে…
১.০৬ নিহন্তার খড়গ
মালকিন, উঠুন।’ কেউ একজন যেন তাঁর কাঁধ ধরে প্রবল ভাবে ঝাঁকাতে থাকে এবং মেহেরুন্নিসার মনে হয় সে কি স্বপ্ন দেখছে, কিন্তু ঘুম ঘুম চোখ খুলে সে নাদিয়াকে তাঁর উপর ঝুঁকে থাকতে দেখে।
‘কি হয়েছে? কেন তুমি আমার ঘুম ভাঙালে?’ পরিচারিকাটা তাঁর শয্যার পাশে রাখা মার্বেলের তেপায়ার উপরে একটা জ্বলন্ত তেলের প্রদীপ রেখেছে এবং কক্ষের আওয়াজির ভিতর দিয়ে প্রবাহিত উষ্ণ বাতাসে এটা কম্পমান একটা কমলা রঙের আভার জন্ম দিয়েছে।
আপনার কাছে একটা চিঠি এসেছে। হেরেমের প্রবেশ দ্বারে যে বার্তাবাহক এটা পৌঁছে দিয়েছে সে বলেছে এটা যেন অবিলম্বে আপনাকে দেয়া হয়। মেহেরুন্নিসা খেয়াল করে পরিচারিকা কথাগুলো বলার সময় কৌতূহলের কারণে প্রায় থরথর করে কাঁপছে। সে বিছানায় উঠে বসে, তাঁর হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন সহসাই বেড়ে গিয়েছে এবং নাদিয়ার হাত থেকে তার জন্য ধরে রাখা সীলমোহর করা কাগজটা নেয়। রাতের অন্ধকারে যে সংবাদ আসে সেটা কেবল দুঃসংবাদই হতে পারে। সে যখন চিঠিটার ভাঁজ খুলছে তখন তাঁর আঙুল মৃদু কাঁপে এবং সে তার ভাইঝির ঝরঝরে হস্তাক্ষর দেখা মাত্র চিনতে পারে। চিঠিটা খুব ব্যস্ততার মাঝে লেখা হয়েছে। পুরো চিঠিটা বেমানান কালির দাগ আর বেশ কয়েকটা শব্দ কেটে দেয়া হয়েছে।
ফুপিজান, ভয়ঙ্কর কিছু একটা ঘটেছে। আমার আব্বাজান সামরিক প্রয়োজনে দিল্লি গিয়েছেন এবং আমার আর আমার দাদিজানের পক্ষে আর কারো মুখাপেক্ষী হওয়া সম্ভব নয়। আজ রাতের বেলা আমি যখন দূর্গে আমার পিতামহের আবাসস্থলে অবস্থান করছিলাম তখন প্রহরীরা আমার দাদাজানকে গ্রেফতার করতে এসেছিল। তারা দাবি করে গোয়ালিওরে নিজের কারাপ্রকোষ্ঠ থেকে সম্রাটকে হত্যা করার অভিপ্রায়ে যুবরাজ খসরু দ্বারা নিয়ন্ত্রিত একটা ষড়যন্ত্রে তাঁর ভূমিকা রয়েছে এবং রাজকীয় কোষাগার দখল করতে তাঁর সাহায্যের জন্য খসরু তাকে তাঁর উজির হিসাবে নিয়োগ করে তাকে পুরস্কৃত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তুমি ভালো করেই জানো আমার দাদাজান কেমন মানুষ–সবসময়েই ভীষণ শান্ত, ভীষণ সম্মানিত। তিনি আমাদের দুশ্চিন্তা করতে নিষেধ করে নিরবে তাঁদের সাথে গিয়েছেন কিন্তু আমি ঠিকই দেখেছি তিনি কতটা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন এবং সেইসাথে তিনি ভয়ও পেয়েছেন।
চিঠিতে আরও কিছু লেখা রয়েছে, কিন্তু মেহেরুন্নিসা ইতিমধ্যে যতটুকু পড়েছে সেটুকুই সে টায়টোয় কোনোমতে আত্মীভূত করে। তার আব্বাজান গিয়াস বেগ, যিনি প্রথমে আকবর আর পরবর্তীতে জাহাঙ্গীরের অধীনে দুই দশকের বেশি সময়কালব্যাপী এমন বিশ্বস্ততার সাথে দায়িত্ব পালন করে আসছেন, তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে সম্রাটকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করার কারণে… এটা একেবারেই অসম্ভব। তাঁর মুহূর্তের জন্য মনে হয় সে এখনও বোধহয় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন রয়েছে এবং পুরো ব্যাপারটাই একটা অদ্ভুত দুঃস্বপ্ন, কিন্তু মুশকিল হল আশেপাশেই কোথাও একটা মশা উচ্চ স্বরগ্রামে ক্লান্তিকরভাবে গুনগুন করছে আর নাদিয়া সবসময়ে যে সুগন্ধি ব্যবহার করে থাকে সেটার তীব্র কস্তুরি গন্ধ, সন্দেহাতীতভাবে বাস্তব।
‘এটা কি? আশা করি কোনো দুঃসংবাদ নেই? নাদিয়া জানতে চায়, তার চোখ উত্তেজনায় চক চক করছে।
‘আমাদের পারিবারিক একটা ব্যাপার। তুমি এখন যেতে পারো, কিন্তু প্রদীপটা রেখে যাও আমি যেন পড়ার জন্য আলো পেতে পারি।’
মেহেরুন্নিসা যখন নিশ্চিত হয় যে পরিচারিকা বাস্তবিকই চলে গিয়েছে সে তার মুখের উপর থেকে নিজের লম্বা কালো চুলের গোছা সরিয়ে নিয়ে পুনরায় আরজুমান্দের লেখা চিঠিটার দিকে তাকায়, ধীরে ধীরে চিঠিটার পুরো বিষয়বস্তু আত্মস্থ হতে আরম্ভ করতে তাঁর হাত পায়ের রক্ত নিস্তেজ হয়ে আসতে থাকে। তাঁর আব্বাজানের জীবন হুমকির মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে আর তাঁদের পুরো পরিবার ধ্বংস কিংবা আরো মারাত্মক পরিণতির মুখোমুখি এসে উপনীত হয়েছে। যুবরাজ খুররমের সাথে আরজুমান্দের বিয়ের ধারণাই এখন হাস্যকর হয়ে পড়েছে, এবং তাঁর নিজের আশা আকাঙ্খও… সে এক মুহূর্তের জন্য তখনও আন্দোলিত হতে থাকা জরির কারুকাজ করা পর্দার দিকে ভীত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারে না, প্রতি মুহূর্তে তার কেবলই মনে হতে থাকে যেকোনো মুহূর্তে পর্দার নাজুক কাপড় একপাশে সরিয়ে হেরেমের প্রহরী আর খোঁজার দল ঝড়ের বেগে ভেতরে প্রবেশ করবে তাকেও গ্রেফতার করতে।
তাকে এখন অবশ্যই মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে। আরজুমান্দের চিঠিখানা শক্ত করে ধরে সে পড়তে থাকে। আমার দাদাজানকে তাঁরা নিয়ে যাবার সময় সেখানে আগত প্রহরীদের একজন তাকে বলেছিল, আপনার ছোট ছেলে মীর খানকে দুই দিন পূর্বে একই অভিযোগে গোয়ালিওরে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং শৃঙ্খলাবদ্ধ অবস্থায় আগ্রায় নিয়ে আসা হয়েছে। দুশ্চিন্তায় আমার দাদাজান প্রায় অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। ফুপুজান দয়া করে আমাদের সাহায্য করেন। আমাদের কর্তব্য করণীয় সম্পর্কে সত্ত্বর আমাদের অবহিত করবেন। চিঠিটার শেষে দ্রুত টানে আরজুমান্দ লেখা।
মেহেরুন্নিসা শয্যা থেকে উঠে দাঁড়ায় এবং চিঠিটা যত্নের সাথে ভাঁজ করে তেপায়ার উপরে তেলের প্রদীপের পাশে রাখে। সে তারপরে মন্থর পায়ে হেঁটে বাতায়নের কাছে যায় এবং সূর্যের তাপে তখনও উত্তপ্ত হয়ে থাকা বেলেপাথরের সংকীর্ণ পার্শ্বদেশে হাত রাখে। সে নিচের দিকে তাকিয়ে দু’জন মহিলা প্রহরীকে হেরেমের আঙিনায় পরিক্রমণ করতে দেখে, তাদের আলকাতরায় চোবানো ছেঁড়া কাপড়ের মশালের আলোয় তাদের চারপাশে নৃত্যরত ছায়ারা ছড়িয়ে যায়। দরবারের সময়রক্ষক, ঘড়িয়ালীকে সে কাছাকাছি কোথাও থেকে ঘণ্টার সংকেত ধ্বনি করতে শুনে–একবার, দুইবার, তিনবার… সে আকাশের দিকে তাকালে সেখানে আকাশের মসিকৃষ্ণ গভীরতার একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে উজ্জ্বল তারকারাজির অসংখ্য নক্সা ছড়িয়ে থাকতে দেখে। পৃথিবীর সমস্যাবলী থেকে এত দূরবর্তী, তারকারাজির দূরাগত শীতল সৌন্দর্য কীভাবে যেন তাঁর মাঝে শক্তি জোগায়, তাকে শান্ত করে এবং আরো পরিষ্কারভাবে চিন্তা করতে তাকে সাহায্য করে।
তাঁর আব্বাজান গিয়াস বেগ, সম্মান আর অতিমাত্রায় অনুগত, নিরপরাধ, সে নিশ্চিত। তাঁর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ সেটা নিঃসন্দেহে ভুল বোঝাবুঝি কিংবা ঈর্ষাপ্রসূত। কিন্তু তাঁর ছোট ভাই মীর খানের অভিযোগের বিষয়টার ব্যাখ্যা কি হতে পারে? সে নিশ্চিতভাবে কিছুই বলতে পারে না। কাবুলে তাঁরা একসাথে বড় হয়েছে। সে সবসময়েই জানে যে তার এই ছোটভাইটা তার কিংবা আসফ খানের মত বুদ্ধিমান–কিংবা তাদের মত মানসিক শক্তির অধিকারী হয়নি। মীর খান আত্মাভিমানী এবং নিজের এই সীমাবদ্ধতা সে কখনও স্বীকার করে না। সে খুব ভালো করেই জানে তাকে কত সহজে ভুল পথে পরিচালিত করা সম্ভব। তারা যখন ছোট ছিল তখন কতবার যে সে তাকে তার নিজের নয় বরং তার স্বার্থে তাকে হঠকারী কাজে প্রলুব্ধ করেছে। তার জন্য ফল সংগ্রহ করতে ভাইকে সে একবার খুবানির গাছের পচা ডাল বেয়ে উঠতে প্ররোচিত করেছিল মনে পড়তে সে আপন মনে হেসে উঠে। সেই ডাল তার ভাইকে নিয়ে নিচে ভেঙে পড়েছিল।
অনেকদিন আগের সেসব কথা। মীর খানের এতদিনে বিচক্ষণ আর বিবেচক হবার কথা, কিন্তু আসাফ খান যেমন অল্প বয়সেই উন্নতি করেছিলেন তেমন সাফল্য সে লাভ করে নি। হতাশা, বড় ভাইয়ের সাফল্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে আর হতাশার কারণেই কি বিশাল পুরষ্কারের মিষ্টি প্রলোভনে ভুলে সে অবাস্তব কোনো ষড়যন্ত্রে সামিল হয়েছিল? তাঁর জানার কোনো উপায় নেই। তাঁর ছোট ভাই তাঁদের আব্বাজান গিয়াস বেগের মতই নিরপরাধও হতে পারে। তাকে বিচার করতে গিয়ে সে কোনো ধরনের তাড়াহুড়ো করতে চায় না। এখন কি করণীয় সেটাই বরং ঠাণ্ডা মাথায় আর যুক্তি সহকারে ঠিক করা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর নিজের এবং তার পরিবারের ভাগ্য–এমনকি হয়তো তাঁদের জীবন–এখন একটা সরু সুতার মাথায় ঝুলছে। তার এখন কোনোভাবেই হঠকারীতা প্রদর্শন করা চলবে না, কিন্তু হাত পা গুটিয়ে বসে থাকাটা হয়তো প্রাণঘাতি প্রতিপন্ন। হতে পারে…
সে দিল্লিতে আসাফ খানকে সবকিছু জানিয়ে চিঠি লিখতে পারে। তিনি হয়তো ইতিমধ্যেই এখানকার পরিস্থিতি সম্বন্ধে অবহিত হয়েছেন এবং এই মুহূর্তে আগ্রার পথে ঘোড়া নিয়ে ধুলোর ঝড় তুলে ছুটে আসছেন। তাঁরা একসাথে বসে সিদ্ধান্ত নিবে তাঁদের পরিবারকে এই বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচাতে তাঁদের কি করা উচিত। তাছাড়া এই ষড়যন্ত্রে তিনিও হয়তো জড়িয়ে পড়েছেন এবং এখন হয়তো বন্দি রয়েছেন। নাহ্, আসাফ খানের ভাগ্যে কি ঘটেছে সেটা জানার জন্য সে অপেক্ষা করবে না। তাকে এবং তাকে একলাই যা করার করতে হবে।
নিজের ছোট কক্ষে প্রায় ঘন্টাখানেক অস্থিরভাবে পায়চারি করার পরে, দিগন্তের কোণে ভোরের ধুসর আলোর রেখা উঁকি দিতে মেহেরুন্নিসা পা আড়াআড়িভাবে রেখে তার লেখার টেবিলের সামনে এসে বসে। সে সবুজ অনিক্স পাথরের দোয়াতদানিতে–তাঁর আব্বাজান দোয়াতদানিটা তাকে উপহার দিয়েছিল–নিজের কলমটা ডুবিয়ে নিয়ে আরজুমান্দের উদ্দেশ্যে দ্রুত কয়েকটা কথা সাজিয়ে লিখে। তোমার আব্বাজান ফিরে আসা পর্যন্ত আমার দাদিজানের কাছে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করো এবং আমার কাছ থেকে পুনরায় কোনো সংবাদ না পাওয়া পর্যন্ত কিছু করবে না। আমার উপরে আস্থা রাখো। সে লেখাটা শেষ করেই ভিজা কালি শুষে নেয়ার জন্য বালির মিহিগুড়ো সেটার উপরে ছিটিয়ে দিয়ে, কাগজটা ভাজ করে এবং গালার লম্বা একটা টুকরো উত্তপ্ত করে সেটা ফোঁটায় ফোঁটায় ভজের উপরে ফেলে এবং নিজের মোহর দিয়ে সেটার উপরে ছাপ দেয়, পারস্যে বহু শতাব্দি যাবত তাঁদের পরিবারে ব্যবহৃত ঈগলের প্রতীক মোহরটায় খোদাই করা রয়েছে। সে মোহরটা কদাচিত ব্যবহার করে কিন্তু এখন ব্যবহার করলে কারণ তাঁদের পরিবারের গৌরবোজ্জল দীর্ঘ অতীতের কথা অহঙ্কারী ঈগলটা, সে যা করবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে কিন্তু আরজুমান্দের কাছে প্রকাশ করে নি সেটা করার জন্য পদক্ষেপ নিতে তাকে সাহস জোগায়।
সে পুনরায় দোয়াতদানি থেকে লেখনীটা তুলে নিয়ে জাহাঙ্গীরের উদ্দেশ্যে আরেকটা চিঠির মুসাবিদা শুরু করে। মহামান্য সম্রাট, আপনাকে এই চিঠি লেখার সাহস আমার কখনও হতো না যদি না আমার পরিবারের প্রতি আমার ভালোবাসা এবং তাঁদের সম্মান রক্ষার জন্য তাঁদের প্রতি আমার ভিতরে একটা কর্তব্যবোধ কাজ করতো। মহামান্য সম্রাট, অনুগ্রহ করে আমাকে একবার দেখা করার অনুমতি দেন। গিয়াস বেগের কন্যা, মেহেরুন্নিসা। সে চিঠিটার আবার ভাঁজ করে এবং গালা গরম করে আর কিছুক্ষণ পরে রক্ত-লাল গালার নরম ফোঁটায় গলে পরতে শুরু করে।
*
যন্ত্রণাদায়ক মন্থরতায় দিনটা অতিবাহিত হতে থাকে। চারপাশ অন্ধকার করে শীঘ্রই সন্ধ্যা নামবে। মেহেরুন্নিসা ভাবে, সবাই নিশ্চয়ই জানে কি হয়েছে। ফাতিমা বেগম আজ তাকে ডেকে পাঠান নি। বাস্তবিকপক্ষে কেউই তাঁর কাছেই আসে নি, এমনকি সদা-উৎসুক নাদিয়ারও আজ কোনো পাত্তা নেই। তাদের ভিতরে নিশ্চয়ই গিয়াস বেগের পরিবারের সাথে বেশি খাতিরের ব্যাপারে একটা ভয়ের সংক্রমণ ঘটেছে, তার মানে এই না যে সেও বিষয়টা পাত্তা দেয়। একজন পরিচারিকাকে চিঠির সাথে একটা স্বর্ণমুদ্রা ঘুষ দিয়ে এবং জাহাঙ্গীরের উজির মাজিদ খানের কোনো পরিচারিকার হাতে চিঠিটা পৌঁছে দিতে বলে সাথে এটাও বলবে যে গিয়াস বেগের মেয়ের কাছ থেকে চিঠিটা এসেছে, কিন্তু তারপরেও জাহাঙ্গীরের কাছে চিঠি লেখার পরে প্রায় বারোঘন্টা অতিবাহিত হতে চলেছে। মাজিদ খানের বিষয়ে সে যা কিছু শুনেছে তার মনে হয়েছে যে মাজিদ খান একটা বিবেকসম্পন্ন মানুষ, যিনি গত কয়েকমাস যাবত তাঁর আব্বাজানের বাসার একজন নিয়মিত অতিথি ছিলেন, কিন্তু তিনিও এখন হয়তো গিয়াস বেগের সাথে একটা দূরত্ব বজায় রাখবেন। উজির মহাশয় একটা জ্বলন্ত মোমবাতির শিখায় চিঠিটা ধরে রেখে, তাঁর শেষ আশাটাও ভষ্ম করে দিচ্ছে সে কল্পনা করে।
‘এই মুহূর্তে আমার সাথে চলেন। মেহেরুন্নিসা চমকে ঘুরে তাকায়। খাজাসারাকে প্রবেশ করতে সে শুনেনি এবং মালাকে তাঁর কাছ থেকে মাত্র চার ফুট দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে কেঁপে উঠে। সে তার হাতের কর্তৃত্বের নিদর্শনসূচক দণ্ড দিয়ে দরজার দিকে ইঙ্গিত করার সময় তাঁর চোখে মুখে একটা আবেগহীন অভিব্যক্তি ফুটে থাকে। মেহেরুন্নিসার পরনে নীল রেশমের তৈরি তাঁর সবচেয়ে সুন্দর আলখাল্লা রূপার জরি দিয়ে যার উপরে সোলোমী ফুলের নক্সা করা ভাগ্যক্রমে যদি সম্রাট দেখা করার জন্য তাকে ডেকে পাঠান সেই কথা ভেবে, কিন্তু মালার কঠোর মুখমণ্ডলের দিকে তাকিয়ে তাঁর সন্দেহ হয় যে মালা আদতেই তাকে সেজন্যই ডাকতে এসেছে। রাজকীয় হেরেম থেকে সে সম্ভবত বহিস্কৃত হতে চলেছে, সেক্ষেত্রে সে কোনোভাবেই নিজের প্রিয় জিনিষগুলো যেমন অনিক্সের সবুজ দোয়াতদানি আর বিশেষ করে তাঁর অলঙ্কারগুলো ফেলে যাবে না। সে দামী একটা কাশ্মিরী শাল, আসাফ খান তাকে দিয়েছিলেন, তুলে নিয়ে নিজের অলঙ্কারের বাক্সের দিকে হাত বাড়ালে খাজাসারা তখন অসহিষ্ণু ভঙ্গিতে বলে, কিছু নিতে হবে না। তুমি যেভাবে রয়েছে ঠিক সেভাবেই আমার সাথে এসো। নিজেকে কেবল অবগুণ্ঠিত করে নাও।
মেহেরুন্নিসা শালটা নামিয়ে রাখে এবং নেকাব বেঁধে নিয়ে নিজের চোখ আজ্ঞানুবর্তীভাবে নত করে রাখে। মালার সবুজ আলখাল্লায় আবৃত লম্বা অবয়বকে অনুসরণ করে নিজের আবাসন কক্ষ থেকে বের হয়ে এসে, দরদালান দিয়ে এগিয়ে গিয়ে হেরেমের আঙিনা অতিক্রম করার সময়, যেখানে ইতিমধ্যেই সাঁঝের ঝাড়বাতি জ্বালান হয়েছে, সে ভাবে আমার জীবনের তাহলে এভাবেই সমাপ্তি ঘটবে। তীর্যক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে, কটু মন্তব্য শুনে, কান্নায় তাঁর চোখের পাতা ভারি হয়ে আসে কিন্তু সে সবকিছু ঝেড়ে ফেলে ধীরে সুস্থে গর্বিত ভঙ্গিতে মাথা তুলে দাঁড়ায়। খাজাসারা যদিও দ্রুত হেঁটে যাচ্ছে কিন্তু বেত্রাহত কুকুরের মত তাড়াহুড়ো করে সে হেরেম থেকে বের হয়ে যাবে না।
কিন্তু তখনই সে খেয়াল করে যে তাঁদের ঠিক উল্টো দিকে অবস্থিত হেরেমের দরজার দিকে মালা তাকে নিয়ে যাচ্ছে না। সে বরং দ্রুত বামদিক দিকে বাঁক নেয় এবং নিচু ধাপ বিশিষ্ট একপ্রস্থ সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যায় যা দূর্গের এমন একটা অংশের দিকে উঠে গিয়েছে মেহেরুন্নিসা আগে কখনও দেখেনি। তার বক্ষপিঞ্জরের সাথে তার হৃৎপিণ্ড ধাক্কা খায়। মালা তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? খাজাসারা সিঁড়ির একেবারে উপরের ধাপে পৌঁছে থামে এবং কাঁধের উপর দিয়ে পিছনের দিকে ঘুরে তাকায়। ‘পা চালিয়ে এসো। মেহেরুন্নিসা তাঁর নীল আলখাল্লার ঝুল সামলে নিয়ে উপরের দিকে উঠতে শুরু করে। সে উপরে উঠে এসে একটা প্রশস্ত চতুরে নিজেকে আবিষ্কার করে। ঠিক উল্টো দিকে দুই পাল্লা বিশিষ্ট উঁচু একটা দরজা যার গায়ে কমদামি পাথর বসান রূপার পাতা ঝলমল করছে। মালা দরজার বাইরে প্রহরারত চারজন রাজপুত প্রহরীকে দ্রুত কিছু একটা বলার সময় মেহেরুন্নিসার দিকে ইঙ্গিত করে।
প্রহরীরা দরজার পাল্লা খুলে দেয়। মালা দরজার নিচে দাঁড়িয়ে মেহেরুন্নিসার এগিয়ে আসবার জন্য অপেক্ষা করে, তারপরে তাঁর কব্জি আঁকড়ে ধরে তাকে নিয়ে দু’পাশে বুটিদার রেশমের পর্দা দেয়া একটা প্রশস্ত অলিন্দ দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। পুরুষ ময়ুরের মত দেখতে, যার ছড়ান পেখমে পান্না আর নীলা বসান, সোনার দাহকে ধিকিধিকি জ্বলতে থাকা ধূপ আর মশলার সুগন্ধে অলিন্দের বাতাস ভারি হয়ে আছে। তাদের সামনে আরো একজোড়া দরজা পেছনের দরজার চেয়ে আরও উঁচু আর চওড়া আর পাল্লার উপরে সোনার পাতের উপরে কচ্ছপের খোলা আর হাতির দাঁতের কারুকাজ করা। দরজার সামনে ইস্পাতের ফলাযুক্ত বর্শা হাতে দশজন রাজপুত প্রহরী ঋজু আর স্থির ভঙ্গিতে সামরিক কায়দায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। ‘আমরা কোথায় এসেছি?’ সে মালার কাছে ফিসফিস করে জানতে চায়।
রাজকীয় হেরেমে মহামান্য সম্রাটের এটা ব্যক্তিগত প্রবেশ পথ। এই দরজা দিয়ে তার একান্ত ব্যক্তিগত কক্ষে যাওয়া যায়।
‘তুমি আমাকে সম্রাটের কাছে নিয়ে চলেছো?
‘হ্যাঁ। তোমার সাথে কি করা হবে সন্দেহ নেই তিনি সিদ্ধান্ত নেবেন।
মেহেরুন্নিসা কিছুই শুনতে পায় না। সে সম্রাটের সামনে উপস্থিত হবার পূর্বে মূল্যবান সময়ের যতটুকু অবশিষ্ট রয়েছে সেই অবসরে জাহাঙ্গীরের কাছে চিঠিটা লেখার পর থেকেই তাকে বলার জন্য সে নিজের মনে যে কথাগুলো আউড়ে এসেছে সেগুলোই আরেকবার স্মরণ করে নেয়। বিশাল দরজাটার সোনালী পাল্লা দুটো এখন ধীরে ধীরে খুলে যাচ্ছে। মালা একপাশে সরে দাঁড়ায় এবং তাকে একলাই সামনে এগিয়ে যেতে হবে। সে মাথা উঁচু করে দরজার নিচে দিয়ে এগিয়ে যায়।
বিশাল কক্ষের দূরবর্তী প্রান্তে সম্রাট একটা নিচু মঞ্চে উপবিষ্ট। মেহেরুন্নিসা আশা করেছিল কর্চি, পরিচারকদের, এমনকি প্রহরীও হয়তো দেখতে পাবে সম্ভাব্য বিশ্বাসঘাতকের মেয়ে আর বোনের হাত থেকে সম্রাটকে সুরক্ষিত রাখতে, কিন্তু কক্ষে তারা দু’জন ছাড়া আর কেউ নেই। বাতায়ন দিয়ে আগত আলোয় দীর্ঘায়িত হতে থাকা ছায়া আর মোমবাতির কাঁপতে থাকা আলোর কারসাজিতে তাঁর পক্ষে জাহাঙ্গীরের অভিব্যক্তি বোঝাটা কঠিন করে তুলে। সে তাঁর কাছ থেকে তখনও পনের ফিট দূরে থাকার সময়ে, মেহেরুন্নিসা যেমন ঠিক করে রেখেছিল সেভাবেই মুখ নিচের দিকে রেখে তাঁর সামনে ছুঁড়ে দেয়, তাঁর খোলা চুল তার চারপাশে উড়ছে। সেইসাথে সে তার পরিকল্পনা অনুসারে জাহাঙ্গীর কথা বলা পর্যন্ত অপেক্ষা করে না।
‘সম্রাট আমার সাথে দেখা করার মহানুভবতা প্রদর্শনের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আমি এখানে এসেছি আপনার সামনে আমার আব্বাজান গিয়াস বেগের পক্ষে সাফাই দিতে। আমি আমার জীবনের দিব্যি দিয়ে বলতে পারি যে আপনার, তাঁর শুভাকাঙ্খি, যিনি তাকে সবকিছু দিয়েছেন, ক্ষতি হয় এমন কোনো কিছু তিনি কখনও করবেন না। আমার আব্বাজান কখনও নিজের পক্ষে সাফাই দিবেন না তাই আমাকেই সেটা করতে হলো। আমি কেবল ন্যায়বিচার কামনা করছি।’ মেহেরুন্নিসা স্থির হয়ে পুরু গালিচায় মুখটা আরো গুঁজে দিয়ে, দুই হাত দু’পাশে ছড়িয়ে, যেভাবে ছিল সেভাবেই থাকে।
তাঁর সামনের ছায়াচ্ছন্ন বেদীতে উপবিষ্ট লোকটার কাছ থেকে কোনো শব্দ ভেসে আসে না। সে মাথা তুলে তাকাবার ইচ্ছাকে জোর করে দমন করে কিন্তু সে যখন কেবল ভাবতে শুরু করেছে যে তার দিকে না তাকিয়ে তার পক্ষে আর থাকা সম্ভব না ঠিক তখনই তার শক্তিশালী হাত নিজের বাহু নিচে সে অনুভব করে, তাকে পায়ের উপরে দাঁড় করাবার জন্য তুলছে। সে চোখ বন্ধ করে থাকে। তিনি যখন তাঁর এত কাছে অবস্থান করছেন তখন সে তার মুখে করুণার পরিবর্তে দোষারোপের অভিব্যক্তি দেখবে সেই ভয়ে চোখ খুলে তার মুখের দিকে তাকাতে পারে না। তাঁর কাঁধ থেকে হাত সরে যায় কিন্তু তারপরেই সে টের পায় তিনি তাঁর নেকাবের একটা পাশ সরিয়ে দিচ্ছেন। সে চোখ খুলে তাকায় এবং জীবনে দ্বিতীয়বারের মত তার চোখে চোখ রাখে। কাবুলে বহু বছর আগে দেখার পর থেকে তার মনে গেঁথে থাকা সেই মুখ সে সামনে দেখতে পায়। মুখাবয়বে বয়সের ছাপ পড়ায় আরও বেশি সুদর্শন দেখায় কিন্তু এই মুহূর্তে সেখানে কঠোর আর শীতল একটা অভিব্যক্তি ফুটে রয়েছে যার দিকে তাকিয়ে সে সহসাই অসুস্থবোধ করে এবং নিস্তেজ হয়ে যায়। জাহাঙ্গীর তার দিকে আগ্রহের সাথে তাকিয়ে কিন্তু তাঁর ভাবনার বিন্দুমাত্র চিহ্ন মুখে ফুটে উঠে না। সে কয়েক মুহূর্ত পরে ঘুরে দাঁড়ায় এবং নিজের বেদীতে উঠে সেখানে পুনরায় আসন গ্রহণ করে। আপনার আব্বাজান আর ভাইজান দু’জনকেই জেরা করা হয়েছে।’
‘আমার আব্বাজান কোনো অপরাধ করতে পারেন না, মেহেরুন্নিসা নিজের কণ্ঠস্বর শান্ত আর সংযত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করতে করতে কোনোমতে বলে। কে তাকে অভিযুক্ত করেছে?
‘গোয়ালিওর দূর্গের প্রধান আধিকারিক। তাঁর গুপ্তচরেরা আড়িপেতে আমার ছেলেকে আপনার ভাই মীর খানের সাথে আলোচনা করতে শুনেছে যে পারস্যের শাহের কাছে যদি কান্দাহার সমর্পণের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয় তাহলে কি সৈন্যবাহিনী পাঠিয়ে আমাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে সাহায্য করতে তিনি রাজি হবেন। আপনার ভাই উত্তর দেয় যে পারস্যের রাজদরবারে গিয়াস বেগের এখন প্রভাব রয়েছে… সে ইঙ্গিত দেয় সে তাকে ষড়যন্ত্রে অংশ নিতে হয়তো রাজি করাতে পারবে।’
মেহেরুন্নিসার মুখ ক্রোধে রক্তিম হয়ে উঠে। সে চোখের সামনে পুরো পরিস্থিতিটা স্পষ্ট দেখতে পায় একজন যুবরাজের বিশ্বাসভাজন হতে পারার গর্বে মীর খান এতটাই উদ্বেলিত হয়ে উঠেছে যে সে যেকোনো কিছু করবে বা বলবে…মেহেরুন্নিসা থুতনি উঁচু করে। এমন একটা ধারণা ঘৃণার অযোগ্য। মীর খান কেবল নিজেকে একজন কেউকেটা হিসাবে জাহির করতে চেয়েছে। আমি ভূমিষ্ঠ হবার আগেই আমার আব্বাজান পারস্য ত্যাগ করেছেন। তিনি পারস্যের সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন মোগল সাম্রাজ্যের একজন আধিকারিক নিযুক্ত হবার পরে আর যোগ্যতার সাথেই তিনি নিজের দায়িত্ব পালন করেছেন। তাকে যদি ষড়যন্ত্রের সাথে যুক্ত করা সম্ভবও হয়–যা তিনি কোনোভাবেই হবেন না–আর পুরো বাপারটা কোনো অর্থ বহন করে না যেখানে তার নাতনির সাথে যুবরাজ খুররমের বিয়ের হতে চলেছে সেখানে আপনার বিরুদ্ধে আপনার অন্য সন্তানকে সমর্থন করে তাঁর কি লাভ?
জাহাঙ্গীর তার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। মেহেরুন্নিসা ভাবে তার জন্য যদি এখনও কোনো অনুভূতি তার ভিতরে অবশিষ্ট থাকেও সেটা তিনি ভালোভাবেই গোপন রেখেছেন।
‘আপনার কথায় যুক্তি রয়েছে কিন্তু আপনি এতটা উত্তেজিত হয়ে তর্ক করার আগেই আমি ইতিমধ্যেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে ষড়যন্ত্রের বিষয়ে গিয়াস বেগ কিছুই জানেন না, জাহাঙ্গীর অবশেষে কথা বলে। আমি তাকে বহুদিন ধরেই চিনি এবং বিশ্বাস করি তিনি একজন সৎ লোক।
মেহেরুন্নিসা ভাবে, আমার আব্বাজান নিরাপদ। তার চারপাশের সবকিছু এক নিমেষের জন্য মনে হয় যেন অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে উঠে এবং সে নিজের চোখের উপর হাত রাখে, নিজেকে শক্ত করতে আপ্রাণ চেষ্টা করে।
কিন্তু আপনার ভাইয়ের ব্যাপারে এটা প্রযোজ্য নয়…’
‘আমার ভাইজান…’।
‘মীর খানের বিরুদ্ধে অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। সে প্রথমে যদিও সবকিছু অস্বীকার করেছিল, একটা সময় পরে… জেরার একটা পর্যায়ে… সে স্বীকার করে যে আমার বিশ্বাসঘাতক সন্তান যুবরাজ খসরু তাকে বিপুলভাবে পুরস্কৃত করার লোভ দেখিয়ে আমার বিরুদ্ধে একটা ষড়যন্ত্রে তাকে অংশ গ্রহণ করতে বলে এবং সে রাজি হয়।
মেহেরুন্নিসা কথা বলে না।
‘আপনি এখানে ন্যায়বিচার চাইতে এসেছেন। এইমাত্র আপনি প্রমাণ করেছেন যে আপনি কতটা বিবেচনাবোধের অধিকারী। আমার স্থানে আপনি থাকলে কি করতেন?
সে কোনো কথা না বলে গাঢ় নীলের জমিনে ঘন লাল ফুলের নক্সা করা পুরু গালিচার দিকে তাকিয়ে থাকে যখন হাসতে হাসতে খুবানি গাছের পচা ডাল বেয়ে এগিয়ে গিয়ে তার জন্য কয়েকটা ফল পারতে এগিয়ে যাওয়া উৎফুল্ল, ভাবনাহীন মীর খানের বালক বয়সের স্মৃতি, তাকে প্রায় দৈহিক যন্ত্রণায় বিদ্ধ করে। সম্রাট। তার কণ্ঠস্বর শান্ত, সংযত, আতঙ্কের লেশমাত্র নেই সেখানে। আপনার সামনে পছন্দের কোনো সুযোগ নেই। মীর খান একজন বিশ্বাসঘাতক। তাকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করুন। আপনার স্থানে আমি থাকলে তাই করতাম।
‘আপনি চিঠিটে আপনার পরিবারের প্রতি আপনার ভালোবাসার কথা উল্লেখ করেছেন। ভাইয়ের মৃত্যুর জন্য পরামর্শ দেয়াটা কি একজন স্নেহময়ী বোনের উপযুক্ত কাজ?
‘পারস্যে একটা প্রবাদ প্রচলিত রয়েছে: “একটা গাছে যদি বাছে ফল ফলে তাহলে বাগান বাঁচাতে হলে গাছটা কেটে ফেল।” মীর খান তাঁর সম্রাট হিসাবে আপনার প্রতি নিজের কর্তব্য পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং সেই সাথে নিজের পরিবারের প্রতিও সে তার দায়িত্ব পালন করে নি। সে একটা কীট আক্রান্ত বৃক্ষ। তাঁর বাকি পরিবার হল প্রবাদে উল্লেখ করা উদ্যান।
‘বেশ কথা। আপনার পরামর্শ অনুযায়ী কাজ হবে। জাহাঙ্গীর ঝুঁকে পড়ে তার পেছনে রাখা পিতলের একটা ঘন্টা তুলে নিয়ে সেটা বেশ জোরে বাজায়। ঘন্টার ধাতব শব্দ দুই কি তিনবার বোধহয় ধ্বনিত হয়েছে বেদীর ডানদিকে অবস্থিত একটা দরজা দিয়ে একজন কর্চি কক্ষের ভেতরে প্রবেশ করে।
‘আদেশ করুন, সম্রাট?
‘বিশ্বাসঘাতক মীর খানকে আমার সামনে হাজির করা হোক।’
মেহেরুন্নিসা কিংবা বেদীর উপরে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকা জাহাঙ্গীর কেউ কোনো কথা বলে না অপেক্ষার সময়গুলো যখন অতিবাহিত হয়। নিজের জীবনের সবচেয়ে দীর্ঘতম বিপর্যয়ের পরবর্তী অধ্যায়ের জন্য সে নিজেকে প্রস্তুত করে। এখন বোধহয় সন্ধ্যা সাতটা বাজে–আরজুমান্দ বানুর আতঙ্কিত চিঠি নাদিয়া তাকে পৌঁছে দেয়ার পরে পনের ঘন্টা অতিবাহিত হয়েছে। সে মানসিকভাবে যদিও পরিশ্রান্ত কিন্তু তার এখন কোনোভাবেই নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করা চলবে না। সে এই পরিস্থিতির ভিতর দিয়ে কেবল শক্ত থেকেই বের হয়ে আসতে পারবে এবং নিজেকে আর নিজের পরিবারকে রক্ষা করতে পারবে।
পুরুষ কণ্ঠস্বর আর আগুয়ান পায়ের শব্দ এক ঝটকায় তাকে তার ভাবনা থেকে বের করে আনে। কর্চি সেই একটা দরজা দিয়ে কক্ষের ভিতরে প্রবেশ করেছে এবং তারপরে দরজার একপাশে দাঁড়িয়ে সে চিৎকার করে বলে, “মীর খানকে ভিতরে নিয়ে এসো।
দু’জন প্রহরী নিজেদের মাঝে তৃতীয় আরেকজনকে টেনে ভিতরে নিয়ে আসে। মোমবাতির দপদপ করতে থাকা আলোয় তারা যখন বেদীর দিকে এগিয়ে যায় মেহেরুন্নিসা তখন নিজের উপর রীতিমত বলপ্রয়োগ করে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়া থেকে বিরত থাকতে। সে যেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রহরীরা তার পাশে এসে দাঁড়ায় এবং তাদের মাঝের লোকটা ঠেলে সামনের দিকে মাটিতে ফেলে দেয়। মীর খান কোনো বাধা না দিয়ে মাটিতে আছড়ে পড়ে। বস্তুতপক্ষে, তাকে দেখে মনে হয় না যে তার জ্ঞান আছে। সে যখন সামনের দিকে টলমল করে আছড়ে পড়ে সেই অবসরে মেহেরুন্নিসা তাঁর কালচে, রক্তাক্ত মুখ দেখতে পায়। তার পরনের কাপড় ছেঁড়া, তাঁর পিঠে আগুনের ছ্যাকার লাল ক্ষত, সম্ভবত তপ্ত লোহার সাহায্যে সৃষ্ট। সে নিজেকে প্রবোধ দেয় মীর খানকে নিজের ভুলের মাশুল অবশ্যই দিতে হবে–যে তাকে অবশ্যই উৎসর্গ করতে হবে যাতে বাকি সবাই তারা রক্ষা পায়–কিন্তু তার পাশে মেঝেতে নিজের অত্যাচারিত ছোট ভাইকে পড়ে থাকতে দেখাটা সহ্য করাও তাঁর জন্য কষ্টকর হয়ে উঠে। জাহাঙ্গীর মীর খান নয় বরং তার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে বুঝতে পেরে, সে প্রাণপণে আত্মসংবরণের চেষ্টা করে। সম্রাট কিছুক্ষণ পরে বন্দির দিকে তাকায়।
‘মীর খান, নিজের সাফাই দিতে তোমার কি বলার আছে?
মীর খানের পুরো দেহ থরথর করে কাঁপছে। প্রহরীদের একজন তাঁর মাথার লম্বা কালো চুলের ঝুটি ধরে এবং তার মাথাটা তুলে ধরে। মহামান্য সম্রাটের প্রশ্নের জবাব দাও।’
মীর খান বিড়বিড় করে দুর্বোধ্য কিছু একটা বলে এবং প্রহরী নিজের জুতো পরা পা তুলে এবার তার পেটে সজোরে একটা লাথি বসিয়ে দেয়। সে এইবার কয়েকটা শব্দ স্পষ্ট করে উচ্চারণ করতে সক্ষম হয়। সম্রাট, আমাকে ক্ষমা করুন।
‘বিশ্বাসঘাতকতার জন্য ক্ষমা করার প্রশ্নই উঠে না। একজন বিশ্বাসঘাতকের মৃত্যুই তোমার প্রাপ্য। তোমায় প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করার পরামর্শ এমনকি তোমার নিজের বোনও দিয়েছে।’ মীর খান হতাশ চোখে তার দিকে তাকালে মেহেরুন্নিসা কুঁকড়ে যায়। আমার উচিত ছিল তোমাকে হাতির পায়ের নিচে পিষে ফেলা কিংবা শূলে দেয়া যেমনটা আমি আমার সন্তানের পূর্ববর্তী বিদ্রোহের সমর্থকদের করেছিলাম যাঁদের পরিণতি থেকে শিক্ষা নেয়ার মত বুদ্ধিও তোমার নেই।’ জাহাঙ্গীরের কণ্ঠস্বর হিম শীতল শোনায়। মীর খানের পাশে বসে তাকে আগলে ধরে একটু আগে যা বলেছিল সেসব ভুলে গিয়ে ভাইয়ের জীবনের জন্য করুণা ভিক্ষা করা থেকে মেহেরুন্নিসা অনেক কষ্টে নিজেকে বিরত রাখে। জাহাঙ্গীর অবশ্য এসবে ভ্রূক্ষেপ না করে বলতে থাকে, কেবল তোমার বোনের খাতিরে যার মত সাহসী তুমি কখনও হতে পারবে না আমি তোমাকে এই জীবন থেকে তোমার প্রাপ্য ধীর আর যন্ত্রণাদায়ক নিস্কৃতির হাত থেকে রেহাই দিলাম। মৃত্যুর পূর্বে তোমার কি কিছু বলবার আছে?
