- বইয়ের নামঃ অ্যাম্পায়ার অব দ্য মোঘল
- লেখকের নামঃ অ্যালেক্স রাদারফোর্ড
- প্রকাশনাঃ রোদেলা প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, উপন্যাস
অ্যাম্পায়ার অব দ্য মোঘল
১.১ প্রথম খণ্ড – তৈমূরের উত্তরাধিকারী
অ্যাম্পায়ার অব দ্য মোঘল – রাইডারস ফ্রম দ্য নর্থ
মূল : অ্যালেক্স রাদারফোর্ড
অনুবাদ : সাদেকুল আহসান কল্লোল
উৎসর্গ : রাকিবুল হাসান
.
প্রধান চরিত্রসমূহ বাবরের পরিবার আর আত্মীয়স্বজন আহমেদ, সমরকন্দের সুলতান, বাবরের চাচাজান এসান দৌলত, বাবরের নানীজান জাহাঙ্গীর, বাবরের সৎ-ভাই। খানজাদা, বাবরের বড়বোন। খুতলাঘ নিগার, বাবরের আম্মিজান উমর শেখ, বাবরের আব্বাজান, ফারগানার সুলতান
বাবরের স্ত্রীরা আয়েশা, মাঙ্গলিঘ গোত্রের প্রধানের কন্যা মাহাম, হুমায়ূনের মা এবং বাবরের প্রিয়তম স্ত্রী গুলরুখ, কামরান আর আসকারীর মা বিবি মুবারক, ইউসুফজাই গোত্রপ্রধানের কন্যা দিলবার, হিন্দালের মা
বাবরের পুত্র হুমায়ূন। কামরান। আসকারী হিন্দাল
বাবরের আত্মীয় সম্পর্কীয় ভাইয়েরা আজাদ খান, ফারগানার অভিজাত ব্যক্তি মাহমুদ, কুন্দুজের সুলতান মির্জা খান, ফারগানার এক গোত্রপতি তামবাল, ফারগানার অভিজাত ব্যক্তি
বাবরের বিশ্বস্ত পারিষদবর্গ বাবুরী, বাজারে বড় হওয়া এক ছেলে এবং বাবরের বিশ্বস্ত বন্ধু বাইসানগার, সমরকন্দের এক সেনাপতি, পরবর্তীতে বাবরের বিশ্বস্ত অধিনায়ক এবং তৎপরবর্তীকালে বাবরের শ্বশুর কাশিম, বাবরের অন্যতম রাজনৈতিক উপদেষ্টা এবং তার হয়ে প্রায়শই দৌত্যের দায়িত্ব পালনকারী ওয়াজির খান, তার পিতার দুধ-ভাই, বাবরের পরামর্শদাতা এবং বাল্যকালে আর সুলতান হবার প্রথম দিকে বাবরের অভিভাবক আবদুল মালিক, ব্যক্তিগত চিকিৎসক
ফারগানা বাবা কাশক, শাহী মহাফেজ বাকি বেগ, শাহী জ্যোতিষ ফাতিমা, প্রধান খিদমতগার কামবার আলী, উজির রেহানা, এক বৃদ্ধা যার দাদা তৈমূরের সাথে দিল্লী আক্রমণে অংশ নিয়েছিল রোক্সানা, বাবরের পিতার রক্ষিতা এবং জাহাঙ্গীরের মা ওয়ালিদ বাট্ট, এসান দৌলতের খিদমতগার ইয়াদগার, ফারগানার বেশ্যালয়ে বাবরের প্রিয় গণিকা ইউসুফ, কোষাধ্যক্ষ
বাবরের অনুগত উপজাতীয় গোত্রপতি আলী দোস্ত, পশ্চিম ফারগানার এক গোত্রপতি আলী ঘোসত, বাবরের প্রধান অশ্ব-পালক এবং পরবর্তীতে প্রধান রসদ সরবরাহকারী আলি মজিদ বেগ, শাহরুখিয়ার জমিদার বাবা ইয়াসাভাল, হিরাটের নিকটবর্তী কোনো স্থানের যোদ্ধা হুসেনি মজিদ, আলি মজিদ বেগের সম্পর্কীয় ভাই এবং গোত্রপতি
মধ্য এশিয়ায় বাবরের প্রধান শত্রু সাইবানি খান, শক্তিশালী উজবেক দলপতি এবং বাবরের গোত্রের আর তৈমূরের বংশধরদের এক পরাক্রমশালী শত্রু
পারস্য পারস্যের শাহ ইসমাইল মোল্লা হুসাইন, শাহ ইসমাইলের অধীনস্ত এক শিয়া মোল্লা
তূর্কী আলি কুলী, ওস্তাদ-গোলন্দাজ
কাবুল বাহলুল আইয়ুব, গ্রান্ড উজির হায়দার তকী, রাজকীয় সিলমোহরের রক্ষক। মুহাম্মাদ-মুকাঈম আর্গহান, হাজারাদের প্রধান ওয়ালি গুল, রাজকীয় কোষাগারের রক্ষক
হিন্দুস্তান বুয়া, ইবরাহিম লোদীর মা। ফিরোজ খান, হিন্দুস্তানী জমিদার গোয়ালিয়রের রাজপরিবার, বিখ্যাত কোহ-ই-নূর, পর্বতের আলো, হীরক খণ্ডের মালিক রানা সাঙগা, রাজপুত রাজ্য মেওয়ার রাজা সুলতান ইবরাহিম লোদী, দিল্লী সালতানাতের সুলতান এবং হিন্দুস্তানের অধিরাজ রোশান্না, বুয়ার খিদমতগার
বাবরের পূর্ব–পুরুষ চেঙ্গিস খান। তৈমূর, পশ্চিমে যাকে তৈমূর লঙ বলা হয়
.
আলোর পর্বত
কোনো অভিযোগ জানাতে আমি লেখনীর আশ্রয় নেইনি; আমার উদ্দেশ্য ছিলো সত্য বয়ান। নিজের প্রশংসা করাও আমার অভিপ্রায় ছিলো না, কেবল ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ছিলো আমার অভীষ্ট। এই ইতিহাসে আমি সত্যের আশ্রয়ে সবকিছু লিপিবদ্ধ করতে চেয়েছি। তার ফলশ্রুতিতে আব্বাজান, আত্মীয় বা আগন্তুকের ভিতরে যা কিছু ভালো বা মন্দ দেখেছি তার সবই আমি লিপিবদ্ধ করার প্রয়াস নিয়েছি। পাঠক আমার সীমাবদ্ধতা ক্ষমা করবেন…
—বাবরনামা, মোঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা
.
প্রথম খণ্ড – তৈমূরের উত্তরাধিকারী
০১.
গেরোবাজের চবুতরায় সংহনন
১৪৯৪ সালের গ্রীষ্মকাল, মধ্য এশিয়ার এক ধূলিময় দূর্গের পোড়া-মাটির প্রাকারবেষ্টিত সমতল ছাদ, দিনের আলোয় যা হাতির চামড়ার মত ধূসর দেখায়, সূর্যাস্তের সময় বাবরের চোখের সামনে এখন সেটাই গোলাপী বর্ণ ধারণ করে। অনেক নিচে জাক্সারটেস নদী ক্রমশ অন্ধকার হয়ে উঠা ভূখণ্ডের দিকে বয়ে যাবার সময়ে একটা স্লান লাল আভার জন্ম দিয়ে যায়। পাথুরে ধাপের উপরে বাবর নড়েচড়ে দাঁড়ায় এবং তার বাবা, এই দূর্গের সুলতানের প্রতি আবার মনোযোগ দেয়। দূর্গের সমতল ছাদে এই মুহূর্তে তিনি তার পরনের আলখাল্লার ফিরোজা রঙের কোমরবন্ধনীতে দু’হাত দৃঢ়মুষ্ঠি করে পায়চারী করছেন। তার বারো বছরের ছেলে আগে বহুবার যে গল্প শুনেছে, সেটা আবার তিনি নতুন করে বলতে শুরু করলে তার চোখে মুখে উত্তেজনার ছন্দ ফুটে উঠে। বাবরের কিন্তু মনে হয় গল্পটা বারবার শুনবার মতো। সে, গল্পটা নতুন করে বলার সময় এর সাথে প্রতিবার যে আনকোরা উপাদান যোগ হয়, সেটা শোনার জন্য কান খাড়া করে থাকে। তার বাবা। গল্পের পরিণতির দিকে এগিয়ে আসলে, সে বাবার কথা বলার সাথে ঠোঁট মেলায়-গল্পের এই একটা অংশ কখনও বদলায় না, তেজোদীপ্ত প্রতিটা শব্দ অলঙ্নীয়ভাবে প্রতিবার উচ্চারিত হয়।
“এবং অবশেষে ব্যাপারটা এমন দাঁড়ায় যে, আমাদের পূর্বপুরুষ মহান তৈমূর যোদ্ধা তৈমূর, যার নামের মানে ‘লোহা’ আর পৃথিবীর উপর দিয়ে ঘোড়ায় চড়ে দাবড়ে যাবার সময়ে তার অশ্বপালের গা থেকে ঘামের মত রক্ত ঝরতো- একটা বিশাল সাম্রাজ্য জয় করেন। যুবক বয়সে যদিও মারাত্মকভাবে জখম হবার কারণে তার এক পা অন্য পায়ের চেয়ে লম্বা হয়ে গিয়েছিল এবং হাঁটবার সময়ে তিনি সামান্য খুঁড়িয়ে হাঁটতেন। তিনি তারপরেও দিল্লী থেকে ভূমধ্যসাগর, সমৃদ্ধ পার্সিয়া থেকে ভলগার অরণ্যভূমি পর্যন্ত একটা বিশাল এলাকা জয় করেছিলেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো সেটা কি তৈমূরের জন্য যথেষ্ট ছিলো? প্রশ্নই ওঠে না! তার শরীর তখনও। শক্তিশালী আর প্রাণবন্ত, পাথরের মত শক্ত তার দেহ আর অফুরন্ত তার আকাঙ্ক্ষা, জীবনের আরো অনেকগুলো বছর তার তখনও উপভোগ করা বাকী। নব্বই বছর আগে চীনের বিরুদ্ধে অভিযানই ছিলো তার শেষ অভিযান। দু’লক্ষ অশ্বারোহী বাহিনীর নির্ভরতার বরাভয়ে তিনি অভিযানে বেরিয়েছিলেন এবং অবশ্যই বিজয় তার পদচুম্বন করতো, যদি আল্লাহতালা তাকে বেহেশতে নিজের সান্নিধ্যে ডেকে না। নিতেন। কিন্তু তৈমূর, মহান যোদ্ধাদের ভিতরে মহানতম- এমন কি তোমার আরেক পূর্বপুরুষ চেঙ্গিস খানের চেয়েও মহান- কিভাবে এসব সম্ভব করেছিলেন? বাছা, তোমার চোখে আমি এই প্রশ্নটাই ভাসতে দেখছি, এবং তোমার অধিকার আছে সেটা জিজ্ঞেস করবার।”
পরম মমতায়, সুলতান তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে, তার দিকে বাবরের টানটান মনোযোগ খেয়াল করেন। তারপরে তিনি আবার বলতে শুরু করেন, কুশীলবের পারঙ্গমতায় তার কণ্ঠস্বরে তখন আবেগ খেলা করতে থাকে।
“তৈমূর ছিলেন সাহসী আর ধূর্ত কিন্তু তার বড় পরিচয় তিনি ছিলেন একজন জাত নেতা। আমার দাদা আমাকে বলেছিলো তার চোখ ছিলো মোমবাতির আলোর মত দূতিহীন, নিষ্প্রভ। মানুষেরা স্তব্ধ আলোর সেই ফাটলের দিকে একবার তাকালে আর চোখ ফিরিয়ে নিতে পারতো না। এবং তৈমূর তাদের আত্মার দিকে তাকিয়ে সেই গৌরবের কথা শোনাতেন শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে যার প্রতিধ্বনি শোনা যাবে এবং পৃথিবীর বুকে তাদের থেকে যাওয়া দেহাস্থির প্রাণহীন ধূলোয় ঘূর্ণি তুলবে। চকচকে সোনা আর দূতিময় রত্নের কথা তিনি শোনাতেন। তার রাজধানী সমরকন্দের দাসবাজারে রেশমের মত কালো চুলের যেসব নিটোল গড়নের মেয়েদের তারা দেখেছে, তিনি তাদের কথা বলতেন। এসব ছাড়াও তিনি তাদের জন্মগত অধিকারের কথা স্মরণ করিয়ে দিতেন। পৃথিবীর অধিশ্বর হবার বকেয়া অধিকারের কথা তাদের মনে করিয়ে দিতেন। তাদের চারপাশে তৈমূরের মন্দ্র কণ্ঠস্বর বয়ে গিয়ে, তাদের মানসপটে সেইসব দৃশ্যের অবতারণা করতো, যা কেবল তাদের পদানত হবার জন্য অপেক্ষা করে রয়েছে আর শীঘ্রই তারা নরকের জ্বলন্ত তোরণের নিচে তার অনুগামী হতো।
“বাছা, তাই বলে তাকে বর্বর ভেবো না।” সুলতান প্রচণ্ড ভঙ্গিতে মাথা নাড়লে তার লালচে-খয়েরী রঙের সিল্কের পাগড়ীর সঞ্জাব এপাশ ওপাশ দুলতে থাকে। “না। তিনি ছিলেন একজন সংস্কৃতিবান মানুষ। তার প্রিয় সমরকন্দ ছিলো রুচি আর সৌন্দর্য, জ্ঞান আর পৃষ্ঠপোষকতার শহর। কিন্তু তৈমূর একটা কথা খুব ভালো করে জানতেন যে, একজন বিজয়ীর সামনে কোনো কিছুই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে না। অভিযান সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত নির্মমতা তার মনপ্রাণ অধিকার করে রাখতে এবং যতবেশি মানুষ সেটার পরিচয় পেতো ততোই মঙ্গল।” তিনি নিজের চোখ বন্ধ করেন এবং পূর্বপুরুষের বিস্ময়কর গৌরবময় দিনগুলো যেনো মানসপটে দেখতে পান। গর্ব আর উত্তেজনার এমন তীব্র একটা রেশ তাকে জারিত কমে যে, তার কপালে স্বেদবিন্দু দেখা দেয়। একটা হলুদ রুমাল বের করে তিনি কপালের ঘাম মোছেন।
বাবর তার বাবার বাচনশৈলীতে সৃষ্ট দৃশ্যকল্পে বরাবরের মতই উল্লসিত হয়ে উঠে। তার দিকে তাকিয়ে হাসে, দেখাতে চায় একই হর্ষোৎফুল্ল গর্বের সেও সমান অংশীদার। কিন্তু সে তাকিয়ে থাকা সত্ত্বেও তার বাবার মুখের অভিব্যক্তি বদলে যায়। তার গভীর চোখে জন্ম নেয়া ঐকান্তিক আলো ম্লান হয়ে আসে এবং সেখানে হতাশার জন্ম হয়। সেখান থেকে আসে বিষণ্ণতা। বাবরের হাসি আড়ষ্ঠ হয়ে উঠে। তার বাবার গল্প সচরাচর তৈমূরের বন্দনার ভিতর দিয়ে শেষ হয়, কিন্তু আজ যেন সুলতানকে কথায় পেয়ে বসেছে। তিনি কথা চালিয়ে যান তার কণ্ঠের উদ্দীপনা মিলিয়ে গিয়ে সেখানে বিষণ্ণ নিরানন্দভাব ফুটে উঠে।
“কিন্তু আমি যদিও আমি মহান তৈমূরের উত্তরপুরুষ-আমার কি আছে? কেবল ফারগানা। এমন একটা রাজ্য যা টেনেটুনে দুইশ মাইল লম্বা বা একশ মাইল চওড়া। চারদিকে তাকিয়ে দেখো- তিনদিকে পাহাড়বেষ্টিত একটা উপত্যকা, যেখানে কেবল ভেড়া আর ছাগলের গলার ঘণ্টার আওয়াজ শোনা যায়।” মেঘাবৃত বেস্তর পর্বতের সুউচ্চ চূড়ার দিকে তিনি হাত তোলেন। “অথচ পশ্চিমে তিনশ মাইল দূরে আমার ভাইয়েরা স্বর্ণমণ্ডিত সমরকন্দের শাসক। আর দক্ষিণে হিন্দুকুশের ওপারে আমার অন্য ভাইয়েরা সমৃদ্ধ কাবুল কজা করে রেখেছে। গরীব আত্মীয় হিসাবে আমি তাদের অবজ্ঞা আর তাচ্ছিল্যের পাত্র। যদিও আমার ধমনীতে- তোমার ধমনীতেও তাদের মত একই রক্ত প্রবাহিত।”
“আব্বাজান-”
“আমরা সবাই যদিও তৈমূর বংশের শাহ্জাদা।” আবেগের আতিশয্যে তাকে থামিয়ে দিয়ে সুলতান বলতে থাকেন, তার সাথে আমাদের কাকে তুলনা করবে? তার বিশাল সাম্রাজ্যের ক্ষুদ্র ভূখণ্ড নিজেদের আয়ত্ত্বে রাখতে আমরা মামুলি গোত্রপতিদের মতো নিজেদের ভিতরে তুমুল ঝগড়ায় ব্যস্ত। বাকি সবার মতো আমিও একই দোষে দোষী।” তার কণ্ঠস্বরে এবার ক্রোধের রেশ পরিষ্কার টের পাওয়া যায়। “তৈমূর যদি আজ জীবিত থাকতেন তবে এই মূর্খতার কারণে আমাদের মুখ দর্শন করতেন না। মির্জা বলে নিজেদের পরিচয় দিতে আমরা গর্ববোধ করি, ‘আমিরের বংশধর, তাকে আমাদের পূর্বপুরুষ হিসাবে উল্লেখ করতে ব্যগ্র হয়ে থাকি, কিন্তু তিনি কি আমাদের নিজের বংশধর বলে স্বীকার করতেন? নিজেদের মহত্ত্ব আর উত্তরাধিকার খুইয়ে ফেলার কারণে কি আমাদের তার সামনে নতজানু হয়ে করুণা ভিক্ষা করা উচিত না?”
সুলতান কঠোর হাতে বাবরের কাঁধ এতো জোরে আঁকড়ে ধরেন যে সে ব্যথা পায়। “বোঝার মতো বয়স তোমার এখন হয়েছে। আমি সে কারণেই এসব কথা তোমাকে বলছি। আমরা তৈমূরের কাছে ঋণী। বাছা আমার, তিনি ছিলেন একজন মহান মানুষ। তোমার ধমনীতে তার রক্তই বইছে। এটা কখনও ভুলে যেয়ো না। যদি পার তারমতো হতে চেষ্টা করবে। তোমার নিয়তির প্রত্যাশা যেনো পূর্ণ হয়, আর সেটা যেনোনা হয় আমার চেয়ে বড়।”
“আব্বাজান আমি চেষ্টা করবো… আমি কথা দিলাম।”
বাবরের চোখের দিকে এক মুহূর্ত তাকিয়ে সুলতান কিছু একটা দেখতে চান। তারপরে সন্তুষ্টচিত্তে, একটা অব্যক্ত শব্দ করে তিনি ঘুরে দাঁড়ান। বাবর সেখানেই চুপ করে বসে থাকে। তার বাবার অপ্রত্যাশিত আবেগ বোধহয় তাকেও স্পর্শ করেছে। তিনি এইমাত্র যা বলে গেলেন সেটা আত্মস্থ করার ফাঁকে, সে তাকিয়ে দেখে যে সূর্য প্রায় অস্তমিত হয়েছে। অন্যান্য দিনের সন্ধ্যার মত, গোধূলির শেষ আলোয় সে দেখে উঁচু-নিচু দৃশ্যপট আবছা হয়ে এসেছে। আধো-অন্ধকার প্রেক্ষাপটের ভেতর থেকে বের হয়ে এসে রাখাল বালকের দল তাদের ভেড়া আর ছাগলের পাল নিয়ে গ্রামের দিকে ফিরে যায়। সেইসাথে কবুতরের ব্যগ্র জোরাল ডাক ভেসে আসে। তার বাবার প্রিয় সাদা পায়রার দল চবুতরায় ফিরে ডানা ঝাপটাচ্ছে।
তার বাবার ঠোঁট থেকে একটা মৃদু দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসবার শব্দ বাবরের কানে আসে, যেন সে স্বীকার করে যে জীবনের প্রাপ্তি আর অপ্রাপ্তির হিসাব মেলানো এখনও বাকী আছে। সে সুলতানকে তার কোমরে ঝোলান চামড়ার ছোট বোতল থেকে একঢোক পানি পান করতে দেখে এবং মুখাবয়বে আবার প্রশান্তির ভাব ফুটে উঠতে, তিনি ঘুরে দাঁড়ান এবং দেয়ালের শীর্ষভাগে অবস্থিত চোঙাকৃতি কবুতরের বাসার দিকে ছাদের উপর দিয়ে তড়িঘড়ি করে এগিয়ে যান, যা নিচের শুষ্ক গিরিখাদের উপরে আংশিক ঝুলন্ত অবস্থায় রয়েছে। পোড়া মাটির মেঝেতে তার পায়ের সোনার জরি দেয়া লাল মখমলের নাগরার শব্দ শোনা যায় এবং তার প্রিয় কবুতরকে উড়ে এসে হাতে বসার আমন্ত্রণ জানিয়ে আর তাদের নধর গলায় প্রেমিকের কোমলতায় হাত বুলিয়ে দেবার অভিপ্রায়ে তিনি ইতিমধ্যে দু’হাত প্রসারিত করে দিয়েছেন। বাবর পুরো বিষয়টার ভিতরে কোনো আকর্ষণ খুঁজে পায় না। নধর মাংসের উড়ন্ত দেহ। তাদের জন্য শ্রেষ্ঠ ব্যবস্থা হলো পালক ছাড়িয়ে নিয়ে আখরোট গুঁড়ো আর ডালিমের আখনিতে হাল্কা আঁচে জ্বাল দেয়া।
বাবরের কল্পনায় আবার তৈমূর আর তার পরাক্রমশালী বাহিনী ফিরে আসে। সারা পৃথিবী তোমার, এমন অনুভূতির আমেজটা কেমন? কোনো শহর দখলের পরে শহরের সুলতানকে তোমার পায়ের কাছে কাতরাতে দেখা? তার বাবার কথাই ঠিক। ছোট্ট এই ফারগানার শাসক হবার থেকে কি আলাদা সে অভিজ্ঞতা। আব্বাজানের দরবারের তুচ্ছ রাজনীতির মারপ্যাঁচ দেখে সে বিরক্ত। প্রধান উজির কামবার-আলী যার ঘামে ভেজা আলখাল্লা থেকে সবসময়ে বুড়ো খচ্চরের মত দুর্গন্ধ বের হয়। হলুদ হয়ে যাওয়া লম্বা দাঁতের কারণে তাকে অবশ্য সেরকমই দেখায়। আর সবসময়েই সে বিপদের আঁচ পাচ্ছে। রক্তলাল চোখে সে সবসময়ে ব্যগ্র কেউ তাদের কথা শুনছে কি না খুঁজতে। তার বাবার কানের কাছে অনবরত ফিসফিস করে কথা বলে চলেছে। তৈমূর এই কুৎসিত নির্বোধটার মাথা বিন্দুমাত্র ভাবনার অবকাশ না দিয়ে ধড় থেকে আলাদা করে দিতেন। বাবর ভাবে, অচিরেই, যখন সে সুলতানের পদে অভিষিক্ত হবে, সম্ভবত সে নিজেই সেটা করবে।
শীঘ্রই নামাযের ওয়াক্ত হবে আর তারপরে জেনানামহলে খেতে যাবার সময়। সে সিঁড়ির ধাপ থেকে লাফিয়ে নামে। ঠিক সেই মুহূর্তে প্রচণ্ড শব্দে সে কিছু একটা ভেঙে পড়তে শোনে, তার পায়ের নিচে ছাদের মেঝে কেঁপে উঠে। কয়েক লহমা পরে কিছু একটা ধ্বসে পড়ার ভেতা আওয়াজ ভেসে আসে। একহাত দিয়ে দেয়াল ধরে সে নিজেকে আগে ধাতস্থ করে এবং বুঝতে পারে চোখে কিছু দেখছে না। এসব কিসের আলামত? মাঝে মাঝে দূর্গকে যা কাঁপিয়ে তোলে সেরকম আরেকটা ভূমিকম্প? না, এবারের শব্দটার ধরণ আলাদা ছিলো। অভিঘাতের উত্তেজনায় সে নিজের অজান্তেই শ্বাসরোধী ধূলিকণা বুকে টেনে নেয় আর চোখ ছাপিয়ে পানির ধারা নেমে আসে দৃষ্টি স্বচ্ছ করার অভিপ্রায়ে। সহজাত প্রবৃত্তিতে বাবর মাথা আর মুখ আড়াল করে। এমন সময়ে সে দ্রুত কারো দৌড়ে আসবার শব্দ শুনতে পায়। এবং টের পায় একজোড়া শক্ত হাত তাকে আঁকড়ে ধরে এবং তুলে পেছনে নিয়ে আসে। “শাহজাদা, আপনি এখন নিরাপদ।”
ভারী কণ্ঠস্বরটা তার পরিচিত। তার বাবার দেহরক্ষী বাহিনীর প্রধান ওয়াজির খানের কণ্ঠ। “কি বলতে চান আপনি…?” কথা বলতে তার রীতিমত কষ্ট হয়: মুখের ভেতরটা শুকিয়ে কাঠ আর কেমন কাঁকড়ময় একটা অনুভূতি এবং জিহ্বার আকৃতি যেনো সহসা মুখের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। তার কথা কেমন জড়ান আর দুর্বোধ্য শোনায় এবং সে আবার বলতে চেষ্টা করে। “কি হয়েছিলো…?” অনেক কষ্টে সে বলে। “ভূমিকম্প ছিল না, তাই না?”
প্রশ্নটা করে বাবর নিজেই অনেক কষ্টে তার পানিপূর্ণ চোখের পাতা খুলে এবং উত্তরটা নিজের চোখেই দেখতে পায়। ছাদের যেখানে পায়রার চবুতরা ছিল সেখানের একটা বিশাল অংশ বেমালুম গায়েব হয়ে গেছে, যেনো কোনো অতিকায় হাত পিঠার একটা কোণা ভেঙে নিয়েছে। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহে শুষ্ক আর ফাটল ধরা অংশটা আর ভার বহন করতে পারেনি। কবুতরের দল বাতাসে তুষারকণার মত উড়াউড়ি করছে।
দীর্ঘকায় সৈনিকের নিরাপদ বাহুর বেষ্টনী থেকে মোচড় খেয়ে মুক্ত হয়ে বাবর সামনের দিকে এগিয়ে যায়। বাবাকে আর দেখতে পাবে না এই অনুভূতিটা সহসা তার পেটের ভেতরে একটা বিশাল শূন্যতার জন্ম দেয়। সুলতানের ভাগ্যে কি ঘটেছে? “সুলতান, অনুগ্রহ করে পিছনে সরে আসেন।”
বাবর ধবংসস্তূপে পরিণত হওয়া ছাদের টিকে থাকা অংশের উপর দিয়ে সন্তপণে এগিয়ে গিয়ে নিচের গিরিখাতের দিকে উঁকি দিতে তার কপালে শীতল ঘামের সৃষ্টি হয়। ধীরে ধীরে থিতিয়ে আসা ধূলোর কুয়াশার ভিতর দিয়ে সে কবুতরের চবুতরা আর দেয়ালের ভেঙে পড়া অংশটুকু নিচের পাথুরে ভূমিতে শতধাবিভক্ত হয়ে পড়ে রয়েছে দেখতে পায়। সেখানে তার বাবার কোনো চিহ্ন সে খুঁজে পায় না। তারপরে বাবর পাথরের ফাটলে জন্ম নেয়া একটা ঝোঁপের ডালে তার বাবার লালচে-খয়েরী রঙের পাগড়িটা কাত হয়ে ঝুলে থাকতে দেখে। চবুতরার সাথে সে নিশ্চয়ই নিচে আছড়ে পড়েছে। ভেতর থেকে উঠে আসা ভয়ের একটা কাঁপুনি দমন করে বাবর ভাবে, সুলতান ধ্বংসস্তূপের নিচে আহত অবস্থায় চাপা পড়েছেন এবং সম্ভবত মৃত।
সে নিচের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। এমন সময় দূর্গের পাদদেশে অবস্থিত তোরণ থেকে জ্বলন্ত মশাল নিয়ে সৈনিকেরা বেরিয়ে এসে পাথরের উপর দিয়ে দ্রুত গিরিখাদের ভেতরে নামতে শুরু করে।
“অপদার্থের দল, জলদি করো!” ওয়াজির খান বাবরের পাশে এসে তাকে পুনরায় নিরাপদ বেষ্টনীর মধ্যে নিয়ে সৈনিকদের লক্ষ্য করে চেঁচিয়ে ওঠে। তারা দুজনে নিরবে সন্ধ্যার ঘনিয়ে আসা অন্ধকারে সৈনিকদের মশালের কমলা আভায় তাদের ধবংসস্তূপ সরিয়ে খুঁজতে দেখে। একজন একটা মৃত কবুতর খুঁজে পায় এবং ক্ষুদ্র নিথর দেহটা অপাংক্তেয়ভাবে একপাশে ছুঁড়ে ফেলে। কোথা থেকে একটা বাজপাখি এসে- ছো মেরে মৃত কবুতরটা নিয়ে আবার আকাশে উড়ে যায়।
“আব্বাজান…” বাবর তার দেহের কাঁপুনি কিছুতেই থামাতে পারে না। নিচের গিরিখাদে উদ্ধারকারী দল পাথর আর মাটির একটা বড় চাই সরাতে সে তার নিচে কাপড়ের টুকরোর মত কিছু একটা দেখতে পায়। বাবার আলখাল্লার অংশ। কিছুক্ষণ আগেই সেটার রঙ ছিল ধুসর আকাশী। এখন রক্তে ভিজে সেটা লাল আর নীলের মিশ্রণে রক্তবর্ণ ধারণ করেছে। আরও কিছু অধীর মুহূর্ত অতিক্রান্ত হয়। সৈনিকেরা তার বাবার দেহ ধবংসস্তূপের নীচ থেকে বের করে নিয়ে আসে। উপর থেকে বাবরের কাছে সেটা কবুতরের নিথর দেহের মত দোমড়ানো প্রাণহীন মনে হয়। সৈনিকেরা এবার উপরে দাঁড়িয়ে থাকা সেনাপতির দিকে পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে নির্দেশের জন্য তাকায়।
ওয়াজির খান ইশারায় সুলতানের দেহটা তাদের দূর্গের অভ্যন্তরে নিয়ে আসতে বলে। আদেশটা দিয়ে সে বাবরকে আরও ভেতরের দিকে নিয়ে এসে আলতো করে তার দৃষ্টি ধ্বংসযজ্ঞের দিক থেকে সরিয়ে নিয়ে আসে। তার চোখে-মুখে এখন কঠোর অভিব্যক্তি, সেই সাথে বাবরের দিকে তাকাতে সেখানে বুঝি চিন্তার ঝিলিক দেখা যায়। তারপরে সে হাঁটু ভেঙে মাটিতে বসে সেজদার ভঙ্গিতে কপাল মাটিতে ঠেকায়। “মির্জা বাবর ফারগানার নতুন সুলতানের জয় হোক। আপনার পিতার রুহ্ পাখির মত উড়ে যেন বেহেশতের দ্বার অতিক্রম করে।”
বাবর একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। যেন সে এইমাত্র যা বলেছে সেটা বুঝতে চেষ্টা করে। তার পিতা- কিছুক্ষণ আগেও প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর একটা মানুষ- ফারগানার সুলতান, এখন মৃত। সে আর কখনও তার কণ্ঠস্বর শুনতে পাবে না, বা মাথায় তার ভারী হাতের উষ্ণ স্পর্শ অনুভব করবে না, বা ভালুকের প্রবলতায় বাবা আর কখনও তাকে আলিঙ্গন করবে না। ফারগানার উপত্যকায় শিকারের অভিযানে সে আর কখনও তার সঙ্গী হবে না। তাঁবুর আগুনের সামনে তার পাশে গুটিসুটি হয়ে বসে রাতের বাতাসে সৈন্যদের গানের গুনগুন শব্দ মিশে যেতে শুনবে না। বাবর নিরবে কাঁদতে শুরু করে। তারপরে পেটের গভীর থেকে উঠে আসা তীক্ষ্ণ বিলাপে তার কিশোর দেহ কেঁপে কেঁপে উঠে।
কান্নার ভিতরেই সন্দেহ আর অনিশ্চয়তা, সেই সাথে তীব্র শোক তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। এখন সে সুলতান… তার বংশগৌরব, মৃত্যুর আগ মুহূর্তে বাবার বলে যাওয়া আশা কি সে পূরণ করতে পারবে? কোনো অব্যক্ত কারণে তার বাবার মুখাবয়বের বদলে সেখানে কৃশ আরো বৃদ্ধ একজনের মুখ, যার চোখের নিম্নাংশের হাড় বেশ বেঁকে নেমে এসেছে এবং শীতল আর দৃঢ়প্রতিজ্ঞ চোখে “দীপ্তিহীন মোমের আলো”র মত দৃষ্টি ভেসে উঠে। আর সেটা ভেসে উঠতে সে যেনো তার বাবার মন্ত্রগুপ্তির মতো আউড়ানো কথাগুলো শুনতে পায়: “তৈমূরের রক্ত আমার ধমনীতে প্রবাহিত।” নিজের অজান্তে সে কথাটার পুনরাবৃত্তি শুরু করে, প্রথমে আস্তে আস্তে পরে সেখানে প্রত্যয়ের বরাভয় বেশ অনুভব করা যায়। তৈমূর আর তার বাবা দু’জনের প্রত্যাশাই সে সফল করবে। বুক টান করে দাঁড়িয়ে ধূলিধূসরিত অশ্রুসিক্ত মুখ আলখাল্লার হাতায় মুছে নিয়ে সে ঘুরে দাঁড়ায়। “এইমাত্র এখানে যা ঘটে গেছে সেটা আমিই আম্মাজানকে বলবো।”
***
উত্তেজিত হওয়া সত্ত্বেও কামবার আলি স্পষ্ট টের পান তার অল্প বয়সী সুন্দরী স্ত্রী ফরিদা আজ অন্যান্য দিনের চেয়ে অনেক বেশি যন্ত্রবৎ সহবাসের দাম্পত্য দায়িত্ব পালন করছে। নানা কারণে প্রধান উজিরের মন আজ বিক্ষিপ্ত অশান্ত হয়ে রয়েছে। সুলতানের আকস্মিক অসাধারণ শাহাদাতবরণ তাকে গভীর চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। আর এ থেকে লাভবান হতে চাইলে সিদ্ধান্ত নেবার জন্য তার হাতে সময় খুবই কম। বারো বছরের এক বালক সুলতান হবে? হতে পারে… কিন্তু আবার না হলেই বা কি ক্ষতি। কুঁচকিতে দ্রুত পানির ছিটে দিয়ে সে জরির কাজ করা ঘন নীল রঙের আলখাল্লা গায়ে কোনোমতে জড়িয়ে নিয়ে পেছনে একবারও না তাকিয়ে ফরিদার কামরা থেকে বের হয়ে যায়।
দপদপ করে জ্বলতে থাকা তেলের প্রদীপে আলোকিত দূর্গের আভ্যন্তরীণ গলিপথের ভিতর দিয়ে এগিয়ে যাবার সময়ে শাহী হারেম থেকে ভেসে আসা বিলাপের ধ্বনি সে শুনতে পায়। বাবরের মা আর নানিজান, আঁদরেল দুই মহিলা, তাদের যুগল কণ্ঠস্বর ভেসে আসতে সামান্য যেটুকু সংশয় অবশিষ্ট ছিল সেটাও দূর হয়। আনুষ্ঠানিক শোকপ্রকাশ তাহলে শুরু হয়েছে। এই দুজনের ব্যাপারে সর্তক থাকতে হবে। তারা শোকে এতটা দিশেহারা হবে না যে, বাবরের স্বার্থ কিংবা নিরাপত্তার বিষয়ে তাদের কোনো খেয়াল থাকবে না।
প্রধান উজির রাজকীয় দরবারের দিকে এগিয়ে যায়, যেখানে সে অন্যান্য রাজকীয় অমাত্যদের ডেকে পাঠিয়েছে। দরবারের সবুজ চামড়ার উপরে পিতলের গজাল আটকানো দরজা দু’জন প্রহরী ভেতরে প্রবেশের জন্য খুলে ধরতে, সে দেখে তিনজন রাজ-কর্মচারি ইতিমধ্যে সেখানে এসে উপস্থিত হয়েছে: ইউসুফ, রাজকীয় কোষাগারের নির্ভীক কোষাধ্যক্ষ, কোষাগারের সোনালী চাবি একটা লম্বা চেনের সাহায্যে তার চওড়া গলায় ঝুলছে; বাকি বেগ, রাজ-জ্যোতিষী, যার রুগ্ন অস্থির আঙ্গুল তসবী জপছে; এবং লোমশ ভ্রর পাকানো তারের মত শরীরের বাবা কাশক রাজকীয় বাজার সরকার। ওয়াজির খান কেবল অনুপস্থিত।
শূন্য সিংহাসনের নিচে সুন্দর নকশা করা পুরু লাল গালিচার উপরে অসম দর্শন তিনজন আসন-পিঁড়ি হয়ে বসে অপেক্ষা করছে। অধিকার শূন্য বিধায় সিংহাসনটাকে ছোট, গুরুত্বহীন আর মলিন দেখায়, সোনার গিল্টিতে হাল্কা দাগ পড়েছে। আর লাল মখমলের সোনার টাসেলযুক্ত কুশনে সময় আর ব্যবহারের ছাপ স্পষ্ট বোঝা যায়।
“বেশ,” কামবার আলী উপস্থিত লোকদের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, “এমন ঘটতে পারে কে আর আগে থেকে ভেবেছিলো?” আরো কিছু বলবার আগে সে চুপ করে তাকিয়ে থেকে তাদের চোখের ভাষা পড়তে চেষ্টা করে।
“আল্লাহতা’লার মর্জি বোঝা ভার।” বাকি বেগ নিরবতা ভেঙে বলে উঠে।
“কি পরিতাপের কথা তুমি নিয়তির গর্ভে কি লুকিয়ে আছে দেখতে পাওনি। অন্তত একবারের জন্য হলেও তারকারাজি তাদের রহস্য তোমার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতে পেরেছে।” বাবা কাশক বলেন।
রাজজ্যোতিষী বাজার সরকারের বিদ্বেষপূর্ণ বাক্যবাণে ক্ষিপ্ত হয়ে ক্রুদ্ধ চোখে তার দিকে তাকায়। “ঈশ্বর চান না যে মানুষ সবসময়ে তার নিয়তির কথা জানতে পারুক- বিশেষ করে একজন সুলতান, যে তার প্রজাদের কাছে ঈশ্বরের মতোই প্রতাপশালী আর তার মতই তাদের দণ্ডমুণ্ডের হর্তাকর্তা।”
“আমি তোমাকে ক্ষিপ্ত করতে চাইনি, কিন্তু সুলতান যদি নিজের মৃত্যুর কথা আগে জানতে পারতেন, তাহলে নিশ্চয়ই তিনি বারো বছরের বালককে তার উত্তরাধিকারী হিসাবে মনোনীত করতেন না,” বাবা কাশক মুদুস্বরে কথাটা বলে আক্ষেপের সাথে মাথা নাড়ে।
কামবার আলীর নাড়ীর স্পন্দন সহসা বেগবান হয়ে উঠে। “বটেই তো। রাজ্য আর রাজত্ব টিকিয়ে রাখতে শক্তিশালী, পরিণত নেতার প্রয়োজন। সুলতানের মৃত্যু সংবাদ শুনতে পেলে সাইবানী খান আর তার মোঙ্গল বর্ণসংকরের দল আমাদের সীমান্তের কাছে এসে হাঁকডাক শুরু করবে। তৈমূরের বংশের সুলতানদের চোখ উপড়ানো কাটা মুণ্ড দিয়ে সে একটা মিনার তৈরি করবে বলে শপথ নিয়েছে। একটা পুঁচকে ছোকরা তার কবল থেকে ফারগানাকে বেশি দিন স্বাধীন রাখতে পারবে না।”
সবাই মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়, সবার মুখে বিষণ্ণতার মুখোশ আঁটা। যেনো ফারগানার কল্যাণই তাদের একমাত্র বিবেচ্য বিষয়।
“উজবেকরাই কেবল আমাদের একমাত্র ভয়ের কারণ না। আমাদের মরহুম সুলতান তার নিজের পরিবারেই অনেক শত্রুর জন্ম দিয়েছেন- সমরকন্দের সুলতান, তার জ্ঞাতী ভাইয়ের রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চল দখলে তার অভিযানের কথা নিশ্চয়ই তিনি এখনও ভুলে যাননি।”
“অবশ্যই সমরকন্দের সুলতান নিজে একজন শক্তিমান যোদ্ধা।” কামবার আলী মৃদু কণ্ঠে মনে করিয়ে দেয়। “মোঘুলিস্তানের খানও কম শক্তিশালী না।” শেষবার ফারগানা সফরে এসে খান স্বর্ণমুদ্রায় ঠাসা বেগুনী মখমলের একটা থলে তার লোভী হাতে গুঁজে দিয়েছিল, সেই স্মৃতি মুহূর্তের জন্য উজিরের মনে ভেসে উঠে। খানের কথা তার মনে আছে: “ফারগানায় যদি কখনও আমার প্রয়োজন অনুভূত হয়, আমাকে কেবল সংবাদ পাঠাবে এবং ঝড়ের বেগে আমি উপস্থিত হব।” সিংহাসন উপহার হিসাবে পেলে খান তাকে নিশ্চয়ই আরো উদারভাবে পুরস্কৃত করবে।
“আরো আছে কাবুলের শাসনকর্তা তিনিও তৈমূরের বংশধর, আমাদের প্রয়াত সুলতানের জ্ঞাতী ভাই।” বাবা কাশক এবার সরাসরি উজিরের চোখের দিকে তাকায়। “তিনি নিশ্চয়ই ফারগানাকে রক্ষা করবেন…”।
কামবার আলী, মাথা নুইয়ে ভদ্রতাসূচক সম্মতি প্রকাশ করে। তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত নেয় আজ রাতেই উত্তরের পাহাড়ী পথে মোঘুলিস্তানের উদ্দেশ্যে দূত পাঠাবে নতুবা দেরি হয়ে যাবে। আমাদের সতর্ক থাকতে হবে, তাড়াহুড়ো করলে আমরা হোঁচট খেতে পারি।” কণ্ঠস্বরে গভীর চিন্তার ব্যঞ্জনা ফুটিয়ে সে বলে। “শাহজাদা বাবরের স্বার্থ যাতে বিঘ্নিত না হয় সেজন্য আমাদের ভাবনা চিন্তা করেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। প্রাপ্তবয়স্ক হলে তিনিই হবেন সিংহাসনের যোগ্য হকদার। আর ততোদিন পর্যন্ত ফারগানাকে নিরাপদ রাখতে আমরা আমাদের প্রতিবেশীদের ভেতর কাউকে রাজপ্রতিভূ নিয়োগ করতে পারি।” বাবরকে এ জীবনে আর তাহলে সিংহাসনে বসতে হবে না, সে মনে মনে ভাবে। একটা ছোট দূর্ঘটনা ঘটতে আর বেশি দেরি নেই। ঘটনাটা সাধারণভাবে সাজাতে হবে যে…
দরবারে ওয়াজির খান প্রবেশ করতে তারা চারজন উঠে দাঁড়ায়। তাকে ক্লান্ত দেখায় এবং তামাটে মুখের উপরে আড়াআড়ি গোলাপী ক্ষত চিহ্নটা- এক যুগ আগে চালানো তরবারির ছোবল যা তার ডানচোখের জ্যোতি ছিনিয়ে নিয়েছিল। এখন ফুলে থাকায় মনে হয় আঘাতটা যেন সপ্তাহখানেকের পুরানো। “মুরুব্বীগণ, দেরি। হবার জন্য আমাকে মার্জনা করবেন।” সে তার ডান হাতের তালু দিয়ে নিজের বুক স্পর্শ করে এবং কামবার আলী উজির পদে আসীন থাকায় তিনি তাদের ভিতরে প্রধান সেটা প্রকাশ করতে তাকে মাথা নত করে অভিবাদন জানায়। “আমি দূর্গের চারপাশে পাহারা দ্বিগুণ করেছি কিন্তু এখন পর্যন্ত সবকিছু শান্তই আছে। সুলতানের মরদেহ গোসল দেয়া হয়েছে এবং আগামীকালের জানাজার সব ইন্তেজাম করা হয়েছে।”
“ওয়াজির খান আমরা আপনার কাছে ঋণী থাকলাম। আমি খুশি হয়েছি।”
“আপনারা ফারগানায় রাজপ্রতিভূ নিয়োগের ব্যাপারে আলাপ করছিলেন?” ওয়াজির খান কামবার আলীর পাশে বসে এবং উজিরের দিকে নিজের ভাল চোখ দিয়ে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে সে তিক্ততা অনুভব করে।
“আমরা আলোচনা করছিলাম। রাজ্যের দায়িত্ব সামলাবার তুলনায় শাহজাদা বাবরের বয়স অল্প। আর উজবে কুকুরের দল আমাদের হুমকী দিচ্ছে।” উজবেকদের নাম উচ্চারণের সময়ে উজির থুতু ফেলার ভঙ্গি করে।
“শাহজাদার বয়স অল্প সেটা সত্যি, কিন্তু তিনি আমাদের প্রয়াত সুলতানের একমাত্র জীবিত সন্তান এবং রাজ্য পরিচালনার জন্য অল্পবয়স থেকেই তাকে প্রস্তুত করা হয়েছে। এটাই তার নিয়তি আর তার পিতা আমাদের মরহুম সুলতানের সেটাই ইচ্ছা ছিলো। বাবর সাহসী, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ আর দ্রুত সবকিছু রপ্ত করতে পারে। আমি নিজে তার সাক্ষী। সুলতানের অনুরোধে, বিশেষ করে বাবরই তার একমাত্র উত্তরাধিকারী এ বিষয়টা নিশ্চিত হতে, আমি তাকে অসি চালনা, তীরন্দাজি, কিভাবে বর্শা ব্যবহার করতে আর রণকুঠার ছুঁড়তে হয়, এসব কিছু যথেষ্ট সময় নিয়ে শিখিয়েছি। বাবর তার বয়সের অন্য ছেলেদের তুলনায় অনেক পরিণত, বিচক্ষণ। আমি নিশ্চিত আমাদের পাঁচজনের পরামর্শ তাকে এই বৈরী সময় অতিক্রম করতে সহায়তা করবে।” ওয়াজির খান নিরাসক্ত কণ্ঠে বলে।
“বন্ধু ওয়াজির খান, বিষয়গুলো যদি এত সহজ হত।” উজির ম্লান হেসে বলে। “শান্তিপূর্ণ সময়ে তোমার পরিকল্পনা অনুসারে কাজ হত, কিন্তু উজবেকদের আকাক্ষার কোনো সীমা পরিসীমা নেই। তারা যে মুহূর্তে শুনবে ফারগানার সুলতান তার অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেকে সিংহাসনে রেখে মারা গেছেন, তারা আমাদের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়বে, পেট চিরে আমাদের নাড়িভূড়ি বের করবে আর আমাদের রমণীদের অসম্মান করবে।”
“মহামান্য উজির, আপনি কি বলেন?”
