.
২.১৩
আগ্রাতে আমার সাথে দেখা করতে আসতে প্রত্যাখান করেছে সে। দেখ কী লিখেছে…আমি একজন পিতা সুলভ সমস্ত অধিকার হারিয়ে ফেলেছি… জাহানারার সামনে আওরঙ্গজেবের চিঠি বাড়িয়ে ধরলেন শাহজাহান। মাখদুমী খান এখন প্রতিদিন পিতা-কন্যার সাক্ষাতের অনুমতি দিয়েছে।
তাদের কারাদণ্ড শুরু হবার পর থেকে গত ছয় মাস ধরে বহুবার আওরঙ্গজেবকে অনুনয় করে পত্র লিখেছে জাহানারা, যেন পিতার সাথে দেখা করতে আসে সে। যা যা ভাবতে পেরেছে সমস্ত যুক্তি দিয়ে বোঝাতে চেয়েছে–শাহজাহানের বয়স আর অসুস্থতা, পিতার প্রতি একজন পুত্রের দায়িত্ব, এমনকি একদা তার প্রতি আওরঙ্গজেবের ভালোবাসার কথাও মনে করিয়ে দিয়েছে। স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে কেমন করে আগুনে পুড়ে গিয়ে প্রায় মৃত্যুমুখে পতিত হবার পর বোনের শয্যাপাশে থাকার জন্য ছুটে এসেছিল সে। আওরঙ্গজেবের উত্তরগুলো বেশ নস্ত্র কিন্তু শীতল। স্পষ্টতাই বুঝিয়ে দিয়েছে যে পিতার প্রতি বিশ্বস্ত থেকে আওরঙ্গজেবের স্নেহ ও মনোযোগ পাবার সমস্ত অধিকার হারিয়েছে সে। কিন্তু শাহজাহানকে লেখা আওরঙ্গজেবের নিষ্ঠুর শব্দগুলো পড়ে দম বন্ধ হয়ে এলো জাহানারার।
‘আপনি আমাকে আপনার কাছে আসতে বলেছেন। কিন্তু কেন আসব আমি? এতে আমাদের দুজনের কী-ই বা লাভ হবে? জানতে চেয়েছেন আমার পিতা হওয়াতে আপনার সাথে আমি এমন আচরণ কীভাবে করেছি। কিন্তু আমার কাছে কখনোই একজন পিতা ছিলেন না আপনি; তাই আমার উপর কোন দাবিও করতে পারেন না। আমাকে কখনোই ভালোবাসেননি। অন্য সন্তানদের সুবিধাতে অবহেলা করেছেন মায়ের মৃত্যুর পর থেকে আরো বেশি। উপহাস করেছেন যখন আমি পরামর্শ দিয়েছিলাম যে, নিজ জীবনে আর সাম্রাজের ক্ষেত্রেও আমাদের ধর্মীয় শিক্ষাগুলোকে আরো কাছ থেকে অনুসরণ করুন।
ধর্মদ্রোহী দারা আর খুনী মুরাদের প্রতি আমার আচরণকে তিরষ্কার করেছেন আপনি–যেন ব্যাপারটা এরকম যে আমার ভাই হওয়াতে তাদের অপরাধ ক্ষমা করে দেয়া উচিত ছিল আমার। নিজেদের ভাগ্যেরই উপযুক্ত তারা আর আইনের মাঝে থেকেই তাদেরকে শাস্তি দিয়েছি আমি। বস্তুত এমনটা না করলে আমিই নিন্দনীয় হতাম। এর চেয়েও বড় কথা আপনার প্রতিবাদ বিশুদ্ধ কপটতা ছাড়া আর কিছুই নয়। আপনি ভুলে যাবার ভান করছেন যে আপনি আমাদের চাচা খসরু আর শাহরিয়ারকে হত্যা করেছেন অন্য কোন কারণে নয়, এই কারণে যে তারা আপনার আর আপনার উচ্চাকাঙ্খর মাঝে বাধা ছিল। অথচ আমাদের লোকদের প্রথানুযায়ী সিংহাসনের উপরে তাদের দাবি আপনার চেয়ে কোন অংশে কম নয়। আপনি, আমি নই, হত্যাকারী–সত্যিকারের অপরাধী।‘