মীর খান অনেক কষ্ট করে হাঁটুর উপর ভর দিয়ে বসে কিন্তু সে যখন কথা বলে সেগুলো না তার বোন না সম্রাটকে উদ্দেশ্য করে বলা। কথাগুলোর মাঝে কোনো প্রকার ক্ষোভ কিংবা ক্রোধ না থাকায় সে হাফ ছেড়ে বাঁচে। ‘মেহেরুন্নিসা… আমাকে ক্ষমা করে দিও…’
‘ভাইজান, আমি আপনাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। তার মুখ শুকিয়ে কাঠ হয়ে থাকায় কথাগুলো ধীরে নিঃসৃত হয়।
‘আর আমাদের আব্বাজান আর আসাফ খানকেও বলে দিও আমায় যেন মার্জনা করে। ষড়যন্ত্রের বিন্দুবিসর্গ সম্বন্ধে তারা জানতো না… এবং আমাদের আম্মাজানকে জানিয়ে তাকে আমি ভালোবাসি আর আমার জন্য যেন কষ্ট না পায়। মীর খান এখন ফুঁপিয়ে কাঁদছে, অশ্রুধারায় তার মুখের শুকনো রক্ত গলতে শুরু করে।
‘জল্লাদকে ডেকে পাঠাও, জাহাঙ্গীর আদেশ দেয়। লোকটা নিশ্চয়ই এতক্ষণ বাইরে অপেক্ষা করেছিল কারণ সাথে সাথে কালো পাগড়ি ধাতব-বোম শোভিত আটসাট জামা পরিহিত দীর্ঘদেহী একটা লোক দুই মাথাযুক্ত একটা কুঠার হাতে ভেতরে প্রবেশ করে এবং তার অন্য পেষল হাতে মনে হয় একটা পশুর চামড়া মুড়িয়ে ধরা রয়েছে।
‘সম্রাট?
‘এই লোকটার শিরোচ্ছেদ কর।
জাহাঙ্গীরের আদেশ শুনে মীর খান পুনরায় মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে। জল্লাদ লোকটা এবার চামড়াটার ভাঁজ খুলে, তারপরে বেদীর সামনে থেকে গালিচাটা সরিয়ে দিয়ে সেখানে পাথরের মেঝের উপরে যত্ন নিয়ে চামড়াটা বিছিয়ে দেয়। সে প্রস্তুত হতে প্রহরীদের উদ্দেশ্যে মাথা নাড়ে। মীর খান তখনও ফুঁপিয়ে কাঁদছিলো যখন প্রহরীরা তাকে পুনরায় ধরে এবং টেনে সামনের দিকে চামড়ার উপরে নিয়ে আসে। তোমার গর্দান বাড়িয়ে দাও, জল্লাদ আদেশের সুরে বলে। একজন প্রহরী তার ডান হাতটা দেহের কাছ থেকে টেনে ধরলে যা এখন ভীষণভাবে কাঁপছে অন্য প্রহরীও তাঁর বাম হাতটা একইভাবে টেনে ধরতে, মেহেরুন্নিসা লক্ষ্য করে তার ভাই দারুণ সাহসের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে ধীরে নিজের গলা বাড়িয়ে দেয়। জল্লাদ তাঁর ঘাড়ের উপর থেকে কালো চুলের গোছা সরিয়ে দেয় তারপরে, সন্তুষ্টচিত্তে পিছিয়ে এসে কুঠারটা হাতে তুলে নেয়। সে তারপরে যত্নের সাথে কুঠারটার ওজন নিজের হাতে ভারসাম্য অবস্থায় রেখে কাঁধের উপর দিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে জাহাঙ্গীরের দিকে তাকাতে সে বোঝা যায় কি যায় না এমনভাবে মাথা নাড়ে।
মেহেরুন্নিসা মোমের আলোয় বাঁকা ফলাটা ঝলসাতে দেখে যখন জল্লাদ কুঠারটা এক মোচড়ে নিজের মাথার উপর তুলে ধরে। হন্তারক ফলাটা নামিয়ে আনতে সে টের পায় তার গালের পাশ দিয়ে বাতাসের একটা ঝাপটা বয়ে যায়, তারপরে ফলাটা তার ভাইয়ের গলা নিখুঁতভাবে দ্বিখণ্ডিত করতে হাম আর মাংসের সাথে ইস্পাতের সংঘর্ষের ভোঁতা আওয়াজ সে শুনতে পায় এবং আরো একটা মৃদু ভোঁতা শব্দের সাথে তাঁর ছিন্ন মস্তক মাটিতে আঘাত করতে উজ্জ্বল রক্ত ছিটকে উঠতে দেখে। মেহেরুন্নিসা কিছুক্ষণ নিথর দাঁড়িয়ে থাকে। তারপরে স্বস্তিকর একটা অনুভূতি–জল্লাদ লোকটা নিজের কাজ ভালোই জানে। তাঁর ভাই কষ্ট পায় নি। সে তাকে যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুর হাত থেকে নিকৃতি দিয়েছে। সে তাকিয়ে দেখে জল্লাদ দ্রুত মীর খানের ছিন্ন মস্তক আর দেহটা চামড়া দিয়ে ঢেকে দেয় এবং একজন প্রহরীর সাহায্যে সেগুলো কক্ষ থেকে সরিয়ে নেয়। আয়তাকার পাথরের খণ্ডের উপরের পড়ে থাকা কয়েক ফোঁটা রক্তই কেবল সাক্ষী দেয় যে কিছুক্ষণ আগে এখানে একজনের জীবনাবসান হয়েছে।
‘সবকিছু মিটে গিয়েছে, মেহেরুন্নিসা শুনতে পায় জাহাঙ্গীর বলছেন। ‘আপনি এবার হেরেমে ফিরে যেতে পারেন।’
মেহেরুন্নিসার অনুভব করার আর চিন্তা করার সব শক্তি যেন বিলীন হয়েছে। সে অন্ধের মত আদেশ পালন করে, কক্ষের দূরবর্তী প্রান্তের অতিকায় সোনালী দরজার দিকে টলতে টলতে এগিয়ে যায় যা ইতিমধ্যে তার জন্য খুলতে শুরু করেছে।
হেরেমে নিজের কক্ষে ফিরে এসে যা সে ভেবেছিল আর কখনও দেখতে পাবে না মেহেরুন্নিসার কিছুটা সময় লাগে অবশেষে কান্নায় ভেঙে পড়তে। নিজের ভাইয়ের মৃত্যুদণ্ড প্রত্যক্ষ করা খুবই কঠিন। নিজেকে সুস্থির রাখার জন্য সে তার হাতের নখ দিয়ে যেখানে আঁকড়ে ধরেছিল সেখান থেকে এখন রক্তপাত শুরু হয়েছে। কিন্তু মীর খান নিজেই নিজেকে এই বিপর্যয়ে আপতিত করেছে। সে দোষী আর ন্যায়বিচার সম্পন্ন হয়েছে। তাকে বাঁচাবার জন্য তার কিছুই করার ছিল না এবং সেই চেষ্টা করতে গেলে সে সম্ভবত নিজেকে আর সেই সাথে তাঁদের পুরো পরিবারকে বিপদগ্রস্থ করে তুলতো। তাঁর আব্বাজান যেমন শিশুকালে তাকে মরুভূমিতে পরিত্যাগ করেছিলেন তাঁদের বাকি পরিবারকে বাঁচবার একটা সুযোগ দিতে, তাকে ঠিক সেভাবেই মীর খানকেও উৎসর্গ করতে হয়েছে। তাঁর বিচক্ষণতার মানে এই নয় যে সে ভাইকে ভালোবাসে না, যতই দুর্বল আর বোকা সে হোক। কিন্তু এখন কি করণীয়? জাহাঙ্গীরের সাথে সাক্ষাতের বিষয়ে সে এতদিন ধরে যে স্বপ্ন দেখছিলো তা অবশেষে পূরণ হয়েছে কিন্তু সে যেমন কল্পনা করেছিল তার থেকে একেবারে ভিন্ন একটা প্রেক্ষাপটে। ভবিষ্যতের গর্ভে তার জন্য… বা তাঁর পরিবারের জন্য… কি অপেক্ষা করছে?
১.০৭ পাপস্খলন
ফতেপুর শিক্রি যাবার পথে শুকনো মাটির উপরে ঘোড়ার খুরের ছন্দোবদ্ধ শব্দ তাঁর কানে সন্তুষ্টির পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে, জাহাঙ্গীর ভাবে। শব্দটা তাকে বলছে যে মাসাধিক কাল অপেক্ষার পরে সে অবশেষে অভীষ্ট সাধনে কাজ করছে। মেহেরুন্নিসাকে দেখার পর থেকেই তাকে নিজের ভাবনা থেকে সে কদাচিত দূরে রাখতে পেরেছে। সে যে সাহসের সাথে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে নিজের বাবার পক্ষে সাফাই দিয়েছে সেটা বহুবছর পূর্বে সে যা আঁচ করেছিল সেটাকেই অভ্রান্ত প্রমাণিত করেছে–যে সে রূপবতী হবার সাথে সাথে একজন অসাধারণ মহিলা। অন্য যে কেউ হলে শোকে কাঁদতে বিলাপ করতো কিন্তু তিনি নিজের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রেখেছেন। তাঁদের মধ্যকার আলাপচারিতা শেষে একটা বিষয়ে তাঁর মনে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই যে তার পুরো পরিবারে মীর খানই একমাত্র বিশ্বাসঘাতক। সে সেই সাথে এটাও জানে যে বহু বছর আগে সে তার মাঝে যে অনুভূতির জন্ম দিয়েছিল সেটা আজও একই রকম রয়েছে। সে এখন তাকে আগের চেয়ে আরও বেশি করে কামনা করে।
অবশ্য, গোয়ালিওরে খসরুর কারাপ্রকোষ্ঠ থেকে অঙ্কুরিত তাঁর বিশ্বাসঘাতকতার শেষ প্রচেষ্টা সাফল্যের সাথে মোকাবেলা করাই ছিল তাঁর প্রথম লক্ষ্য। যতই দিন অতিবাহিত হয়েছে সে ততই মীর খানের মত আরো মাথা গরম তরুণদের কথা জানতে পেরেছে যারা খসরুর প্রতি নিজেদের আনুগত্য ঘোষণা করেছিল তার প্রতিশ্রুতির বহরের কারণে মোহিত হয়ে যা করার কোনো এক্তিয়ারই তার উচ্চাকাঙ্খী ছেলের ছিল না। সে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়, খসরুর সহযোগীরা উড়াল দেয়ার আগেই তাদের গ্রেফতারের বিষয়টা নিশ্চিত করে, তাদের জেরা করে আরো ষড়যন্ত্রকারীদের নাম তাঁদের কাছ থেকে আদায় করে এবং তারপরে তাঁদের প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করে।
খসরুর বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়াটাই ছিল সবচেয়ে কঠিন। সে অতীতে অনেক বেশি করুণা প্রদর্শন করেছে কিন্তু তার ফলাফল কি হয়েছে? খসরু তাঁর উদারতার বদলে কেবলই ছলনার আশ্রয় নিয়েছে। না, সে তার কাছ অনুতাপ কিংবা কৃতজ্ঞতা কিছুই আশা করতে পারে না। খসরুকে সে যে শাস্তিই দিক না কেন সেটা যেন এতটাই কঠোর হয় যে ভবিষ্যতে তাঁর বিদ্রোহের ব্যাপারে আর কোনো সন্দেহের অবকাশ না থাকে। কিন্তু তারপরেও তাঁর তাড়াহুড়ো করার কোনো দরকার নেই… সে বর্তমানে খসরুকে কেবল গোয়ালিওরের ভূগর্ভস্থ একটা কারা কুঠরিতে অন্তরীণ করে রাখতে আদেশ দিয়েছে এবং নির্দেশ দিয়েছে তাকে যেন সম্পূর্ণভাবে নিঃসঙ্গ অবস্থায় রাখা হয়।
সে ইয়ার মোহাম্মদকে, বাদখশান থেকে আগত বৃদ্ধ কিন্তু কঠোর শাসক, বিশ্বাস করতে পারে যাকে সে সম্প্রতি গোয়ালিয়রের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেছে, তার আদেশ যেন যথাযথভাবে পালিত হয় সেটা নিশ্চিত করতে। পূর্ববর্তী শাসনকর্তার বিষয়ে, সে নিশ্চিতভাবেই অনেক বিষয়ে শিথিলতা প্রদর্শন করেছিল আর খসরুকে অনেকবেশি সুযোগ সুবিধা দিয়েছিল। যুবরাজকে ষড়যন্ত্রের সুযোগ দেয়ার জন্য সেই সবচেয়ে বেশি দায়ী আর সে কারণেই জাহাঙ্গীরের কোপানলে পরার ভয়ে সে নিজের অবহেলার জন্য খেসারত দিতে মরীয়া হয়ে ষড়যন্ত্রকারীদের বিষয়ে যাবতীয় তথ্য সরবরাহ করেছে, এমনকি নিজেকে বাঁচাতে সে নিরীহ গিয়াস বেগকেও পর্যন্ত ফাঁসিয়ে দিয়েছে। জাহাঙ্গীর তাকে বরখাস্ত করতে, তার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে এবং তাকে নির্বাসিত করতে দ্বিতীয়বার চিন্তা করে নি।
তার ঠোঁটের কোণে নিষ্ঠুর এক চিলতে হাসি ফুটে উঠে। সম্রাটের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবার হঠকারী ভাবনা বহুদিন আর কারো মনে উদয় হবে না। আর বিপর্যয় এখন যখন সমাপ্তির কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে তখন সে নিজের একান্ত ব্যক্তিগত কিছু বিষয়ে মনোযোগ দেবার মত সময় সে অবশেষে লাভ করেছে। গতরাতে, মেহেরুন্নিসার ভাবনা যখন তাকে পুনরায় আবার রাতের বেলা জাগিয়ে রাখতে আরম্ভ করেছে, তখন সে না ভেবে থাকতে পারে নি যে খসরুর এই অনাকাঙ্খিত বিদ্রোহের কারণে মেহেরুন্নিসার পরিবার আর তার নিজের মধ্যকার পরিস্থিতি কি আদতে খুব সূক্ষভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। এই প্রশ্নের উত্তর কেবল পাক কেবলা সুফি বাবাই দিতে পারবেন। আর এই কারণেই তাঁর প্রাত্যহিত দরবারিক কর্মকাণ্ড সমাধা হতেই সে তার সাথে দেখা করার জন্য যাত্রা করবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
জাহাঙ্গীর তার সামনে দ্রুত ঘনিয়ে আসা সন্ধ্যালোকে, সে দেখতে পায় ইতিমধ্যেই রাতের খাবারের জন্য আগুন জ্বালান হয়েছে। ফতেপুর শিক্রি এখান থেকে খুব একটা দূরে নয়। সে তার কচি আর দেহরক্ষীদের চমকে দিয়ে সহসাই নিজের ঘোড়ার খুরে ঝড়ের বোল তুলে। তারা সবাই নিজের ঘোড়ার গতিবেগ বৃদ্ধি করে তার কাছাকাছি থাকবার প্রয়াসে তাঁদের ব্যস্ত হয়ে উঠার আওয়াজ সে পেছনে থেকে ভেসে আসতে শুনে।
পনের মিনিট পরে, তাকে বেশিরভাগই এখন পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকা ফতেপুর শিক্রির বেলেপাথরের শহরের মূল প্রতিরক্ষা প্রাচীরের বাইরে নিচু একটা মাটির বাড়ির সামনে ঘোড়া থেকে নামতে দেখা যায়। সে ছেলেবেলায় বর্তমান সুফি সাধকের বাবার সাথে প্রথমবার যখন দেখা করতে এসেছিল তখনকার চেয়ে বাড়িটাকে এখন যেন অনেকবেশি ছোট আর হতদরিদ্র মনে হয়, কিন্তু এটাও সত্যি যে স্মৃতির সাথে সময় প্রায়শই বিবিধ ছলনা করে থাকে। তোমরা সবাই এখানেই অপেক্ষা করো।’ দরজার ডানপাশে অবস্থিত একটা ক্ষুদ্র জানালা দিয়ে ভেতরে উঁকি দিয়ে সে একটা তেলের প্রদীপের খুবানি আভা দেখতে পায়। সে হাত থেকে ঘোড়া চালনার দস্তানা জোড়া খুলে ফেলে কাঠের দবেজ দরজায় টোকা দেয় এবং তারপরে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আলতো করে ধাক্কা দিয়ে দরজার পাল্লা খুলে। কক্ষের ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে সে আবারও দরজায় টোকা দেয় এবং এবার মাথা নত করে নিচু সরদলের নিচে দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে।
কক্ষটার মেঝে দুরমুজ করা মাটির তৈরি তার উপরে কেবল কয়েকটা জীর্ণ মাদুর বিছানো রয়েছে এবং তাঁর যতদূর মনে পড়ে এক কোণে একটা দড়ির চারপায়া থাকবার কথা কিন্তু সুফি বাবার কোনো চিহ্ন সেখানে নেই। জাহাঙ্গীরের মনটা এক মুহূর্তের জন্য হতাশায় ছেয়ে যায় কিন্তু পরক্ষণেই সে বাইরে থেকে কণ্ঠস্বরের আওয়াজ ভেসে আসতে শুনে এবং মুহূর্ত পরেই সুফিবাবা ভেতরে প্রবেশ করেন, তিনিও নিজের সাদা পাগড়ি পরিহিত মাথা সরদলের সাথে গুতো খাওয়া থেকে বাঁচাতে নিচু করে রেখেছেন।
‘সম্রাট, আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত, আপনাকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্য আমি ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত থাকতে পারি নি। আমি আগুন জ্বালাবার কাঠ সংগ্রহ করতে গিয়েছিলাম।’
‘আপনাকে আগে থেকে না জানিয়ে আসবার কারণে আমিই আসলে ভুল করেছি।’
‘সম্রাট, অনুগ্রহ করে…’ সুফিবাবা একটা মাদুরের দিকে ইঙ্গিত করে এবং জাহাঙ্গীর যখন তাঁর মুখোমুখি আসন পিড়ি হয়ে থিতু হয়ে বসে। এত ব্যগ্রভাবে আমার কাছে ছুটে আসবার কারণটা কি এবার জানতে পারি?
‘আপনার দিক নির্দেশনা আমার আবার প্রয়োজন।
‘সেই একই বিষয়ে?
জাহাঙ্গীরের মনে হয় সে বুঝি সুফিবাবার চোয়াল সামান্য চেপে বসতে দেখেছে। হ্যাঁ। পরিস্থিতি এখন বদলে গিয়েছে।
কীভাবে সেটা হয়েছে?
‘আপনি আমায় বলেছিলেন যে আমি কেবল আল্লাহতালার চোখের গুনাহগার নই সেইসাথে আমি আমার ভালোবাসার রমণীর এবং যাকে আমি আমার স্ত্রীর মর্যাদা দিতে চাই–আমার কোষাধ্যক্ষ গিয়াস বেগের কন্যা মেহেরুন্নিসার–পরিবারের প্রতিও অন্যায় করেছি, তাঁরা তাঁর জন্য যাকে স্বামী হিসাবে নির্বাচিত করেছিল তাকে হত্যা করে। আমার এই অন্যায়ের কারণে আপনি আমাকে হুশিয়ার করেছিলেন আমি যা চাই সেটা পাবার জন্য কোনো ধরনের ব্যগ্রতা প্রদর্শন করে আল্লাহ্তা’লার রোষানলে পড়ার ঝুঁকি না নিয়ে বরং ধৈর্য ধারণ করতে আর অপেক্ষা করতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। সুফিসাধক কোনো কথা না বলে কেবল মাথা নাড়ে এবং জাহাঙ্গীর পুনরায় বলতে শুরু করে, আমার সন্তান খসরু আবারও আমায় সিংহাসনচ্যুত করে আমাকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছিল। গিয়াস বেগের ছোট ছেলে প্রধান ষড়যন্ত্রকারীদের অন্যতম–মেহেরুন্নিসার আপন ভাই। সে অপরাধ স্বীকার করে এবং আমি তাকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করি। আপনার কাছে আমার প্রশ্ন হলো আমার প্রতি তার অপরাধ কি তাঁর পরিবারের প্রতি আমার অন্যায়কে কি নাকচ করবে না?
সুফিবাবা চোখ এখন অর্ধনিমিলিত এবং তার থুতনি এই মুহূর্তে নিজের ভাঁজ করা হাতের উপরে রাখা কিন্তু এখনও তিনি কোনো কথা বলেন না। জাহাঙ্গীর ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে। সে সম্ভবত মেহেরুন্নিসাকে এমনিও ডেকে পাঠাতে পারতো কিন্তু সুফি সাধক আর বহুকাল আগে গত হওয়া তার বাবার প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা তাকে সেটা করা থেকে বিরত রেখেছে।
সুফিবাবা অবশেষে মৌনতা ভঙ্গ করেন। আপনি যা বললেন তার কিছুটা অংশ বাস্তবিকই যুক্তিযুক্ত। আপনার অপরাধের চুড়ান্ত বিচারের ভার আল্লাহতালার হাতে কিন্তু এই মুহূর্তে আপনাদের দুই পরিবারের ভিতরে এখন আপনিই কেবল একমাত্র অপরাধী নন। আমার বিশ্বাস পাপে পাপ ক্ষয় হয়েছে। কিন্তু স্মরণ রাখবেন যে আপনার ভাগ্যে যাই লেখা থাকুক, আপনি নিজের আকাঙ্খকে চরিতার্থ করতে আপনি যে পদক্ষেপ নিয়েছেন সেটা একজন মানুষ আর বিশেষ করে একজন সম্রাট হিসাবে আপনার জন্য অগৌরবের।’
‘আমি জানি। জাহাঙ্গীর তার মাথা নত করে। সুফিবাবা ঠিকই বলেছেন। শের আফগানকে হত্যা করাটা তার একেবারেই ঠিক হয় নি। পুরো ব্যাপারটা ঈর্ষাতুর এক প্রেমিকের মত কাজ হয়েছে কোনোভাবেই সেটা একজন অমিত-ক্ষমতাধর সম্রাটের উপযুক্ত নয়। কিন্তু সুফিবাবার কথাগুলো এসব ভাবনা ছাপিয়ে তাকে আনন্দে আপ্লুত করে তুলে। মেহেরুন্নিসা অবশেষে তার হতে চলেছে। সুফিবাবা আমায় বলেন ভবিষ্যতের গর্ভে কি অপেক্ষা করছে? এই রমণী কি আমি যাকে খুঁজছি আমার সেই আত্মার আত্মীয় হবে?
‘সম্রাট আমার পক্ষে এই প্রশ্নের উত্তর দেয়া সম্ভব নয়। আমি আপনাকে আগেই বলেছি আমার আব্বাজানের মত আত্মার অধিকারী আমি নই। তাঁর মত ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষমতা আমার নেই। কিন্তু আপনি যেমন বলেছেন সত্যিই যদি আপনি তাকে সেরকমই ভালোবাসেন–এবং তার মাঝেও আপনার প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি করতে পারেন তাহলে সবকিছুই সম্ভব।
বাঁচালেন। আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না আপনার কথায় আমি কতটা স্বস্তি পেয়েছি। আমি কীভাবে আপনাকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাতে পারি?
‘আমি যা কিছু বলেছি সবই আল্লাহতালার প্রতি আমার বিশ্বাস আর তাঁর অভিপ্রায় মাথায় রেখে বলেছি কোনো পুরষ্কারের আশায় নয়, কিন্তু ফতেপুর শিক্রি থেকে চলে যাবার আগে আমার আব্বাজানের কবরটা জিয়ারত করলে আমি খুশি হব। আপনার সমস্ত অত্যাচার আর পাপের জন্য, কেবল শের আফগানের হত্যাকাণ্ডের জন্যই না, আবারও আল্লাহতা’লার কাছে করুণা ভিক্ষা করবেন। আব্বাজান হয়ত তাহলে বেহেশত থেকে আপনাকে আশীর্বাদ করবেন এবং আপনার আগামী জীবনটা আরও সুগম করে দেবেন।
*
‘নাহ্, এটাও পুরোপুরি ঠিক হয় নি। শোন…’ সাল্লা পংক্তিটা জোরে জোরে আবৃত্তি করে, আবৃত্তি করার সময় সে তার মাতৃভাষা আর্মেনীয় থেকে পার্সীতে অনুবাদ করতে থাকে। মেহেরুন্নিসা মাথা নাড়ে। ভাষাটা রপ্ত করতে তাঁর আরও সময় লাগবে কিন্তু এই বিনোদনটা তার ভালোই লাগে। এখানে প্রতিটা দিন আগের দিনের মতই এবং নিঃসন্দেহে আগামী দিনও। সে যদিও পুনরায় ফাতিমা বেগমের সাথেই বসবাস করছে, তাকে একঘরে করে রাখা হয়েছে। পুরোটা সময় কেবলই খসরুর সাথে ষড়যন্ত্রকারী সন্দেহভাজনদের গ্রেফতারের তাজা খবর সে শুনছে। তাঁর ভাইয়ের মৃত্যুদণ্ডই হেরেমের অধিবাসীদের তাঁর প্রতি সতর্ক করার জন্য যথেষ্ট। সাল্লার যদিও, তাঁর বিদ্বান বাবা রাজকীয় পাঠাগারের আধিকারিক, এসব নিয়ে কোনোপ্রকার হেলদোল আছে বলে মনে হয় না। ফাতিমা বেগমের পরিচারিকা হিসাবে তাকে সম্প্রতি নিয়োগ করা হয়েছে এবং মেহেরুন্নিসা তাঁর সান্নিধ্য পেয়ে একরকম বর্তে গিয়েছে। সাল্লা আর্মেনিয়াসের পাশাপাশি মেহেরুন্নিসাকে খানিকটা ইংরেজিও শিখাবে বলেছে, যা তার আব্বাজান, যখন তরুণ বয়সে জনৈক ইংরেজ ব্যবসায়ীর অধীনে মুনশী বা সেক্রেটারি হিসাবে কর্মরত থাকার সময়ে রপ্ত করেছিলেন, তাকে শিখিয়েছে।
মেহেরুন্নিসা যে পংক্তিগুলো ভাষান্তর করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছিল সেই পংক্তিগুলো সে পুনরাবৃত্তি করার সময়ে সাল্লার আন্তরিক মুখের চারপাশে তাঁর ঘন কালো লম্বা চুলের গোছা বৃত্তাকারে ঝুলতে থাকে তাঁর চুল এতই ঘন যে চুল আচড়াবার সময়ে তাকে চিরুনির সাথে রীতিমত যুদ্ধ করতে হয়: ‘রাত যখন গম্ভীর হয়ে আলকাতরার ন্যায় কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করে তখন ভয় পাবে না। জানবে সেটা কেবলই ভেসে যাওয়া কোনো মেঘের কারসাজি যা চাঁদ আর তারাদের আলো শুষে নিয়েছে। আবারও তাদের আলোর দীপ্তি ফিরে আসবে, পূর্বের মতই সৌন্দর্যমণ্ডিত যা একদা হারিয়ে গিয়েছিল।’
শব্দগুলো মেহেরুন্নিসাকে স্পর্শ করে। এটা কার কবিতা?
‘আমাদের অন্যতম মহান কবি-ইয়েরেভানের হ্যাগোপান।
কতদিন আগের…’ মেহেরুন্নিসা কথা শেষ করতে পারে না কারণ নাদিয়া ঝড়ের বেগে তার কক্ষে এসে প্রবেশ করেছে।
‘মালকিন, আপনাকে এখনই আমার সাথে যেতে হবে। খাজাসারা আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন।
আবার কি ঘটলো? মেহেরুন্নিসা চিন্তিত মুখে উঠে দাঁড়ায়। জাহাঙ্গীরের সাথে তার সাক্ষাৎকারের পর থেকেই সে আশঙ্কা করছে যেকোনো মুহূর্তে তাকে তার বাবা-মায়ের কাছে ফেরত পাঠানো হবে। বাবা মা আর ভাই আসাফ খানের কাছে যে চিঠিগুলো সে লিখেছিল সেগুলোয় আশঙ্কার কথা ছিল। সে নিশ্চিত যে হেরেম থেকে বাইরের সাথে যেকোনো ধরনের সংবাদ বিনিময়–বিশেষ করে ষড়যন্ত্রের দায়ে অভিযুক্ত পরিবারের সাথে সতর্কতার সাথে খুটিয়ে দেখা হবে।
নাদিয়াকে অনুসরণ করে বাইরের আলোকউজ্জ্বল প্রাঙ্গণে এসে দাঁড়াতে–উত্তল মার্বেলের উপর সূর্যঘড়ির ছায়া বলছে এখনও দুপুর হয়নি–মেহেরুন্নিসা দেখে মালা তার জন্য অপেক্ষা করছে। খাজাসারার দীর্ঘদেহী অবয়বের পিছনে গাঢ় সবুজ বর্ণের আলখাল্লা পরিহিত ছয়জন পরিচারিকা মালার দিকে তাকিয়ে থেকে হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাঁদের ভিতরে তিনজন খোঁজা আর তিনজন মহিলা।
‘আপনি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন, মেহেরুন্নিসা খাজাসারার উদ্দেশ্যে বলে।
‘হ্যাঁ, মালকিন।
‘আপনি কি বলতে চান?
‘জনসমক্ষে কথাটা বলার অনুমতি আমায় দেয়া হয়নি। অনুগ্রহ করে আমায় অনুসরণ করুন।
খাজাসারা উচ্চপদস্থ কোনো রাজকীয় কর্মচারীর ন্যায় দন্ডটা হাতে নিয়ে সদর্পে এগিয়ে যায়, একদিক দিয়ে বিবেচনা করতে গেলে সে আসলেও তাই। পরিচারিকার দল তাকে অনুসরণ করে এবং মিছিলটার একেবারে শেষে থাকে মেহেরুন্নিসা। ছোট্ট মিছিলটা জাহাঙ্গীরের ব্যক্তিগত খাস কামরায় প্রবেশের বাঁকটা এড়িয়ে, যা মেহেরুন্নিসা এখন ভালো করেই চেনে, প্রধান প্রাঙ্গণের উপর দিয়ে হেরেমের প্রবেশ পথের দিকে এগিয়ে যায়। তাকে শেষ পর্যন্ত তাহলে বহিষ্কারই করা হচ্ছে…
কিন্তু তখনই মেহেরুন্নিসা তোরণগৃহের বামে একটা ক্ষুদ্র খিলানযুক্ত তোরণদ্বার লক্ষ্য করে। সেখানে পৌঁছে মালা ভেতরে প্রবেশ করে হারিয়ে যায়। পরিচারিকার দলকে অনুসরণ করে খিলানাকৃতি তোরণের নিচে দিয়ে এগিয়ে যেতে মেহেরুন্নিসা একটা সংকীর্ণ গলিপথের মাঝে নিজেকে আবিষ্কার করে যা বামদিকে বাঁক খেয়ে খাড়াভাবে নিচের দিকে নেমে গিয়েছে। সে এক মুহূর্তের জন্য আতঙ্কিত হয়ে চিন্তা করে তাকেও কি একই ভূগর্ভস্থ কারাপ্রকোষ্ঠে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কিন্তু তারপরেই সে খেয়াল করে যে ভেতরের বাতাস ক্রমশ উষ্ণ হচ্ছে। বেলেপাথরের দেয়াল বেয়ে জলকণা গড়িয়ে নামছে এবং কারাগারের সেঁতসেঁতে গন্ধের বদলে তাঁর নাকে–গোলাপজল, চন্দনকাঠ আর তিমিমাছ থেকে প্রাপ্ত গন্ধদ্রব্যের সুগন্ধ ভেসে আসে। সামনে আরেকটা তীক্ষ্ণ বাঁক দেখা যায় এবং মেহেরুন্নিসা সামনে আলো দেখতে পায়। আরও কয়েক কদম সামনে এগিয়ে যেতে সে নিজেকে একটা ক্ষুদ্র আয়তাকার আঙ্গিণায় আবিষ্কার করে যার চারদিকেই উঁচু দেয়াল। সে উপরের দিকে তাকিয়ে সে কেবল ছোট আয়তাকার আকাশের ধাতব নীল দেখতে পায়। প্রাঙ্গণের মাঝে একটা ঝর্ণা থেকে বুদ্বুদ নিঃসৃত হচ্ছে এবং ঠিক উল্টোদিকের দেয়ালের ফাঁকাস্থানের ভিতর দিয়ে সুগন্ধি স্রোত, আর্দ্রতার উৎস দেখা যায়– হাম্মামখানা।
‘অনুগ্রহ করে কাপড় খুলে রাখুন, খাজাসারা বলে।
মেহেরুন্নিসা বিস্মিত চোখে অপলক তাকিয়ে থাকে।
‘হেরেমের প্রচলিত নিয়মরীতির কারণে আমরা এই নিভৃতস্থানে পৌঁছাবার পূর্বে আপনাকে কিছু জানানো থেকে আমায় বিরত রেখেছিল, কিন্তু সম্রাট আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। আজ রাতে আপনি যদি তাকে প্রীত করতে, পারেন তাহলে আপনি তার সাথে একই শয্যায় শয়ন করবেন। কোনো তর্ক করা চলবে না। আমি যা বলছি আপনাকে তাই করতে হবে।
মেহেরুন্নিসা এতটাই বিস্মিত হয় যে পরিচারিকার দল তার দেহ থেকে পোষাকের আবরণ সরিয়ে নিয়ে তাকে নগ্ন করতে থাকলে সে বাধা না দিয়ে পাথরের মত দাঁড়িয়ে থাকে। তারা প্রথমেই তাঁর পালিশ করা গোলাপি স্ফটিকের টুকরো বসানো কলাই করা পরিকরের মুক্তাখচিত টাসেল খুলে দেয় তার পরনের গোলাপি রেশমের আলখাল্লা সরিয়ে দিয়ে তাঁর অন্তর্বাস খুলে নেয় এবং তার পা থেকে রেশমের তৈরি চটিও তাঁরা সরিয়ে নেয়। সে কিছু বোঝার আগেই সে দেখে পুরোপুরি নগ্ন অবস্থায় সে ছোট আঙিনায় নেমে আসা উজ্জ্বল সূর্যালোকে দাঁড়িয়ে রয়েছে আর খাজাসারা কাবুলের দাসবাজারে তার দেখা দাস ব্যবসায়ীদের মত নিরাসক্ত চোখে তাকে খুটিয়ে দেখছে। নিজের ঘন কালো চুল ঝাঁকিয়ে সে চেষ্টা করে নিজের স্তনযুগল আড়াল করতে এবং ঘুরে দাঁড়ায়, সে এখনও মালা একটু আগে যা বলেছে সেটাই বুঝতে চেষ্টা করছে। জাহাঙ্গীর অবশেষে তাহলে তাকে ডেকে পাঠিয়েছেন কিন্তু মনে হচ্ছে তিনি তাকে আর নিজের স্ত্রী করতে চান না। মামুলী একজন রক্ষিতার মত তাকে তার শয্যার জন্য উপযোগী করা হচ্ছে।
‘চলুন, খাজাসারা উন্মুক্তস্থানটার দিকে ইশারা করে তাকে হাম্মামে প্রবেশ করতে বলে। ভেতরে, গরম পাথরের উপরে প্রবাহিত সুগন্ধি পানির স্রোত থেকে উষ্ণতা নির্গত হচ্ছে যা মার্বেলের সংকীর্ণ ঢালু পথ দিয়ে নিচে নামছে। তার চোখ জ্বালা করে এবং সে টের পায় তাঁর ত্বক ঘামতে শুরু করেছে। সে বরাবরই হাম্মাম পছন্দ করে কিন্তু এখন দীর্ঘ প্রক্রিয়া শুরু হতে সে অনুভব করে তার দেহ উত্তেজনায় টানটান হয়ে আছে। প্রথমে, একটা মার্বেল পাথরের খণ্ডের উপর শুয়ে থাকার সময় পরিচারিকার দল গরম হিসহিস করতে থাকা উষ্ণ পাথরের উপরে আরো পানি ঢালে, সে টের পায় এবার আসলেই তাঁর দেহ কুলকুল করে ঘামতে শুরু করেছে, তার ত্বক পরিষ্কার করে এবং সেটাকে এখন রেশমের ন্যায় নরম আর তুলতুলে মনে হয়। এরপরে, পাশের একটা কক্ষে সে পানির ছোট্ট একটা চৌবাচ্চায় অবগাহন করে যার পানি এত ঠাণ্ডা যে দূর্গের বরফঘর থেকে চৌবাচ্চায় দেয়ার জন্য নিয়ে বরফের টুকরোগুলো এখনও পানিতে ভাসছে। তাকে এরপরে তৃতীয়, বড় একটা কক্ষে নিয়ে আসা হয়। কক্ষটায় কোনো প্রাকৃতিক আলো নেই কিন্তু চারপাশের দেয়ালের কুলুঙ্গিতে স্থাপিত অসংখ্য তেলের প্রদীপের আভায় দেখা যায় দেয়ালের আস্তরের উপরে আর উঁচু খিলানাকৃতি ছাদে জটিল ফুলের নক্সা করা রয়েছে। সেখানে তূর্কী এক মহিলা বিশাল পুরুষালি হাতে সুগন্ধি তেল দিয়ে তার সারা দেহ মালিশ করে দেয়ার সময় সে মুখ নিচু করে একটা মার্বেলের বেঞ্চে শুয়ে থাকে।
কামরাটার এক কোণে পিতলের ধূপাধারে জ্বলতে থাকা ধূপের ঝাঁঝালো গন্ধে তার মাথা ঘুরতে শুরু করে। সে সময়ের হিসাব হারিয়ে ফেলে যখন তার মালিশ শেষ হতে কোথা থেকে এক খোঁজা এসে তাঁর দেহ মসলিনের একটা আলখাল্লায় জড়িয়ে দেয় যা এতই সূক্ষ যে তার দেহের চারপাশে এটাকে প্রায় স্বচ্ছ দেখায় এবং তাকে একটা নিচু তেপায়র কাছে বসার জন্য নিয়ে আসে। তাকে সেখানে বসিয়ে খোঁজাটা এবার তার চুল আচড়াতে আরম্ভ করে, সুগন্ধি ছিটিয়ে দেয় এবং পাথরখচিত ফিতে দিয়ে চুলে বেণী করে দেয়। আরেক খোঁজা, মনোসংযোগের কারণে এর জ্বটা কুঁচকে রয়েছে, তার ভ্র তুলে দেয় এবং তারপরে চোখে সুন্দর করে কাজল দিয়ে তার লম্বা কালো চোখের পাপড়িতে আরও কালো করে তুলে। তারপরে, মর্মরসদৃশ অ্যালাবাস্টারের একটা আলতার পাত্র থেকে আলতা নিয়ে তার ঠোঁট দুটো রাঙিয়ে দেয়। খোঁজাটা যখন উঠে দাঁড়িয়ে উফুল্ল একটা শব্দ করে মেহেরুন্নিসা বুঝতে পারে সে নিজের কাজ নিয়ে সন্তুষ্ট। তৃতীয় খোঁজা এবার সবুজ জেড পাথরের পাত্রে মেহেদী নিয়ে আসে। একটা সূক্ষ্ম তুলি দিয়ে সে তার হাতে পায়ে আর বাহুতে জটিল আলপনা এঁকে দেয়। অন্যমনস্কভঙ্গিতে তাকিয়ে থেকে যেন অনেক দূর থেকে দেখছে এমনভাবে সে তার কাজ দেখে-ভাবটা এমন যেন সে একটা ছোট্ট পুতুল সাজাচ্ছে যার সাথে তার নিজের কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু লোকটা পরবর্তী কথায় তার সম্বিত ফিরে সে বুঝতে পারে এটা আসলেই তাঁর দেহ। মালকিন, এবার আপনার আলখাল্লাটা খুলতে যে হবে।’
মেহেরুন্নিসা তার মসৃণ, খানিকটা বিরক্তিকর মুখে দিকে চোখ তুলে তাকায়। খোঁজা হলেও তার কণ্ঠস্বর পুরুষের মতই ভারি। তুমি কি বলছো?’