“শাহজাদা বাবর প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত আমরা মরহুম সুলতানের কোনো আত্মীয়কে মসনদ রক্ষার দায়িত্ব দিতে পারি। কিন্তু প্রশ্নটা হলো আমরা কাকে অনুরোধ করবো…”
“আমি বুঝেছি। উত্তম প্রস্তাব। আমি মামূলি একজন সৈনিক আর আজ রাতে আমার আরও কাজ আছে। রাজনৈতিক বিষয়ে আপনারা আমার চেয়ে অনেক অভিজ্ঞ। আমাদের রাজ্যের জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে আল্লাহতালা আপনাদের হেদায়েত করুন।” ওয়াজির খান উঠে দাঁড়ায়, মাথা নুইয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে ধীর পায়ে দরবার ত্যাগ করে। দরবার থেকে বের হয়ে এসেই তার পায়ের গতি বৃদ্ধি পায়। মাঝের আঙ্গিনা অতিক্রম করে দূর্গের অপর প্রান্তে অবস্থিত শাহী হারেমের দিকে সে এগিয়ে যায়।
***
বাবর তার আম্মিজান, খুতলাঘ নিগারের পাশে বসে আছে। তার লম্বা কালো চুলে স্বস্তির পরশ পেতে মায়ের আঙ্গুল বিলি কাটে। বাবর ইতস্তত ভঙ্গিতে শোকসংবাদটা জানাবার পরেই তার মায়ের চেহারা এতোটাই ফ্যাকাশে হয়ে যায় যে তার ভয় হয় আম্মিজান বুঝি অজ্ঞান হয়ে যাবে এবং খবরটা শোনার পরে তিনি অন্ধ মহিলার মত শূন্য দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। বাস্তবতা হৃদয়ঙ্গম করতে পেরে, সে জিকির করার মত দুলতে শুরু করে। তার ভেতর থেকে তীব্র শোকের তীক্ষ্ণ ভয়ঙ্কর পরিদেবন বিষাদের মাত্রা সঞ্চয় করে বের হয়ে আসে। সুলতানের যদিও অনেক রক্ষিতা ছিলো কিন্তু তিনিই ছিলেন তার একমাত্র স্ত্রী। তাদের ভিতরে মহব্বতের সম্পর্কটা বেশ দৃঢ় ছিলো।
সে তাকিয়ে তার নানিজান, এসান দৌলতকে, আনমনে বীণার তারে টোকা দিতে দেখে। বীণার বিষণ্ণ সুর শরণ সন্ধানী পাখির মত কামরার ভেতরে প্রতিধ্বনি তুলে ভাসতে থাকে। তার মাথার সাদা চুল, যা অল্প বয়সে বেশ ঘন ছিলো কিংবা সেরকমই তিনি দাবি করেন, কাঁধের উপরে বেণী করা। তার কিশমিশের ন্যায় চোখ লালচে হয়ে আছে কিন্তু তিনি নিজেকে সামলে নিয়েছেন। বাবরকে একটু আগেই তিনি কান্না চেপে স্থিরসংকল্প কণ্ঠে বলেছেন, তিনি একজন খানিম, চেঙ্গিস খান, মানুষ যাকে মহাসাগরসম শাসক বলতো, তৈমূরের জন্মের দু’শো বছর আগে চেনা পৃথিবীর অর্ধেকটা যিনি অভিহরণ করেছিলেন, তার সাক্ষাৎ বংশধর।
বাবর তার নানীজানের মুখের দিকে তাকাতে, কে ছিলেন মহান যোদ্ধা- চেঙ্গিস খান নাকি তৈমূর, সেটা নিয়ে বাবার সাথে নানীজানের নিরন্তর তর্কের কথা তার মনে পড়ে যায়। জন্মের সময় বাবরের মাথা বড় থাকায়, আম্মিজানের যন্ত্রণাদায়ক দীর্ঘস্থায়ী গর্ভাবস্থার কথা এসান দৌলত সবসময়ে গল্প করেন। পুরোটা সময় তিনি তার মেয়েকে আশ্বাস বাণী শুনিয়েছিলেন যে, চেঙ্গিসের মতই বাবরও তার ক্ষুদ্র হাতের মুঠোয় রক্তের দলা নিয়ে তার যোদ্ধা নিয়তির প্রতীক- জন্ম নেবে। কিন্তু তার ভবিষ্যদ্বাণী ভুল প্রমাণিত হয়। অবশ্য এতে বিন্দুমাত্র হতাশ না হয়ে তিনি বলতে থাকেন, “সে নিশ্চয়ই একজন মহান শাসক হবে!”
এসান দৌলত যেনো তার চোখের দৃষ্টি অনুভব করে। তিনি বাবরের দিকে তাকালে সে নানীজানের চোখে এমন কিছু একটা দেখে যা আগে কখনও দেখেনিঃ অনিশ্চয়তা। তিনি এবার বীণাটা নামিয়ে রাখেন। “খানজাদা, কাউকে বলো বরফ দিয়ে শরবত দিতে,” তিনি তার মোল বছরের নাতির দিকে তাকিয়ে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলেন।
বাবর দেখে তার লম্বা অপূর্ব সুন্দরী বোন দ্রুত উঠে দাঁড়ায়, পরিচারিকাকে আদেশ দেয়। সে কামরার প্রবেশপথের কাছে পৌঁছাতে যেখানে প্রদীপের আলোর আগ্রাসন সবচেয়ে ক্ষীণ, সে আরেকটু হলেই হারেমের প্রধান পরিচারিকা ফাতিমার সাথে ধাক্কা খেত। বেচারীর চওড়া, ভোতা মুখ অশ্রুসিক্ত। “মালিক,” খানজাদা বরফ দেয়া শরবতের কথা বলার আগে সেই বলতে শুরু করে, “মালিক, ওয়াজির খান আপনার মহামহিম আম্মিজান আর নানীজানের সাথে দর্শন প্রার্থনা করেছে।”
“আগামীকাল সকাল পর্যন্ত সে অপেক্ষা করতে পারবে না? তারা শোকাবিভূত এবং তাদের বিশ্রামের প্রয়োজন।
“সে বলেছে ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ।” ফাতিমা হাত দিয়ে অনুনয়ের ভঙ্গি করে যেন তার হয়ে মিনতি করছে।
খানজাদা তার আম্মিজান আর নানীজানের দিকে তাকিয়ে তাদের ইঙ্গিতপূর্ণ দৃষ্টি বিনিময় করতে দেখে। তারপরে খুতলাঘ নিগার বলেন, “আমরা তার সাথে দেখা করবো। বাবর, তুমি অনুগ্রহ করে এখন যেতে পার।”
“কিন্তু কেননা? আমি থাকতে চাই।”
“আমি যা বলছি তাই করো।” তার আম্মা এবার উঠে বসেন।
“না।” এসান দৌলত এবার হস্তক্ষেপ করেন, “সে ফারগানার নতুন সুলতান। ওয়াজির খান যা বলতে এসেছে তা আমাদের চেয়ে বেশি তাকে প্রভাবিত করবে। তাকে থাকতে দাও।”
খুতলাঘ নিগার তার কিশোর ছেলের স্থিরসংকল্প কচি মুখের দৃঢ় প্রতিজ্ঞ মনুস্থির দিকে তাকায় এবং মাথা নেড়ে সম্মতি দেয়। তিন রমণী নিজেদের সামলে নিয়ে তাদের মুখের নেকাব টেনে দেয়। বয়োজ্যেষ্ঠ রমণী তার একপাশে মেয়ে অন্যপাশে নাতিনকে নিয়ে দাঁড়াতে, বাবর তাদের কাছ থেকে দূরে সরে আসে। নানিজানের কথায় তার ভিতরে কিছু একটা বদলে গিয়েছে। সে আশঙ্কিত কিন্তু সেইসাথে উত্তেজিতও বটে।
ওয়াজির খান নিচু সরদলের নিচে দিয়ে ঝুঁকে ভেতরে প্রবেশ করে গভীর শ্রদ্ধায় নিজেকে তাদের সামনে প্রণত করে। “এত রাতে অনাহূত সাক্ষাৎ প্রার্থনার জন্য আমাকে মার্জনা করবেন, মালিক।”
“কি হয়েছে?” নেকাবের উপর দিয়ে এসান দৌলত বিচক্ষণ তীক্ষ্ণ চোখে তার মুখ খুটিয়ে দেখে।
“বিষয়টা আমাদের মহামান্য সুলতানকে নিয়ে।” ওয়াজির পলকের জন্য আঁধারে দাঁড়িয়ে থাকা বাবরের দিকে তাকায়। তিনি এখানে একটুও নিরাপদ নন। আমরা এখন এখানে যখন আলাপ করছি, কুচক্রীর দল তখন তার কাছ থেকে মসনদ কেড়ে নিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের ষড়যন্ত্র করছে।”
“তোমাকে আরও খুলে বলতে হবে। কে ষড়যন্ত্র করছে?” এসান দৌলত জানতে চান। তার চোখের রঙ বদলে গেছে এবং চোখের নিচের উঁচু হাড়ে লাল রঙের ছোপ দেখা যায়।
“আমরা তোমাকে বিশ্বাস করি।” খুতলাঘ নিগার মৃদুকণ্ঠে বলেন। “তুমি ছিলে মরহুম সুলতানের সবচেয়ে বিশ্বস্ত সেনাপতি। তারচেয়েও বড় কথা, আমার স্বামীকে শিশুকালে তোমার আপন মা স্তন্যদুগ্ধ দ্বারা লালন করেছেন, যা তোমাকে সুলতানের দুধ-ভাইয়ের সম্মান দান করেছে। রক্তের মত অচ্ছেদ্য একটা বন্ধনে তোমাকে আবদ্ধ করেছে। সামনের অনাগত দিনগুলোয় আমি দেখতে চাই তুমি সেই বন্ধনের সম্মান রক্ষা করো… আমার সন্তানকে তুমি ঠিক তার আব্বাজানের মতো আগলে রাখবে… দয়া করে সব খুলে বলো। তুমি কি শুনেছো?”
“অসহিষ্ণু, রাজবৈরী, কুটিল স্বভাবের লোকেরা আপনাদের বিরুদ্ধে চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছে। উজির আর দরবারের অন্য সদস্যরা মসনদে অন্য আরেকজনকে অভিষিক্ত করার পরিকল্পনা আঁটছে- তারা ভেবেছে আমি তাদের কথোপকথনের শেষ অংশটুকু শুনেছি। কিন্তু তারা জানে না দরবারের বাইরে নিভৃতে দাঁড়িয়ে আমি তাদের পুরো আলোচনা শুনেছি। তারা রাজ্যের মঙ্গলের উসিলায় কাজটা হাসিল করতে চায়। আপনাদের সন্তান শাসনকার্য পরিচালনার পক্ষে নিতান্ত অল্পবয়সী এবং তাকে সিংহাসনের অধিষ্টিত করলে ফারগানায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে, যদি তারা শাহজাদা প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে উঠা পর্যন্ত কোনো রাজপ্রতিভূ নিয়োগ না করে। মুশকিল হল, আমাদের প্রতিবেশী রাজ্যগুলোর শাসকদের কাছে অনেক আগেই তারা নিজেদের বিকিয়ে দিয়েছে। প্রত্যেকে নিজ নিজ প্রভুর স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করছে। রাজ্যে শীঘ্রই তাদের প্ররোচণায় অশান্তি শুরু হবে। তাদের লোভের কারণে, মসনদের জন্য প্রতিপক্ষের ভিতরে যুদ্ধ শুরু হবে। একটা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ আরেকটা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের জন্ম দেবে। আর সবশেষে যেই বিজয়ী হোক, আপনার ছেলে তততদিন জীবিত থাকবে না। যতোদিন সে বেঁচে আছে- সবাই তাকে একটা হুমকি হিসাবেই দেখবে।”
“এটা অসম্ভব। সনাতন মর্যাদার স্মারক তৈমূর বংশের শাহজাদাদের অলঙ্ঘনীয় নিরাপত্তা দিয়েছে…” খুতলাঘ নিগারের কণ্ঠস্বর হোঁচট খায়।
“আমাদের এখন কি করণীয়?” এসান দৌলত ওয়াজির খানের বাহু আঁকড়ে ধরে জিজ্ঞেস করে। হাড়সর্বস্ব অবয়ব সত্ত্বেও তার ভিতরে একটা যুদ্ধংদেহী শক্তি লুক্কায়িত রয়েছে। এসান দৌলত ধমনীতে চেঙ্গিস খানের রক্ত আর চেতনায় তার আত্মাকে ধারণ করেন।
“হ্যাঁ, এখন আমাদের কি করণীয়?” বাবর অন্ধকার ছেড়ে বের হয়ে এসে জানতে চায়। দেয়ালের কুলঙ্গিতে রক্ষিত প্রদীপের নিভুনিভু আলোয় তার মুখের স্থির সংকল্প আর সিদ্ধান্ত প্রতিফলিত হয়।
“আমাদের দ্রুত কাজ করতে হবে। আমাদের চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।” ওয়াজির খান সংক্ষেপে কেবল এটুকুই বলে। “আগামীকাল আপনার আব্বাজান আমাদের মরহুম সুলতানের নামাজে জানাজার ঠিক অব্যবহিত পরেই দূর্গের শাহী মসজিদে আমরা আপনাকে সুলতান হিসাবে ঘোষণা করবো। মোল্লা একবার আপনার নামে খুবা পাঠ করার পরে কেউ যদি আপনার বিরোধিতা করে তবে সে চক্রান্তকারী হিসাবে চিহ্নিত হবে। আর আমাদের খেয়াল রাখতে হবে আমাদের শুভাকাক্ষিরা যেন এ সময় প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে উপস্থিত থাকে। আমার প্রহরীরা সবাই বিশ্বস্ত। ফারগানার অনেক অভিজাত ব্যক্তিও আমাদের পক্ষে রয়েছেন। বিশেষ করে আপনি যদি তাদের বিশ্বস্ততার প্রতিদান দেবার প্রতিশ্রুতি দেন।”
“আমাকে কাগজ, দোয়াতদানি আর পালক এনে দাও,” এসান দৌলত তার নাতিনকে আদেশ করে। “আজ রাতটা আমরা কেবল শোক পালনে কাটাবো না, আমাদের নিরুদ্বেগ আরও বড় বিপর্যয় আমাদের উপরে আপতিত করবে। আমি খুব ভালো করেই জানি কাদের উপরে আমরা বিশ্বাস রাখতে পারি আর কারা কপট, অবিশ্বাসী। সবাই মনে করে আমি কিছুই বুঝতে পারি না, কিন্তু চারপাশে কি ঘটছে আমি খুব ভালোই লক্ষ্য করি। এইসব গুরুত্বপূর্ণ চিঠি লেখার দায়িত্ব আমি কোনো খুশনবিশকে দিতে চাই না, চিঠিগুলো আমি নিজে লিখবো। ওয়াজির খান তোমার উপরে প্রতিটা চিঠি নিরাপদে আপন আপন গন্তব্যে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব রইল। চিঠিগুলো কেন পাঠান হচ্ছে জিজ্ঞেস করবার ধৃষ্টতা কেউ দেখালে তাকে বলবে মরহুম সুলতানের জানাজা উত্তর ভোজের আমন্ত্রণপত্র। কথাটা আংশিক সত্যি কিন্তু সেগুলো একই সাথে মসজিদে বাবরের অভিষেকের আমন্ত্রণপত্রও বটে। আকশীর আশেপাশে ঘোড়ায় অর্ধদিনের দূরত্বে বসবাসকারী সব বিশ্বস্ত গোত্রপতিকে আমি ডেকে পাঠাচ্ছি। আমি তাদের অনুরোধ করবো জানাজা শেষে ভোজসভা আরম্ভ হবার পরে গোপনে আর নিঃশব্দে তারা যেন মসজিদে প্রবেশ করে। বাবর বেটা, আমার পাশে এসে তেলের প্রদীপটা একটু উঁচু করে ধরো।”
রাত গভীর হবার সাথে সাথে তাদের চারপাশে দূৰ্গটা নিরব হয়ে আসে। বাবর অপলক তাকিয়ে দেখে নানীজান অক্লান্তভাবে লিখে চলেছেন। মাঝে মাঝে কেবল পালকের মাথা তীক্ষ্ণ করতে বা কালি শেষ হয়ে গেলে লেখায় সাময়িক বিরতি দেন। অবিশ্বাস্য ব্যাপার, সে ভাবে, রক্তের বৈরীতা আর তিক্ত শত্রুতার কথাই নানীজান কেবল জানে না, চেঙ্গিস খানের সময় থেকে গোত্রসমূহের ভিতরে চলে আসা জটিল বৈবাহিক সম্পর্ক আর ব্যক্তিগত বিশ্বস্ততার গভীর সম্পর্কের বিষয়েও তার অসীম জ্ঞান। এই প্রথম সে তার প্রতি কৃতজ্ঞবোধ করে তাকে জোর করে গোত্রপতিদের ভিতরে কারা বন্ধু আর কে কে শত্রু সে বিষয়ে নানীজান তাকে ধৈর্য ধরে শিখিয়েছেন বলে তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়- এর পেছনের কারণগুলো সম্পর্কেও তিনি তাকে বলেছেন। তার মুখের সূক্ষ্ম ভাঙাচোরা দাগের দিকে তাকিয়ে বাবর স্বস্তি বোধ করে যে এসান দৌলত তার মিত্র, শত্রু নন।
সবগুলো চিঠি লেখা শেষ হতে- কাগজের উপরে তুর্কী লিপির এলোমেলো বিন্যাস সেগুলো ভাজ করে লাল মোম দিয়ে সীল করে একজন বিশ্বস্ত লোক দিয়ে চিঠিগুলো পৌঁছে দেবার জন্য ওয়াজির খানকে দেয়া হয়। বাইরের প্রাঙ্গণে দূর্গ থেকে বের হয়ে যাওয়া ঘোড়ার খুরের শব্দ প্রতিধ্বনি তোলে। সুবেহসাদিকের সময়ে ফজরের নামাজের আজানের ধ্বনি ভেসে আসবার পরেই কেবল এসান দৌলত তার লেখনী বন্ধ করেন।
১.২ প্রথম রক্তপাত
০২. প্রথম রক্তপাত
বাবর ঘোড়ার পিঠে বসে, ওয়াজির খানের মনোনীত আটজন প্রহরীকে কাঁধে করে ধূসর-সবুজ জেড পাথরের শবাধারে তার বাবার মরদেহ বয়ে নিয়ে আসতে দেখে। ভারী পাথরের কাঠিন্যের জন্য তাদের প্রত্যেকের কাঁধে ভেড়ার চামড়ার পুরু আস্তর দেয়া থাকলেও শবাধারটা অসম্ভব ভারী। তাদের বাতাসে পুড়ে তামাটে বর্ণ ধারণ করা মুখ ঘামে ভিজে আছে এবং একজন হোঁচট খেয়ে আরেকটু হলেই কাঁধ থেকে শবাধারটা ফেলে দিতো। উপস্থিত সবাই আঁতকে উঠে জোরে শ্বাস টানে শবাধারটা যদি মাটিতে আছড়ে পড়ে তবে সেটা একটা অশনিসঙ্কেত হিসাবে বিবেচিত হবে। বাবরের পাকস্থলীর কাছটা টানটান হয়ে যায় কিন্তু কামবার আলীর কচ্ছপের মতো মুখ নির্বিকার থাকে।
“হুঁশিয়ার, তোমরা আমাদের সুলতানকে বহন করছে।” ওয়াজির খানের কণ্ঠস্বরের তীব্রতায় প্রহরীটা নিজেকে সামলে নিয়ে পুনরায় কাঁধে শবাধারের ভার নেয় এবং শবাধারবাহীরা স্মৃতিসৌধের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত সমাধিকক্ষের দিকে ঢালু দরদালান বেয়ে ধীরে ধীরে নিচে নামতে থাকে।
বাবরের পিতা মৃত্যুর অনেককাল আগেই নিজের সমাধিসৌধের পরিকল্পনা করেছিলেন। বাবর যখন তার বিশাল-স্তনের দাইয়ের কোলে নিতান্ত দুগ্ধপোষ্য শিশু, সুলতান তখন ফারগানা আর ফারগানার বাইরে থেকে রাজমিস্ত্রী এবং অন্যান্য কারিগরদের ডেকে আনেন। তার ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধায়নে আকশি দূর্গের দেড় মাইল পশ্চিমে জাক্সারটেস নদীর তীরে কারিগরের দল সমরকন্দে মহান তৈমূরের শেষ বিশ্রামস্থলের একটা ক্ষুদ্র সংস্করণ নির্মাণ করে। এখন ডিম্বাকৃতি গম্বুজের নীলাভ সবুজ টালির সাথে উজ্জ্বল বর্ণের রূপালি নীল টালির বিন্যাস জুন মাসের তীব্র সূর্যালোকে চোখ ধাধিয়ে দেয়। বাবর ভাবে, বাবা এসব দেখলে গর্ববোধ করতো এবং ভাবনাটা তার উত্তেজিত মুখমণ্ডলে আবছা একটা হাসির অভিব্যক্তির জন্ম দেয়।
তার চোখের দৃশ্যপট থেকে শবাধারটা আড়াল হতেই, উপস্থিত জনগণের মাঝে বিলাপের ক্রন্দন ধ্বনি গমগম করে উঠে- যাদের ভেতরে রেশমের আলখাল্লা পরিহিত গোত্রপতি আর অভিজাতদের সাথে একই কাতারে দাঁড়িয়ে রয়েছে মামুলি পশুপালকও, যাদের গায়ে তাদের পালিত পশুর গন্ধ। পার্থিব জীবনের পরিস্থিতি যাই হোক, সব মানুষই তাদের পরণের আলখাল্লা টেনে ছিঁড়ে এবং মাথার পাগড়িতে কবরের মাটি ছিটায় যার রেওয়াজ চেঙ্গিস খানের অনেক আগে থেকে চলে আসছে। তাদের মনে তখন কি ভাবনা খেলা করছিলো? এখানে কতজন তারমতো শোকগ্রস্ত? বাবর ভাবে। এসান দৌলতের চিঠির কারণে গোত্রপতিরা আজ এখানে উপস্থিত হয়েছে বটে, কিন্তু সময় যখন হবে সে তাদের কতজনের উপরে নির্ভর করতে পারবে?
“যাদের কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই এমন লোকদের থেকে সাবধান ব্যাপারটা অস্বাভাবিক, তার বাবা সবসময়ে তাকে এই উপদেশটা দিয়েছে। বাবর একবার ওয়াজির খানের দিকে আড়চোখে না তাকিয়ে পারে না, কিন্তু পরমুহূর্তে নিজেই লজ্জিত হয়। বাবা মারা যাবার পরে, আর নানীজান ছাড়া, লম্বা ঋজু-পৃষ্টদেশের এই সৈনিককেই পৃথিবীতে সে তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত লোক বলে জেনে এসেছে। কিন্তু ওখানে মুখে গুটিবসন্তের দাগভর্তি ধূসর দাড়িঅলা গোত্রপতি, পাহাড়ের সুরক্ষিত আশ্রয় থেকে রাতের আঁধারে বেরিয়ে এতো দ্রুত ঘোড়া দাবড়ে এসেছে যে তার গায়ের আলখাল্লা নিজের আর ঘোড়ার ঘামে মাখামাখি অবস্থা, তার কি মনোভাব? অথবা ঐ গাজরের মতো উঁচু-দাঁতঅলা, মোঙ্গলদের প্রাচীন রীতি অনুসারে যার মাথা পুরোটা কামান, যাকে তার মরহুম পিতা ষড়যন্ত্র, কপটতা আর লোভের কারণে একবার নির্বাসনে পাঠিয়েছিলেন এবং সম্প্রতিই ফিরে আসবার। অনুমতি দিয়েছিলেন, সে কি ভাবছে? এসান দৌলতকে আমন্ত্রণপত্র পাঠাবার সময়ে এসব ঝুঁকি নিতে হয়েছে। আশা করেছে যে কেবল মিত্রদেরই সে ডেকে পাঠিয়েছে, কিন্তু বাবর তার অল্প বয়সে একটা বিষয় খুব ভালো করেই জানে, এদের ভিতরে অনেকেই অনায়াসে পিঠ দেখাতে পারে।
কিন্তু এখন সেসবের সময় না। তার প্রথম কাজ এখন আব্বাজানকে সমাধিস্থ করা। ওয়াজির খান মাথা নত করে বাবরের ঘোড়ার অলঙ্কারখচিত মাথার সাজ শক্ত করে ধরতে সে ঘোড়া থেকে নামে। চোখের কোণের অশ্রু মুছে সে গভীর একটা শ্বাস নেয় এবং তার বাবার প্রিয় মোল্লা আর শোকার্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সমাধিগর্ভে শেষ শ্রদ্ধা প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবার জন্য প্রস্তুত হয়। এক মুহূর্তের জন্য সে তার মায়ের কোমল হাতের স্পর্শ অনুভব করতে লালায়িত হয়ে। উঠে। কিন্তু খুতলাঘ নিগার, তার বোন আর নানীজানের সাথে শাহী হারেমে অপেক্ষা করছেন, যা বিধিসম্মত। এসব অনুষ্ঠানে মেয়েদের উপস্থিত থাকবার রেওয়াজ নেই। সুলতানের মৃতদেহ নিয়ে অনুগমনকারী অনুচরবর্গ দূর্গ থেকে বের হয়ে চপল ছন্দে বহমান জাক্সারটাসের তীরের দিকে রওয়ানা হবার সময়ে তারা দেয়াল থেকে ঝুলতে থাকা পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে নিরবে শেষ বিদায় জানিয়েছেন। সমাধিসৌধের অন্ধকারাচ্ছন্ন প্রবেশপথের দিকে বাবর এগিয়ে যেতে সে দেখে যে, কামবার আলী তার আগেই সেখানে পৌঁছে গিয়েছে, প্রথমে প্রবেশ করার বাসনায়। পরণের খয়েরী আলখাল্লা তার দেহের চারপাশে নিশানের মত উড়ছে। “উজির!” বাবরের কিশোর কণ্ঠ কঠোর শোনায়। মানানসই একটা কণ্ঠস্বর। থমকে থেমে পাশে সরে দাঁড়াবার সময়ে কামবার আলীর মুখে বিরক্তির সামান্য রেশ ফুটে উঠেই মিলিয়ে যায়।
“আমার বাবার শবানুযাত্রীদের নেতৃত্ব আমি দেব। সেটাই বাঞ্ছনীয়।” বাবর তাকে অতিক্রম করে এগিয়ে যাবার সময়ে উজিরের পায়ের নরম চামড়ার নাগরা ভালো করে মাড়িয়ে দেয়। বেশ তৃপ্তিকর একটা অনুভূতি।
“অবশ্যই, শাহজাদা।”
বাবর যথাযথ শ্রদ্ধা প্রদর্শনপূর্বক মোল্লাকে তার সাথে আসতে বলে। কামবার আলী দীর্ঘ অন্ধকার গলিপথে তাদের অনুসরণ করে। রাজদরবারের অন্য সদস্যরা, তাদের পদমর্যাদা অনুসারে বাবরের অনুবর্তী হয়। ইউসুফ, রাজকোষের কোষাধ্যক্ষ হবার। কারণে, মরহুম সুলতানের শবাধারের পাদদেশে রাখার জন্য একটা পাত্রে চকচক করতে থাকা সোনার আশরফি বহন করে আনে। বাবা কাশক, শাহী বাজারসরকার হিসাবে দায়িত্ব পালনের নিমিত্তে লাল চামড়া দিয়ে বাঁধাই করা একটা খেরোখাতা বয়ে নিয়ে আসে। যেখানে মরহুম সুলতানের জীবদ্দশায় কৃত সমস্ত শাহী খরচের হিসাব লিপিবদ্ধ রয়েছে। খেরো খাতাটাও তার শবাধারে দেয়া হবে, যার মানে। সুলতান পরলোকে গমন করেছেন তার সমস্ত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন শেষ করে। বাকি বেগের হাতে শাহী জ্যোতিষবিদ হিসাবে একটা স্ফটিকের গোলক দেখা যায়। সে মনে মনে ভাবে, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া শেষ হবার পরে, এই চকচকে গোলকের। গভীরতায় দৃষ্টিপাত করে, বিষাদ ভারাক্রান্ত কণ্ঠে সে ঘোষণা করবে যে, একজন অপ্রাপ্তবয়স্ক বালককে সুলতান হিসাবে বরণ করে নিতে তারকারাজির সম্মতি নেই। অমাত্যগণ ভূগর্ভস্থ সমাধিকক্ষের সাতসেঁতে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়ালে অন্যেরা ঢালু গলিপথে ঠাসাঠাসি করে। অভ্যন্তরের ভারী বাতাসে মানুষের ঘামের গন্ধ ভুরভুর করে। ভীড়ের চাপে বাবরের দু’হাত নাড়াবার জায়গা থাকে না। মোল্লা মৃদুকণ্ঠে মোনাজাত শুরু করে। কিন্তু শীঘ্রই তার কণ্ঠস্বর তীব্রতা লাভ করে সমাধিকক্ষের অভ্যন্তরে ভাসতে থাকলে ভয়ের একটা শীতল স্রোত বাবরের মেরুদণ্ড দিয়ে বয়ে যায়। সে একটা বদ্ধস্থানে অবস্থান করছে। কোনো শত্রু যদি এখন হামলা করতে মনস্থ করে? সে তার মানসপটে নিজের দ্বিখণ্ডিত গলা থেকে রক্ত ছিটকে জেড পাথরের শবাধারের নার্গিস আর টিউলিপের জটিল অলঙ্করণে পড়তে দেখে। সে নিজেকে প্রাণপণে চিৎকার করতে শোনে, কিন্তু গলগল করে বের হতে থাকা রক্তে শ্বাসরুদ্ধ একটা ঘড়ঘড় শব্দ ভেসে আসে।
মূর্চ্ছাপ্রবণতা আর বিবমিষা তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। বাবর চোখ বন্ধ করে প্রাণপণে নিজেকে সামলে নিতে চায়। অল্পবয়সের অনভিজ্ঞতা আর এখনও অজাতশত্রু হওয়া সত্ত্বেও, তাকে প্রাপ্তবয়স্ক একজন পুরুষের ভূমিকা পালন করতে হবে। ফারগানার মসনদ তার হবে যদি সে আগামী কয়েক ঘণ্টা, সাহসিকতার সাথে নিজের ভূমিকা পালন করতে পারে। তৈমূরের রক্ত তোমার ধমনীতে বহমান। সে তার বাবার প্রায়শই অসীম গর্বের সাথে উচ্চারিত বাক্যটা নিরবে মনে মনে আউড়ায়। শব্দগুলো তার মস্তিষ্কে অনুরণিত হতে থাকলে বহু বহুকাল পূর্বে সংঘটিত মহান গৌরবময় যুদ্ধের আর অনাগত অভিযানের ছবি তার মানসপটে ভেসে উঠে। স্থিরসংকল্পে জারিত মন তার রক্ত শাণিত করে তোলে- এর সাথে যুক্ত হয় কিছু মানুষ তার যুক্তিসঙ্গত দাবি আগ্রাহ্য করতে চায়, সেই ক্রোধ।
অন্তেষ্টিক্রিয়ার শোভাযাত্রা নিয়ে রওয়ানা হবার ঠিক আগমুহূর্তে খুতলাঘ নিগার বাবরের আলখাল্লার বেগুনী রঙের পরিকরে যে রত্নখচিত বাঁটযুক্ত খঞ্জরটা খুঁজে দিয়েছে সেটার ভার অনুভব করে এবং সেটার বাঁটে আঙ্গুল চেপে বসতে তার শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে আসে। চোখে জিজ্ঞাসা নিয়ে সে চারপাশে তাকায়। ওয়াজির খানের লোকেরা সমাধি গর্ভে উপস্থিত আছে। তারা নিশ্চয়ই আততায়ীর হাতে তাদের শাহজাদার কোনো ক্ষতি হতে দেবে না। নাকি তারাও বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে? প্রহরীদের মুখমণ্ডলের দিকে তাকিয়ে সে বুঝতে পারে তাদের কারো সম্বন্ধেই তার কোনো ধারণা নেই। মাত্র গতকালও পরিবারের প্রতি তাদের আনুগত্যের বিষয়টা তার কাছে ছিলো প্রশ্নাতীত। কিন্তু আজ পুরো বিষয়টাই পাল্টে গিয়েছে। তার আঙ্গুল খঞ্জরের বাঁট আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরে।
সে জোর করে তার মনোযোগ আবার মোল্লার উপরে নিবদ্ধ করে। যিনি তার গভীর, সুরেলা কণ্ঠে তেলাওয়াত করছেন: “আল্লাহ পরম করুণাময়। আমাদের সুলতান উমর-শেখের আত্মা যেন বেহেশতের উদ্যানে এখন অধিষ্ঠিত থাকে। আমরা যারা তার পেছনে রয়ে গিয়েছি তাদের বিষণ্ণতা যেন মুক্তোবিন্দু হয়ে ঝরে এবং আমরা যেন এটা ভেবে উল্লসিত বোধকরি যে আমাদের সুলতান এখন পরম প্রশান্তির বারিধারা পান করছেন।” সে মোনাজাত শেষ করে এবং হাত ভাঁজ করে নিয়ে শবাধার থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে ঢালু করিডোর দিয়ে উপরে উঠতে শুরু করলে, দর্শনার্থীরা বহুকষ্টে দু’পাশে ভাগ হয়ে গিয়ে তাকে বাইরে যাবার পথ করে দেয়।
বাবর এক মুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করে এবং তার প্রিয় আব্বাজানকে নিরবে বিদায় জানায়। তারপরে কোনোমতে অশ্রু চেপে রেখে সে মোল্লাকে অনুসরণ করে চোখ পিটপিট করতে করতে সূর্যালোকে বের হয়ে আসে। বাম কান ঘেষে উড়ন্ত পাখির ডানা ঝাপটানোর মতো একটা শব্দ তাকে চমকে দিতে সে লাফিয়ে পেছনে সরে আসে। বাজপাখি দিয়ে কেউ এই অসময়ে শিকার করছে? সে চারপাশে ক্রুদ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখতে চায় ফারগানার সুলতানকে তার সমাধিসৌধে অন্তিম শয়ানে শায়িত করার সময়ে বাজপাখি উড়ায়, কার এতবড় স্পর্ধা। বাঁকানো ঠোঁটে শিকারের খুবলে নেয়া অংশ এবং পায়ের নখে রেশমের বেণী করা ফিতে ঝোলানো, উজ্জ্বল চোখ আর গলায় অলঙ্কৃত কলারের কোনো পাখি সে দেখতে পায় না। তার বদলে নীল কালো পালকশোভিত, লম্বা শরযষ্টির একটা তীর বাবরের পায়ের কাছে মাটিতে গাঁথা অবস্থায় তিরতির করে কাঁপছে। আর কয়েক ইঞ্চি তাহলেই তীরটা তার দেহে বিদ্ধ হতো।
উপস্থিত লোকজনের ভিতরে আতঙ্কিত শোরগোল শুরু হয় এবং হুড়োহুড়ি করে ঝোপঝাড় আর গাছের পেছনে আশ্রয় নিতে ছুটোছুটি আরম্ভ করার আগে, সবাই বিভ্রান্ত চোখে আকাশের দিকে তাকায় যেন বিকেলের আকাশ অন্ধকার করে এক পশলা তীর তাদের এখনই বিদ্ধ করবে। গোত্রপতিরা নিজ নিজ অনুচরকে ঘোড়া আনতে বলে, ধনুক আর তূণীরের দিকে হাত বাড়ায়। ভোজবাজির মত ওয়াজির খান কখন যেন বাবরের পাশে এসে দাঁড়িয়ে, নিজের দেহ দিয়ে তাকে আড়াল করে, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চারপাশের দৃশ্যপট জরিপ করছে। আশেপাশের বিরান সমভূমিতে লুকিয়ে থাকার জায়গা অল্পই আছে, কিন্তু একটা নিঃসঙ্গ পাথর বা বিচ্ছিন্ন ঝোঁপের পেছনে সহজেই একজন আততায়ী ধনুর্ধর লুকিয়ে থাকতে পারে যার হাতে রয়েছে। কসাইয়ের নিপূণতা আর অন্তরের হত্যার জীঘাংসা। ওয়াজির খান তার দাস্তানা পরা। হাত দিয়ে জোরাল একটা ইঙ্গিত করতেই অশ্বারোহী প্রহরীদের একটা দল সম্ভাব্য আততায়ীর খোঁজে বেরিয়ে পড়ে।
“শাহজাদা, এই মুহূর্তে আপনার প্রাসাদে ফিরে যাওয়া উচিত।”
বাবর তখনও সম্মোহিতের দৃষ্টিতে তীরটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। “দেখো,” সে ঝুঁকে মাটিতে গেঁথে থাকা তীরটা তুলে নিয়ে বলে, “পালকের চারপাশে কিছু একটা আটকানো রয়েছে।” সে মোটা লাল সূতার বাঁধন ছিঁড়ে ফেলে যা পার্চমেন্টের একটা টুকরো তীরের সাথে আটকে রেখেছিল এবং সেটাতে লেখা হুমকির দিকে তাকিয়ে থাকে। তার মাতৃভাষা তুর্কীতেই চামড়ার ফালিতে লেখা রয়েছে কিন্তু অক্ষরগুলো তার চোখের সামনে লাফাতে থাকার কারণে তার এক মুহূর্ত সময় লাগে লেখাটার অর্থ উপলব্ধি করতে।
ওয়াজির খান পার্চমেন্টটা তার হাত থেকে কেড়ে নেয় এবং তাতে যা লেখা রয়েছে সেটা উচ্চকণ্ঠে পড়ে শোনায়: “পৃথিবীর অধিশ্বর পরাক্রমশালী সাইবানি খান তার শুভেচ্ছা পাঠাচ্ছে। তিন চন্দ্রমাসের সময় অতিক্রান্ত হবার আগেই তিনি ফারগানা নামে পরিচিত খোয়াড়ের দখল বুঝে নিয়ে এর সিংহাসন মূতে ভাসিয়ে দেবেন।”
“বেজন্মা উজবেক,” অবজ্ঞার সাথে একজন সৈনিক চেঁচিয়ে উঠলেও, বাবর তার চোখে আশঙ্কার মেঘ জমা হতে দেখে।
“এসবের অর্থ কি?” শাহী জ্যোতিষী হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে এসে ওয়াজির খানের হাত থেকে চামড়ার টুকরোটা ছিনিয়ে নেয়। বাকী বেগ হুমকিটা পড়ে এবং বাবর তাকে আঁতকে উঠে সশব্দে শ্বাস নিতে শুনে। ছোটখাট মানুষটা পায়ের ডিমের উপরে দাঁড়িয়ে, মুষ্টিবদ্ধ হাতে সামনে পেছনে দুলতে শুরু করে এবং তার কীচকী কণ্ঠ থেকে একটা বিলাপ উথলে উঠে: “সাইবানি খান আসছে, সেই এলাচি খুনী…আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি…সে একটা বিশাল কালো ঘোড়ার পিঠে বসে রয়েছে যার খুরের দাপটে মানুষের খুলি গুঁড়িয়ে যাচ্ছে।” তার বিলাপ এবার চিল চিল্কারে পরিণত হয়: “সাইবানি খান আসছে! তার পেছনে ধেয়ে আসছে মৃত্যু আর মহামারী!”