এক কি দুই মিনিটের মত চুপচাপ বসে রইল পিতা আর কন্যা। এরপর শাহজাহান বলে উঠলেন সে যা লিখেছে তাতে খানিকটা সত্যিও আছে। আমার সত্তাইদের মৃত্যুর জন্য আমিই দায়ী। কিন্তু তোমাদের নিরাপত্তার জন্যেই তারা মারা গিয়েছে–আমার সন্তানদের নিরাপত্তা–আর রাজপরিবারের। তাই মারা গেছে যেন আমার পুত্রেরা, আপন ভাই হিসেবে কখনো এমন বিপদের মুখোমুখি না হতে যা আমার ক্ষেত্রে হয়েছিল। নিজের কাছেও তাদের মৃত্যু নিয়ে সহজ হতে পারি নি কখনো। এখন মনে হচ্ছে অনর্থক হয়েছে সবকিছু…রক্তের প্রাচীন চক্র, পিতার বিরুদ্ধে পুত্র, ভাইয়ের বিরুদ্ধে ভাই আবারো শুরু হয়েছে। আমি নিজেকেই দোষ দিচ্ছি। আমি আত্মপ্রসন্নতায় ডুবে ছিলাম যখন আমার উচিত ছিল কঠোর আর উদ্যমী হবার। বিশ্বাস করেছিলাম প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে যে শত্রুতা মোগলদেরকে চুরমার করে দিয়েছে তা কখনো আমার পরিবারে ঘটবে না।
আওরঙ্গজেবের আচরণ এমন হবে তুমি তো জানতে না।
তুমি বুঝতে পেরেছিলে–তার সম্পর্কে সতর্ক করতে চেয়েছিলে!
না। আমি উদ্বিগ্ন ছিলাম যে আপনারা দুজন একে অপরের কাছ থেকে দূর সরে যাচ্ছেন। কিন্তু কখনোই ভাবিনি যে অতৃপ্তির বশে আপনার বিরুদ্ধে সে বিদ্রোহ করবে বা দারাকে হত্যা করবে… কেঁপে উঠল জাহানারার কণ্ঠস্বর। নিজেকের শান্ত করার চেষ্টা করতে করতে পড়তে লাগল আওরঙ্গজেবের পত্রের বাকি অংশটুকু।
‘কিন্তু এখন বাস্তব ব্যাপারগুলো নিয়ে কথা বলতে হবে আমাকে। আমি দয়ালু হয়ে নতুন অবস্থার সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্যে আপনাকে সময় দিতে চাই। আপনার দুর্ব্যবহার আর অভিযোগ ভরা পত্রগুলোকে মেনে নিয়েছি এমন এক বৃদ্ধের প্রলাপ হিসেবে যার শারীরিক আর মানসিক শক্তি নিঃশেষের দোরগোড়ায় আর যে কিনা মেনে নিতে পারছে না যে সময় বয়ে চলেছে, তিনি আর সম্রাট নন। গত কয়েক মাস ধরে আপনার রাজকীয় মণি-মুক্তা দিয়ে দিতে ক্রমাগত প্রত্যাখান শুনতে শুনতে আমি ক্লান্ত। কিন্তু আমার ধৈৰ্য্যও শেষ হবার পথে। হয় আমি যা চেয়েছি তা পাঠিয়ে দেবেন–তৈমুরের আংটি সহ অথবা আপনার কাছে থেকে নিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করব আমি। আশা করছি মর্যাদা বজায় রেখে পদক্ষেপ নেবেন, বাকি আপনার মর্জি।‘
নড়াচড়ার শব্দ শুনে চোখ তুলে তাকাল জাহানারা। নিজের সব দামি আর মূল্যবান সম্পদ রাখা চামড়ায় মোড়ানো সিন্দুকের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আছেন পিতা। গলায় পেঁচানো পাতলা স্বর্ণের চেন থেকে একটা চাবি নিয়ে খুলে ফেললেন সিন্দুক, ভেতরে হাত ঢুকিয়ে ছড়িয়ে ফেলতে লাগলেন ভেতরের জিনিস–মিনা করা চেন, রুবির হার, পান্না আর হীরা, সোনার ভারী কঙ্কন। কার্পেটের উপর ছড়িয়ে পড়ে আলো ছড়াতে লাগল সবকিছু।