‘অনুগ্রহ করে আপনার আলখাল্লাটা খুলেন, সে আবারও বলে। সে তারপরেও যখন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, তখন সেই তার দিকে ঝুঁকে এসে তাঁর মসলিনের আলখাল্লার গলার নিচে হাত ঢুকিয়ে আলতো করে সেটা তার কাঁধের উপরে তুলে নিয়ে আসে যতক্ষণ না তাঁর স্তনযুগল অনাবৃত হয়। তারপরে, শক্ত করে ঠোঁট চেপে রেখে সে তার স্তনবৃন্তে তুলির অগ্রভাগ আলতো করে ছুঁইয়ে সেগুলোকে আরও গাঢ় করে তুলতে তুলির স্পর্শে তার স্তনবৃন্ত শক্ত হয়ে যায় এবং এসব কিছুই লক্ষ্য না করে লোকটা তার স্তনবৃন্তের চারপাশের আপাত ধুসর ত্বকে ছোট ছোট ফুলের নক্সা আঁকতে থাকে। তার কাজ শেষ হতে সে পুনরায় তাঁর আলখাল্লাটা জায়গামত নামিয়ে দেয় এবং চিৎকার করে বলে, ‘খাজাসারা মালকিন প্রস্তুত।’
মালা তাঁর পাশে এসে দাঁড়ায় তারা দু’জনে জহুরীর চোখ নিয়ে তাকে খুটিয়ে দেখে। তারপরে মালা সন্তুষ্ট ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে। চমৎকার। তুমি দারুণ কাজ দেখিয়েছে। আর মেহেরুন্নিসাকে সে বলে, বাইরের আঙিনায় আবার ফিরে চলো।’ প্রাঙ্গণের বিভিন্ন স্থানে বন্ধনীযুক্ত মশালদানে মশাল জ্বলতে শুরু করেছে এবং আঙিনার উপরের এক চিলতে আকাশের বুকে তাকিয়ে সে দেখে ইতিমধ্যে রাতের প্রথম তারারা উঁকি দিতে শুরু করেছে, যেন তাকে বলছে প্রস্তুতি নিতে তার কত দীর্ঘসময় অতিবাহিত হয়েছে।
‘এসো কিছু খেয়ে নেবে। খাজাসারা ঝর্ণার কাছে একটা রূপার তৈরি কাঠামোর উপরে রাখা একটা পাত্রে রক্ষিত খুবানি, পেস্তা আর অন্যান্য শুকনো ফলের দিকে ইঙ্গিত করে কিন্তু মেহেরুন্নিসার পেটে শক্ত গিট অনুভূত হয় এবং সে মাথা নেড়ে মানা করার সময় মাথায় পরানো অলঙ্কারের ভার অনুভব করে। যেমন তোমার অভিরুচি। খাজাসারা আবার হাততালি দিতে তিন মহিলা পরিচারিকা হলুদ রঙের ব্রোকেডের কাজ করা ঢোলা একটা আলখাল্লা, স্যাটিনের সোনালী রঙের পাদুকা এবং গলায় পরার জন্য হলুদ বিড়ালাক্ষের মত দেখতে পাথরের ছড়া তার গলায় আর কোমড়ে পরাবার জন্য নিয়ে আসে। অনুগ্রহ করে একটু ঘুরে দাঁড়ান যাতে করে আমি অন্তত সন্তুষ্ট হতে পারি যে সবকিছু ঠিক ঠিক করা হয়েছে, পরিচারিকার দল তাদের কাজ শেষ করার পরে মালা কথাটা বলে। মেহেরুন্নিসা অনুগত ভঙ্গিতে ধীরে ধীরে পাক খেয়ে ঘুরতে শুরু করে। মালা তাকে আসন্ন রাতে তাঁর জন্য কি অপেক্ষা করছে খুলে বলার পর থেকেই তাঁর কেবলই মনে হচ্ছে যে কেউ একজন যেন তার নিয়তির ভার তার হাত থেকে কেড়ে নিয়েছে আর এই বোধটা আশঙ্কাজনকভাবে কেবল প্রবলতর হচ্ছে। সে অচিরেই আরো একবার জাহাঙ্গীরের সামনে নিজেকে দেখতে পাবে। শেষবার তার কি বলা আর করা উচিত সে সম্বন্ধে তার ঠিক ঠিক ধারণা ছিল। এইবার তাঁর কোনো ধারণাই নেই…
যথেষ্ট হয়েছে। মালা বলে। চলুন এবার যাওয়া যাক। সময় হয়ে এসেছে।’
‘খাজাসারা… আমাকে পথ দেখান, একটু পরামর্শ দিন।’ সে যদিও তাকে অনুরোধ করে মেহেরুন্নিসা এর জন্য নিজেকে তিরস্কার করে, কিন্তু সে কোনোভাবেই নিজেকে বিরত রাখতে পারে না।
মালা ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কেমন চাপা একটা হাসি হাসে। তোমার দায়িত্ব সম্রাটকে প্রীত করা। এটুকুই কেবল তোমার জানা থাকা জানা দরকার।
*
মেহেরুন্নিসাকে খোঁজাদের একজন মূল আঙিনায় ফিরিয়ে নিয়ে আসে এবং উপরে সম্রাটের কক্ষের দিকে উঠে যাওয়া সিঁড়ি বেয়ে সে উঠে আসে। মালা সতর্কতার সাথে তাঁর মাথায় সোনালী চুমকি বসানো যে নেকাবটা পরিয়ে দিয়েছে সেটার ঝকমকে পর্দার ভিতর দিয়ে তাকাতে সবকিছু কেমন নির্বাক আর তুচ্ছ মনে হয়–রাজপুত প্রহরীর দল দরজার রুপালি পাল্লাগুলো হট করে খুলে দিয়ে তাকে আর তাঁর সঙ্গী খোঁজাকে অতিক্রম করতে দেয়, জাহাঙ্গীরের ব্যক্তিগত কামরার অতিকায় দরজার সোনালী পাল্লাগুলো মনে হয় যেন শীতল শক্ত ধাতুর চেয়ে নরম কাপড়রে মত যেন চকচক করছে।
সোনালী দরজার পাল্লার ঠিক মুখেই অপেক্ষমান মহিলা পরিচারিকাকে মেহেরুন্নিসা জীবনে কখনও দেখেনি, কিন্তু এ বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই যে খোঁজা আর মেয়েটা পরস্পর পরস্পরের পরিচিত। খোঁজাটা মাথা নত করে, বলে, মহামান্য সম্রাটের আদেশ অনুসারে আমি মেহেরুন্নিসাকে নিয়ে এসেছি।’
‘খালেদ আপনাকে ধন্যবাদ, ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটা উত্তর দেয় এবং তারপরে, তার সঙ্গে আসা খোঁজাটা বের হয়ে যায় এবং প্রহরীরা সোনালী পাল্লা দুটো বাইরে থেকে টেনে তার পেছনে সেটা বন্দ করে দেয়, মেয়েটা এবার মেহেরুন্নিসার হাত আঁকড়ে ধরে। আমার নাম আশা, আমি মহামান্য সম্রাটের বামা দেহরক্ষীবাহিনীর প্রধান এবং এটা আমার দায়িত্ব যে রাজকীয় শয়নকক্ষে গমনকারী সব রমণী যে নিরস্ত্র সেটা নিশ্চিত করা। অনুগ্রহ করে আপনি হাত তুলে দাঁড়ান। মেয়েটা এবার দ্রুত কিন্তু পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মেহেরুন্নিসার দেহ তল্লাশি করে। বেশ। আমার সাথে এসো।’
মেহেরুন্নিসা আশাকে অনুসরণ করে লম্বা কক্ষটার দূরতম প্রান্তের দিকে এগিয়ে যাবার সময়, বেদীটার পাশ দিয়ে হেঁটে যায় যেখানে জাহাঙ্গীর তার ভাইয়ের বিচারের সময় উপবেশন করেছিল এবং বেদীটা থেকে প্রায় পনের ফিট পেছনে একটা পর্দা দ্বারা আড়াল করা একটা দরজার নিচে দিয়ে বের হয়ে আসে। দরজাটা তাঁদের বেশ প্রশস্ত একটা করিডোরে পৌঁছে দেয় যার শেষ প্রান্তে অবস্থিত একটা ছোট বর্গাকার দরজার কাছে যাবার রাস্তাটা আরো রাজপুত সৈন্য পাহারা দিচ্ছে। মেহেরুন্নিসা তাঁর নেকাবের ভেতর থেকেও দরজায় বসান পাথর থেকে বিচ্ছুরিত হওয়া আগ্নেয় আলোর আভা স্পষ্ট দেখতে পায়। আশা দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে প্রহরীদের উদ্দেশ্যে কথা বলে। এই রমণীকে সম্রাটের মনোরঞ্জনের জন্য পাঠান হয়েছে। দরজা খুলে দাও।’ রাজপুত প্রহরীর দল বিনা বাক্য ব্যয়ে আদেশ পালন করে। মেহেরুন্নিসা অনুভব করে আশা তার পিঠের মাঝে আলতো করে হাত রেখে তাকে সামনের দিকে অন্ধকারাচ্ছন্ন কক্ষের মাঝে তাকে পথ দেখায়।
দরজার পাল্লাগুলো তার পেছনে বন্ধ হতে, মেহেরুন্নিসা দাঁড়িয়ে পড়ে। জাহাঙ্গীর মাত্র কয়েক ফিট দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে তার পরনের ব্রোকেডের আলখাল্লাটা গলার কাছে রুবির একটা বকলেশ দিয়ে আটকানো, তাঁর কালো চুল কাঁধের উপর ছড়িয়ে রয়েছে।
‘সম্রাট, আপনি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। তাদের শেষবার দেখা হবার সময় সে যে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে এত কষ্ট করেছিল দেখা যায় এই দফা তাকে পরিত্যাগ করেছে এবং সে নিজের কণ্ঠস্বরে মৃদু একটা কম্পন টের পায়।
জাহাঙ্গীর আরো কাছে এগিয়ে আসে। তোমার নেকাবটা খুলে রাখো। সে ধীরে ধীরে হাত তুলে রেশমের চুমকি শোভিত টুকরোটা টেনে ছিঁড়ে ফেলে এবং সেটাকে ভাসতে ভাসতে মাটিতে পড়তে দেয়। মেহেরুন্নিসা, আমি দীর্ঘসময় আপনার জন্য অপেক্ষা করেছিলাম। আমি আজ রাতটা আপনার সাথে অতিবাহিত করতে চাই, কিন্তু তার আগে আমাকে জানতে হবে আপনি কি আমার সাথে রাত কাটাতে আগ্রহী?
‘জাঁহাপনা, আমি আগ্রহী, সে নিজেই কথাগুলো বলছে টের পায়।
‘আসুন তাহলে।’ সে ঘুরে দাঁড়িয়ে ফুলের নক্সা তোলা রেশমের চাদর দিয়ে আবৃত বিশাল একটা নিচু বিছানার দিকে এগিয়ে, কিন্তু বিছানায় কোনো বালিশ বা কোনো তাকিয়া কিছুই নেই। বিছানার দুই পাশে রূপার মোমদানিতে জ্বলন্ত লম্বা মোমবাতি বিছানার মসৃণ উপরিভাগে ছায়া ফেলেছে। জাহাঙ্গীর নিজের আলখাল্লাটা খুলে ফেলে এবং অবহেলা ভরে সেটাকে মাটিতে ফেলে দেয়। মৃদু আলোতে তাঁর তৈলাক্ত, পেষল দেহ চিকচিক করে। মেহেরুন্নিসা যখন ধীরে ধীরে নিজের বসন ত্যাগ করে আপন নগ্নতা প্রতিভাত করতে তখন সে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে। তিনি যদি জোর করে তাকে নিজের বাহুর ভেতর টেনে আনতেন তাঁর স্বামী শের আফগান মেসটা করতে পছন্দ করতো তারচেয়ে তার দেহের প্রতিটা বাঁক, প্রতিটা ফাটল চোখে পড়তে জাহাঙ্গীরের চোখে ফুটে উঠা চাঞ্চল্য অনেকবেশি উত্তেজক। অচিরেই যা ঘটতে চলেছে সেটা একটা দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্কে সূচনা করবে নাকি তাঁদের জীবনের কেবলই স্বল্পকালস্থায়ী একটা অধ্যায় মেহেরুন্নিসার নিজের ভেতরে উপচে উঠা শারীরিক চাহিদার তুলনায় সহসাই গুরুত্বহীন হয়ে উঠে। সে এতদিন বিশ্বাস করে এসেছে যে মন দেহকে নিয়ন্ত্রণ করে কিন্তু এখন সে বুঝতে পারে ব্যাপারটা সবক্ষেত্রে সত্যি নয়।
জাহাঙ্গীর কিছু বলবে সেজন্য অপেক্ষা না করে সে নিজেই ধীরে ধীরে তাঁর দিকে এগিয়ে যায় এবং নিজের হাত উঁচু করে সে নিজের সুরভিত দেহ দিয়ে তাঁর দেহকে প্রবলভাবে আঁকড়ে ধরে। সে অনুভব করে তাঁর স্তনবৃন্ত জাহাঙ্গীরের বুকের কাছে শক্ত হয়ে উঠেছে এবং তার কামোত্তেজনাও কম প্রবল নয়। সে দু’হাতে তাঁর নিতম্ব আঁকড়ে ধরতে সে সহজাত প্রবৃত্তির কারণে সাথে সাথে বুঝতে পারে সে তার কাছে কি চাইছে। সে তার কাঁধ শক্ত করে আঁকড়ে ধরে, সে দু’পায়ে তার কোমর সাপের মত পেঁচিয়ে ধরে। জাহাঙ্গীর তার ওজন সামলাতে গিয়ে আরও জোরে তার নিতম্ব চেপে ধরে এবং নিজের ভেতর সম্রাটের প্রবল উপস্থিতি অনুভব করে সে কেঁপে উঠে এবং চাপানউতোর শুরু হয়। সে যতই তার গভীর থেকে গভীরতর অংশে প্রবিষ্ট হয় ততই তাঁর পিঠ ধনুকের মত বেঁকে যায় আর শীৎকার শুরু করে, তার নখ জাহাঙ্গীরের ত্বক খামচে ধরে তাকে আরো প্রবল হতে উৎসাহিত করে।
‘সোনা অপেক্ষা করো, সে ফিসফিস করে মেহেরুন্নিসার কানে কানে বলে। সে তাকে বিছানার কাছে নিয়ে এসে তাকে সেখানে শুইয়ে দিয়ে আপাতনের ছন্দপতন না ঘটিয়ে তার উপরে টানটান হয়ে শুয়ে পড়ে। তাঁর মুখ এখন তাঁর ডান স্তনবৃন্তে, তাঁর জীহ্বা সেটাকে উত্তেজিত করে আর তাঁর দাঁত এর চারপাশের নরম জায়গাগুলো ঠোকরাতে থাকে। তাদের দুজনের শ্বাসপ্রশ্বাসের বেশ জোরালো হয়। সে টের পায় জাহাঙ্গীরের পিঠ টানটান হয়ে উঠেছে। সে শীর্ষানুভূতির চূড়ায় পৌঁছে গিয়েছে কিন্তু কোনমতে নিজেকে প্রশমিত করে, অপেক্ষা করে সঙ্গীর সহচর্যের। সে শেষ একটা প্রবল অভিঘাতে মেহেরুন্নিসাকেও সেখানে উঠিয়ে আনে। মেহেরুন্নিসা তাঁদের দুজনের সম্মিলিত শীৎকারের শব্দ শুনতে পায় যখন তাঁর ঘামে ভেজা দেহটা ভগ্নস্তূপের মত তার উপরে নেমে আসে আর তারা দুজন পরস্পরকে জড়িয়ে শুয়ে থাকে, হৃৎপিণ্ডে ঝড়ের মাতম। তাকে আপুত করে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া অনুভূতি ধীরে ধীরে প্রশমিত হতে শুরু করতে সে নিজের আরুক্তম মুখ দিয়ে তার বুকে ঘষতে থাকলে জাহাঙ্গীরের আঙুল তার লম্বা চুল নিয়ে খেলতে থাকে।
*
মেহেরুন্নিসা ছয় ঘন্টা পরে নিদ্রালু ভঙ্গিতে তার চোখের পাতা মেলে এবং আধ-খোলা গবাক্ষ দিয়ে ভোরের ধুসর আলো বর্শার মত নেমে আসতে দেখে। সে সেই সাথে আরও দেখে কেন তাঁর নিদ্রাভঙ্গ হয়েছে। আশা তাঁর শয্যার পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মেহেরুন্নিসা এস্ত ভঙ্গিতে নিজের নগ্ন দেহ রেশমের চাদরের একপাশ টেনে নিয়ে ঢাকতে চেষ্টা করে।
‘জাহাপনা,’ আশা পিঠের উপর ভর দিয়ে, একহাত বুকের উপরে রাখা আর অন্যহাত নিজের মাথার উপর প্রসারিত করে, তখনও গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন জাহাঙ্গীরের দিতে তাকিয়ে কথাটা বলে। অনুগ্রহ করে উঠেন, জাহাঙ্গীর চোখ খুলে তাকায়। জাহাপনা, ঝরোকা বারান্দায় আপনার উপস্থিতির সময় হয়েছে।’
জাহাঙ্গীর সাথে সাথে শয্যা থেকে উঠে পড়ে এবং আশা ইতিমধ্যে তার জন্য নিজের হাতে যে রেশমের আলখাল্লাটা ধরে রয়েছে সেটার দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। সে মাথা নিচু করে তাকে সুযোগ করে দেয় রেশমের একটা সবুজ পাগড়ি মাথায় পরিয়ে দিতে যেটায় লম্বা একটা সারসের পালক হীরক খচিত ব্রোচ দিয়ে আটকানো রয়েছে। তারপরে, তার দিকে আশার বাড়িয়ে রাখা ব্রোঞ্জের আয়নায় নিজের উপস্থিতি দ্রুত একবার পর্যবেক্ষণ করে, সে রেশমের উড়তে থাকা সবুজ পর্দা সরিয়ে বাইরে অবস্থিত ঝরোকা-ই-দর্শনের, উপস্থিতির বারান্দা যেখান থেকে দিকে যমুনা নদী দেখা যায় সেদিকে, এগিয়ে যায়।
মেহেরুন্নিসা শয্যা ত্যাগ করে, কক্ষের ভিতর দিয়ে নগ্নভাবেই নেমে এসে পর্দার আড়াল থেকে দেখার জন্য এগিয়ে যায়। জাহাঙ্গীর সেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে যেমনটা সে প্রতিদিন সকালেই করে নিজের লোকদের কাছে প্রমাণ করতে যে মোগল সম্রাট এখনও জীবিত রয়েছেন। তোরণগৃহে রক্ষিত অতিকায় দুষ্টুভি ঢাকের বোলের তালে সে তার হাত উঁচু করে। দূর্গের নিচে নদীর তীরে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকা জনতার অনুকূল গর্জন শোনার সময় মেহেরুন্নিসাও সেই উত্তেজনায় জারিত হয়। এটাই হল আসল ক্ষমতা যখন একজনের বেঁচে থাকা বা মারা যাওয়া নিয়ে লক্ষ কোটি মানুষ চিন্তিত। দূর্গপ্রাকার থেকে এবার তূর্যধ্বনি ভেসে আসে–সবকিছুই সম্রাটের প্রাত্যহিক কৃত্যানুষ্ঠানের অংশ।
মহান সম্রাট… মেহেরুন্নিসার সহসাই শীত শীত অনুভূত হওয়ায় সে শয্যায় ফিরে আসে এবং তাঁদের দেহের ওমে তখনও উষ্ণ রেশমের চাদরটা দিয়ে নিজের দেহ আবৃত করে। গত রাতে সে মুহূর্তের জন্য ইতস্তত না করে রক্ত মাংসের তৈরি একজন মানুষের কাছে নিজেকে এমন আবেগের সাথে সমর্পিত করেছিল যে সে নিজেই জানতো না তার মাঝে এমন আবেগ রয়েছে। তারা তিনবার দৈহিকভাবে মিলিত হয়েছিল, প্রতিবারই আবেগের প্রচণ্ডতা পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতাকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। কিন্তু এখন দিনের আলোয় চারপাশ অভিষিক্ত এবং তাঁর প্রেমিক মোটেই কোনো সাধারণ লোক নয় বরং একজন সম্রাট যার নিজের পছন্দের কোনো শয্যাসঙ্গিনী থাকা খুবই সম্ভব। তিনি কেন তাকে ডেকে পাঠালেন? কাবুলে তাকে প্রথমবার দেখার পর থেকে কাটার মত তাকে বিব্রত করতে থাকা একটা বাসনাকে প্রশমিত করতে? কেবলই কৌতূহল?
তাঁর কি আশা করা উচিত? মাঝে মাঝে সম্রাটের শয্যাসঙ্গিণী হবার নিয়তি মেনে নেয়া? তার উপপত্নীর মর্যাদা লাভ করা? তিনি সম্ভবত বাসনা চরিতার্থ করার পরে তার সম্পর্কে আর আগ্রহ প্রদর্শন করবেন না। তার চেয়ে দশ বছরের ছোট কোনো মেয়েকে তিনি অনায়াসে শয্যাসঙ্গিনী করতে পারেন… আধঘন্টা পরে জাহাঙ্গীর যখন ফিরে আসে তখনও সে এই বিষয়টা নিয়েই আকাশ কুসুম ভেবে চলেছে। তিনি ইতিমধ্যেই গোসল করে নিয়েছেন–তাঁর মুখের চারপাশে ভেজা চুলের কালো গোছ ঝুলে আছে। সে আগেই যেমন লক্ষ্য করেছে তার অভিব্যক্তি আন্দাজ করা খুবই কঠিন।
‘সম্রাট, আমি কি এবার হেরেমে ফিরে যাবো? সে জানতে চায়, রাতের অন্ধকারে যে লোকটার বাহুলগ্না হয়ে তার সম্পূর্ণভাবে নিজেকে যার সমকক্ষ মনে হয়েছে তাঁর কাছ থেকে চলে যাবার আদেশ শোনবার চেয়ে প্রশ্নটা সে ইচ্ছে করে নিজেই করে।
‘হ্যাঁ।
মেহেরুন্নিসা নিজের সাবলীল পা দুটো এক ঝটকায় শয্যার উপর দিয়ে ঘুরিয়ে আনে এবং ঝুঁকে নিজের হলুদ রঙের আলখাল্লাটা তুলে নেয়। জাহাঙ্গীর তার পেছনে এসে দাঁড়ায়। সে স্তনবৃন্তে তার হাতের আর ঘাড়ের কাছে তার ঠোঁটের উপস্থিতি অনুভব করে। সে তারপরে তাকে এক ঝটকায় তুলে নেয় এবং তাকে ঘুরিয়ে নিয়ে তার মুখোমুখি দাঁড়াতে বাধ্য করে।
‘তুমি কিছুই বুঝতে পার নি, সে বলে, আর আমি নিজেও ঠিক নিশ্চিত নই যে আমিও পুরোপুরি বুঝেছি…’
‘জাহাপনা?’
‘গত রাতে তোমায় এখানে ডেকে পাঠানোটা কিন্তু আমার খেয়াল ছিল না। কাবুলে তোমায় প্রথম দেখার মুহূর্ত থেকেই আমি তোমায় কামনা করেছি এবং তোমায় নিয়ে আমার ভাবনা কখনও থেমে থাকেনি। আমি যখন জানতে পারলাম আমার বিরুদ্ধে একটা ষড়যন্ত্রে তোমার পরিবারকে মিথ্যা জড়ানো হয়েছে আমি তখন ভয় পেয়েছিলাম ঘটনাটা হয়তো চিরতরে তোমায় আমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নেবে। একজন সম্রাট কখনও অসন্তোষ… রাজবৈরীতাকে প্রশ্রয় দিতে পারে না, উচিত নয়। তাঁর শক্তিশালী চোয়াল দৃঢ়ভাবে চেপে বসে। তুমি যখন আমার সাথে দেখা করার অনুমতির জন্য রীতিমত অনুনয় করেছিলে তখনও আমি জানতাম না তুমি আসলে ঠিক কি অনুরোধ করবে। গিয়াস বেগের ব্যাপারটা খুব একটা জটিল ছিল না। আমি তোমায় তখনই বলেছিলাম আমি ততক্ষণে বিশ্বাস করেছি যে তিনি নির্দোষ। সে যাই হোক, তুমি সাহসিকতার সাথে তাঁর পক্ষাবলম্বন করেছিলে যখন তুমি জানতে যে আমি তাকে ইতিমধ্যে দোষী সাব্যস্ত করেছি। কিন্তু তোমার ভাই মীর খানের বিষয়ে তোমার আচরণ আমাকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করেছিল। আমি জানি পরিবারের ভিতরে একজন বিশ্বাসঘাতক থাকলে নিজের কাছে কেমন লাগে…’ তিনি কথাটা শেষ না করে খানিকটা নির্দয় ভঙ্গিতে হাসেন, ‘আমি জানি পরিবারের প্রতি ভালোবাসার টান প্রশমিত করাটা কত কঠিন। সেটা করবার মত সামর্থ্য তোমার রয়েছে–আমি তোমার ভাইয়ের প্রাণদণ্ড কার্যকর করছি তুমি প্রত্যক্ষ করেছে যাতে করে তোমার পরিবারের বাকি সমস্যরা বাঁচবার একটা সুযোগ পায়।
তিনি তাঁর থুতনি উপরের দিকে কাত করে তার মুখের দিকে কঠোর দৃষ্টিতে তাকালে মেহেরুন্নিসার চোখের কোণে কান্নার রেশ জমতে শুরু করে।
‘আমার দাদাজান হুমায়ুন নিজের জীবনসঙ্গিনী হামিদার মাঝে আত্মার আত্মীয়কে খুঁজে পেয়েছিলেন। আমার মনে হয় আমি তোমার মাঝেই যাকে খুঁজছি পেয়েছি। আমি তোমায় আমার সম্রাজ্ঞী করতে চাই এবং আমার সব স্ত্রীদের প্রধান। আমার বিরুদ্ধে নিজ পুত্রের বিদ্রোহ দমন করা শেষ হলেই আমরা বিয়ে করবো_যদি তুমি আমায় গ্রহণ করতে সম্মত হও।
‘আমি অন্য কারো কথা চিন্তাই করতে পারি না। সে টের পায় তিনি পরম মমতায় তাঁর অশ্রু মুছিয়ে দিচ্ছেন।
কিন্তু আমি তোমায় আরো একটা কথা বলতে চাই। আমি যদি কথাটা না বলি তাহলে আমি নিজের কাছেই ছোট হয়ে যাব। তোমার স্বামী শের আফগানকে আমার নির্দেশেই হত্যা করা হয়েছিল। আমিই আগ্রা থেকে গৌড়ে একজন আততায়ী প্রেরণ করেছিলাম তাকে হত্যা করতে।’
মেহেরুন্নিসা চমকে উঠে, সে আরো একবার সেই ধুসর নীল চোখ দুটো নিজের মানস পটে ভেসে উঠতে দেখে। খুনী কি একজন ফিরিঙ্গি ছিল?
‘হা। তার নাম বার্থোলোমিউ হকিন্স। সে এখন আমার দেহরক্ষীদের একজন। আমি তাকে হত্যা করার পরেই কেবল জানতে পেরেছি যে তোমার স্বামী অসংখ্য অপরাধে অপরাধী ছিল–উৎকোচ গ্রহণ, নিষ্ঠুরতা, হুমকি প্রদর্শন করে অর্থ আদায়–কিন্তু তাকে হত্যা করার সময়ে আমি এসব কিছুই জানতাম না। আমি তাকে হত্যা করার আদেশ দিয়েছিলাম কারণ সে আমার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মেহেরুন্নিসা… তুমি কি পারবে আমায় ক্ষমা করতে?
মেহেরুন্নিসা তাঁর আঙুলের অগ্রভাগ জাহাঙ্গীরের ঠোঁটে পরম আবেগে স্থাপন করে। কোনো কিছু বলার কোনো দরকার নেই আর আমার ক্ষমা করার প্রশ্নই উঠে না। আমি শের আফগানকে ঘৃণা করতাম। সে আমার সাথে ভীষণ নিষ্ঠুর আচরণ করতো। আমি তার হাত থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছি বলে আমি কৃতজ্ঞ।
‘তাহলে আমাদের মিলনের মাঝে আর কোনো বাঁধাই রইল না। জাহাঙ্গীর মাথা নুইয়ে এনে মেহেরুন্নিসাকে লম্বা আর আবেগঘন একটা চুম্বন দেয়।
*
পরিচারকের দল তাঁর ব্যক্তিগত দর্শনার্থী কক্ষে তাঁর প্রবেশের জন্য প্রবেশ পথের পর্দা দুপাশে সরিয়ে ধরতে, জাহাঙ্গীর ইয়ার মোহাম্মদের চওড়া কাঠামোটা দেখতে পায়, তাঁর সদ্য নিযুক্ত গোয়ালিওরের শাসনকর্তা। ইয়ার মোহাম্মদ, জাহাঙ্গীরকে দেখা মাত্র, মধ্য এশিয়ায় অবস্থিত নিজ মাতৃভূমিতে প্রচলিত অভিবাদন জানাবার ঐতিহ্যবাহী রীতি অনুসারে নিজেকে সামনের দিকে নিক্ষেপ করে, শ্ৰদ্ধাপ্রকাশের জন্য হাত শরীরের দু’পাশে প্রসারিত করে অধোমুখে মাটিতে প্রণত হয়।
‘ইয়ার মোহাম্মদ, ওঠো। আমার বিরুদ্ধে আমার বিশ্বাসঘাতক ছেলের সাথে মিলিত হয়ে যারা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল তুমি কি তাদের হাত থেকে পৃথিবীকে মুক্তি দিয়েছো?
‘জাঁহাপনা, আমি বিশ্বাস করি, আমি তাঁদের সবাইকে সনাক্ত করতে আর তাদের সবার সাথে হিসাব চূড়ান্ত করতে সক্ষম হয়েছি। আপনার আদেশ অনুসারে, যারা অপরাধ স্বীকার করেছিল জল্লাদের তরবারির নিচে আমি তাদের দ্রুত আর সহজ মৃত্যু দান করেছি। সাদ আজিজ নামে একজনই কেবল তপ্ত লাল লোহার দ্বারা নির্যাতন করার পরেও নিজের দোষ স্বীকার করতে অস্বীকার করেছিল। আমার মনে হয় তার ধারণা ছিল সে চালাকি করে আমাদের পরাস্ত করতে এবং বিচার এড়িয়ে যেতে পারবে কিন্তু অন্য একজন ষড়যন্ত্রকারীকে যখন মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন সে সাদ আজিজের লেখা একটা চিঠি আমাকে দেখিয়েছিল– আমার মনে হয় মৃত্যুর পূর্বে সে নিজের বিবেকের কাছে পরিষ্কার থাকতে চেয়েছে। সাদ আজিজ সেই চিঠিতে যুবরাজ খসরুকে সমর্থন করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। আমি যখন চিঠিটা নিয়ে তার মুখোমুখি হয় সে ঔদ্ধত্যের চরমে পৌঁছে দাবি করে যে চিঠিটা জাল।
বিশ্বাসঘাতকতা পুরষ্কার সম্বন্ধে সবার সম্যক ধারণা থাকা উচিত বিবেচনা করে আমি তৃণভূমি এলাকায় প্রচলিত প্রাচীন মোগল শাস্তির একটা তাকে দেই, গোয়ালিওর দূর্গের নিচে অবস্থিত বিশাল কুচকাওয়াজ ময়দানে আমি সেনাছাউনি আর শহরের লোকদের সমবেত হবার আদেশ দেই। তোরণগৃহ থেকে দামামার বাদ্যের সাথে আমি সাদ আজিজের চার হাত পায়ের সাথে শক্ত করে বুনো স্ট্যালিয়ন বাঁধার আদেশ দেই। প্রহরীরা ঘোড়ার লাগাম ছেড়ে দেয় এবং চাবুকের আঘাতের বল্পা চালে ঘোড়াগুলোকে ছুটতে বাধ্য করে যাতে করে সাদ আজিজের চার হাত পা তার দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আসে। আমি তাঁর চার হাত পা দূর্গের চারটা প্রবেশ পথের প্রতিটায় একটা করে স্থাপন করি আর তার দেহ আর মস্তক বাজারে প্রদর্শন করার জন্য রাখা হয়।
ইয়ার মোহাম্মদের বাম গালের সীসা-রঙের ভয়ঙ্কর ক্ষতচিহ্ন বিশিষ্ট সরু মুখটা ভাবলেশহীন দেখায় যখন সে তার কার্যবিবরণী পেশ করে। জাহাঙ্গীর এক মুহূর্তের জন্য তাঁর নিযুক্ত শাসনকর্তার নিষ্ঠুরতার বিষয়ে নিজের কাছেই প্রশ্ন করে কিন্তু সে যা করেছে সেটা করার এক্তিয়ার তার রয়েছে। সাদ আজিজকে দোষ স্বীকার করার যথেষ্ট সুযোগ দেয়া হয়েছিল। তার যন্ত্রণাদায়ক আর লজ্জাজনক মৃত্যু দেখে যদি অন্যরা বিদ্রোহের ভাবনা থেকে নিজেদের বিরত রাখে তাহলে কাজটা যুক্তিযুক্ত হয়েছে। বস্তুত পক্ষে একটা বিষয় জেনে তাঁর ভালো লাগে যে মাত্র তিনমাসের ভিতরে সে তার সন্তানের বিদ্রোহ প্রচেষ্টা পুরোপুরি নস্যাৎ করতে সক্ষম হয়েছে। এরপরেও অবশ্য পরবর্তী প্রশ্ন জিজ্ঞেস করাটা তার জন্য খুব কঠিন হয়।
“আর যুবরাজ খসরু?
‘আপনি ঠিক যেমন আদেশ দিয়েছিলেন ঠিক সেভাবেই শাস্তি কার্যকর করা হয়েছে। আপনার প্রেরিত হেকিম, যিনি বাস্তবিকই এসব বিষয়ে ভীষণ দক্ষ, প্রথমেই যন্ত্রণা লাঘব করার জন্য তাকে আফিম দিয়েছিল। তারপরে আমার চারজন শক্তিশালী সৈন্য তাকে মাটিতে চেপে ধরে এবং পঞ্চমজন তাঁর মাথাটা শক্ত করে ধরে রাখে যাতে নড়াচড়া করতে না পারে যখন হেকিম রেশমের মজবুত সুতো দিয়ে তার চোখের পাতা একসাথে শক্ত করে সেলাই করে দেয়। যুবরাজ তার চারপাশের পৃথিবীর কিছুই দেখতে পাবেন না এবং জাহাপনা আপনার আর আপনার সাম্রাজ্যের শান্তির জন্য তিনি এখন আর কোনো হুমকি নন।
জাহাঙ্গীরের কাছে ভাবতে খারাপই লাগে যে তাঁর সুদর্শন আর প্রাণবন্ত ছেলেটার এমন পরিণতি হয়েছে কিন্তু সে নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দেয় যে সে নিজেই এই পরিণতি ডেকে এনেছে। অন্ধ করে দেয়াটা মোগলদের আরেকটা ঐতিহ্যবাহী শাস্তি দেয়ার পদ্ধতি যা তাদের সাথেই মধ্য এশিয়া থেকে হিন্দুস্তানে এসেছে। একজন শাসক এই পদ্ধতির আশ্রয় নিয়ে নিজের পরিবারের অবাধ্য সদস্যদের হত্যা না করে তাদের নিষ্ক্রিয় করতে পারেন। তাঁর উজির মজিদ খান তাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল যে এভাবেই তার দাদাজান হুমায়ুন নিজের সৎ-ভাইদের ভিতরে সবচেয়ে দুর্দমনীয়, কামরানের সমস্যার সমাধান করেছিল। জাহাঙ্গীর বিষয়টা নিয়ে যতই চিন্তা করেছে ততই তাঁর কাছে মনে হয়েছে এটাই সবচেয়ে উপযুক্ত শাস্তি হতে পারে। কামরানের ক্ষেত্রে তার চোখের মণিতে সুই দিয়ে এঁফোড় ওফোঁড় করার পরে তাতে লবণ আর লেবু ঘষে দিয়ে চিরতরে তাঁর দৃষ্টিশক্তি নষ্ট করে দেয়া হয়েছিল। খসরুর চোখের পাতা কেবল সেলাই করে দেয়া হয়েছে, তার সন্তান যদি কোনোদিন সত্যিই নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয় সে তখন তাহলে হেকিমকে আবার তাঁর চোখের পাতা খুলে দেয়ার আদেশ দিবে।
জাহাঙ্গীর সহসা একটা শব্দ শুনে ঘুরে দাঁড়িয়ে কক্ষের প্রবেশ পথে সন্ত্রস্ত দর্শণ এক কর্চিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে।
‘জাহাপনা-’ সে বলতে শুরু করে, কিন্তু মাঝপথেই থেমে যায়।
‘আমি আদেশ দিয়েছিলাম যে আমাকে যেন কোনোভাবেই বিরক্ত করা না হয়, আমি ইয়ার মোহাম্মদের সাথে একা আলাপ করতে চাই।’ জাহাঙ্গীর ক্রুদ্ধ চোখে অল্পবয়সী ছেলেটার দিকে তাকিয়ে থাকে।
‘আমি হেরেম থেকে একটা জরুরি সংবাদ নিয়ে এসেছি।’
‘সেটা কি?’ জাহাঙ্গীর ভাবতে গিয়ে সহসাই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠে, মেহেরুন্নিসার কি কিছু হয়েছে।
‘মহামান্য সম্রাজ্ঞী, মান বাঈ। তাঁর পরিচারিকা তাকে তার বিয়ের পোষাকে নিজের শয্যায় শায়িত অবস্থায় খুঁজে পেয়েছে। তাঁর শয্যার পাশে আফিম মিশ্রিত পানির একটা বোতল পড়ে ছিল। তাঁদের ধারণা তিনি মাত্রাতিরিক্ত সেবন করেছেন–বোতলে কেবল তলানি পড়ে ছিল।
জাহাঙ্গীরের মনটা করুণার সাথে সাথে বিরক্তিতে ছেয়ে যায়। মান বাঈ সবসময়েই অস্থিরপ্রকৃতির কখনও কখনও উন্মত্ত, এবং তার প্রথম স্ত্রী হবার কারণে একটা সময়ে সে পরবর্তীতে যাদের বিয়ে করেছে তাদের পাগলের মত ঈর্ষা করতো। সে একাধিকবার নিজের ক্ষতি করার চেষ্টা করে তার মনোযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছে। সে নিশ্চয়ই তার সন্তান খসরুর অন্ধত্বের কথা শুনেছে। গোয়ালিওর থেকে ইয়ার মোহাম্মদের সাথে আগত পরিচারিকাদের একজন নিশ্চয়ই শাস্তির কথা আলোচনা করেছে এবং খবর দ্রুত দেখা যাচ্ছে বেশ তড়িৎ গতিতে ছড়িয়েছে। নিজের সন্তানের প্রতি মান বাঈয়ের অন্ধ স্নেহের কারণে তিনি সবসময়ে ছেলের অপরাধের গুরুত্ব অস্বীকার করেছেন। তিনি সবসময়ে তাকে অবাধ্য, একটু বেশিমাত্রায় প্রাণবন্ত হিসাবেই দেখেছেন। খসরুর উচ্চাশার রক্তলোলুপ গভীরতা এবং সেটা অর্জন করার জন্য সে কত কিছু করতে পারে, তিনি কখনও বোঝার চেষ্টা করেন নি। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে তিনি জাহাঙ্গীরের কাছে বারবার অনুরোধ করেছেন খসরুকে ক্ষমা করতে, কখনও আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছেন কখনওবা কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। আফিম সেবন সম্ভবত সংবাদটা পাবার পরে তাঁর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া–শোক আর প্রতিবাদের অভিব্যক্তি। কিন্তু খসরুকে অন্ধ করে দিয়ে তিনি যেমন সন্তুষ্ট বোধ করেন নি তেমনি ব্যাপারটা নিয়ে তার ভিতরে কোনো ধরনের আক্ষেপও নেই। ষড়যন্ত্র দমনে শাস্তি প্রদান করা না হলে, বিশৃঙ্খলার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে। ‘আমি এখনই যাচ্ছি। ইয়ার মোহাম্মদ আমায় মার্জনা করবেন, সে কথাটা বলেই দ্রুত কক্ষ থেকে বের হয়ে আসে।
হেরেমে মান বাঈয়ের কক্ষের কাছাকাছি পৌঁছাতে, সহসা সে বিলাপধ্বনি শুনতে পায়। সে ভিতরে প্রবেশ করতে, একহাত প্রসারিত করে, ডিভানের উপর নিখুঁতভাবে শুয়ে থাকা একটা আকৃতির চারপাশে তার রাজপুত পরিচারিকাদের জটলা করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। তাঁর প্রথম স্ত্রী মৃত্যুবরণ করেছে এটা জানার জন্য জাহাঙ্গীরকে কারো সাথে কোনো কথা বলতে হয় না।
সে কিছুক্ষণের জন্য স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, তাঁর মনে সন্দেহ, মর্মপীড়া আর আত্মনিন্দার একটা ঝড় বইতে থাকে। সে তাকে প্রথমবার যখন দেখেছিল সেই মান বাঈয়ের স্মৃতি-তরুণী এবং তাকে তার অশুভ সত্ত্বা দখল করার আগে ভালোবাসা আর বেঁচে থাকার জন্য কাঙাল-হুহু করে তার চোখের সামনে ভেসে উঠে। সে একটা সময়ে তাকে পছন্দই করতে এবং কখনও তার ক্ষতি চায় নি, এমন নির্মম মৃত্যুর প্রশ্নই উঠে না। তাঁর চোখের কোণে অশ্রুবিন্দু টলটল করতে থাকে, কিন্তু সে চোখ মুছে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। তার আত্মহত্যায় তাকে কোনোভাবেই দায়ী করা যাবে না। খসরু নিজের জীবনের সাথে সাথে আরও অনেকের জীবনই ধ্বংস করেছে, এবং সে, একমাত্র সেই নিজের হঠকারীতা আর স্বার্থপর উচ্চাশার দ্বারা নিজের মায়ের মৃত্যুর কারণ হয়েছে। জাহাঙ্গীরের মুখের অভিব্যক্তি কঠোর হয়ে উঠে। সে আর কখনও নিজের পরিবারের কোনো সদস্যকে সুযোগ দেবে না তার রাজতুকে হুমকির সম্মুখীন করে বা তার সাম্রাজ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে।
‘অন্তেষ্টিক্রিয়ার জন্য চিতা নির্মাণের আদেশ দাও। মান বাঈকে তাঁর হিন্দু ধর্ম অনুসারে দাহ করা হবে কিন্তু সেই সাথে সম্রাটের স্ত্রী হিসাবে তাকে তার প্রাপ্য সম্মান দেখান হবে, সে গম্ভীরভাবে বলে এবং তারপরে একটা কথা না বলে কামরা থেকে বের হয়ে যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়ায়।
১.০৮ ‘প্রাসাদের নূর’
জাহাঙ্গীর তাঁদের বিয়ের পরের দিন সকালে অলসভাবে আড়মোড়া ভাঙে তারপরে তার পাশে নিরাভরণ হয়ে শুয়ে থাকা মেহেরুন্নিসার দিকে মাথা ঘুরিয়ে তাকায়। তাঁর ত্বকের মুক্তোর মত আভা দেখে তার দিকে আড়াআড়িভাবে ঘুরে থাকা তার কোমর স্পর্শ করতে তাঁর খুব ইচ্ছা হয় কিন্তু সে তার ঘুম ভাঙাতে চায় না। ঘুমন্ত অবস্থায় তাঁর নিটোল স্তনের উঠা নামা, পুরু ঐ ঠোঁট, ছোট খাড়া নাক আর চওড়া ভ্রু যুগল দেখতে তার ভালোই লাগে। সে নিশ্চিত, তার কমনীয় মুখশ্রী দেখতে তার ভিতরে কখনও বিরক্তি উদ্রেক হবে না। সে নিশ্চিত, দ্বিতীয়বারের মত খসরুর বিদ্রোহ প্রচেষ্টা দমন আর মান বাঈয়ের মৃত্যুর ঠিক পরপরই, তাদের বিয়েটা অবশ্যই তার জীবন আর তাঁর রাজত্বকালের একটা নতুন সূচনার স্মারক হয়ে থাকবে। সে তার নিজের এবং তাঁর সাম্রাজ্যের জন্য যত স্বপ্ন দেখেছে সবকিছু সে তাকে পাশে নিয়ে সফল করবে।
মেহেরুন্নিসা সহসাই তার বড় বড় চোখ দুটো খুলে সরাসরি তার দিকে তাকায়।
‘তোমার কাছে আমি একটা ওয়াদা করতে চাই,’ সে বলে।
‘সেটা কি?