কামবার আলীও ইতিমধ্যে বাবরের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, তার পেছনেই আছে শাহী কোষাধ্যক্ষ আর বাজারসরকার। তারা তিনজনই মাথা নাড়তে থাকে। “অন্তেষ্টিক্রিয়ার ভোজ শেষ হবার পরে আজ রাতেই শাহী পরামর্শকের দল বৈঠকে বসবে। সাইবানি খান মিথ্যা হুমকি দেবার পাত্র না,” উজির বলেন। ইউসুফ আর বাবা কাশক প্রবল বেগে মাথা নেড়ে সম্মতি প্রকাশ করে। তাদের সাথে এবার বাকী বেগও তাল মিলিয়েছে।
ওয়াজির খান সম্মতি প্রকাশের কোনো ধরণের অভিব্যক্তি করা থেকে বিরত থাকে। তার বদলে সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কামবার আলীর দিকে তাকিয়ে থাকলে উজির বেচারা অস্বস্তির ভিতরে পড়ে। “শ্রদ্ধেয় উজির, জনগণকে শান্ত করতে আপনি নিশ্চয়ই তাদের উপরে আপনার সন্দেহাতীত প্রভাব খাটাবেন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে আমার সৈন্যরা আপনার তত্ত্বাবধায়নে সদা প্রস্তুত থাকবে।”
“তোমার কথা যুক্তিসঙ্গত, ওয়াজির খান। আবারও তোমাকে ধন্যবাদ জানাই।” কামবার আলী তার পাগড়ী পরিহিত মাথাটা কাত করে কথাটা বলে দ্রুত বিদায় নিলে অন্যান্য অমাত্যরা পঙ্গপালের মত তাকে অনুসরণ করে। বাবর শুনতে পায় বাকী বেগ তখনও আসন্ন বিপর্যয় সম্পর্কে বিড়বিড় করছে, দমকা হাওয়ার মত বিরক্তি তাকে ঘিরে ধরে। সে একবার শুধু মসনদে অধিষ্ঠিত হোক, এই মেরুদণ্ডহীন ক্লিবটাকে দূর করে অন্য কোনো যোগ্য ব্যক্তিকে তার ব্যক্তিগত জ্যোতিষী হিসাবে নিয়োগ করবে। তার বাবা কেন এই লোকটাকে এত খাতির করতেন সেটা তার কাছে একটা রহস্য- আসলেই এত জ্যোতিষী থাকতে এই অপদার্থটাকে কেন বেছে নিয়েছিলেন। বাকী বেগের পরিবার হয়ত কখনও তার উপকার করেছিলো, যার প্রতিদান দেয়াকে তিনি নিজের কর্তব্য বলে বিবেচনা করেছিলেন।
আপাতত আক্রমণের আর কোনো সম্ভাবনা না থাকায়, শবানুগামীরা ঝোপঝাড়ের আড়াল থেকে আলখাল্লার ধূলো ঝাড়তে ঝাড়তে বের হয়ে আসে। সাইবানি খানের নাম মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়তেই, বাবর তাদের কাউকে এমন আর্তস্বরে বিলাপ করতে শোনে, যেন তাদের ভবিতব্য ইতিমধ্যে নির্ধারিত হয়ে গেছে। সে ঘাড় উঁচু করে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে তাদের অজান্তে সূর্যকে ঢেকে দিয়ে দিগন্তের উপর দিয়ে মেঘের দল উড়ে এসে মাথার উপরে জড়ো হয়েছে। নিজের ঊর্ধ্বমুখী কপালে সে বৃষ্টির ফোঁটা অনুভব করে।
“শাহজাদা।” ওয়াজির খান আবার তাকে ধরে ঝাঁকি দেয় এবার এত জোরে যে তার মনে হয় কাঁধের কাছ থেকে পুরো হাতটাই খুলে আসবে। কণ্ঠস্বরে জরুরি ভাব ফুটিয়ে সে ফিসফিস করে কথা বলে: “সাইবানি খানের হুমকি। তার পক্ষে এটা কিভাবে সম্ভব? পাহাড়ের অন্যপ্রান্তে এত দ্রুত সুলতানের মৃত্যুর খবর সে কিভাবে পেলো। আমার মনে হয় এটা ভেতরের কারো কাজ, সম্ভবত কামবার আলীর যোগসাজশে এটা ঘটান হয়েছে। সে সম্ভবত আপনাকে খুন করার পায়তারা করছে। নিদেনপক্ষে, সে মানুষের মনে একটা আতঙ্কের জন্ম দিতে চায়, যাতে একজন কিশোরকে সুলতান হিসাবে গ্রহণ করার ব্যাপারে তাদের ভিতরে দ্বিধা-দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। কিন্তু এতে আমাদের পরিকল্পনার কোনো হেরফের হবে না। দূর্গের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। পথে কোনো কারণে বা কারো জন্য ঘোড়ার গতি হ্রাস করবেন না। আমি যতদ্রুত পারি আপনাকে অনুসরণ করছি।”
ওয়াজির খানের উদ্বেগ বাবরের ভিতরেও সংক্রামিত হয়। সে তার ঘোড়া নিয়ে আসতে বলে এবং দ্রুত পর্যাণে উপবিষ্ট হয়। এক মুহূর্তের জন্য ওয়াজির খান তার ঘোড়ার লাগাম ধরে থাকে। “শাহজাদা, আর কয়েক ঘণ্টা তারপরে সব ঠিক হয়ে যাবে,” সে বলে। তারপরে, দেহরক্ষী বাহিনীর একটা দলকে বাবরের সাথে যাবার নির্দেশ দিয়ে সে ঘোড়ার মসৃণ পশ্চাদ্ভাগে একটা চাপড় বসিয়ে দিতে ঘোড়ার খুরে ছন্দের বোল উঠে।
বৃষ্টি আরো জোরে পড়তে শুরু করলে এবং বাড়ন্ত ঘাসের ঝোঁপের মাঝ দিয়ে দুলকি চালে এগিয়ে যাবার সময়ে, বাবর কাঁধের উপর ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকায়। সে কামবার আলীকে উত্তেজিত জনতার মাঝে দু’হাত উঁচু করে এগিয়ে যেতে দেখে। সে আসলে কি চায়? তাদের শান্ত করতে না উত্তেজনা আরো উসকে দিতে? তার সহজাত প্রবর্তনা বলছে ওয়াজির খানের বিশ্লেষণে কোনো ফাঁক নেই: যে দুরাত্মার হাত তীরটা ছুঁড়েছে সেটা কোনো উজবেকের হাত হতে পারে না।
বাবর তার ফারের মোটা ওভারটিউনিকের পকেটের গভীরে হাত দিয়ে তীরটা বের করে নিয়ে আসে। ঘোড়ার লাগাম দাঁতে কামড়ে ধরে সে তীরটা দ্বিখণ্ডিত করে এবং চরম অবজ্ঞার সাথে সেটা মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে। দ্বিখণ্ডিত তীরটা মাটিতে পড়ে থাকা ভেড়ার লাদির উপরে গিয়ে পড়ে।
***
“বাছা, কেমন অভিজ্ঞতা হল।” খুতলাঘ নিগারের চেহারায় পরিশ্রান্তভাব, অবিরাম কান্নার কারণে চোখ রক্তজবার মত লাল। হারেমের অনেক ভেতর থেকে বাবর চাপাকান্না ভেসে আসার শব্দ শোনে। মৃত সুলতানের জন্য হারেমের সবাই শোকের কৃত্যানুষ্ঠান পালন করছে। বিষাদের এই রোলের ভিতরে অদ্ভুত একটা ঐক্যতান রয়েছে, যেন কোনো মহিলাই সাহস পায় না প্রথমে কান্না থামাবার।
“সবকিছু নির্বিঘ্নে সমাপ্ত হয়েছে।” সে সিদ্ধান্ত নেয় আম্মাজানকে তীরের কথা বলবে না- অন্তত এখনই না। জীবনে এই প্রথম সে মায়ের কাছে কিছু গোপন করলো। কিন্তু তার প্রাণ সংশয় দেখা দিয়েছিলো এটা জানতে পারলে তিনি আতঙ্কিত হয়ে উঠবেন।
“আর তোমার মরহুম আব্বাজান। তিনি শান্তিতে সমাহিত হয়েছেন?”
“হ্যাঁ, মা। আমরা সবাই তার জন্য মোনাজাত করেছি, তাকে যেন বেহেশত নসীব করা হয়।”
“এবার তাহলে দুনিয়াদারির কাজের তদারকি শুরু করতে হয়।” খুতলাঘ নিগার হাতে তালি দিলে, তার ব্যক্তিগত পরিচারিকা ফাতিমা ছায়ার ভেতর থেকে বের হয়ে আসে। তার হাতে হলুদ রেশমের উপরে সোনা আর রূপার জরি দিয়ে ফুলের নক্সা তোলা একটা আলখাল্লা আর একই কাপড়ের একটা পাগড়ি যার উপরে একটা ময়ূরের পালক গোঁজা রয়েছে। খুতলাঘ নিগার বিম্র চিত্তে আলখাল্লাটা তার হাত থেকে নেয়। “এটা ফারগানার সুলতানদের মসনদে অভিষেকের আলখাল্লা। এর আমেজ অনুভব করো, এটা এখন তোমার।”
বাবর হাত বাড়িয়ে ভাঁজ করা চকচকে আলখাল্লাটা স্পর্শ করে এবং গর্বের একটা শিরশিরে অনভূতি তার ভিতরে ছড়িয়ে যায়। সুলতানের আলখাল্লা- তার আলখাল্লা। রেশমের শীতল পরশ তার আঙ্গুলের ডগায় ছড়িয়ে পড়ে।
তার স্বপ্নবেশের চটকা ঘোড়ার খুরের সম্মিলিত বোলে ভেঙে যায়। বাবর জানালা থেকে নিচের বৃষ্টিস্নাত আঙ্গিনার দিকে তাকায়। সন্ধ্যে প্রায় হয়ে এসেছে এবং রাত্রির প্রস্তুতি হিসাবে ইতিমধ্যে মশাল জ্বালান হয়েছে। সে ওয়াজির খান আর মোল্লাকে ঘোড়ায় উপবিষ্ট অবস্থায় দূর্গে প্রবেশ করতে দেখে। তাদের ঘোড়াগুলো ঘন ঘন নাক টানে আর তাদের গা থেকে ভাপ বের হয়। শীঘ্রই বাকি শবানুগামীরা দূর্গে ফিরে আসবে আর তারপরেই তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাহেন্দ্রক্ষণ যা তাকে এই আলখাল্লা পরিধানের অধিকার দান করবে। বাবর মুখ তুলে তার মায়ের দিকে তাকায়। তার চোখে শঙ্কার ছায়া ফুটে থাকলেও অভিব্যক্তিতে দৃঢ়তার ছাপ। “জলদি করো,” খুতলাঘ নিগার বলেন। “আমাদের হাতে সময় বড় কম। আলখাল্লাটা তোমার বড় হবে কিন্তু এটা দিয়েই আমাদের কাজ চালিয়ে নিতে হবে।” তিনি ফাতিমার সাহায্যে বাবরের গায়ে আলখাল্লাটা পরিয়ে পরিকর দিয়ে সেটা শক্ত করে কোমরের কাছে বেঁধে দেন এবং তার পরে তার মাথার লম্বা কালো চুলে পাগড়িটা পরান। “দেখি আমার ছেলেকে? এই মুহূর্তে তুমি কেবল একজন শাহজাদা বটে, কিন্তু চাঁদ উঠার পরেই তুমি হবে ফারগানার সুলতান।” তিনি তার সামনে একটা চকচকে পিতলে বাঁধান আয়না তুলে ধরলে বাবর সেখানে নিজের। কঠোর, হয়তো সামান্য বিস্মিত মুখের প্রতিবিম্ব ফুটে উঠতে দেখে।
“খানজাদা!” তার মা চেঁচিয়ে বাবরের বোনকে ডাকেন। মসনদের দাবি ঘোষণার সময়ে বাবরের পোশাক এবং অন্যান্য অনুষঙ্গ কি হবে সে বিষয়ে স্পষ্টতই বোঝ যায় তিনি যথেষ্ট চিন্তা ভাবনা করেছেন। তার বোন বাইরে অপেক্ষা করছিল এবং করিডোরে দাঁড়িয়ে কান খাড়া করে মায়ের ডাকের প্রতীক্ষায় ছিল। সে দ্রুত কামরার ভিতরে প্রবেশ করে। সবুজ মখমলে মোড়ান একটা লম্বা, সরু বস্তু তার হাতে ধরা। যত্নের সাথে সে তার হাতের জিনিসটা নামিয়ে রেখে সামান্য নাটকীয় ভঙ্গিতে মখমলের ভাজটা সরিয়ে ভেতরের কোষ থেকে একটা বাঁকান তরবারি বের করে আনে।
খুতলাঘ নিগার সেটা নিয়ে বাবরের দিকে বাড়িয়ে ধরেন। “ফারগানার প্রতীক, ন্যায়বিচারের তরবারি- আলমগীর।”
সাদা জেড পাথরের উপরে নানা দামী রত্নে খচিত ঈগলের মাথার মত বাঁটটা দেখামাত্র বাবর চিনতে পারে। পাখিটার বিস্তৃত ডানা মুষ্ঠিবদ্ধ হাতের বিভঙ্গ লাভ করেছে আর বাঁটের উপরে উঁচু হয়ে থাকা চুনির চোখ সম্ভাব্য আক্রমণকারীর দিকে শাণিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। তার মৃত আব্বাজানের হাতে সে বেশ কয়েকবারই এটা দেখেছে তিনি অবশ্য তাকে এটা কখনও স্পর্শ করতে দিতেন না। “প্রথমবারের মত নিজের হাতে ধরতে পেরে বেশ ভাল লাগছে।” সে বাঁটটা ধরে অদৃশ্য শত্রুর উদ্দেশ্যে সেটা কয়েকবার বাতাসে আন্দোলিত করে।
“তোমার বাবার রেখে যাওয়া সম্পদের ভিতরে এটা অন্যতম। লোকে বলে চোখের চুনি দুটো তৈমূরের, তিনি দিল্লী থেকে পাথর দুটো নিয়ে এসেছিলেন। ফারগানার নতুন সুলতান হিসাবে এখন থেকে তুমি এগুলোর মালিক।” খুতলাঘ নিগার তার সামনে হাঁটু মুড়ে বসে তরবারির মণিমুক্তা খচিত খাপটা তার কোমরের সাথে আটকে দেয়, যে ইস্পাতের শিকলের সাহায্যে সেটা ঝুলছে তার দৈর্ঘ্য ঠিক করে দেয়।
“নানিজান কোথায়?” এসান দৌলতকে আশেপাশে কোথাও দেখা যায় না এবং বাবর এই সময়ে তার উপস্থিতির প্রয়োজনীয়তা বিশেষভাবে অনুভব করে। সে মনে মনে চায় তিনি তাকে সুলতানের এই বেশে দেখুক তাকে অবিকল সুলতানের মত দেখাচ্ছে বলে মন্তব্য করুক।
“তিনি নামাজে বসেছেন। তিনি বলেছেন ফারগানার সুলতান হিসাবে তিনি তোমাকে স্বাগত জানাবেন।”
এক মহিলা ভৃত্য ভিতরে প্রবেশ করে প্রণত হয়। “মালিক, ওয়াজির খান সাক্ষাতের অনুমতি প্রার্থনা করেছেন।”
খুতলাঘ নিগার মাথা নেড়ে সম্মতি দেয়। তিনি আর খানজাদা নেকাবের নিম্নাংশ দিয়ে মুখ ঢাকতে না ঢাকতে ওয়াজির খান ভিতরে প্রবেশ করে। বাবর খেয়াল করে, এইবার সে প্রণত হয় না- সময় এত গুরুত্বপূর্ণ যে সেসব সৌজন্য প্রকাশের আবশ্যিকতা নেই। দীর্ঘদেহী সেনাপতি শাহী আলখাল্লা পরিহিত বাবরের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে সন্তুষ্টির সাথে মাথা নাড়ে। “মহামান্য শাহী পরিবার, মোল্লা আর আমার সৈন্যরা কর্তব্য পালনে প্রস্তুত। কিন্তু, এই মুহূর্তে, কামবার আলীও অন্তে যষ্টিক্রিয়ার ভোজপর্ব শেষে উপস্থিত শোকাহত অভ্যাগতদের সামনে বক্তৃতা দেবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। সে তাদের বলবে যে রাজ্য বিপর্যয়ের সম্মুখীন, আর এই বিপর্যয় সামাল দেবার পক্ষে আমাদের সুলতানের বয়স অনেক অল্প। সে তৈমূরের বংশের অন্য কোনো শাহজাদাকে রাজপ্রতিভূ হিসাবে মনোনীত করতে অনুরোধ করবে। গতরাতে মোঘুলিস্তানের খানের কাছে তার পাঠান একটা চক্রান্তপূর্ণ চিঠি আমার প্রহরীদের হস্তগত হয়েছে, যার বিষয়বস্তু তাকে মসনদে অধিষ্ঠিত করান, এছাড়াও উজিরের কুটিল ষড়যন্ত্রের অন্যান্য প্রমাণ আমাদের হাতে রয়েছে।”
“কিন্তু আমাদের হাতে এখনও সময় আছে?” খুতলাঘ নিগার হারেমের রীতিনীতির তোয়াক্কা না করে ওয়াজির খানের বাহু আঁকড়ে ধরে ব্যগ্র কণ্ঠে জানতে চান।
“আমাদের হাতে সময় আছে, কিন্তু শাহজাদাকে এখন আমার সাথে যেতে হবে নতুবা কামবার আলী আমাদের আসল উদ্দেশ্য বুঝে ফেলতে পারে। সে ভেবে বসে আছে শাহজাদা দূর্গে ফিরে এসে আপনার সাথে বসে দোয়া’দরূদ পাঠ করছেন।”
সে এবার বাবরের দিকে তাকায়। “শাহজাদা, অন্য আরেকটা আলখাল্লা দিয়ে নিজেকে অনুগ্রহ করে আবৃত করে নিন।” সে তার হাতে ধরা বাবরের ঘোড়ায় চড়ার ধূলি ধূসরিত আলখাল্লাটা তার দিকে এগিয়ে দিলে বাবর দ্রুত সেটা গায়ে চাপিয়ে নেয়, আর তার আম্মিজান দক্ষ হাতে আলখাল্লার ধাতব বাকলেসগুলো আটকে দিয়ে অভিষেকের পাগড়ির ঢেউতোলা শোভাবর্ধক পালকটা শিরাবরণী দিয়ে ঢেকে দেয়।
তরবারির বাঁটে হাত রেখে ওয়াজির খান বাবরকে তার পেছনে পেছনে বাইরের করিডোরে আসতে ইঙ্গিত করে ঘুরে দাঁড়ায়। খানজাদার পাশ দিয়ে এগিয়ে যাবার সময়ে সে আঙ্গুল দিয়ে ভাইয়ের চিবুকে হাত বুলিয়ে দেয়। তার বোনের চোখে আশঙ্কার ছায়া ভারী উপস্থিতি।
আতপ্ত আর উল্লাসের যুগপৎ উপস্থিতি বাবর নিজের ভিতরে অনুভব করে। আজ সন্ধ্যার ঘটনাবলীর উপরে তার পুরো ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। বৃদ্ধ উজিরের ধূর্ততা ছোট করে দেখবার কোনো অবকাশ নেই। ওয়াজির খান সম্ভবত তার এই আশঙ্কা টের পেয়ে মুহূর্তের জন্য দাঁড়ায়। “শাহজাদা, সাহস রাখেন, সব ঠিক হয়ে যাবে।” “সাহস।” বাবর শব্দটা বিড়বিড় করে উচ্চারণ করার ফাঁকে তরবারির অলংকৃত বাটে আঙ্গুল বুলায়।
তারা অন্ধকারাচ্ছন্ন গলিপথ, তীক্ষ্ণ ধাপযুক্ত প্যাচান সিঁড়ির কুলঙ্গিতে রাখা তেলের প্রদীপের আলোয় কিম্ভুতকিমাকার ছায়ার জন্ম দিতে দিতে দ্রুত এগিয়ে যায়। দূর্গের সবচেয়ে প্রাচীন অংশে মসজিদটা অবস্থিত, বাবরের পূর্বপুরুষদের আদেশে পেছনের পাথুরে পাহাড় খোদাই করে এটা নির্মাণ করা হয়েছে। গুহা-সদৃশ্য পাথুরে প্রকোষ্ঠ কেয়ামত পর্যন্ত টিকে থাকবে- রোদে পোড়ান মাটির ইটের তৈরি ছাদের মত ভঙ্গুর না, যা ধ্বসে পড়ে তার পিতাকে বেহেশতের পথে নিয়ে গিয়েছে।
মসজিদের সামনের ছোট শান্ত উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে ওয়াজির খানকে অনুসরণ করে সে উপস্থিত হয়। বৃষ্টি থেমে গিয়েছে এবং মেঘের আড়াল ছেড়ে চাঁদ বের হয়ে এসেছে। চাঁদের শীতল খাপছাড়া আলোতে সে ওয়াজির খানের ছয়জন প্রহরীকে মসজিদের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। তারা নিরবে তাদের সেনাপতিকে অভিবাদন জানায়।
বাবরকে বাইরে অপেক্ষা করার জন্য অনুরোধ করে ওয়াজির খান কোরানের আয়াত উত্তীর্ণ করা তীক্ষ্ণ শীর্ষদেশযুক্ত বাঁকান তোরণাকৃতি খিলানের নীচ দিয়ে মসজিদের ভিতরে প্রবেশ করে। উল্কণ্ঠিত কয়েক মুহূর্ত অতিক্রান্ত হবার পরে সে বাইরে বের হয়ে আসে। “মহামান্য শাহজাদা,” সে মৃদু কণ্ঠে বলে, “আপনি এবার ভিতরে প্রবেশ করতে পারেন।”
বাবর তার উপরের আলখাল্লা খুলে ফেলে ভিতরে প্রবেশ করে। মক্কাশরীফের দিকে মুখ করা মিহরাবের দুপাশে দুটো মশাল জ্বলছে, যেখানে দাঁড়িয়ে ইমাম সাহেব নিরবে নামাজ আদায় করছেন। আবছা আলোতে বাবর প্রায় বিশজনের মত গোত্রপতিকে আসনসিঁড়ি অবস্থায় বসে থাকতে দেখে, প্রতিটা লোক, গোত্রগত মৈত্রীর বন্ধন আর রক্তের সম্বন্ধের কারণে তার প্রতি বিশ্বস্ততা ঘোষণা করতে প্রস্তুত।
মসজিদের ভিতরে উপস্থিত প্রত্যেকের চোখের দৃষ্টি তার উপরে আপতিত, তাকে মাপছে বুঝতে পেরে, বাবর অতীতে- যারা ফারগানার সুলতান ছিলেন তাদের ওজন নিজের উপরে ভারী হয়ে চেপে বসছে অনুভব করে, মনে হয় তার কাঁধ সেই ভারের চাপে বেঁকে যাচ্ছে। বাবর মসজিদের মেঝেতে কালো পাথরে চিহ্নিত স্থানের দিকে এগিয়ে গিয়ে যেখানে তার পিতা ফারগানার মরহুম সুলতান নামাজ পড়তেন সেখানে আনত হয়ে পরম শ্রদ্ধায় পাথরের শীতল মেঝেতে কপাল স্পর্শ করে। বাইরের তারকাশোভিত আকাশে একটা প্যাচা তীক্ষ্ণ শব্দ করে উড়ে যেতে, ইমামসাহেব খুতবা পাঠ আরম্ভ করেন, যে নসিহতে বাবরকে আল্লাহতালা আর পৃথিবীর সামনে ফারগানার সুলতান হিসাবে অভিহিত করা হবে।
***
“আপনারা বুঝতেই পারছেন, সম্মানিত ভদ্ৰোমহোদয়গণ, এই বিষয়ে আমাদের বিবেচনার সামান্যই অবকাশ রয়েছে। কামবার আলী তার চেহারায় যথোচিত গম্ভীর হালছাড়া একটা অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তোলে। “এমন কি আজই, আমাদের মহামান্য মরহুম সুলতানের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সময়েই, উজবেক হার্মাদ সাইবানি খান নরকে যেন স্থান হয় বেজন্মাটার- আমাদের হুমকি দেবার মত ধৃষ্টতা দেখিয়েছে। কেবল কুটিল উজবেকরাই না, আমাদের রাজ্যের প্রতি আরও অনেকের লোলুপ দৃষ্টি আছে। এই রাজ্য পরিচালনা আর রক্ষা করতে চাইলে শাহজাদা বাবরের মত অল্পবয়সী কিশোরের পরিবর্তে পাশ্ববর্তী রাজ্যের কোনো অভিজ্ঞ শক্তিশালী ব্যক্তিকে আমাদের বেছে নিতে হবে। আমরা কাকে নির্বাচিত করবো সেটা এখনই নিশ্চিত করে বলা সম্ভব না… আজ রাতের কোনো এক সময়ে শাহী মন্ত্রণা পরিষদ বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করার জন্য মিলিত হবে।”
কামবার আলী তার চারপাশে তাকিয়ে বর্গাকার প্রস্তরখণ্ডের মেঝের উপরে নিচু কাঠের টেবিলের পেছনে তাকিয়ার উপরে আসনসিঁড়ি হয়ে বসে থাকা গোত্রপতিদের উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বরের ফিসফিস গুঞ্জন শোনে। কি পরিতাপের বিষয় তার বেল্লিক তীরন্দাজ বাবরকে শরবিদ্ধ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
শাহী দরবারের অন্য সদস্যরা, ইউসুফ, বাবা কাশক, এবং বাকী বেগও চুপ করে দেখে আর অপেক্ষা করে, তাদের সবাই নিজ নিজ পৃষ্ঠপোষককে রাজপ্রতিভূ হিসাবে নিয়োগ দিয়ে প্রাপ্ত উপঢৌকনের সম্ভাব্য পরিমাণ বিশ্লেষণের সুখস্বপ্নে বিভোর।
“আল্লাহ সাক্ষী, এটা হতে পারে না!” ফারগানার পশ্চিমাঞ্চল থেকে আগত গোত্রপতি আলী-দোস্তের কর্কশ কণ্ঠস্বর কামবার আলীর স্বপ্নচারিতায় বিঘ্ন ঘটায়। কাঠবাদামের সসে ঝলসানো আস্ত ভেড়া রাখা কাঠের অস্থায়ী টেবিলের উপরে আলী- দোস্ত সজোরে ঘুসি বসিয়ে দেয়। তার হাতে ধরা তেল চর্বি মাখান মাংস কাটার ছুরিটা সে বাতাসে আন্দোলিত করে। “শাহজাদার বয়স রাজ্য পরিচালনার পক্ষে নিতান্তই অল্প কথাটা সত্যি, আর তাই বলে আগন্তুকের দ্বারস্থ হতে হবে। আমি তৈমূর বংশের সন্তান। আমার বাবা ছিলেন মৃত সুলতানের রক্ত-সম্পর্কের ভাই। আমি একজন পরীক্ষিত যোদ্ধা- গত শীতেই প্রথম তুষারপাতের পরে আমি নিজ হাতে বিশজন উজবেককে হত্যা করেছি আমাদের গবাদি পশুর পালে হামলা করার সময়ে…?! রাজপ্রতিভূ নিযুক্ত করতে হলে আমার চেয়ে যোগ্য কাউকে খুঁজে পাবে না ভেড়ার চর্বি লেপটানো আবেগে লাল হয়ে উঠা মুখে, সে গনগনে চোখে কামরায় উপস্থিত সবার দিকে তাকায়।
“ভাইয়েরা, শান্ত হোন।” বাকী বেগ হাত তোলে সবাইকে শান্ত করার অভিপ্রায়ে কিন্তু কেউ তার বাক্যে কর্ণপাত করে না।
আলী-দোস্ত হাচড়পাঁচড় করে উঠে দাঁড়াতে, তার লোকেরা ক্রুদ্ধ মৌমাছির মত বিড়বিড় করতে করতে তার চারপাশে এসে সমবেত হয়। কিছুক্ষণের ভিতরেই একের পর এক গোত্রপতি নিজের স্বপক্ষে অকাট্য দাবি আর মসনদে নিজের অধিকার জানিয়ে উঠে দাঁড়াতে আরম্ভ করে। আলী-দোস্ত তার গামলার মত হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে তাকে অপমান করেছে ভেবে নিয়ে পাশে দাঁড়ানো একটা লোককে আঘাত করতে চেষ্টা করে এবং লোকটা উল্টে পরতে সে এবার অন্য হাতে ধরা মাংস কাটার ছুরির ডগাটা তার গলায় ঠেকায়। কাঠের অস্থায়ী টেবিলের উপরে কিছুক্ষণ আগে পরিবেশন করা ঘিয়ে ভাজা শুকনো বাদাম দিয়ে রান্না করা মুখরোচক বিরানী আশেপাশের তাকিয়ার উপরে ছিটকে পড়তে শুরু করে।
কামবার-আলী কামরার দূরবর্তী প্রান্তে নিরাপদ স্থানে দাঁড়িয়ে কামরায় বিদ্যমান বিশৃঙ্খলার দিকে তাকিয়ে থাকেন, তার অভিব্যক্তিতে বিষণ্ণতার কোনো চিহ্ন পরিলক্ষিত হয় না। এসব তথাকথিত যোদ্ধারা সব বাচ্চা ছেলের মত একটা ভেড়া- বা একটা মেয়ে মানুষের জন্য এরা খুন করতে পিছপা হয় না। ওয়াইনের মাদকতায় শুরু হওয়া এই বিশৃঙ্খলা শীঘ্রই প্রশমিত হবে এবং এর ফলে তার পরামর্শের যৌক্তিকতা আরও বৃদ্ধি পাবে। সে তাকিয়ে দেখে তালুকের মত এক গোত্রপতি আরেকজনের গলা চেপে ধরে শূন্যে তুলে তাকে ইঁদুরের মত ঝকাতে থাকে যতক্ষণ না ভরপেট খাওয়া লোকটা সবকিছু তার মুখে উগড়ে দেয়।
“ফারগানার সুলতানের নামে বলছি এসব বন্ধ করো!”
কামবার আলী চমকে ঘুরে তাকায়। বিশাল দরজার নিচে ওয়াজির খান দাঁড়িয়ে আছে আর তার পেছনে বর্ম-পরিহিত প্রহরীর দল। উজিরের মুখে ফুটে উঠা বিদ্রুপের হাসি, কামরার ভিতরে তাদের অবস্থান গ্রহণের সময়ে প্রহরীদের একজনের ধাক্কায় মাটিতে ছিটকে পড়ার সাথে সাথে অদৃশ্য হয়ে যায়। ক্রুদ্ধ দাঙ্গাকারীরা প্রথমে বুঝতে পারে না কি ঘটছে। প্রহরীরা তাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে কোষমুক্ত তরবারি চামড়ার ঢালে আঘাত করতে, শাপশাপান্ত করে, ধ্বস্তাধ্বস্তি করতে থাকা গোত্রপতিরা পরস্পরকে ছেড়ে দিয়ে থিতু হয়ে দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকিয়ে নির্বাক হয়ে যায়।
“নতুন সুলতানকে অভিবাদন জানাবার জন্য প্রস্তুত হও,” ওয়াজির খান কঠোর কণ্ঠে বলে।
“পরিতাপের বিষয়, এটা আল্লাহর ইচ্ছা যে এই মুহূর্তে আমাদের কোনো সুলতান নেই,” উজির মাটি থেকে কোনমতে উঠে দাঁড়িয়ে তার পরণের আলখাল্লার ধূলো ঝাড়তে ঝাড়তে বলে।
ওয়াজির খান কামবার আলীর শীর্ণ কাধ বজ্রমুষ্ঠিতে চেপে ধরে। “আমাদের সুলতান আছেন। মসজিদে তার নামে খুতবা পাঠ করা হয়েছে। উপস্থিত সবাই এখন মাথা নত কর।” মদের প্রভাবে বিভ্রান্ত লোকগুলো বেকুবের মত তাকিয়ে থাকে। প্রহরীরা দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোর মাঝে প্রবেশ করে জোর করে তাদের হাঁটু ভেঙে বসিয়ে দেয় এবং যারা সামান্য গাইগুই করে তাদের হাতের তরবারির চ্যাপ্টা প্রান্ত দিয়ে লাঠির মত আঘাত করে।
“ফারগানার ন্যায়সঙ্গত সুলতান, মির্জা বাবরের জয় হোক,” ওয়াজির খানের কণ্ঠস্বর গর্জে উঠে ঘোষণা করে এবং দেহের মাপের চেয়ে বড় হলুদ আলখাল্লা আর লম্বা মখমলের পাগড়ি মাথায় বাবর ভিতরে প্রবেশ করতে সে নিজেকে তার সামনে প্রণত করে। গোত্রপতিদের যারা তার সালতানাত মেনে নিয়েছে তারা তার পেছনে এসে দাঁড়ায়। সবার চোখে সতর্ক দৃষ্টি, যদি প্রয়োজন পড়ে সেজন্য সবার হাত তরবারির বাঁটে।
বাবরের মনে ক্ষীণ সন্দেহ আছে তারা তার প্রতি বিশেষ কোনো মৈত্রীর বন্ধন অনুভব করে কিনা সেটা নিয়ে। তারা কেবল একটা বাজি ধরেছে। কিন্তু এখন তারা বিজয়ী পক্ষে থাকতে ইচ্ছুক যাতে প্রতিশ্রুত প্রতিদান লাভ করতে পারে।
বিশৃঙ্খলার দিকে তাকিয়ে বাবরের কাছে পুরো দৃশ্যটা হাস্যকর মনে হয়- ভারী শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে থাকা লোকেরা মাটিতে তাকিয়া, মাংসের ঝোল আর পোলাও এ মাখামাখি অবস্থায় পড়ে আছে এবং তাদের পোষা কুকুরের দল হঠাৎ অপ্রত্যাশিত ভোজের সম্মুখীন হয়ে নিজেদের ভিতরে কামড়াকামড়ি করছে। গড়গড় করতে থাকা কুকুরের দলের চেয়ে আন্তরিক বলা যাবে না কামবার আলীর অভিব্যক্তিকে যখন সে ধীরে বাবরের সামনে হাঁটু ভেঙে বসে কপাল মাটিতে ঠেকায়।
“উজির, আর উপস্থিত সবাই এবার উঠে দাঁড়াতে পারেন।” সুলতান হিসাবে বাবর তার প্রথম আদেশ দেয়ামাত্র নিজের ভিতরে সে একটা আন্ত্রিক উত্তেজনা বোধ করে।
কামবার আলী ধড়ফড় করে উঠে দাঁড়ায়, ভেতরের আতঙ্ক দমনের ব্যর্থ প্রয়াসের লক্ষণ তার চেহারায় স্পষ্ট ফুটে আছে। “সুলতান, আপনার দরবারের সদস্যরা আপনার আদেশ পালনে প্রস্তুত।”
“তাহলে তুমি এটা কিভাবে ব্যাখ্যা করবে- মোঘুলিস্তানের খানের কাছে পাঠান এই আমন্ত্রণপত্র?” বাবর হাত বাড়ালে ওয়াজির খান তার হাতে একটা চামড়ার বাক্স উঠিয়ে দেয়। বাবর ভেতর থেকে একটা কুণ্ডলীকৃত কাগজ বের করে উজিরের চোখের সামনে ধরতে তার ভিতরে কোনো বিকার দেখা যায় না।
“রাজ্যের ভালোর জন্য আমি এটা পাঠিয়েছিলাম।” উজিরের শ্বাস-প্রশ্বাসের বেগ দ্রুত হয়ে উঠেছে।
“নিজের ভালোর জন্য এটা পাঠিয়েছিলে-” ওয়াজির খান ক্রুদ্ধ কণ্ঠে শুরু করতে বাবর হাতের ইশারায় তাকে থামিয়ে দেয়। শাসক হিসাবে এটা তার প্রথম পরীক্ষা এবং সে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে চায় নতুবা আগামীকাল, আগামী মাসে বা আগামী বছর কোনো না কোনো সময়ে তাকে তার জন্মগত অধিকার থেকে বঞ্চিত করার ষড়য়ন্ত্র আবার শুরু হবে।
কামবার আলীর মুখে এখন ক্রোধের আভাস এবং বাবর ভয় আর ঘামের তিক্ত ঘ্রাণ উজিরের ভিতর স্পষ্ট টের পায়। কিন্তু তার মৃত আব্বাজানের কাছে যে লোকটা এত প্রশ্রয় পেয়েছে তার প্রতি সামান্যতম করুণা সে বোধ করে না। কেবল ক্রোধ আর প্রতিশোধের কামনা তাকে জারিত করে।
শাহী জ্যোতিষী, শাহী কোষাধ্যক্ষ আর শাহী বাজারসরকারকে একস্থানে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে এবং হতাশায় তাদের চোখ মুখ ঝুলে পড়েছে। তাদের নিয়ে যাও,” বাবর প্রহরীদের আদেশ করে। “আমি পরে তাদের বিষয় বিবেচনা করবো।” দেয়ালের অনেক উপরে স্থাপিত একটা ক্ষুদে জাফরীর দিকে তার নজর যায় এবং মনে হয় জাফরির পেছনে সে একটা নড়াচড়া লক্ষ্য করেছে। সেখানে বসেই রাজকীয় মহিলারা উৎসবে আর ভোজসভায় মার্জিতভঙ্গিতে সবার চোখের আড়ালে থেকে অংশগ্রহণ করেন। সহজাত প্রবত্তির বলে সে বুঝতে পারে সেখানে কারা রয়েছে তার আম্মিজান আর নানিজান সেখান থেকে সুলতান হিসাবে তার প্রথম পদক্ষেপ দেখছে আর তাকে এগিয়ে যেতে অনুরোধ করছে।
তার নিজের কাছেই অবাক লাগে ভাবতে যে এখন সে মানুষের জীবন মৃত্যুর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সে বহুবার নিজের আব্বাজানকে দেখেছে মানুষকে মৃত্যুদণ্ড দিতে। গত দু’এক বছরে সে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে দেখেছে শিরোচ্ছেদ, চামড়া তুলে নেয়া, ঘোড়া দিয়ে টেনে দেহ টুকরো করে ফেলা। তাদের আর্তনাদ আর রক্তের গন্ধ এখনও তার গলায় সে অনুভব করে কিন্তু যতক্ষণ তা ন্যায়বিচার নিশ্চিত করছে তার কখনও মনে হয়নি ব্যাপারটায় কোনো অসঙ্গতি রয়েছে।
আর এখন সে নিশ্চিতভাবেই জানে তার মা আর নানীমা তার কাছে ঠিক কি প্রত্যাশা করছেন। তার নামের মানে “বাঘ” আর তাকেও সেই বিশাল মার্জারের দ্রুততায় সিদ্ধান্ত নিতে হবে। “তুমি আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছো আমাকে হত্যা করতে চেয়েছো, তাই নয় কি?” সে শীতল কণ্ঠে বলে। কামবার আলী তার চোখের দিকে তাকায় না। বাবর ধীরে ধীরে তার তরবারি কোষমুক্ত করে। “প্রহরী!” সে ওয়াজির খানের দু’জন লোকের উদ্দেশ্যে ইঙ্গিত করতে তারা উজিরকে মাটিতে ঠেসে ধরে তার দু’হাত শক্ত করে দেহের পেছনে চেপে ধরে। তারপরে তারা তার মাথা থেকে পাগড়ি খুলে নেয় এবং আলখাল্লার পেছনটা ছিঁড়ে ফেলে তার গর্দানের পেছনের দিক উন্মুক্ত করে।
উজির গর্দান টান করে ভাগ্যকে ধন্যবাদ দাও যে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা সত্ত্বেও তোমাকে আমি দ্রুত মৃত্যু দান করছি।” বাবর টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে, মায়ের কামরায় দাঁড়িয়ে কয়েক ঘন্টা আগে যেমন অনুশীলন করেছিলো তেমনিভাবে একবার তরবারিটা বাতাসে আন্দোলিত করে। সে মনে মনে প্রার্থনা করে, আল্লাহ কাজটা করার শক্তি আমাকে দাও। মাথা যেন নিখুঁতভাবে দ্বিখণ্ডিত হয়। সৈন্যদের হাতের ভিতরে উজির ছটফট করতে থাকে তার চোখে বিষাক্ত দৃষ্টি। বাবর আর একমুহূর্তও ইতস্তত না করে, তরবারি উপরে তুলে ধরে ফলাটা সজোরে উজিরের ঘাড় লক্ষ্য করে নামিয়ে আনে। পাকা তরমুজ দ্বিখণ্ডিত করার মত তরবারির ফলা উজিরের ঘাড়ের শীর্ষ, কোমলাস্থির ভিতর দিয়ে কেটে বের হয়ে আসে। বর্গাকৃতি পাথরের মেঝে, উপর দিয়ে বিচ্ছিন্ন মুণ্ডটা হলুদ দাঁত বের হয়ে থাকা গড়িয়ে যায়, তরল চুনির মত রক্তধারা গড়িয়ে পড়ে।
বাবর ধীর গতিতে আতঙ্কিত লোকদের দিকে তাকায়। “আমি হয়ত কিশোর কিন্তু আমি তৈমূরের বংশধর আর তোমাদের ন্যায়সঙ্গত সুলতান। উপস্থিত কারো মনে এ বিষয়ে দ্বিধার অবকাশ রয়েছে?”
