থামল হোথর্ন… যেন নিশ্চিত হতে চাইছে, ওর কথা আসলেই শুনছি কি না আমি।
মাথা ঝাঁকালাম।
পকেট থেকে সিগারেটের আরেকটা প্যাকেট বের করল সে, আরেকটা সিগারেট ধরাল।
বলতে লাগল, ‘ওই কনসালটেন্সি করে নিজের খরচটা ভালোই চালিয়ে নিতে পারছি। দিন-প্রতি একটা ভাতা তো পাই-ই, খরচাপাতি যা-যা লাগে তা-ও দেয়া হয় আমাকে। কিন্তু ইদানীং একটু টানাটানির মধ্যে পড়ে গেছি। কারণ আজকাল আর খুন-টুন তেমন একটা হচ্ছে না। যা-হোক, সেই টিভি শো-তে পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করতে গিয়ে যখন পরিচয় হলো আপনার সঙ্গে, তখন জানতে পারলাম, আপনি নাকি বইও লেখেন। তখনই একটা চিন্তা খেলে গিয়েছিল আমার মাথায়– আমরা একজন আরেকজনকে সাহায্য করতে পারি। বখরা আধাআধি। ইন্টারেস্টিং অনেক কাহিনি জানা আছে আমার। সেসব নিয়ে… মানে, আমাকে নিয়ে লিখতে পারেন আপনি।’
‘কিন্তু… আমি তো বলতে গেলে চিনিই না আপনাকে।’
‘আমাকে চিনতে বেশি সময় লাগবে না আপনার। …এখন একটা কেস আছে আমার হাতে! বেশিদিন হয়নি ওই কেস নিয়ে কাজ করছি, তবে… আমার মনে হয় আপনি যে-ঘরানার লেখক, কেসটা মনঃপুত হবে আপনার।’
আমার কেক আর চা নিয়ে হাজির হলো ওয়েইট্রেস। মনে মনে আফসোস করলাম– কেন যে অর্ডার দিতে গিয়েছিলাম এসব! এগুলো যদি না-দেয়া হতো এখন আমার সামনে, তা হলে যেভাবেই হোক হোথর্নকে পাশ কাটিয়ে বাসার পথ ধরতে পারতাম।
বললাম, ‘একটা কথা বলুন তো। বিখ্যাত শত শত লোক আছে দেশে- বিদেশে। তাঁদের কথা বাদ দিয়ে আপনার কথা কেন পড়তে যাবে লোকে?’
‘কারণ আমি একজন গোয়েন্দা। লোকে গোয়েন্দাকাহিনি পড়তে পছন্দ করে।’
‘কিন্তু গোয়েন্দা বলতে যা বোঝায়, আপনি তো সে-রকম কেউ না আসলে। চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে আপনাকে। …আচ্ছা, ভালো কথা, আপনাকে বরখাস্ত করা হলো কেন, বলুন তো?’
‘ওই ব্যাপারে কথা বলতে চাই না আমি।’
‘দেখুন, আপনি কিন্তু আবারও একগুঁয়েমি শুরু করেছেন। যদি চান আপনাকে নিয়ে কিছু লিখি আমি, তা হলে সব কথা সোজাসুজি বলতে হবে আমাকে। আপনার ব্যাপারে সব কথা জানা দরকার আমার।’
‘যেমন?’
‘কোথায় থাকেন আপনি। বিয়ে করেছেন কি না। ব্রেকফাস্টে কী খেয়েছেন আজ। যখন হাতে কোনো কাজ থাকে না তখন কী করেন… মোদ্দা কথা, আপনার ব্যাপারে সব জানতে হবে আমাকে। …গোয়েন্দাকেই যদি ঠিকমতো জানতে না- পারে লোকে, তা হলে খুনের গল্প পড়বে কেন?’
‘আপনার কি তা-ই মনে হয়?’
‘হ্যাঁ।’
মাথা নাড়ল হোথর্ন। ‘একমত হতে পারলাম না আপনার সঙ্গে। দ্য ওয়ার্ড ইয মার্ডার… মানে, আসল কথা হলো খুন। লোকে পড়বে একটা খুনের গল্প… গোয়েন্দা কীভাবে সমাধান করে হত্যারহস্যটার। গোয়েন্দাকে চিনে কী করবে তারা?’