‘সেটা হল যে আমি আর কখনও বিয়ে করবো না। আমার যদিও আরও অনেক স্ত্রী রয়েছে কিন্তু তুমিই হবে আমার শেষ স্ত্রী। মেহেরুন্নিসা তাকে চুম্বন করার জন্য সামনের দিকে ঝুঁকে আসে কিন্তু নিজের অভিপ্রায়ে সফল হবার আগে সে বলতেই থাকে, দাঁড়াও মেয়ে আমার আরও কিছু বলার আছে। আমাদের বিয়ে স্মরণীয় করতে দরবারে আজ থেকে সবাই তোমায় নূর মহল হিসাবে জানবে।’
মেহেরুন্নিসা উঠে বসে। নূর মহল মানে প্রাসাদের আলো। এটা একটা বিশাল সম্মানের…’
‘আমার রক্ষিতাদের মত কথা বলো না, যাদের মুখে মুখ আর অন্তরে অভিলাষ আর ছলনা। সে এমনভাবে তাকায় যেন সে ভেবেছিল তিনি তাঁর সাথে ঠাট্টা করছেন কিন্তু তিনি মোটেই ঠাট্টা করছেন না এবং বলতে থাকেন, তার কণ্ঠস্বর গম্ভীর, তোমার কৃতজ্ঞতা আমি চাই না। এই উপাধিটা আমি পছন্দ করেছি কারণ তুমি আমার জীবনে আলোকচ্ছটা বয়ে এনেছো। তোমার জন্য দরবারের একজন অলঙ্কার প্রস্তুতকারী তোমার নতুন নামযুক্ত একটা সীলমোহর প্রস্তুত করছে–হাতির দাঁতের উপর পান্নাখচিত… এটা আমার হৃদয়ে এবং আমার দরবারে তুমি যে স্থান দখল করে রেখেছো সেটা প্রকাশ করবে। কিন্তু আমার কাছে তুমি সবসময়ে মেহেরুন্নিসাই থাকবে। আমার এখনও মনে আছে আমার মরহুম আব্বাজানের দর্শনার্থী কক্ষের একটা স্তম্ভের পেছনে দাঁড়িয়ে আমি তোমার আব্বাজানকে পারস্য থেকে তার যাত্রার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে শুনছি–কেমন করে, তুমি ভূমিষ্ঠ হবার প্রায় সাথে সাথে, তিনি এমন বেপরোয়া পরিস্থিতির ভিতরে ছিলেন যে তোমায় তিনি পরিত্যাগ করেছিলেন, এবং কীভাবে বৈরী আবহাওয়া আর নেকড়ের মুখে তোমায় ফেলে যাবার ভাবনা সহ্য করতে না পেরে তোমার জন্য আবার ফিরে এসেছিলেন… আমার কাছে তখন মনে হয়েছিল যদিও আমি তখন কেবলই একজন বালক যে অদৃষ্ট তোমার জীবনে একটা ভূমিকা পালন করেছে। অদৃষ্ট আমার পরিবারেও ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করে। আমার প্রপিতামহ বিশ্বাস করতেন যে এখানে এই হিন্দুস্তানে একটা সাম্রাজ্যের সন্ধান পাওয়া তাঁর অদৃষ্টে রয়েছে। আমার আর আমার সন্তানদের অদৃষ্ট উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সেই সাম্রাজ্যের উন্নতি বিধান করা।
‘আমি আপনাকে সাহায্য করবো, মেহেরুন্নিসা বলে, প্রতিটা শব্দ সে আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করে। নিয়তি তাকে প্রভাব আর প্রতিপত্তি লাভের একটা সুযোগ দান করেছে তার মত খুব মেয়েই যা লাভ করে এবং সে সুযোগটা হাতছাড়া করবে না।
জাহাঙ্গীর উঠে বসে এবং কাঁধের উপর থেকে নিজের কালো চুল আঁকিয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে হাসে, তার নগ্ন অবয়বের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ হতে তাঁর মেজাজ আরো একবার হাল্কা হয়ে উঠে। এটা আমাদের বাসর রাতের শয্যা। আমি গম্ভীর বিষয় নিয়ে বড় বেশি কথা বলছি। আমরা এখন কেবল একজন নববিবাহিত পুরুষ আর নববধূ, আর আমি এখন কেবল তোমার সাথে আবারও মিলিত হতে চাই।
মেহেরুন্নিসা তাঁর দিকে দু’বাহু বাড়িয়ে দেয়।
*
সাল্লা চিরুনি দিয়ে তার লম্বা চুল আঁচড়ে দেবার সময় মেহেরুন্নিসা তাঁর চোখ বন্ধ করে রাখে। সে আর্মেনিয়ান মেয়েটাকে তাঁর সঙ্গিনী করতে সমর্থ হওয়ায় সে খুব খুশি হয়েছি কিন্তু মালার হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবার চেয়ে সন্তুষ্টিজনক আর কিছুই হতে পারে না। তার বিয়ের তিন সপ্তাহ পরে যমুনা নদী দেখা যায় এমন একটা বুরুজে নিজের নতুন আর বিলাসবহুল আবাসন এলাকায়–যেখানে একসময় জাহাঙ্গীরের দাদিজান হামিদা বাস করতেন–সে খাজাসারাকে ডেকে পাঠায়।
‘তুমি যেভাবে রয়েছে ঠিক সেভাবেই বিদায় নেবে। সবকিছু রেখে যাবে, মেহেরুন্নিসা, মালা তাকে যা বলেছিল ঠিক সেই শব্দগুলোই পুনরাবৃত্তি করে, তাকে বলেছিল। খাজাসারা শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
‘কিন্তু আপনি আমাকে বরখাস্ত করতে পারেন না। আমি আমার দায়িত্ব সততা আর বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ থেকে পালন করেছি।’
‘তুমি তোমার ক্ষমতা বড্ড বেশি উপভোগ করো।
খাজাসারার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠে। সে প্রত্যুত্তরে কিছু একটা বলবে বলে মনে হয় কিন্তু বুঝতে পারে সেটা বলাটা মোটেই বুদ্ধিমানের মত কাজ হবে না এবং মাথা ঝাঁকিয়ে সে চলে যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়ায়।
‘তুমি কিছু একটা ভুলে যাচ্ছো।
মালা থমকে যায় এবং সে যখন তার মাথা ঘুরিয়ে পুনরায় মেহেরুন্নিসার দিকে তাকায় দেখে যে তার চোখ ক্রোধের অশ্রুতে চিকচিক করছে। ‘মহামান্য সম্রাজ্ঞী, সেটা কি?
“তোমার কর্তৃত্বের দণ্ড।
মেহেরুন্নিসা বিয়ের অনুষ্ঠানের সময় মেহেদি রঞ্জিত হাত বাড়িয়ে দেয়, এবং মালা অনিচ্ছা সত্ত্বেও হাতির দাঁতের কারুকাজ করা দণ্ডটা তাঁর দিকে এগিয়ে দেয় তার স্পর্শের কারণে সেটা তখনও উষ্ণ হয়ে রয়েছে।
‘মালকিন–এই জুঁই ফুলগুলি আমি কি আপনার চুলে গেঁথে দেবো? সাল্লা তার আবলুস কাঠের তৈরি চিরুনি বাতাসে আন্দোলিত করে জানতে চায়।
মেহেরুন্নিসা মাথা নাড়ে। সাল্লার চপল আঙুলগুলো নিজেদের কাজে ব্যস্ত হয়ে উঠতে সে আরো অনেক আনন্দময় স্মৃতির মাঝে নিজের মনকে হারিয়ে যেতে দেয়। জাহাঙ্গীরের সাথে তার বিয়ের রাতটা শের আফগানের সাথে তার যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল সেটা থেকে কতই না আলাদা প্রকৃতির। তাঁর তখন অনেক অল্প বয়স, অনেক অনভিজ্ঞ, বিশেষ করে পুরুষরা যা পছন্দ করে। শের আফগানের কাছে কেবল নিজের সন্তুষ্টিই মূখ্য ছিল। জাহাঙ্গীর একজন কুশলী প্রেমিক কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা সে তার প্রতিটা প্রণয়স্পর্শের মাঝে তার ভালোবাসার আবেগ অনুভব করতে পারে। সে প্রতিদিনই তাকে উপহার পাঠায় এবং তাকে বলে, তোমার যদি কিছু পছন্দ হয় তুমি কেবল মুখ ফুটে সেটা বলবে আর সেটা তোমার হবে। একজন সম্রাজ্ঞী হিসাবে, তার ভাবতে ভালোই লাগে, শ্রেষ্ঠ সবকিছু সে চাইলেই পেতে পারে। সে এই জাঁকালো দরবারে নিজের অবস্থানের যথাযথ প্রয়োগ করতে পারবে।
কিন্তু কি হবে সেই অবস্থান? জাহাঙ্গীর মনেপ্রাণে যা কামনা করে সেই আত্মার আত্মীয় সে কীভাবে হবে? সে হুমায়ুন আর হামিদার মাঝে বিদ্যমান আন্তরিক সম্পর্কের কথা বলেছে। তার কাছে হুমায়ুন আর হামিদা কেবল দুটি নাম, কিন্তু তাকে তাদের ব্যাপারে আরও অনেক কিছু জানতে হবে, জাহাঙ্গীর তাকে যেভাবে কামনা করে তাকে চেষ্টা করতে হবে সেভাবে নিজেকে পরিবর্তিত করতে আর তার মাঝে দিয়েই সে নিজের অস্থির আকাঙ্খা আর উচ্চাশাগুলো পূরণ করতে পারবে। সবচেয়ে বড় কথা তাঁর প্রতি তাঁর ভালোবাসা যেন বজায় থাকে। সেটা ছাড়া আর কিছুরই কোনো মূল্য নেই…।
তার জন্য–এবং তাঁর পরিবারের জন্য এই মুহূর্তে সম্ভাবনাগুলো-অসীম বলে প্রতিয়মান হয়। জাহাঙ্গীর তার আব্বাজানকে রাজকীয় কোষাধ্যক্ষ হিসাবেই কেবল পূর্নবহাল করেন নি সেই সাথে নতুন অনেক খেতাবে তাকে ভূষিত করেছেন যার ভিতরে রয়েছে ইতিমাদ-উদ-দৌলা উপাধি, যার মানে সাম্রাজ্যের স্তম্ভ। খুররমের সাথে আরজুমান্দের বিয়ের ব্যাপারে সে অচিরেই উদ্যোগ নেবে কিন্তু কোনো তাড়াহুড়ো করতে যাবে না… কেউ যেন বলতে না পারে যে নতুন সম্রাজ্ঞী অধিষ্ঠিত হতে না হতেই তিনি নিজের পরিবারের সমৃদ্ধির জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন। হেরেমে যদিও সবাই এখন তার সাথে শ্রদ্ধাপূর্ণ আচরণ করে, সে জানে জাহাঙ্গীরের সাথে তার বিয়ের ফলে নিশ্চিতভাবেই অনেকেই নারাজ হয়েছে। জাহাঙ্গীরের অন্যান্য স্ত্রীদের মত তার জন্ম কোনো অভিজাত বংশে হয় নি। খুররমের আম্মিজান, যোধা বাঈ, একজন রাজপুত রাজকুমারী, অন্যদিকে তাঁর বড়ভাই পারভেজের আম্মিজান, সাহিব জামালের জন্ম প্রাচীন এক মোগল অভিজাত বংশে। তাঁদের সাথে এখন পর্যন্ত তাঁর কেবল একবারই দেখা হয়েছে–উভয়েই তাঁর আবাসিক এলাকায় সৌজন্যমূলক দেখা করতে এসেছিল–সে তখন তাদের আনুষ্ঠানিক শিষ্টাচার আর রসিকতার নিচে চাপা তাচ্ছিল্য আর সতর্কতা আঁচ করতে পেরেছে।
‘পারস্য থেকে তোমার আব্বাজানের কপর্দকশূন্য অবস্থায় মোগল দরবারে আগমন করাটা ছিল একটা অসাধারণ ঘটনা, মেহেরুন্নিসার দেয়া রূপার তবকযুক্ত খুবানির তশতরী থেকে একটা তুলে নেয়ার সময় যোধা বাঈ তাঁর বৃত্তাকার মুখে একটা বাঁকা হাসি ফুটিয়ে রেখে কথাটা বলে।
‘আমার আব্বাজান ছিলেন একজন অভিজাত ব্যক্তি যার নিজের দেশে অদৃষ্ট কখনও তার উপরে সদয় হয় নি। তিনি ভাগ্যবান মৃত সম্রাটের অনুগ্রহ তিনি লাভ করেছিলেন।
বস্তুতপক্ষে, তোমাদের পুরো পরিবারটাই ভাগ্যবান বলতেই হবে। যোধা বাঈয়ের মুখের হাসি একটু যেন টানটান হয়ে উঠে।
‘সেটা সত্যি কথা, অবশ্য এসব কিছুই আল্লাহতা’লার মেহেরবানি, মানুষের এতে কোনো হাত নেই, মেহেরুন্নিসা প্রত্যুত্তরে বলে এবং খুররমের সুন্দর চেহারার প্রশংসা করে আলোচনার মোড় খুররমের দিকে ঘুরিয়ে দেয়।
যোধা বাঈ, একজন মমতাময়ী আর সন্তানগর্বে গর্বিত মা হবার কারণে খানিকটা নমনীয় হন, কিন্তু তারপরেই সরাসরি মেহেরুন্নিসার চোখের দিকে তাকিয়ে বলেন, এটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ যে আমার সন্তান যেন ভালো কোনো বংশে বিয়ে করে। তার ধমনীতে একই সাথে মোগল রাজবংশ আর ক্ষমতাবান রাজপুত গোত্রের রক্ত বইছে।
মেহেরুন্নিসা শিষ্টাচার বজায় রেখে সম্মতি জানায় কিন্তু সে ঠিকই বুঝতে পারে যোধা বাঈ আসলে কি বোঝাতে চেয়েছে–আরজুমান্দকে বিয়ের ব্যাপারে খুররমের আকাঙ্খ সে সমর্থন করে না। সে এখন বিয়েটাকে পরিণতির দিকে এগিয়ে নেয়ার জন্য আরো অনেক বেশি সংকল্পবদ্ধ।
পারভেজের আম্মিজান তুলনামূলকভাবে মৃদুভাষী। সাহিব জামালের ঘন পাপড়িযুক্ত কালো চোখের মণিতে মেহেরুন্নিসা এক ধরনের উদ্ধত কৌতূহল লক্ষ্য করে, যদিও সে অনেক কম প্রশ্ন করে। সে কেবল নিজের আর নিজের পরিবার সম্পর্কে তাঁর পূর্বপুরুষেরা কীভাবে বাবরের সাথে তাঁর হিন্দুস্তান অভিযানে অংশ নিয়েছিল–কেবল সেই কথাই বয়ান করে। সে একটা বিষয় পরিষ্কার বুঝিয়ে দেয় যে মেহেরুন্নিসা তাঁর কাছ থেকে সামান্যতম ঘনিষ্ঠতা প্রত্যাশা না করলেই ভালো। আমি নিরূপদ্রব, নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করি, সাহিব জামাল বিড়বিড় করে বলে। আমার স্বাস্থ্য খুবই নাজুক আর সঙ্গত কারণেই আমার বন্ধুবান্ধবের সংখ্যা খুবই সীমিত।
তাদের এই বিদ্বেষের কিছুটা অবশ্য অল্পবয়স্কা, সুন্দর মুখশ্রীর অধিকারী প্রতিপক্ষের প্রতি যৌবনের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যাওয়া দু’জন রমণীর স্বাভাবিক ঈর্ষা। মেহেরুন্নিসা নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে নিজেই হেসে ফেলে। সে জুই ফুলের প্রতিমূর্তি হয়ে উঠেছে…সে কোনোমতেই তাদের বৈরীতাকে দ্বারা নিজেকে প্রভাবিত হতে দেবে না এবং সে ইতিমধ্যে ইয়াসমিনার, জাহাঙ্গীরের সবচেয়ে কনিষ্ঠ সন্তান শাহরিয়ারের উপপত্নী মাতা, সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপন করেছে। সে ছেলেটাকে যতটুকু দেখেছে তাতে তাঁর মনে হয়েছে দেখতে অস্বাভাবিক রকমের সুদর্শন হলেও, অতিরিক্ত প্রশ্রয়ের কারণে ছিচকাদুনে হয়ে উঠেছে এবং যখনই কোনো কিছু তার মনঃপুত হবে সে সোজা দৌড়ে গিয়ে মায়ের কাছে নালিশ জানাবে–যদি তাঁর শিক্ষকদের কথা বিশ্বাস করতে হয় এবং সেইসাথে পড়ালেখায় ভীষণ দুর্বল। তাকে হেরেম থেকে সরিয়ে নিয়ে এবার আলাদা থাকবার বন্দোবস্ত করতে হবে। কিন্তু ইয়াসমিনাকে সে এসব কিছুই বলেনি, স্পষ্টতই ছেলের প্রতি তাঁর প্রবল ভালোবাসা।
সাল্লা তার চুল বাঁধা শেষ করতে, মেহেরুন্নিসা তার আলখাল্লার নিচে লাল মখমলের ময়ানে আবদ্ধ ইস্পাতের হালকা খঞ্জরটার অস্তিত্ব অনুভব করে যা সে পোষাকে নিচে লুকিয়ে রেখেছে। ফাতিমা বেগমের সাথে অবস্থান করার সময় সে নাদিয়ার কাছে হেরেমের অনেক ঝগড়া আর ঈর্ষার কাহিনী শুনেছে। এক অল্পবয়স্ক সুশ্রী রক্ষিতাকে নিয়ে একটা গল্প রয়েছে যাকে তাঁর প্রতিপক্ষ এক খোঁজাকে উৎকোচ দিয়ে পাথুরে বারান্দা থেকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেয়ায় তাঁর মৃত্যু হয়েছিল। আকবরের এক অল্পবয়স্কা স্ত্রীকে নিয়ে অন্য আরেকটা গল্প প্রচলিত রয়েছে যার খাবারে তার এক শত্রু কাঁচের গুড়ো মিশিয়ে দেয়ায় যন্ত্রণায় চিৎকার করতে করতে বেচারীর মৃত্যু হয়েছিল। না, খঞ্জর বহন করাকে কোনোভাবেই বাড়াবাড়ি বলা যাবে না বা বাস্তবিক পক্ষেই খাদ্য পরীক্ষক হিসাবে কাউকে নিয়োগ দেয়া যার কাজ হবে বিয়ের উপহার হিসাবে প্রাপ্ত মিষ্টান্ন আর ফলমূল পরীক্ষা করা যা এখনও প্রতিদিন অজস্র পরিমাণে আসছে। অবশ্য সে যখন জাহাঙ্গীরের সাথে আহার করে তখন সে নিরাপদ। সম্রাটের খাদ্য প্রস্তুতকে কেন্দ্র করে বিশদ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়ে থাকে, যার ভিতরে রয়েছে বাদশাহী রাধুনিদের পরিহিত বিশেষ ধরনের খাটো হাতার আলখাল্লা থাকে যাতে করে সবসময়ে তাঁদের হাত দৃশ্যমান থাকে যাতে করে জাহাঙ্গীরের টেবিলে খাবারের পাত্রগুলো বয়ে নিয়ে যাবার আগে রসুইখানায় খাবারের পাত্র বহনকারীদের চোখের সামনে ময়দার লেই দিয়ে সেগুলোর মুখ বন্ধ করার সময় তারা খাবারে বিষের গুড়ো মিশিয়ে দেয়ার চেষ্টা করতে না পারে। সে যখন একা থাকবে বিপদের সম্ভাবনা তখনই আর তাকে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে।
*
মেহেরুন্নিসা, আধঘন্টা পরে উঁচু-চূড়াযুক্ত একটা রূপালী হাওদায় উপবিষ্ট অবস্থায় আগ্রা দূর্গের ঢালু পথ দিয়ে নিচে নেমে আসবার সময়, উত্তেজনা আর গভীর সন্তুষ্টির একটা যুগপত অনুভূতিতে জারিত হয়। বাঘ শিকারে জাহাঙ্গীরের সাথে যোগ দেয়ার জন্য সে যখন প্রথমবার প্রস্তাব করেছিল, জাহাঙ্গীরের চোখে মুখে নিখাদ বিস্ময়ের ছাপ ফুটে উঠেছিল। কোনো রাজকীয় মোগল রমণী এমন কিছু আগে কখনও করে নি, সে কোনোমতে তাকে বলে।
‘কিন্তু কেন নয়? আমি কেন প্রথম হতে পারি না? আমার পক্ষে যতখানি সম্ভব আমি আপনার সঙ্গী হতে এবং আপনার সাথে আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে চাই। আর তাছাড়া, ব্যাপারটা আমার কাছে দারুণ উত্তেজক বলে মনে হয়েছে।’
‘আমি বিষয়টা ভেবে দেখবো, তিনি তাকে বলেন, কিন্তু সে নিশ্চিত বুঝতে পারে তার অনুরোধ তাকে কৌতূহলী করে তুলেছে। জাহাঙ্গীর পরের দিন তাকে হাতির দাঁতের আর আবলুস কাঠের কারুকাজ করা বাটযুক্ত অবিকল দেখতে একজোড়া মাস্কেট উপহার দেয় এবং তাকে বলে যে সে তার শিকারের জন্য এই বিশেষ হাওদা নির্মাণের নির্দেশ দিয়েছেন। হাওদাটার চারদিকে প্রশস্ত খোলা জায়গা রয়েছে এবং তাকে মানুষের দৃষ্টির আড়ালে রাখতে যদিও পাতলা কাপড়ের পর্দার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে পর্দাগুলো বড় বড় পিতলের আংটা থেকে ঝোলানো হয়েছে এবং শিকারের সঙ্কটপূর্ণ মুহূর্তে তাকে তার অস্ত্র তাক করার সুযোগ দিতে সেগুলোকে দ্রুত একপাশে টেনে সরিয়ে দেয়া সম্ভব।
মেহেরুন্নিসা বন্দুক ছোঁড়া মকশো করার সময় জাহাঙ্গীর তার প্রশিক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। তিনি শিকারের সময় নিজের হাতির পিঠে সওয়ার হয়ে পর্দা ঘেরা হাওদায় তার সাথে অবস্থানের সিদ্ধান্ত নেয়ায় বিষয়টা তার আনন্দ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। তাদের পেছনে হেরেমের দু’জন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত খোঁজা বসে রয়েছে যারা যত দ্রুত সম্ভব তাদের শিকারের মাস্কেট গুলি ভর্তি করতে সক্ষম।
‘তোমায় উৎফুল্ল দেখাচ্ছে। জাহাঙ্গীরের ঠোঁট তার গলার পাশে আলতো করে ছোঁয়া দিয়ে যায়।
‘আমি আসলেই খুশি। আজ আমি জীবনের প্রথম শিকার করতে সংকল্পবদ্ধ।
‘আমাদের ভাগ্য হয়ত প্রসন্ন নাও হতে পারে। আজ সকালে আমার শিকারীরা বাঘের যে দলটাকে দেখেছিল তারা হয়ত ইতিমধ্যে অন্যত্র সরে গিয়েছে।
প্রথমে মনে হতে থাকে যে জাহাঙ্গীরের কথাই বোধ হয় ফলতে চলেছে। তাঁদের সামনে দুলকি চালে ছুটতে থাকা শিকারীর দল বাঘের দলটার কোনো নিশানাই খুঁজে পায় না। আগ্রা ত্যাগ করার প্রায় তিনঘন্টা পরে জাহাঙ্গীর হয়তো ফিরে যাবার আদেশ দিতো কিন্তু মেহেরুন্নিসা ব্যাকুল কণ্ঠে অনুরোধ করে, আরেকটু। অনুগ্রহ করে আরেকটু এগিয়ে গিয়ে দেখি। দেখেন, আজ সকালে যে পাহাড়ের কাছে বাঘের দলটা দেখা গিয়েছিল আমরা প্রায় তার কাছে পৌঁছে গিয়েছি…’
জাহাঙ্গীর তার ব্যগ্রতা দেখে মুচকি হাসে। বেশ, দেখা যাক।
প্রথম দর্শনে গুটিকয়েক কণ্টকযুক্ত ঝোঁপ বিশিষ্ট বালিয়াড়ি-সদৃশ্য প্রান্তর দেখে খুব একটা সম্ভাবনাময় বলে মনে হয় না। বাঘের জন্য এখানে পর্যাপ্ত আড়াল নেই। কিন্তু তারপরেই হঠাৎ পায়ের নিচের মাটি কয়েকটা বিশাল ধুসর রঙের পাথরের দিকে উঠতে শুরু করেছে যার মাঝে তেঁতুল গাছ জন্মায়। তাঁদের বহনকারী হাতিটা সহসাই দাঁড়িয়ে পড়ে এবং জাহাঙ্গীর শিকারীর কথা শোনার জন্য হাওদা থেকে নিচে ঝুঁকে আসে।
‘তাঁরা তাজা পায়ের ছাপ খুঁজে পেয়েছে। তাঁরা সাথে করে নিয়ে আসা ছাগলের একটা মৃতদেহ পাথরের কাছে রাখতে চলেছে, জাহাঙ্গীর কিছুক্ষণ পরে ফিসফিস করে বলে। আমরা এখানে বাতাসের স্রোতের দিকে অপেক্ষা করবো।’
সময় অতিবাহিত হবার সাথে সাথে বাতাসের মৃদুমন্দ প্রবাহ তেঁতুল গাছের মাঝে একটা আলোড়ন সৃষ্টি করে কিন্তু আর কোথাও কোনো শব্দ বা নড়াচড়া দৃষ্টিগোচর হয় না। মেহেরুন্নিসা এরপরেই একটা তীব্র, কস্তরীবৎ গন্ধ পায় এবং জাহাঙ্গীর আরও একবার ফিসফিস করে বলে, তারা আসছেন… চেয়ে দেখো… দু’জন, পাথরের ভিতরে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
মাস্কেটগুলো আমাদের হাতে দাও এবং মোম লাগানো সুতোয় আগুন জ্বেলে প্রস্তুত রাখো, সে খোঁজা দু’জনকে আদেশ দেয় এবং এক ঝটকায় হাওদার পর্দা সরিয়ে দেয়। মেহেরুন্নিসা দ্রুত ভারসাম্যের জন্য হাওদার প্রান্তে নিজের অস্ত্রের কারুকাজ করা লম্বা ইস্পাতের ব্যারেল আলম্বিত করে এবং পলিতার পাতলা ক্ষুদ্র দৈর্ঘ্য পরীক্ষা করে। তারপরে, জাহাঙ্গীর তাকে যেভাবে শিখিয়েছে সেভাবে সামনের দিকে অবনত হয়ে, সে ব্যারেল বরাবর তির্যকদৃষ্টিতে তাকায়। পাথরের আড়াল থেকে নিশ্চিতভাবেই এইমাত্র দুটো কালো আর কমলা রঙের আকৃতি বের হয়ে এসেছে। বাঘ দুটো, নিজেদের পিঠের অতিকায় চেটালো অস্থির মাঝে মাথা নিচু করে রেখে, ধীরে এবং সতর্কতার সাথে মৃত ছাগলটার দিকে এগিয়ে আসছে। সে জ্বলন্ত মোমের সুতার জন্য পেছনের দিকে হাত বাড়াতে যাবে তখনই জাহাঙ্গীর বলে, না, এখন নয়। তুমি যদি তাড়াহুড়ো করো তাহলে তুমি হয়তো তাদের ভয় পাইয়ে দেবে।
নিজের কানের ভেতর রক্তের দবদব শব্দ শুনতে শুনতে অপেক্ষা করাটা রীতিমত অত্যাচার মনে হয়। বাঘ দুটো ইতিমধ্যে ছাগলের মৃতদেহটার কাছে পৌঁছে গিয়েছে এবং তারা মাংসের ভিতরে নিজেদের দাঁত বসাবার সাথে সাথে সে টের পায় তাঁদের সতর্কতায় একটা ঢিলেমী এসেছে।
‘এখন!’ জাহাঙ্গীর বলে। তুমি ডানপাশের বাঘটাকে নিশানা করো। আমি বাম পাশেরটাকে সামলাচ্ছি।’
মেহেরুন্নিসা তার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা খোঁজাটার কাছ থেকে মোম দেয়া জ্বলন্ত সুতাটা নিয়ে সে তার লক্ষ্যবস্তুর চওড়া বুকে জমে থাকা ছাগলের রক্ত নিশানা করে। সে গুলি করার সাথে সাথে আকষ্মিক তীক্ষ্ণ একটা শব্দ শুনতে পায়, এবং তারপরেই তাঁর গুলিবিদ্ধ বাঘটা একপাশে কাত হয়ে পড়ে যায়, জন্তুটার সাদা গলা তাজা লাল রক্তে ক্রমশ লাল হয়ে উঠে। জাহাঙ্গীরের গুলি করা বাঘটাও প্রায় একই সময়ে বিকট একটা গর্জন করে হুড়মুড় করে মাটিতে আছড়ে পড়ে এবং কিছু সময় থরথর করে কাঁপার পরে নিশ্চল হয়ে পড়ে থাকে, গোলাপি আর কালচে রঙের জীহ্বা জন্তুটার আধ খোলা মুখ থেকে বের হয়ে থাকে। নতুন এক ধরনের আন্ত্রিক রোমাঞ্চ মেহেরুন্নিসার ভিতর দিয়ে বিদ্যুৎ চমকের মত বয়ে যায়। জ্বলজ্বলে চোখে এবং ঠোঁট ভাঁজ করে সে জাহাঙ্গীরের দিকে ঘুরে তাকায়।
তাঁদের বহনকারী হাতির পেছন থেকে ঠিক সেই সময়ে উচ্চ স্বরগ্রামের একটা প্রলম্বিত চিৎকার ভেসে আসে এবং পিঙ্গল বর্ণের মাদী ঘোড়ায় উপবিষ্ট এক তরুণ কর্চি মাস্কেটের শব্দে আতঙ্কিত হয়ে তাঁদের পাশ দিয়ে দ্বিগ্বিদিক শূন্য হয়ে ঘোড়া হাঁকায়। তাঁদের হাতিটা আতঙ্কিত হয়ে শুড় উঁচু করে এবং পা নাড়ায় কিন্তু মাহুত কোনোমতে তাকে শান্ত করে। কনুই আর গোড়ালী উন্মত্তের ন্যায় ঝাপটাতে ঝাপটাতে তরুণ অশ্বারোহী বৃথাই লাগাম টেনে ধরতে চেষ্টা করে। হতভাগ্য লোকটাকে নিজের ঘোটকীর মাথার উপর দিয়ে নিখুঁতভাবে সামনের দিকে মৃত বাঘ দুটোর কয়েক গজের ভিতরে আছড়ে পড়ে সেখানেই বিমূঢ়ভাবে শুয়ে থাকতে দেখে মেহেরুন্নিসা আরেকটু হলেই হেসে ফেলেছিল। মেহেরুন্নিসাকে সহসাই সহজাত একটা প্রবৃত্তি অধোমুখ হয়ে পড়ে থাকা তরুণের বদলে উপরে পাথরের দিকে তাকাতে বলে। কালো আর কমলা রঙের কিছু একটা সেখানে নড়াচড়া করছে। ‘আমার অন্য মাস্কেটটা দাও-জলদি!’ হাতে ধরা মাস্কেটটা ফেলে দিয়ে সে খোঁজার হাত থেকে নতুন আরেকটা নেয় এবং দ্রুত দু’বার নড়িয়ে হাওদার প্রান্তদেশে সেটা স্থাপণ করে এবং পাথরের দিকে ব্যারেলটা তাক করে। বাঘটা যখন নিচে পড়ে থাকা পরিচারক যুবককে লক্ষ্য করে, যে তখনও মাটিতে পড়ে রয়েছে, বিশাল একটা বক্ররেখায় লাফ দিতে বোঝা যায় এটা আগের দুটোর চেয়েও বিশালদেহী মেহেরুন্নিসা একেবারে সময়মত নিশানা স্থির করে। সে গুলি চালায়। সে তাড়াহুড়োর কারণে নিজেকে ঠিকমত অবলম্বন প্রদান করতে ভুলে গিয়েছিল এবং মাস্কেটটা থেকে গুলিবর্ষণের সময়ের পশ্চাদাভিঘাত তাকে পিছনের দিকে ছিটকে ফেলে দেয়। সে টলমল করে কোনোমতে উঠে দাঁড়িয়ে দেখে বাঘটা পরিচারক ছেলেটার দেহের উপরে, যে এই মুহূর্তে নিজেকে প্রাণপনে মুক্ত করতে চেষ্টা করছে, আড়াআড়িভাবে পড়ে রয়েছে।
দারুণ নিশানাভেদ। তুমি ঠিক আছে তো?’ জাহাঙ্গীর জানতে চায়। জোরে শ্বাস নিতে নিতে সে মাথা নাড়ে। আমায় তুমি সবসময়ে বিস্মিত করো।’ তিনি মেহেরুন্নিসার দিকে নিখাদ প্রশংসার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। আমার চেয়েও দ্রুত তোমার প্রতিক্রিয়ার গতি।
‘বাঘটা একটা হুমকি ছিল। আমি সহজাত প্রবৃত্তির বশে যা করার করেছি।’
‘বাঘের বদলে যদি একটা লোক থাকতো তাহলেও কি তুমি গুলি চালাতে? হ্যাঁ, যদি সে আমার শত্রু হয়… বা আপনার, তাহলে কেন নয়।
*
খুররম তার হবু-স্ত্রীর এই চিত্রকর্মটা উপহার হিসাবে পেয়ে খুশিই হবে, জাহাঙ্গীর প্রতিকৃতিটা খুটিয়ে অবেক্ষণ করার সময় মনে মনে চিন্তা করে যা মুসক খান, তাঁর দরবারের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিত্রকর, তাঁর ব্যক্তিগত আবাসন কক্ষে কারুকাজ করা রোজউডের একটা কাঠামোর উপর সাজিয়ে রেখেছে। ইংল্যান্ড নামে বহুদূরের একটা ছোট রাজ্যের শাসক সম্প্রতি দরবারে কিছু উপহার প্রেরণ করেছেন যার ভিতরে তার নিজের আর তার পরিবারের প্রতিকৃতিও রয়েছে। তাঁদের আঁটসাঁট পোষাক আর উঁচু-চূড়াযুক্ত এবং পালকশোভিত ঢেউ-খেলান প্রান্তযুক্ত টুপিতে যদিও তাদের দেখতে অদ্ভুত লাগলেও, তার চারপাশে যারা রয়েছে তাঁদের প্রতিকৃতি ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলার ধারণাটা জাহাঙ্গীরের পছন্দ হয়েছে এবং সে বেশ কয়েকটা প্রতিকৃতি তৈরীর নির্দেশ দিয়েছে। মোল্লারা ব্যাপারটা পছন্দ করে নি, তাদের দাবি মনুষ্য সৃষ্টি এমন প্রতিকৃতি স্রষ্ঠার দৃষ্টিতে তাঁর প্রতি কটাক্ষপূর্ণ, কিন্তু তাকে তুষ্ট করতে উদ্গ্রীব কিছু অমাত্যের দল, এখন আবার পাগড়ির অলঙ্কার হিসাবে নিজেদের সম্রাটের প্রতিকৃতির অলঙ্কৃত অনুচিত্র পরিধান করতে আরম্ভ করেছে।
আরজুমান্দের মুখাবয়ব যত্নের সাথে পর্যবেক্ষণ করে, জাহাঙ্গীর মেহেরুন্নিসার সাথে একটা সাদৃশ্য খুঁজে পায়, যদিও তাঁর কাছে মনে হয় তাঁর স্ত্রীর মুখাবয়বে বিদ্যমান ঐশ্বরিক সৌন্দর্য এখানে অনুপস্থিত যা তাঁদের বিয়ের ছয় মাস পরে তাকে এখনও ক্রমাগতভাবে মুগ্ধ করছে। মেহেরুন্নিসার সাথে সে নিজেকে সম্পূর্ণ বোধ করে যেমনটা সে আগে কখনও অনুভব করে নি। তাঁর ভালোবাসা তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে। মেহেরুন্নিসা যে কেবল তার মানসিক স্থিতি বুঝতে পারে তাই নয় সে সেটা পরিবর্তনও করতে সক্ষম। সে যদি কখনও বিষণবোধ করে তাহলে সে তাকে হাসাতে পারে। সে যদি কোনো কারণে উদ্বিগ্ন হয় সে। তখন সুন্দর কথা বলেই কেবল তার দুশ্চিন্তা প্রশমিত করে না সেই সাথে বাস্তবসম্মত বিচক্ষণ পরামর্শও দেয়–কখনও কোনো কিছুতেই উত্তেজিত হয় না এবং সবসময়েই প্রাসঙ্গিক। সে তার উজির মাজিদ খান এবং মন্ত্রিপরিষদের বাকি সদস্যদের সাথে সাথে তার পরামর্শ শোনার জন্যও প্রায় সমান সময় ব্যয় করে, যাদের কথা থেকে তাকে ব্যক্তিগত স্বার্থ প্রণোদিত বক্তব্য থেকে বিজ্ঞ জনোচিত পরামর্শ আলাদা করতে হয়। এক মাসের ভিতরে সে তার পরামর্শ অনুযায়ী আরজুমান্দ বানুর সাথে তাঁর সন্তান খুররমের বিয়ের অনুমতি প্রদান করবে। যোধা বাঈ তাকে বোঝাতে চেয়েছিল যে বিয়েটা মোটেই পাল্টাপাল্টি ঘরে হচ্ছে না কিন্তু তার সংকল্প লক্ষ্য করে সে তার বেশি কিছু বলেনি।
সে ইতিমধ্যে দিনও ঠিক করে ফেলেছে–১০ মে, ১৬১২, তাঁর জ্যোতিষীরা তাকে নিশ্চয়তা দিয়েছে দিনটা নববিবাহিত দম্পতির সর্বাত্মক শান্তি নিশ্চিত করবে। মোগল দরবারে এখন পর্যন্ত যা প্রত্যক্ষ করেছে তাঁর ভিতরে সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ বিয়ের অনুষ্ঠান আয়োজন করাই এখন কেবল তার দায়িত্ব। নিজের সন্তানের খাতিরে সে কেবল এমন আয়োজন করবে না সেই সাথে নিজের পরিবারকে এভাবে সম্মানিত হতে দেখে মেহেরুন্নিসা যে আনন্দ লাভ করবে সেটাও একটা বড় কারণ।
*
খুররম তাঁদের বাসর কক্ষে মিহি তাঁর দিয়ে তৈরি পর্দার কাছেই একাকী দাঁড়িয়ে রয়েছে, তার পরনে কেবল ব্রোকেডের সুবজ রঙের একটা আলখাল্লা যা কোমরের কাছে একটা সরু সোনার পরিকর দিয়ে বাঁধা, পর্দার পেছনে আরজুমান্দ বানুর পরিচারিকারা তাকে তাঁদের বিয়ের পূর্ণতা অর্জনের জন্য প্রস্তুত করছে। সে নিজের হাতের দিকে তাকায়, সেদিনই সকালে তার আম্মিজান সৌভাগ্যের স্মারক হিসাবে সেখানে মেহেদী আর হলুদের সাহায্যে বিভিন্ন নক্সা এঁকে দিয়েছেন। সে এখনও জ্বলজ্বলে মুক্তোর তৈরি বিয়ের তাজ পরিধান করে রয়েছে যা আব্বাজান তাঁর মাথায় বেঁধে দিয়েছিলেন, সে দূর্গ থেকে হীরক খচিত মাথার সাজ পরিহিত হাতিতে, যা গ্রীষ্মের সূর্যালোকে সাদা আগুনের মত গনগন করছে, উপবিষ্ট হয়ে আসফ খানের প্রাসাদের উদ্দেশ্যে গমনকারী বিয়ের বিশাল শোভাযাত্রাকে অনুসরণ করার জন্য রওয়ানা দেবার ঠিক আগ মুহূর্তে। তাঁর হাতির ঠিক আগেই কুচকাওয়াজ করে এগিয়ে চলেছে তূর্যবাদক আর ঢুলীর দল, পেছনে রয়েছে সোনালী তশতরীর উপরে স্তূপ হয়ে থাকা মশলা বহনকারী পরিচারকদের সারি, তারপরে খুররমের বন্ধু আর দুধ-ভাইয়েরা সবাই একই রকম দেখতে কালো স্ট্যালিয়নে উপবিষ্ট।
বিয়ের অনুষ্ঠান আর আনুষ্ঠানিকতা উদ্যাপন মনে হয় যেন শেষ হবে না–মোল্লাদের সুললিত কণ্ঠের গম্ভীর উচ্চারণ, ফিসফিস করে বিয়েতে আরজুমান্দের সম্মতি প্রদান, গোলাপজলে তাঁর হাত ধুয়ে দেয়ার কৃত্যানুষ্ঠান এবং শুভ মিলন নিশ্চিত করতে হাতলবিহীন পানপাত্র থেকে পানি পান, সবশেষে ভোজসভা আর উপহার আদানপ্রদান। চকচক করতে থাকা পর্দার পরতের আড়ালে তার পাশে বসে থাকা আরজুমান্দের দিকে সে আড়চোখে তাকায় বুঝতে চেষ্টা করে তার মনে কি ভাবনা খেলা করছে। সে শীঘ্রই অবশ্য সেটা জানতে পারবে। সে তাকে প্রায় পুরোপুরি লাভ করেছে… তার হৃৎপিণ্ড ধকধক করে এবং সে বিস্মিত হয়ে অনুধাবন করে কতটা অনিশ্চিত সে বোধ করছে, খানিকটা হয়ত বিচলিত…তার প্রত্যাশা এত বেশি যে তাঁর ভয় হয় সবকিছু বোধহয় মিলবে না। আরজুমান্দ বানুর সাথে সহবাসের অভিজ্ঞতা যদি শেষ পর্যন্ত বিশেষ কোনো দ্যোতনা লাভ না করে তাহলে কি হবে? তার আপন মা, সচরাচর যিনি হাসিখুশি থাকেন, খুব বেশি কিছু প্রত্যাশা না করার জন্য তাকে সতর্ক করে দিয়েছেন, কিন্তু সে জানে সবকিছুর পরে তাকে শেষ পর্যন্ত নিজের সহজাত প্রবৃত্তির উপরেই ভরসা রাখতে হবে। মেহেরুন্নিসাকে যোধা বাঈ অপছন্দ করেন এবং তার পরিবারের আরেকজন মহিলার সাথে নিজের ছেলের বিয়েকে তিনি স্বাভাবিক কারণে তাই স্বাগত জানাননি। আম্মিজানকে যখন বলা হয় যে মেহেরুন্নিসা জাহাঙ্গীরকে তার শক্তি আর নিঃশ্বাসের সৌরভের কারণে প্রশংসা করেছে তখন সে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে আম্মিজানকে বলতে শুনেছে যে বহুভোগ্যা একজন রমণীর পক্ষেই কেবল এমন তুলনা করা সম্ভব।
একজন পরিচারিকা অবশেষে হেঁচকা এক টানে পর্দা সরিয়ে দেয়। আরজুমান্দ গজদন্তবর্ণের রেশমের একটা তাকিয়ায় একেবারে নিরাভরণ হয়ে শুয়ে রয়েছে, তার লম্বা চুল কাঁধের উপরে খোঁপা করে বেঁধে দেয়া হয়েছে। তার দেহ সুগন্ধি তেলের কারণে মৃদু দীপ্তি ছড়ায় যা তার ত্বকে মালিশ করা হয়েছে–এই আনুষ্ঠানিকতা উদ্দেশ্য কেবল নববধূকে তার স্বামীর কাছে আকর্ষণীয় করে তোলাই নয় সেই সাথে রতিক্রিয়ার জন্য তাকে প্রস্তুত আর উত্তেজিত করে তোলা। হেরেমের পরিচারিকারা নিজেদের কাজ বেশ ভালোভাবেই সম্পন্ন করেছে। খুররম তাঁর নিটোল স্ত নযুগলের উঠা নামা, কিশমিশের মত ছোট স্তনবৃন্তের টানটান আকর্ষণ এবং তাঁর চোখের দ্যুতিময়তা লক্ষ্য করে।
‘আমাদের একা থাকতে দাও, সে পরিচারিকাদের আদেশ দেয়ার সময় ঠিকই বুঝতে পারে যে তারা তাদের পাতলা নেকাবের ভিতর দিয়ে কৌতুকপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। সে তারপরে ধীরে শয্যার দিকে এগিয়ে যায় এবং আলখাল্লার পরিকরের বাধন খুলে সেটাকে মাটিতে লুটিয়ে পড়তে দেয়। সে তাঁর নবপরিণীতা বধূর পাশে শোয়, তার খুব কাছে তাকে স্পর্শ না করে। তাকে পুরোপুরি নিজের করে পাবার আগে সে তাকে কিছু বলতে চায় যদি কথাগুলো বলার মত শব্দ সে খুঁজে পায়। সে এক কনুইয়ের উপর উঁচু হয়ে তার জ্বলজ্বল করতে থাকা চোখের মণির দিকে তাকায়। আরজুমান্দ। আমার আগামী অনাগত সময়ে যাই লেখা থাকুক আমি তোমায় ভালোবাসব এবং রক্ষা করবো। আল্লাহতালা যতদিন আমাদের একসঙ্গে থাকার ক্ষণ নির্দিষ্ট করেছেন ততক্ষণ আমার নিজের চেয়ে তোমার সুখই আমার কাছে অধিক গুরুত্বপূর্ণ হবে। আমি শপথ করে বলছি।
‘আর আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি আমি নিজেকে আপনার যোগ্য স্ত্রী হিসাবে প্রমাণ করবো। আমার আব্বাজান প্রথম যখন আমাকে বলেন যে আপনি আমাকে বিয়ে করতে আগ্রহী আমি ভয় পেয়েছিলাম… আপনার সাথে আমার যোজন ব্যবধান, আপনি এমন একটা পৃথিবীর মানুষ যা আমার কাছে একেবারেই অজানা…কিন্তু আমার চাচাজানের বিশ্বাসঘাতকতা যখন আমাদের পরিবারের জন্য অসম্মান বয়ে আনে তখনও আপনি আমায় ভুলে যাননি। আজ রাতে আমি নিজেকে আপনার কাছে নিবেদন করবো যতটা সম্পূর্ণভাবে এবং যতটা বিশ্বস্ততার সাথে একজন মেয়ের পক্ষে করা সম্ভব। তার সুন্দর মুখশ্রী প্রায় মলিন দেখায় কথাটা বলার সময়।
‘আর কথা নয়, খসরু ফিসফিস করে বলে এবং তাকে নিজের কাছে টেনে নেয়।
*
মালকিন। যুবরাজ খুররম আর তাঁর নবপরিণীতা বধূর বাসর শয্যার নিরীক্ষণ সমাপ্ত হয়েছে। বিয়ে সম্পূর্ণ হয়েছে এবং আরজুমান্দ বানু বাস্তবিকই একজন কুমারী ছিল। মেহেরুন্নিসা আর জাহাঙ্গীরের সামনে নতজানু হয়ে খুররমের হেরেমের তত্ত্বাবধায়ক কথাগুলো বলার পরে নতুন দম্পতির সন্ত নি কামনায় প্রথাগত মোনাজাত করে। দোয়া করি আল্লাহতা’লা তাঁদের যেন এত সন্তান দেন যাতে নববধূ রাজবংশের রত্নগর্ভা হিসাবে ভাস্বর হয়ে থাকে। মেহেরুন্নিসা জাহাঙ্গীরের দিকে তাকিয়ে প্রণয়মিশ্রিত হাসি হাসে। সে একজন সম্রাজ্ঞী এবং তাঁর ভাইঝি সম্রাটের প্রিয় সন্তানের স্ত্রী। ভবিষ্যত এত সম্ভাবনাময় আগে কখনও মনে হয় নি…
১.০৯ জীবন আর মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ
‘খুররম, বিবাহিত জীবনের সাথে তুমি মানিয়ে নিয়েছে।’ কথাটা সত্যি, জাহাঙ্গীর শ্বেতপাথরের দাবার ছকের দিকে তাকিয়ে মনে মনে নিজের পরবর্তী চাল নিয়ে চিন্তা করার অবসরে ভাবে। খুররমকে দেখে পরিতৃপ্ত মনে হয়। জাগতিক সবকিছুর চেয়ে তুমি ভালোবাস এমন একজন রমণীকে খুঁজে পাওয়া বেহেশতের আশীর্বাদ। সে খুবই খুশি যে তাঁর নিজের মত তাঁর সন্তানও এমন আনন্দের সন্ধান লাভ করেছে।
খুররম মৃদু হাসে কিন্তু কোনো উত্তর দেয় না। আরো কিছুক্ষণ চিন্তা করে সে তার একটা হাতিকে সামনের দিকে দুই ঘর বাড়িয়ে দেয়। জাহাঙ্গীর ছেলের চোখে মুখে ফুটে উঠা সন্তুষ্ট অভিব্যক্তি দেখে বুঝে যে তাঁর ধারণা সে একটা মোক্ষম চাল দিয়েছে। বস্তুতপক্ষে, বেটা তাঁর চালে ভুল করেছে। আর দুটো চাল এবং সে তাহলে কিস্তিমাত করবে।
‘সুখ তোমায় অসতর্ক করে তুলেছে। গত কয়েক মাস তুমি আমার কাছে দাবায় পরাজিত হও নি কিন্তু আজ রাতে তুমি হারবে। দশ মিনিট পরে খেলা শেষ হয় এবং পরাজিত আর খানিকটা হতাশ খুররম উঠে দাঁড়ায়, তাঁর ঘোড়া নিয়ে আসবার আদেশ দেবে। কিন্তু জাহাঙ্গীর মনে কিছু একটা রয়েছে সে বলতে চায়। সে ঠিক নিশ্চিত নয় আরজুমান্দের সাথে তার বিয়ের কয়েক দিনের ভিতরে এমন একটা সংবাদ শুনে তার ছেলের কি প্রতিক্রিয়া হবে এবং সে জানে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা সে এতদিন স্থগিত করে রেখেছিল। কিন্তু খুররম একজন মোগল যুবরাজ এবং তার অবশ্যই বোঝা উচিত তার আসল কর্তব্য কোথায়…
‘খুররম… তুমি বিদায় নেয়ার আগে আমি তোমায় একটা কথা বলতে চাই।’
কি আব্বাজান?”