সারা ঘরে পরিপূর্ণ নিরবতা বিরাজ করে। তারপরে ধীরে ধীরে একটা আওয়াজ ভেসে উঠে। “বাবর মির্জা, বাবর মির্জা।” শব্দটা জোরাল হয়ে কামরায় ভাসতে থাকে এবং একটা সময় মনে হয় কেবল শব্দটা যেন পরিপূর্ণ করতে পারছে না পুরো ব্যাপারটা, লোকগুলো তাদের তরবারির চ্যাপ্টা দিক দিয়ে চামড়ার গোলাকৃতি ঢালে আঘাত করতে থাকে বা হাত মুঠো করে দেয়াল বা টেবিল চাপড়াতে শুরু করে, যতক্ষণ না পুরো কামরাটা তাদের আবেগে মথিত হয়ে উঠে।
১.৩ তৈমূরের অঙ্গুরীয়
০৩. তৈমূরের অঙ্গুরীয়
বাবর দরবারে প্রবেশ করতে সভাসদবৃন্দ বুকে হাত দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে মাথা নত করে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে। বাবর ভাবে, কেবল আঠারজন, এবং তার উদ্দেশ্যে উচ্চারিত নানীজানের হুঁশিয়ারী, তাদের আনুগত্যের কি ভয়ঙ্কর পরীক্ষার মুখেই না এনে দাঁড় করিয়েছে। চোখ সরু করে সে প্রত্যেককে আলাদা আলাদা করে জরিপ করে। মাত্র একমাস আগে, যখন তার আব্বাজান জীবিত ছিলেন, তার ভাবনাচিন্তা কি বিচিত্রভাবে অন্যরকম ছিল। সে তখন কল্পনা করতে পোড় খাওয়া এসব যোদ্ধাদের ভেতরে কে তাকে অসি চালনা শেখার জন্য তাদের সাথে যোগ দিতে আহবান জানাবে, কে জাক্সারটাসের তীরে পোলো খেলার ছলে তাদের সাথে ঘোড়সওয়ারির জন্য আমন্ত্রণ করবে। এখন বিষয়টা একেবারে আলাদা। তার বাল্যকালের অকাল মৃত্যু হয়েছে। খেলার সময় শেষ। তারা এখন যুদ্ধের মন্ত্রণাসভায় সমবেত হয়েছে।
বাবর তার জন্য নির্দিষ্ট মখমলের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়ে, গোত্রপতিদেরও বসতে ইঙ্গিত করে, হাত উঁচু করে। “কাশিম, চিঠিটা নিয়ে এসো।”
তার পেছনে পেছনে সভাকক্ষে কালো আলখাল্লা পরিহিত যে লম্বা, শীর্ণকায় লোকটা প্রবেশ করেছিলো, সে এবার সামনে এগিয়ে এসে মাথা নত করে অভিবাদন জানায় এবং আগের দিন ক্লান্ত বার্তাবাহক যে চিঠিটা নিয়ে এসেছে সেটা তার হাতে তুলে দেয়। শান্তি হারাম করে দেয়া চিঠিটা হাতে ধরতে তার আঙ্গুলের সবগুলো গাট সাদা হয়ে আসে। এমনকি এখন তার নিজের আম্মিজানও কামরায় বসে কাঁদছেন, মুখটা নিজের বুকের উপরে ঝুঁকে পড়েছে, বাবরের বোন খানজাদার কোনো কথাই কানে তুলছেন না এমনকি নিজের মা, তার নানীজান এসান দৌলতের তীক্ষ্ণ যুক্তিও তার কান্না প্রশমিত করতে পারছে না। আম্মাজানের এভাবে ভেঙে পড়া দেখে তার নিজের আত্মবিশ্বাসে চিড় খেয়েছে। বাবার আকষ্মিক দুর্ঘটনার পরেও খুতলাঘ নিগার এভাবে ভেঙে পড়েননি, কিন্তু এখন হতাশা তাকে আপুত করে ফেলেছে।
“উজির সাহেব, চিঠিটা উচ্চকণ্ঠে পাঠ করুন যাতে উপস্থিত সবাই আমার চাচাজান, সমরকন্দের সুলতান আহমেদের, বিশ্বাসঘাতকতার কথা পরিষ্কার শুনতে পায়।”
কাশিম চিঠিটা পুনরায় তার হাত থেকে নিয়ে ধীরে ধীরে সেটা খুলে। বাবর ভাবে, তাকে উজির নির্বাচিত করে সে ভুল করেনি। পরিবার পরিজনহীন একজন দরিদ্র ব্যক্তি অথচ ঈর্ষণীয় জ্ঞানের অধিকারী তার পূর্ববতী উজির কামবার আলীর মত উচ্চাকাতি কুচক্রী না লোকটা, যার মাথা এখন দূর্গের প্রবেশদ্বারে একটা দণ্ডের শীর্ষদেশে সংস্থাপিত হয়ে পচছে।
কাশিম কেশে গলা পরিষ্কার করে। “বিষাদের এই মুহূর্তে আল্লাহতালার আশীর্বাদ আমার ভাতিজার উপরে অবিশ্রান্ত ধারায় বর্ষিত হোক। আল্লাহতালা, তার পিতা আমার ভাইকে পার্থিব বোঝা থেকে মুক্তি দেয়াকে যুক্তিসংগত মনে করে তার আত্মাকে বেহেশতের উদ্যানে ডেকে নিয়েছেন। আমরা যারা পেছনে রয়ে গিয়েছি যাদের শোকাহত হবার কারণ রয়েছে কিন্তু জীবিতদের প্রতি কর্তব্যও আমাদের স্মরণে রাখতে হবে। ফারগানা আমি কোনমতেই স্বজ্ঞানে এই ক্ষুদ্র, দারিদ্রপীড়িত এলাকাকে রাজ্য হিসাবে অভিহিত করতে পারি না- অরক্ষিত আর একলা হয়ে পড়েছে। তৈমূরের উত্তরসূরীদের শত্রুরা চারপাশ থেকে ঘিরে আসছে। আমার ভাইয়ের ছেলে, নিতান্তই বালক, নগ্ন আর আক্রম্য অবস্থায় রয়েছে। তাকে রক্ষার্থে আমি যদি এখনই কোনো পদক্ষেপ না নেই, তবে নিজের পরিবারের প্রতি যথাযথ ভালবাসা প্রদর্শনে আমি ব্যর্থ হয়েছি বলে মনে করবো। প্রিয় ভাতিজা, এই চিঠি যখন তুমি পড়ছে, আমার সৈন্যরা তখন সমরকন্দের নীলাভ-সবুজ তোরণ অতিক্রম করে ফারগানার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে গেছে। ফারগানার নিরাপত্তার জন্য আমি একে অঙ্গীভূত করছি। তোমার আন্তরিক ধন্যবাদ এক্ষেত্রে কেবল বাক্যের অপচয় ঘটাবে। কোনো ধরণের ঝামেলা বা প্রতিরোধ আমি বরদাশত করতে রাজি নই এবং আশা করছি খুদে ফারগানা একটা দারুণ শিকারের ক্ষেত্র বলে ভবিষ্যতে বিবেচিত হবে। তোমার প্রসঙ্গে বলি, প্রিয় ভাতিজা, আমি তোমাকে আমার আশ্রয়ে নিয়ে আসব এবং পিতার আদর কাকে বলে আমার কাছ থেকে তুমি সেটা আবার জানতে পারবে। এবং যখন তুমি প্রাপ্তবয়স্ক হবে, তখন আমিই তোমার জন্য একটা খুদে জায়গীর খুঁজে বের করবো, যেখানে তুমি শান্তিতে এবং সন্তুষ্টিতে বসবাস করতে পারবে।”
যোদ্ধার দল অস্বস্তির সাথে নড়েচড়ে বসে, ভুলেও কেউ কারো চোখের দিকে তাকায় না। তাম্বাল, বাবরের দুরসম্পর্কের আত্মীয়, অস্পষ্ট কণ্ঠে কিছু একটা বলে এবং আলি মাজিদ বেগ, সমরকন্দের আগুয়ান বাহিনী তারই এলাকার উপর দিয়ে সরাসরি এগিয়ে আসবে, ভেড়ার চামড়ার কারুকাজ করা আঁটসাট জ্যাকেট মনোযোগ দিয়ে খোটাতে শুরু করে যেন সহসা সেটায় পোকার সংক্রমণ ঘটেছে। বাবর তাদের আশঙ্কা অনুভব করতে পারে। তৈমূরের বংশধরদের ভিতরে তারা চাচাজান সবচেয়ে ক্ষমতাবান আর সমরকন্দ চীন আর পারস্যের ভিতরে বিদ্যমান সিল্ক রুটের উপরে অবস্থিত, চারপাশে উর্বর ফলের বাগান, আর গম এবং তুলার ক্ষেত থাকার কারণে তৈমূরের অধিকৃত এলাকার ভিতরে সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী। সমরকন্দ নামের অর্থই হল চর্বির শহর যাব দেয়ালের পাশ দিয়ে প্রবাহিত জারাফশান নদীকে বলা হয় স্বর্ণ প্রসবিনী।
“আমি আমার দ্রুতগামী অশ্বারোহীদের কেন পাঠিয়েছিলাম এত্তেলা দিতে আপনারা এখন বুঝতে পারছেন। ফারগানার স্বাধীনতার প্রতি এই জঘন্য হুমকীর সমুচিত জবাব দিতে হলে আমাদের প্রস্তুত হতে হবে। আমি অল্পবয়স্ক হতে পারি, কিন্তু আমি আপনাদের ন্যায়সঙ্গত সুলতান। আমার নামে মসজিদে খুতবা পাঠের সময়ে আপনারা উপস্থিত ছিলেন। কামবার আলী আর তার সহযোগীদের আমি শায়েস্তা করেছি। এখন আমি আপনাদের আহ্বান জানাচ্ছি, বহিঃশত্রুর মোকাবেলায় আমার পাশে এসে দাঁড়াবার জন্য, নিজেদের সম্মান রক্ষার্থেই যা আপনাদের করা উচিত।” বাবরের কণ্ঠস্বর শান্ত আর পরিষ্কার, তার উচ্চারিত শব্দ পাথরের দেয়ালে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে সুমধুর প্রতিধ্বনির জন্ম দেয়। ওয়াজির খানের সহায়তায় বাবর আজ যা বলবে সেটা আগে থেকেই অনুশীলন করেছে।
নিরবতা। বাবরের আশা স্তিমিত হতে থাকে এবং সে টের পায় তার পেটের ভিতরটা কেমন ফাঁপা লাগছে। প্রয়োজন হলে সে ওয়াজির খানকে ডেকে পাঠাবে কথা বলার জন্য তার অকাট্য যুক্তি গোত্রপতিরা যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করবে, যদিও বাবর তার বিশ্বস্ত দেহরক্ষী বাহিনীর প্রধানের সহায়তা ছাড়াই সফল হবার আশা পোষণ করে। তাকে অবশ্যই কঠোর হতে হবে…বয়সের কারণে যতটা সম্ভব ঠিক ততটাই মন্দ্র কণ্ঠে সে আবার অনুরোধ করে: “আমাদের অবশ্যই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। আমরা যদি হাত গুটিয়ে বসে থাকি, তবে আগামী পূর্ণিমার আগেই সমরকন্দের বাহিনী আমাদের তোরণের বাইরে এসে শিবির ফেলবে।”
“মহামান্য সুলতানের অভিপ্রায় কি জানতে পারি?” আলি মজিদ বেগ মাথা তুলে সরাসরি বাবরের চোখের দিকে তাকায়। তার বাবার সবচেয়ে বিশ্বস্ত গোত্রপতিদের ভিতরে সে অন্যতম এবং বাবর লোকটার পটোলচেরা চোখের দৃষ্টিতে সমর্থন দেখতে পেয়ে কৃতজ্ঞ বোধ করে।
“সুলতানের বাহিনী সমরকন্দ থেকে জারাফশান নদীর তীর বরাবর পূর্বদিকে এগিয়ে যাবে। আমরা বৃত্তাকারে তাদের পাশ কাটিয়ে গিয়ে উত্তরের পাহাড়ের দিক থেকে তাদের আক্রমণ করবো। তারা সেদিক থেকে আক্রমণ প্রত্যাশা করবে না। আমরা আমার চাচাজানকে দেখিয়ে দেবো যে ফারগানা নিজেকে রক্ষা করতে জানে।” পরিকল্পনাটা ওয়াজির খান তাকে বলেছে এবং সে পুরো বিষয়টা তাকে একে দেখালে বাবর বুঝতে পেরেছে এতে কাজ হলেও হতে পারে।
আলি মজিদ বেগ চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে। “সুলতান, আপনি ঠিকই বলেছেন। উত্তরের গিরিপথ থেকে আমরা তাদের আক্রমণ করতে পারি এটা ব্যাটাদের মাথাতেও আসবে না।”
“আমরা আপনার চাচাকে প্রতিহত করতে পারব। এটা সম্ভব- অন্তত এখনকার মত হলেও। কিন্তু সাইবানি খান আসলে আমরা কি করবো- সে আসবেই?” তামবাল শান্ত কণ্ঠে প্রশ্নটা করে। আলি মজিদ বেগের মত সে বাবরের চোখের দিকে তাকায় না, চোখ সরিয়ে নেয়।
বাবর টের পায় তামবালের কথায় আবার অস্বস্তিকর পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। তৈমূরের রাজত্বে অনেক আগে থেকেই উজবেক সম্প্রদায় হামলা করে এসেছে, উত্তরের তৃণভূমির মাঝে অবস্থিত আশ্রয়স্থল ছেড়ে তারা ঘনঘন আক্রমণ করেছে এবং লুঠতরাজ চালিয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিককালে, তাদের নতুন নেতা সাইবানি খানের নেতৃত্বে তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। তারা এবার প্রভূত্ব স্থাপনের অভিপ্রায়ে অভিযানে বের হতে চাইছে। আর ক্ষুদ্র ফারগানা যথেষ্ট লোভনীয় একটা লক্ষ্যবস্তু হিসাবে বিবেচিত হতে পারে। “সময় হলে সেই উজবেক আর তার ছুঁচোদেরও আমরা সমুচিত জবাব দেবো,” বাবর নির্ভীক কণ্ঠে বলে।
“কিন্তু আমাদের মিত্র প্রয়োজন। তৈমূরের বংশধরদের অধীনে শাসিত রাজ্য বা ফারগানা কেউই একা নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখতে পারবে না। উজবেকরা, শেয়াল যেমন একটা একটা করে মুরগী ধরে তেমনি এক এক করে আমাদের পরাজিত করবে,” তামবাল বলতে থাকে।
“অবশ্যই আমাদের মিত্র প্রয়োজন, কিন্তু আমরা সেটা স্বাধীন মানুষ হিসাবে বেছে নেব, ভাল মনিবের অধীনে নতজানু দাসের মত নয়,” বাবর তাদের বোঝাতে চেষ্টা করে।
“স্বাধীন মানুষের চেয়ে একজন দাস হয়ত বেশি দিন বেঁচে থাকতে পারে। আর সময় যখন অনুকূল হবে সে তখন আবার স্বাধীনতা লাভের জন্য প্রয়াস নেবে। আমরা যদি আপনার চাচার অধীনতা মেনে নেই তবে আমরা উজবেকদের শায়েস্তা করতে পারব। আর সাইবানি খানের মাথা তার কাঁধের উপর থেকে গড়িয়ে পড়লে এবং তার ভিতরে খড় ভরে হারেমে ঝোলাবার জন্য একটা দর্শনীয় বস্তুতে পরিণত হলে ফারগানার স্বাধীনতার বিষয়টা বিবেচনা করার জন্য আমাদের পক্ষে সেটা হবে উপযুক্ত সময়।”
কামরার ভিতরে একটা ঐক্যমতের গুঞ্জন ধ্বনিত হয় এবং অবশেষে এবার তামবাল তার চোখের দিকে তাকায়। তার মুখের অভিব্যক্তি বিষণ্ণ কিন্তু ঠোঁটের সামান্য বাঁক সেটা ভেস্তে দিয়ে সন্তুষ্টি ঠিকই ফুটিয়ে তুলেছে যে তার কথা মোক্ষম স্থানে আঘাত করেছে।
বাবর সহসা উঠে দাঁড়ায় এবং সিংহাসনের নিচে একটা পাদানি থাকায় ভাগ্যকে মনে মনে ধন্যবাদ জানায় যা তার কিশোর অবয়বকে সামান্য বাড়তি উচ্চতা দান করে। “অনেক হয়েছে! আমরা আমার চাচাজানের বাহিনীকে আগে ফিরিয়ে দেব, এবং তারপরে লোকবলের ভিত্তিতে আমি- আপনারা কেউ না- সিদ্ধান্ত নেব ফারগানা কার সাথে মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ হবে।”
গোত্রপতিরা কিছু না বলে সবাই পড়িমড়ি করে উঠে দাঁড়ায়- সুলতান দাঁড়িয়ে আছেন এসময়ে বসে থাকাটা একটা অচিন্তনীয় ব্যাপার, সে তারা মনে মনে যাই ভাবুক না কেন। এমনকি অপরের বাহু ছিঁড়ে নেয়ার মত শক্তিশালী যোদ্ধাও দরবারের এসব আদবকায়দা সম্বন্ধে পরিপূর্ণ ওয়াকিবহাল।
“আগামী চারদিন পরে আমরা রওনা দেব। আমি তোমাদের আদেশ করছি সমস্ত লোকজন নিয়ে এখানে এসে আমার সাথে যোগ দেবার জন্য। তাদের সবাইকে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে আসতে বলবে।” সহজাত প্রবৃত্তির বশে বাবর কথাটা শেষ করে ঘুরে দাঁড়িয়ে দরবার থেকে বের হয়ে আসলে, তার উজির আর ওয়াজির খান তাকে অনুসরণ করে।
“সুলতান আপনি ভালই সামলেছেন বিষয়টা আর তর্কের কোনো অবকাশ না দিয়ে বুদ্ধিমানের কাজ করেছেন।” দরবারের দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়া মাত্র ওয়াজির খান মন্তব্য করে।
“আমি সত্যিই জানি না। আমার আহবানের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য আমাকে আগামী চারদিন অপেক্ষা করতে হবে। তাদের ভিতরে কেউ কেউ সম্ভবত সমরকন্দে আমার চাচার কাছে ইতিমধ্যে দূত পাঠিয়েছে। আমার চেয়ে তিনি তাদের বেশি উপঢৌকন দেবার সামর্থ্য রাখেন।” বাবর হঠাৎ ক্লান্ত বোধ করে আর তার মাথা যেন ব্যাথায় ছিঁড়ে যায়।
“সুলতান, তারা আসবে।” কাশিমের নিরুদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর বাবরকে চমকে দেয়। উজির সাহেব সাধারণত তাকে কোনো প্রশ্ন করা না হলে নিজে থেকে কথা বলেন না। মাত্র চার সপ্তাহ আগে আপনার নামে “খুতবা পাঠ করা হয়েছে-আপনার গোত্রপতিরা নিজের লোকদের কাছেই মুখ দেখাতে পারবে না যদি তারা আপনাকে এত দ্রুত আর যুদ্ধে নিজেকে প্রমাণ করার কোনো সুযোগ না দিয়েই পরিত্যাগ করে। আর সুলতান, এখন যদি আমার জন্য আর কোনো আদেশ না থাকে তবে আমি আমার কাজে ফিরে যেতে চাই।” সে দ্রুত তাদেরকে রেখে গলিপথ দিয়ে এগিয়ে যায়। “আমি কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করি যেন তার কথাই ঠিক হয়,” বাবর বিড়বিড় করে বলে, তারপরে সহসা ক্ষেপে উঠে পাথরের দেয়াল একবার না দুইবার, লাথি বসিয়ে দিলে তার ভিতরে জমা হওয়া আবেগ অনেকটা প্রশমিত হয়। সে যখন তাকিয়ে দেখে ওয়াজির খান বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, তখন নিজের মুখে সামান্য হাসি ফুটিয়ে তোলে এবং এক মুহূর্তের জন্য তার মন থেকে দুশ্চিন্তার সব মেঘ অপসারিত হয়েছে।
***
বাবর জেনানামহলের দিকে এগিয়ে যেতে, পরিচারকের দল আগে আগে দৌড়ে যায় সুলতানের আগমন সংবাদ ঘোষণা করতে। আজকের দিনটা সেসব দিন থেকে কত আলাদা, যখন সে এই একই গলিপথ দিয়ে দৌড়ে গিয়ে তার মায়ের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ত, আর তিনি প্রথমে বকা দিলেও পরক্ষণেই পরম মমতায় তার গায়ে হাত বুলিয়ে দিতেন। আর এখন কত আড়ম্বরের ঘনঘটা। মধূমক্ষিকার মত ঘরের বিন্যাসে প্রবেশ করতে, কালো চোখের একটা ঝলক আর মসৃণ, সুগঠিত গোড়ালির শোভাবর্ধনকারী সোনার মলের আভা সে দেখতে পায় এবং চন্দনকাঠের গন্ধে ভারী হয়ে থাকা বাতাসে শ্বাস নেয়। সে এখনও যদিও নারী সংসর্গ করেনি এবং বয়স এখনও অল্প হওয়া সত্ত্বেও মেয়েরা তার চোখে পড়ার জন্য এখনই প্রতিযোগিতা শুরু করেছে- এমনকি ফরিদা, কামবার আলীর তরুণী বিধবা স্ত্রী, তার মা দয়াপরবশ হয়ে তাকে হারেমে আশ্রয় দিলে, সেও বাদ যায় না। সে যদিও এখনও তার মৃত স্বামীর জন্য শোকপালন করছে, কিন্তু বাবর ঠিকই তাকে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখেছে। আর বাকীরা ইচ্ছা করেই তার যাত্রা পথে উঁকি দেয়, তাদের প্রত্যেকের চোখে স্পষ্ট আমন্ত্রণ।
সে যেখানে দেখে গিয়েছিল সেখানেই তার মাকে দেখতে পায়, কিন্তু এখন তিনি ঘুমিয়ে আছেন। তার বোন খানজাদা পিঠ সোজা করে মাটিতে বসে রয়েছে, থুতনির নিচে হাটু ভাঁজ করা, কামরার এককোণে বসে আনমনে মেহেদী রাঙান হাতে, সোনালী শেকলের প্রান্তে ফিরোজা খচিত বকলেসে বাঁধা পোষা বেজীর সাথে খেলছে। ভাইকে দেখামাত্র সে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায়। “ভালো?” সে ব্যগ্র কণ্ঠে জানতে চায়, কিন্তু গলার স্বর নিচু রাখে যাতে খুতলাঘ নিগার জেগে না উঠেন।
“আমরা অচিরেই জানতে পারবো। আগামী চারদিনের ভিতরে রওয়ানা দেবার আদেশ দিয়ে আমি আসছি। আম্মিজান কেমন আছেন?”
খানজাদার ভ্রু কুচকে উঠে। “তাকে কিছুতেই বোঝাতে পারবে না। তিনি ধরেই নিয়েছেন আমাদের চাচাজান মসনদ দখল করে তোমাকে হত্যা করবে। তিনি একবার তাকে নাকি বলতে শুনেছেন যে ফারগানা সমরকন্দের সাথে একটা আকর্ষণীয় বাড়তি অংশ হিসাবে যুক্ত হতে পারে। আম্মিজান বারবার বলছেন তিনি সবসময়ে আমাদের রাজ্যকে দখলযোগ্য আর ঘৃণার সাথে অভিহিত করতেন। আব্বাজান এ কারণেই তার সীমান্তে মাঝেমাঝে হামলা চালিয়েছিল- গৌরবের খাতিরে, দেখাতে চেয়েছিলেন তিনি মোটেই ভীত নন।”
“বেশ, আমি নিজেও অবশ্য ভীত নই। আমরা যদি এই হুমকির যথাযথ উত্তর দিতে ব্যর্থ হই তাহলে তৈমূরের বংশধর বলে আমাদের মুখ দেখাবার উপায় থাকবে না। পরাভব স্বীকার করার চেয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে মারা যাওয়াও আমি মেনে নেব।” বাবর তার নিজের কণ্ঠের আবেগে নিজেই চমকে উঠে। আড়চোখে তাকিয়ে দেখে তার মা ঘুম থেকে জেগে উঠেছেন। তার কথা নিশ্চয়ই তিনি শুনতে পেয়েছেন। তার চোখ যদিও এখনও লাল কিন্তু তার অভিজাত মুখাবয়বে গর্ব ঝলসে উঠে। “আমার বেটা,” মৃদু কণ্ঠে হাত বাড়িয়ে তিনি বলেন। “আমার বালক বীর।”
***
দূর্গের প্রকারবেষ্টিত সমতল ছাদের উপরে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে, তারাদের এত উজ্জ্বল বা এত বেশি সংখ্যককে আকাশের গায়ে ভেসে থাকতে সে আগে কখনও দেখেনি। বাতাস শীতল আর নির্মল। বুক ভরে তাজা বাতাস টেনে নিতে আসন্ন শীতের আমেজ বাবর অনুভব করতে পারে যখন নদীগুলো জমে বরফে পরিণত হবে। আর পাহাড়ের উপর থেকে নেকড়ের দল গ্রামগুলোতে এসে হাজির হবে এবং পশুপালকের নধর ভেড়াগুলো শিকার করবে।
আর কয়েকঘণ্টা পরেই সে তার প্রথম অভিযানে রওয়ানা দেবে। তার বাবার ঈগলের মত বটের তরবারি, আলমগীর তার পরিকর থেকে ঝুলছে কিন্তু সুলতানের বর্ম তার এখনও বড় হয়। ওয়াজির খান শাহী অস্ত্রশালা থেকে তার জন্য একটা ধাতব-শৃঙ্খল নির্মিত অলঙ্কৃত বক্ষাবরণী আর চূড়াযুক্ত শিয়োস্ত্রাণ খুঁজে বের করেছে, যেগুলো তার গায়ের প্রায় মাপমতই হয়েছে। তৈমূরের কোনো শাহজাদার ছিল এসব যুদ্ধসাজ, উপরের তারকারাজির মত বর্মে খচিত শীতল আর উজ্জ্বল পাথরের উপরে আঙ্গুল বুলিয়ে সে ভাবে, আর তার কি পরিণতি হয়েছিলো?
নিচের আস্তাবল থেকে মৃদু হ্রেষারব ভেসে আসে। ওয়াজির খান তাকে বলেছে, ঘোড়া আগে থেকেই আসন্ন যুদ্ধের কথা টের পায়। দূর্গের দেয়ালের বাইরে, বাবর ঝুড়িসদৃশ পা-ওয়ালা বহনযোগ্য ধাতব পাত্রে কয়লার গনগনে লাল আভা এখান থেকেই দেখতে পায়। অস্থায়ী শিবিরগুলো জেগে উঠতে শুরু করেছে। চামড়ার তাবুর ভেতর থেকে আবছা অবয়ব বাইরে বের হয়ে এসে হাত পা নেড়ে প্রত্যূষের শীতের আমেজ ভাঙতে চেষ্টা করে। পরিচারকের দল পানি ভর্তি জগ নিয়ে আসা যাওয়া করে আর আলকাতরায় ডুবান কাপড়ে আগুন ধরিয়ে মশাল জ্বালিয়ে দেয়।
তার প্রায় সব গোত্রপতিই এসেছে, বাবর সন্তুষ্ট চিত্তে ভাবে। চারহাজার সৈন্যের একটা বাহিনী নিয়ে সে যাত্রা শুরু করবে। সমরকন্দের শক্তির কাছে নেহাতই ছোট, কিন্তু নিজেদের উপস্থিতি জানান দিতে আর ক্ষতি সাধনের জন্য পর্যাপ্ত হয়ত সন্ধি আর মীমাংসায় সম্মত করানোর জন্য যথেষ্ট। তার মরহুম আব্বাজানের রেখে যাওয়া কৌতূহলকর আর ঘটনাবহুল সামরিক অভিযানের প্রতি আরও মনোযোগ দেয়া তার উচিত ছিল। আর সেটা না দেবার কারণে তাকে এখন ওয়াজির খানের পরামর্শের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। কিন্তু নিজেকে সে প্রতিশ্রুতি দেয় যে শীঘ্রই সব শিখে নেবে। তাকে শিখতেই হবে।
ভোরের আলো এখন ফুটতে শুরু করেছে, একটা ধূসর কমলা রঙের আলোর আভা পাহাড়ের উপর দিয়ে ভেসে উঠে তার এবড়োখেবড়ো প্রান্তরেখা আলোকিত করে তোলে। বাবর সহসা একদল অশ্বারোহীকে উপত্যকার উপর দিয়ে দ্রুতবেগে ছুটে আসতে দেখে- সম্ভবত দেরি করে আসা কোনো যোদ্ধার দল। ঘোড়সওয়াড়দের এগিয়ে আসবার দ্রুততায় প্রীত হয়ে সে পাথরের সিঁড়ি বেয়ে নিচের আঙ্গিনায় নেমে আসে তাদের স্বাগত জানাতে।
দূর্গের প্রবেশ পথের ঢাল ধরে ঘোড়ার আগুয়ান বহর ভাপ ছড়াতে ছড়াতে উঠে আসে। তাদের দলনেতা চিৎকার করে দূর্গের গজাল দিয়ে মজবুত করে তোলা। দরজা খুলে তাদের ভিতরে প্রবেশ করতে দেবার অনুমতি প্রার্থনা করে।
“দাঁড়াও!” ওয়াজির খানের কণ্ঠস্বর বাতাস চিরে ভেসে আসে। বাবর দেখে হন্তদন্ত হয়ে নেমে এসে তার দেহরক্ষী বাহিনীর প্রধান সদর দরজার জাফরির ফুটো দিয়ে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে। তাদের সবুজ রেশমের বুকে গুঁড়িমেরে থাকা বাঘের নিশান ঘোষণা করছে নতুন আগত অশ্বারোহী বাহিনী ফারগানা নয় সমরকন্দ থেকে আসছে।
অশ্বারোহী বাহিনীর দলনেতার ঘোড়া লাগামে টান পড়তে পিছিয়ে আসে। “আমরা সংবাদ নিয়ে এসেছি,” সে কর্কশ কণ্ঠে বলে। “আমাদের সুলতান ইন্তেকাল করেছেন।”
“মহামান্য সুলতান, আপনি অনুগ্রহ করে সরে দাঁড়ান। আমাকে ব্যাপারটা সামলাতে দেন। পুরোটাই কোনো ধরণের চালাকি হতে পারে,” ওয়াজির খান তাকে সতর্ক করে দিয়ে তারপরে অশ্বারোহী বাহিনীকে ভিতরে প্রবেশের সুযোগ করে দেবার জন্য প্রহরীদের ইঙ্গিত করে দরজা খুলে দেবার জন্য। তরবারির বাঁটে হাত রেখে সে সামনে এগিয়ে আসে। “তোমাদের পরিচয় দাও।”
“আমি বাইসানগার, সমরকন্দের সুলতানের দেহরক্ষী বাহিনীর একজন অধিনায়ক। এরা আমার লোক।”
বাইসানগারের মুখ ঘাম আর ধূলোয় মাখামাখি কিন্তু বাবরের যেটা সবচেয়ে চোখে পড়ে সেটা হল ধূলোর আস্তরণের নিচে তার চরম ক্লান্তি। এটা কোনো ধোকাবাজির ঘটনা হতে পারে না। ওয়াজির খানের হুঁশিয়ারী অমান্য করে সে সামনে এগিয়ে আসে। “আমি বাবর, ফারগানার সুলতান। আমার চাচাজানের কি হয়েছে?”
“আমাদের সুলতান ফারগানার মহামান্য সুলতানকে… প্রতিরক্ষার অভয় দানের জন্য সমরকন্দ থেকে রওয়ানা হয়েছিলেন। রাতের বেলায় তিনি তার বাহিনীর সাথে একটা খরস্রোতা নদীর পাশে অস্থায়ী ছাউনি স্থাপন করেছিলেন এবং তার লোকের নদীর উপরে একটা অস্থায়ী সেতু নির্মাণের সময়ে উজবেকরা আমাদের অতর্কিতে আক্রমণ করে। আলো ফোঁটার দু’ঘণ্টা পরের ঘটনা এটা। বিস্ময় আর বিভ্রান্তিতে আমরা কচুকাটা হয়ে যাই। আমাদের রণহস্তী, উটের বহর আর অন্যান্য ভারবাহী জম্ভর দল আতঙ্কে দিগ্বিদিক ছুটে পালায়, তাদের সামনে যা কিছু পড়েছে সব কিছু তারা মাড়িয়ে গেছে। আমাদের লোকেরা বীরত্বের সাথে মোকাবেলা করতে চেষ্টা করে কিন্তু তাদের বেশিরভাগই মারা যায়। কেউ কেউ অসমাপ্ত সেতুর উপর দিয়ে পালাতে চাইলে তাদের ভারে সেতু ভেঙে পড়ে এবং পানির তোড়ে তারা ভেসে যায়। নদীর পানি শীঘ্রই লাল হয়ে উঠে- উজবেক আর আমাদের রক্তে, এটা সত্যি- কিন্তু আমরা পর্যদস্ত হয়েছি।”
“আর আমার চাচাজান?”
“আক্রমণ আরম্ভ হবার সময়ে তিনি নদীর তীরে তার লাল রঙের তাবুতে অবস্থান করছিলেন। তিনি সেখান থেকে কোনমতে ঘোড়ায় চেপে শত্রুর মোকাবেলা করতে এগিয়ে আসেন কিন্তু কোথা থেকে একটা তীর এসে তার গলা বিদ্ধ করতে তিনি মাটিতে পড়ে গিয়ে যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকেন। আমরা তাকে ঘোড়ার খুরের আওতা থেকে সরিয়ে নিয়ে আসি বটে, কিন্তু হেকিম বৈদ্যদের ডেকে কোনো লাভ হয়নি- হেকিমের কিছুই করার ছিল না। তারা রক্তপাতই বন্ধ করতে পারেনি। কয়েক ঘণ্টার ভিতরেই তিনি ইন্তেকাল করেন। খবরটা আমাদের লোকদের ভিতরে ছড়িয়ে পড়তে কোনো কোনো গোত্রপতি, অনাগত আশঙ্কায় নিজেদের লোকদের ডেকে নিয়ে গ্রামে ফিরে গেছে।” ক্ষোভে বাইসানগারের কণ্ঠস্বর তিক্ত শোনায়।
“আর তোমরা কেন এখানে এসেছো?”
“আপনার চাচাজানের অন্তিম ইচ্ছা পূরণ করতে। ফারগানার জন্য লোভ করার কারণেই আল্লাহতালা তাকে শাস্তি দিয়েছে। গলায় জমে থাকা রক্তের বুদবুদের ভিতর দিয়ে শেষ নিঃশ্বাস নেবার তিনি আপনার কাছে করুণা ভিক্ষা চেয়েছেন যাতে বেহেশতের উদ্যানে প্রশান্তিতে বিশ্রাম নিতে পারেন।”
বাবর ভাবে, আমি যে চাচাজানকে চিনি মোটেই তার মত আচরণ না, কিন্তু হয়ত মৃত্যু সন্নিকটে উপস্থিত বুঝতে পারলে মানুষ বদলে যায়।
“তুমি যা বলছে তার স্বপক্ষে কোনো প্রমাণ তোমার কাছে আছে?” ওয়াজির খানের এক চোখে এখন জ্বলজ্বল করছে সন্দেহ এবং বাবর এবার খেয়াল করে সে তার লোকদের এখনও সরে দাঁড়াবার নির্দেশ দেয়নি। বাইসানগারের দিকে তার তিনজন সৈন্য এখনও ধনুক তাক করে দাঁড়িয়ে আছে।
“এই আমার প্রমাণ।” বাইসানগার তার আঁটসাট চামড়ার জ্যাকেটের গভীরে হাত ঢুকিয়ে একটা ছোট, দাগযুক্ত থলে বের করে। থলেটার গলার কাছের বেণী করা দড়ির ফাঁস আলগা করে সে ভেতর থেকে একটা কাপড়ের টুকরো বের করে আনে। যত্নের সাথে, শ্রদ্ধাবনত চিত্তে, সে কাপড়ের ভাঁজ খুলতে ভেতরের বস্তু দৃশ্যমান হয়: রক্তে রঞ্জিত একটা সোনার বেশ ভারী আংটি।
বাইসানগার আংটিটা বাড়িয়ে ধরলে বাবরের দম আটকে আসতে চায়। “দেখেন,” প্রায় ফিসফিস কণ্ঠে বাইসানগার বলে, “মহান তৈমূরের অঙ্গুরীয়।” হলুদ ধাতুর উপর খোদাই করা ক্রুদ্ধ বাঘটা এখনই বুঝি গর্জে উঠে লেজ ঝাপটাবে।
***
যুদ্ধকালীন মন্ত্রণা পরিষদের মেজাজ এবার একেবারেই আলাদা। বাবর, একপাশে উজির আর অন্যপাশে ওয়াজির খান পরিবেষ্টিত হয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে, ভেতরে অবস্থানরত গোত্রপতিদের ঘটনাবলীর অসাধারণ পরিণতি নিয়ে উচ্চকণ্ঠে আলাপ করতে শোনে।
“সুলতান, নিয়তির লিখন পরিষ্কার।” তামবালের চোখ উত্তেজনায় চকচক করে। “সুলতান আপনাকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করে গিয়েছেন তার কোনো পুত্র সন্ত নি ছিল না। অন্যরা সমরকন্দ দখল করতে চাইবে, কিন্তু আমরা যদি একটু তৎপরতা দেখাই তাহলে সেটা আপনার নিজের রাজত্ব হতে পারে।”
বাবর চেষ্টা করেও মুখে বিড়ম্বনার হাসি ফুটে উঠা ঠেকাতে পারে না। আর উজবেকদের কি হবে? কয়েকদিন আগেই আমরা তাদের সম্পর্কে আতঙ্কে ছিলাম। আর তোমাদের কথাই ফলেছে তারা আমার চাচাজানকে বেঘোরে মেরেছে, তার সৈন্যবাহিনী তছনছ করে দিয়েছে, তার রসদের বহর কুক্ষিগত করেছে। এখন তারাও যদি সমরকন্দ দখলের পায়তারা করে?”
“কিন্তু এখন প্রায় শরৎ কাল। মৌসুম আমাদের পরম বান্ধব। প্রতিবছর একই ঘটনা ঘুরে ফিরে ঘটে। প্রতিবার শীতের সময়ে সাইবানি খান উত্তরে তুর্কিস্তানের নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরে যায় আর বরফ না গলা পর্যন্ত সেখানেই থাকে।”
“আলি মজিদ বেগ, আপনার কি অভিমত?” কিন্তু বাবর ইতিমধ্যেই তার উত্তরটা জেনে ফেলেছে। লোকটার পুরো দেহ থেকে ইতিমধ্যে উচ্ছ্বাস এবং আত্মবিশ্বাস চুঁইয়ে পড়তে শুরু করেছে। সম্ভাব্য গৌরব আর গনিমতের মালের কথা চিন্তা করে তার চোখে উজ্জ্বল দীপ্তি ফুটে উঠেছে। সমরকন্দ ধনী সমৃদ্ধ শহর ঠিকই, কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা এটা ছিল তৈমূরের সাম্রাজ্যের কেন্দ্রবিন্দু। তৈমূরের বংশোদ্ভূত প্রতিটা শাহজাদা আর অভিজাত ব্যক্তি সেখানে নিজের উপস্থিতি কামনা করে। বাবরও এর ব্যতিক্রম না। বয়স তার এখনও যদিও অল্প কিন্তু নিয়তি তাকে এমন একটা সুযোগের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে যা হয়ত জীবনে দ্বিতীয়বার সে পাবে না। সে দীর্ঘজীবন কামনা করে না বা রেশমের তাকিয়ায় শুয়ে কি সুযোগ হেলায় হারিয়েছে সেটা ভেবে শান্তিতে মরতেও চায় না। মনে কোনো খেদ নিয়ে সে বেহেশতে যেতে চায় না।
আলি মজিদ বেগ তাকে নিরাশ করে না। “আমি বলি কি শীত আসবার আগেই আমাদের রওয়ানা দেয়া উচিত।”
“আর ওয়াজির খান, আপনি কি বলেন?”
তার সাথে পরিকল্পনা আলোচনার সময় এখন বাবরের হাতে নেই। সে কি তার শরীরে ভীষণভাবে আলোড়ন তোলা উত্তেজনা যা তাকে রীতিমত কাঁপিয়ে তুলেছে তা প্রশমিত করতে কিছু বলবে? ওয়াজির খান তার একমাত্র চোখ দিয়ে বাবরের দিকে ভাবুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। বাবর ভাবে এই শুরু করলো শীতল যুক্তির বিন্যাস, আমার উত্তেজনা প্রশমিত করার অভিপ্রায়ে। সে আমাকে বলবে আমার বয়স অল্প নিজের রাজত্ব বজায় রাখা এক কথা আর আরেকটা রাজ্য দখল করা একেবারেই আলাদা কথা। সে আমাকে বলবে অপেক্ষা করেন, আমাকে বলবে অভিজ্ঞতাকে অবশ্যই সাহস, ধৈৰ্য্য আর উচ্চাশার সাথে সমন্বিত করতে হবে।
“তামবাল, ঠিকই বলেছে। রক্তের তৃষ্ণা নিবারন করে সাইবানি খান তার সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে এখন উত্তরের দিকে যাচ্ছে, জাল্লারটাস নদীর তীর বরাবর ফারগানা থেকে অনেকদূরে তাদের গন্তব্যস্থল। আমি রেকী করতে লোক পাঠাব। কিন্তু উজবেক নির্মমতা অনুপস্থিত থাকা সত্ত্বেও এধরণের অভিযানের জন্য আমাদের সৈন্য সংখ্যা অপ্রতুল। আমাদের মিত্র দরকার, বেতনভোগী- আপনি যাদের বলেন, ভাড়াটে সৈন্য। পার্বত্য গোত্রগুলোকে আমাদের সাথে যোগ দেবার জন্য প্ররোচিত করতে হবে। আমরা যদি বেতন দেই তাহলে তারা আসবে, এবং তারা যদি আসে আমরা তাহলে আল্লাহ সহায় থাকলে নিশ্চয়ই বিজয়ী হব।”
বাবর এমনভাবে ওয়াজির খানের দিকে তাকায় যেন সে আগে কখনও তাকে দেখেনি। “আপনি হবেন আমার সর্বাধিনায়ক। যা প্রয়োজন বিনা দ্বিধায় সেটা সম্পন্ন করেন। আমরা দু’সপ্তাহ পরে রওয়ানা দেব।”
“সুলতান।” ওয়াজির খান মাথা নত করে।
***
শীতল ধরণীর বুকে ঘোড়ার খুর আঘাত করে, তারপরে আবার, যেন তাদের খুরের বোলই একমাত্র বাস্তবতা। বাবর ক্লান্তিতে টলতে থাকলে সে তার ঘোড়ার কেশর আঙ্গুল দিয়ে পেচিয়ে ধরে নিজেকে সামলে নেয়। আকশী দূর্গ ত্যাগ করার পরে, প্রতিদিন সে অগ্রগামী বাহিনীর সাথে রওয়ানা হয়েছে, তাবু, রান্নার সরঞ্জাম আর রসদবাহী, ভারবাহী পশুর দলকে ছেড়ে এবং প্রতিদিন রাতের বেলা আবার পশ্চাদবর্তী তাদের সাথে এসে যোগ দিয়েছে। চারদিন আগে তার পুরো বাহিনী ফারগানা অতিক্রম করে সমরকন্দের ভূমিতে প্রবেশ করেছে কিন্তু নিঃসঙ্গ কয়েকজন পশুপালক ছাড়া আর কারও দেখা তারা পায়নি।
বাবর উপরের দিকে তাকায়। এক ঘণ্টার ভিতরে সূর্য তাদের সামনে অস্ত যাবে কিন্তু তার আগেই পাহাড়ী গিরিপথ আর খরস্রোতা নদী অতিক্রম করে পশ্চিমে তাদের তিনশ মাইল পথ পরিক্রমা শেষ হবার কথা। সমরকন্দের অট্টালিকাসমূহের গম্বুজ নৈবেদ্যের মত তাদের সামনে অবারিত পড়ে রয়েছে। সম্ভবত আজ রাতেই সে তৈমূরের রাজধানী অধিকার করবে। বাবর মানসপটে দেখতে পায় নতুন তৈমূর বংশীয় সুলতান তাদের রক্ষা করতে উপস্থিত হয়েছে দেখতে পেয়ে শহরের কৃতজ্ঞ মানুষ তার চারপাশে এসে জড়ো হয়েছে।
ভাবনাটা মনে উদিত হতেই সে তার ঘোড়র পেটে খোঁচা দেয় এবং ক্লান্তির শেষ সীমায় পৌঁছে যাওয়া সত্ত্বেও, জন্তুটা ছিটকে সামনে এগোয়, একটা টিলার ঢাল বেয়ে উঠে যায়। সেখান থেকে কিছুটা দূরে জারাফশান নদীর টলটলে পানির ওপারে রোমাঞ্চকর আকাশের গায়ে আবছাভাবে ফুটে আছে সমরকন্দ। বাবর সম্মোহিতের ন্যায় তাকিয়ে থাকে। তার শ্বাস গলায় আটকে আসে। সম্ভবত, এই মুহূর্তের পূর্বে, সে বিশ্বাসই করতো না সমরকন্দ বলে সত্যি কিছু একটার অস্তিত্ব রয়েছে। এখন আর সন্দেহের অবকাশ নেই। কোনো উপকথার গল্প না, কোনো অশরীরি প্রেতাত্মার আনাগোনায় অতিষ্ট না, কেবল রক্ত মাংসের মানুষের বসবাস রয়েছে এখানে, যা সে নিজের বলে দাবি করতে এসেছে।
বাবর তার কণ্ঠ চিরে একটা উল্লসিত চিৎকার বের করতে চায় কিন্তু তার উল্লাস গলাতেই শুকিয়ে আসে। দক্ষিণে শহর থেকে কয়েক মাইল দূরে সমরকন্দের প্রসিদ্ধ ফলের বাগানের পত্রহীন গাছ যা কয়েক সপ্তাহ আগেই সুগন্ধি আপেল আর ডালিমের ভারে নুয়ে ছিল সেখানে একটা অস্থায়ী ছাউনি দেখা যায়। হিম বাতাসে নিশান উড়তে দেখা যায় আর রান্নার জন্য তৈরি উনুন থেকে ধোঁয়ার কুণ্ডলী পেঁচিয়ে আকাশে উঠে যাচ্ছে। তাকিয়ে থাকার সময়েই বাবর দেখতে পায় অশ্বারোহী একটা বাহিনী ছাউনিতে দুলকি চালে প্রবেশ করেছে, বিভিন্ন তাবুর ভিতর দিয়ে তারা দক্ষতার সাথে বিচরণ করতে করতে এগিয়ে গেলে ট্রাম্পেটের ধাতব শব্দ তাদের স্বাগত জানায়।
তারমানে, তার সমস্ত ব্যগ্রতা সত্ত্বেও, সমরকন্দে প্রথমে পৌঁছান সম্ভাব্য সুলতানের কাতারে সে পড়ে না। কেউ একজন তার আগেই এসে হাজির হয়েছে। ছুরিকাহতের মত হতাশার একটা অনুভূতি তাকে বিদ্ধ করে।
ওয়াজির খান তার পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছে এবং সামনের দৃশ্যাবলী দেখে সেও উচ্চস্বরে গাল বকছে। “সুলতান, আমি আমার অগ্রগামী সৈন্যদের পাঠাব।”
“সাইবানি খানের শিবির এটা?”