সেক্ষেত্রে বলতে বাধ্য হচ্ছি, আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। আপনার আইডিয়াটা ভালো ছিল, সন্দেহ নেই যে-কেস নিয়ে কথা বলতে চাইছিলেন সেটা ও দারুণ কিছু-একটা ছিল। কিন্তু আমি আসলেই খুব ব্যস্ত। তা ছাড়া আপনি যে-প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন আমার কাছে, সে-রকম কোনো কাজ করি না আমি। নিজের গোয়েন্দাকে নিজের কল্পনামতো সাজিয়ে নিই, বাস্তবের কারও সঙ্গে মেশাই না। ছোট্ট একটা উদাহরণ দিই, তা হলেই বুঝতে পারবেন। শার্লক হোমসের নাম নিশ্চয়ই শুনেছেন। এই কিছু দিন আগে ওকে নিয়ে একটা কাহিনি লিখে শেষ করলাম। পোয়ারোকে নিয়েও টুকটাক লিখেছি, টিভিতে একটা রহস্যকাহিনি-নির্ভর সিরিযও লিখেছি… নাম মিডসামার মার্ডার্স। মোদ্দাকথা, আমি কল্পকাহিনির লেখক। বাস্তব জীবনের ঘটনা নিয়ে যাঁরা লেখালেখি করেন, তাঁদের কাউকে খুঁজে বের করা উচিত আপনার।’
‘কথা তো একই, তা-ই না? আপনিও লেখক, যাঁদেরকে খুঁজে বের করতে বলছেন তাঁরাও লেখক।
‘না, কথা এক না। আমার প্রতিটা কাহিনির উপর আমার পূর্ণ দখল আছে। যা লিখি আমি, তার আদ্যোপান্ত আমার মাথায় থাকে সব সময়। নিজের মতো করে একটা অপরাধ তৈরি করি আমি, কিছু ক্লু জুড়ে দিই ওই ঘটনার সঙ্গে, তারপর ঘটনাপ্রবাহ সাজাই নিজের মতো করে। গোয়েন্দাকাহিনিকে যদি এভাবে উপস্থাপন করা হয় পাঠকের কাছে, তা হলে তারা মজা পায়, বইয়ের কাটতি বাড়ে। কিন্তু কোনো একটা গোয়েন্দাকাহিনিকে যদি একজন গোয়েন্দার দৃষ্টিভঙ্গিতে বর্ণনা করতে শুরু করি, তা হলে কেমন হবে ব্যাপারটা, ভেবে দেখেছেন? কোথায় কোথায় গেলেন আপনি, সেসব লিখতে হবে আমাকে। কী কী দেখলেন, কার কার সঙ্গে কী কী কথা বললেন, লিখতে হবে সেসবও। ওসবে মজা পাবে না পাঠক।’ মাথা নাড়লাম। ‘আমি দুঃখিত, মিস্টার হোথর্ন। আপনার প্রস্তাবে আগ্রহ পাচ্ছি না।’
সিগারেটের যে-অংশটা পুড়ছে, সেটার উপর দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে হোথর্ন। আশ্চর্য হয়নি সে, অপমানিতও হয়নি। ওকে দেখে মনে হচ্ছে, ওর প্রস্তাবের জবাবে কী বলবো আমি, তা যেন আগে থেকেই জানত।
‘তার মানে আপনি আসলে বইয়ের কাটতি নিয়ে ভাবছেন। কিন্তু যে-কাহিনি শোনাবো আমি আপনাকে, সেটার বিক্রি যদি দারুণ হয়, তা হলে? কোন্ কেস নিয়ে কাজ করছি আমি এখন, সেটা কি শুনতে চান না?’
ওর মুখের উপর সরাসরি বলে দিতে চাইছিলাম, না, চাই না; কিন্তু আমাকে সুযোগটা না-দিয়ে সে বলে চলল, ‘কেসটা একজন মহিলার। একটা ফিউনারেল পার্লারে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন তিনি। পার্লারটা লন্ডনের আরেক প্রান্তে, দক্ষিণ কেনসিংটনে। নিজের শেষকৃত্যানুষ্ঠান কীভাবে করতে চান তিনি, তা নিয়ে বিস্তারিত কথা বললেন ওই পার্লারের ফিউনারেল ডিরেক্টরের সঙ্গে। এবং সেদিনই, ঘণ্টা ছয়েক পর, কেউ একজন খুন করেছে তাঁকে… ঢুকে পড়েছিল তাঁর বাড়িতে, গলায় ফাঁস লাগিয়ে শেষ করে দিয়েছে তাঁকে। এবার বলুন, পুরো ঘটনা কি স্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে আপনার কাছে?’