সুস্থির হয়ে একটু বসো এবং মন দিয়ে আমি কি বলি শোন। আমি তোমায় যা বলতে যাচ্ছি সেটা আমাদের সাম্রাজ্য এবং আমাদের রাজবংশ উভয়ের জন্যেই মঙ্গলকর।’
খুররমের চোখে মুখে সহসা সতর্ক অভিব্যক্তি ফুটে উঠতে দেখে, জাহাঙ্গীর খানিকটা বিষণ্ণভাবে চিন্তা করে, কি দ্রুত একজনের মন মানসিকতা পরিবর্তিত হতে পারে। তারা কিছুক্ষণ আগেই আগ্রার নিদাঘতপ্ত রাতে পিতা পুত্রের ভূমিকায় কি চমৎকারভাবে দাবা খেলা উপভোগ করছিল। শাসক হওয়া মানে অবিরত একটা দুঃসহ বোঝা বহন করে চলা… সাধারণ মানুষ থেকে একেবারে আলাদা এবং তাঁদের কাছে একেবারে অজানা একটা চাপ সহ্য করা… কিন্তু সে নিজেকে অন্য কোনো পরিস্থিতির মাঝে কল্পনাও করতে পারে না। সে একেবারেই বাল্যকাল থেকেই, যখন সে বুঝতে শিখেছে সে কে, তখন থেকেই সে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হতে চেয়েছে। সে নিশ্চিত, খুররমও ঠিক তাই চায়। এহেন উচ্চাশার সাথে সাথে আসে রাজবংশের প্রতি একটা দায়িত্ববোধ, ব্যক্তিগত জীবনে সেটা যতই অনাকাঙ্খিত বা ধ্বংসকারী হোক। জাহাঙ্গীর গভীর একটা শ্বাস নিয়ে বলতে আরম্ভ করে।
*
আগ্রা দূর্গের নিকটে যমুনা নদীর অর্ধ বৃত্তাকার বাক বরাবর নির্মিত খুররমের হাভেলীর হেরেমের প্রাচীর বেষ্টিত উদ্যানে একটা রেশমের চাঁদোয়ার নিচে একটা লম্বা আর নিচু শয্যার উপরে স্থূপীকৃত তাকিয়ার মাঝে আরজুমান্দ শুয়ে রয়েছে। গ্রীষ্মকালের গনগনে উষ্ণ বায়ুপ্রবাহ শুরু হয়েছে। সে এখানে সেসব অস্বস্তি থেকে নিরাপদ এবং শহরে যারা কাদা বা পোড়ামাটির সাধারণ গুমোট বাড়িতে বাস করে তাদের সে মোটেই ঈর্ষা করে না। মাঝেমাঝে রান্নার আগুন থেকে নির্গত স্ফুলিঙ্গ বাতাসে ঘুরপাক খেয়ে অনেক উঁচুতে উঠে; বাড়িগুলোর শুকনো খড়ের ছাদে আগুন ধরিয়ে দেয়। তাঁর পরিচারিকা তাকে বলেছে যে তিনদিন আগে দুটো বাড়ি আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়ে ভেতরে অবস্থানরত মহিলাদের পুড়িয়ে মেরেছে যারা আগুনের লেলিহান শিখার কবল থেকে দৌড়ে বাইরে বের হয় নি পর্দা তথা শালিনতার ভয়ে।
কিন্তু মনখারাপ করা ভাবনার সময় এখন না–যখন সে উফুল্ল থাকে তখনও না। তাঁর দু’হাত নিজের মসৃণ সমতল পেটের উপর আগলে রাখার ভঙ্গিতে রাখা থাকে যেখানে নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়েছে। সে আট সপ্তাহের গর্ভবতী। খুররমের জন্য তাঁর ভালোবাসা ততটাই পরিপূর্ণ যতটা তার জন্য খুররমের ভালোবাসা। তাকে ছাড়া–সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসবার সাথে সাথে সে যে উত্তেজনা অনুভব করে সেটা ছাড়া–সে এখন আর কোনো কিছু চিন্তাও করতে পারে না এবং জানে যে নিজের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি লাভ করে সে তার কাছে আসবে। তাঁদের বিয়ের রাতে সে যদিও লাজ ছিল, আজকাল তার শারীরিক আকাঙ্খ খুররমের সাথে পাল্লা দেয়। তার আলিঙ্গনের মাঝে নিজের খুঁজে পাওয়া উদ্দামতার জন্য তাঁর লজ্জা পাওয়া উচিত কিন্তু সে তারবদলে গর্ব অনুভব করে, জানে যে তাকেও সে একই রকম আনন্দ জারিত করে।
সহসা সে হেরেমের উদ্যান থেকে প্রাসাদের আঙিনাকে পৃথককারী কাঠের উঁচু তোরণদ্বারের ওপাশে ঢালু পথ বেয়ে উঠে আসা ঘোড়ার খুরের শব্দ শুনতে পায়। খুররম সম্ভবত একটু আগেই ফিরে এসেছে। তূর্যধ্বনির একটা সংক্ষিপ্ত বাজনা তাকে আশ্বস্ত করে তার ধারণাই সঠিক। উদ্যানের দূরবর্তী প্রান্তে অবস্থিত দরজার পাল্লা খুলে গিয়ে তাকে প্রকটিত করতে, সে সাদা কালো টালি বসান পথের উপর দিয়ে তার দিকে দৌড়ে যাবার সময় সে খালি পায়ের তালুতে টালির উষ্ণতা অনুভব করতে পারে। সে তাকে আশ্লেষে জড়িয়ে ধরে কিন্তু চুম্বন না করে এমন এক অব্যক্ত আবেগে তাকে জড়িয়ে থাকে যে তার চোখে মুখে ফুটে থাকা আন্তরিক অভিব্যক্তি সত্ত্বেও সে ঠিকই বুঝতে পারে কোথাও মারাত্মক কোনো একটা ঝামেলা হয়েছে। ‘খুররম, মালিক আমার কি হয়েছে? কি ব্যাপার?’ সে তাকে আলিঙ্গন থেকে মুক্তি দিলে অবশেষে সে জানতে চায়।
‘আমি তোমায় একটা কথা বলতে চাই।’ তাঁর কণ্ঠস্বর কেমন ধারালো শোনায় কিন্তু তার অভিব্যক্তিতে সে তার জন্য ভালোবাসা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায় না। ব্যাপারটা যাই হোক না কেন নিশ্চয়ই ততটা খারাপ…
‘আমার আব্বাজান বলেছেন আমার পুনরায় বিয়ে করা উচিত।’
নাহ্…’ মাতৃত্বের সহজাত প্রবৃত্তির বশে সে নিজের উদর স্পর্শ করে। তার প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করে খুররম তাকে পুনরায় নিজের বাহুর মাঝে টেনে নেয় এবং তাকে নিজের খুব কাছে নিয়ে আসে। আরজুমান্দ…সোনা আমার… এতটা ভেঙে পড়ো না…’
‘মেয়েটা কে?
‘মোঘল সাম্রাজ্যের প্রতি সদিচ্ছার স্মারক হিসাবে রাজকুল বধূ হবার জন্য শাহের প্রেরিত এক পার্সী রাজকন্যা। আমার আব্বাজানের ধারণা তাকে প্রত্যাখান করার বোকামীর পরিচায়ক হবে।
কিন্তু খুররম আপনিই কেন? কেন পারভেজ নয়? সে আপনার চেয়ে বয়সে বড়।
‘আব্বাজানকে ঠিক এই কথাটাই আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি আমাকে বলেছেন যে তার সব সন্তানের ভিতরে তাঁর উত্তরাধিকারী হিসাবে আমিই যোগ্যতম। খসরু বিশ্বাসঘাতক, পারভেজ সুরা আর আফিমে মাত্রাতিরিক্ত রকমের আসক্ত, আর তরুণ শাহরিয়ার ভীতু আর লাজুক। তিনি বলেছেন যে আমি যদি আদতেই পরবর্তী মোগল সম্রাট হিসাবে অভিষিক্ত হই তাহলে তিনি চান আমার সিংহাসনকে যতটা সম্ভব সুরক্ষিত করতে। শাহের পরিবারের সাথে মৈত্রীর সম্বন্ধ ভবিষ্যতে সহায়তা করবে।
‘আপনি কি উত্তর দিয়েছেন?
‘আমার আর কিইবা বলার আছে? আমি একজন যুবরাজ এবং আমার আব্বাজানের উত্তরাধিকারী হতে আগ্রহী… আমার পক্ষে কেবল নিজের খেয়াল খুশিমত আচরণ করা সম্ভব নয়। আমি তাকে বলেছি যে আমার আর কাউকে স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করার আগ্রহ নেই–বলেছি যে মনে প্রাণে আমি তোমাকেই আমার স্ত্রী হিসাবে গন্য করি–কিন্তু আমি তাঁর আদেশ পালন করবো।’
আরজুমান্দ নিজেকে তাঁর আলিঙ্গণ থেকে সরিয়ে নেয়। আপনি তাকে কবে বিয়ে করবেন?
‘দরবারের জ্যোতিষী নির্দিষ্ট দিন ঠিক করবে কিন্তু যথাযথভাবে রাজকুমারীর আগ্রায় উপস্থিত হওয়া আর যৌতুকের পরিমাণ নিয়ে সম্মতিতে পৌঁছাবার জন্য প্রয়োজনীয় সময়ের কথা বিবেচনা করলে বলা যায় আগামী কয়েক মাসের আগে নয়। আমার আব্বাজান পরিকল্পনা করছেন তাকে আর তার সাথে আগত সফরসঙ্গীদের পারস্যের সীমান্তে স্বাগত জানাবার জন্য উপযুক্ত সংখ্যক রক্ষীবাহিনী প্রেরণ করবেন।’
“আর আমাকে কি জাফরি কাটা অন্তঃপটের পেছন থেকে দেখতে হবে যে বাসর শয্যার জন্য তাঁর দেহকে তেল আর সুগন্ধি সিক্ত করতে এবং মেহেদী দিয়ে পরিচারিকার দল তাঁর শরীরে আল্পনা করছে?’ আরজুমান্দের পুরো দেহ এখন থরথর করে কাঁপছে এবং সে আর পরোয়া করে না তার অশ্রু সে এখন দেখল কি না।
‘আমি আর তুমি দুজনেই হতভাগ্য। আমাদের মত অবস্থানের মানুষ জীবনে খুব কমই ভালোবাসার জন্য বিয়ে করে এবং আমার আব্বাজান ইচ্ছে করলে আমাদের বাধা দিতে পারতেন। সাম্রাজ্যের প্রতি আর তাঁর প্রতি নিজের কর্তব্য থেকে আমি কখনও বিচ্যুত হব না। কিন্তু আমি তোমায় একটা প্রতিশ্রুতি করছি–তুমিই আমার পুরো পৃথিবী। তুমি আমার মুমতাজ–এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যেকোনো রমণীর চেয়ে তুমি আমার কাছে অনন্য–তুমি সেই রমণী যাকে আমি আমার সন্তানদের জননী হিসাবে কামনা করি। এই রাজকন্যা কখনও আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হবে না, আমি শপথ করে বলছি। সে এখানে নয় অন্য আরেকটা প্রাসাদে বাস করবে। তাঁর কণ্ঠস্বর সামান্য কেঁপে যায় এবং সে তাকে হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোখ মুছতে দেখে।
খুররমের যেকোনো কথার চেয়ে তাঁর এই সামান্য অঙ্গভঙ্গিই তাকে অনেক কিছু বলে দেয়। কিন্তু আরজুমান্দের কাছে পৃথিবী সহসাই একটা খাপছাড়া জায়গা বলে মনে হয়।
*
সে আগে কখনও এমন যন্ত্রণার সাথে পরিচিত ছিল না–দু’জন ধাত্রীর তত্ত্বাবধায়নে তাঁদের কথা অনুযায়ী দায়িত্ব নিয়ে চাপ প্রয়োগের চেষ্টা করার সময় তার শরীর যে শারীরিক যন্ত্রণা সহ্য করছে কেবল সেটাই নয় এর সাথে যুক্ত হয়েছে মাত্র আধ মাইল দূরে আগ্রা দূর্গে খুররম আরেকজনকে স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করছে সেটা জানা থাকায় অবর্ণনীয় মানসিক কষ্ট। তার পুরো দেহ ঘামে জবজব করছে এবং ব্যাথায় কুঁকড়ে যাবার মাত্রা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকলেও তাঁর মাথায় কেবল একটা কথাই ঘুরছে যে জাহাঙ্গীর তার ছেলের মাথায় বিয়ের তাজ বেঁধে দিচ্ছেন আর পার্সী রাজকন্যা নেকাবের আড়ালে বসে রয়েছে। মেয়েটা যদি অপরূপ সুন্দরী হয়? খুররম কীভাবে যে মেয়েকে জীবনেও দেখেনি তাকে ভালো না বাসবার প্রতিশ্রুতি দেয়?
‘মালকিন, শুয়ে পড়ুন। সুতির ঘামে ভেজা চাদর সে যার উপরে শুয়ে ছিল শক্তিশালী হাত তাকে পুনরায় তার উপরে শুতে বাধ্য করে। সে কোনো কিছু না ভেবেই জানালার কাছে গিয়ে রাতের আকাশ চিরে উৎসবের আতশবাজি দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠে বসার চেষ্টা করেছিল। তারা যখন এসব শুরু করবে তার মানে হল যে নতুন বিয়েকে সম্পূর্ণতা দানের সময় আসন্ন…
‘আপনার শরীরকে শীথিল করতে চেষ্টা করুন। ব্যাথার জন্য অপেক্ষা করুন। ধাত্রীদের একজন তাঁর উঠে বসবার চেষ্টাকে ভুল করে সন্তান জন্ম দেয়ার জন্য শক্তি প্রয়োগের আকাঙ্খ ভেবেছে। আরজুমান্দ নিজেকে চুপ করে শুয়ে থাকতে বলে, ধাত্রীরা তাকে ঠিক যেমন করতে বলেছে।
মালকিন, এবার, চাপ দিন!
নিজের দেহের অবশিষ্ট শক্তিটুকু একত্রিত করে এবং দুপাশ থেকে ধাত্রী দুজন তার দুই কাঁধ শক্ত করে চেপে ধরে থাকলে, আরজুমান্দ তার পক্ষে যত জোরে সম্ভব চাপ দেয়। তার চারপাশের সব কিছু কেমন ঘোলাটে হয়ে যায়। সে তাকিয়ার উপরে আবার এলিয়ে পড়ে। তার কানে ভেসে আসা এই তীক্ষ্ণ স্বরের কান্না কে করছে? এই আতঙ্কিত শব্দটা কি সেই করছে? সে নিজের চোখ বন্ধ করে এবং পালকের মত নির্ভার হয়ে ভাসতে থাকার একটা অনুভূতি তাকে আচ্ছন্ন করে…
‘মালকিন…’ একটা হাত আলতো করে তাঁর কাঁধ স্পর্শ করে। সে ভাবে, নির্ঘাত ধাত্রীদের একজন হবে আর চেষ্টা করে নিজেকে সরিয়ে নিতে। কোনো লাভ হয় না–সে কিছুই করতে পারে না। যেকোনো মুহূর্তে ব্যাথাটা আবার শুরু হবে এবং তার মাঝে ব্যাথাটার সাথে লড়াই করার মত আর বিন্দুমাত্র শক্তি অবশিষ্ট নেই।
‘আমাদের একা থাকতে দাও, আরেকটা উঁচু আর পুরুষ কণ্ঠস্বর ভেসে আসে। একটা দরজা খুলে আবার বন্ধ হয়ে যায়। সে চোখ খুলে তাকায়। উল্টোদিকের দেয়ালের জানালা দিয়ে চুঁইয়ে প্রবেশ করা সকালের আলোয় প্রথমে তার দেখতে কষ্ট হয়।
‘আরজুমান্দ, তোমার কি নিজের স্বামী আর কন্যাকে কিছুই বলার নেই? খুররম চোখ ধাঁধানো আলোর মাঝ থেকে বের হয়ে আসে। তার বাহুতে কারুকাজ করা সবুজ রেশমের কাপড়ে জড়ানো একটা পোটলা। তাঁর পাশে হাঁটু মুড়ে বসে সে বাচ্চাটাকে তাঁর বাহুতে আলতো করে শুইয়ে দেয়।
*
শীতের সন্ধ্যাবেলা সূর্য যখন অস্তাচলে যেতে বসেছে এবং জাহাঙ্গীর দ্রুত তার মন্ত্রণা কক্ষের দিকে হেঁটে যাবার সময়, যমুনার পানির দিকে তাকিয়ে তার মনে হয় পানিতে বুঝি কেউ স্বর্ণকুচি মিশিয়ে দিয়েছে, জাফরশানকে সমরকন্দের দেয়ালের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া তথাকথিত স্বর্ণবাহী নদী এবং যার কথা সে তার মহান পূর্ব পুরুষ মহামতি বাবরের রোজনামচায় পড়েছে–সে ঠিক যেমন কল্পনা করেছে। মোগলদের জন্য সাম্রাজ্য জয় করতে বাবর প্রাণপণ করে যুদ্ধ করেছিলেন এবং তাদের সেখান থেকে বিতাড়িত করতে আশাবাদী এমন লোক সবসময়েই থাকবে। হিন্দুস্তানের লাল মাটিতে তাঁরা তাঁদের সবুজ নিশান প্রোথিত করার পর থেকে বহুবার তাঁদের যুদ্ধ করতে হয়েছে এবং এখন তারা আবারও সেই সম্ভাবনার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। সাম্রাজ্যের দক্ষিণ সীমান্ত থেকে প্রাপ্ত শান্তি বিঘ্নিতকারী সংবাদ পর্যালোচনার জন্য সে তার সমর উপদেষ্টাদের বৈঠক আহ্বান করেছে।
দক্ষিণে দাক্ষিণাত্যের মালভূমির ধনী মুসলিম সালতানাত–গোলকুণ্ডা এবং বিশেষ করে আহমেদনগর আর বিজাপুর–সবসময়ে চেষ্টা করেছে নিজেদের স্বাধীনতা আর তারচেয়েও বেশি প্রয়াস নিয়েছে নিজেদের ভূখণ্ডে অবস্থিত রত্নখনির প্রভূত সম্পদ প্রবলভাবে রক্ষা করতে এবং দীর্ঘকাল যাবত মোগলদের জন্য একটা সমস্যা হয়ে রয়েছে। এই রাজ্যগুলো মাঝে মাঝে যদিও পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়, কিন্তু অনেকবারই তারা সম্মিলিতভাবে তাদের অধিরাজের বিরুদ্ধে নিজেদের বাহিনী একত্রিত করেছে। তার মনে আছে আকবর তাকে বলেছিলেন কীভাবে তিনি তাদের মোগল কর্তৃত্বের অধীনে এনেছিলেন আর কীভাবে বিজাপুর এবং আহমেদনগরের শাসকেরা সহসা খাজনা পাঠাতে অস্বীকার করায়, তাদের ভূখণ্ডের কিছু অংশ দখল করার জন্য সৈন্যবাহিনী পাঠিয়ে তাঁদের তিনি ভয় দেখিয়েছিলেন।
দক্ষিণের এই রাজ্যগুলো এখন আবার মোগলদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের ঝাণ্ডা তুলেছে। শত্রুপক্ষের এবারের সেনাপতি মালিক আম্মার নামে এক অপরিচিত আবিসিনিয়ান। ক্রীতদাস হিসাবে ভারতবর্ষে আগমনের পর সে আহমেদনগরের সুলতানের অধীনে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় ক্ষমতার শিখরে উঠে আসে এবং এখন আহমেদনগর আর বিজাপুর উভয় রাজ্যের শাসকরা তাঁদের পক্ষে মোগলদের বিরুদ্ধে গুপ্ত গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনার জন্য তাকে নিয়োগ করেছে। মালিক আম্বার নিজের তুচ্ছ অবস্থান থেকে ক্ষমতার শিখরে উঠে আসায় নিশ্চিতভাবেই সংকল্প, উচ্চাশা আর চারিত্রিক দৃঢ়তার অধিকারী হবার সাথে সাথে অবশ্যই একজন চতুর আর দক্ষ যোদ্ধা। জাহাঙ্গীর ভাবে নিশ্চিতভাবেই পারভেজের চেয়ে ধূর্ত, ছয়মাস পূর্বে মালিক আম্বারের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে প্রথমবারের মত অবহিত হবার পরে বিদ্রোহ সমূলে দমন করার আদেশ দিয়ে যাকে দাক্ষিণাত্যে প্রেরণ করেছিল।
জাহাঙ্গীর তার মন্ত্রণা কক্ষে প্রবেশ করার সময় তার সেনাপতি আর উপদেষ্টারা তাকে স্বাগত জানাতে উঠে দাঁড়ালে সে তাদের প্রত্যেকের চেহারায় একায়ত অভিব্যক্তি দেখতে পায়। তাদের ভিতরে ইকবাল বেগের দীর্ঘদেহী অবয়ব, পারভেজের সাথে প্রেরিত তাঁর বয়োজ্যেষ্ঠ আধিকারিকদের অন্যতম, তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তাঁর মুখাবয়বের বলিরেখায় চরম পরিশ্রান্তির ছাপ। তাঁর একহাতে পট্টি বাঁধা আর সেটা একটা দড়ির সাহায্যে কাঁধ থেকে ঝোলানো রয়েছে। পট্টির উপরে ভেসে উঠা রক্তের ছোপ দেখে বোঝা যায় তার ক্ষতস্থান এখনও পুরোপুরি সারে নি।
‘ইকবাল বেগ, আপনার অভিযানের পুরো প্রতিবেদন আমাদের সামনে পেশ করেন, জাহাঙ্গীর বৃত্তাকারে উপবিষ্ট উপদেষ্টাদের কেন্দ্রে নিজের নির্ধারিত আসনে অধিষ্ঠিত হয়ে বলে।
‘জাহাপনা, আমি খেদের সাথে জানাচ্ছি মালিক আম্বার আমাদের বাহিনীর ললাটে দুর্ভাগ্যজনক এক পরাজয়ের কলঙ্ক এঁকে দিয়েছে। আমরা অতর্কিত আক্রমণের শিকার হয়েছি এবং আমাদের সহস্রাধিক সৈন্য নিহত হয়েছে আর ততোধিক সৈন্য আহত হয়েছে। আমরা বিশাল একটা ভূখণ্ড হারিয়েছি।’
‘আমাকে ঠিক কি ঘটেছিল বিস্তারিতভাবে খুলে বলো, জাহাঙ্গীর আদেশ দেয়, চেষ্টা করে তাঁর অনুভূত উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার কোনো লক্ষণই যেন তার অভিব্যক্তিতে প্রকাশ না পায়।
ইকবাল বেগকে, অবশ্য দৃশ্যত বিপর্যস্ত দেখায়, সে তার অক্ষত হাত দিয়ে নিজে আচকানের প্রান্তদেশ অস্বস্তির সাথে মোচড়ায় নিজের বিপর্যয়ের কাহিনী পুনরাবৃত্তি করার সময়। একদিন সকাল বেলা দাক্ষিণাত্যের পাহাড়ের মাঝে অবস্থিত সংকীর্ণ এক উপত্যকায় আমাদের অস্থায়ী ছাউনিতে আমার লোকেরা তাদের তৈরি করা রান্নার আগুনের চারপাশে জটলাবদ্ধ হয়ে অবস্থান করে, ওম পোহাচ্ছিল আর ডাল এবং চাপাটি সহযোগে যখন সকালের প্রাতরাশ করছিল ঠিক সেই সময় মালিক আম্বারের অশ্বারোহী বাহিনী অতর্কিতে আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। আপনার সন্তানের আদেশে মোতায়েন করা আমাদের গুটিকয়েক প্রহরী চৌকিকে শস্য মাড়াইয়ের কস্তুনীর সামনে পড়া তুষের ন্যায় ছত্রভঙ্গ করে তারা আমাদের শিবিরের মাঝে উন্মত্তের ন্যায় বিচরণ শুরু করে, আমরা যখন আমাদের কোষবদ্ধ অস্ত্র আর অন্যান্য উপকরণের জন্য সংবেগে ছুটোছুটি করছি বা তাদের উদ্যত তরবারি আর বর্শার ফলা তাবুর অগ্নিকুণ্ড থেকে তুলে নেয়া জ্বলন্ত কাঠের টুকরোর সাহায্যে প্রতিরোধের চেষ্টা করছি, তারা নির্বিচারে আমাদের অসংখ্য সৈন্যকে হতাহত করে।
জাহাঙ্গীর লক্ষ্য করে ইকবাল বেগ যখন তাঁর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছে তাঁর মুখ তখন অশ্রুতে ভিজে গিয়েছে। একদল অশ্বারোহী আমার পুত্র আসিফ আর তাঁর গুটিকয়েক সঙ্গীকে কয়েকটা মালবাহী শকটের কাছে কোণঠাসা করে ফেলে তারা যখন সেসব শকটে রক্ষিত সিন্দুকের অর্থ আর অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী রক্ষার আপ্রাণ চেষ্টা করছিল। সে আর তার সহযোদ্ধারা যদিও বীরত্বের সাথে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল কিন্তু তাঁরা লড়াই করছিল মাটিতে দাঁড়িয়ে আর তাঁদের সাথে ছিল কেবল তরবারি। তাঁরা অশ্বারোহীদের আহত করার জন্য তাদের কাছে যেতেই ব্যর্থ হয়। অন্যদিকে, মালিক আম্বারের একজন যোদ্ধা আসিফকে তার বর্শার ধারালো ইস্পাতের ফলায় বিদ্ধ করে। আঘাতটা তাকে হতবিহ্বল করে ফেলে, মালবাহী শকটের কাঠের কাঠামোর এতটাই গভীরে প্রোথিত হয় যে বর্শার অধিকারী সেটা সেখানেই পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়। আমি তার কাছে পৌঁছাবার পূর্বেই আসিফ মারা যায়…’ ইকবাল বেগের কণ্ঠস্বর মিলিয়ে গিয়ে ধারাবাহিত ফোঁপানিতে পরিণত হয়। জাহাঙ্গীর জানে আসিফ ছিল তার একমাত্র জীবিত সন্তান।
ইকবাল বেগ আরেকদফা কথা থামিয়ে নিজের রুমাল দিয়ে মুখ থেকে অশ্রু মোছে এবং ধীরে ধীরে আত্মসংবরণ করে, সে বলতে শুরু করে। সংগঠিত প্রতিরোধের ন্যূনতম সম্ভাবনা নাকচ করে, মালিক আম্বারের লোকেরা এরপর নিজেরা তিনটি দলে বিভক্ত হয়। প্রথম দলটা মনোনিবেশ করে আমাদের যত বেশি সংখ্যক রণহস্তী হত্যা করা যায় সেই প্রচেষ্টায়, তাঁরা জম্ভগুলোর মুখে বর্শার ফলা আমূল বিদ্ধ করে কিংবা স্রেফ তাঁদের শূড়গুলো কেটে দেয় যা ছাড়া প্রাণীগুলো বাঁচতে পারবে না। দ্বিতীয় দলটা আমার ছেলে যে মালবাহী শকটের বহর রক্ষা করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছে সেখান থেকে নগদ অর্থ আর যত বেশি সংখ্যক অন্যান্য উপকরণ তাঁরা বহন করতে পারবে সেই প্রয়াস নেয় এবং তৃতীয় দলটা আমাদের অস্থায়ী শিবিরে প্রজ্জ্বলিত অগ্নিকুণ্ড থেকে জ্বলন্ত কাঠ নিয়ে আমাদেরই শিবিরে আগুন ধরিয়ে দেয়। তারা এরপরে যেমন ঝড়ের বেগে নেমে এসেছিল ঠিক সেই দ্রুততায় ফিরে যায়। আমাদের পক্ষে হতাহতের সংখ্যা এতবেশি ছিল আর সত্যি কথা বলতে আমাদের আত্মবিশ্বাসে এমনই চিড় খেয়েছিল যে তাদের পিছু ধাওয়া করার মানসিকতাও আমাদের তখন ছিল না। আহত পশুর মত নিজেদের ক্ষতস্থান পরিচর্যা করা ছাড়া আমরা কিছুই করতে পারি নি।
‘তাঁরা এত সহজে কীভাবে আপনাদের শিবিরে হামলা করলো? জাহাঙ্গীর কঠো কণ্ঠে জানতে চায়।
‘তারা পাহাড় টপকে এসে আক্রমণ করেছিল বিশাল কোনো বাহিনীর পক্ষে যা অনতিক্রম্য বলে আমরা ধরে নিয়েছিলাম। সেনাপতি মাথা নত করে বলে। জাহাপনা, আমার স্বীকার করে লজ্জা নেই, তাঁরা আমাদের চেয়ে এলাকাটা ভালো করে চিনে।
‘আর আমার ছেলে পারভেজ?’
‘আক্রমণ যখন শুরু হয় তিনি তখনও নিজের তাবুতেই অবস্থান করছিলেন। তার দেহরক্ষী দল সর্তক আর সশস্ত্র ছিল যেমনটা তারা সবসময়েই থাকে। তারা আপনার সন্তানের তাবুর চারপাশে ভালোমতই প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। আর তাছাড়া, মালিক আম্বার সহজ লক্ষ্যবস্তুকে আক্রমণের নিশানা করেছিল। আমাদের আরও সর্তক থাকা উচিত ছিল… আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত, জাঁহাপনা।
‘আমি আপনার মনোভাব অনুধাবন করতে পারছি এবং আপনার সন্তান বিয়োগে আমিও আপনার সাথে শোকাগ্রস্থ। যা হবার হয়ে গিয়েছে। মালিক আম্বারের এই ধৃষ্টতা আর আমাদের ভূখণ্ড থেকে তাকে বিতাড়িত করার প্রতি আমাদের এখন নিজেদের সমস্ত প্রয়াস নিবদ্ধ করতে হবে। এটা কীভাবে সর্বোত্তম উপায়ে হাসিল করা সম্ভব আসুন আমরা সবাই মিলে সেটা আলোচনা করি। আমরা আগামীকাল সকালে আমাদের আলোচনা শুরু করবো।
যুদ্ধ উপদেষ্টাদের সভা শেষ হলে জাহাঙ্গীর খুররমকে অপেক্ষা করতে বলে। এই পরাজয় একটা অপমান যার অবশ্যই প্রতিশোধ নিতে হবে। আমরা যদি এটা করতে ব্যর্থ হই তাহলে আমাদের প্রতিবেশীরা এমনকি বিদ্রোহভাবাপন্ন সামন্ত রাজ্যগুলোও ব্যাপারটা থেকে প্রেরণা লাভ করতে পারে। আমি পারভেজকে ফেরত আসতে আদেশ দিচ্ছি। যুদ্ধ করার মত মন মানসিকতা তার নেই এবং ইকবাল বেগ যদিও বিষয়টা উল্লেখ করার মত অবস্থানে নেই কিন্তু আমার অন্য সেনাপতিদের কথা যদি ঠিক হয় তাহলে খুব কম সময়েই সে সংযত অবস্থায় থাকে। আমার মনে হয় শিবিরের চারপাশে যথেষ্ট সংখ্যক প্রহরী মোতায়েন আর তাঁর দেহরক্ষীরা যখন সজাগ এবং বাইরে গিয়ে শক্রর মোকাবেলা করছে তখন তার তাবুতে অনর্থক সময়ক্ষেপন উভয়ের পেছনেই তার সুরাপানের একটা ভূমিকা রয়েছে। সে অভিযানের দায়িত্ব লাভের জন্য আমার কাছে রীতিমত অনুনয় করেছিল এবং আমিও ভেবেছিলাম দায়িত্ব লাভ করলে সে নিজেকে শুধরে নিতে চেষ্টা করবে, কিন্তু আমি ভুল ভেবেছিলাম।
খুররম কোনো উত্তর দেয় না। সে আর পারভেজ যদিও কেবল দুই বছরের ছোটবড়, তাঁরা দুজনে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে বড় হয়েছে আর তাদের ভিতরে কখনও কোনো ধরনের ঘনিষ্ঠতা ছিল না। জাহাঙ্গীর আলোচনা চালিয়ে যায়, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি তার পরিবর্তে তোমায় রাজকীয় সেনাবাহিনীর সেনাপতি করে দাক্ষিণাত্যে প্রেরণ করবো। মহামান্য সম্রাজ্ঞী তাই বলেছেন এবং আমিও তার সাথে একমত যে তুমি তার চেয়ে অনেক বেশি যোগ্য। মালিক আম্বারের বিরুদ্ধে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করো এবং তখন দেখবে আরো অনেক সম্মান তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।
‘আব্বাজান, আমি আপনাকে নিরাশ করবো না, খুররম, জীবনে প্রথমবারের মত স্বাধীন নেতৃত্ব লাভের উত্তেজনা কোনোমতে গোপন করে, বলে।
‘খুশি হলাম। আজ থেকে তোমার অভিযান শুরু হওয়া পর্যন্ত–যা আমার ইচ্ছা তোমার জন্য নতুন সৈন্য আর উপকরণ প্রস্তুত হওয়া মাত্র শুরু হোক–আমি চাই যুদ্ধ উপদেষ্টাদের প্রতিটা বৈঠকে তুমি উপস্থিত থাকো।
*
আগ্রা দূর্গ থেকে নিজের হাভেলীর সদর দরজা পর্যন্ত পুরোটা পথ খুররমের তূরীয় আনন্দ বজায় থাকে, সেখানে পৌঁছে সে আরজুমান্দকে কি বলবে সেটা চিন্তা করতে গিয়ে তার আনন্দের সলিল সমাধি ঘটে। তাঁদের কন্যা জাহানারার বয়স মাত্র দুই বছর। তাদের দুজনকে এখানে রেখে যাবার চিন্তাটাই অকল্পনীয়। আর তাছাড়া আরজুমান্দ কি বলবে? কিন্তু সে এমন একটা সুযোগের জন্যই অপেক্ষা করেছিল আর তার উচিত সুযোগটা গ্রহণ করা। সে যদি আরজুমান্দের মুখোমুখি হতে না পারে তাহলে শত্রুর মোকাবেলা কীভাবে করবে? সে হেরেমের দিকে অগ্রসর হবার সময় নিজেই নিজের কাছে প্রশ্ন করে।
আরজুমান্দ বরাবরের মতই তার জন্য অপেক্ষা করছিল। আজ তাঁর পরনে নীল রঙের স্বচ্ছ পাজামা আর আঁটসাট কাচুলি যার ফলে তার তলপেট অনাবৃত, এবং তার নাভীমূলে হীরকখচিত একটা পোখরাজ জ্বলজ্বল করছে। তার মনে হয় সে বোধহয় আগে কখনও তাকে এত সুন্দরী দেখেনি, ভাবনাটা আজ এজন্যই যে সম্ভবত সে জানে যে তাঁর রূপ উপভোগের বিলাসিতা থেকে সে অচিরেই বঞ্চিত হতে চলেছে।
সে আশ্লেষে তাঁর অধর চুম্বন করে তারপরে ব্যগ্র ভঙ্গিতে তাঁর দু’হাত ধরে।
‘আরজুমান্দ। আব্বাজান আজ আমায় বিশাল এক সম্মানে ভূষিত করেছেন। তিনি আমায় দাক্ষিণাত্যের বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধমান রাজকীয় বাহিনীর অধিনায়কত্ব দান করেছেন। আমি যদি এই দায়িত্ব পালনে সফল হই তাহলে সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে তিনি সর্বসম্মক্ষে আমায় তার উত্তরাধিকার হিসাবে ঘোষণা করবেন…’।
সে কিছুক্ষণের জন্য নির্বাক হয়ে থাকে তারপরে গম্ভীর কণ্ঠে বলে, আমি আপনার জন্য গর্ব অনুভব করছি। আপনি আপনার আব্বাজানের প্রত্যাশা ছাপিয়ে যাবেন। আপনাকে কবে নাগাদ রওয়ানা দিতে হবে?