“আমার মনে হয় না। শিবিরটা যথেষ্ট বড় না। আর মনে হয় না যে শহর কেউ আক্রমণ করেছে বা অবরোধ করেছে, সাইবানি খান এখানে উপস্থিত থাকলে সে চুপ করে বসে থাকতো না।”
“তাহলে কে?”
“আমি জানি না। আমাদের আর সামনে এগোনো ঠিক হবে না। আমরা ঐ পাহাড়ের পাদদেশে ফিরে যাবো, সেখানে বাতাসের আড়ালে ছাউনি ফেলবো, আমাদের অস্তিত্ব কেউ টের পাবে না, আর আগামীকাল আমাদের মূল বাহিনীর এখানে পৌঁছাবার জন্য অপেক্ষা করবো।”
ওয়াজির খান বাবরের অভিব্যক্তিতে ফুটে উঠা মূর্ত হতাশা ঠিকই বুঝতে পারে। “এই জায়গাটার নাম কোলবা টিলা, আশা আর স্বপ্নের মিলনস্থল। পাঁচ বছর আগে আপনার মরহুম আব্বাজানের সাথে, এখানে, এই স্থানে আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম আমাদের পিছনে ছিল ফারগানার সেনাবাহিনী। সুলতান, আপনার মত তিনিও সমরকন্দের দিকে তাকিয়ে ছিলেন এবং যা দেখেছিলেন সেটা তার হৃদয়ে শ্বাসরুদ্ধকর উচ্চাশা আর কামনার জন্ম দিয়েছিলো।”
“তারপরে কি হয়েছিলো?”
“সমরকন্দের সুলতান পশ্চিমে বিদ্রোহ দমনে ব্যস্ত ছিলেন। আক্রমণের জন্য সময়টা ছিল নিখুঁত, কিন্তু আল্লাহ্র অভিপ্রায় বোঝা মুশকিল। সেদিন রাতেই আপনার আব্বাজান, যিনি এত তীব্র গতিতে ঘোড়া দাবড়ে এসেছিলেন যে তার শ্রেষ্ঠ ঘোড়াগুলোর একটা ক্লান্তির ধকল সামলাতে পারেনি, এমন ভীষণ জ্বরে আক্রান্ত হন যে হেকিমরা তাকে বাঁচাবার আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলো। আমাদের সামনে ফিরে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনো গত্যন্তর ছিল না। আপনার আব্বাজান কষ্ট পেয়েছিলেন কিন্তু সেটাই ছিল তার নিয়তি।”
“আমার আব্বাজান আর চাচাজান পরস্পরকে এত ঘৃণা করতো কেন? তারা রক্তসম্পর্কের ভাই।”
“সৎ-ভাই, ভিন্ন মায়ের গর্ভে জন্ম নেয়া এবং যে মুহূর্ত থেকে তারা বুঝতে পারে যে দু’জনেই একই জিনিস কামনা করে-তৈমূরের শহর, তারা পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বীতে পরিণত হয়। আপনার চাচাজান ছিলেন চার বছরের বড়। তিনি সমরকন্দ দখল করেন আর বাকি জীবনটা সেজন্য আপনার আব্বাজানকে বিব্রত করতে ব্যয় করেছেন। কিন্তু আপনার আব্বাজান এমন কিছু অর্জন করেছিলেন যেটা তিনি পারেননি। তার অসংখ্য স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও, এবং হেকিমের ভেষজ আর মালিশ ব্যবহার করেও তিনি একজন উত্তরাধিকারীর জন্ম দিতে ব্যর্থ হন যে তার অবর্তমানে মসনদে অধিষ্ঠিত হবে। অন্য কোনো কারণে না, কেবল এ জন্যই তিনি আপনার আব্বাজানকে ক্ষমা করতে পারেননি। এজন্যই তিনি আপনার কাছ থেকে ফারগানা ছিনিয়ে নেবার পায়তারা করেছিলেন। সম্ভবত আপনাকে জানে শেষ করে দেবারও অভিপ্রায় তার ছিল।”
বাবর মানসপটে চাচাজানের অগ্রসর হবার সংবাদে তার বিহ্বল আম্মিজানকে তীব্র যন্ত্রণায় কাঁদতে দেখে। চাচাজানের শত্রুতার আসল কারণ তিনি ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন। কিন্তু মৃত্যুর সময়ে তার চাচাজান ভুল বুঝতে পারেন এবং তৈমূরের আংটি তাকে দিয়ে যান। এটা নিয়তির কারসাজি ছাড়া আর কি? সমরকন্দ শাসন করাই তার নিয়তি, এবং তার আব্বাজানের মত সারা জীবন নিজেকে হতাশার জালে জড়িয়ে রাখতে হবে না।
“সুলতান, ফিরে চলুন।”
বাবর বুনো উন্মত্ততায় ঘোড়া দাবড়ে গিয়ে এসব অনাহুত আগন্তুকদের মুখোমুখি হয়ে তার স্বপ্নে বাগড়া দেয়ার জন্য তাদের একটা চরম শিক্ষা দেয়ার অভিপ্রায় অনেক কষ্টে দমন করে। বিষণ্ণ চিত্তে সে ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নেয় এবং কোলবা টিলার উপর থেকে বাড়ন্ত ঘাসের ঢিবির মধ্যে দিয়ে ওয়াজির খানকে অনুসরণ করে নিচে নেমে আসে।
শীঘ্রই তাবু টাঙানো হয় কিন্তু ধোঁয়ার গন্ধে সমতলে ছাউনি ফেলা লোকগুলো টের পেয়ে যাবে ভেবে গরম খাবারের বন্দোবস্ত করা হয় না। তাপমাত্রা হ্রাস পেতে বাবর কয়েক পরত ভারী ঝাঝালো গন্ধের ভেড়ার চামড়া গায়ে চাপিয়েও শীতে কাঁপতে থাকে। অবশেষে নিজের অজান্তে কখন যেন সে ঘুমিয়ে পড়ে তাকে ঝাঁকি দিয়ে কেউ তার তন্দ্রা ভাঙালে তার মনে হয় কয়েক মিনিট অতিক্রান্ত হয়েছে। “সুলতান, আমার কাছে সংবাদ আছে।” ওয়াজির খান তার পাশে হাঁটু ভেঙে বসে আছে। তার মুখের অভিব্যক্তিও অনেকটাই স্বাভাবিক। এমনকি সেখানে সামান্য হাসির আভাসও সে যেন দেখতে পায়। “আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে আমরা হৃদয় বিনিময়ের কোনো ঘটনায় বাগড়া দিয়েছি।”
“আপনি কি বোঝাতে চাইছেন?”
“পাঁচদিন আগে, কুনদুজের শাহজাদা, আপনার জ্ঞাতি ভাই মাহমুদ এখানে উপস্থিত হন। পুরো শহর না কেবল একটা মেয়েকে এখান নিয়ে যাবার অভিপ্রায় তার ছিল। সমরকন্দের বিশৃঙ্খলার ভিতরে সে ভেবেছিল নিঃশব্দে ভেতরে প্রবেশ করে তাকে খুঁজে বের করবে। মেয়েটা আর কেউ না প্রধান উজিরের কন্যা।”
“সে বসে আছে কেন?” বাবরের নিজের কানকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। তার আম্মিজানের প্রিয় বোনের ছেলে মাহমুদকে শেষবার যখন দেখেছে তখন সে ছিল উচ্ছল, দুরন্ত একটা ছেলে, যার মুখে তখনও দাড়ি গজায়নি আর বাঁদরামির কারণে, যাকে প্রায়ই ঝামেলায় পড়তে হত। বাবর অন্ধের মত তার পেছনে ঘুরে বেড়াত। সেই মাহমুদ একটা মেয়ের জন্য বিরহে কাতর হয়ে মনোকষ্টে ভুগছে এই ধারণাটাই তার কাছে হাস্যকর মনে হয়।
ওয়াজির খানের মুখে আবার চিরাচরিত গম্ভীর অভিব্যক্তি ফিরে এসেছে। “আপনার ভাই শহরের প্রবেশ দ্বার রুদ্ধ দেখতে পেয়েছেন। প্রধান উজির নিজেকে সমরকন্দের সুলতান বলে ঘোষণা করেছে- শহর আর আশেপাশের পুরো এলাকার।
“সে এই অধিকার কিভাবে লাভ করলো?”
“কোনভাবেই না। তৈমূরের সাথে তার কোনো রক্তের সম্বন্ধ নেই। কিন্তু সে ক্ষমতাবান। কোষাগার তার নিয়ন্ত্রণে সে ইচ্ছা করলে যে কাউকে ঘুষ দিয়ে বশ করতে পারে।”
“কিন্তু তিনি যখন শুনবেন প্রয়াত সুলতানের ভাস্তে আমি এখানে এসেছি তিনি নিশ্চয়ই তার দাবি ত্যাগ করবেন। তিনি তার চারপাশের লোকদের উদ্দেশ্যে যতই মোহর বর্ষণ করুক আমার দাবি তার চেয়ে অনেক জোরাল।”
বাবরের কণ্ঠের বালকসুলভ ক্রোধ টের পেয়ে ওয়াজির খান আবার হেসে উঠে। “তিনি সংবাদ পেয়েছেন যে আপনি আসছেন কিন্তু তিনি ঘোষণা দিয়ে বসেছেন যে কোনো অনভিজ্ঞ কিশোরের হাতে তিনি মসনদ ছেড়ে দেবেন না। আর শাহজাদা মাহমুদের সাথেও নিজের মেয়ে বিয়ে দেবেন না। তিনি মনে মনে পরিকল্পনা করেছেন আপনার আরেক জ্ঞাতি ভাই- কাবুলের শাহজাদার সাথে তার মেয়ের বিয়ে দেবেন।”
“আমরা তাকে বিয়ে দেওয়াচ্ছি।” বাবর লাফিয়ে উঠে দাঁড়াতে তার গায়ের ভেড়ার চামড়ার কম্বল ছিটকে যায়। “আমার ঘোড়া নিয়ে আসতে বলেন, আমি আমার ভাইয়ের শিবিরে যাব।”
আকাশে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে এমন সময় বাবর তার দেহরক্ষীদের সাথে নিয়ে, মাহমুদের ছাউনির দিকে এগিয়ে যায়, একটা কালো আলখাল্লায় তার আপাদমস্তক আবৃত।
“হুঁশিয়ার।” নির্জীব ধূসর আলোর পেছন থেকে এক সৈনিকের কণ্ঠস্বর ভেসে আসে। “নিজের পরিচয় দেন।”
“বাবর, ফারগানার সুলতান, যিনি তার ভাই কুন্দুজের শাহজাদা মাহমুদের, সাথে দেখা করতে ইচ্ছুক।”
নিরবতা, তারপরে বিড়বিড় আলোচনা, তারপরে একটা জ্বলন্ত মশাল উঁচু করে ধরতে চারপাশ আলোকিত হয়ে উঠে। সৈন্যরা তার ছোট দলটা ঘিরে রাখতে বাবর হাত দিয়ে চোখ আড়াল করে। অবশেষে সে একটা পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনতে পায়, সে শেষবার যেমন শুনেছিল তার চেয়ে এখন অনেক গম্ভীর হয়েছে কিন্তু আন্তরিকতা সেই আগের মতই আছে। “ভাই, তোমাকে স্বাগতম।” ঘাড় পর্যন্ত লম্বা কালো অবিন্যস্ত চুল, বাম হাতের দাস্তানায় একটা বাজপাখি নিয়ে মাহমুদ এগিয়ে এসে। ডানহাত দিয়ে বাবরের কাঁধ জড়িয়ে ধরে। “অসময়ে এসে ভোর বেলা বাজপাখি দিয়ে শিকারের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আমি খুশি হয়েছি তোমাকে দেখে।” সে একটা বিশাল বর্গাকার তাবুর দিকে ইশারা করে।
মাটিতে পুরু গালিচা পাতা এবং দেয়াল আর ছাদ কাপড়ের পর্দা দিয়ে আড়াল করা। মাহমুদ তার বাজপাখির চোখে ঠুলি পরিয়ে সোনালী দাঁড়ে বসিয়ে দেয়, আর নিজে মখমলের তাকিয়ার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বাবরও তার দেখাদেখি একই কাজ করে। “তোমার আব্বাজানের মৃত্যুর সংবাদ শুনে আমি দুঃখ পেয়েছি। তিনি ছিলেন একজন খাঁটি মানুষ আর মহান যোদ্ধা। তার আত্মা শান্তি লাভ করুক। কুন্দুজে আমরা তার স্মরণে নিশ্চয়ই শোক পালন করেছি।”
“ধন্যবাদ।” বাবর মাথা নামিয়ে বলে।
“আর আমার খুদে ভাইটা এখন তাহলে সুলতান।”
“আপনি যেমন একদিন হবেন।”
মাহমুদ হাসে। “সত্যি।”
“কিন্তু আজ আপনার ভাবনা অন্য খাতে বইছে।”
মাহমুদের হাসি কান পর্যন্ত গিয়ে ঠেকে। “বাবর, তুমি যদি তাকে দেখতে। রেশমের মত ত্বক, ধনুকের ছিলার মত টানটান দেহ আর প্রায় আমারই সমান লম্বা। আমি তাকে বেগম করবো। আমি প্রতিশ্রুতি দিয়েছি আর সেটা ভঙ্গ করার কোনো অভিপ্রায় আমার নেই।”
“তোমাদের দেখা হয়েছিলো কোথায়?”
“সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তা কোরো না- আমি মোটেই মেয়েদের ছদ্মবেশে উজিরের হারেমে গোপনে প্রবেশ করিনি। ব্যাপার হয়েছে কি, গত বছর তার বাবা সমরকন্দ থেকে কুন্দুজ আসছিলো রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব নিয়ে তখন সে তার সাথে সফরসঙ্গী হিসাবে ছিলো। তারা আমাদের উত্তরের সীমান্ত দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করতে দস্যুদের কবলে পড়ে। আমি আমার সৈন্যদের নিয়ে যাচ্ছিলাম তাদের অভ্যর্থনা জানাতে। আক্রমণ যখন হয় আমরা নিকটেই ছিলাম। আমরা শোরগোলের শব্দ শুনে তাদের উদ্ধার করতে ছুটে যাই। আর তখনই আমি তাকে প্রথম দেখি- সে একটা পাথরের পেছন থেকে যার আড়ালে সে লুকিয়ে ছিল বের হয়ে আসে, তার নেকাব আর পরণের কাপড় অর্ধেকই ছেঁড়া…” মাহমুদ চুপ করে যায় সেই নয়নাভিরাম দৃশ্য আবার কল্পনা করে।
“প্রধান উজিরের উচিত তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা।”
“সে তাই ছিল। কিন্তু কুন্দুজ কাবুলের মত সমৃদ্ধ না।” মাহমুদ কাঁধ ঝাঁকায়। “আর, ভাইটি তুমি কি জন্য এখানে এসেছো?”
“উচ্চাশা নেই এমন লোকের থেকে সাবধান।” বাবরের মনে তার আব্বাজানের এই কথাটা অনাদিষ্টভাবেই চকিতের জন্য উঁকি দেয়। কিন্তু যার উচ্চাশা আছে তার থেকেও কি সতর্ক থাকা উচিত নয়? মাহমুদ কি আসলেই এই সময়ে সমরকন্দ এসেছে কেবলই একটা মেয়ের জন্য, হোক না সে যতই রূপসী?
বাবর ঠিক করে সত্যি কথাই বলবে। “সমরকন্দের সুলতান যদিও আমার আব্বাজানের ভাই ছিলেন কিন্তু তিনি মোটেই ফারগানার মিত্র ছিলেন না আর আমাকে মসনদ চ্যুত করার ব্যবস্থা প্রায় পাকা করে ফেলেছিলেন। কিন্তু পথে মৃত্যু বরণ করার সময়ে তিনি তার লোকদের আদেশ দিয়ে যায় এটা আমার কাছে পৌঁছে দেবার জন্য।” বাবর তার হাত প্রসারিত করে দেখায়। তার অনামিকায় তৈমূরের অঙ্গুরীয়, এখন আর তাতে রক্তের দাগ লেগে নেই, শোভা পাচ্ছে। আংটিটা তার হাতে সামান্য বড় হলেও সে লাল রেশমের সুতো দিয়ে ব্যাপারটা আপাতত সামলে নিয়েছে। জ্বলন্ত কাঠ কয়লার কুলঙ্গি থেকে ভেসে আসা আলোয় আংটিটা দ্যুতি ছড়ায় আর সে শুনতে পায় মাহমুদ জোরে শ্বাস নেয়।
“তুমি বিশ্বাস কর যে তুমিই তৈমূরের উত্তরাধিকারী?”
“আমার ধমনীতে তার রক্ত বইছে। আমি আমার শহর ঠিকই আদায় করে নেব।”
“আমার ধমনীতেও তার রক্তই বইছে,” মাহমুদ মৃদু কণ্ঠে বলে। তারা পরস্পরের চোখের দিকে তাকায় আর সহসা যেন দুজনের চোখ থেকেই সব বালখিল্যতা উধাও হয়ে যায়। বাবর কৃতজ্ঞ বোধ করে যে তার খঞ্জরটা দামী রত্নখচিত খাপসহ তার কোমরের বেগুনী পরিকরের ভেতরে গোজা রয়েছে বলে।
“দুশ্চিন্তা কোরো না, খুদে ভাইটি- যদিও সম্ভবত তোমাকে আর খুদে বলার অবকাশ নেই। নেকড়ে মায়ের মুখের অনুভূতির মতই কিছু একটা আমি দেখছি যার শাবক সামান্য আগেই আমার হাতে খুন হয়েছে।” মাহমুদ আবার হাসতে শুরু করে। “এটা সত্যি যে আমি সমরকন্দে এসেছিলাম কারণ মনে হয়েছিলো শহরটায় একটা বিভ্রান্তি সৃষ্টি হবে। কিন্তু আমার ছাউনি ভালো করে দেখো আমার সাথে একশোর বেশি লোক নেই। শহর অবরোধের কোনো অভিপ্রায় আমার ছিল না, আমি এসেছিলাম আচমকা হামলা চালিয়ে কিছু সম্পদ বাগিয়ে নেয়া আর এখানের আগুন প্রশমিত করতে।” সে একটা ভেংচি কেটে দুপায়ের ফাঁকে উদ্দেশ্যপ্রনোদিত ভঙ্গিতে হাত বুলায়।
“তোমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হোক। আগুন নির্বাপিত হোক।”
“আর ভাইটি তোমার সাথে কতজন লোক আছে?”
“আমরা মূল বাহিনী যখন এসে পৌঁছাবে তখন সেটা হবে ছয় হাজারের বেশি যোদ্ধার একটা বহর যাদের ভিতরে অনেকেই তীরন্দাজ।” বাস্তবে বাবরের সৈন্য। সংখ্যা টেনেটুনে পাঁচ হাজার হবে কিন্তু একটু বাড়িয়ে বলতে ক্ষতি কি।
মাহমুদ বেশ অবাক হয়েছে বোঝা যায়। “আমি ভাবিনি যে ফারগানা এত বড় একটা সৈন্যবহর একত্রিত করতে পারবে।”
“অনেকেই আমার বেতনভোগী আর তাদের লোকজন কিন্তু বাকীরা পাহাড়ী গোত্রগুলি থেকে এসেছে।”
“চলো আমরা একসাথে আক্রমণ করি।” মাহমুদ বাবরের হাত আঁকড়ে বলে। “প্রধান উজিরের মাথা তুমি একটা বর্শার ফলায় গেথে নিলে আমি আমার বেগমকে লাভ করবো।”
“ক্ষতি কি?” বাবর হেসে বলে। তার প্রশিক্ষিত সৈন্যবহর থাকতে মাহমুদ কোনো বেগরবাই করতে পারবে না, আর মসনদের দিকে তাকাবার তার প্রশ্নই উঠে না।
***
দু’মাস পরে তার লোকেরা যখন ক্লান্ত পায়ে পূর্বে ফারগানার দিকে ফিরে চলে তখন ব্যর্থতার জ্বালায় জ্বলতে থাকা বাবর শীতের কোনো তীব্রতাই টের পায় না। ঘোড়াগুলোর, আলুথালু কেশরে তুষারকণা আটকে আছে, পেছনের পায়ের মাঝখানের জোড়া অব্দি বরফে দেবে যায়। নাক টেনে এগিয়ে যাবার জন্য তারা চেষ্টা করতে থাকলে তাদের নিঃশ্বাস থেকে কুয়াশার মেঘ সৃষ্টি হয়। কোথাও কোথাও বরফ এত পুরু যে সওয়ারী তখন বাধ্য হয় নিজের ওজনের ভার থেকে পশুটাকে রেহাই দিতে এবং তারপরে সেও তার পাশে পাশে কষ্ট করতে থাকে। মালপত্র রসদের বেশিরভাগই ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরিত্যক্ত অবস্থায় বরফের ভেতরে পড়ে থাকে।
বাবর বিষণ্ণ মনে ভাবে, এবারের অভিযান এমনভাবে শেষ হবার কথা ছিল না। লাল সুতো দিয়ে মোটা করা আংটিটা তার আঙ্গুলে তারপরেও একটু ঢিলে হয়। পুরোটাই একটা দর্পোদ্ধত অভিজ্ঞতা তার ব্যর্থতা আর অপমানের সাক্ষর।
ওয়াজির খান তার পাশেই রয়েছে, ভারী উলের কম্বলে আবৃত থাকায় দাড়ি আর ভুরুতে বরফ জমেছে। ধূসর আকাশে ভারী তুষারপাতের সম্ভাবনায় মেঘের আনাগোনা শুরু হতে হাজির হয়েছে, ওয়াজির খান তাকে অনুরোধ করেছিলো আক্রমণ স্থগিত রাখার জন্য নিষ্ঠুর নিয়তে শীতকাল এবার আগেই এসে। কিন্তু বাবর সে অনুরোধে কর্ণপাত করেনি- মাহমুদও যখন তার দু’পায়ের মাঝের আগুন নির্বাপিত না করেই বাড়ির দিকে রওয়ানা হয়েছিলো তখনও না, বা যখন তার টাকা দিয়ে কেনা মিত্র আর পাহাড়ী অধিবাসীরা লুঠপাটের কথা বলে সেটা না করতে পারার জন্য গাল বকতে বকতে ফিরে যায় তখনও তার সম্বিৎ ফিরেনি। আর এখন সে তার অহঙ্কার আর ঔদ্ধত্যের মূল্য পরিশোধ করছে। সমরকন্দের প্রাকার তারা ভাঙতে পারেনি আর শহরের ভেতরে প্রধান উজির যে মসনদ তার না সেটা আগলে বসে রয়েছে আর সাথে আছে তার মেয়ে যার জন্য সে বিশাল পরিকল্পনা তৈরি করেছে- মাহমুদ না নিজের মেয়ের কুমারীত্ব সে কাবুলের শাহজাদার কাছে সমর্পন করবে।
“মহামান্য সুলতান, আমরা আবার ফিরে আসব।” ওয়াজির খান বরাবরের মতই এবারও তার মনের কথা বুঝতে পেরেছে। শীতে অসার হয়ে আসা ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে বের হয়ে আসা শব্দগুলো ধীরে ধীরে ভেসে আসে। “এটা ছিল কেবল একটা হামলা। আমরা একটা সুযোগ দেখে সেটা নিয়েছিলাম কিন্তু পরিস্থিতি আমাদের অনুকূলে ছিল না।”
“ওয়াজির খান, সেটাই আমাকে কষ্ট দিচ্ছে। আমি যখন চিন্তা করি কি হতে পারত তখন মনে হয় কেউ যেন আমার পাজরে জ্বলন্ত খঞ্জর ঢুকিয়ে দিয়েছে…”
“কিন্তু যুদ্ধের প্রথম স্বাদ আপনি লাভ করেছেন। পরেরবার আমরা প্রস্তুতি নিয়ে আসব এবং পুরো সাজসজ্জার সাথে আর তখন আপনি জানবেন সাফল্য কাকে বলে।” নিজের দুর্ভোগ সত্ত্বেও, কথাগুলো বাবরকে উৎফুল্ল করে তুলে। সে কিশোর বয়সী। ইতিমধ্যেই একটা রাজ্যের সুলতান। সমরকন্দ এই শীতে সে দখল করতে পারেনি- এই সত্যিটা স্বীকার করার ভিতরে সে কোনো দুর্বলতা খুঁজে পায় না। দুর্বলতা লুকিয়ে থাকে হতাশার ভিতরে, যখন বুকে দম আর বাহুতে বল থাকা সত্ত্বেও, কেউ হাল ছেড়ে দেয় এবং সেটা সে কখনই করবে না। “আমি আবার ফিরে আসব,” বাতাসের গর্জন ছাপিয়ে সে চিৎকার করে উঠে এবং মাথা উঁচু করে তার বাবার শিখিয়ে দেয়া রণহুঙ্কার দেয়। স্পর্ধিত শব্দটা শীতের ঝড়ো বাতাসে মিলিয়ে যায় বটে কিন্তু তার প্রতিধ্বনি বাবরের মস্তিষ্কে অনুরণিত হতেই থাকে।
১.৪ সমৃদ্ধির শহরে
০৪. সমৃদ্ধির শহরে
বাবরের সৌভাগ্যেই বলতে হবে যে খুনী তাড়নায় সময়ের আগে হাজির হওয়া শীতকাল এবার বসন্তের অকালবোধনে শেষ হয়েছে। বাবর তার কামরায় দাঁড়িয়ে বালকের দলকে জমে থাকা জাক্সারটাসের বুকে পাথর ছুঁড়ে মারতে দেখে, বরফের বুকে সৃষ্টি হওয়া ফাটল দিয়ে পানি উথলে উঠে। কয়েকটা নিশ্চিন্ত ভেড়া জমে থাকা স্রোতের উপর চড়ে বেড়াচ্ছিল, শীতল তোড়ে তারা ভেসে যায়। তাদের মিহি, উচ্চ মাত্রার আর্তস্বর কয়েক সেকেন্ড পরেই মিলিয়ে যায়।
জাক্সারটাসের পরে এগিয়ে যাওয়া সমভূমিতে, তার গোত্রপতিরা আবার নিজেদের লোকজন নিয়ে এসে ছাউনি ফেলেছে। এবার ডাক পাঠাবার সময়ে সে তার বার্তাবাহকদের আরও দূরে যেতে বলেছে, উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম চারদিক থেকে যাযাবর গোত্রগুলিকে প্রাচুর্যপূর্ণ লুণ্ঠিতদ্রব্যের প্রতিশ্রুতি ফুলের কাছে মৌমাছির মত টেনে এনেছে। সাইবানি খান তার উত্তরের শীতকালীন আশ্রয়ে আটকে থাকার কারণে, বাবর ভাবে, আক্রমণের এটাই উত্তম সময়। শীঘ্রই সে তার বাহিনীকে যাত্রার আদেশ দেবে।
কিন্তু সমরকন্দের অভিমুখে তার অসমাপ্ত অভিযান শুরু করার পূর্বে আম্মিজানের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসতে হবে সে দ্রুতপায়ে তার কামরার দিকে এগিয়ে যায়। এইবার, খুতলাঘ নিগারের পিতলের বার্ণিশ করা আয়নায় সে তার ভিন্ন। চেহারা দেখে যার সাথে আব্বাজানের মারা যাবার রাতের সেই অনিশ্চিত অন্ধকার সময়ের চেহারার কোনো মিল নেই। কয়েক সপ্তাহ আগে বাবর তার ত্রয়োদশ জন্মদিন উদযাপন করেছে। তার গালে হাল্কা শত্রু দেখা দিয়েছে আর আগের চেয়ে সে অনেকটাই লম্বা আর চওড়া হয়েছে। কণ্ঠস্বরে ভাঙন এসেছে আর তৈমূরের অঙ্গুরীয় এখন আর আঙ্গুলে মোটেই ঢিলে হয় না।
“বাছা, তুমি দ্রুত যুবকে পরিণত হচ্ছো।” আম্মিজান তাকে বিদায় চুম্বন দিতে তার কণ্ঠে গর্বের প্রচ্ছন্ন ছোঁয়া টের পাওয়া যায়। এমন কি সন্তুষ্ট-আর সেই কঠোর বুড়িকে প্রীত করা কোনো মামুলি বিষয় না, কুচকে যাওয়া কিশমিশের মতই যার মুখের ত্বক কিন্তু তার ক্ষুরধার চোখে কিছুই এড়িয়ে যাবার জো নেই।
“শহরটা আমার দখলে আসবার পরে আমি তোমাদের সবাইকে নিয়ে যাবার জন্য লোক পাঠাব।”
“তুমি ওয়াদা করছো?” খানজাদা নিমেষে চিবুক উঁচু করে জানতে চায়। “ওয়াদা করছি।” সে নিচু হয় বোনকে চুমো দেয়ার জন্য যে এখন বাবরকে প্রীত করে, লম্বায় তার চেয়ে ইঞ্চি ছয়েক খাটো।
হারেমের ভিতর দিয়ে ফিরে আসার সময়ে সে একটা খোলা দরজা অতিক্রম করে। জানালাবিহীন কক্ষটায় তেলের প্রদীপের মৃদু আলোয় এক লম্বা তরুণী কেবল কাচুলী আর গোলাপী ফুলের ছোপ তোলা ঘাঘড়া পরিহিত অবস্থায় সামনে ঝুঁকে বসে চুল আচড়াচ্ছে। বাবর নিচু চৌকাঠ অতিক্রম করে।
সে তাকে দেখা মাত্র হাঁটু ভেঙে বসে কপাল মাটিতে ঠেকায় আর তার মাথার চুল চকচকে পানির মত চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। “ফারগানার সুলতান, বাবরকে আমার অভিনন্দন। আল্লাহতালা আপনার উপর প্রসন্ন হোন।” তার কণ্ঠস্বর চাপা কিন্তু পরিষ্কার উত্তরের পাহাড়ী মানুষের টান তাতে স্পষ্ট।
“আপনি দাঁড়াতে পারেন।”
মার্জিত ভঙ্গিতে সে উঠে দাঁড়ায়। তার চোখ পটলচেরা, দেহবল্লরী তন্বী এবং মধুর রঙের মত ত্বক। বাবর খেয়াল করে তার কামরার এককোণে রাখা পুরান দুটো কাঠের সিন্দুক থেকে কাপড় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।
“আমি ভ্রমণ করে ক্লান্ত। আমার পরিচারকদের বলেছি আমাকে একটু একা থাকতে…” সে কথা শেষ না করেই থেমে যায় এবং বাবর তার চেহারায় অনিশ্চয়তা ভর করতে দেখে যেন সে কিছু একটা ভোলা করে দেখছে। সে ঘুরে দাঁড়ায় বেরিয়ে আসার জন্য। সৈন্যবহর যাত্রা শুরু করার আগে আরো অনেক কিছু তদারকি করা বাকি।
আমাকে এখানে নিয়ে আসবার জন্য “সুলতানকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাই।” সে তার দিকে একপা এগিয়ে আসলে বাবরের নাকে মৃগনাভীর গন্ধ ভেসে আসে। “আমার বাবার রক্ষিতারা, অবশ্যই, আমার দূর্গে সাদরে আমন্ত্রিত।”
“আর সেই রক্ষিতার গর্ভে তার ঔরসজাত সন্তান?”
একটা বিরক্তিবোধ ক্ষণিকের জন্য বাবরকে আপুত করে। “অবশ্যই।” এই রোক্সানার সামান্য গোত্রপতির কন্যার কোনো অধিকার নেই তাকে এই প্রশ্ন করার। তার অস্তিত্বের কথা সে কেবল কয়েক সপ্তাহ আগে জানতে পেরেছে। কোনো দুর্বোধ্য কারণে তার মরহুম আব্বাজান তাকে দূর্গে নিয়ে না এসে তার নিজের লোকদের মাঝেই তাকে রেখেছিলেন। শিকারে গেলেই কেবল তিনি তার সাথে দেখা করতেন। রোক্সানার কথা তিনি কাউকে বলেননি। একথাও কখনও বলেননি, যে আট বছর আগে যখন তার বয়স চৌদ্দ বছরের বেশি কোনভাবেই না, তখন রোক্সানা তাকে একটি পুত্রসন্তান উপহার দিয়েছে, জাহাঙ্গীর।
তুষারপাত শেষ হবার ঠিক পরপরই, যখন রোক্সানার বাবা দূর্গে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন তখন কেউই অবিন্যস্ত দাড়িশোভিত মলিন গোত্রপতিকে ভালো করে লক্ষ্যই করেনি। সে তখন ভেড়ার চামড়ার কোটের ভেতরের পকেট থেকে বাবরের বাবার নিজের হাতে লেখা একটা চিঠি বের করে যেখানে তিনি রোক্সানাকে তার রক্ষিতা আর ছেলেকে নিজের বংশধর বলে স্বীকার করেছেন। সেখানে আরও লেখা আছে তার অকালমৃত্যু ঘটলে রোক্সানাকে যেন শাহী হারেমের নিরাপত্তায় নিয়ে আসা হয়।
খুতলাঘ নিগার কোনো উচ্চবাচ্য করে ব্যাপারটা মেনে নেন। তার স্বামীর অধিকার আছে যত ইচ্ছা রক্ষিতা রাখার আর বস্তুত তার স্ত্রীর সংখ্যা তিনজন। খুতলাঘ নিগার নিজে তো জানেন তিনিই ছিলেন তার ভালোবাসা, প্রতিদিনের সহচরী, তার উত্তরাধিকারী সন্তানের মাতা। পৃথিবীর আর কোনো দম্পতি তাদের শারীরিক আর মানসিক বন্ধনের জুড়ি হতে পারবে না। তাদের মিলনের আত্মিক অভিরূপ এমনই যে তাদের কেবল দুটি সন্তান বেঁচে আছে। রোক্সানা আর বাবরের সভাইয়ের অপ্রত্যাশিত আবির্ভাব তাকে মোটেই বিচলিত করেনি। আর তাই আম্মিজান যখন বাবরকে অনুরোধ করেন, সে অন্যসব অল্পবয়সী ছেলের মতই নিজের বাবা-মা’র প্রেমের বিষয়ে আলাপ করতে অস্বস্তি বোধ করে, আলোচনাটা সংক্ষিপ্ত করতে চায়। তাকে তার সন্তানকে নিয়ে আসতে দাও,” তিনি অবশেষে শীতল কণ্ঠে আলোচনা শেষ করেন। বাবর পরে খেয়াল করে দেখেছে যে খুতলাঘ নিগারের কামরার পাশেই রোক্সানার জন্য কামরা বরাদ্দ করা হয়েছে। অচেনা লোকদের মাঝে এসে উপস্থিত হওয়া নারীর প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন? মোটেই না। তিনি তাকে কাছে রেখেছেন যেন তার উপরে লক্ষ্য রাখতে পারেন।
“সুলতানের মহানুভবতার তুলনা হয় না। রোক্সানা এবার তার দিকে তাকিয়ে হেসে উঠে। “আপনার ভাইও আপনাকে তার কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে।”
সভাই, বাবর ভাবে, এবং মোটেই হাসির উত্তর দেয় না। সে তাকে এখনও দেখেনি। ছেলেটা কোনো কারণে জ্বরে আক্রান্ত সন্দেহ নেই মশার বা আটুলির কামড়ের ফল। খুতলাঘ নিগার তাকে এবিষয়ে কিছুই বলেনি। “আপনার সন্তান শীঘ্রই সুস্থ হয়ে উঠুক, বাবর বলে। সৌজন্যমূলক বাক্য কিন্তু বাবর জানে বাক্যটায় শীতল একটা অনুভূতি রয়েছে। সেটা বাবরের ইচ্ছাকৃত। গোড়ালির উপরে ঘুরে দাঁড়িয়ে বাবর দ্রুত বের হয়ে যায়, তার মন ইতিমধ্যেই আসন্ন অভিযানের উত্তেজনায় ব্যপৃত হয়ে পড়েছে।
***
চোখে প্রচ্ছন্ন গর্ব নিয়ে বাবর তার অশ্বারোহী বাহিনীকে পশ্চিমের চারণভূমিতে ছড়িয়ে পড়তে দেখে, সে ভাবে এবারের অভিযানের জন্য আট হাজার লোক আমার আহবানে সাড়া দিয়েছে। অশ্বারোহী বাহিনীর ঠিক পেছনেই জমিদারদের বরকন্দাজ আর তাদের লোকেরা। তারপরে আছে গাট্টাগোট্টা চেহারার গোত্রপতির দল, বুনো চকরাখের মত, যারা কাশগড় আর ফারগানার মধ্যবর্তী উঁচু পাহাড়ী এলাকায় বাস করে তাদের ঘোড়া, ভেড়া আর লোমশ ইয়াকের পাল নিয়ে। মালবাহী গরুর গাড়িগুলো যাতে লম্বা তীক্ষ্ণ শিংএর বলদ জোতা হয়েছে মালের ভারে সেগুলোর চাকা তীব্র শব্দে প্রতিবাদ জানায়। এইবার ভাগ্যের উপরে সে কিছুই ছেড়ে দেয়নি। তার যুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণাসভায় সে লম্বা অভিযানের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু বারবার পর্যালোচনা করেছে, অবরোধী অনুষঙ্গ থেকে সমরকন্দের দেয়াল টপকাবার সিঁড়ি, এত লোকের খাবারের বন্দোবস্ত, তাদের শান্ত রেখে বিজয়ের জন্য উদ্বুদ্ধ করতে গানবাজনার ব্যবস্থা সবকিছুর দিকেই লক্ষ্য রাখা হয়েছে।
শীতের অলস মাসগুলোতে ওয়াজির খান আর বাবর, তাদের অনুপস্থিতিকালীন সময়ে ফারগানার নিরাপত্তা কিভাবে নিশ্চিত করা যায় সেটাও বিবেচনা করেছে। সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার উজির কাশিম, যার আনুগত্য আর দক্ষতা প্রশ্নাতীত, তাকেই রাজপ্রতিভূ হিসাবে রেখে যাওয়া হবে। উজবেক অনুপ্রবেশের কোনো সংবাদ এখনও পাওয়া যায়নি, এবং কোনো ধরণের বিপদ হলে কাশিম সাথে সাথে তাকে সংবাদ পাঠাবে।
এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল সমরকন্দের শত্রুর মনোভাব আঁচ করা, সে কি করতে পারে। বাবর জানে যে প্রধান উজির এবারও- এখন প্রকাশ্যে নিজেকে সমরকন্দের সুলতান হিসাবে অভিহিত করেন-তার অভিযানের খবর আগেই পাবে। শহরের শস্যাগারে গত বসন্তের ফসল এখনও মজুদ করা আছে এবং শহরের দেয়াল সুরক্ষিত রাখার জন্য সৈন্যদের বিশ্বস্ততা কেনার মত স্বর্ণখণ্ড কোষাগারে মজুদ রয়েছে।
নাগাড়ে দশদিন পথ চলার পরে কোলবা টিলা তাদের দৃশ্যপটে ভেসে উঠে। বাবর ওয়াজির খানের পাঠান রেকীদলের ফেরত আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করে না। সে তার ধূসর স্ট্যালিয়নটা পান্নার মত সবুজ ঘাস, যা গত শীতের তুষারপাতের আর্দ্রতায় এখন ও সিক্ত আর মাঝে মাঝে হলুদ, গোলাপী আর সাদা বসন্তের ফুলের নকশায় শোভিত, উপর দিয়ে দাবড়ে নিয়ে যায়। তার ঘোড়ার আগুয়ান গতিতে একটা লম্বা লেজবিশিষ্ট পাখি, শান্তি বিঘ্নিত হতে শূন্যে ডানা ঝাঁপটে ত্রাহি রব তুলে বাতাসের রবাভয়ে নিজেকে উঠিয়ে নেয়। দিগন্তের বুকে আকাশের প্রেক্ষাপটে সমরকন্দের গম্বুজ আর মিনারের দৃশ্যপট সামনে ভেসে উঠলে বাবর টের পায় তার নাড়ীর স্পন্দনে মাদলের বোল উঠছে। পুরো শহরটা ঘিরে আছে একটা শক্তিশালী দেয়ালের ব্যুহ এবং তার ভিতরে বাবরের চোখ খুঁজে নেয় আরেকটা বেষ্টনীর প্রাকার, শহরের ভেতরের নিরাপদতম স্থান তৈমূর যা নিজের সর্বোচ্চ অট্টালিকা কোক সরাই এর চারপাশে নির্মাণ করেছিলো। তার মৃত্যুর পর থেকে জায়গাটার একটা বদনাম ছড়িয়ে পড়েছে। বাবর ছোটবেলা থেকে উচ্চাকাঙ্ক্ষী শাহজাদাদের নির্যাতন, হত্যা আর অন্ধ করে দেয়ার গল্প এবং প্রাসাদে নিমন্ত্রিত হয়ে গিয়ে হারিয়ে যাওয়া অমাত্যদের কাহিনী শুনে এসেছে।
বাবর তার আজদাহাটাকে এক জায়গায় স্থির করে দাঁড় করায়। এত দূর থেকেও বাবর টের পায় একটা অতিকায় দানবের মত শহরটা সতর্ক আর উদগ্রীব হয়ে আছে এবং অপেক্ষা করছে। অসংখ্য চোখ বাইরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে, অনুমান করতে চেষ্টা করছে কখন আর কোনো দিক থেকে বাবর এসে উপস্থিত হবে এবং তার সাথে লোকবল কত থাকবে। ফারগানা থেকে পশ্চিমে তাদের তিনশ মাইল যাত্রাপথের পুরোটাই গুপ্তচরের নজরদারির ভিতরে ছিল।
এইবার অবশ্য আশেপাশে অন্যকোন অস্থায়ী ছাউনি দেখা যায় না। নিজের বিরহকাতর ভাই মাহমুদের কথা ভেবে বাবর আনমনেই হেসে উঠে। কোনো সন্দেহ নেই নিজের প্রজ্জ্বলিত নিম্নাঞ্চল নির্বাপিত করতে সে ইতিমধ্যেই আরেকজন রমণীকে খুঁজে নিয়েছে। কিন্তু তারপরেও যদি সে তাকে বেগম করতে চায়, বাবর শপথ নেয় উজিরের কন্যা তারই হবে। ভেট হিসাবে বাবর তাকে পাঠিয়ে দেবে।
***
“সুলতান, আপনাকে ধৈৰ্য্যশীল হতে হবে,” ওয়াজির খান গত পাঁচমাস ধরে যা বলে আসছে সে কথারই পুনরাবৃত্তি করে। অস্থায়ী শিবিরের সদাসতর্ক চোখ কানের ব্যাপ্তি এড়িয়ে, একটা ফলবাগানের ভিতরে তারা বসে আছে। ওয়াজির খান শীতের প্রকোপ কমাবার জন্য এক ঝুড়ি জ্বলন্ত কয়লা নিয়ে এসেছিল যার দিকে এখন ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে আছে। এই উষ্ণতাটুকু তাদের প্রয়োজন ছিল। শরৎকাল আসছে। বাতাসে এখনই হাড় কাঁপিয়ে দেয়ার মত কনকনে হিম। “আমি দিব্যি দিয়ে বলতে পারি আমাদের ভেতরেই বিভীষণ আছে। আমরা নিকুচি শের যখনই শহরের কোনো অংশের দেয়াল আক্রমণ করতে যাই বা নিচে সুড়ঙ্গ বানাই সেখানেই তারা আগে এসে বসে থাকে। খবর পায় কি করে।” বাবর জ্বলন্ত কয়লায় ভিতরে খঞ্জরের অগ্রভাগটা দিয়ে একটা গুতো দেয়।
“সুলতান সব শিবিরেই গুপ্তচর থাকে। এই বাস্তবতা মেনে নিতে হবে। আর আমাদেরও কি চর নেই শহরের ভেতরে।”
“তারা সবাই ঘোড়ার লাদি পরিষ্কার করছে।”
“আরও অনেক কিছুই করবে, যখন করার সময় হবে। গত পাঁচমাস আমরা শহরটা অবরোধ করে রেখেছি। আমাদের পানি আর রসদের কোনো ঘাটতি নেই কিন্তু শহরের ভেতরের অবস্থা ঠিক উল্টো। শীঘ্রই তারা বাধ্য হবে খাবারের অন্বেষণে লোক পাঠাতে। আমাদের গুপ্তচরদের এখন কেবল সতর্ক থেকে তাদের গোপনে বের হবার রাস্তাটা চিনে নিতে হবে। শক্তি দিয়ে যা কাবু করা যায় না ছলনায় সেটা সহজেই পরাভূত হয়।”
হতাশায় বাবর অব্যক্ত স্বরে গুঙিয়ে উঠে। বিজ্ঞ আর ঠাণ্ডা বিচক্ষণ ওয়াজির খান যে লোক যুদ্ধ বিষয়ক কলাকৌশলে অজ্ঞ বাবরকে নিজ হাতে সবকিছু শিখিয়েছেন তিনি তাকে ভালো করে মনে করিয়ে দেন তার আরও অনেক কিছু শেখার বাকি আছে। বিগত মাসগুলো তাকে অনেক কিছুই শিখিয়েছে। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহে, সে জেনেছে যেখানে ঘাস আশেপাশের থেকে বেশি লম্বা আর সবুজ, বুঝতে হবে সেখানে লুকান পানির ধারা অবশ্যই আছে। সে শিখেছে যুদ্ধের সম্ভাবনা পিছিয়ে গেলে কিভাবে কুচকাওয়াজ আর শরীরচর্চার মাধ্যমে সৈন্যদের প্রস্তুত আর মনোবল চাঙ্গা রাখতে হবে। সে তাদের আদেশ দিয়েছে সমরকন্দের উঁচু দেয়ালের বাড়াবাড়ি ধরণের কাছে গিয়ে পোলো খেলতে এবং শহরের শ্রেষ্ঠ তীরন্দাজদের হেলায় মোকাবেলা করতে বলে সে ঘোড়ার খুরে মত্ত মাদলের বোল তুলে ছুটে গিয়ে ভেড়ার মাথার বলে তার ম্যালেট দিয়ে আঘাত করেছে যা তারা তাদের খেলা শেষ হলে- ইচ্ছাকৃতভাবে শহর রক্ষাকারী প্রাকারের উপর দিয়ে চরম অবজ্ঞায় ভেতরে ছুঁড়ে দিয়েছে।
বাবর, অন্ধকারে কিভাবে নিরবে দলবল নিয়ে এগিয়ে যেতে হয় এবং কিভাবে লম্বা মই স্থাপন করতে হয় উঁচু দেয়ালের সাথে, যার শীর্ষভাগ ভেড়ার চামড়া মোড়ান রয়েছে কৌতূহল উদ্রেককারী শব্দ রোধ করতে, আয়ত্ব করেছে। মই বেয়ে সে। তাদের সাথে উপরে উঠতে গিয়ে প্রস্তরখন্ড, তীরের ঝাপটা আর বালতি ভর্তি গরম জ্বলন্ত আলকাতরার সামনে পড়েছে এবং পিছিয়ে এসেছে। সে তার লোকদের খোঁড়া অন্ধকার, বালুময় সুড়ঙ্গে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে গিয়েছে দেয়ালের দিকে আশা করেছে নিচে দিয়ে যেতে পারবে কিন্তু ফারগানার পাহাড়ের মত অনড় ভিতের মুখোমুখি হয়েছে।
বাবর দিনের বেলায় আক্রমণ করেছে, তার লোকেরা ঘামে ভিজে অতিকায় অবরোধ অনুষঙ্গ টেনে এনেছে বিশাল প্রস্তরখণ্ড ছুঁড়ে মারতে। কিন্তু সমরকন্দের লোহা দিয়ে বাধান গেট আর পুরু দেয়াল এসব ঝাপটা আর মাথায় লোহার পাত দেয়া বড় ভারী কাঠের লাঠির আঘাত অনায়াসে সামলে নিয়েছে।
“আমি বুঝতে পারছি না। আমার চাচা সমরকন্দের সুলতান ছিল। আমি তৈমূরের সাক্ষাৎ বংশধর। আমি আশ্বস্ত করেছি যে শহরে কোনো অরাজকতা সৃষ্টি হবে না। লোকজন নিজের গরজে দরজা খুলে আমাকে প্রবেশ করার জন্য অনুরোধ করছে না কেন? সুদখোর উজিরের ভিতরে তারা কি পেল?”
ওয়াজির খানের হাসি হাসি মুখ দেখে বাবর বুঝতে পারে সে আবার বেফাঁস কথা বলে ফেলেছে। “এমন হতে পারে সে তাদের ভয় দেখিয়ে বশে রেখেছে। একটা কথা মনে রাখবেন সাধারণ মানুষ আপনাকে চেনে না। তৈমূর মারা যাবার পর থেকে অগণিত সুলতান আর গোত্রপতির দল নিজেকে মহান যোদ্ধার আত্মীয় দাবি করে সমরকন্দ অবরোধ করেছে স্বর্ণ আর সৌভাগ্যের প্রত্যাশায়। আপনার আপন। চাচাও বাহুবলে শহরটা অবরোধ করেছিলেন। শহরবাসীরা উপদ্ৰবকারীর প্রতি কেন সদয় হবে? হাম্বলদস্তা উজিরকে অন্তত তারা চেনে।”
পেঁচার ডাক শুনে তারা আকাশের দিকে তাকায়, সেখানে ইতিমধ্যেই রাতের তারারা বিদায় নিতে শুরু করেছে।
“সুলতান, এবার আমাদের ফেরা উচিত।” ওয়াজির খান কয়লা ভর্তি ঝুড়িটা লাথি মেরে উল্টে দিয়ে জ্বলন্ত কয়লাগুলি পা দিয়ে মাটি চাপা দেয়।
বাবর কেঁপে উঠে, কিন্তু সেটার কারণ কেবল উষ্ণতার সমাপ্তির ভিতরে নিহিত ছিল না। “ওয়াজির খান আমার দুশ্চিন্তা হচ্ছে। আমরা যদি শীঘ্রই শহরটা দখল না করি তবে শীতকাল এসে আবার আমার সৈন্যবাহিনীর দফারফা করে দেবে। আমি বিজয় অর্জন না করেই দ্বিতীয়বারের মত ফারগানায় ফিরে যেতে বাধ্য হব। তখন আমার লোকেরা কি ভাববে আমাকে?”
ওয়াজির খান তার বাহুতে হাত রাখে। “আমাদের হাতে সময় আছে। সূর্য এখনই ক্রান্তিকালে আসেনি। আল্লাহতা’লা সহায় থাকলে, সমরকন্দের পতন হবেই।” বাবর ভাবে, তার কথাই ঠিক। তার মরহুম আব্বাজান অনেক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছিলেন কিন্তু তাই বলে কখনও হতাশ হননি। তিনি যেন কি একটা কথা বলতেন? “তোমার সৈন্যরা যদি তোমাকে দ্বিধাগ্রস্থ দেখে তবে সব শেষ। তারা তোমার প্রতি নেতৃত্ব আর নিয়মানুবর্তিতার জন্য তাকিয়ে রয়েছে।” হ্যাঁ, সুলতানের কাজ হচ্ছে শক্ত থাকা। তাকে অবশ্যই এটা মনে রাখতে হবে।
তারা ঘোড়ায় চড়ে ছাউনির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। ছাউনির কাছাকাছি পৌঁছালে ঘোড়ার খুরের বোল ছাপিয়ে একটা লোকের ক্রুদ্ধ কণ্ঠ বাবরের কানে ভেসে আসে। দূর্বিনীত বদমাশগুলো কি নিজেদের ভিতরে আবার ঝামেলা বাধিয়েছে, যারা তার সেনাবাহিনীর সবচেয়ে বড় অংশ? বাতাসে শোরগোলের আওয়াজ আরও জোরাল হতে এবং শপথ আর প্রতিজ্ঞার ঝড় বইতে থাকলে, সে ক্লান্ত মনে ভাবে।
হাম্মামখানার তাবুর কাছ থেকে গোলমালের শব্দ আসছে। সে আর ওয়াজির খান আরেকটু সামনে এগিয়ে যেতে, বাবর দেখে তার একজন ভাড়াটে সেনাপতি বনাঞ্চলে বিচরণ করা যাযাবর-নিজের কয়েকজন মার্কামারা সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে দুটো বস্তার জিনিসপত্র তল্লাশি করছে। আরেকজন লোক, পোশাক-আশাক দেখে মনে হয় আশেপাশের গ্রামের কৃষক, দাঁড়িয়ে দেখছে। “আমার কাছ থেকে এভাবে কেড়ে নেবার কোনো অধিকার তোমার নেই। তোমরা যদি সবই এভাবে রেখে দাও-আমার শস্য এমনকি আমার ভেড়াগুলোও বাদ দাওনি, তাহলে এই শীতে আমি আমার পরিবারকে কি খেতে দেব।” লোকটা ইশারায় কাছেই জড়োসড়ো হয়ে থাকা আলুথালু বাদামী রঙের ভেড়ার দিকে ইশারা করে। ক্রোধে লোকটার চোখে পানি টলটল করছে।
এই গোবেচারা, হাল্কা পাতলা, বিপর্যস্ত চেহারার কৃষিজীবি লোকটা ক্রোধে হতাশায় যেসব যোদ্ধাদের সামনে দাপাদাপি করছে তারা হাতের ঝটকায় তাকে জানে মেরে ফেলতে পারে, কিন্তু তার স্পর্ধা চোখে পড়ার মত, কিছু একটা আছে লোকটার ভিতরে, বাবর ভাবে।
“জানে বেঁচে গেলে বলে কপালকে ধন্যবাদ দিতে দিতে তোমার আস্তাকুড়ে ফিরে যাও। আর তোমার স্ত্রীর সাথে দেখা হলে তাকে আমার তরফ থেকে একটা চুমো দিয়ে বোলো, তার সঙ্গ আমি উপভোগ করেছি, যোদ্ধাদের একজন খিকখিক করে হাসতে হাসতে লোকটার পোদে একটা লাথি বসিয়ে দিলে বেচারা দূরে ছিটকে গিয়ে পড়ে। লোকটা উঠতে চেষ্টা করলে আরেকটা লাথি কষিয়ে দেয়।
“এখানে কি হচ্ছে?”
চমকে উঠে বোকা বোকা চোখে লোকগুলো বাবরের দিকে তাকিয়ে থাকে।
“মহামান্য সুলতানের প্রশ্নের উত্তর দাও,” ওয়াজির খান বাঘের ঝাপটা নিয়ে বলে। কিন্তু তবুও কেউ উত্তর দেয় না।
“উঠে দাঁড়াও,” বাবর মাটিতে পড়ে থাকা কৃষককে ইঙ্গিত করতে, সে ধীরে, পেটে হাত দিয়ে উঠে দাঁড়ায়, তার বলিরেখা পূর্ণ মুখে আশঙ্কার আঁকাজোকা। সে যদি সৈন্যদের ঘৃণা করে বোঝাই যায় তাদের সুলতানের প্রতিও তার কোনো আস্থা নেই। সে কারুকার্যময় লাগাম সজ্জিত ঘোড়ায় উপবিষ্ট কর্তৃত্বব্যঞ্জক বালকের কাছ থেকে দূরে সরে আসে।
“যেখানে আছে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকো।” বাবর ঘোড়া থেকে লাফিয়ে নেমে জীবন্ত চিত্রপটের দিকে তাকিয়ে দেখে। তার সামনে দুটো পাটের তৈরি বস্তা অসহায়ের মত উল্টে পড়ে ভেতরের সব মামুলি জিনিসপত্র ছত্রাকারে ছিটিয়ে রয়েছে। বাবর তার হাতের চামড়ার দাস্তানা খুলে ফেলে, একটা বস্তায় হাত ঢুকায় এবং ভেতর থেকে মলিন কাপড়চোপড়, একটা কাঠের পাত্র এবং কয়েকটা কাপড়ের ব্যাগ বের করে আনে। কাপড়ের ব্যাগগুলো খুলে সে ভেতরে ইঁদুরের কালো বিষ্ঠার সাথে মিশ্রিত ছাতা ধরা শস্যদানা দেখতে পায়। অন্য থলেটা ভারী প্রতিয়মান হয়। ভেতরে ছয়টা হাড্ডিসার মুরগী, যাদের সদ্য মাথা মোচড়ানো হয়েছে, এবং একটা। পনিরের পিণ্ড আর বস্তার আস্তরে মুরগীর পালক আর রক্তে দলা পাকিয়ে রয়েছে। দেখা যায়।
বাবর বস্তাটা একপাশে ঠেলে সরিয়ে দেয়ার সময় লক্ষ্য করে দাঁড়িয়ে থাকা কৃষক তার যথাসর্বস্ব ধনের মত সেটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। এগুলো কোথা থেকে এসেছে?” বাবর জানতে চায়। নিরবতা। “আমি জানতে চাইছি এসব কোথা থেকে এসেছে?” দ্বিতীয়বার সে সরাসরি কৃষকের চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করে। ‘সুলতান, জাফরশান নদীর ওপারে আমার গ্রাম থেকে এসেছে।”
“আর এসব তোমার কাছ থেকে জোর করে কেড়ে নেয়া হয়েছে?”
“হ্যাঁ, সুলতান।”
“জোর করে?”
“হ্যাঁ, সুলতান। এই দুইজন কেড়ে নিয়েছে।”
লোকটা লজ্জায় মাথা নিচু করে।
বাবর তার সেনাপতির দিকে তাকায়। “আমি পরিষ্কার আদেশ দিয়েছিলোম গ্রাম থেকে কোনো কিছু লুঠ করা হবে না, আমরা সব কিছু দাম দিয়ে কিনে নেবো। তৈমূরের উত্তরসূরী গরীব লোকদের নিপীড়ন করতে তাদের রক্তে ধরণী সিক্ত করতে এখানে আসেনি।”
যাযাবর লোকগুলো তার দিকে গনগনে চোখে তাকায়। “আমরা এখানে কয়েক। সপ্তাহ যাবৎ আছি। আমরা কিছুই জোর করে নেইনি। লুঠ করার মত কোনো মালই নেই। আমার লোকেরা বিরক্ত হয়ে পড়েছে। তাদের আমোদ দরকার। আর কি এমন নিয়েছে কৃষক নামের এই লার্ভাকীটের কাছ থেকে মামুলি কিছু সামগ্রী।”
“আর তার স্ত্রীকে ধর্ষণ করেছে।”
“তারা তো বললো সেই মহিলা খুব একটা অনিচ্ছুক ছিল না।” দলপতি খিকখিক করে হাসতে তার চওড়া কোদালের মত দাঁতের মধ্যেখানের ফাঁক উন্মুক্ত হয়ে পড়ে।
ক্রোধের একটা ঝাপটা বাবরকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। তার ইচ্ছে হয় তাদের এখনই এখানেই তরবারির আঘাতে দ্বিখণ্ডিত করে হতভাগাদের দেহবিহীন মুণ্ড গোবরের ঢিপিতে লাথি মেরে ফেলে দেয়। “ওয়াজির খান এই দুই লুটেরাকে এখনই গ্রেফতার করেন। তারা লুঠতরাজ আর ধর্ষণের অভিযোগে দোষী। তারা জানে এর কি শাস্তি। তাদের গোত্রের অন্য সদস্যদের উপস্থিতিতে আমি চাই এই মুহূর্তে তাদের সাজা কার্যকর করার ব্যবস্থা নেয়া হোক।”
ওয়াজির খান হাত উঁচু করে ইশারা করতেই প্রহরীরা এসে দু’জনকে বন্দি করে যারা কোনো প্রকারের বাধা দেবার পরিবর্তে আহাম্মকের মত দাঁড়িয়ে চোখ পিটপিট করে যেন আশেপাশে যা ঘটছে সেটা তাদের জ্ঞানগম্যির বাইরে।
“আর তোমাকে বলছি,” বাবর গোত্রপতির দিকে এবার তাকায় যার মুখের আমুদে হাসি অনেক আগেই উবে গেছে। বাবর খেয়াল করে তার আঙ্গুল কোমরে খয়েরী রঙের উলের তেলতেলে মসৃণ কাপড়ে জড়ান খঞ্জরের বাটের আশেপাশে চঞ্চল ভঙ্গিতে নড়াচড়া করছে এবং দেহ টানটান হয়ে আছে, মূর্খটার মাথায় কোনো ধরণের দূর্মতি ভর করলে সেটা মোকাবেলার জন্য সে সম্পূর্ণ প্রস্তুত। “এই অভিযানে তুমি আমার আইন মেনে চলবে অথবা তার পরিণতি ভোগ করবে এই শপথ নিয়েই তুমি আমার সাথে মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। ভবিষ্যতেও যদি তুমি তোমার লোকদের সামলে রাখতে ব্যর্থ হও তাহলে জেনো তোমারও একই পরিণতি হবে।” বাবরের কণ্ঠে হুমকির প্রচণ্ডতা। “তুমি সবার সামনে ঘোষণা করবে এটা ন্যায়বিচার-শাহী ন্যায়বিচার। আমি আমার শিবিরে কোনো ধরণের রক্তপাত চাই না। এখনই তোমার সব লোকদের এখানে ডেকে পাঠাও!”
গোত্রপতির দৃষ্টি বাবর, ওয়াজির খান আর প্রহরীদের হাতে ধৃত দুই লুণ্ঠনকারীর চোখের মরিয়া-দৃষ্টির ভিতরে ঘোরাফেরা করে। বাবর তার চোখে আর অভিপ্রায়ে মৃত্যুর শাণিত সঙ্কেত অনুভব করে। কিন্তু অস্ফুট কসম আউরে গোত্রপতি তরবারির বাট থেকে হাত সরিয়ে নেয় এবং তার পরিষ্কার কামান মাথা আনুগত্য প্রদর্শনের অভিপ্রায়ে নত করে।
দশ মিনিট পরে, অভিযুক্ত দুজনের চারপাশে একটা নিরব বৃত্ত তৈরি করে তাদের ক্ষুদ্র গোত্রের সব সদস্য এসে জড়ো হয়। বাবর ইশারায় অনুমতি দিলে সে কেশে গলা পরিষ্কার করে এবং বন্দিদের উদ্দেশ্যে বলে: “আমি যে আইন রক্ষা করব বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, তোমরা সেটা ভঙ্গ করেছে। আমি, গোত্রপতি হবার কারণে, বিচারের জন্য তোমাদের সোপর্দ করলাম। তোমাদের দেহ টুকরো করে হায়না আর শকুনের খোরাক হিসাবে ফেলে রাখা হবে। এখানে উপস্থিত সবাই আরেকটা কথা শুনে রাখো, আমার আদেশে এটা সংঘটিত হবে। দণ্ড কার্যকর যারা করবে তাদের বিরুদ্ধে কেউ কোনো প্রতিশোধমূলক মনোভাব পোষণ করবে না।”
ওয়াজির খান তার প্রহরীদলকে সামনে এগোবার ইঙ্গিত দেয়। কোষমুক্ত তরবারি নিয়ে তারা কাঁপতে থাকা বন্দির দিকে এগিয়ে যায় এবং তাদের হাঁটু ভেঙে দাঁড়াতে বাধ্য করে। ঝকঝকে তরবারির ফলা মৃত্যু মুখে নিয়ে তাদের ঘাড়ের উপরে নেমে আসতে সকালের তাজা শীতল বাতাসে লোকগুলোর শেষ আর্তনাদ পুকুরে ঢিল পড়ার মত ভেসে উঠে ডুবে যায়।
বাবরের পেটের খাবার মোচড় খেয়ে উঠে আসতে চায় এবং গভীর শ্বাস নিয়ে সে নিজেকে শান্ত রাখে। এটাই আইন। শৃঙ্খলা আর শ্রদ্ধা বজায় রাখতে কোনো নেতা যা করতো সে কেবল সেটাই করেছে। আর্তনাদ প্রশমিত হয়ে শকুনের দল আশু ভোজের সম্ভাবনায় কোলাহল শুরু না করা পর্যন্ত বাবর নিজেকে চোখ ফিরিয়ে নেয়া থেকে বিরত রাখে।
“তোমার জিনিসপত্র গুছিয়ে নাও আর এটা ধরো।” বাবর রৌপ্য মুদ্রা ভর্তি উটের চামড়ায় তৈরি একটা থলে হতভম্ব কৃষকের দিকে বাড়িয়ে ধরতে সে কয়েক মুহূর্ত সেটার দিকে বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে তারপরে সেটা হাতে নেয়। বাবর পিঠ ঘুরিয়ে নিয়ে রওয়ানা দেবে এমন সময় লোকটা গলা পরিষ্কার করে ইতস্তত ভঙ্গিতে কিছু একটা বলতে চায়।
“আর কিছু বলবে?” চর্মসার আর দুর্দশাগ্রস্থ কৃষকটা- বাবরের মনে বিরক্ত আর ক্লান্ত একটা অনুভূতির জন্ম দেয়। আজ এখানে যা কিছু ঘটেছে তাতে এই লোকটার কোনো হাত নেই, কিন্তু লুটেরার দল যখন তার গ্রামে হানা দিয়েছিলো তখন সেই সত্যিকারের মানুষের মত তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে ছিল…বাবর ভাবনাটা অবান্তর বলে সেখানেই থামিয়ে দেয়। এই লোকটা যোদ্ধা না, সে একজন পরিশ্রমী মানুষ এবং সে সাহস করে তার শিবিরে এসেছিল ন্যায়বিচারের প্রত্যাশায়।
“সুলতান…একটা ব্যাপার যা আপনার বোধহয় জানা উচিত…তিন দিন আগে পূর্ণিমার সময়ে যা আমি নিজের চোখে দেখেছি।”
“কি দেখেছো?…বলো।”
“আমি দেখেছি কিছু লোক…সম্ভবত, গুপ্তচর– শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছে। আমি তখন ভেড়া চরাতে গিয়েছিলাম, গাছের আড়ালে লুকিয়ে আমি তাদের বের হতে দেখি, এবং বেশ কয়েক ঘণ্টা পরে তাদের ফিরেও আসতে দেখেছি। সুইপ্রস্তুতকারকদের ফটকের পাশে দিয়ে একটা গলিপথ সমরকন্দের দিকে চলে গেছে। সুলতান চাইলে আমি সেটা দেখাতে পারি।”
বাবরের হৃৎস্পন্দন হঠাৎ বেড়ে যায়। “তুমি যদি সত্যি কথা বলে থাকো তবে ঐ রৌপ্যমুদ্রার কয়েকগুণ বেশি আমি তোমার ওজনের সমান সোনার মোহর তোমাকে দেব।”
***
“সুলতান, এটা স্রেফ পাগলামি।”
“হয়ত।” বাবর টের পায় তার নিজের ভেতরে উত্তেজনার রাশ আলগা হচ্ছে। আর কয়ের ঘণ্টা পরে সে সমরকন্দের ভেতরে থাকবে।
“অন্তত আমাকে আপনার সাথে যাবার অনুমতি দেন।”
“না, ওয়াজির খান। ছিন্ন বস্ত্র পরিহিত একটা কিশোরকে কে ভাল করে খেয়াল করতে যাবে? কিন্তু সমরকন্দের অনেকেই তোমায় চেনে। আমি একলাই বরং নিরাপদে থাকব।”
ওয়াজির খানকে অন্তত একবার হলেও কিংকর্তব্যবিমূঢ় দেখায়। তার অন্ধ চোখের উপরের আড়াআড়ি ক্ষতচিহ্ন স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে কুঞ্চিত হয়ে উঠে। “কিন্তু আপনি আমাদের সুলতান,” সে একগুয়ে কণ্ঠে বলে। “ফারগানার কি হবে যদি আপনি আর ফিরে না আসেন?”
“আমি ফিরে আসছি। এখন আমাকে যেতে দাও।”
বাবর তার নিজের পছন্দ করা নির্ভরযোগ্য, শক্তপোক্ত দেখতে কালো টাটু ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসে এবং পেছন দিকে একবারও না তাকিয়ে রাতের আঁধারে অজানার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়।
চাঁদের আলোয় পশ্চিমদিকে বয়ে যাওয়া নহরের সমান্তরালে এগিয়ে যাওয়া। এবড়োখেবড়ো পথটা আলোকিত হয়ে আছে, যা আগের রাতে সে নিজে ওয়াজির খান আর সেই কৃষকটার সাথে এসে দেখে গিয়েছিল। তার মস্তিষ্কে পথটার প্রতিটা নুড়িপাথর যেন গাঁথা হয়ে রয়েছে। সে এখন খান উর্তি তৃণভূমির উপর দিয়ে ঘোড়া দাবড়ে চলেছে- তার মরহুম আব্বাজান তাকে প্রায়ই এর কথা বলতো- গ্রীষ্মকালে তৈমূর একবার এখানে অবকাশযাপনের উদ্দেশ্যে ছাউনি ফেলেছিল। রেশমের ছাউনির নিচে শুয়ে পানির ধারা বয়ে যাবার শব্দ শুনবে বলে, যা ছিল বেহেশতের উদ্যানে প্রবাহিত জলধারার ন্যায় শীতল আর বিশুদ্ধ। এখন সেই একই জলধারার চঞ্চল শব্দ যেন মহান তৈমূরের কণ্ঠস্বর হয়ে বয়ে চলেছে, তাকে বলছে: “এগিয়ে যাও। সব কিছু তুচ্ছ করে।”
এক ঘণ্টা নিরবিচ্ছিন্নভাবে পথ চলার পরে স্রোতধারা বিভক্ত হতে বাবর বামদিকের স্রোত অনুসরণ করে সেটা সমরকন্দের বিশাল সবুজাভ-নীল তোরণের আধমাইল দক্ষিণ দিয়ে বয়ে গেছে। তাকে খুব সতর্ক থাকতে হবে। দূর্গ প্রকারের পেছন থেকে তাকিয়ে থাকা সতর্ক দৃষ্টি নিঃসঙ্গ অশ্বারোহীকেও সন্দেহের চোখে দেখবে যদি সে খুব কাছে এগিয়ে যায়। সে স্রোতধারার দূরবর্তী পাড় দিয়ে এগিয়ে যায়, যেখানে সে পাড়ে জন্মানো উইলো গাছের ছায়ায় মিশে গিয়ে সবার দৃষ্টি এড়িয়ে অশরীরির মত এগিয়ে যেতে পারবে।
ওয়াজির খান অবশ্য ঠিকই বলেছিল। পুরো ব্যাপারটাই পাগলামির চুড়ান্ত। এতগুলো মাস শহর অবরোধ করে রাখার পরে এখন যদি শহরের রক্ষাব্যুহের দুর্বল স্থান আর তার অধিবাসীদের মনোভাব জানবার শখ বাবরের হয়ে থাকে তবে সে নিজে একলা না এসে তার অধীনস্থ কোনো গুপ্তচরকে সুড়ঙ্গ পথে পাঠাতে পারতো। কৃষকটার ইতস্তত ভঙ্গিতে উচ্চারিত সেই কয়েকটা বাক্য শোনবার মুহূর্ত থেকে বাবর জানে নিয়তির অমোঘ হাত তাকে সামনে টেনে নিয়ে চলেছে।
মাথার উপরে ঝুঁকে থাকা উইলোর শাখার ভেতর দিয়ে রাতের মেঘহীন পরিষ্কার আকাশ দেখা যায়। স্রোতস্বিনীর অপর পাড়ে সে শহরের আবছা অবয়ব দেখতে পায়। আর কয়েক মিনিট আর তারপরেই অন্ধকারের ভেতর থেকে দৈত্যের মত সবুজাভ-নীল তোরণদ্বার প্রকটিত হবে। শীঘ্রই একদিন, বাবর নিজেকে কথা দেয়, রাতের আঁধারে চোরের মত নিজের শহরে প্রবেশের বদলে, সে এই তোরণদ্বারের নীচ দিয়ে নিজের বাহিনী নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করবে।
একটা ক্ষুদ্র জন্তু- ইঁদুর, খুব সম্ভবত নদীর তীরে বসবাসকারী ইঁদুর- তার টাটুর খুরের নীচ দিয়ে দৌড়ে গেলে আতঙ্কে হেষাধ্বনি তুলে বেচারা চঞ্চল ভঙ্গিতে পাশে সরে যায়। বাবর নুয়ে পড়ে তার টাটুর নরম, ঝাকড়া গলায় হাত বুলিয়ে তাকে শান্ত করে। এখান থেকে পায়ে হেঁটে এগিয়ে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। বাবর ঘোড়ার সাজ খুলে নেয় এবং পিঠ থেকে ভাঁজ করা কম্বলটা নামায় যার উপরে সে এতক্ষণ বসে ছিল তারপরে ওয়াজির খানের সাথে তার যেমন কথা হয়েছিলো, টাট্ট ঘোড়াটা ছেড়ে দেয় যাতে সেটা পথ খুঁজে ছাউনিতে ফিরে যেতে পারে। আগামীকাল ঠিক এই সময়ে ওয়াজির খান এখানেই আরেকটা নতুন ঘোড়া নিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করবে।
কোমল অন্ধকারের ভিতর দিয়ে দক্ষিণে আরও আটশ গজ এগিয়ে যাবার পরে সে সুইপ্রস্তুতকারকদের তোরণদ্বারের উভয়পার্শ্বে জ্বলন্ত মশালের বিরক্তিকর লালবিন্দু সে দেখতে পায়। লম্বা আর সংকীর্ণ, সমরকন্দের ছয়টা প্রবেশদ্বারের ভিতরে, এটা সবচেয়ে সেটা আর নিরাভরণ। এই তোরণদ্বার সাধারণত কৃষক আর ব্যবসায়ীরা সচরাচর ব্যবহার করে থাকে। তৈমূর কদাচিত এটা ব্যবহার করেছেন। অতিকায় লোহার তোরণদ্বার আর নীল টাইলে সজ্জিত সবুজাভ-নীল তোরণদ্বার তিনি সাধারণত ব্যবহার করতেন যার প্রবেশ পথের খিলানাকৃতি তোরণের উপরের কামরায় অবস্থানরত নকীবের দল কাড়াকাড়া আর কর্কশ-সুরের তূর্যনাদের মাধ্যমে তার আগমন ঘোষণা করতো।
সময় হয়েছে এবার স্রোতস্বিনী অতিক্রম করার, যা এখানে অনেক গভীর প্রায় নদীর দ্যোতনায় প্রবাহিত হচ্ছে। বাবর প্রায় তার কাঁধ ছাপিয়ে বয়ে যাওয়া পানিতে ধীরে ধীরে নেমে আসে। প্রায় তীরের কাছে পৌঁছে সে তলদেশের আলগা পাথরে হোঁচট খায় আর ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। শীতল পানির স্রোত মাথার উপরে বয়ে গিয়ে তার শ্বাসরোধ করে ফেলে সে টের পায় পানির টানে সে ভেসে যাচ্ছে। ডুবন্ত। মানুষের মত অকুলান হয়ে সে কোনমতে একহাত পানির উপরে তুলে আর সেটা গাছের ডালের মত কিছু একটার সাথে ধাক্কা খেতে সে ব্যাথায় কুচকে যায়। আরেকবারের চেষ্টায় সে একটা ডাল কোনমতে ধরে আর এবার দু’হাত ব্যবহার করে নিজেকে তীরে তুলে নিয়ে আসে।
হাঁপাতে হাঁপাতে, সে চোখের উপর থেকে চুল সরিয়ে চারপাশে ভাল করে তাকায়। অন্ততপক্ষে সে নহরের অপর পারে এসে পৌঁছেছে। সহজাত প্রবৃত্তির বশে সে তার। তৈমূরের আংটি খোঁজে, যা তার গলায় একটা চামড়ার পাতলা দড়ির সাহায্যে ঝুলে আছে। তার আঙ্গুল ভারী, মোটা ধাতব অস্তিত্ব টের পেতে সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। সে নিরবে গুটিসুটি মেরে কাঁপতে কাঁপতে কান খাড়া করে। কিছুই না। না কোনো ফেঁকড়ি ভাঙার আওয়াজ না বাদুরের নরম ডানার ঝাপটানি। সে এবার সামনে সুইপ্রস্তুতকারকদের আবছাভাবে দৃশ্যমান তোরণদ্বারের দিকে তাকায়। গুঁড়ি মেরে নিঃশব্দে সামনে এগিয়ে সে একটা পুরান বাগানের ধ্বসে পড়া দেয়ালের কাছে। এসে পৌঁছে, যেখানে ডালিম গাছের মাঝে মরা ডালপালার স্তূপের নিচে গোপন সুড়ঙ্গে প্রবেশের মুখটা ঢাকা রয়েছে।
গতরাতে পাহারা দেবার জন্য কোনো প্রহরী ছিল না। বাবর কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করে আজও যেন সেরকমই থাকে। আর তাছাড়া সুড়ঙ্গের ভেতরেও সে কারো মুখোমুখি হতে চায় না। তাকে দ্রুত করতে হবে- আর সেই সাথে সতর্কও থাকতে হবে। খোলা স্থানের দিকে দৌড়ে যাবার প্রবণতা গলা টিপে মেরে সে একটা বুড়ো গাছের কোটরে গা-ঢাকা দেবার স্থান খুঁজে বের করে এবং সেখানে চুপ করে বসে কান খাড়া করে চারপাশে লক্ষ্য রাখে। তোমার নামের অর্থ বাঘ, বাবর নিজের মনে বলে, আজ রাতে তাই সেরকমই আচরণ করো। খোলা জায়গা এড়িয়ে গিয়ে তাই আঁধারের আলিঙ্গনে নিজেকে আবৃত করো আর নিজের অসহিষ্ণুতা দমন করতে শেখো।
কিছুক্ষণ পরে, একটা বাচ্চা শেয়াল তার পাশ দিয়ে অতিক্রম করে। বাবরের গায়ের গন্ধ সে ঠিকই টের পায়, কিন্তু সেটা অগ্রাহ্য করে সামনে এগিয়ে যায়। শেয়ালের আচরণ দেখে বাবর নিশ্চিত হয় আশেপাশে কোনো দ্বিপদী প্রাণী নেই। আর সে তার লুকিয়ে থাকার স্থান থেকে এবার তাই বেরিয়ে আসে। তার পরণের মোটা কাপড়ের তৈরি আলখাল্লা আর ভেড়ার চামড়ার আঁটসাট জ্যাকেট- গরীব কৃষকের লেবাস- এখনও ভিজে চুপচুপে হয়ে আছে আর তার ত্বকে শীতল অনুভূতির জন্ম দিচ্ছে। পানিতে ভেজা কুকুরের মত সে নিজেকে ঝাঁকায়, তারপরে নিজেকে ভাল করে রগড়ে নেয়।
কম্পিত বুকে, সে সুড়ঙ্গের মুখের দিকে এগিয়ে যায় এবং মুখ থেকে ডালপালা সরিয়ে দেয়। তারপরে বুকে ভর দিয়ে সুড়ঙ্গে প্রবেশ করে এগিয়ে যাবার আগে নিজের পেছনে পুনরায় ডালপালাগুলো আবার জায়গামত রেখে দেয়। হাত বাড়িয়ে সে সুড়ঙ্গের মুখ আটকে রাখা ঝুলদরজার প্রান্ত খুঁজে। এই তো পেয়েছি! দরজাটার হাতল আঁকড়ে ধরতে একটা ছোট পোকা- সম্ভবত পিঁপড়ে বা পেটের নিচে চিমটেওয়ালা ক্ষুদে পোকা- তার আঙ্গুলের উপর দিয়ে হেঁটে যায়। বাবর সাবধানে দরজাটা খুলে এবং ভেতরে উঁকি দেয়। খনিকূপের মত সরু পথটা ইটের তৈরি আর দু’পাশে কাঠের ডাসা লাগান রয়েছে। সে দু’পাশের ডাসায় পা দিয়ে নামতে শুরু করে আর মাথার উপরে ঝুলদরজাটা টেনে যথারীতি বন্ধ করে দেয়।
তার চারপাশে এখন সূচীভেদ্য অন্ধকার এবং কেমন একটা অস্বাস্থ্যকর, স্যাঁতাস্যাঁতে, মাটি মাটি গন্ধ তার নাকে ভেসে আসে যেন কোনকিছু- বা কেউ একজন- এখানে মারা গিয়েছে, যা সম্ভবত এখানেই থেকে গিয়েছে। সমরকন্দের একটা গৌরবময় ইতিহাস রয়েছে, সত্যি কিন্তু সেই সাথে সেটা সংঘাতময়ও বটে। এই সুড়ঙ্গটা প্ৰথমকে খুঁড়েছিল? সে কল্পনা করতে চেষ্টা করে। তারা কি ভয়ঙ্কর ভবিতব্য এড়াতে নাকি ভেতরে প্রবেশের জন্য এই গর্তটা খুড়েছিল?
সতর্কতার সাথে, বাবর খনিকূপ সদৃশ সুড়ঙ্গটার তলদেশে নিজেকে নামিয়ে নিয়ে আনে, আগের রাতের অভিযানের অভিজ্ঞতা থেকে সে জানে সুড়ঙ্গটা মাত্র দশ ফিট গভীর। কিন্তু প্রশ্ন হল সুড়ঙ্গটা এখান থেকে কোথায় গিয়েছে? সে দুহাত দিয়ে দু’পাশে শক্ত করে ধরে পা টিপে টিপে সামনে এগিয়ে যায়। তার পায়ের নিচের মাটিতে প্যাঁচপ্যাঁচে শব্দ সৃষ্টি হয় এবং মনে হয় ক্রমশ ঢালু হয়ে নিচের দিকে নেমে গেছে। পিছলে গিয়ে টলতে টলতে সে সামনে এগিয়ে যায় এবং কয়েক কদম পরে পায়ের নিচে শক্ত পাথরের অস্তিত্ব অনুভব করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।
মাথার উপরের ছাদ নিচু হয়ে আসতে বাবর ঝুঁকে অন্ধকারের ভিতর দিয়ে এগিয়ে যায়। এখন কোনো শত্রুর মুখোমুখি হলেই হয়েছে, আর দেখতে হবে না। সোজা হয়ে সে দাঁড়াতেই পারছে না, শত্রুর মোকাবেলা করবে কিভাবে। আর তরবারি চালাবার কোনো প্রশ্নই উঠে না। সে সাথে করে তার মরহুম আব্বাজানের ঈগলের মাথার বাটযুক্ত তরবারি নিয়ে আসেনি। কপাল খারাপ হলে সে যদি ধরা পড়ে তখন। তার মত একজন কৃষকের সন্তানের কাছে সেটা কিভাবে এল তা নিয়ে অনেক প্রশ্নের উদ্রেক হবে। কিন্তু মুশকিল হল তরবারিটা ছাড়া তার নিজেকে অরক্ষিত মনে হয়।
স্যাঁতস্যাঁতে, পাতিগন্ধময় বাতাসে সে যেভাবে কুঁজো হয়ে রয়েছে, তাতে শ্বাস নেয়া রীতিমত কষ্টকর হয়ে উঠেছে। পায়ের ধাপ গুনতে গুনতে, সে দ্রুত এগিয়ে যায়- দশ, বিশ, ত্রিশ। সে আগে হিসেব করে রেখেছে যে ছয়শো ধাপ তাকে শহরের দেয়ালের কাছে যাবে। কিন্তু তার কোনো ধারণা নেই সুড়ঙ্গটা আসলে কতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। সে গোনার চেষ্টা চালিয়ে যেতে চেষ্টা করে। নব্বই, একশ। কপালের ঘাম গড়িয়ে মুখে একটা নোনতা স্বাদ ছড়িয়ে যায়। অসহিষ্ণুচিত্তে সে জিহ্বা দিয়ে লবণাক্ত ঘামের ফোঁটা ঘন ঘন টুসকি দিয়ে ঝেড়ে ফেলতে চেষ্টা করে। একশ পঞ্চাশ…সুড়ঙ্গটা এখন বেশ প্রশস্ত হয়ে উঠেছে, দু’জন অনায়াসে হেঁটে যেতে পারবে। বাবরের গতিবেগ দ্রুততর হয়ে উঠে। সে এখন প্রায় দৌড়াচ্ছে। চারশ….