‘অচিরেই। আমার কেবল একটা বিষয়েই আক্ষেপ থাকবে… যে আমাকে আমার স্ত্রী কন্যাকে এখানে রেখে যেতে হচ্ছে।
আরজুমান্দ তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকে। আপনাকে কেন এমনটা করতে হবে?
‘আমি তোমায়–পাঁচশো মাইল কিংবা তারও বেশি পথ–যা বিপদসঙ্কুল, গরম আর অস্বস্তিকর সেখানে নিয়ে যেতে পারি না। তোমার সেখানেই থাকা উচিত যেখানে আমি জানবো যে তুমি নিরাপদে রয়েছে।’
‘খুররম, আপনি যখন বলেছিলেন আপনাকে দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে হবে–যে এটা আপনার কর্তব্য–আমি সেটা মেনে নিয়েছিলাম। আমি এখন আপনাকে বলছি যে আমি অবশ্যই আপনার সাথে যাব–কারণ সেটা আমার কর্তব্য–আর আপনার সেটা মেনে নেয়া উচিত। আমার দাদাজান আর দাদিজান পরিস্থিতি যতই বিপদসঙ্কুল হোক সবসময়ে একত্রে থেকেছেন। তাঁরা ভালো করেই জানতেন যে অন্য যেকোনো সম্ভাবনার চেয়ে তাঁদের পৃথক হওয়াটা সবচেয়ে জঘন্য পরিস্থিতির জন্ম দিতে পারে। সম্রাট আর সম্রাজ্ঞী মেহেরুন্নিসাকেই দেখেন–তাঁরা কখনও পরস্পরের কাছ থেকে পৃথক হোন না। তিনি যখন শিকারে যান এমনকি তখনও তিনি তার সাথে থাকেন। সম্রাটের চেয়ে তিনি একজন দক্ষ নিশানাবাজ আর শিকারী। তারা যখন একা থাকেন তখন তিনি তাঁর সাথে একত্রে ঘোড়ার পিঠে পর্যন্ত আরোহণ করেন। আমি নিশ্চিত তিনি যদি যুদ্ধ যাত্রা করেন তাহলে মেহেরুন্নিসাও তাঁর সঙ্গী হবেন। আমি তাহলে কেন ভিন্ন আচরণ করবো?
‘তুমি শারীরিকভাবে যথেষ্ট শক্তিশালী নও। জাহানারার জন্মের সময় তোমায় কঠিন সময় অতিবাহিত করতে হয়েছিল… তোমার এখানে থাকা উচিত যেখানে সবসময়ে সেরা হেকিম পাওয়া যাবে, তোমার আবারও গর্ভধারণ করা উচিত…’।
‘সেরা হেকিম আমাদের সাথেই যেতে পারে। খুররম আমি কাঠের পুতুল নই। আমি এখানে হারেমের স্বাচ্ছন্দ্য উপভোগ করি কিন্তু আপনার সাথে একত্রে থাকার আনন্দের সাথে এসব কিছুর তুলনাই চলে না। আমায় যদি নগ্ন পায়ে জাহানারাকে কোলে নিয়ে আপনাকে অনুসরণ করতে হয় আমি করবো আর সেটা খুশি মনেই করবো।’ সে তার কব্জি আঁকড়ে ধরে এবং খুররম তার নখের তীক্ষ্ণতা নিজের পেশীতে বেশ অনুভব করে। সে তাকে কখনও এতটা সংকল্পবদ্ধ দেখেনি, তাঁর কোমল মুখাবয়বে এখন প্রায় যুদ্ধংদেহী একটা অভিব্যক্তি।
‘আমার আব্বাজানের সম্ভবত উচিত আমার বদলে আপনাকে মালিক আম্বারের বিরুদ্ধে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রেরণ করা–আপনাকে দারুণ হিংস্র দেখাচ্ছে। সে মুচকি হাসে, আশা করে প্রত্যুত্তর দিতে গিয়ে আরজুমান্দও হেসে ফেলবে, কিন্তু তাঁর অভিব্যক্তি সামান্য শীথিলও হয় না। তার এখন কি করা উচিত? পরবর্তী সম্রাট হিসাবে নিজের যোগ্যতা প্রদর্শনের সুযোগ আব্বাজান তাকে দিয়েছেন… সে যদিও সমরবিদ্যায় প্রশিক্ষণ নিয়েছে, ঘন্টার পর ঘন্টা ওস্তাদের কাছে পূর্ববর্তী মোগল অভিযানের কৌশল অধ্যয়ন করেছে, খঞ্জর, তরবারি, গাদাবন্দুক আর গদা নিয়ে লড়াই করতে জানে কিন্তু সে পূর্বে কখনও কোনো অভিযান পরিচালনা করে নি। তার মনোনিবেশে কোনোকিছু–কোনো ব্যক্তিও–যেন বিঘ্ন ঘটাতে না পারে। সেই সাথে এটাও সত্যি আরজুমান্দকে এখানে রেখে যাবার অর্থ নিজের দেহের একটা অংশকেই নিজের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করা। সে যদি একটা বিষয়ে নিশ্চিত থাকে যে প্রতিটা দিনের শেষে সে এখানে তার জন্য প্রতিক্ষা করছে তাহলে সম্ভবত সে আরও পরিষ্কারভাবে চিন্তা করতে আরও দক্ষতার সাথে লড়াই করতে পারবে। সে নিশ্চিতভাবেই আনন্দিত হবে…
‘খুররম…’ তার নখ আরও গভীরভাবে আঁকড়ে বসে।
সবকিছুই সহসা অনেক সহজ হয়ে যায়। তাদের পরস্পরের কাছ থেকে পৃথক হতে হবে না আর সেও তাকে নিরাপদ রাখার জন্য সম্ভাব্য সবকিছুই করবে। বেশ। চলো একসাথেই যাওয়া যাক।
‘আর সবসময়েই তাই হবে। তাঁর কণ্ঠস্বর আত্মপ্রত্যয়ে গমগম করে।
১.১০ ‘পৃথিবীর অধিশ্বর’
আগ্রার সাড়ে চারশ মাইল দক্ষিণপশ্চিমে, বুরহানপুরের বেলেপাথরের তৈরি দূর্গ-প্রাসাদের সম্পূর্ণ অবয়ব প্রশস্ত তপতী নদীর শান্ত জলস্রোতে প্রতিফলিত হয়। খুররম শহরটায়-দাক্ষিণাত্যে মোগল নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহৃত–মাসখানেক পূর্বে এসেছিল এবং এখন মালিক আম্বারের বিরুদ্ধে তাঁর অভিযান শুরুর বাসনায় কৃতসংকল্প হয়ে পুনরায় শহরটা ত্যাগ করছে। চারতলা বিশিষ্ট হাতির আস্তাবল, হাতিমহল থেকে বাকান ঢালু পথ দিয়ে যূথবদ্ধ হস্তিবাহিনী একপাশে প্রসারিত হয়ে অংশত আবৃতকারী ইস্পাতের বর্মে সজ্জিত হয়ে দূর্গের পাশে অবস্থিত কুচকাওয়াজ ময়দানে সমবেত হতে শুরু করেছে। তাঁদের মাহুতেরা সেখানে জম্ভগুলোর কানের পেছনে বসে, তাদের হাতে থাকা লোহার লোহার দণ্ড দিয়ে অতিকায় প্রাণীগুলোর কানের পিছনে আলতো করে টোকা দিতে তারা হাঁটু ভেঙে বসে পড়লে অন্য সহকারীরা তাঁদের পিঠে গিল্টি করা হাওদা স্থাপন করছে। হাওদাগুলো চামড়া ফালি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা হতে খুররমের প্রধান সেনাপতিরা তাদের কর্চি আর দেহরক্ষীদের নিয়ে সেখানে চার হাত পায়ের সাহায্যে উঠে বসছে, প্রতিটা হাওদায় সাধারণত তিনজন আরোহণ করছে কিন্তু বড় হাতির ক্ষেত্রে সংখ্যাটা চার। ঘর্মাক্ত দেহে কেবলমাত্র সাদা লেঙ্গট পরিহিত অবস্থায় শ্রমিকের দল অন্য হাওদাগুলোয় ছোট ছিদ্রব্যাসের কামান, গজনল তুলছে।
সবার প্রস্তুতি সম্পন্ন শেষ হতে দূর্গের প্রধান তোরণদ্বার খুলে যায় এবং সেখান দিয়ে খুররমের নিজের রণহস্তী বাইরে বের হয়ে আসে। অন্য যেকোনো হাতির চেয়ে বৃহদাকৃতি, এর পিঠে সবুজ চাঁদোয়া বিশিষ্ট একটা হাওদা যেখানে খুররম ইতিমধ্যেই, মাথায় সোনালী গিল্টি করা শিয়োস্ত্রাণ আর ফিরোজা খচিত কারুকাজ করা ইস্পাতের বর্ম পরিহিত অবস্থায় যুদ্ধের জন্য নিখুঁতভাবে সজ্জিত হয়ে, অবস্থান গ্রহণ করেছে। আরো চারটা হাতির একটা দল তাকে অনুসরণ করে। প্রথম হাতিটার হাওদার চারপাশ কারুকাজ করা মসলিনের পর্দা সোনালী ফিতে দিয়ে শক্ত করে বাঁধা রয়েছে আরজুমান্দ বানুকে কোনো ধরনের কৌতূহলী দৃষ্টি থেকে আড়াল করতে; অবশিষ্ট তিনটা হাতির প্রতিটায় চারজন করে কমলা-পাগড়ি পরিহিত রাজপুত যোদ্ধা রয়েছে, খুররমের দেহরক্ষীদের ভিতরে সবচেয়ে বিশ্বস্ত, তার আদেশ অনুযায়ী আরজুমান্দকে যেকোনো ধরনের অপমানের হাত থেকে তারা নিজেদের প্রাণের বিনিময়ে রক্ষা করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। চৌকষভাবে অস্ত্র সজ্জিত প্রত্যেক রাজপুত যোদ্ধার সাথে সর্বাধুনিক গাদাবন্দুক ছাড়াও রয়েছে অপেক্ষাকৃত কম প্রাণঘাতি কিন্তু দ্রুত নিক্ষেপযোগ্য তীর আর ধুনক এবং অবশ্যই তরবারি। সযত্ন চর্চিত চওড়া গোফের আড়ালে তাদের মুখে কঠোর একটা অভিব্যক্তি ফুটে রয়েছে। তোরণদ্বারের পাশে সমবেত হওয়া অল্প সংখ্যক মানুষের ভীড়ে সামান্যতম ঝামেলার ইঙ্গিত পেতে, মোগল বাহিনীকে নেতৃত্ব শূন্য করতে বা তাঁদের নেতাকে তার সুন্দরী স্ত্রীর সাহচর্য বঞ্চিত করতে ওঁত পেতে থাকা সম্ভাব্য আততায়ীল সন্ধানে যাকে হয়ত মালিক আম্বার পাঠিয়েছে, তারা সতর্ক দৃষ্টিতে এখনও আবেক্ষণ করছে। সমবেত জনতার মাঝে অবশ্য কেবল ভক্তি ভরে মাথা নত করা আর খালি হাতে হাততালি দেয়া আর হাত নেড়ে বিদায় জানানোই চোখে পড়ে।
খুররম, আরজুমান্দ আর তাদের দেহরক্ষীদের বহনকারী হাতির পেছনে অন্য রণহস্তীগুলো এবার বিন্যস্ত হয়। পুরো দলটা একসাথে কাঠের মালবাহী ভারি শকটে স্থাপিত সূক্ষ কারুকাজ করা ব্রোঞ্জের কামান আর সেগুলোর সাথে ইতিমধ্যে জোয়াল দিয়ে বাঁধা ষাড়ের পালের পাশ দিয়ে ধীরে ধীরে ধূলিধূসরিত কুচকাওয়াজ ময়দান অতিক্রম করে। সবচেয়ে বড় কামানগুলো টেনে নেয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত দলগুলোয় সর্বোচ্চ সংখ্যক ত্রিশটি ষাড় রয়েছে সবগুলোর শিং মোগল বাহিনীর স্মারক সবুজ রঙে রঞ্জিত, প্রতি তিনটা পশুর জন্য রয়েছে একজন করে চাবুকধারী গাড়োয়ান যাতে কেউ নিজেদের কাজে অবহেলা করতে না পারে। কামানবাহী শকটগুলোর মাঝে মাঝে রয়েছে আট চাকাবিশিষ্ট উট বা খচ্চর বাহিত গোলা-বারুদ বহনকারী শকট, কামানের জন্য যেগুলোতে বারুদের বস্তা রয়েছে, বৃষ্টি আর আদ্রতার হাত থেকে রক্ষা করতে বাগুলো পানিনিরোধক বস্ত্র দিয়ে ভালো করে আবৃত করা রয়েছে আর বস্তাগুলোর পাশেই রয়েছে পাথরের অথবা লোহার তৈরি কামানের গোলা।
খুররম আর তাঁর সঙ্গীদের বহনকারী হাতির বহর অবশেষে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তার উৎকৃষ্ট অশ্বারোহীদের বারো জনের আড়াআড়িভাবে বিন্যস্ত একটা সেনাপুরঃসর অগ্রদলের পেছনে নির্ধারিত স্থান গ্রহণ করে এবং খুররমের আদেশে তাদের প্রত্যেকের পরনে একই ধরনের সোনালী কাপড়ের পোষাক সাথে একই কাপড় দিয়ে তৈরি পাগড়ির শীর্ষভাগে সারসের লম্বা সাদা পালক পতপত করে উড়ছে। গাঢ় বর্ণের ঘোড়া তাদের সবাইকে বহন করছে এবং তাদের বর্শার অগ্রভাগে সবুজ আর সোনালী রঙের নিশান উড়ছে। আমি একটা বিষয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত মালিক আম্বার যখন গুপ্তচর মারফত আমাদের সৈন্য সজ্জার সংবাদ জানতে পারবে, খুররম তার পাশে অবস্থানরত কর্চির উদ্দেশ্যে বলে, সে অনুধাবন করবে একজন সেনাপতি অস্ত্র আর রসদের সংস্থান ছাড়াও জনসমক্ষে নিজেদের উপস্থাপনের মত খুটিনাটি ব্যাপারেও যার মনোযোগ রয়েছে এমন একজনকে তাঁর ভয় পাওয়া উচিত। তারপরে, গর্ব আর আত্মবিশ্বাসে ভরপুর খুররম চিৎকার করে অগ্রসর হবার আদেশ দেয়। দূর্গের প্রাকার থেকে ব্রোঞ্জের তূর্য ধ্বনি ভেসে আসবার সাথে সাথে সেনাপুরঃসর অগ্রদলের মাঝ থেকে অশ্বারূঢ় তূর্যবাদকেরা প্রত্যুত্তর দেয়। তোরণগৃহ থেকে দশ ফুট পরিধির বিরাটাকৃতি নাকাড়াগুলো মন্দ্র শব্দে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেয় এবং অশ্বারোহী বাদকদলের লোকেরা ঘোড়ার পিঠের দু’পাশে ঝোলানো ঢাকে সংবদ্ধ বোল বাজাতে শুরু করলে এর সাথে সঙ্গতি রেখে সৈন্যবাহিনীর সারিগুলো ধীরে ধীরে গতিশীল হয়ে উঠে।
দক্ষিণে তপতীর বালুকাময় তীরের দিকে এবং দূর্গ থেকে দূরে বহরটা এগিয়ে যেতে শুরু করলে আরও অশ্বারোহী বাহিনী তাদের সাথে এসে যোগ দেয় আর তারপরে যোগ দেয় নিম্নমানের চলনসই পোষাক পরিহিত কিন্তু তারপরেও পর্যাপ্ত অস্ত্র সজ্জিত পদাতিক বাহিনীর সারি। এঁদের পেছনে থাকে মূল মালবাহী বহরের বিভিন্ন আকৃতির শকট। সবশেষে, যখনই কোনো সেনাবাহিনী যাত্রা আরম্ভ করে, যারা পূর্বে গমন করেছে তাঁদের বাহনের খুর থেকে উত্থিত ধুলার মাঝে কাশতে কাশতে আসে সৈন্যদের প্রয়োজনীয় সেবা করতে উদ্গ্রীব সেনাছাউনি অনুসরণকারী বিশৃঙ্খল আর উচ্ছঙ্খল জনতার একটা দল এবং অস্থায়ী ছাউনিতে তারাই মনোরঞ্জন আর বিশ্রামের সুযোগ করে দেয়। যাত্রার কারণে ক্ষয়ে যাওয়া জুতো আর নতুন পোষাক তৈরি করার জন্য বহরের সাথেই রয়েছে দর্জি আর মুচির দল। তাদের সাথে আরো রয়েছে মিষ্টান্ন বিক্রিকারী হালুইকর আর সুরা বিক্রেতা। তাদের ভিতরে রয়েছে আগুন খেকোর দল, দড়াবাজ আর জাদুকরের পাশাপাশি রয়েছে আত্মমগ্ন দরবেশের একটা দল। প্রাতিজনিক প্রবোধ আর বিমুক্তি দেয়ার জন্য সৈন্যসারির সাথে যোগ দেয় অগণিত বেশ্যা, তাঁদের সবাই দেখতে সুন্দরী বা অল্পবয়সী নয় কিন্তু একবেলার ডাল ভাতের মূল্যের বিনিময়ে তাঁরা নিজেদের দেহ বিক্রি করতে উদ্গ্রীব।
*
খুররম ছয় সপ্তাহ পরে হেরেমের নির্ধারিত তাবুতে আরজুমান্দের সাথে একই শয্যায় শুয়ে থাকা অবস্থায় সে চোখ খুলে এবং দেখে ইতিমধ্যেই তার ঘুম ভেঙেছে। সে তাকে নিজের বাহুর মাঝে আলিঙ্গণ করে, দিনের লড়াইয়ের সময়ে সাবধানতা অবলম্বনের জন্য তার কাছে মিনতি করে। সে সতর্ক থাকবে বলে তাকে প্রতিশ্রুতি দেয় এবং আশ্বস্ত করে মালিক আম্বারের বাহিনীকে দুর্বল করতে সে কেবল তাদের উপরে একটা ঝটিকা আক্রমণ পরিচালনার পরিকল্পনা করেছে, সে তাঁর উষ্ণ অধর চুম্বন করে। সে তারপরে আলতো করে নিজেকে তাঁর আলিঙ্গন থেকে মুক্ত করে এবং শয্যার কারুকাজ করা নীল পশমের আচ্ছাদনী একপাশে সরিয়ে দেয়। সে উঠে দাঁড়ায়, নিজের নগ্ন পেষল দেহে সবুজ রেশমের একটা আলখাল্লা জড়িয়ে নেয় এবং ভোরের প্রথম আলো অস্থায়ী শিবিরের চারপাশের নিচু পাহাড়ী এলাকাকে সোনালী আভায় গিলটি শুরু করার মুহূর্তে সে মাথা নিচু করে দ্রুত হেরেমের তাবু থেকে বের হয়ে আসে। ভোরের শীতল তাজা বাতাসে শ্বাস নেয়ার জন্য কয়েক মুহূর্ত থমকে দাঁড়িয়ে সে পার্শ্ববর্তী একটা তাবুর দিকে এগিয়ে যায় যেখানে তার কচিঁ যুদ্ধের উপযুক্ত পোষাকে সজ্জিত হতে তাকে সাহায্য করার জন্য অপেক্ষা করছে। খুররম দ্রুত নিজের কারুকাজ করা বক্ষস্থল রক্ষাকারী বর্ম বেঁধে নেয় এবং তাঁর গলাকে সুরক্ষিত রাখতে লোহার জালির তৈরি সঞ্জাবযুক্ত তাঁর চূড়াকৃতি শিরোস্ত্রাণ পরিধান করে। সে মশলা দিয়ে তন্দুরে ঝলসান মুরগী আর গরম দুটো নান দিয়ে দ্রুত প্রাতরাশ সমাপ্ত করে, তারপরে তার কালো ঘোড়ায় আরোহণ করে এবং যেখানে তার শ্রেষ্ঠ অশ্বারোহী যোদ্ধাদের সমন্বয়ে গঠিত প্রায় পাঁচ হাজারের একটা আক্রমণকারী বাহিনী অপেক্ষা করছে সেদিকে দেহরক্ষী পরিবেষ্টিত অবস্থায় এগিয়ে যায়, আক্রমণ শুরু করার জন্য মুখিয়ে থাকায়, তাঁদের বাহনগুলো অস্থির ভঙ্গিতে মাটিতে খুর দিয়ে আঘাত করছে।
‘যাত্রা করা যাক, সে তার অশ্বারোহী বাহিনী স্থূলকায় তরুণ সেনাপতি কামরান ইকবালকে বলে এবং তাঁরা যাত্রা শুরু করে। খুররম তার শিবিরের বহিঃসীমানার শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যুহের ভিতর দিয়ে অতিক্রম করার সময় সে শেষবারের মত দীর্ঘক্ষণ হেরেমের তাবুর দিকে তাকিয়ে থাকে। আরজুমান্দ সেখানে রয়েছে বলে সে খুশি। গতরাতে, আজকের সকালের এই আক্রমণ পরিকল্পনা চূড়ান্ত হবার পরে, আরজুমান্দের প্রশান্ত উপস্থিতি তাঁর দেহমন শমিত করতে সহায়তা করেছে এবং আজকের যুদ্ধ পরিস্থিতির জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে সে খানিকটা ঘুমিয়ে নিতে পেরেছে। সে কালো ঘোড়ার পাজরে গুঁতো দিয়ে রুক্ষ পল্লীপ্রান্তরের উপর দিয়ে নিজের লোকদের নিয়ে প্রায় বারো মাইল দূরে অবস্থিত নির্দিষ্ট স্থানের দিকে এগিয়ে যায় যেখানে, যদি তার গুপ্তদূতদের অনুমান সঠিক হয়ে থাকে, আজ সকালের মাঝামাঝি কোনো একটা সময়ে মালিক আম্বারের বাহিনীর উপস্থিত হবার কথা।
খুররম সকাল প্রায় নয়টা নাগাদ একটা নিচু রিজের ছায়ায় তাঁর লোকদের নিয়ে যাত্রা বিরতি করে যা তাঁর অনুমিত দিক থেকে যদি মালিক আম্বারের লোকের অগ্রসর হয় তাহলে তাকে তাদের দৃষ্টিপটের আড়ালে রাখবে। সে গিল্টি করা ভঁজু-অগ্রভাগ বিশিষ্ট পর্যাণের উপর থেকে পিছলে মাটিতে নেমে এসে রিজের শীর্ষদেশের দিকে দ্রুত দৌড়ে যায়। শীর্ষের কাছাকাছি পৌঁছাবার ঠিক আগ মুহূর্তে সে পেটের উপর ভর দিয়ে মাটিতে সটান শুয়ে পড়ে এবং উঁকি দেয়। তার কয়েকজন সেনাপতি অচিরেই তার সাথে এসে যোগ দেয়। কয়েকটা ছাগল ছাড়া কেউই নড়াচড়া করছে এমন আর কিছু খুঁজে পায় না। শঙ্কাকুল দৃষ্টিতে দিগন্ত তন্নতন্ন করে প্রায় পৌনে এক ঘন্টা আবেক্ষন করার সময় তার মাথার ভিতরে দুশ্চিন্তার ঝড় বইতে থাকে যে তার গুপ্তদূতেরা হয়তো কোথাও ভুল করেছে বা মালিক আম্বার কোনোভাবে তার অভিপ্রায়ের কথা জানতে পেরেছেন এবং গুপ্তদূতদের বিভ্রান্ত করে নিজের গতিপথ পরিবর্তিত করেছেন বা এমনকি মোগল ছাউনি হয়তো আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তারপরেও খুররমের দৃষ্টিতে কিছুই আটকায় না। সে নিজেই নিজের সাথে তর্ক করতে থাকে তার কি নিজের বাহিনীর একাংশ প্রেরণ করা উচিত শিবিরে সবকিছু ঠিক আছে কিনা দেখে আসবার জন্য কিন্তু শেষে আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেয়। সে দশ মিনিট পরে পরম স্বস্তির সাথে পূর্বদিকে ধূলোর একটা দেখতে পায়–মালিক আম্বার যেদিক থেকে আসবে বলে সে প্রত্যাশা করেছিল। তাঁর গুপ্তদূতের দলের একজন সদস্য কয়েক মিনিট পরেই, নিরাপদ দূরত্ব থেকে মালিক আম্বারের বাহিনীর উপর পর্যায়ক্রমে নজর রাখার জন্য যাদের আদেশ দেয়া হয়েছিল, তাঁর ঘর্মাক্ত হবার কারণে চিত্রবিচিত্র খয়েরী রঙের ঘোড়ায় চেপে হাজির হয়।
‘তারা কতদূরে অবস্থান করছে?’ খুররম জানতে চায়। গ্রীষ্মের দাবদাহের কারণে দূরত্বের ধারণা অনেক সময় ভ্রান্তিজনক হয়ে উঠে।
‘জাহাপনা, দুই কি তিন মাইল হবে।
‘আমি যা ভেবেছিলাম এটা তারচেয়েও কম। তাঁরা কি ধরনের ব্যুহ বজায় রাখছে?
‘তাদের মূল বাহিনী থেকে প্রায় সোয়া মাইল দূরে পুরো বাহিনীকে ঘিরে নিজেদের গুপ্তদূতেরা বৈরী প্রতিপক্ষের সন্ধানে ভ্রমণ করছে কিন্তু আমি যেখানে অবস্থান করছিলাম সেখান থেকে দেখে অবশিষ্ট বাহিনীকে আমার বেশ শমিত মনে হয়েছে। কামান আর বারুদবাহী শকটগুলো এখনও আচ্ছাদিত রয়েছে–এই বিষয়ে আমি পুরোপুরি নিশ্চিত।
‘তার মানে আমরা এত কাছে থাকতে পারি সেটা তারা এখনও সন্দেহ করে নি?’
‘জাহাপনা, আমার সেটা মনে হয় না।’
‘বেশ, তাঁরা অচিরেই অবগত হবে, খুররম কথা বলে, রিজ থেকে নামার জন্য সে ইতিমধ্যেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। সে চিৎকার করে নিজের সেনাপতিদের ডাকে, আমরা সরাসরি তাদের আক্রমণ করতে যাচ্ছি। সবাই মনে রাখবেন তাঁদের কামানগুলো অকেজো করে দেয়াই আমাদের লক্ষ্য। আমরা তাঁদের যতবেশি সংখ্যক কামান ধ্বংস বা অকেজো করে দিতে পারবো আমরা আমাদের শত্রুর লড়াই করার ক্ষমতা ততবেশি হ্রাস করতে পারবো।’
খুররম সোয়া ঘন্টা পরে নিজের বাহিনীর পুরোভাগে অবস্থান করে মালিক আম্বারের সৈন্যসারির দিকে আস্কন্দিত বেগে ঘোড়া হাকিয়ে এগিয়ে যায়। শুষ্ক মাটির বুকে ঘোড়ার খুরের আঘাতে ঢাকের বোল উঠে আর ছিটকে উঠা ধূলিকণা তাঁদের সওয়ারীর চোখে বিদ্ধ হয় এবং তাঁদের নাক মুখ ধূলোয় কিচকিচ করতে থাকে। খুররম মৃত্যুদায়ী অভিপ্রায়ে অগ্রসর হবার সময় চারপাশ অন্ধকার করে থাকা ধূলোর মেঘের ভিতর দিয়ে দেখতে পায় যে মালিক আম্বারের লোকেরা এতক্ষণে বিপদ বুঝতে পেরেছে। অশ্বারোহী যোদ্ধারা আক্রমণ প্রতিহত করতে ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিতে শুরু করে আর তোপচিরা হন্তদন্ত হয়ে কামানের উপর থেকে আবরণ সরাতে থাকে আর কামানের মুখ প্রতিপক্ষের দিকে ঘোরাবার জন্য ষাড়ের পালকে নির্বিচারে চাবুক দিয়ে আঘাত করতে থাকে, যখন অন্যেরা গোলাবারুদ বহনকারী শকট থেকে কামানের গোলা আর বারুদের বস্তা টেনে নামায়। তীরন্দাজেরা রণহস্তীর হাওদায় অবস্থান গ্রহণের জন্য বেয়ে উঠতে থাকে। তবকীরা তাঁদের বন্দুকগুলোকে প্রস্তুত করে এবং সেগুলোর দীর্ঘ ব্যারেল তেপায়ার উপর স্থাপন করে যাতে করে আরো নিখুঁতভাবে নিশানাভেদ করা যায়। খুররম আরো দেখতে পায় সূর্যের আলোয় ঝকঝক করতে থাকা বক্ষস্থল আবৃতকারী বর্ম পরিহিত একদল লোক সৈন্যব্যুহের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে ব্যস্তভাবে ঘোড়া নিয়ে ছোটাছুটি করছে। তারা সম্ভবত মালিক আম্বার আর তার আধিকারিকেরা, সৈন্যদের উৎসাহ জোগাচ্ছে আর প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিচ্ছে।
আকাশের বুক চিরে ঝাঁকে ঝাঁকে তীর তাঁর বল্পিত গতিতে ধাবমান লোকদের উপরে আছড়ে পড়তে শুরু করে। তাঁর কানের পাশ দিয়ে গাদাবন্দুকের গুলি মৃত্যুর শিস বাজিয়ে যায় আর মালিক আম্বারের প্রতিরক্ষা ব্যুহ থেকে আলোর ঝলকানি আর সাদা ধোয়ার কুণ্ডলী দেখা যেতে বোঝা যায় যে শত্রুপক্ষের গুটিকয়েক তবকি এখন অন্তত গুলিবর্ষণ শুরু করেছে। সে এর কিছুক্ষণ পরেই আরো মন্দ্র একটা অভিঘাত আর উত্তাল তরঙ্গের ন্যায় ধোয়ার কুণ্ডলী উঠতে দেখলে তার মাঝে সন্দেহের কোনো অবকাশ থাকে না যে এইমাত্র মালিক আম্বারের একটা কামানও যুদ্ধে যোগ দিয়েছে। খুররম দশ গজেরও কম দূরত্বে তাঁর সামনের সারির একজন যোদ্ধাকে–এক তরুণ রাজপুত নিশানা বাহক–তার পর্যাণ থেকে পেছনের দিকে ছিটকে মাটিতে আছড়ে পড়তে দেখে, হতভাগ্য অশ্বারোহী ভূপাতিত হবার সময় তার হাত থেকে সবুজ রঙের মোগল নিশানা ছিটকে যায়। তাকে অনুসরণরত–আরেকজন রাজপুত–অশ্বারোহীর বাহন ভূপাতিত দেহের কারণে হুমড়ি খায় এবং তারপরে নিশানের সাথে পা জড়িয়ে যেতে এটাও মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে, তাঁর রাজপুত সওয়ারীকে মাথার উপর দিয়ে মাটিতে ছিটকে ফেলে এবং তারপরে আরো একটা ঘোড়াকে তার আরোহীসহ ধূলোয় ফেলে দেয়। খুররম ভাবে, মালিক আম্বারের সৈন্যসারি আর মাত্র সোয়া মাইল দূরে রয়েছে। এই দূরত্ব অতিক্রম করতে যে সময় প্রয়োজন সেই অবসরে শত্রুপক্ষ খুব বেশি একটা ক্ষতিসাধন করতে পারবে বলে তার কাছে মনে হয় না। সে তার ঘোড়ার গলার কাছে সহজাত প্রবৃত্তির বশে নুয়ে এসে, সে মালিক আম্বারের কামানের অবস্থান অভিমুখে আরো সরাসরি অগ্রসর হবার অভিপ্রায়ে লাগামে মোচড় দেয় এবং ছোটার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকা কালো ঘোড়ার পাজরে দিনের প্রথমবারের মত গুঁতো দেয়।
সে এরপরেই নিজেকে মালিক আম্বারের সৈন্যসারির মাঝে নিজেকে দেখতে পেয়ে, কামানগুলোকে সুরক্ষিত রাখতে সেগুলোর কয়েক গজ সামনে একটা ব্যুহ রচনা করে নিজের সহযোদ্ধাদের সাথে অবস্থানরত বেগুনী রঙের পাগড়ি পরিহিত এক তবকীর উদ্দেশ্যে তরবারি কোপ বসিয়ে দেয়। সে ইতিমধ্যে একবার গুলি করেছে এবং সে বন্দুকে পুনরায় গুলি ভর্তি করতে তাঁর পাশে সীসার গুলিভর্তি সাদা সুতির থলে থেকে একটা গুলি নিয়ে ইস্পাতের দণ্ডের সাহায্যে লম্বা ব্যারেলে প্রবেশ করাতে মরীয়া হয়ে চেষ্টা করছে। সে তাঁর আরাধ্য কাজ আর কখনও শেষ করতে পারবে না। খুররমের তরবারি, সেদিন সকালেই অস্ত্রাগারের তত্ত্বাবধায়ক নিখুঁতভাবে শান দিয়ে ধারালো করে তুলেছে, তবকীর মুখের একপাশে আঘাত হেনে বেচারার চোয়াল প্রায় বিচ্ছিন্ন করে তার সাদা দাঁতের সারি অনাবৃত করে ফেলে। হাতের বন্দুক ফেলে দিয়ে লোকটা মাটিতে পড়ে যেতে খুররম পেছনের দিকে একবারও না তাকিয়ে সামনের কামান আর গোলাবারুদবাহী শকটের দিকে দেহরক্ষী পরিবেষ্টিত অবস্থায় দিকে ছুটে যায়। খুররমের অবস্থান থেকে মাত্র দশ গজ দূরে একটা কামান কানে তালা ধরিয়ে দেয়া শব্দ আর সাদা ধোয়ার মেঘ সৃষ্টি করে গোলাবর্ষণ করে। খুররমের আরেকজন দেহরক্ষীর উদরে গিয়ে গোলাটা আঘাত করতে তার দেহের উপরের অংশ নিমেষে স্থানচ্যুত হয় আর তার রক্তাক্ত ঘোড়াটা সহসা তাল হারিয়ে আরেক দিকে দৌড়ে যায় তখনও তার দেহের নিচের অংশ পর্যাণে বসে রয়েছে।
বারুদের ঝাঁঝালো ধোঁয়ায় কাশতে শুরু করে, তার কান ভোঁ-ভোঁ করতে থাকে, খুররম তার ঘোড়াকে পুনরায় সামনের দিকে অগ্রসর হবার ইঙ্গিত করে, আরেকজন তোপচীকে লক্ষ্য করে তরবারি চালায় যে পাথরের অসম্ভব ভারি কামানের একটা গোলার ওজনে নুয়ে প্রায় বাঁকা হয়ে গিয়ে নিজের অস্ত্রের দিকে যাবার জন্য প্রাণান্তকর পরিশ্রম করছে। পিঠে আঘাত প্রাপ্ত হতে, লোকটার হাত থেকে পাথরের গোলাটা পড়ে যায় এবং তার সাদা রঙের নোংরা জোব্বাটা রক্ত শুষে নিতে থাকলে, সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। এক মিনিট বা সম্ভবত তারও কম হবে–যুদ্ধক্ষেত্রে সময় যেন সহসাই স্থবির হয়ে উঠে–খুররম সৈন্যসারির অন্যপাশে পৌঁছে যায়। নিজের চারপাশে তাকিয়ে সে দেখতে পায় যে আরো অনেক তোপচি হাতের ইস্পাতের দণ্ড ফেলে দিয়ে নিজের অবস্থান পরিত্যাগ করে দৌড়ে পালাতে শুরু করেছে। অধিকাংশের প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হয় যেহেতু তাঁর অনুগত অশ্বারোহী যোদ্ধারা তাদের তরবারি নিয়ে পেছন থেকে তাঁদের উপর চড়াও হয় তারা দৌড়াতে করায় বা বর্শা দিয়ে তাদের গেঁথে ফেলে।
খুররমের লোকজন দ্রুত তার চারপাশে সমবেত হতে আরম্ভ করে। ‘তোমাদের ভিতরে যাঁদের কীলক বিতরণ করা হয়েছে সেগুলো কামানের পশ্চাদভাগে সর্বশক্তি দিয়ে ঢুকিয়ে দেবে, সে আদেশ দেয়। যাদের কাছে কাঠের ছোট হাতুড়ি রয়েছে তারা চেষ্টা করবে কামানের সম্মুখভাগের বহনকারী শকটের চাকাগুলো ভেঙে দিতে। আর যাদের উপরে বারুদের চিহ্নরেখা তৈরি করে বারুদ বহনকারী শকটগুলো গুঁড়িয়ে দেয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তারা আমরা প্রস্থান করার সাথে সাথে কাজ শুরু করে দেবে। তোমাদের কাজের সময়ে মালিক আম্বারের লোকদের আমরা বাকি যারা রয়েছি তারা ব্যস্ত রাখবো।
তার সৈন্যরা ঘোড়া থেকে নেমে যখন কাজ শুরু করবে খুররম একটা তূর্যধ্বনি শুনতে পায় এবং পোয়র স্রোতের মাঝে বিদ্যমান একটা ফাঁক দিয়ে–সে ইতিমধ্যেই বুঝতে পেরেছে যা রণক্ষেত্রকে এমন বিভ্রান্তিকর স্থানে পরিণত করে–সে মালিক আম্বারের বিশৃঙ্খল সৈন্যসারির পেছন থেকে তাঁর একদল অশ্বারোহীকে আবির্ভূত হতে দেখে এবং কৃতসংকল্প ভঙ্গিতে তাঁরই অবস্থানের দিকে হামলা করতে এগিয়ে আসতে দেখে। ‘এসো, আমরা তাঁদের মুখোমুখি হই,’ খুররম চিৎকার করে এবং তাঁর কালো ঘোড়াকে সামনে অগ্রসর হতে ইঙ্গিত করে।
সে আর তার লোকেরা তাদের ঘোড়াগুলোকে বল্পিত বেগে ধাবিত করার পূর্বেই শত্রু সৈন্য তাদের আক্রমণ করে। খুররমকে দেখে মনে হয় চিনতে পারায়, প্রতিপক্ষের গাট্টাগোট্টা দেখতে এক যোদ্ধা যে শিরোস্ত্রাণ পরার কিংবা বর্মে সজ্জিত হবার সময় পায়নি তার দিকে সরাসরি এগিয়ে যাবার জন্য লাগাম ধরে টান দেয়। খুররম তার ঘোড়াকে চক্রাকারে ঘোরায়, জটা এখন নিজের পূর্ববর্তী যুদ্ধ প্রয়াসের কারণে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে, তার মুখোমুখি হতে। তাঁর প্রতিপক্ষ অবশ্য আঘাত করার প্রথম সুযোগ লাভ করে, খুররমের বক্ষ আবৃতকারী বর্ম লক্ষ্য করে সে হাত দুলিয়ে নিজের বাঁকানো তরবারি নামিয়ে আনতে আঘাতটা নিশানা ভেদ করে আর তারপরে ইস্পাতে প্রতিহত হতে, খুররমও ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে ফলে তাঁর প্রথম আঘাতও বিফলে যায়, প্রতিপক্ষের যোদ্ধা মাথা নিচু করতে তরবারিটা উপরের বাতাস কেটে বের হয়ে যায়। কিন্তু খুররম তারপরেই, দ্রুত ভারসাম্য লাভ করে, পুনরায় তরবারি দিয়ে আঘাত করে, তাঁর তরবারির ক্ষুরধার ফলা লোকটার বুকের লম্বালম্বি হাড়ের ঠিক নিচে তাঁর স্ফীত আর অরক্ষিত উদরের গভীরে আঘাত হানে। সে অস্ত্র আর লাগাম ছুঁড়ে ফেলে এবং নিজের ক্ষতস্থান খামচে ধরে লোকটা তার ঘোড়া থেকে পাথরের মত খসে পড়ে, জটা তার প্রবল ভার থেকে মুক্ত হতেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা পরিহার করে সেখান থেকে দ্রুত অন্যদিকে ধাবিত হয়।
খুররম আক্রমণের আকষ্মিকতা শেষে জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে দম ফিরে পাবার চেষ্টা করার সময়ে নিজের চারপাশে তাকিয়ে দেখে যে মালিক আম্বারের যোদ্ধারা ক্রমশ আরো বেশি সংখ্যায় লড়াইয়ে যোগ দিচ্ছে এবং সেই সাথে এটাও লক্ষ্য করে যে তার পক্ষের বেশ কয়েকজন সৈন্য মাটিতে আহত বা নিহত অবস্থায় হাত পা ছড়িয়ে পড়ে রয়েছে। সে যেমন আশা করেছিল তাঁদের এই ঝটিকা আক্রমণ ঠিক ততটাই সফল হয়েছে, মালিক আম্বারের যুদ্ধ উপকরণ আর তার শক্তি অনেকটাই তাঁরা আজ হ্রাস করেছে। তাদের অভিপ্রায় এখন যখন অর্জিত হয়েছে তখন এটাই উপযুক্ত সময় তাঁর আর তার অনুগত লোকদের নিরাপদে পশ্চাদপসারণ করা যখন তারা সেটা করতে পারবে। যথেষ্ট হয়েছে, সবাই এখনই ঘোড়ায় চাপো, কামানগুলো অকেজো করা যারা প্রায় শেষ করে ফেলেছে তাদের উদ্দেশ্যে সে চিৎকার করে। আহত কিংবা ঘোড়া হারিয়েছে এমন প্রত্যেককে তুলে নাও আর একটা ঘোড়ায় দু’জন আরোহণ করো কিন্তু তোমরা যখন স্থান ত্যাগ করবে তখন বারুদ বহনকারী শকটের চারপাশে তোমাদের সৃষ্ট বারুদের চিহ্নরেখায় অবশ্যই মনে করে অগ্নি সংযোগ করবে।
সে তার পদাতিক হিসাবে দায়িত্ব পালনরত সৈন্যদের হুড়োহুড়ি করে নিজেদের বাহনের পর্যাণে আরোহণ করতে, সহযোদ্ধাদের পেছনে তুলে নেয়ার সময় সে তাকিয়ে থাকে। দীর্ঘদেহী এক রাজপুত আহত একজন সহযোদ্ধাকে নিজের ধুসর ঘোড়ায় তুলে নেয়া জন্য প্রাণান্ত হচ্ছে তখনই শূন্য থেকে মৃত্যু মুখে নিয়ে দুটো তীর অল্প সময়ের ব্যবধানে নেমে এসে আহত যোদ্ধাকে বিদ্ধ করে, এবং সে পেছনের দিকে উল্টে পড়ে, স্পষ্টতই মৃত্যু ভূমি স্পর্শ করার পূর্বেই হয়েছে। চলে এসো, খুররম উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলে, এবং নিজের কালো ঘোড়ার পাঁজরে গোড়ালী দিয়ে গুতো দেয় যার কালো চামড়া ঘামের সাদা ফেনায় জবজব করছে। সবশেষে যাঁরা শত্রুপক্ষের এলাকা ত্যাগ করবে সে তাদের সাথে অবস্থান করে। সে তীব্র বেগে ঘোড়া দাবড়ের নেয়ার সময়, পেছনের পরিস্থিতি দেখার জন্য নিজের পর্যাণে ঘুরে গিয়ে সে তার পেছনে তাকাতে সে দেখে, মালিক আম্বারের সৈন্যদের ছোঁড়া একটা বর্শা আঘাতে, তার আরেকজন যোদ্ধা নিজের বাহন থেকে কাত হয়ে একপাশে পড়ে যাচ্ছে। হতভাগ্য লোকটার পা রেকাবে আটকে যায় এবং রেকাবের চামড়া ছিঁড়ে যাবার আগে বেশ কিছুটা দূরত্ব সে ঘোড়ার পেছনে ছেচড়ে যায়।
খুররম সহসা অনুভব করে গরম বাতাসের একটা হলকা তার পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে এবং আবারও একটা বিকট বিস্ফোরনের শব্দ তাঁর কানে তালা ধরিয়ে দেয়। বারুদবাহী শকটগুলোর একটা অন্তত বিস্ফোরিত হয়েছে। আরেকটা বিস্ফোরণের আওয়াজ ভেসে আসে এবং খুররম তাঁর বাম গালের নাকের কাছে তীব্র একটা যন্ত্রণা অনুভব করে আর তরল কিছু একটা তার মুখের উপর দিয়ে গড়িয়ে ঠোঁটের কাছে আসে। জিনিষটার স্বাদ নোনতা আর তার জীহ্বায় কেমন ধাতব একটা অনুভূতি–রক্ত। সে ঘোড়ায় চেপে ছোটার মাঝেই গালে হাত দিয়ে একটা পাতলা ধাতুব টুকরো টেনে বের করে। সে ভাবে, জিনিষটা সম্ভবত টিনের তৈরি বারুদ রাখার তোড়ং।
সে অচিরেই আবার সেই রিজের চূড়ায় ফিরে আসে যেখান থেকে সে আক্রমণ আরম্ভ করেছিল, যেখানে তাঁর বাকি সৈন্যরা পুনরায় নতুন করে গোষ্ঠীবদ্ধ হচ্ছে। সে তার ঘোড়ার প্রবলভাবে স্পন্দিত হতে থাকা পাজরে করতল দিয়ে মৃদু আঘাত করে জটাকে আদর করে, এবং আবারও নিজের পেছন দিকে তাকালে, সে দেখে যে গুটিকয়েক পিছিয়ে পড়া দলছুট মোগল সৈন্য তখনও মালিক আম্বারের বিভ্রান্ত সৈন্যদের কাছ থেকে পালিয়ে আসছে। একটা ধুসর ঘোড়ার সামনের পা ঢাল দিয়ে উপরের দিকে উঠার সময়ে নিজের দেহের ভারে বেঁকে যায় এবং বিশাল প্রাণীটা ভূপাতিত হয়, পিঠের গাট্টাগোট্টা দেখতে, ধনুকের মত বাঁকানো পায়ের আরোহী সময়মত পর্যাণ থেকে লাফ দিয়ে সরে যায়। খুররম ভালো করে খেয়াল করলে দেখে যে ঘোড়াটার পার্শ্বদেশে তরবারির বিশাল একটা ক্ষত রয়েছে। প্রাণীটা তার উপরে অর্পিত দায়িত্ব ভালোমতই পালন করেছে এবং সাহসিকতার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে পিঠের আরোহীকে এত দূর পর্যন্ত নিয়ে এসেছে।
মালিক আম্বারের লোকেরা তাদের পিছু ধাওয়া করে নি। খুররম বুরহানপুর ত্যাগ করার পর থেকে অতিবাহিত দু’মাসে এমন ঘটনা আরো দু’বার ঘটেছে, তাঁদের প্রতিপক্ষ সবসময়ে কৌশলগত নিরাপদ আশ্রয়স্থলে অবস্থান অব্যাহত রেখেছে, ঝটিকা হামলায় নিজের বাহিনীর ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপারটা আপাত দৃষ্টিতে বোধহয় মেনেই নিয়েছে এবং আজ সকালের মত ঝটিকা আক্রমণের সময় নিজ পক্ষের হামলাকারীদের, তারা যখন মূল বাহিনী থেকে পৃথক হয়ে হামলা শুরু করে, তখনও তাদের অনুসরণ করার কোনো তাগিদ তার ভিতরে লক্ষ্য করা যায়নি। মালিক আম্বার মনে হচ্ছে দাক্ষিণাত্যের মালভূমির সীমান্তের লাগোয়া পাহাড়ের অভ্যন্তর পর্যন্ত পশ্চাদপসারণ অব্যাহত রাখতে সংকল্পবদ্ধ যা খুররমের আগমনের সংবাদ প্রথমবার শোনার পরে থেকেই তিনি বজায় রেখেছেন। তার সংখ্যায় অপ্রতুল সৈন্যবাহিনী এখানে যেকোনো যুদ্ধে পরিচিত ভূপ্রকৃতি নিজের সুবিধামত ব্যবহার করতে সক্ষম হবে।
খুররম তার রক্তে রঞ্জিত তরবারির ফলা পর্যাণে রক্ষিত এক টুকরো কাপড়ের সাহায্যে পরিষ্কার করে এবং পরম যত্নের সাথে আরো একবার তরবারিটাকে এর রত্নখচিত ময়ানে কোষবদ্ধ করে, হতাশা আর সন্তুষ্টির একটা মিশ্র অনুভূতির মাঝে সে বিরাজ করছে। সে মালিক আম্বারের সৈন্যবাহিনীর আরো ক্ষতি সাধন করতে পেরেছে, তাদের গোলাবর্ষণের ক্ষমতা আর সৈন্য সংখ্যা ন্যূনতম গ্রহণযোগ্য মোগল প্রাণহানির বিনিময়ে অর্জিত হওয়ায় সে সন্তুষ্ট, আর হতাশ এই জন্য যে মালিক আম্বার এখনও চূড়ান্ত নিষ্পত্তিমূলক যুদ্ধে নিজেকে নিয়োজিত করে নি। সে অবশ্য নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে মনে মনে বলে যে এমন একটা যুদ্ধের সম্ভাবনা সৃষ্টি হতে খুব বেশি দিন দেরি হবে না।
*
‘দেখি, আমাকে দেখতে দাও, আরজুমান্দ আদেশের সুরে বলে। খুররম তার পরিশ্রান্ত কালো ঘোড়া নিয়ে মাত্র পাঁচ মিনিট আগেই তার অস্থায়ী সেনাছাউনিতে আস্কন্দিত বেগে এসেছে। আরজুমান্দ রীতিনীতির তোয়াক্কা না করে তাকে অভ্যর্থনা জানাতে হেরেম থেকে ছুটে এসেছে, সে তাবুর উষ্ণ অভ্যন্তরভাগে মধ্যবর্তী সময়টা নিরন্তর পায়চারি করে অতিবাহিত করেছে, তার পরিচারিকারা দরবারের সাম্প্রতিক গুজবের রসালো মুখরোচক অংশ শুনিয়ে তার মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করলে বা যখন জলখাবারের কথা জিজ্ঞেস করেছে সে তাদের সব কিছুরই যন্ত্রবৎ উত্তর দিয়েছে। খুররমের মুখে জমাট বাধা রক্তের দাগ দেখে সে সাথে সাথে তাকে তাবুতে ফিরিয়ে নিয়ে আসে।
‘কিস্যু হয়নি। সামান্য আচড় মাত্র। সত্যিই বলছি। ক্ষতস্থানে ইতিমধ্যেই মামাড়ি পড়া শুরু হয়েছে, খুররম প্রতিবাদ জানায় কিন্তু আরজুমান্দ সে সবে মোটেই পাত্তা না দিয়ে ক্ষতস্থান পরিষ্কার করার জন্য নিম পাতার নির্যাস আনতে বলে, সে শুনেছে সংক্রমণ প্রতিরোধে এটা একটা নিশ্চিত উপায়। পরিচারিকাদের একজন হন্তদন্ত হয়ে নিম পাতার সন্ধানে যেতেই, আরজুমান্দ খুররমের বুকের বর্মের বাঁধন খুলে এবং তার দেহ থেকে সেটা সরিয়ে নেয়ার সময় সে আপন মনেই বিড়বিড় করে বলতে থাকে, ‘আল্লাহতালাকে লাখ লাখ শুকরিয়া যে আপনি নিরাপদে ফিরে এসেছেন। ‘আমি তোমাকে বলেছি সোনা আমি অবশ্যই ফিরে আসবো… তোমায় ভীষণ উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে। তুমি কি নিশ্চিত যে আমার সাথে যুদ্ধযাত্রায় অংশ নেয়া তোমার জন্য সত্যিই ভালো হবে? বুরহানপুরে তুমি কি আরও শান্তিতে থাকতে না?”