তারপরে সে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। কিসের শব্দ? পুরুষ কণ্ঠের হৈচৈ আর কর্কশ অট্টহাসি সে নিশ্চিতভাবেই শুনতে পায়। সহসা তাকে চমকে দিয়ে সামনে থেকে কমলা আলোর আভা ভেসে আসে। বাবর এবার অস্পষ্ট দেয়াল দেখতে পায় এবং সেটা বাম দিকে তীক্ষ্ণ বাঁক নিয়েছে। বদ্ধস্থানে গলার স্বর গমগম করে প্রতিধ্বনি তুলছে। মুহূর্তের ভিতরেই কণ্ঠস্বর যাদের তারা বাঁক ঘুরবে আর তাকে দেখতে পাবে। বাবর পাগলের মত ঘুরে দাঁড়িয়ে অন্ধকার কোণায় ছুটে যায়। হতাশায় প্রায় ফোঁপাতে ফোঁপাতে সে দৌড়াতে থাকে এবং সুড়ঙ্গের একটা ভাজের মাঝে নিজেকে আপ্রাণ চেষ্টা করে মিলিয়ে দিতে। কিন্তু কণ্ঠস্বরগুলো এখন আবার মিলিয়ে যেতে শুরু করেছে। লোকগুলোকে যদি সুড়ঙ্গটা পাহারা দেবার জন্য পাঠান হয়ে থাকে তবে বলতেই হবে তারা তাদের দায়িত্ব ঠিকমত পালন করেনি। একটা মলিন হাসি তার মুখে ফুটে উঠে। ওয়াজির খানের লোক হলে এতক্ষণে কাজে গাফিলতির জন্য। তাদের চামড়া জীবন্ত খালিয়ে নেয়া হত।
বাবর অপেক্ষা করে। পুনরায় অন্ধকার আর নিরবতা নেমে এসেছে। বেশ কয়েকবার গভীরভাবে শ্বাস নিয়ে, কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে সে আবার সামনে এগোতে শুরু করে। বাবর তার পায়ের ধাপের গণনা গুলিয়ে ফেলেছে কিন্তু সে একটা ব্যাপারে নিশ্চিত যে সে শহরে দেয়ালের কাছে নিশ্চিতভাবে পৌঁছে গেছে। সে এবার বাম দিকের তীক্ষ্ণ বাঁকটা ঘুরে এবং সামনে এগিয়ে যায়। আরও পাঁচ মিনিট নাগাড়ে হাঁটবার পরে সে তার সামনে আবছা আলোর আভাস বুঝতে পারে যা জ্বলন্ত মশালের কমলা রঙের আভা না বরং চাঁদের আর রাতের তারার একটা শীতল বিকিরণ।
হাতের উল্টোপিঠ সে তার কপালের ঘাম মোছে এবং দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে নিজেকে যতটা সম্ভব অন্ধকারে মিশিয়ে দিতে চেষ্টা করে যেন দূরবর্তী প্রান্তে ধনুকে তীরে জুড়ে তৈরি থাকা সতর্ক প্রহরী তাকে সহজ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করতে না পারে। কিন্তু সামনে কেবল নিরবতা বিরাজ করছে। পুরো শহর এখন বোধহয় ঘুমে বিভোর। সে তার বিবর্ণ মাটির দাগ লাগা পোষাক আর হাত সুড়ঙ্গের ভিতরের আলোতে কোনমতে দেখতে পায়। তাকে তৈমূরের বংশের রাজপুত্র বলে কেউ চিনতে পারবে সে ভয় এখন আর নেই। শহরের ভিতরে সে অনায়াসে ভীড়ের মাঝে মিশে যেতে পারবে, গতকালের বাসি রুটির সন্ধানে আরেকজন হতভাগ্য কিশোর এসেছে।
সুড়ঙ্গটা এসে দূষিত পানিতে পূর্ন একটা বৃত্তাকার গর্তে এসে শেষ হয়েছে, বাবর ভাবে, সম্ভবত কোনো অব্যবহৃত ইঁদারার খাড়া ফাঁকা স্থান। উঁকি দিয়ে সে রাতের তারকাখচিত আকাশের চাঁদোয়া দেখতে পায়। নিরবে সন্তর্পনে সে খাঁড়া দেয়ালে গাঁথা ধাতব কীলক বেয়ে উপরে উঠতে আরম্ভ করে। এমন সুড়ঙ্গ এই শহরে আর কতগুলো আছে? কোনো সন্দেহ নেই শত্রুরা তার প্রতিটা পরিকল্পনা সম্পর্কে আগেই অবহিত হয়েছে। তার ছাউনি দূষিত করতে দলে দলে গুপ্তচরের দল ইঁদুরের মত হাজির হয়ে তার গোপন তথ্য জেনে নিয়ে ঘরে ফিরে এসেছে। কিন্তু এখন, বাবর ভাবে, ইঁদুর হবার পালা এবার আমার।
দেয়ালের উপরে পাথরের গোলাকার রক্ষামূলক বেষ্টনীর উপর দিয়ে বাবর নিজেকে টেনে তুলে এবং ছায়ার ভিতরে আলতো করে নেমে আসে। চাঁদের আলোতে বাবর দেখে সে একটা আঙ্গিনার মত জায়গায় উপস্থিত হয়েছে যেখানে কেবল দুটো হাড্ডিসার নেড়ী কুত্তা ঘুমিয়ে রয়েছে। বাবর তাদের পাঁজরের হাড় ছন্দোবদ্ধ ভঙ্গিতে উঠানামা করতে দেখে এবং তাদের মৃদু কেঁউ কেউ স্বরে ফোঁপানি শুনতে পায়। পরাক্রমশালী সমরকন্দে তৈমূরের উত্তরাধিকারীর আগমনের কি অনবদ্য তরীকা কেবল নেড়ী কুকুরের সহচর্যে গায়ের গন্ধে ভূত পালাবে আর করণে ছেঁড়া ফাটা কাপড়।
এখন প্রশ্ন হল সে ঠিক কোথায় আছে? বাবর জানতে পারলে বর্তে যেত। এখন সে কেবল লোকজন উঠে চলাচল শুরু করা পর্যন্ত লুকিয়ে থাকতে পারে। লোকের আড়াল তার প্রয়োজন। শীতে কাঁপতে কাঁপতে সে দেয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে রাখা একটা কাপড়ের স্তূপ খুঁজে পায়। এতেই কাজ চলবে। সে কাপড়ের নিচে আলতো করে ঢুকে আসে এবং সে মাথার উপরে টেনে দিয়ে নিজেকে পুরোপুরি ঢেকে ফেলে। সে ভাবে, সমরকন্দ। সমরকন্দ! তারপরে কিছু বুঝে উঠবার আগেই ঘুম জোয়ারের মত দুচোখ ছাপিয়ে এসে তার ক্লান্ত শরীরের দখল বুঝে নেয়।
“এটা আমার জায়গা! তোমার পঁচা গাজর নিয়ে অন্য কোথাও যাও।”
বাবর ঘুম ভেঙে চমকে উঠে এবং কাপড়ের ফাঁক দিয়ে উঁকি দেয়। কয়েক ঘণ্টা আগে যে জায়গাটা জনমাবনহীন ছিল এখন লোকজনে গমগম করছে। ভোরের আবছা আলোতে, তার মনে হয় লোকগুলো একটা বাজার বসাতে চাইছে। যার কণ্ঠস্বরে তার ঘুম ভেঙেছে সে তাকিয়ে কালো, ধূলি ধূসরিত আলখাল্লা পরিহিত এক লম্বা, শীর্ণকায় বৃদ্ধলোকের। নিজের পছন্দসই স্থানের দখল বুঝে নিয়ে, সে আসনপিড়ি হয়ে বসে এবং জোব্বার পকেট থেকে কয়েকটা ছাতা-পড়া পেঁয়াজ বের করে।
সতর্কতার সাথে, বাবর তার লুকানর স্থান থেকে বের হয়ে আসে। রুক্ষ দর্শন, ছিন্ন বস্ত্র পরিহিত লোকের দল ততোধিক কুঞ্চিত আনাজপাতির সামান্য পরিমাণ কাপড়ের উপরে সাজিয়ে রাখছে- গাজর রঙ বিগড়ে গিয়েছে এবং অঙ্কুরিত হয়েছে আর কুচকে যাওয়া মুলা। আরেক বৃদ্ধা যার কুঞ্চিত মুখ থেকে নেকাব খসে পড়েছে। বেপড়োয়া অনটনে, সমাধিস্থ করার জন্য যেভাবে মৃতদেহ পবিত্র করা হয় ঠিক একই যত্নে একটা মৃত ইঁদুর সাজিয়ে রাখছে। অন্যেরা, বোঝাই যায় যাদের কাছে বিক্রি করার মত কিছু নেই আর কেনার সামর্থ্যের প্রশ্নই উঠে না, তারা চারপাশে ভিড় করে দাঁড়িয়ে ক্ষুধার্ত চোখে তাকিয়ে রয়েছে।
বাবর বিস্মিত হয়ে ভাবে, এই লোকগুলো উপবাস করছে। অবরোধ অনেক মাস হল বজায় আছে এবং সে আশা করেনি যে রসদের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে, কিন্তু তাই বলে…এক শিশুর কান্নায় তার চিন্তার জাল ছিঁড়ে যায়। এক তরুণী মাতা যার স্তনের দুগ্ধধারা শুকিয়ে গেছে এবং যার চোখের তারা ভর করেছে অসহায়তা। নেকাবের একটা কোণা পানিতে ভিজিয়ে নিয়ে সেটাই নিজের সন্তানের বুভুক্ষ ঠোঁটে গুঁজে দেয়।
“নিজেদের ঘাঁটিতে ব্যাটারা ভালই আছে,” বৃদ্ধলোকটা বলে, তারপরে এমন ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে থুতু ফেলে যে আরেকটু হলে কফের দলা তার নিজের সাতটা পেঁয়াজের স্তূপে গিয়ে পড়ত। “তারা আমাদের কাছ থেকে সব কিছু কেড়ে নিয়েছে। তারা বছরের পর বছর টিকে থাকতে পারবে, রেশমের আলখাল্লার নিচের ভূড়ি আমাদের খাবার দিয়ে পূর্ণ করবে। ন্যায়বিচার বলে কি কিছু নেই?”
“বুড়া মিয়া, চুপ করো, মুখে লাগাম দাও, তোমার কারণে আমরা সবাই বিপদে পড়বো। শীতকাল আসলে গতবারের মত এবারও আক্রমণকারীরা দেশে ফিরে যাবে।”
“আর তারপরে কি ঘোড়ার ডিম হবে? কৃতজ্ঞতায় উজিরকে আরো বেশি করে তখন খাজনা দিতে হবে! বেশ্যার বেটার বড্ড বাড় বেড়েছে! আর সবাই বলছে আমাদের বিবি, বেটীদের সে নাকি ভীষণ পছন্দ করে। মরহুম সুলতান, আল্লাহ তাকে বেহেশত নসীব করুন, তার চেয়েও নাকি দ্বিগুণ বড় আমাদের উজিরের হারেম। আমি শুনেছি একরাতে সে তিনজন নারীর সাথে সহবাস করে।”
“বুড়া মিয়া, শান্ত হও, তোমার বসন্তের দাগঅলা স্ত্রী আর মেয়ের চেয়ে ঐ ছাগলটা অনেক বেশি যৌনাবেদনময়,” আরেক লোক ফোড়ন কাটে।
নিজের বিবি-বেটীদের আব্রু রক্ষায়, পেঁয়াজ বিক্রেতা ক্রুদ্ধ কণ্ঠে সাফাই দিতে শুরু করতে বাবর আলগোছে সেই চত্বর থেকে সরে আসে এবং একটা গলি ধরে হাঁটতে শুরু করে। সব জায়গাতেই একই দৃশ্য। চোখে মুখে অনাহারের নির্মম ছাপ পড়া, ক্ষুধার্ত মানুষের দল ছায়ামূর্তির মত ধীরপায়ে হেঁটে চলেছে, যেন তাদের দেহের শেষ বিন্দু জীবনীশক্তি নিংড়ে নেয়া হয়েছে। সে দাঁতহীন মাড়ি দেখিয়ে এক বৃদ্ধাকে হাসতে দেখে, যে শিশুর মত মমতায় একটা মৃত বিড়ালের নির্জীব দেহ কোলে করে রেখেছে। ইঁদারার ধারে গতরাতে ঘুমন্ত কুকুরগুলো যে এতদিন বেঁচে রয়েছে সেটা ভেবে সে বেশ অবাক হয়।
ম্লান কমলা রঙের উদীয়মান সূর্যের কাক্ষিত দৃশ্যপট- যা তাকে নিজের অবস্থান সম্পর্কে অবহিত করবে। বাবর জানে যে সূর্যের দিকে পিঠ করে হাঁটলে তৈমূরের সুরক্ষিত আস্তানার দেয়ালের কাছে তার পৌঁছে যাওয়া উচিত। আপাতভাবে মনে হয় তার ধারণাই ঠিক। সে দ্রুত এগিয়ে যেতে শুরু করে, খেয়াল করে রাস্তাগুলো ক্রমশ চওড়া হয়ে উঠেছে আর দুপাশের ভবনগুলো এখন অনেক বেশি অভিজাত দর্শন। সে সুদৃশ্য ফুল লতাপাতা আর জ্যামিতিক নকশার প্রাণবন্ত টাইলসে সজ্জিত হাম্মামখানা, গম্বুজযুক্ত মসজিদ আর অপরূপ সুন্দরভাবে তৈরি করা মাদ্রাসা দেখতে পায়, যেখানে বিদ্যার্থীর দল নামাজ আদায় করে আর অধ্যয়ন করে।
তার পূর্বপুরুষেরা এত সুন্দর একটা শহর তৈরি করেছে এমন বালকসুলভ একটা গর্ববোধ তার ভিতরে জন্ম নেয়। সে যখন সমরকন্দের সুলতান হবে, শহরের আশেপাশের বাগান আর ক্ষেত থেকে সজি এবং ফল এসে আবার বাজার বোঝাই করে ফেলবে। রুটিঘর আর রন্ধনশালা- যা এখন শূন্য আর পরিত্যক্ত থেকে আবারও বাতাসে সুবাস ছড়াবে। সমৃদ্ধশালী আর সুখী নাগরিকের দল, তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠবে। এবং, তৈমূরের সময়ের মত, প্রতিভাবান মানুষের দল- কবি, চিত্রকর, পণ্ডিত- সভ্য দুনিয়ার নানা প্রান্ত থেকে এখানে এসে মিলিত হবে। পুরো বিষয়টার তাৎপর্য অনুধাবন করতে পেরে, বাবর চোখ বন্ধ করে ফেলে। “বাছা, আমাদের পথ থেকে সরে দাঁড়াও।”
বাবরের পিঠের নাজুক অংশে শক্ত কিছু একটা আঘাত করে। সহজাত প্রবৃত্তির বশে, সে কোমরে অস্ত্রের জন্য হাত দিয়ে দেখে সেখানে কিছু নেই। সে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখে, সমরকন্দের রাজকীয় পান্না সবুজ রঙের পরিকর পরিহিত দুজন সৈন্য। তাদের যাবার মত পাশে যথেষ্ট জায়গা রয়েছে কিন্তু তারপরেও তাদের একজন তার হাতের বল্লমের বাঁট দিয়ে বাবরকে আবার আঘাত করে, এবার পাঁজরে খোঁচাটা লাগে এবং সে ঘুরতে ঘুরতে দেয়ালে গিয়ে আঘাত করে। সেঁতো হাসি দিয়ে, লোক দুটো সদম্ভে সামনে এগিয়ে যায়।
বাবর, মার্জারের-মত অপলক দৃষ্টিতে পেছন থেকে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে, কিন্তু তারা পেছনে ফিরেও তাকায় না। সৈন্য দু’জন বাঁক ঘুরতে সে তাদের পিছু নেয়। তারা যেদিকে এগিয়ে চলেছে, তাতে সে নিশ্চিত দু’জন কোক সরাইয়ের দিকেই যাচ্ছে। নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে, অনুসরণ শুরু করতে সে আরো বেশি সৈন্যের দেখা পেতে থাকে, তাদের কেউ কেউ শহরের সুনসান, আতঙ্কিত নগরের রাস্তায় টহল দিচ্ছে, কেউবা শহর রক্ষাকারী প্রাচীর থেকে ফিরে আসা প্রতিহারী, সেনা। পূর্বের তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে, কেউ এগিয়ে আসছে বুঝতে পারলে সে। জঞ্জালের আড়ালে কিংবা চৌকাঠের পেছনে লুকিয়ে পড়ে চেষ্টা করে তাদের চোখে আড়ালে থাকতে।
আর তারপরে, একটা সময়ে সে উপরের দিকে তাকালে তৈমূরের দেয়াল পরিবেষ্টিত আস্তানা দেখতে পায় এবং এর ঠিক কেন্দ্রে তৈমূরের সুউচ্চ দূর্গপ্রাসাদ, অতিকায় কোক সরাই। দূর্গের প্রাকার-বেষ্টিত চিহ্নিত স্থান থেকে সবুজ রেশমের নিশান বাতাসে পতপত করে উড়ছে। বাবর ভাবে, ওটা আমার প্রাসাদ। অবচেতন মনে সে তৈমূরের আংটিটা স্পর্শ করে এবং সেটা মুঠোর ভিতরে আঁকড়ে ধরে।
পাথর দিয়ে বাঁধান পথে সৈন্যদের কুচকাওয়াজের শব্দে তার দিবা স্বপ্নের চটকা ভাঙে। একটা দল আস্তানায় ফিরে আসছে। তাদের অনেক পেছনে থেকে বাবর তীক্ষ্ণ চোখে সৈন্যদলটা আর তাদের অস্ত্রশস্ত্র খুঁটিয়ে দেখে। দীর্ঘকায়, মজবুত শরীরের মানুষ, তাদের অবয়বে অপুষ্টির বিন্দুমাত্র চিহ্ন নেই। আর প্রত্যেকের হাবেভাবে যোদ্ধার অভিব্যক্তি: এদের পরণেও সমরকন্দের উজ্জ্বল সবুজ পরিকর। জোর করে জুড়ে বসা উজির তাদের আনুগত্যের জন্য কত মোহর দিয়েছেন?
সহসা পেছন থেকে কেউ একজন তার কাঁধে হাত দেয় এবং আতঙ্কিত বাবর, সব কিছু অগ্রাহ্য করে দৌড় দেবার জন্য প্রস্তুত হয়, কিন্তু হাতটা ইস্পাতের মত কঠিন। অসহায় বাবর ঘুরে দাঁড়ায় তার আক্রমণকারীর মুখোমুখি হতে।
“শুভেচ্ছা নেবেন। আমি আশা করিনি এত শীঘ্রই আপনাকে সমরকন্দে দেখবো। অবরোধ এখনও শেষ হয়নি।”
বাবর ঢোক গিলে। “বাইসিনগার!” তৈমূরের রক্ত রঞ্জিত আংটি ফারগানায় কাছে পৌঁছে দেবার সময়েই তার সাথে বাবরের শেষ দেখা হয়েছিলো।
“আপনি অনর্থক ঝুঁকি নিয়েছেন। গত ত্রিশ মিনিট ধরে আমি আপনাকে অনুসরণ করছি।”
বাবরের মুখ এতটাই শুকিয়ে আছে যে সে কথা বলতে পারে না এবং সে নিচের দিকে তাকায়। সে যা দেখে তা দেখে আবার ঢোক গিলে। বাম হাত দিয়ে বাইসিনগার যদিও তাকে শক্ত করে ধরে রেখেছে, তার ডান হাত শক্ত হয়ে তার পাশে কাঠের দণ্ডের মত ঝুলছে।
বাইসিনগার তার দৃষ্টি অনুসরণ করে। “আপনার চাচার শেষ নির্দেশ পালন করে তৈমূরের আংটি পৌঁছে দেবার শাস্তি। আমি ভাগ্যবান যে এখনও মাথাটা আস্ত আছে, কারণ সমরকন্দের নিরাপত্তার জন্য গ্রান্ড উজিরের আমাকে দরকার আছে।” সে নিজের হৃৎপিণ্ডের গতি প্রশমিত করে এবং চারপাশে তাকিয়ে পালাবার সম্ভাবনা বিচার করতে গেলে হতাশায় দমে যায় যখন দেখে একদল সৈন্য তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। তারা নিশ্চয় অবাক হচ্ছে তাদের দলপতিকে একটা ময়লা পোশাক পরিহিত কৃষক বালকের সাথে কথা বলতে দেখে। সে এখন যদি পালাতে চেষ্টা করে তবে তারা তাকে এক নিমেষে ধরে ফেলবে। “এখন কি করবে?” সে অবশেষে কথা বলে।
“ব্যাপারটা খুব সাধারণ। আমি যদি আপনাকে গ্রান্ড উজিরের কাছে ধরিয়ে দেই তবে আমার কপাল ফিরে যাবে। বিলাসবহুল প্রাসাদে, যেখানে ঝর্ণা থেকে গোলাপজল প্রবাহিত হচ্ছে আর সুন্দরী দাসীরা আমার সব ইচ্ছা পালনের জন্য মুখিয়ে রয়েছে, আমি অনায়াসে নিজেকে অধিষ্ঠিত করতে পারব।” বাইসিনগারের চোখ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। “জীবন অনেক বেশি জটিল। আপনার মরহুম চাচা একজন ভাল শাসক ছিলেন এবং তার শেষ আদেশ যে কোনো মূল্যে পালনের জন্য আমাকে কতৃত্ব দিয়েছিলেন। উজির আমার সম্মান আর অহংকারে আঘাত করেছে। তাকে আমার হাতে তুলে দেবার প্রতিশ্রুতি যদি আপনি আমাকে দেন, তবে আমি আপনার হাতে সমরকন্দ তুলে দেব।”
বাবরের চোখ ঝলসে উঠে। “আমি তোমাকে কথা দিলাম। তৈমূরের রক্ত ধমনীতে বইছে এমন একজন সুলতান তোমাকে কথা দিচ্ছে।”
“আমার সুলতান।” তাদের দিকে যারা তাকিয়ে রয়েছে সবার চোখ এড়িয়ে বোঝা যায় কি যায় না এমন ভঙ্গিতে বাইসিনগার বশ্যতা স্বীকার করে মাথা নত করে।
১.৫ কোক সরাই
০৫. কোক সরাই
সন্ধ্যা নেমে আসতে, ওয়াজির খানকে পাশে নিয়ে বাবর, তার সেনাবাহিনীর তুঙ্গস্পর্শী উত্তেজনায় শিহরিত হতে থাকা একটা দলের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা করে, ভরপেট খেয়ে তরবারিতে শান দিয়ে আর পিঠে চামড়ার তৈরি ঢাল বেঁধে যারা পায়ে হেঁটে প্রধান ছাউনি থেকে রওয়ানা দেবার জন্য প্রস্তুত হয়েছে। প্রথমে তারা তিন রাত আগে নহরের কিনারা ধরে বাবরের অনুসৃত পথ অনুসরণ করবে, কিন্তু তারপরে চাহাররাহা তোরণদ্বার দিয়ে সমরকন্দে প্রবেশের জন্য সংকেতের অপেক্ষায় লুকিয়ে অপেক্ষা করবে, শহরে প্রবেশের এই তোরণদ্বারের পাহারায় নিয়োজিত আছে বাইসিনগার, আর সে বাবরকে সেটা খুলে দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
“আমার সাথী-যোদ্ধারা, আজ রাতে আমরা আমাদের নিয়তির মুখোমুখি হব। এসো আমরা যোদ্ধার আত্মায় বলীয়ান হয়ে হৃদয়ের সবটুকু সাহস জড়ো করি- লড়াই করার শারীরিক সাহস কেবল না, আমি জানি সেটা তোমাদের ভালই আছে, বরং নহর ধরে দ্রুত এগিয়ে গিয়ে আমাদের জন্য আক্রমণের সংকেত না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করার ধৈৰ্য্য যেন তোমাদের থাকে। আমরা প্রত্যেকেই তার সহযোদ্ধার বাঁচা-মরার দায়িত্ব বহন করছি। নিজের অবস্থান থেকে আমাদের ভিতরে একজনও যদি পিছিয়ে আসে- অনিচ্ছাসত্ত্বেও বা অসহিষ্ণুতার জন্য- জেনে রেখো, সে আমাদের সবার সাথেই বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। আমার বয়স কম হতে পারে, আমি জানি আমি আমার ভূমিকা ঠিকমতই পালন করবো। তোমরা কি আমাকে। প্রতিশ্রুতি দেবে যে তোমাদের দায়িত্বও তোমরা ঠিকমত পালন করবে?”
সমস্বরে সবাই একসাথে চিৎকার করে বলে উঠে “হাঁ, সুলতান।”
সময় আর নষ্ট না করে বাবর অগ্রবর্তী দলটাকে যাত্রা করবার আদেশ দেয়। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দুটো সারি তৈরি করে নহরের পাশ দিয়ে তারা কুয়াশার ভিতরে হারিয়ে যায়। পানির যতটা কাছে সম্ভব থেকে, তীরের উইলো গাছে ডালপালা আর ঝোপঝাড়ের সামান্য আড়ালের পুরোটা সদ্ব্যবহার করে তারা এগিয়ে যায়। নিরবে এভাবে পনের মিনিট এগিয়ে যাবার পরে সহসা, সামনের কাতারের সৈন্যদের ভেতরে কেউ সামান্য কেশে উঠে। বাবরের কানে প্রহরী কুকুরের হুঙ্কারের মত জোরাল শোনায় হচিটা। অবশ্য সমরকন্দের দিক থেকে কোনো ধরণের নড়াচড়ার আওয়াজ পাওয়া যায় না। বাবর আবারও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। তারপরেই সৈন্যটা আবার কেশে উঠে, এবার মনে হয় আগের চেয়েও জোরে এবং মনে হয় অনন্তকাল ধরে কাশতে থাকতে যা আদতে এক মিনিটেরও অনেক কম। এখনও মশার ভনভন আওয়াজ ছাড়া আর কিছুর শব্দ পাওয়া যায় না, অন্ধকারে প্রতিটা মানুষের উন্মুক্ত ত্বকে তারা মহানন্দে কামড়াতে শুরু করেছে।
“সুলতান, আমি তাকে ফেরত পাঠাব,” ওয়াজির খান ফিসফিস করে তাকে বলে। “বাঁচলাম।”
মূল ছাউনি থেকে রওয়ানা দেবার দুই ঘণ্টা পরে, বাবর সঁইপ্রস্তুতকারকদের তোরণদ্বারের কাছের সেই স্থানটা চিনতে পারে, যেখান থেকে সমরকন্দে রেকী করার অভিপ্রায়ে গোপন সুড়ঙ্গের উদ্দেশ্যে সে উঠে গিয়েছিল। আজ রাতে অবশ্য সে তার লোকদের নিয়ে নহরের কিনারা ধরে সামনে এগিয়ে যায়। জ্যোৎস্নার আলোয় প্রসন্ন চিত্তে বয়ে যাওয়া স্রোতস্বিনী আরও একবার তার বন্ধুর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, যখন উত্তরদিকে বাঁক নিয়ে সেটা চারহাররাহা তোরণদ্বারের মাত্র দুইশ গজ দূর দিয়ে বয়ে গিয়েছে দেখা যায়।
বাবর আর তার লোকেরা, নহরের কিনারের আগাছা আর উইলোর আড়ালের পুরো সদ্ব্যবহার করে কোনো ধরণের অবাঞ্ছিত শব্দের জন্ম না দিয়ে তোরণদ্বারের খুব কাছাকাছি জায়গায় পৌঁছে যায়। ওয়াজির খানের সাথে সংক্ষিপ্ত পরামর্শ করে নিয়ে, বাবর চাঁদ মাথার উপরে উঠে না আসা পর্যন্ত তার লোকদের ঝোপঝাড়ের আড়ালে আত্মগোপন করে থাকার আদেশ দেয়- তোরণদ্বার খুলে দেবার ব্যাপারে বাইসানগারের সাথে তার সেরকমই কথা হয়েছে।
***
অস্বস্তি দূর করতে বাবর একটু নড়ে উঠে। কিন্তু ব্যাপারটা কঠিন। মশার ঝাঁক তাকে এখনও ছেকে ধরে আছে। আর না চুলকে কামড়ের জায়গা থাকতে পারছে না। আসনপিড়ি হয়ে বসে থাকায় তার কাপড়ে কাদা লেগেছে এবং নড়লেই নিচে থেকে প্যাঁচপেচে শব্দ ভেসে আসে, কিন্তু ঘন আগাছার কারণে জায়গাটা বেশ ভাল আড়াল তৈরি করেছে। সে যদি, ঠিক তার মাথার উপরের চারকোণা আকাশের তারা আর চাঁদের আবর্তন দেখে, ঠিকমত সময় আন্দাজ করে থাকে, তাহলে এখানে থানা নেয়ার পরে নব্বই মিনিট অতিবাহিত হয়েছে।
সে যেখানে গুঁড়ি দিয়ে আত্মগোপন করে রয়েছে, সেখান থেকে অবশ্য আশেপাশের এলাকা আর আকাশের এমন বেশি কিছু অংশ দেখা যায় না, যার ফলে সে চাঁদের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারবে। তাকে নিশ্চিতভাবে জানতে হবে আরও কতক্ষণ তাদের এখানে অপেক্ষা করতে হবে। ওয়াজির খানের পিতৃব্যসুলভ উপদেশ অমান্য করে, যে অন্য আর সবার মত তারও মাথা নিচু করে রেখে, সময়ের হিসাবের ভার তার নিজস্ব আরও অভিজ্ঞ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার উপরে ছেড়ে দেয়া উচিত, বাবর মাথা উঁচু করে। আগাছার আড়াল থেকে ভাল করে দেখার জন্য উঁকি দিতে, ওয়াজির খানের পরামর্শে পরিধান করা ইস্পাতের জালিকা দেয়া জ্যাকেট, যেটা তার দেহের মাপের চেয়ে অনেক বড়, কুঁচকে গিয়ে তার বাহুর নিচে বোগলের কাছে খোঁচা দেয়। অসহিষ্ণুভাবে বাবর টানাহেঁচড়া শুরু করে, আলখাল্লার নিচে হাত দেয় এবং চেষ্টা করে কুঁচকে যাওয়া ইস্পাতের জ্যাকেট সোজা করতে। কিন্তু সে বিষয়টা আরও জটিল করে তোলে।
তার ঠিক মুখের সামনে, আগাছার আড়াল থেকে একজোড়া বুনো হাঁস আর্তস্বরে ডানা ঝাঁপটে উঠে। বর্ম ঠিক করতে গিয়ে তার মাত্রাতিরিক্ত নড়াচড়ায় বোধহয় বেচারারা আতঙ্কিত হয়ে উঠেছে। বিব্রতভঙ্গিতে সে আবার মাথা নিচু করে, কিন্তু আগাছার আড়ালে মাথা নিচু করতে সে তার কয়েক ফিট দূরে পায়ের আওয়াজ শোনে যা দ্রুত কাছে এগিয়ে আসছে। যদিও যুক্তি তাকে বলে যে সেটা তারই কোনো লোকের পায়ের আওয়াজ, কিন্তু সহজাত প্রবৃত্তির বশে সে তার মরহুম আব্বাজানের ঈগলের মাথার বাঁটযুক্ত আলমগীর আঁকড়ে ধরে। লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের জীবন বাঁচাতে লড়তে প্রস্তুত। শব্দটা আরও বাড়তে এবার ওয়াজির খানের কাদামাখা মুখ আগাছার আড়াল থেকে উঁকি দেয়, পেটের উপরে ভর দিয়ে কনুইয়ের সাহায্যে অনেকটা বাইম মাছের মত এঁকেবেঁকে তার দিকে এগিয়ে আসছে। বাবর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে এবং সেই সাথে কোনো একটা অদ্ভুত কারণে তার মনে হয় যে পিঠে ঢাল আটকানো এবং প্রায় উপুড় হয়ে শুয়ে থাকার কারণে ওয়াজির খানকে বেঢপ আকৃতির কচ্ছপের মত দেখাচ্ছে।
“সুলতান, সময় হয়েছে। আমি কি সংকেত দিতে আদেশ দেব।”
কোনমতে হাসি চেপে বাবর মাথা নাড়ে।
ওয়াজির খান যেভাবে এসেছিল সেভাবেই মাথা নিচু করে পিছলে পেছনে সরে যায়। মুহূর্ত পরে, তার আদেশে, রাতের নির্মেঘ আকাশে একটা জ্বলন্ত তীর বিশাল বৃত্তচাপ তৈরি করে আকাশে উঠে আসে, ধূমকেতুর মত জ্বলছে তার জ্বলন্ত পুচ্ছ। আগাছার ভিতরে এবার বাবর উঠে দাঁড়ালে তার পেট গুলিয়ে উঠে এবং উত্তেজনা আর আশঙ্কায় তার পা কাঁপছে টের পায়। তার লোকেরা তার চারপাশে, আড়াল ছেড়ে একে একে উঠে দাঁড়াতে থাকে।
ওয়াজির খানও তার পাশে এসে দাঁড়ায়। “আমরা শীঘ্রই জানতে পারব বাইসিনগার এক কথার মানুষ কিনা।”
“সে তার কথা রাখবে।” বাবর সে ব্যাপারে নিশ্চিত কিন্তু পোড় খাওয়া ওয়াজির খানের মনের সংশয় দূর হয় না, উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেন যে তরুণ অনভিজ্ঞ বাবর হয়ত প্রতারিত হয়েছেন।
বাবর আর ওয়াজির খানকে সামনে রেখে, তাদের যোদ্ধারা আগাছার আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে এবং আক্রমণাত্মক বিন্যাসে সজ্জিত হয় আর জলাভূমির উপর দিয়ে দ্রুত চারহাররাহা তোরণদ্বারের দিকে এগিয়ে যায়, তাদের পায়ের চামড়ার নাগরা মাঝেমধ্যেই কাদায় আটকে যায় এবং সবাই শান্ত ভঙ্গিতে শ্বাস নেয়। তারা আরও এগিয়ে যেতে বাবর দেখে সুউচ্চ সবুজাভ-নীল তোরণ বা পুঁইপ্রস্তুতকারকদের তোরণের তুলনায় সেটা অনেক ছোট। তোরণদ্বারের দু’পাশে শক্তপোক্ত পাথরের যেনতেনভাবে তৈরি করা বুরুজ নির্মানের সময় দর্শনীয়তার চেয়ে উদ্দেশ্যের বিষয়ে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। এবং বাবর এখান থেকেই তোরণদ্বারের ভারী লোহার গ্রিল দেখতে পায়, যা শহরে প্রবেশের সংকীর্ণ গলিপথটা সুরক্ষিত করে রেখেছে। তার মনে হয় ফোকলা দাঁতের কেউ তার দিকে মুখব্যাদান করে হাসছে।
সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়ে কিনা দেখতে বাবর চোখ পিটপিট করে চারপাশে তাকালে বুঝতে পারে কোথাও কিছু নড়ছে না- এমন কি তোরণদ্বারের উপরের প্রকোষ্ঠ যেখান থেকে বাইসানগার কপিকল দিয়ে গ্রিল তোলার আদেশ দেবে সেখানেও কোনো আলো জ্বলছে না। কোনো কিছু না ঘটলে সে কি করবে? হয়ত পুরোটাই একটা নির্মম ছলনা। বা এটাও হতে পারে পুরো পরিকল্পনাই ফাঁস হয়ে গিয়েছে আর বাইসানগার এখন কোনো অন্ধকার কুঠরিতে নিপীড়ন সহ্য করতে না পেরে তাদের পায়তারা যন্ত্রণাক্লিষ্ট কণ্ঠে বয়ান করছে।
বাবর নিজেকে শান্ত করে চিন্তা করতে থাকে। তার সামনে এখন কি পথ খোলা রয়েছে? কিন্তু মনে মনে সে জানে তার সামনে এই একটাই পথ রয়েছে। তাদের এগিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। এমন কি এখন, জ্বলন্ত তীরের বাঁকান গতিপথের মাধ্যমে যা সূচীত হয়েছে, বাছাই করা চার’শ যোদ্ধার দল ইতিমধ্যে তার তিন রাত আগের যাত্রাপথ পুনরায় অনুসরণ করে স্যাঁতস্যাঁতে সংকীর্ণ সুড়ঙ্গে নেমেছে, যা তাদের শহরের ভেতরে নিয়ে যাবে। সে তাদের পরিত্যাগ করবে না। যাই ঘটুক না কেন, সে তার লোকদের নেতৃত্ব দিয়ে তোরণ আক্রমণ করবেই।
তার মন যখন এসব বিক্ষিপ্ত ভাবনার দোলাচালে আচ্ছন্ন, বাবর তোরণদ্বারের ডান পাশের দেয়ালের উপরে হাতে মশাল ধরা একটা ছায়ামূর্তি দেখতে পায়। যেটা ইচ্ছাকৃতভাবে সে এপাশওপাশ দোলাতে থাকে। একই সাথে বাবর আশেপাশে কোথাও বিশাল একটা পুলির ঘুরতে শুরু করার কর্কশ খরখর আওয়াজ শুনতে পায়। লোহার গ্রীলটা প্রথমে কেঁপে উঠে, তারপরে অনিচ্ছাসত্ত্বেও যেন উপরে উঠতে শুরু করে। ওয়াজির খানের দিকে তাকিয়ে সে বিজয়ীর একটা হাসি দেয়, তারপরে আক্রমণের জন্য পূর্ব নির্ধারিত সংকেত চাপা স্বরে বলে উঠে। তার লোকেরা সংকেতটা পুনরাবৃত্তি করতে সে একটা চাপা গমগমে আওয়াজ শুনতে পায়। সংকেতটার কোমল আবেদন, থিতিয়ে আসতে নিজের ভেতরে সে একটা উদ্দীপনা টের পায় যা তাকে সামনে এগিয়ে যেতে বাধ্য করে।
ডান হাতে তার মরহুম আব্বাজানের তরবারি, বাম হাতে খঞ্জর নিয়ে বাবর তোরণদ্বারের বাকি পথটুকু দৌড়ে অতিক্রম করে। লোহার গ্রীল ইতিমধ্যে এক তৃতীয়াংশ উঠে এসেছে। তার লোকেরা তাকে ঘিরে ধরতে গ্রীলের নিচের তীক্ষ্ণ শলাকার খোঁচা থেকে বাঁচতে সে নিজেকে গুটিয়ে একটা বলের মত করে এবং নীচ দিয়ে গড়িয়ে আসে। কুণ্ডলাকৃতি থেকে মুক্ত হয়ে সে লাফিয়ে পায়ের উপরে উঠে দাঁড়ায় এবং অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকে, বাতাস কেটে মৃত্যু মুখে নিয়ে ছুটে আসা তীরের অমোঘ শব্দ বা অন্ধাকারে হুল্লোড় তুলে ডিগবাজি দিয়ে ধেয়ে আসা কুঠারের সামান্যতম আভাসের জন্য তার প্রতিটা ইন্দ্রিয় টানটান হয়ে রয়েছে। কিন্তু তোরণদ্বারের উপরের প্রকোষ্ঠ থেকে পাথরের সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত নেমে আসা পায়ের শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা যায় না। বাইসানগার এগিয়ে আসে, মুখের অভিব্যক্তি ভাবলেশহীন। “স্বাগতম। আমি আমার কথা রেখেছি।” সে বাবরের সামনে এসে নতজানু হয়। “আমাদের দ্রুত যা করার করতে হবে। গুপ্তচরের দল সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে- এমন কি এখনও হয়ত কেউ আমাদের দেখছে এবং যেকোন মুহূর্তে পাগলাঘন্টি বেজে উঠতে পারে। আমার বিশজন লোক এই তোরণের পাহারায় রয়েছে আর বাকিরা কোক সরাইয়ের নিকটে অপেক্ষা করছে।” শহরের দিকে এগিয়ে যাওয়া একটা অন্ধকার গলির দিকে ইশারা করে সে দেখায়। “আমার সঙ্গে আসুন।”
বাইসানগারের কথা শেষ হতে, সামনে, নগর প্রাকারের অভ্যন্তরে কোক সরাইয়ের ছাদে অন্ধকার বিদীর্ণ করে সহসা কমলা রঙের আলোর আভা দেখা যায়- মশাল। তাদের উপস্থিতির খবর সেনাছাউনিতে পৌঁছে গেছে। শিঙার গগনবিদারী আর্তনাদ এবং কর্কশ স্বরে সেনাপতিদের নিজ নিজ লোককে ডাকার শব্দ ভেসে আসতে বোঝা যায় যে বিপক্ষকে চমকে দেবার সুযোগ তারা হারিয়েছে। বাবর ইতস্তত করে না। তরবারি উপরে তুলে গায়ের পুরোটা শক্তি ব্যবহার করে সে তার লোকদের রণহুঙ্কার দেয়- “ফারগানা।” তার কানের পর্দা দপদপ করে, সে সামনের দিকে। ধেয়ে যায়।
গলিটার দুপাশে লম্বা, উঁচু, মাটির ইটের সারিবদ্ধ বাসা যার দরজা নিশ্চিতভাবেই ভেতর থেকে বন্ধ। বাবর এক মুহূর্তের জন্য দরজাগুলোর পেছনে জড়সড় হয়ে বসবাসকারী পরিবারগুলোর কথা ভাবে, যারা দোয়া করছে যেন এই ঝড় শীঘ্রই শেষ হয়। তাদের জানবার কথা না যে সাধারণ নাগরিকদের হত্যা বা লুট করার উপরে সে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। তার শত্রুদের অবশ্যই উপযুক্ত মূল্য দিতে হবে, নিরীহ লোকদের রক্তে স্নান করে সে সমরকন্দে তার শাসনকাল শুরু করতে চায় না।
“সুলতান, এই পথে।” বাইসানগার বাবরের বাহু আঁকড়ে ধরে এবং হেঁচকা টানে বামদিকে বাঁক নেয়া একটা সরু গলিতে তাকে নিয়ে আসে। হঠাৎ ভারসাম্য হারিয়ে ফেলতে বাবর টলে উঠে এবং আরেকটু হলেই সে আছাড় খেতো। মুহূর্তের জন্য সে তার পেছনে ওয়াজির খানের দিকে তাকায়। গলিটার দুপাশে উঁচু দেয়াল আর ভীষণ সংকীর্ণ। পাশাপাশি একজন বড়জোর দুজন লোক এগিয়ে যেতে পারবে- অতর্কিত আক্রমণের জন্য আদর্শ স্থান। গাঢ় অন্ধকারের ওপাশে তাদের জন্য কি অপেক্ষা করছে?