না, আরজুমান্দ সাথে সাথে উত্তর দেয়, তাঁর কণ্ঠস্বর কঠোর। সংবাদের জন্য অপেক্ষার প্রহর এখানে সংক্ষিপ্ত। বার্তাবাহকের আগমনের জন্য প্রতীক্ষা করা এবং তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে তারা কি সংবাদ নিয়ে এসেছে সেটা আন্দাজ করার চেষ্টা অনেক বেশি মারাত্মক। আমি এখানে সেনাছাউনিতে আপনার সাথে থাকতে পারছি এবং আপনার ভাবনা জানতে আর চূড়ান্ত বিজয়ের ক্ষণে, আমি জানি যা অবশ্যম্ভাবী, উপস্থিত থাকতে পারবো। সে তার কথার মাঝেই তাকে আলিঙ্গণ করে, ঘামের ঝাঁঝালো গন্ধ যা তার জোব্বাকে নোংরা করেছে পাত্তা না দিয়ে।
খুররম যখন তার গালে প্রণয়স্পর্শ ফিরিয়ে দিচ্ছে, তাঁর মন তখনও ভাবতে থাকে বিজয় অর্জনের জন্য সে আরও কীভাবে তার প্রচেষ্টা জোরদার করতে পারে যা আরজুমান্দ অবশ্যম্ভাবী মনে করে। মালিক আম্বার এখনও সবচেয়ে বিপজ্জনক প্রতিপক্ষ হিসাবে বর্তমান।
*
‘যুবরাজ, উন্মুক্ত প্রান্তরে যুদ্ধে আমাদের মোকাবেলা না করে মালিক আম্বার এখান থেকে পাঁচ মাইল দূরে একটা বদ্ধ একটা উপত্যকায় পশ্চাদপসারণ করেছে, কামরান ইকবাল, তাঁর গুপ্তদূতের অভিযান সমাপ্ত করে ফিরে এসে পোষাক পরিবর্তন করে যখন পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করে দাবদাহের উত্তাপে তাঁর গোলগাল মুখটায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গড়িয়ে পড়তে শুরু করে। তার লোকজন ইতিমধ্যে প্রবেশ পথে পাথর, মালবাহী শকট উল্টে রেখে আর অন্য যা কিছু তারা হাতের কাছে পেয়েছে সবকিছু দিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।
খুররম মনে মনে ভাবে, অবশেষে অপেক্ষার পালা সমাপ্ত হতে চলেছে। আক্রমণ শুরু হবার পর থেকেই যার কারণে তাকে নিজের গালে একটা অগভীর ক্ষত সহ্য করতে হয়েছে তার লোকেরা মালিক আম্বারের বাহিনীর উপরে সবসময়ে নজর রেখে এসেছে বিশেষ করে তারা যখন আহমেদনগরের সুলতানের ভূখণ্ডের দিকে ফিরে যেতে শুরু করে। খুররম পরবর্তীতে শত্রুপক্ষকে পর্যায়ক্রমিক পার্শ্ববর্তী আক্রমণ আর হয়রানিমূলক ঝটিকা হামলা চালিয়ে প্রতিপক্ষকে তাদের সব শক্ত ঘাঁটি থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে যেখানে পৌঁছাতে পারলে তারা নতুন করে সৈন্য সংগ্রহ করতে পারতো। মালিক আম্বার, যিনি পশ্চাদপসারণের সময় নিজের লোকদের ভিতরে শৃঙ্খলা বজায় রাখার কঠিন কাজে আপাত দৃষ্টিতে সফল হয়েছেন, অবশেষে স্পষ্টতই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাকে এবার ঘুরে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করতে হবে। আবিসিনিয়ার ভাড়াটে যোদ্ধা প্রতিরক্ষার জন্য সবচেয়ে উপযোগী ভূখণ্ডও যদি নির্বাচিত করে থাকেও, খুররম নিজের বিজয়ের ব্যাপারে আস্থাশীল। পেছনের উপত্যকা সম্বন্ধে কি জানো? আসলেই কি সেটা কানাগলি?’
‘উপত্যকাটা অনেকটা বোতল আকৃতির। প্রবেশ পথটা বোতলের গলা বা বলা যায় সবচেয়ে সংকীর্ণ অংশ। দুই পাশ খাড়াভাবে উঠে গিয়েছে আর পায়ের চাপে গড়িয়ে পড়তে পারে এমন পাথর এবং আলগা নুড়িতে ঢাকা। উপত্যকার মাঝে ঝর্ণার পানিতে সৃষ্ট একটা নদী রয়েছে যা মালিক আম্বারের লোকদের পানির সংস্থান দেবে। আর সেখানে প্রচুর কাঠও রয়েছে। তাঁরা কিছু গাছ কেটে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারবে এবং তারপরেও যথেষ্ট গাছ দাঁড়িয়ে থাকবে আমাদের যেকোনো আক্রমণ বিক্ষিপ্ত করে দিতে।’
‘তোমার কি মনে হয়? আমরা কি এখন আক্রমণ করবো?’ শেষ যুদ্ধের সম্ভাবনায় অধৈর্য হয়ে উঠা খুররম জানতে চায়।
‘না, যুবরাজ। যদিও বর্তমান পরিস্থিতিতে আক্রমণ করাটাই সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে হচ্ছে, আমার মনে হয় সেটা ঠিক হবে না, কামরান ইকবাল বলে। উপত্যকার প্রবেশ মুখটা খুবই সংকীর্ণ আর সহজেই এলাকাটা সুরক্ষিত করা সম্ভব। আমরা যদি কেবল আমাদের সঙ্গে থাকা অশ্বারোহী যোদ্ধাদের ভরসায় আক্রমণ শুরু করি তাহলে মারাত্মক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবার ঝুঁকি রয়েছে। রণহস্তীর বহর আর কামানবাহী শকটগুলো এসে যোগ দেয়া পর্যন্ত আমাদের অবশ্যই অপেক্ষা করা উচিত।’
খুররম বুঝতে পারে কামরান ইকবাল ঠিকই বলেছে। এতগুলো সপ্তাহ। কৌশলী অভিযান পরিচালনা করে মালিক আম্বারের বাহিনীকে বর্তমান অবস্থানে নিয়ে এসে এখন ব্যর্থতার সম্ভাবনা আছে জেনেও আক্রমণ করলে সে বোকামির পরিচয় দেবে। মালিক আম্বারের অবস্থা এই মুহূর্তে নিজ গুহায় কোণঠাসা অবস্থায় আহত সিংহের ন্যায়, যে এখনও অসতর্ক বা অতি উৎসাহী শিকারীকে প্রাণঘাতি আঘাত করতে সক্ষম।
*
‘আজ আমরা জয়লাভ করবো, খুররম এক ঘন্টা আগে আরজুমান্দকে বলেছে। মালিক আম্বারের সৈন্যরা যে উপত্যকায় নিজেদের স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে অবরুদ্ধ করে রেখেছে সেখান থেকে আধ মাইল দূরে একটা টিলার উপরে রোকের অবস্থান থেকে সে এখন সামনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। প্রবেশ পথটা সত্যিই খুব সংকীর্ণ–কোনোমতেই দুইশ গজের বেশি চওড়া হবে না-এবং দু’পাশের পাহাড় এতটাই খাড়াভাবে উঁচু হয়েছে যে সেটা বেয়ে উপরে উঠা বিশেষ করে এমন একদল মানুষের জন্য যাদের লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করা হচ্ছে। মালিক আম্বারের সৈন্যরা প্রবেশ পথটা পাথর, গোড়া থেকে কেটে ফেলা গাছ এমনকি কাঁটাগাছের ঝোঁপ যা আশেপাশের এলাকায় প্রচুর জন্মে একসাথে বেঁধে গোছা করে ফেলে রাখার সাথে সাথে নিজের সাথের মালবাহী শকটগুলোও উল্টে দিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। প্রতিবন্ধকতা বরাবর নিয়মিত দূরত্বে খুররমের অতর্কিত হামলার পরেও কার্যক্ষম রয়েছে মালিক আম্বারের এমন অবশিষ্ট কামানের নল মুখ ব্যাদান করে রয়েছে।
খুররম এখন আগের চেয়েও বেশি নিশ্চিত যে গতকাল সন্ধ্যাবেলা যুদ্ধের কৌশল নির্ধারণী বৈঠকে সে ঠিকই বলেছিল যে উপত্যকার ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে এসে নদীটা যেখানে বাইরে বের হয়ে এসেছে সেটাই একমাত্র সম্ভাব্য দূর্বল স্থান। মালিক আম্বারের লোকজন নদীতে বাঁধ না দিয়ে সেখানে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারবে না যা অচিরেই তাদের পেছনের স্থান প্লাবিত করে এলাকাটা পাহারা দেয়াই তাদের জন্য অসম্ভব করে তুলবে।
যুদ্ধের কৌশল নির্ধারণী সভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুসারে তাঁর রণহস্তীর একটা বহর ইতিমধ্যেই আক্রমণের জন্য অগ্রসর হতে আরম্ভ করেছে, উপত্যকার প্রবেশ পথের দিকে ধীরে কিন্তু নিশ্চিন্ত নিশ্চয়তায় এগিয়ে চলেছে। খুররম কয়েকটা হাওদা থেকে গাদাবন্দুকের গুলির ঝলক দেখতে পায় এবং অন্যগুলো থেকে ভেসে আসে তাঁর বহনযোগ্য ছোট কামান–গজলের চাপা গর্জন আর ঘোয়া। হাতির বহরের ঠিক পেছনে আড়াআড়িভাবে বিন্যস্ত অশ্বারোহী যোদ্ধাদের সারি ইতিমধ্যেই সমবেত হতে শুরু করেছে প্রতিবন্ধকতায় সৃষ্ট সামান্যতম ফাটলের সর্বোচ্চ সুযোগ নিতে। খুররমের মন চাইছে তাদের সাথে থেকে আক্রমণের নেতৃত্ব দিতে কিন্তু যুক্তি দিয়ে সে জানে যে আরজুমান্দ ঠিকই বলেছে এবং কেবল তার নিরাপত্তার কথা ভেবেই না বরং সে তাকে তাঁর সেনাপতিদের পরামর্শ অনুসরণ করতে অনুরোধ করেছিল এই জন্য যে যুদ্ধক্ষেত্র আর সেখানকার ঘূর্ণায়মান ধোয়ার কুণ্ডলী আর এর অনুগামী বিভ্রান্তি থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করে রণনীতি পরিচালনা করলেই সে তার দায়িত্ব অনেকবেশি কার্যকরভাবে পালন করতে পারবে।
মালিক আম্বারের সৈন্যদের তড়িঘড়ির করে তৈরি করা প্রতিবন্ধকতার পেছন থেকে কামানগুলো এখন গোলাবর্ষণ করতে শুরু করেছে এবং খুররম তাঁর হাতির বহরের অগ্রগামী একটা হাতিকে থমকে দাঁড়িয়ে যেতে এবং তারপরে ধীরে ধীরে একপাশে কাত হয়ে নদীতে ভূপাতিত হতে দেখে, পিঠের হাওদাটা ভেঙে গুঁড়িয়ে যায়। আরেকটা হাতির ঘাড়ের দু’পাশ থেকে দুই মাহুতই নিচে আছড়ে পড়ে, সম্ভবত তবকীদের সম্মিলিত গুলিবর্ষণের একটা ঝাপটা তাদের আঘাত করেছে। হাতিটা আক্রমণের অভিমুখ থেকে নিজেকে ঘুরিয়ে নেয়, ভয় আর আতঙ্কে শুড় উঁচু করে রেখেছে। বিশাল জন্তুটা দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পালাবার সময় এর গজদাঁতের সাথে সংযুক্ত ধারালো তরবারির আঘাতে পেছনে অনুসরণরত আরেকটা হাতির পা প্রায় দ্বিখণ্ডিত করে ফেললে সেটাও ভূপাতিত হয়। হাতিটা ভূপাতিত হবার সময় খুররম এর হাওদা থেকে গজনল মাটিতে আছড়ে পড়ে বিধ্বস্ত হতে দেখে। আরেকটা হাতি সেটার সাথে হোঁচট খেয়ে সামনের দিকে ছিটকে পড়লে ঘাড়ের দু’পাশ থেকে দুই মাহুতের সাথে সাথে পিঠে স্থাপিত হাওদাও স্থানচ্যুত হয়।
হাতির বহরের গুটিকয়েক দাঁড়িয়ে থাকা সদস্য এখনও সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে কিন্তু স্বগোত্রের ভূপাতিত সহযোদ্ধাদের ধরাশায়ী দেহ পাশ কাটিয়ে অগ্রসর হওয়াটা তাদের জন্য ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠছে। মালিক আম্বারের প্রতিবন্ধকতায় ফাটল ধরাতে তাদের যদি সফল হতে হয় তাহলে সেদিকে যে গতিতে তাদের ছুটতে হবে সেই গতি অর্জন করা তাদের জন্য এই মুহূর্তে প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে। খুররমের চোখের সামনেই আরো একটা হাতি ভূপাতিত হয়, এত মন্থরভাবে জন্তুটা ভূপাতিত হয় যে পিঠের হাওদায় অবস্থানরত চারজন যোদ্ধাই লাফিয়ে মাটিতে নামতে পারে এবং নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য পেছনের দিকে দৌড়াতে শুরু করে। খুররম হতাশ হয়ে চারজনের একজনকে, স্পষ্টতই গাদাবন্দুকের গুলির আঘাতে, মুহূর্ত পরেই মাটিতে ছিটকে পড়তে দেখে। ভূপাতিত সহযোদ্ধাকে সাহায্য করার জন্য দ্বিতীয়জন ঘুরে দাঁড়ায় কিন্তু আহত লোকটার কাছাকাছি পৌঁছাবার আগে সে নিজেই গুলিবিদ্ধ হয়। তৃতীয়জনও গুলিবিদ্ধ হয় কিন্তু তার আঘাত বোধহয় খুব একটা মারাত্মক না এবং বুকে ভর দিয়ে খুররমের অবস্থানের দিকে একটু একটু করে এগিয়ে আসতে শুরু করে। চতুর্থজন নদীর অগভীর অংশের ভিতর দিয়ে দৌড়াবার কারণে গাদাবন্দুকের গুলির আওতা থেকে প্রায় বের হয়ে আসবার মুহূর্তে সেও গুলিবিদ্ধ হয়, প্রচণ্ড আক্ষেপে বাতাসে দু’হাত ছোঁড়াছুড়ি করতে করতে মুখ নিচের দিকে দিয়ে পানিতে আছড়ে পড়ে।
ইত্যবসরে আরো অন্তত চারটা হাতি ভূপাতিত হয়েছে যখন অন্য দুইটা কি তিনটা হাতি গতিপথ পরিবর্তন করতে শুরু করেছে। বিশাল প্রাণীগুলোর একটা, মারাত্মকভাবে আহত, টলমল করতে করতে নদীর দিকে এগিয়ে গিয়ে ফোয়ারার মত উপরের দিকে পানি ছিটিয়ে দিয়ে জলশয্যা নেয়, রক্তে দ্রুত বহমান পানি লাল হয়ে যায়। খুররম মনে মনে চিন্তা করে, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরো ব্যাপক হবার আগে এখনই আক্রমণ বন্ধ করা উচিত, এবং সে সাথে সাথে কালক্ষেপণ না করে তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সামরিক সংবাদ বহনকারী অপেক্ষমান অশ্বারোহীকে যুদ্ধ বন্ধের প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেয়। সে বরাবরই জানতো যে মালিক আম্বার একজন কুশলী, দক্ষ আর অভিজ্ঞ প্রতিপক্ষ। সে নিশ্চিত পোড় খাওয়া আবিসিনিয়ান সেনাপতি ভেবেছে যে উপত্যকায় ভালোভাবে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলে সে যদি মোগল বাহিনীর এতটাই ক্ষতিসাধন করতে পারে যার ফলে তারা হয় পশ্চাদপসারণ করবে, নিজেদের তার পাল্টা আক্রমণের ঝুঁকির সম্মুখীন করে, নতুবা লড়াইটাকেই নিদেনপক্ষে এতটাই দীর্ঘস্থায়ী করা যার ফলে একটা অচলাবস্থার সৃষ্টি হবে যা কাজে লাগিয়ে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সে নিজেদের জন্য শান্তি আর নিরাপদ অতিক্রমণের সুবিধা আদায় করে নিতে পারবে। খুররম যদি এই দুটো সম্ভাবনার একটাও যদি মেনে নেয় তাহলে নিজের বদরাগী পিতার প্রতিক্রিয়া আন্দাজ করতে তাঁর খুব একটা কষ্ট হয় না আর সেই সাথে সে নিজের প্রথম অভিযানে সাফল্য অর্জনে ব্যর্থ হবে। তাকে এখন একটু সময় নিয়ে নতুন কৌশলের কথা ভাবতে হবে। আজ দুপুরের পরে পুনরায় আরেকদফা নিষ্ফল সম্মুখ আক্রমণ শুরু করার চেয়ে আগামী দুই কি একদিন আক্রমণ মূলতবি রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
‘আমাদের কেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে? খুররম পরে তার চারপাশে অর্ধবৃত্তাকারে আসনপিঁড়ি হয়ে বসে থাকা তার সেনাপতিদের কাছে জানতে চায়।
কমপক্ষে ছয়শ সৈন্য হয় নিহত হয়েছে নতুবা মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে। আমাদের হেকিমরা কেবল তাঁদেরই চিকিৎসা করার সময় পেয়েছে যাদের বেঁচে থাকার একটা সম্ভাবনা রয়েছে বলে তাদের কাছে মনে হয়েছে। সম্ভবত একইরকম গুরুত্বপূর্ণ, আমাদের সেরা রণহস্তির ত্রিশটা মারা গেছে অথবা এত জঘন্যভাবে আহত হয়েছে যে তাদের কষ্ট লাঘব করাই করুণা প্রদর্শনের সামিল, কামরান ইকবাল পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে। ‘আমি যতটা ভয় করেছিলাম পরিস্থিতি তারচেয়েও একটু বেশি মারাত্মক। আমার মনে হয় আপাতত প্রকাশ্যে সম্মুখ আক্রমণের ধারণা আমাদের বাতিল করা উচিত। আমরা কি নিশ্চিতভাবে জানি যে উপত্যকার পেছন দিক দিয়ে বাইরে বের হবার জন্য কোনো পথ নেই আর আমরা যেমন ধারণা করেছি উপত্যকার পার্শ্বদেশ ঠিক ততটাই খাড়া হয়ে উঠে গিয়েছে।’
‘হ্যাঁ, যুবরাজ, আমরা এ ব্যাপারে যতদূর জানি তাতে তাই মনে হয়েছে। স্থানীয় অধিবাসীরা, যারা প্রায়শই তথ্যের একটা ভালো উৎস হিসাবে বিবেচিত হয়ে থাকে, ভয়ে হয় পালিয়ে গিয়েছে বা এতটাই আতঙ্কিত যে তাঁরা দরকারি তথ্য দেবে না। আমরা যদি তথ্যের জন্য তাঁদের চাপ দেই তাহলে আমরা যা শুনতে চাই বলে তাদের মনে হবে তারা ঠিক সেটাই আমাদের বলবে আর সেটা তাহলে তখন অপ্রয়োজনীয় তথ্যের চেয়েও ভয়ঙ্কর হবে।’
‘আমরা আমাদের গুপ্তদূতদের কয়েকজনকে প্রেরণ করেছিলাম, নাকি আমরা শেষ পর্যন্ত পাঠাইনি, চারপাশের পাহাড়ী ঢালে ঘুরে দেখতে আর পেছন থেকে উপত্যকাটা অনুসন্ধান করতে?
‘হা, কিন্তু মালিক আম্বারের নিজেরও মনে হয় অসংখ্য গুপ্তদূত চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে। আমাদের লোকদের চেয়ে তাঁরা এই এলাকাটা অনেক ভালো করে চিনে বলে বেশ কয়েক দফা তারা সাফল্যের সাথে আমাদের উপর অতর্কিত আক্রমণ পরিচালনা করেছিল। আক্রমণের কবল থেকে যারা বেঁচে এসেছিল আর যারা কোনো ধরনের বিপত্তি ছাড়াই অভিযান সমাপ্ত করতে পেরেছিল সবাই একই কথা বলেছে যে তারা যা দেখেছে তাতে সামনের সংকীর্ণ প্রবেশপথটাই বস্তুতক্ষে উপত্যকায় সশস্ত্র লোকজন প্রবেশের একমাত্র রাস্তা।
ভালো কথা, আমাদের আক্রমণ করার বিষয়ে আপনি কি পরামর্শ দেবেন? খুররম জিজ্ঞেস করে, কিছুক্ষণের জন্য নিজের মতামত দূরে সরিয়ে অন্যের কথা শুনতে চায়।
‘যুবরাজ, আমাদের আসলে কামানগুলোকে একটা অগ্রবর্তী স্থানে নিয়ে যাওয়া দরকার যেখান থেকে সেগুলো প্রতিবন্ধকতার সত্যিকারের ক্ষতিসাধন করতে পারবে, ওয়ালী বেগ, কৃশকায় দেখতে এক বাদশানি, খুররমের তোপচিদের মধ্যে সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ এবং বয়স কম করে হলেও যুবরাজের দ্বিগুণ।
কাজটা করার চেয়ে বলাটা অনেক সহজ। তোপচিদের জন্য সামান্যতম আড়াল থাকবে না এবং তাঁরা তাঁদের কামানগুলো কার্যকর করার আগেই মালিক আম্বারের তবকিরা সহজেই তাদের পাখির মত গুলি করে ভূপাতিত করবে।’
‘আমরা কামানের মঞ্চের জন্য আড়াল হিসাবে মৃত হাতির দেহগুলো কেন ব্যবহার করছি না?’ কামরান ইকবাল পরামর্শের সুরে বলে।
হ্যাঁ, কিন্তু তারপরেও কামানগুলো আমাদের জায়গামত নিয়ে যেতে হবে এবং সেটা করতে গেলে আমাদের প্রচুর লোকক্ষয়ের ব্যাপারটা মেনে নিতে হবে।
খুররমের মাথায় সহসা একটা ভাবনা খেলা করে যায়। যুদ্ধের পরামর্শদাতারা আর আরজুমান্দ উভয়পক্ষই যখন সামনে থেকে যুদ্ধের নেতৃত্ব না দেয়ার পরামর্শ দেয়, তারা তখন ধোয়ার কুণ্ডলীর ফলে সৃষ্ট বিভ্রান্তিকে তাদের পক্ষের অন্যতম যুক্তি হিসাবে উপস্থাপন করেছিল। ধোয়াকে নিজের সুবিধার্থে সে কেন ব্যবহার করার কথা চিন্তা করছে না?
“আমরা কি ঘোয়ার একটা অন্তরাল তৈরি করতে পারি আড়াল হিসাবে যা ব্যবহার করে আমাদের লোকেরা কামানগুলো নিয়ে এসে মৃত হাতির দেহগুলোর পিছনে সেগুলো স্থাপন করতে পারে? সে প্রশ্ন করে। আমি সেখানে প্রচুর ঘাস আর ঝোঁপঝাড় দেখেছি যা পোড়ালে প্রচুর ধোয়া সৃষ্টি হবার কথা। কয়েক ঘন্টার ভেতরেই প্রচুর ঘাস আর ঝোঁপঝাড় আমার লোকদের পক্ষে সংগ্রহ করা সম্ভব।’
‘যুবরাজ, এতে কাজ হলেও হতে পারে, ওয়ালী বেগ বিষয়টা নিয়ে ভাবতে ভাবতে বলে।
কাজ হবে। আমরা আমাদের লোকদের আদেশ দিতে পারি তাঁরা যেন নিজেদের বাহুতে সবুজ বা সাদা রঙের কাপড় টুকরো বেধে রাখে যা ধূম্রমেহের ভিতরে তাদের পরস্পরকে সনাক্ত করতে সাহায্য করবে। অবিলম্বে পোড়াবার জন্য ঝোঁপঝাড় সংগ্রহ শুরু করতে লোক পাঠাবার ব্যবস্থা করেন। আমরা রাতের বেলা সেগুলো জায়গামত নিয়ে যাব, এবং ওয়ালি বেগ, আপনি ভোরের আলো ফোঁটার ঘন্টা দুয়েক আগে কামানগুলো স্থানান্তরিত করার কাজ শুরু করবেন যাতে অন্ধকারও আমাদের বাড়তি আড়াল দান করে।
*
পরদিন সকাল চারটার সময় ষাড়ের দল তাঁর প্রথম কামানটা যখন টেনে নিয়ে ধীরে ধীরে উপত্যকার প্রবেশমুখের দিকে অশ্বারোহী প্রহরী সাথে করে এগিয়ে যেতে থাকে খুররম ততক্ষণে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে গিয়েছে। বিভিন্ন স্থানে ইতিমধ্যে পর্যাপ্ত পরিমাণ ঝোঁপঝাড় মজুদ করা হয়েছে যেখান থেকে বাতাস মালিক আম্বারের অবস্থান অভিমুখে ধোয়া প্রবাহিত করে, তার লোকদের দৃষ্টি ঝাপসা করে দেবে। খুররম সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ হওয়া সত্ত্বেও আশা করে যে আগামী কয়েক ঘন্টা এখন যেমন মোটামুটি প্রবল বেগে বাতাস বইছে সেটা যেন দিক পরিবর্তন না করে বা বন্ধ না হয়ে যায়। তার ধারণা প্রায় বিশ মিনিট সময় অতিবাহিত হবার পরে সে গুলির শব্দ পায়। ষাড়ের দলটার তত্ত্বাবধায়করা ইতিমধ্যেই মালিক আম্বারের বেশ কিছু অগ্রগামী প্রহরীদের মোকাবেলা করেছে যাদের সে প্রতিবন্ধকতার বাইরে মোতায়েন করেছিল। খুররম মনে মনে ভাবে, আবিসিনিয়ান আসলেই একজন চৌকষ সেনাপতি, কিন্তু আমিও নিজেকে তার সমকক্ষ হিসাবে প্রমাণ করবো। ভোরের প্রথম আলো উঁকি দিতে শুরু করেছে এবং তার পোয় ব্যবহার করার পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করার সময় হয়েছে। শুকনো পাতার বহ্নৎসবশুরু করো, সে চিৎকার করে বলে, এবং সাথে সাথে একজন অশ্বারোহী তাঁর আদেশ পালনের বিষয়টা নিশ্চিত করতে এগিয়ে যায়। ওয়ালি বেগ আর তাঁর তোপচিদের আগেই নির্দেশ দেয়া হয়েছে হাতির মৃতদেহগুলোর পেছনে একটা সুবিধাজনক সুরক্ষিত স্থানে তারা যখন পৌঁছাতে পারবে তখনই যেন সাথে সাথে কামান থেকে গোলাবর্ষণ করা আরম্ভ করে। সে দুই বা এক মিনিটের ভিতরেই প্রথমবারের মত কামান থেকে গোলাবর্ষণ করার ভারি মন্দ্র শব্দ শুনতে পায়, প্রায় সাথে সাথেই পটকার মত তবকিদের গুলিবর্ষণের শব্দ ভেসে আসে। যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে, এবং মূল যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সে যদিও ছয়শ গজ বা তারও বেশি দূরে অবস্থান করছে তারপরেও খুররম জ্বলন্ত ঝোঁপের গন্ধ অনায়াসে চিনতে পারে। পুরোপুরি যখন সকাল হয় সে দেখে যে ধোয়ার বেশির ভাগ আসলেই মালিক আম্বারের অবস্থানের দিকে বয়ে চলেছে।
খুররম তার সেনাপতিদের কাছ থেকে প্রবল বিরোধিতার সম্মুখীন হলেও সিদ্ধান্ত নেয় যে প্রতিবন্ধকতায় সৃষ্ট ফাটলের ভিতর দিয়ে অশ্বারোহী যোদ্ধাদের আক্রমণের নেতৃত্ব সে নিজে দেবে। সেখানে এখন যেকোনো মুহূর্তে ফাটল দেখা দেবে। সে সহিসকে ডেকে এনে নিজের বিশাল কালো ঘোড়ার পিঠে চেপে বসে এবং দুলকি চালে তার অপেক্ষমান দেহরক্ষী আর কামরান ইকবালের নেতৃত্বাধীন অন্যান্য অশ্বারোহী যোদ্ধাদের সমাবেশের দিকে এগিয়ে যায়। একজন বার্তাবাহককে মাত্র দশ মিনিট পরেই তাদের দিকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়। যুবরাজ, বোয়ার কারণে ঠিক নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না কিন্তু আমাদের ধারণা আমরা নদীর কাছ থেকে বিশ গজ দূরে যেখানে মূলত মালবাহী শকট উল্টে দিয়ে আর ঝোঁপঝাড়ের সাহায্যে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়েছিল সেখানে একটা ফাটল সৃষ্টি করতে সফল হয়েছি।’
কামরান ইকবাল, তাহলে কি আর করা, এবার তাহলে দ্রুত অগ্রসর হওয়া যাক, খুররম উত্তেজনা চেপে রেখে আদেশ দেয়। অন্য যেকোনো যুদ্ধের আগমুহূর্তের চেয়ে নিজেকে এখন তাঁর অনেক বেশি সন্ত্রস্ত মনে হয়। তাঁর হৃৎপিণ্ড দ্রুতবেগে স্পন্দিত হচ্ছে, শিরায় অশ্বের গতি এবং তাঁর মুখ শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। সে অবশ্য ঘোড়ায় চেপে সামনের দিকে অগ্রসর হওয়া শুরু করতে নিজেকে বাধ্য করে মন থেকে সব ভাবনা ঝেড়ে ফেলতে এবং কেবল সামনের ব্যাপারটায় মনোনিবেশ করতে চেষ্টা করে। সে আর তার লোকজন কিছুক্ষণের ভিতরেই প্রথম মৃত হাতিটা পাশ কাটিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যায় এবং বাতাসে এক ঝলকের জন্য ইতিমধ্যে শুরু হওয়া পচনের দুর্গন্ধ তাঁর নাসারন্ধ্রে এসে ধাক্কা দেয়। দুর্গন্ধ আর মৃতদেহের চারপাশে ভনভন করতে থাকা উপলবৎ বর্ণের কালো মাছির দল কারণে এর পেছনে অবস্থিত ব্রোঞ্জের বিশাল কামানগুলো থেকে গোলাবর্ষণ করা মোগল তোপচিদের জন্য একটা মারাত্মক পরীক্ষা। তারা এরপরে যে হাতির মৃতদেহটার পাশ দিয়ে যায় সেটা থেকে আরো প্রবল দুর্গন্ধ ভেসে আসে, সবচেয়ে কষ্টসহিষ্ণু পাকস্থলীর অধিকারীর পক্ষেও বমি চেপে রাখাটা কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। মালিক আম্বারের লোকেরা ধোয়ার কারণে প্রায় অন্ধের মত নিজেদের কামান থেকে পাল্টা গোলাবর্ষণ আরম্ভ করে এবং ভাগ্যক্রমে তাঁদের একটা গোলা এসে মৃত হাতির উদরে বিস্ফোরিত হলে ফুলতে শুরু করা নাড়িভূড়ি ছিন্নভিন্ন হয়ে চারপাশে ছিটকে যায়–সেই সাথে দুর্গন্ধও।
সে বড় করে একটা ঢোক গিলে পাকস্থলী থেকে খাবারের উঠে আসা কোনোমতে দমন করে এবং মুখের চারপাশে জড়ানো সুতির বড় রুমালটা আরও ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে, খুররম তাঁর লোকদের অগ্রসর হবার গতি দ্রুততর করার আদেশ দেয়। ঘূর্ণায়মান ধোয়ার মাঝে বিদ্যমান একটা ফাঁকা স্থানের ভিতর দিয়ে সে দেখে যে মালিক আম্বারের প্রতিবন্ধকতা থেকে তাঁরা মাত্র তিনশ গজ বা তারও কম দূরে রয়েছে কিন্তু সেখানে কোনো ফাটল দেখতে না পেয়ে সে আতঙ্কিত হয়ে উঠে। ঘোয়ার আচ্ছাদন তারপরে আবার সরে যায় এবং এক মুহূর্তের জন্য সে তার বামপাশে নদীর কাছাকাছি ফাটলের মত কিছু একটা দেখতে পায় তারপরেই কেবল সে বিশ্বাস করে। ফাটল দেখা দিয়েছে!’ সে প্রাণপণে চিৎকার করে উঠে। ‘বামদিক দিয়ে আক্রমণ করো!
সে নিজের আদেশ অনুসরণ করে কালো ঘোড়ার পাঁজরে গুতো দিয়ে ঝড়ের বেগে ছুটতে করে। এক মিনিটেরও কম সময়ের ভিতরে ধোয়ার মাঝে অবরোধকটা আবছাভাবে আবির্ভূত হয়ে পুনরায় আবার আড়ালে চলে যায়। অবরোধকটা কেবল আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে। সে তাই বাধ্য হয় লাগাম শিথিল করতে এবং নিজের পর্যাণের উপরে সামনের দিকে ঝুঁকে এসে খুররম অবরোধকের অবশিষ্টাংশ লাফিয়ে অতিক্রম করার জন্য তার বাহনকে তাড়া দেয়, দূর থেকে দেখে যা প্রায় তিন ফিট উঁচু বলে মনে হয়। ঘোড়াটা তার নিতম্ব আর পিছনের পায়ের মাংসপেশি পুরোটা শক্তি ব্যবহার করে সামনের দিকে লাফ দিয়ে অনায়াসে প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে যায়।
সে এখন শত্রু শিবিরের ভেতরে, তাঁর দেহরক্ষীরা দ্রুততার সাথে তাকে অনুসরণ করে। তোপচিদের নিরস্ত্র করতে চেষ্টা করো, সে চিৎকার করে বলে। অবরোধক বরাবর ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে ভাসমান ধোয়ার মাঝে, সে একটা কামানের সামনে এসে পড়ে যা মুহূর্তের ভিতরে গোলাবর্ষণ করবে। সে তার ভারি কিন্তু নিখুঁত ভারসাম্যের তরবারিটা মাথার উপর থেকে মাত্র একবার অর্ধবৃত্তাকারে চালনা করে সলতেয় অগ্নি সংযোগ করতে ব্যস্ত তোপচিকে কবন্ধ করে দেয়। নিজের মুখে ছিটকে আসা উষ্ণ রক্তের স্বাদ অনুভব করার মাঝেই দ্রুত আরো দু’বার তরবারি চালিয়ে সে অন্য দু’জনের ভবলীলা সাঙ্গ করে, একজন কামানে বারুদ ভরার জন্য ব্যবহৃত লোহার দণ্ড ধরে দাঁড়িয়েছিল আর অন্যজনের হাতে ছিল কামানে ভরার জন্য বারুদের থলে। তাঁর দেহরক্ষীরা তখনও তাকে চারপাশ থেকে ঘিরে অবস্থান করছিল, সে এর ভেতরেই অবরোধক বরাবর আস্কন্দিত বেগে সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে আরেকটা কামানের গোলন্দাজদের তাদের সহায়তায় আহত কিংবা নিহত করে। সে এরপরে শত্রু শিবিরের আরো ভেতরে প্রবেশ করার জন্য দ্রুত বহমান নদীর নুড়িময় উপান্তের দিকে ঘুরে, তাঁর ইচ্ছে শত্রুপক্ষের আরো বেশি সংখ্যক যোদ্ধাকে যুদ্ধের জন্য প্রলুব্ধ করে টেনে আনে এবং তাঁদের ধ্বংসের নিয়ামক হয়।
সে তার লোকদের সাথে নিয়ে বেশ কয়েকজন তবকিকে কচুকাটা করে যাঁরা অবরোধকের চারপাশের লড়াই থেকে ইতিমধ্যে পালাতে শুরু করেছিল। কিন্তু সহসা মালিক আম্বারের অশ্বারোহী যোদ্ধাদের সঙ্ঘবদ্ধ একটা দল ধোয়ার ভেতর দিয়ে তাঁর ডানদিক থেকে বের হয়ে এসে পাশ থেকে তাঁর নিজস্ব অশ্বারোহীদের আক্রমণ করার জন্য প্রচণ্ড বেগে ছুটে আসে, তাদের আক্রমণের প্রাথমিক ধাক্কা সামলাতে না পেরে প্রতিপক্ষের দু’জন ভূপাতিত হয়। খুররম তাঁর আক্রমণকারীদের মুখোমুখি হবার জন্য নিজের কালো ঘোড়া চক্রাকারে ঘুরিয়ে নিয়ে দু’জন আক্রমণকারী যখন তার পাশ দিয়ে অতিক্রম করছে তখন তাদের লক্ষ্য করে তার তরবারি দিয়ে আঘাত করে চায়। তাঁর প্রতিপক্ষের একজন যোদ্ধা তাঁর আঘাত এড়িয়ে গেলেও অন্যজন নিজের পাকস্থলীতে গভীর একটা ক্ষত নিয়ে নিজের পর্যাণ থেকে মাটিতে আছড়ে পড়ে।
খুররম এরপর যখন খুব কষে লাগাম টেনে ঘুরতে চেষ্টা করে তাঁর প্রথম প্রতিপক্ষকে পুনরায় আক্রমণ করতে, আরেকজন শত্রু তার লম্বা বর্শা দিয়ে প্রাণপনে তাকে ধাক্কা দেয়। বর্শার ফলা তার বুকের বর্মে বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং ভিতরে প্রবেশ না করে পিছলে সরে যায় কিন্তু এত প্রবল শক্তিতে আঘাতটা করা হয়েছিল যে, সে ঘোরার সময় আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ায়, খুররম তার ঘোড়র উপর থেকে একপাশে ছিটকে গিয়ে হুড়মুড় করে নদীর কিনারের মাটিতে আছড়ে পড়ে। সে নিচে থেকে উপরের দিকে তাকিয়ে দেখে বর্শাধারী অশ্বারোহী পুনরায় তার দিকে বর্শা তাক করেছে। সময় মনে হয় যেন থমকে থেমে গিয়েছে এবং সহসাই তার মনে হয় আরজুমান্দকে তার আবার দেখতে খুব ইচ্ছা করছে এবং সে যদি অশ্বারোহীর গতিপথ থেকে নিজেকে সরিয়ে না নেয় তাহলে সে আর কোনোদিনই তাকে দেখতে পাবে না। সে একেবারে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করে থাকে, বস্তুতপক্ষে অশ্বারোহী প্রাণঘাতি আঘাতের জন্য বর্শা ইতিমধ্যেই পিছনে নিয়ে গিয়েছে। সে তারপরে পানির মাঝে আর নুড়িপাথরের উপর দিয়ে গড়িয়ে একপাশে সরে যায়। সে গড়িয়ে সরে যাবার ভিতরেই কোমরের পরিকর থেকে ছুঁড়ে মারার জন্য বিশেষভাবে প্রস্তুত করা একটা খঞ্জর টেনে বের করে এবং প্রতিপক্ষের উদ্দেশ্যে সেটা ছুঁড়ে মারে। খঞ্জরটা লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে ব্যর্থ হলেও শত্রুর ঘোড়ার পশ্চাদ্ভাগে আঘাত হানলে জম্ভটা পিছনের পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পিঠের আরোহীকে পিছনের দিকে ছিটকে ফেললে বিরাট শব্দ করে সে পানিতে অবতরণ করে।
খুররম চার হাতপায়ের উপর ভর করে নদীর অগভীর স্থানের ভিতর দিয়ে বাতাসের অভাবে খাবি খেতে থাকা লোকটা কাছে যায় এবং তার উপরে নিজেকে ছুঁড়ে দেয়। সে তার গলা আঁকড়ে ধরে, হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে কণ্ঠার হাড়ে ধাক্কা দেয় আর শক্ত করে চেপে রাখে যতক্ষণ না সে লোকটার ভিতর থেকে জীবনের সব ধরনের চিহ্ন বিলুপ্ত হয় এবং তাঁর দেহটা অসাড় হয়ে পড়ে। লাশটা একপাশে সরিয়ে রেখে, খুররম অনেক কষ্ঠ করে নিজের পায়ে উঠে দাঁড়ায় এবং টলমল করতে করতে নদীর পানি থেকে উঠে আসে, তাঁর পরনের কাপড় থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে এবং পায়ের নাগড়া পানিতে বোঝাই, তারপরেও প্রাণে বেঁচে রয়েছে বলে ভাগ্যকে ধন্যবাদ দেয়। সে পানি থেকে উঠে আসার সময়েই তার এক দেহরক্ষীকে তাঁর কালোর ঘোড়ার লাগাম ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। নদীর তীরে তাঁর দেহরক্ষীদের অন্তত পাঁচজনের দেহ নিথর হয়ে পড়ে রয়েছে যখন তাঁদের দু’জন সহযোদ্ধা আরেকজনের বাহুর গভীর এক ক্ষতস্থান সেলাই করতে সাহায্য করছে, এক তরুণ রাজপুত, বেচারা দাঁতে দাঁত চেপে রেখে ক্ষতস্থান সেলাই করার সময়ে যন্ত্রণায় চিৎকার করা থেকে নিজেকে বিরত রেখেছে। খুররম অবশ্য ঘোড়ার পিঠে পুনরায় আরোহণ করে চারপাশে তাকিয়ে দেখে খুশি হয় যে তার নিজের লোকদের চেয়ে তার শত্রুদের অনেক বেশি মৃতদেহ পড়ে রয়েছে এবং তাঁরা পশ্চাদপসারণ করে, যুদ্ধক্ষেত্রের এই অংশটা মোগলদের অনুকূলে পরিত্যাগ করেছে। মালিক আম্বারের লোকেরা কোথায় গিয়েছে?
নদীর তীর বরাবর উপত্যকার শেষপ্রান্তের দিকে তাদের আরো সঙ্গীসাথীদের নিয়ে পশ্চাদপসারণ করেছে।’
‘আমরা কি অবরোধকের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছি?
‘হ্যাঁ, যুবরাজ, কামরান ইকবাল প্রশ্নের উত্তর দেয়, সে দ্রুত শ্বাস নিতে নিতে এই মাত্র এসে উপস্থিত হয়েছে। কয়েকটা স্থানে বিচ্ছিন্নভাবে প্রতিরোধ গড়ে উঠলেও আমরা সহজেই তাদের পরাস্ত করেছি।’
‘বেশ, পশ্চাদপসারণকারীদের তাহলে পিছু ধাওয়া করা যাক, কিন্তু হুশিয়ার। আগুন নিভতে শুরু করেছে আর ধোয়ার আড়াল দ্রুত সরে যাচ্ছে। আমরা এখন অনেক বেশি দৃশ্যমান আর তবকি এবং গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকা তীরন্দাজদের কাছে আমরা এখন অনেক সহজ নিশানা। আমরা তাই দ্রুত অগ্রসর হবো আর পুরোটা সময় নদীর তীর অনুসরণ করবো যেখানে সামান্য হলেও কিছুটা প্রতিবন্ধকতা রয়েছে।
খুররম কথা বলার মাঝেই গোড়ালি দিয়ে তাঁর ঘোড়ার পাঁজরে আবারও গুতো দেয় এবং নদীর তীর বরাবর এগিয়ে যাওয়া শুরু করে। সে আর তার লোকজন অচিরেই যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালাতে থাকা তীরন্দাজ আর পদাতিক সৈন্যদের একটা দলকে আক্রমণ করে। সবাই নিজেদের অস্ত্র ফেলে দেয় কিন্তু একজন তীরন্দাজ সম্ভবত মৃত্যু নিশ্চিত জেনেই অবনত হয় আর খুররমের দিকে ধনুক তাক করে। খুররমের দেহরক্ষীদের একজন তাঁর পিঠে তরবারির আড়াআড়ি এক কোপ বসিয়ে দিয়ে তাকে মাটিতে ফেলে দেয় কিন্তু তার আগেই সে তার কালো পালকযুক্ত তীরে মৃত্যুর মন্ত্র দিয়ে যুবরাজের দিকে নিক্ষেপ করে। তীরটা তাঁর গিল্টি করা পর্যাণে বিদ্ধ হবার আগে তাঁর উরুতে আচড় কেটে যায়। খুররম কোনো ব্যাথা অনুভব করে না কিন্তু বেশ বুঝতে পারে তার পা বেয়ে রক্ত পড়তে শুরু করেছে। সে বিষয়টা পাত্তা না দিয়ে আরও কয়েকশ গজ ঘোড়া নিয়ে সামনে এগিয়ে যায় যতক্ষণ না একটা ফাঁকা জায়গায় স্থাপিত কয়েক সারি তাবুর কাছে এসে পৌঁছে। পুরো এলাকাটা পরিত্যক্ত মনে হয় এবং বেশ কয়েকটা তাবুতে আগুন জ্বলছে, খুব সম্ভবত মালিক আম্বারের পশ্চাদপসারণকারী লোকের কাজ।
খুররম তাঁর দেহরক্ষীদের নিয়ে অস্থায়ী শিবির পেছনে ফেলে নদীর তীর বরাবর সামনের দিকে এগিয়ে যায় যা দু’পাশের পাহাড় ক্রমশ উঁচু এবং চারপাশ থেকে আরও ঘিরে আসায় প্রতিমুহূর্তে আরও সংকীর্ণ হয়ে আসছে। সহসা গাছের আড়াল থেকে গুলি বর্ষণের শব্দ ভেসে আসে এবং দেহরক্ষীদের একজন কপালে গাদাবন্দুকের তিলক নিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। নদীতে বিদ্যমান একটা বাঁক ঘুরতেই, খুররম সামনে গাছের কাণ্ড ফেলে তৈরি করা একটা অবরোধক দেখতে পায় যার পেছন থেকে কয়েকজন তবকী গুলি করছে। তাঁর সামনে পথটা এতটাই সংকীর্ণ যে সে ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিতে ব্যর্থ হয়ে সরাসরি অবরোধক অভিমুখে ঘোড়া হাকালে বন্দুকের গুলি তার চারপাশের বাতাস কেটে বের হয়ে যায়। অবশ্য, ভাগ্য তার সহায় থাকে এবং সে আর তার বাহন কালো ঘোড়াটা কোনো আচড় ছাড়াই গাছের গুঁড়ির তৈরি অবরোধক লাফিয়ে অতিক্রম করে। প্রতিরোধকারীরা প্রায় সাথে সাথে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে এবং চারপাশের গাছপালা অভিমুখে পালিয়ে যায়। কিন্তু একজন যোদ্ধা, যার গায়ের কৃষ্ণবর্ণ ত্বক আর মুখাবয়বের বৈশিষ্ট্যের কারণে তাকেও মালিক আম্বারের মতই আবিসিনিয়ান বংশোদ্ভূত বলে মনে হয়, গাছের গুঁড়িতে পা আটকে গিয়ে হাত পা ছড়িয়ে মাটিতে আছড়ে পড়ে। তাকে জীবন্ত বন্দি করো!’ খুররম চিৎকার করে উঠে। তাঁর দু’জন দেহরক্ষী সাথে সাথে তাঁর আদেশ পালন করতে নিজেদের ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফিয়ে মাটিতে নেমে কৃষ্ণবর্ণের পরিশ্রান্ত লোকটার দু’হাত দু’পাশ থেকে চেপে ধরে।
‘লোকটাকে আমার কাছে নিয়ে এসো, খুররম আদেশ দেয়। তারা তাই করে, তাঁর সামনে তাকে জোর করে হাঁটু মুড়ে বসতে বাধ্য করে। মালিক আম্বার কোথায়? খুররম দরবারে এবং বয়োজ্যেষ্ঠ আধিকারিকদের সাথে আলোচনার সময় ব্যবহৃত পার্সী বদলে হিন্দিতে প্রশ্নটা করে।
আপনাকে যদি বন্দি করা হতো তাহলে আপনি কখনও আপনার সেনাপতির অবস্থানের কথা বলতেন না এবং আমিও বলবো না। কিন্তু সহজাত প্রবৃত্তির বশে সে আড়চোখে একবার উপত্যকার কিনারের দিকে তাকাতে নিজের অজান্তেই সে সত্যি কথা প্রকাশ করে ফেলে। সে তার দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকাতে নুড়িপাথরে ভর্তি পাহাড়ী ঢলের শীর্ষদেশে কয়েকটা অবয়ব দেখতে পায়। এই উপত্যকা থেকে বের হবার একটা পথ সেখানে রয়েছে, তাই না?
অবয়বগুলো দেখতে পেয়ে লোকটা অনেকটাই শমিত হয়েছে, এবং প্রশ্নের উত্তরে বলে, “আপনি যদি গাছের ডালপালা দিয়ে আমাদের তৈরি মইয়ের ব্যবস্থাকে বাইরে বের হবার পথ বলতে চান, তাহলে হ্যাঁ আছে। কিন্তু ব্যবস্থাটা আপনার কোনো কাজে লাগবে না। ঘোড়া মই ব্যবহার করতে পারবে না এবং আমাদের সেনাপতি আর তার সাথে যেসব সৈন্যরা রয়েছে তাদের জন্য উপরে আগে থেকেই ঘোড়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং আপনি পিছু ধাওয়া করার কোনো প্রচেষ্টা নেয়ার অনেক আগেই তারা নাগালের বাইরে চলে যাবে।
‘সে যা বলেছে সেটার সত্যতা যাচাই করে দেখো, খুররম তার দেহরক্ষীদের উদ্দেশ্যে বলে, কিন্তু হুশিয়ার। সামনে আরও আক্রমণকারী ওঁত পেতে থাকতে পারে।’
*
খুররম সেদিন সন্ধ্যাবেলা আরজুমান্দের সান্নিধ্যে শুয়ে থাকে। তার উরুর ক্ষতটা ততটা মারাত্মক নয় এবং সেখানে এখন সাদা সুতি কাপড়ের পট্টি বাধা রয়েছে আর সেও গোসল করে পরিচ্ছন্ন হয়েছে। তার লোকজন বাইরে দারুণ হৈ-হট্টগোলের মাঝে নিজেদের বিজয় উদযাপন করছে। সে কিছুটা সময় তাঁদের সাথে অতিবাহিত করেছে তারপরে হেকিমের তাবুতে গিয়ে আহতদের পরিচর্যার বিষয়ে খবর নিয়ে অবশেষে আরজুমান্দের কাছে ফিরে এসেছে। সেনাপতি হিসাবে তার প্রথম একক অভিযানে বিজয়ের আনন্দে যুদ্ধে আহত সৈন্যদের কষ্ট আর আবিসিনিয়ান যোদ্ধা যে সত্যি কথাই বলেছে–মালিক আম্বার আসলেই পালিয়ে গিয়েছে, এই তথ্য খানিকটা কালিমা লেপন করেছে। অবশ্য যুদ্ধবন্দি আর নিহত সৈন্যদের লাশ গণনা করে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়েছে যে সে নিজের সাথে খুব বেশি হলে কয়েক’শ যোদ্ধা নিয়ে যেতে পেরেছে। আহমেদনগরের সুলতানের সেনাবাহিনী পরাস্ত হয়েছে। তাকে এখন শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য দেনদরবার করতে হবে। মোগল বিজয় অর্জিত হয়েছে।
*
আগ্রা দূর্গের পাশে যমুনা নদীর তীরে খুররমের সেনাবাহিনী শ্রেণীবদ্ধভাবে দণ্ডায়মান রয়েছে। অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে ইস্পাতের বর্মসজ্জিত রণহস্তির সারি সুশৃঙ্খলভাবে বিন্যস্ত–যেহেতু এটা যুদ্ধের নয় উৎসবের সময়–আজ তাদের গজদাতে কোনো তরবারি সংযুক্ত করা হয়নি, যা তাঁদের মাহুতেরা সোনালী রঙ করে দিয়েছে। কমলা আর লাল রঙের পাগড়ি পরিহিত রাজপুত রক্ষীবাহিনী পরিবেষ্টিত অবস্থায় সোনালী রঙ করা শিঙের সাদা ষাড় দিয়ে টেনে নিয়ে আসা মালবাহী শকটগুলোয় রয়েছে. খুররমের বাহিনীর দখল করা ধনসম্পদ ভর্তি বাক্স।
খুররম নিজেও একেবারে সামনের সারির সেনাপতিদের থেকে বিশ কদম আগে তাঁর কালো স্ট্যালিয়নে প্রাণীটা যুদ্ধক্ষেত্রে দারুণ সাহসিকতার সাথে তাকে সহযোগিতা করেছে উপবিষ্ট অবস্থায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। সোনালী রঙের আনুষ্ঠানিক মাথার সাজ আর সবুজ মখমলের ভারি পর্যাণের কাপড় যা প্রায় মাটি ছুঁইছুই করছে ঘোড়াটা অভ্যস্ত না হওয়ায় থেকে থেকেই অস্থির ভঙ্গিতে নড়াচড়া করছে আর মাথা ঝাঁকাচ্ছে। শান্ত হও বাছা, খুররম বিড়বিড় করে বলে, জন্তুটার ঘামে চিকচিক করতে থাকা গলায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দেয়। তোমার উচিত আমাদের নিরাপদে ফিরে আসা লোকদের উদ্যাপন করতে এবং আমাদের বিজয়ে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করতে দেয়া। সহসা দূর্গপ্রাকারের পুরোটা দৈর্ঘ্য জুড়ে অসংখ্য ক্র্য ধ্বনিত হতে জাহাঙ্গীর সেখানে আবির্ভূত হয়ে হাত নেড়ে বিজয়ী মোগল বাহিনীকে স্বাগত জানায়।
জাহাঙ্গীরের হাতের আন্দোলিত ভঙ্গি দেখে যমুনার অপর তীরে, কনুই দিয়ে ধাক্কাধাক্কি করতে থাকা এবং আরেকটু ভালো করে দেখার জন্য চোখ কুঁচকে তাকিয়ে থাকা জনতার মাঝ থেকে উল্লসিত গর্জন ভেসে আসে। একটা খেপাটে আকাঙ্খ সহসা খুররমকে আবিষ্ট করে তার ইচ্ছে হয় নিজের ঘোড়া নিয়ে কালচে বাদামি পানি সাতরে অতিক্রম করে এবং উফুল্ল, মুগ্ধ দর্শকদের কাতারে গিয়ে যোগ দেয়। বিজয় আর জনগণের স্বহর্ষ করতালি কি সবসময়ে এত ভালো অনুভূতির সৃষ্টির করে? কিন্তু এসব চিন্তা দূরে সরিয়ে সে আবার উপরের দিকে তাকিয়ে দেখে তাঁর আব্বাজান প্রস্থান করেছেন। তাঁর কাছে যাবার এবার সময় হয়েছে। খুররম তার দেহরক্ষীদের দ্বারা অনুসৃত হয়ে দুলকি চালে ঘোড়া নিয়ে দূর্গ অভিমুখে খাড়াভাবে উঠে যাওয়া ঢালু পথটার দিকে এগিয়ে যায়। আরজুমান্দ সেখানে একটা রাজকীয় হাতির পিঠে পান্নাখচিত হাওদায়, দৃষ্টিগোচর হওয়া থেকে রেশমের পর্দা দিয়ে সৃষ্ট আড়ালে তার জন্য অপেক্ষা করছে। বারোজন অশ্বারোহী দেহরক্ষী–গুরুত্বের স্মারক হিসাবে জাহাঙ্গীরের প্রেরিত–তার হাতির পিছনে জোড়ায় জোড়ায় বিন্যস্ত হয়ে অবস্থান করছে। আগ্রায় তার স্ত্রীর বিজয়দৃপ্ত প্রত্যাবর্তনে তাঁর প্রতিরক্ষা সহচর হিসাবে সামনে অবস্থানকারী সৈন্যদের খুররম মনোনীত করেছে যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের প্রদর্শিত সাহসিকতার কথা বিবেচনা করে। খুররম সব শেষে আসা নিজের দেহরক্ষীদের আদেশ দিয়ে সামনে তার জন্য নির্ধারিত স্থানে অবস্থান নেয় এবং ঢাল দিয়ে অগ্রসর হতে সে নিজের দাস্তানাবৃত হাত দিয়ে তাঁর ক্ষুদ্র বহরের উদ্দেশ্যে ইশারা করে।
প্রধান তোরণগৃহের নিচে দিয়ে অতিক্রম করে তারা দূর্গে প্রবেশ করতে অতিকায় দামামাগুলো গুরুগম্ভীর শব্দে বেজে উঠে এবং পরিচারকের দল গিল্টি করা গোলাপের পাপড়ি আর চাঁদ এবং তারার মত দেখতে সোনা আর রূপার তৈরি ক্ষুদ্র অলঙ্কার মুঠো মুঠো ছুঁড়ে দেয় যা তাঁদের চারপাশে ভাসতে ভাসতে নিচে পড়ে। বাঁকানো আর খাড়া ঢাল দিয়ে তাঁরা উপরে উঠা অব্যাহত রাখলে খুররম লক্ষ্য করে প্রতিটা দেয়ালে ব্রোকেডের সবুজ পট্টি বাঁধা রয়েছে। তাঁরা শীঘ্রই আরেকটা তোরণদ্বার অতিক্রম করে এবং প্রাচীরবেষ্টিত প্রধান আঙিনায় এসে পৌঁছে, যার শেষপ্রান্তে রয়েছে তাঁর আব্বাজানের বহু স্তম্ভবিশিষ্ট তিন দিক খোলা, দেওয়ানি আম। আঙিনাটা অভিজাত অমাত্যদের ভীড়ে গিজগিজ করছে কিন্তু ঠিক মধ্যেখানে গোলাপের পাপড়ি শোভিত একটা প্রশস্ত পথ খালি রাখা হয়েছে। পথটার শেষ মাথায় একটা বেদীর উপরে সিংহাসনে উপবিষ্ট অবস্থায় সে তার আব্বাজানের ঝলমলে অবয়র দেখতে পায়।
জাহাঙ্গীর যেখানে বসে রয়েছে খুররম যখন সেখান থেকে ত্রিশ ফিট দূরে রয়েছে, সে তার হাত তুলে পিছনের শোভাযাত্রাকে থামার ইঙ্গিত করে এবং ঘোড়া থেকে নেমে দাঁড়ায় যাতে করে সে তার আব্বাজানের কাছে পায়ে হেঁটে যেতে পারে। সে বেদীর দিকে দুই কি তিন কদম এগিয়েছে যখন সে জাহাঙ্গীরের ডাক শুনতে পায়, ‘দাঁড়াও। আমিই আসছি তোমার কাছে।
চারপাশ থেকে রুদ্ধশ্বাস বিস্ময়ের শব্দ ভেসে উঠে। বিজয়ী সেনাপতিকে স্বাগত জানাতে নিজের সিংহাসন থেকে সম্রাটের নেমে আসা–এমনকি আপন রক্তসম্পর্কিত আত্মীয়ের ক্ষেত্রেও–অভূতপূর্ব একটা ঘটনা। জাহাঙ্গীর ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়, সিংহাসন থেকে বেদীর কিনারে হেঁটে আসে এবং মার্বেলের ছয়টা নিচু ধাপ বেয়ে নিচে নামে। খুররম তাকিয়ে দেখে তার দিকে এগিয়ে আসার সময় আব্বাজানের রত্নখচিত পাগড়ির সারসের পালক দুলছে এবং কীভাবে তার কানে, গলায় আর আঙুলের হীরকখণ্ড শুভ্র আগুনের ন্যায় জ্বলজ্বল করছে, কিন্তু সে এসব কিছু এমনভাবে তাকিয়ে দেখে যেন সে স্বপ্ন দেখছে।
তাঁর আব্বাজান যখন মাত্র কয়েকফিট দূরে অবস্থান করছে, খুররম হাঁটু ভেঙে বসে পড়ে এবং মাথা নত করে। জাহাঙ্গীর তার চুল স্পর্শ করে, তারপরে বলে, ‘জিনিষটা নিয়ে এসো।’ খুররম আড়চোখে উপরে তাকিয়ে দেখে একজন পরিচারক ছোট একটা সোনার ট্রে নিয়ে এগিয়ে আসছে যার উপরে কিছু একটা স্তূপ করা রয়েছে–কি রয়েছে সে দেখতে পায় না–আর তাঁর আব্বাজান তাঁর কাছ থেকে সেটা নেয়। খুররম আবার দৃষ্টি নত করে এবং পরমুহূর্তে সে বুঝতে পারে তাঁর আব্বাজান ট্রের জিনিষগুলো তাঁর মাথায় আলতো করে ছোঁয়ান। তাঁর চারপাশে স্বর্ণমুদ্রা আর দামী রত্নপাথর বৃষ্টির মত ঝরে পড়তে থাকে।
‘আমার বিজয়ী আর প্রিয়তম পুত্র তোমায় স্বাগতম, তাঁর আব্বাজান বলছে সে শুনতে পায়, তারপরে নিজের কাঁধে জাহাঙ্গীরের হাত অনুভব করে, তাকে তুলে দাঁড় করায়। আমি চাই এখানে উপস্থিত সবাই সেনাপতি এবং আমার পুত্র হিসাবে তোমার জন্য আমার উচ্চ ধারণার কথা জানুক। তোমায় নিয়ে আমার গর্বের স্মারক হিসাবে, আমি আজ তোমায় শাহ জাহান উপাধিতে ভূষিত করছি, যার মানে পৃথিবীর অধিশ্বর।’
গর্বে খুররমের বুকটা ফুলে উঠে। সে অনেক আশা নিয়ে যুদ্ধাভিযানে যাত্রা করেছিল কিন্তু সেই সাথে সে কতটা সাফল্য লাভ করতে পারবে সেটা নিয়ে খানিকটা বিচলিতও ছিল। সে এখন একটা কাজ ভালো করে সমাপ্ত করার প্রগাঢ় সন্তুষ্টি বোধ করে। সে তাঁর আব্বাজানের কাছে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেছে এবং তিনিও সেটার প্রশংসা করেছেন। তাঁর আব্বাজানের উত্তরাধিকারী হিসাবে তার মনোনীত হবার উচ্চাশা পরিপূরণে নিশ্চিতভাবে এখন কোনো কিছুই আর প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারবে না।
১.১১ লাল মখমলের জুড়িগাড়ি
মেহেরুন্নিসা সম্রাটের একান্ত ব্যক্তিগত কক্ষের লাগোয়া বারান্দায় একপ্রান্ত ঘেষে স্থাপিত রেশমের চাঁদোয়ার নিচে থেকে তাকিয়ে দেখে। প্রচেষ্টা সার্থক হয়েছে। দক্ষিণে খুররমের বিজয়ের সংবাদ এসে পৌঁছাবার পর থেকেই সে এই অন্তরঙ্গ উদ্যাপনের বিষয়টা পরিকল্পনা করছিলো। খাবারের বন্দোবস্ত ছিল চমৎকার, বিশেষ করে তাঁর নির্দেশে তাঁর পার্সী রাধুনির তৈরি করা পদগুলো–ডালিমের রসে ফোঁটান তিতিরের মাংস, আখরোট আর পেস্তা দিয়ে ঠাসা আস্ত ভেড়ার রোস্ট, জাফরান এবং শুকনো টক চেরী সহযোগে দিয়ে রান্না করা পোলাও–এবং মিষ্টি আঁশের, সুগন্ধিযুক্ত তরমুজ আর জাম যা জাহাঙ্গীরের পছন্দ। তাঁর আদেশে শেষের পদটা বরফ চূর্ণ পাত্রে পরিবেশন করার বদলে এমন একটা ট্রে’র উপরে পরিবেশিত হয় যার নিম্নভাগে মুক্তা আর হীরক খণ্ড বিছানো রয়েছে। সঙ্গীত শিল্পী, নর্তকী আর পায়রার ঝক ভালোমতই মনোরঞ্জন করেছে, কিন্তু এখন সবাই বিদায় নিয়েছে এবং তারা চারজন কেবল একাকী রয়েছে।
আরজুমান্দকে দেখতে দারুণ রূপসী দেখাচ্ছে, বারান্দার চারপাশের দেয়ালে আয়নাযুক্ত ক্ষুদ্র চোরকুঠরিতে রক্ষিত তেলের জ্বলন্ত প্রদীপের আলোয় আপন ভাস্তিকে খুটিয়ে দেখতে দেখতে মেহেরুন্নিসা ভাবে। জাহাঙ্গীর তাকে তার কন্যা জাহানারর ভূমিষ্ঠ হওয়াকে স্মরণীয় করে রাখতে রুবি আর পান্নার যে মুকুটটা দিয়েছিল সেটায় তাকে ভীষণ মানিয়েছে। সেইসাথে মাতৃত্বের অভিজ্ঞতা। আরজুমান্দ আবারও গর্ভবতী হয়েছে এবং তাঁর ত্বক আর চুল যেন বাড়তি জেল্লা ছড়াচ্ছে। মেহেরুন্নিসা গোড়ালির কাছে ফুলে থাকা রেশমের চওড়া লাল পাজামার উপরে তাঁর সংক্ষিপ্ত আঁটসাট চোলির কারণে নিরাভরণ নিজের মসৃণ, সমতল উদরের দিকে চোখ নামিয়ে তাকায়। সে প্রতি মাসে সন্তান ধারণের লক্ষণের জন্য আশা করে থাকে এবং প্রতি মাসে তাকে হতাশ হতে হয়। তার খুব ইচ্ছে জাহাঙ্গীরের ঔরসে সন্তানের জন্ম দেয়া–বিশেষ করে পুত্রসন্তান। সে তাকে তাহলে আরো বেশি ভালোবাসতে ব্যাপারটা সেরকম নয়, কিন্তু এটা দীর্ঘ সময়ের জন্য তাঁদের আরো কাছাকাছি বেঁধে রাখবে এবং অন্যদের চোখে তার মর্যাদা আরো বাড়িয়ে দেবে। মোগল রাজবংশের সাথে তাঁর নিজের রক্তের মিশ্রণ এবং পুরুষানুক্রমে সেটা উত্তরপুরুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়ছে চিন্তা করতেই কেমন ভালো লাগে। কিন্তু সময় শেষ হয়ে আসছে। তার দেহ যদিও এখনও সুঠাম আর হালকা পাতলা রয়েছে কিন্তু গতমাসে সাল্লা তার দীঘল কালো চুলের বেণীর মাঝে একটা পাকা চুল খুঁজে পেয়েছে। প্রথমবারের মত সেটা পাওয়া গেলেও নিশ্চিতভাবেই এটা শেষবার নয়।
তাঁর পরিবারের অন্য আরেকজন অল্পবয়সী সদস্য–আরজুমান্দ যে এরচেয়ে বরং সম্রাটদের জননী আর পিতামহী হতে পারে। মেহেরুন্নিসা ভোজসভা শুরু হবার সময় তাকে হাতির দাঁতের বোতামযুক্ত, সাদা রেশমের মুক্তাখচিত যে জোব্বা উপহার দিয়েছে তাঁর ভাস্তি এই মুহূর্তে সেটা খুররমকে দেখাচ্ছে। সে তার পাশে উপবিষ্ট জাহাঙ্গীরের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে তাকে নিজের পুত্র আর আরজুমান্দের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে তার অভিব্যক্তিতে পরিষ্কার গর্বের ছাপ ফুটে রয়েছে। সেদিনই সন্ধ্যাবেলা তিনি তাকে বলেছিলেন, দাক্ষিণাত্যে পারভেজের পরিবর্তে খুররমকে পাঠাবার তোমার পরামর্শটা ঠিক ছিল। আমি নিশ্চিত ছিলাম না সে এমন দায়িত্বের যোগ্য হয়েছে কিনা কিন্তু আমার চোখে যা ধরা পড়েনি তুমি সেটা দেখতে পেয়েছিলে–যে যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় সাহসিকতার সাথে সাথে তাঁর সেই বুদ্ধিও রয়েছে।’
কিন্তু খুররম এখন যখন তাঁর আব্বাজানের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে কিছু একটা বলে আর জাহাঙ্গীর হাসি মুখে উঠে দাঁড়িয়ে তার দিকে এগিয়ে যায়, সহসা একটা সন্দেহ তাঁর মনে উঁকি দিয়ে যায়। তাঁর পরিবারের উপকারের জন্য–সেই সাথে তাঁর নিজের ভাস্তির সুখের কথা বিবেচনা করে–খুররমের সাথে আরজুমান্দের বিয়ের ব্যাপারটাকে বাস্তবতা দিতে সে তার ক্ষমতায় যতটুকু সম্ভব সব কিছুই করেছে। তাঁর মনে একটা বিষয়ে কখনও কোনো ধরনের সন্দেহ ছিল না যে খুররম যদি তার আব্বাজানকে অভিভূত করতে পারে সেটা তার নিজের পরিবারের জন্য মঙ্গলজনক হবে–এজন্যই সে জাহাঙ্গীরকে পরামর্শ দিয়েছিল তাকে দাক্ষিণাত্যের নেতৃত্ব দিতে। কিন্তু যদি তাঁর নিজের স্বার্থ আর তার বৃহত্তর পরিবারের স্বার্থ পরস্পর থেকে আলাদা হয়ে যায়? খুররম কতটা সুচারুভাবে দায়িত্ব পালন করবে, জাহাঙ্গীর কতটা মুগ্ধ হবে এর মাত্রা সে আন্দাজ করতে পারেনি… সেদিনই দুপুরের দিকে দেওয়ানি আমের সিংহাসনের একপাশে অবস্থিত জালি পর্দার পেছন থেকে সে যখন তাকিয়ে ছিল তখন জাহাঙ্গীরকে নিজের সিংহাসন থেকে নেমে এসে নিজ সন্তানের মাথা মোহর আর রত্নপাথর বর্ষিত করতে দেখে সে ভীষণ অবাক হয়েছে। তিনি তাকে একবারও বলেননি যে এমন। একটা পদক্ষেপের পরিকল্পনা তিনি করছেন, এটাও বলেননি যে তিনি এরপরই, ঠিক যেমনটা তিনি করেছেন, খুররমকে যুদ্ধের সময় লাল তাবু ব্যবহারের অধিকার আর সেই সাথে কিসার ফিরোজের শাসকের উপাধি দান করবেন–দুটো বিষয় পরিষ্কার ইঙ্গিত করছে যে তিনি তাকে তাঁর উত্তরাধিকারী হিসাবে ঘোষণা করতে ইচ্ছুক।
খুররম এখন যখন দরবারে ফিরে এসেছে জাহাঙ্গীর তাকে সম্ভবত সাম্রাজ্য পরিচালনার কাজে আরো বেশি করে নিয়োজিত করতে চাইবেন। খুররম, তাঁর চেয়ে হয়ত, তাঁর কাছে বেশি বিশ্বস্ত হয়ে উঠবে যার প্রতি তিনি স্বাভাবিকভাবেই বেশি মনোযোগ দেবেন। জাহাঙ্গীরকে, সম্রাট হিসাবে, নিয়মিত অনেক দায়িত্ব পালন আর তত্ত্বাবধান করতে হয়। সে নিশ্চিত, তাঁর উদ্যম আর স্বচ্ছ চিন্তাশক্তির কারণে জাহাঙ্গীরের এই বোঝার অনেকটাই সে পালন করতে সক্ষম–বস্তুতপক্ষে সে ইতিমধ্যেই তাঁর কাছে এর প্রমাণ রাখতে শুরু করেছে। তিনি মাত্র কয়েক মাস পূর্বে কাবুলের উত্তরপশ্চিম দিকে ভ্রমণরত বণিকদের শিবিরে রাতের বেলা ডাকাতদের আক্রমণের ব্যাপারে তাঁদের অভিযোগের ব্যাপারে তাকে বলেছিলেন। তাঁর পরামর্শ তাকে এতটাই প্রীত করেছিল যে তিনি ট্রাঙ্ক রুট বরাবর আরো অনেকগুলো রাজকীয় সরাইখানা নির্মাণের আদেশ দেন যেখানে পর্যটকের দল নিজেদের জন্য নিরাপদ আশ্রয় এবং তাদের পণ্য আর পশুর জন্য সুরক্ষিত আস্তাবল নিশ্চিতভাবে খুঁজে পাবে।
এমন নয় যে সে কেবল এসব গতানুগতিক বিষয়েই সাহায্য করতে পারবে। সে ইতিমধ্যে জটিল সিদ্ধান্তের কারণে জাহাঙ্গীরের উপরে চেপে বসা দুশ্চিন্তার ভার উপলব্ধি করতে পেরেছে। সে যদি সাথে সাথে আবেগ কিংবা প্রণোদনার বশে কাজ না করে–যার জন্য সে প্রায়শই অনুতপ্ত হয়–সে প্রায়ই সেগুলো ফেলে রাখে, এবং বিশেষ করে সে যখন হতবুদ্ধি বা উদ্বিগ্ন থাকে মনকে প্রশান্ত করতে সে সামান্য আফিম আর সুরার আশ্রয় নেয়। সে তাঁর আব্বাজানের কাছে এবং জালি পর্দার পেছন থেকে জাহাঙ্গীরের উপদেষ্টাদের বৈঠকের আলোচনা শুনে রাজকীয় দপ্তর পরিচালনার ব্যাপারে অনেক কিছু জেনেছে বলে দায়িত্ব ভাগাভাগি করতে পারবে… এবং তাঁর কাছে এটা কেবল একটা দায়িত্ব না বরং গভীর সন্তুষ্টির বিষয়।
জাহাঙ্গীরের উচ্চগ্রামের হাসিতে তাঁর ভাবনার জাল ছিন্ন হয়। খুররম নিশ্চয়ই তাকে আমোদিত করার মত কিছু একটা বলেছে এবং তিনি তাঁর পুত্রের কাঁধ চাপড়ে দিচ্ছেন। খালি চোখে দেখলে একটা সুখী পারিবারিক দৃশ্য বলে মনে হবে কিন্তু মেহেরুন্নিসার কাছে সহসাই এই দৃশ্যটা অনেক অশুভ কিছু একটা সম্ভাবনা উপস্থাপন করে এবং অনেক আগেই এটা বুঝতে না পারার জন্য সে নিজেরই উপরেই ক্রুদ্ধ হয়ে উঠে। তাকে জীবনে আরো একবার অপেক্ষা আর পর্যবেক্ষণ করতে হবে কিন্তু নিজের স্বার্থের ব্যাপারে তাকে সব চেয়ে বেশি দৃষ্টি রাখতে হবে। জাহাঙ্গীরের কাছে অন্য কেউ না বরং সে নিজে কতটা গুরুত্বপূর্ণ জাহাঙ্গীর যেন সেটা বুঝতে পারে তাকে এটা প্রথমে নিশ্চিত করতে হবে।
*
‘জাহাপনা, ইংল্যান্ড থেকে আগত দূত দেওয়ানি আমের বাইরে অপেক্ষা করছেন,’ শরতের এক পড়ন্ত বিকেলবেলা মেহেরুন্নিসার সাথে নিজের একান্ত ব্যক্তিগত কক্ষে বসে থাকার সময় কর্চি এসে বলে।
‘চমৎকার। আমার পরিচারকদের আসতে বলো। তাঁর পরিচারকেরা তাকে সজ্জিত করার কাজ শুরু করলে সে মুচকি হাসে। সে এই বৈঠকের জন্য খানিকটা কৌতূহল নিয়ে অপেক্ষা করেছিল। মোগল রাজদরবারে আট সপ্তাহ আগে সংবাদ আসে যে সুরাট বন্দরে ইংল্যান্ড থেকে একজন দূত এসেছে। আগ্রা অভিমুখে দূত মহাশয়ের অগ্রসর হবার গতি মন্থর হওয়ায় তিনি উপহার সামগ্রী আগেই প্রেরণ করেছিলেন। উপহার সামগ্রীগুলোর একটা, উঁচু চাকার উপরে প্রকাণ্ড তরমুজের আকৃতির গিল্টি করা একটা অদ্ভুত দর্শন জুড়ি গাড়ি–জাহাঙ্গীর আগে কখনও এমন কিছু দেখেনি–তাকে ভীষণ প্রীত করে যদিও লাল মখমলে ছত্রাকের দাগ রয়েছে–নিঃসন্দেহে প্রত্যন্ত দ্বীপ যেখান থেকে দূতমহাশয় লবণাক্ত স