“দূর্গে পৌঁছাবার এটা সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত পথ।” বাইসানগারের কণ্ঠ তীক্ষ্ণ আর তাতে আর্তি ঝরে পড়ে।
বাবর চোখ সরু করে তার দিকে তাকায়। সে জানে যে তার বয়স কম হওয়া সত্ত্বেও তার লোকেরা এখন তার মাঝে একজন নেতাকে দেখতে চাইছে। এখন ইতস্তত করার কোনো অবকাশ নেই, যখন শত্রুর কণ্ঠস্বর প্রতি মুহূর্তে তাদের দিকে। এগিয়ে আসছে। সে বাইসানগারকে বিশ্বাস করে, যা তাকে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। ওয়াজির খানকে পাশে নিয়ে সে তার লোকদের বলে অনুসরণ করতে এবং ঘুরে দাঁড়িয়ে বাইসানগারের পেছন পেছন গলিতে প্রবেশ করে। বাবর বিস্মিত হয় যে শহর দখলের লড়াই শুরু হতে তার ভিতরের ভয় কোথায় যেন উবে গেছে এখন সেখানে কেবল উত্তেজিত উল্লাস বিরাজ করছে। সব যুদ্ধেই কি একই অনুভূতি হয়? সহসা, পূর্বদিকে খানিকটা দূর থেকে, সে একটা জোরাল হুঙ্কার ভেসে আসতে। তার লোকেরা নিশ্চয়ই সুড়ঙ্গ থেকে বের হয়ে এসেছে এবং এখন শহরের কেন্দ্রস্থলের দিকে ছুটে যাচ্ছে। তারা গ্রান্ড উজিরের অনুগত সেনাবাহিনীকে ব্যস্ত রাখবে।
গলিটা এবার ডান দিকে আরেকটা তীক্ষ্ণ বাঁক নিয়েছে, এবং তারপরে সহসাই শেষ হয়েছে। চারপাশে আধো-অন্ধকারে তাকিয়ে বাবর দেখে সে একটা প্রাঙ্গনের মত জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছে, যার একদিকে, ঠিক তার উল্টোপাশে, তৈমূরের দূর্গপ্রাসাদের উঁচু দেয়াল। গতবারের অভিযানের স্মৃতি আর তার পর্যবেক্ষণ করা পরিকল্পনার কথা স্মরণ করে, সে বুঝতে পারে তারা নিশ্চয়ই দক্ষিণ দিকে এসে পৌঁছেছে। হ্যাঁ, কয়েক’শ গজ সামনে দেয়ালের ভিতরে, পূর্বদিকে বিস্তৃত কোক সরাইয়ের তীক্ষ্ণ দাঁতের মত প্রাচীরের বেষ্টনী দেয়া দূর্গপ্রাসাদ সে দেখতে পায়। বাইসানগার তাদের ভালই পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছে। আরও খুশির কথা বাবর ঠিক তার মাথার উপরের দেয়ালে কোনো প্রহরী দেখতে পায় না। সম্ভবত তারা কল্পনাও করেনি শত্রু এখান দিয়ে বেয়ে উপরে উঠতে পারে।
যাই হোক, বাইসানগার আর ওয়াজির খানের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে বাবর দ্রুত আঙ্গিনাটা অতিক্রম করে এবং দূর্গপ্রাসাদের দেয়ালে গায়ে নিজেকে মিশিয়ে দিয়ে দাঁড়ায়। গলিপথে তার লোকেরা এসে উপস্থিত হলে সে ইশারায় তাদেরও একইভাবে দাঁড়াতে বলে। কোনো ধরণের দ্বিধাদ্বন্দ্বে না ভুগে তারা তার আদেশ পালন করে। বাইসানগার নিচু স্বরে কিছু একটা বলতে, কালো আলখাল্লা পরিহিত, গম্বুজাকৃতি শিরোস্ত্রাণ মাথায় দেয়া ছায়ামূর্তির দল আঙ্গিনার পশ্চিমদিকের কোণায় অবস্থিত ভাপ উঠতে থাকা আবর্জনার স্তূপের আড়াল ছেড়ে বের হয়ে আসে। বাইসানগারের সৈন্যদল। তারা এসে নিরবে তাদের সেনাপতিকে ঘিরে দাঁড়ায়।
“সুলতান, সামনের বাঁকের মুখে একটা বন্ধ করে দেয়া তোরণদ্বারের কাছে দূর্গপ্রাসাদের দেয়ালের উচ্চতা সবচেয়ে কম,” বাইসানগার ফিসফিস করে বলে। “আর আমরা সেখান দিয়েই ভিতরে প্রবেশ করবো। আমার লোকেরা মই নিয়ে এসেছে এবং আমি আমার তীরন্দাজদের বলবো নিরাপত্তার আড়াল দিতে।” বাবর আর ওয়াজির খান সম্মতি জানিয়ে মাথা নাড়ে। দেয়ালের গায়ের সাথে প্রায় মিশে গিয়ে এবং বাইসানগারের নেতৃত্বে আক্রমণকারী দলটা দূর্গপ্রাসাদের দেয়ালের কোণার দিকে আস্তে আস্তে এগিয়ে যায়। সতর্কতার সাথে বাইসানগার একবার চারপাশে তাকিয়ে দেখে এবং তারপরে পেছনে সরে এসে বাবর আর ওয়াজির খানকে ইঙ্গিত করে দেখতে।
দ্রুত একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে তারা সবাই নিশ্চিত হয় যে সবকিছু ঠিক আছে। তোরণদ্বারটা এখান থেকে মাত্র ত্রিশ গজ দূরে। সহসা এই উত্তেজনা আর উৎকণ্ঠা বাবরের কাছে অসহ্য মনে হতে থাকে। ওয়াজির খানের আগলে রাখা বাহুর বেষ্টনী থেকে এক ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে, সে চিৎকার করে তার লোকদের অনুসরণ করতে বলে, তোরণদ্বার লক্ষ্য করে দৌড়াতে শুরু করে। দেয়ালের আড়ালে লুকিয়ে থাকার কথা সে বেমালুম ভুলে যায় এবং সাথে সাথে সে তীরের বাতাস কেটে এগিয়ে যাবার হুশ শব্দ শুনতে পায় তারপরেই আরেকটা, কোনো। সন্দেহ নেই তার মাতালের মত চিৎকার শুনে তীরন্দাজের দল দূর্গের ছাদের। বেষ্টনীর পিছনে এসে হাজির হয়েছে। একটা লম্বা শরযষ্টি বিশিষ্ট তীর তার গালে আঁচড় কেটে যায় পেছনের ভূমিতে গেঁথে যাবার পূর্বে। তীব্র জ্বালার প্রতি সে ভ্রূক্ষেপ করে না। মুহূর্তের উল্লাস ছাড়া আর কিছুই সে অনুভব করে না। সে তোরণদ্বারের দিকে দৌড়ে যায়। কোনমতে অক্ষত দেহে সে সেখানে পৌঁছে, যে পাথর দিয়ে তোরণদ্বার আটকানো সেটার সাথে নিজেকে প্রায় মিশিয়ে দেয়, আশা করে মাথার উপরে ঝুলন্ত সরদল তাকে কিছুটা হলেও আড়াল দেবে। চারপাশে তাকিয়ে সে তার পাশের পাথরের চৌকাঠে একটা গুটিসুটি মেরে থাকা বাঘ খোদাই করা দেখতে পায়, সমরকন্দের শাহী প্রতীক, কান দুটো মাথার সাথে লাগানো আর মুখটা ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে বাঁকানো রয়েছে।
বাইসানগারের তীরন্দাজের দল এখন অবস্থান নিয়ে, দেয়ালের উপরে দাঁড়িয়ে থাকা নিরাপত্তা রক্ষীদের সমুচিত জবাব দিয়ে চলেছে। বাবর টের পায় কপালের উপর থেকে উষ্ণ তরলের একটা ধারা গড়িয়ে চোখে এসে পড়ছে। আঙ্গুল দিয়ে স্পর্শ করে সে টের পায় জিনিসটা রক্ত কিন্তু তার নিজের না। উপরের দিকে তাকিয়ে সে দেখে গলায় শরবিদ্ধ এক সৈন্য দেয়ালের উপরে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। হাত উঁচু করে সে লোকটার শরবিদ্ধ জায়গাটা স্পর্শ করতে, সে তাল হারিয়ে ফেলে। মুহূর্ত পরে, বাবরের পায়ের কাছে একটা ভোতা শব্দ করে লোকটার দেহ আছড়ে পড়ে। রক্ত আর শ্লেষ্ম ছিটকে, হতভাগ্য লোকটা কুঁকড়ে গিয়ে কিছুক্ষণ ছটফট করে এবং তারপরে ক্রমশ ছড়িয়ে পড়া কালো রক্তের মাঝে তার দেহটা নিথর হয়ে যায়।
বাইসানগারের লোকের এখন দেয়ালের গায়ে লম্বা লম্বা কাঠের মই স্থাপন করছে। কাঠের ধাপের দু’পাশে চামড়ার ফালি আটকে মইগুলো তৈরি করা হয়েছে বটে কিন্তু দারুণ কার্যকর মইগুলো। তাদের লোকেরা ইতিমধ্যে মই বেয়ে উঠতে শুরু করেছে, তারা একহাতে কাঠের ডাসা ধরে অন্য হাতে মাথার উপরে ঢাল ধরে রেখেছে উপর থেকে ছোঁড়া তীর লক্ষ্যভ্রষ্ট করতে।
বাবরের হৃৎপিণ্ড এখনও দুরন্ত গতিতে স্পন্দিত হচ্ছে এবং সে দ্রুত কিছু একটা করতে মরিয়া হয়ে উঠে। সে চারপাশে তাকায় উপরে উঠার অন্য কোনো পথ খোঁজে। তোরণদ্বার ভাঙার কোনো সুযোগ নেই। প্রথম দৃষ্টিতে, পাথরের দেয়াল। মসৃণ দেখায়, প্রতিটা পাথর নিখুঁতভাবে জোড়া দেয়া। ফারগানার বুনো পাহাড় আর দরীতে সে খামোখাই বেড়ে উঠেনি, বাবর নিজেই নিজেকে বলে। ভাল করে তাকাতে সে পাথরের দেয়ালে অনেক ফাটল আর চিড় দেখতে পায় যেখানে হাত। আর পা দিয়ে তার মত হাল্কা পাতলা একজন বেয়ে উঠতে পারবে। তার মরহুম। আব্বাজানের মূল্যবান তরবারি পিঠে ঝুলিয়ে, বাবর গভীর একটা শ্বাস নেয়। শেষবারের মত চারপাশে তাকাতে সে দেখে ওয়াজির খান তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তাকে রীতিমত উদ্বিগ্ন দেখায়। বাবর দ্রুত ঘুরে দাঁড়ায় এবং দেয়ালের পাদদেশ দিয়ে দৌড়ে যাবার সময়ে তাকে লক্ষ্য করে ছোঁড়া তীর ফাঁকি দিয়ে মইয়ের কাছ থেকে দূরে সরে যায়।
সে দেয়াল বেয়ে উঠতে শুরু করে, তার হাত দেয়ালের উপরে হাতড়াতে থাকে, সামান্য বের হয়ে থাকা পাথরের কোণা, এবং চুনের আস্তর খসে পড়ার কারণে দুই পাথরের মাঝে উন্মুক্ত হয়ে উঠা ফাঁক কিংবা রাজমিস্ত্রীদের বাটালির ঘাইয়ের ফলে সৃষ্ট দাগ খুঁজে- যেখানে সে বুড়ো আঙ্গুল কিংবা হাত বা পায়ের কিনারা রাখতে পারে। সে তার ঊর্ধ্বমুখী গতি অব্যাহত রাখে নতুবা সে পড়ে যাবে, এবং প্রতিমুহূর্তে তার হাত নতুন অবলম্বন খুঁজতে থাকে। তৈমূরের রাজমিস্ত্রীরা অসাধারণ কাজ করেছে- হাতের কাজের দক্ষতার কারণেই কি তিনি তাদের সমরকন্দে নিয়ে আসেননি? বড্ড বেশি দক্ষ সম্ভবত, বাবরের ভাবনা সহসা মাটি থেকে বিশ ফিট উপরে একটা ঝকি খায়, যখন তার পা কোনো অবলম্বন ছাড়া শূন্যে ঝুলতে থাকে এবং সে টের পায় কেবল হাতের উপরে ঝুলে থাকার কারণে তার নখ উপরে আসতে চাইছে।
পাথরের মত শুষ্ক আর ধূলোময় মুখে, বাবর কোনো মতে ঝুলে থাকতে চেষ্টা করে, পাগলের মত পা দিয়ে ডানে বামে খুঁজতে থাকে কোনো অবলম্বন পাওয়া যায় কিনা, কিন্তু কেবল মসৃণ পাথরের দেয়ালে তার পা ঘষা খায়। দেহের পুরো ওজন নেবার কারণে তার বাহুদ্বয় প্রতিবাদ জানাতে শুরু করে। তারপরে, যখন তার মনে হতে শুরু করে যে হাত ছেড়ে দিয়ে নিচে গড়িয়ে পড়াই শ্রেয়, ঠিক তখনই তার ডান পা নরম কিছু একটায় গিয়ে পড়ে শুকিয়ে বিবর্ণ হয়ে যাওয়া ঘাসের একটা গোছা, পাথরের ফাটলের গভীরে যার বীজ প্রোথিত। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে, বাবর এবার তার ডান পা গোছাটার উপরে রেখে দেখে সেটা ভার নিতে পারে কিনা এবং সেটা তার দেহের ভর কিছুটা সামাল দিলে তার হাতের অসহ্য ব্যাথা কমে আসে।
এক নিমেষের জন্য সে তার চোখ বন্ধ করে। নিজেকে তার ক্ষুদ্র, অরক্ষিত, অসহায়, একটা কীটের মত মনে হয়। কিন্তু সে অন্তত এক মুহূর্তের জন্য বিশ্রাম নিতে পারে। পুনরায় চোখ খুলে, মাথার অবিন্যস্ত চুলের মাঝ দিয়ে তাকিয়ে সে দেখে দেয়ালের শীর্ষদেশ বাড়াবাড়ি ধরণের কাছে সম্ভবত মাথার সাত কি আট ফিট উপরে। সতর্কতার সাথে, অনুসন্ধানী ভঙ্গিতে সে ডান হাত উপরে বাড়িয়ে দেয় এবং মাথার দুই ফিট উপরে বের হয়ে থাকা একটা পাথরের খাঁজ খুঁজে পেতে সে স্বস্তিতে আরেকটু হলে জোরে হেসে উঠত। তারপরে, ডান পা ঘাসের গোছর উপরে রেখে যা তার প্রাণ বাঁচিয়েছে, সে বাম পা ভাঁজ করে এবং উপরের দিকে সেটা রাখার জায়গা পাওয়া যায় কিনা দেখে। পুনরায় সে আরেকটা খাজ খুঁজে পায়- খুব বড় কোনো ফাটল না- সংকীর্ণ একটা খাঁজ, পাথরের গায়ে একটা আড়াআড়ি ফাটল, কিন্তু সেটাই যথেষ্ট। শেষ একটা হেঁচকা টানে, দেয়ালের শীর্ষভাগে সে নিজেকে উপরে টেনে তোলে এবং কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করতে থাকে যেন তরবারির ফলা তার আঙ্গুলের উপরে নেমে না আসে।
ছাদের কিনারের প্যারাপেটের উপর দিয়ে টপকে সে নিজেকে দেয়ালের উপরের চওড়া অংশে নিয়ে আসে যেখানের পাথর প্রহরীদের পায়ের ঘষায় মসৃণ হয়ে গিয়েছে। বাবর চারপাশে তাকিয়ে অবাক হয়ে দেখে যে প্রথম যারা উপরে উঠে এসেছে সে তাদের অন্যতম। সে ভেবেছিল তার অনেক সময় লেগেছে কিন্তু কিছুক্ষণের ভিতরে ওয়াজির খানের নেতৃত্বে তার আরও লোক এসে হাজির হয় এবং দড়ির মই বেয়ে উঠে আসবার কারণে সবাই হাঁসফাঁস করছে।
দেয়ালের নিরাপত্তা রক্ষায় যারা নিয়োজিত ছিল, বোধহয় পালিয়েছে। একপা পিছিয়ে এসে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বাবর পালিয়ে যাওয়া কোনো সৈন্যের একপাশে ফেলে যাওয়া একটা রূপা দিয়ে বাধান ঢালের সাথে হোঁচট খায়। সে ঝুঁকে ঢালটা তুলতে যাবে। কিন্তু পেছন থেকে ভেসে আসা একটা শব্দ শুনে সে ঘুরে তাকায়। দেয়ালের ভিতরের দিকে অবস্থিত একটা আঙ্গিনা থেকে উপরে উঠে আসা একটা সংকীর্ণ সিঁড়ি দিয়ে সমরকন্দের অপেক্ষাকৃত সাহসী সৈনিকের একটা দল হুড়মুড় করে উপরে উঠে আসছে। বাবর, তাদের উজ্জ্বল সবুজ রঙের পরিকর আর বর্শার মাথায় উড়তে থাকা সবুজ নিশান দেখে ধারণা করে, গ্রান্ড উজিরের ব্যক্তিগত দেহরক্ষীর দল। একটা হুঙ্কার দিয়ে, বাবর তাদের দিকে ধেয়ে যায়, জানে যে ওয়াজির খান আর তার লোকেরা তাকে অনুসরণ করবে এবং শপথ, হুঙ্কার, আর এলোপাথাড়ি তরবারি ধারালো যোতের ভিতরে নিজেকে আবিষ্কার করে। দেয়ালের উপরের অংশটা যদিও বেশ চওড়া- সম্ভবত দশ ফিট প্রশস্ত- দু’পাশ থেকে শীঘ্রই টপাটপ মানুষ নিচে আছড়ে পড়তে থাকে। কেউ আহত হয়ে নিচে পড়ে, কাউকে আবার অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী প্রতিপক্ষ ঠেলেই ফেলে দেয়। ঘামের উষ্ণ, নোতা গন্ধ তার নাক প্রায় বন্ধ করে দেয়। সে এরপরে যতদিন বেঁচে থাকবে তার স্মৃতিতে এটা যুদ্ধের ঘ্রাণ হিসাবে বিরাজ করবে।
কাঁচাপাকা লম্বা দাড়ির এক দীর্ঘকায় যোদ্ধা ভীড়ের ভিতরে বাবরকে আলাদা করে, তার হাল্কা দেহকাঠামো আর অপেক্ষাকৃত তরুণ বয়স লক্ষ্য করে লোকটার মাংসল চোখেমুখে ক্রুদ্ধ বিদ্রুপের হাসি খেলে যায়। ইঁদুর শিকারের আগে বাবর বিড়ালের চোখে মুখে এমন ভাব দেখেছে এবং লোকটার অবজ্ঞা বাবরকে ক্ষেপিয়ে তোলে। ওয়াজির খান অনুরোধ করেছিলে যে বাবর যেন এমন কিছু পরিধান না করে যাতে তাকে ফারগানার সুলতান হিসাবে সনাক্ত করা না যায় কিন্তু এই হোঁকা উদ্ধত শুয়োরটাকে সে আজ তার জাত চিনিয়ে দেবে।
“বুড়ো খোকা তোমার বাসায় থাকা উচিত ছিল, আগুনের পাশে বসে থেকে তোমার ভেজা পাজামা বদলে দেয়ার জন্য পরিচারককে ডাকতে।”
এক মুহূর্তের জন্য উদ্ধত যোদ্ধাটা হতবাক হয়ে যায় কিন্তু তারপরে বাবর কি বলছে সেটা হৃদয়ঙ্গম করতে পেরে তার অভিব্যক্তি ক্রোধে ফেটে পড়ে। সে তার চর্মসদৃশ শক্ত হাতে বর্শাটা ধরে বাবরের দিকে এগিয়ে আসে। “পুঁচকে ইঁদুরের ছানা, আমি যদি তোমাকে পিষে না দিয়েছি।”এত দ্রুত সবকিছু ঘটে যে বাবর কোনো প্রতিরোধই করতে পারে না, সে বর্শার মুখটা ঘুরিয়ে নিয়ে ভোঁতা দিকটা বাবরের পেটে বেমক্কা একটা গুতো দেয়।
বাবর টের পায় ধাক্কার চোটে তার পা ভারসাম্য হারিয়েছে আর সে পিছনে ছিটকে পড়েছে। ডুবন্ত মানুষের মত সে হাত নাড়ে, ভয় পায় যে আঘাতের প্রাবল্য তাকে দেয়ালের নিচে ছিটকে ফেলবে। কিন্তু সে টের পায় তার মাথা পেছন দিকে হেচকা টানে নিচু প্যারাপেটের গায়ে বুকে যায়। ক্ষণিকের জন্য তার চারপাশের জগত আলোর ফুলঝুরিতে ভরে উঠে, খানিক আগে নহরের ধারে আগাছার আড়াল থেকে যে বিশুদ্ধ রূপালি নক্ষত্রের দীপ্তির দিকে তাকিয়ে ছিল, সে রকম না অনেকটা উজ্জ্বল এবড়োথেবড়ো আকৃতির একটা জটলা মত যা পিচ্ছিল রক্তের মত লালে জারিত। তার মুখ লবণাক্ত পানিতে ভরে উঠতে সহজাত প্রবৃত্তির বশে সে সেটা উগরে দেয়। তারপরেও সে ঠিকমত শ্বাস নিতে পারে না- আঘাতটা তার বুকের সব বাতাস বের করে দিয়েছে।
দাড়িঅলা লোকটা তার দিকে আবার ধেয়ে আসে। “খোকা ওটা কেবল শুরু ছিল। ঐ বিদ্রুপের কারণে মারা যাবার আগে তোমার কপালে আরো ভোগান্তি আছে, সে থুতু ফেলে এবং একই সাথে বর্শাটা দিয়ে বাবরের নিতম্বে খোঁচা দিতে চায়। একেবারে সময়মত বাবর গড়িয়ে পাশে সরে গিয়ে আঘাতটা এড়ায় এবং বর্শার ফলা পাথরের মেঝেতে ধাক্কা খেয়ে আগুনের ফুলকি ছোটায়। তার প্রতিপক্ষ গালবকে। দশাসই ওজন হওয়া সত্ত্বেও বিস্ময়করভাবে লোকটার চলাফেরা অনেক দ্রুত। বিশাল ভালুকের মত সে বাবরের দিকে স্থির প্রতিজ্ঞ ভঙ্গিতে ধেয়ে আসে, সে অর্ধেক ঝুঁকে এক হাতে প্রচণ্ড ব্যাথা করতে থাকা পেট আঁকড়ে ধরে দম ফিরে পেতে আপ্রাণ চেষ্টা করে। কিন্তু অন্য হাতে ঠিকই তরবারিটা ধরা রয়েছে। তার নিঃশ্বাস সবে আগের চেয়ে স্বাভাবিক হয়ে এসেছে এবং সে মাত্র সুস্থির বোধ করতে শুরু করেছে।
“তা ইঁদুরের ছানা- শীঘ্রই তুমি তোমার দলের বাকি ধাড়ি ইঁদুরগুলোর সাথে নিচের গোবরের গাদায় গড়াগড়ি খাবে,” লোকটা কথা বলার ফাঁকে বর্শার ফলার তীক্ষ্ণ দিকটা সরাসরি বাবরের মুখের দিকে নিশানা করে। বাবর হীরক দ্যুতিময় শীতল আভাযুক্ত ফলার দিকে সম্মোহিতের ন্যায় তাকিয়ে থাকে। এক মুহূর্তের জন্য তার নিজেকে পক্ষাঘাতগ্রস্থ মনে হয় কোনো ধরণের প্রতিক্রিয়া দেখাতে অক্ষম, কিন্তু দানবটা তার দিকে বর্শার ফলা দিয়ে আঘাত করেছে, সহজাত প্রবৃত্তির বলে সে ঠিকই বুঝতে পারে তার কি করতে হবে। নিজের সবটুকু ক্ষিপ্রতা আর গতি জড়ো করে সে মাটিতে শুয়ে পড়ে এবং তার আততায়ীর নাগালের কাছ থেকে সরে গিয়ে আগুয়ান বর্শার নিচে দিয়ে তার দিকে গড়িয়ে আসে। তার দেহ দানবটার পায়ে এসে ধাক্কা খেতে সে তার লম্বা ফলাযুক্ত খঞ্জর দিয়ে বদমায়েশটার একটা পায়ের হাঁটুর পেছনের মাংসপেশী দ্বিখণ্ডিত করে দেয়। একটা বিকট আর্তনাদ করে, তার প্রতিপক্ষ একপাশে কাত হয়ে পড়ে যায় এবং পায়ের ক্ষতস্থান থেকে রক্ত ফিনকি দিয়ে বের হয়। বাবর টলোমলো পায়ে উঠে দাঁড়ায় এবং আবার আঘাত করে। এবার সে লোকটার বাম বোগলের নিচে পাজর লক্ষ্য করে আঘাত করে যা তার বর্ম আবৃত করে রাখেনি। সে অনুভব করে তার খঞ্জরের ফলা মাংসপেশী আর মোটা কার্টিলেজ ভেদ ভেতরে প্রবেশ করে, লোকটার পাঁজরের ভিতরে পিছলে যায়। দানবটা নিচু কণ্ঠে একটা ফ্যাসফেসে আওয়াজ করে এবং সামনের দিকে ঝুঁকে আসে। বাবর তার খঞ্জরের ফলা বের করে আনলে রক্ত ছিটকে বেরিয়ে আসে। সে বিস্মিত দৃষ্টিতে হাতাহাতি লড়াইয়ে প্রথম হত্যা করা লোকটার লাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।
“সুলতান! সাবধান!” ওয়াজির খান একেবারে ঠিক সময়ে হুঁশিয়ার করে দেয়। এক ঝটকায় ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁটু ভেঙে বসে পড়ে, বাবর তার ঘাড় লক্ষ্য করে রণকুঠার নামিয়ে আনা অন্য আরেক আক্রমণকারীকে ভীষণভাবে আঘাত করে। সহসা বাবর আবার জানতে পারে ভয় কাকে বলে। কি আহাম্মক সে এভাবে পেছন থেকে তাকে আক্রমণের সুযোগ দিয়েছিলো। মওকা পেয়ে ওয়াজির খান তার নতুন আক্রমণকারীকে লাথি মেরে ভূপাতিত করে এবং বাঁকা তরবারির মোক্ষম কোপ বসিয়ে দিতে, ছাদের উপরে তার ছিন্ন মাথা গড়াতে থাকে।
দ্বিতীয় সুযোগ লাভ করে কৃতজ্ঞ, বাবর, জানে অনেক অনভিজ্ঞ যোদ্ধাই এই সুযোগ লাভে বঞ্চিত হয়, ইতিমধ্যে উঠে দাঁড়িয়েছে, দু হাতে খঞ্জর আর তরবারি প্রস্তুত, কিন্তু চারপাশে তাকাতে দেখে গ্রান্ড উজিরের রক্ষীবাহিনী ইতিমধ্যে হয় খুন হয়েছে নয়তো প্রাণ নিয়ে পালিয়ে বেঁচেছে। সবাই তারা একজন দু’জনের দল করে একে অন্যের উপরে পড়ে রয়েছে বা পাথরের উপরে অস্বাভাবিক ভঙ্গিতে হাত পা ছড়িয়ে পড়ে আছে, তাদের একদা উজ্জ্বল পরিকর এখন রক্তে ভেজা। ছিন্নভিন্ন নাড়িভূড়ি আর গড়িয়ে পড়া মলের গন্ধ নাকে বাবর ঝাপটা দেয়।
“আসুন।” বাইসানগার তার পাশে দাঁড়িয়ে। তার কাঁধের একটা গভীর ক্ষত থেকে রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে আর মুখটা ব্যাথায় শক্ত হয়ে আছে। কিন্তু সেসব পাত্তা না দিয়ে সে কয়েকশ ফিট দূরে কোক সরাইয়ের আবছা অবয়বের দিকে বারবার ইঙ্গিত করে। “গ্রান্ড উজির ওখানেই লুকিয়ে রয়েছে- আমি যদি তাকে ঠিক চিনে থাকি তাহলে ব্যাটা গিয়ে জেনানা মহলে আশ্রয় নেবে।”
নিজের লোকদের অনুসরণ করতে বলে, বাবর হোঁচট খেতে খেতে বাইসানগারে পিছু নিয়ে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যায়, যা দেয়াল থেকে নিচের আঙ্গিনায় নেমে গিয়েছে। পড়ে থাকা লাশ আর আধা পিচ্ছিল জমাট রক্তের উপর দিয়ে কোনমতে টপকে যাবার সময়ে একটা মুখের উপরে তার দৃষ্টি আটকে যায়। মুখটা সম্ভবত তারই বয়সী আরেক কিশোর যোদ্ধার। রক্তশূন্য, মৃত্যুযন্ত্রণার নিরব চিৎকারে তার ঠোঁট পেছনে বেঁকে গিয়ে মাড়ি বের হয়ে আছে এবং তার চোখের লম্বা পাপড়ির নিচে বিশাল কালো চোখে দৃষ্টির মায়া মিলিয়ে গিয়ে ফুটে আছে মৃত্যুর বিভীষিকা। বাবর কেঁপে উঠে এবং দ্রুত চোখ ফিরিয়ে নেয়। ওয়াজির খান তাকে হুঁশিয়ার করে চিৎকার করে না উঠলে তারও একই ভাগ্য বরণ করতে হতো।
বাবর আর ওয়াজির খান এবং তাদের লোকেরা বাইসানগারকে প্রাঙ্গনের উপর দিয়ে অনুসরণ করে এগিয়ে গেলে দূর্গ আস্তানাকে নিরব আর শান্ত দেখায়। দেয়ালের উপরে একচোট লড়াইয়ের পরে তাদের আর নিরবে এগিয়ে যাবার কোনো মানে হয় না- দূর্গ আস্তানায় তাদের উপস্থিতি এখন আর গোপন নেই। কিন্তু বাবরের লোকদের অনেকেই গরু আর ভেড়া-চোর হবার কারণে তারা নিরবে আর গোপনে এগিয়ে যায়। গ্রান্ড উজিরের বাকী দেহরক্ষী এবং সৈন্যরা সব কোথায়? বাবর আশঙ্কা করে যে কোনো সময়ে তীরের একটা ঝাপটা ধেয়ে আসতে পারে, কিন্তু সে রকম কিছুই ঘটে না।
চার-তলা কোক সরাইয়ের কাছে গোপনে পৌঁছালে তারা সেটাকে রহস্যজনকভাবে নিরব দেখতে পায়, ড্রাগনের হাতল যুক্ত পিতলের চকচকে দরজাগুলো খোলা এবং অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে। তৈমূরের কিংবদন্তির দূর্গ। এমন চমৎকার একটা কিছু নির্মাণের জন্য না জানি আত্মবিশ্বাসের প্রয়োজন। দূর্গের প্রতিটা পাথর থেকে শক্তি আর ক্ষমতা যেন ঠিকরে পড়ছে। বাবরের তার মরহুম আব্বাজানের বলা অশুভ গল্পগুলো মনে পড়ে। “তৈমূরের সব সন্তান যারা বিদ্রোহ করেছে এবং সিংহাসনে বসেছে সবাই সেখানেই বসেছে। সিংহাসনের মোহে পড়ে যারা নিজের প্রাণ হারিয়েছে সবাই সেখানেই প্রাণ দিয়েছে। বলা হয় তারা তাদের শাহজাদাকে কোক সরাইয়ে নিয়ে গিয়েছে’ কথাটার মানে সেই শাহজাদা ইতিমধ্যে মারা গিয়েছে।”
ওয়াজির খান আর বাইসানগার নিজেদের ভিতরে আলাপ করে। ভিতরে প্রবেশের জন্য অধীর বাবর তাদের সাথে এসে যোগ দেয়। “সুলতান, আমাদের সতর্ক থাকতে হবে,” বাবরের ভিতরের অস্থিরতা লক্ষ্য করে ওয়াজির খান দ্রুত কথাটা বলে। “পুরো ব্যাপারটা একটা ফাঁদও হতে পারে।” বাবর মাথা নাড়ে। সে ঠিকই বলেছে। কেবল অসতর্ক আহাম্মকই হুড়মুড় করে ভেতরে প্রবেশের মত ভুল করবে। বন্ধ তোরণদ্বারের কাছে তাড়াহুড়োর কারণে প্রায় মরতে বসার ঘটনা স্মরণ করে বাবর অনেক কষ্টে নিজের অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণ করে। তারপরেও ওয়াজির খান যখন তার ছয়জন লোককে দেয়ালে প্রজ্জ্বলিত মশাল খুলে নিয়ে সতর্কতার সাথে তাদের ভিতরে প্রবেশ করে দেখতে বলে যে কোনো ধরণের ফাঁদ পাতা আছে কিনা, বাবরকে তখনও অস্থিরভাবে উসখুশ করতে দেখা যায়।
বাবরের কাছে যা কয়েক যুগের মত মনে হয়, বস্তুত পক্ষে, কয়েক মিনিট পরে, লোকগুলো বাইরে এসে জানায় যে আপাত দৃষ্টিতে সবই ঠিক আছে। বাবরের হৃৎপিণ্ড লাফিয়ে উঠে এবং সে ভিতরে প্রবেশ করে, তার লোকেরা জোটবদ্ধ ভঙ্গিতে তাকে অনুসরণ করে। পিতলের দরজা অতিক্রম করে তারা একটা উঁচু খিলানাকৃতি ছাদের প্রবেশ কক্ষ দেখতে পায় এবং তারপরেই ঠিক সামনে রয়েছে চওড়া নিচু সিঁড়ির ধাপ। ধীরে, সতর্কতার সাথে দপদপ করতে থাকা মশালের আলোয় তারা সিঁড়ি দিয়ে উঠতে শুরু করে, সামনের অন্ধকারের দিকে সবাই চোখ কুঁচকে তাকিয়ে রয়েছে। ত্রিশ ধাপ ওঠার পরে তারা দ্বিতীয় তলায় এসে পৌঁছে। সামনে সিঁড়ির আরেকটা ধাপ দেখা যায়। বাবর প্রথম ধাপে ইতিমধ্যে পা রেখেছে এমন সময় সে একটা চিৎকার শুনতে পায়।
“সুলতান, নেমে আসুন, শীঘ্রই নেমে আসুন!” বাবর ঝুঁকে পড়তে সামনের অন্ধকার। থেকে ছুঁড়ে মারা একটা বর্শা তার মাথার উপর দিয়ে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে চলে যায়, এতটাই কাছ দিয়ে যে তার ঘাড়ের চুল দাঁড়িয়ে পড়ে। নিমেষ পরেই, গ্রান্ড উজিরের দুই ডজন দেহরক্ষীর আরেকটা দল সিঁড়ি বেয়ে তাদের দিকে ধেয়ে আসে। পরের মুহূর্তে বাবর পাগলের মত ডানে বামে মোচড় খেয়ে তরবারি চালাতে শুরু করে। বিভ্রান্তির মাঝে তার তরবারির চেয়ে এখন খঞ্জরই বেশি কাজে আসে। সে শত্রুর ঢালের নিচে দিয়ে এগিয়ে গিয়ে তার খঞ্জরের ফলাটা উপরের দিকে করে কোপ বসিয়ে দেয়, সে জায়গামত আঘাত করতে পারলে হাতে আর কব্জিতে উষ্ণ রক্তের ধারা গড়িয়ে পড়ছে টের পায়। তার লোকেরা তাকে চারপাশে থেকে ঘিরে রেখেছে, হুঙ্কার দিয়ে এবং ঘোঁতঘোঁত শব্দ করতে করতে পুরো দলটা সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে।
গ্রান্ড উজিরের লোকেরা সিঁড়ির নিচে থেকে উঠে আসা আক্রমণের চাপ সামলাতে না। পেরে পিছু হটতে শুরু করে। শীঘ্রই তাদের আরও পেছনে নিয়ে যাওয়া হয়। সহসা তাদের শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে এবং হেরে যাওয়া যুদ্ধে প্রাণ না দেয়া আর পালাবার প্রবণতা জোরালো হতে তারা সিঁড়ি ভেঙে পালাতে আরম্ভ করে। বাবরের লোকেরা এবার দো-তলার সিঁড়ি বেয়ে পলায়মান অবয়বগুলোকে কোপাতে কোপাতে এগিয়ে। যায় এবং তৃতীয় তলার কিছুটা পর্যন্ত দাবড়ে দেয়।
তাড়াহুড়োয়, বাবর একটা অসমান ধাপে পিছলে যায় এবং কাত হয়ে গড়িয়ে পড়ে। তার আগুয়ান লোকদের একজন ঠিক পিছনেই ছিল, যে নিজেকে সামলাতে না পেরে বাবরের গায়ে হোঁচট খায় এবং তার পেলব পিঠের উপর পা দিয়ে মাড়িয়ে গেলে আরও একবার বাবরের বুক থেকে সব বাতাস বের হয়ে যায়। লড়াই তৃতীয় তলায় স্থানান্তরিত হতে বাবর চোখমুখ কুঁচকে কোনো মতে উঠে দাঁড়ায়। কিছুক্ষণের জন্য তার বমি বমি পায় এবং চোখে ঝাপসা দেখে। দেয়ালে হাত দিয়ে সে নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করে এবং জোরে শ্বাস নিতে গেলে কালশিটে পরা পাঁজর আর পেটের টান খাওয়া মাংসপেশী ব্যাথায় প্রতিবাদ জানায়।
“সুলতান।” ওয়াজির খান সিঁড়ি ভেঙে তার দিকে ছুটে আসে। “আপনি কি জখম হয়েছেন?”
বাবর মাথা নাড়ে। “না, আমি ঠিক আছি।”
“গ্রান্ড উজিরের অবশিষ্ট সৈন্যরা যারা আমাদের হাত থেকে পালিয়ে বেঁচেছে- এই ভবনের ছাদে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। আমরা প্রায় জয় লাভ করেছি।” ওয়াজির খানের মুখে দুর্লভ একটা হাসি ফুটে উঠে এবং সে বাবরের কাঁধ স্পর্শ করে। “আসুন।”
ঠিক সেই মুহূর্তে নিচে থেকে একটা গোলমালের শব্দ ভেসে আসে এবং পাথরের সিঁড়িতে দুদ্দাড় শব্দে অনেকগুলো পা তাদের দিকে ছুটে আসে। বাবর ঝটিতে ঘুরে দাঁড়ায় নতুন দুর্দৈব মোকাবেলা করতে। সিঁড়ির অন্ধকার থেকে বের হয়ে আসা ছায়াগুলোকে সে চিনতে পারে, তারই লোক, একেবারে সামনে রয়েছে আলি মজিদ বেগ ফারগানার পশ্চিম থেকে আগত পেশল দেহের গোত্রপতি, যাকে সে আর ওয়াজির খান সুড়ঙ্গ পথে আগত লোকদের নেতা হিসাবে মনোনীত করেছে।
“সুলতান, দূর্গ আর নগর প্রাসাদ আমাদের দখলে- সেই সাথে পুরো শহর।” আলি মজিদ বেগকে বিধ্বস্ত দেখায়, কিন্তু ঘাম আর রক্তের নিচে তার পটল-চেরা চোখে বিজয়োল্লাস চিকচিক করে।
“তোমরা দারুণ যুদ্ধ করেছে।”
“সুলতান।” আলি মজিদ বেগ যদিও এখনও হাঁপাচ্ছে, নিজের আর অধীনস্থ লোকদের সাফল্যে তার কণ্ঠে গর্ব উথলে উঠে।
“তোমরা কি গ্রান্ড উজিরকে কোথাও দেখেছো?”
আক্ষেপের সাথে আলি মজিদ বেগ মাথা নাড়ে।
“তাহলে বাইসানগার যা ভেবেছে সেটাই ঠিক। এখানেই কোক সরাইয়ে রক্ষিতাদের আঁচলের তলায় গিয়ে ব্যাটা লুকিয়েছে, যদি না কোনক্রমে শহর ছেড়ে পালিয়ে না যায়।”
“সুলতান, সে পালিয়ে যাবে কোথায়? কে তাকে আশ্রয় দেবে?” ওয়াজির খান প্রশ্নের ভঙ্গিতে বলে।
ওয়াজির খানকে পাশে নিয়ে বাবর সিঁড়ির বাকি ধাপগুলো অতিক্রম করে কোক সরাইয়ের উপরের তলায় উঠে আসে। সিঁড়ি যেখানে শেষ হয়েছে ঠিক তার উল্টো দিকে, তার উৎফুল্ল যোদ্ধাদের মাঝ দিয়ে সে রূপার উপরে সবুজাভ-নীল মিনে আর পাথরের কারুকাজ করা একজোড়া দরজা দেখতে পায়।
“জেনানা মহল?” বাবর জানতে চায়।
বাইসানগার সম্মতি প্রকাশ করে মাথা নাড়ে।
মানস চোখে, বাবর সহসা নিজের বোন খানজাদার ভয়ার্ত চোখ দেখতে পায়। সে কেমন অনুভব করতো, যদি তার বোন এমন একটা দরজার পেছনে, বিজয়োল্লাসে উন্মাদ যোদ্ধাদের হাত থেকে। অসহায় ভাবে লুকিয়ে থাকতো? সে তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকদের দিকে ঘুরে তাকায়। “মেয়েদের যেন কেউ অপমান না করে। আমি সমরকন্দ এসেছি এর নতুন সুলতান হিসাবে, রাতের আঁধারে আসা কোনো হন্তারক আমি নই।”
সে তার লোকদের অনেকের ভেতরে তাদের আবেগতাড়িত মুখে আশাহতের বেদনা দেখতে পায়। তারা সম্ভবত বিশ্বাস করে যে, সে এমন কথা বলতে পেরেছে কারণ সে একজন লোকের চাহিদা আর হতাশা সম্পর্কে অসম্পূর্ণ ধারণাযুক্ত এক কিশোর। যাকগে তাদের যা ইচ্ছা তারা ভাবতে পারে। আড়চোখে ওয়াজির খানের দিকে তাকালে সে তার সেনাপতির মুখে প্রসন্নতা দেখে বুঝতে আরও একটা পরীক্ষায় সে উতরে গিয়েছে।
নিচের আঙ্গিনা থেকে নিয়ে আসা মাথায় লোহার পাতযুক্ত দেয়াল চূর্ণকারী দুরমুশের আঘাতে রূপার দরজা কেঁপে উঠে এবং সবুজাভ-নীল পাথরের উজ্জ্বল টুকরো খোলামকুচির মত ছিটকে মাটিতে পড়ে। কিন্তু দরজাটা তারপরেও অনড় দাঁড়িয়ে থাকে। চকচকে রূপার পাতের নিচের কাঠ নিশ্চয়ই সেরকম মজবুত আর হুড়কাও দৃঢ়। তার লোকেরা চতুর্থবারের মত দুরমুশটা দিয়ে দরজায় ধাক্কা দেবার সময় বাবর মনে মনে ভাবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দরজার রূপার আস্তরণ ফেটে বেঁকে যায় এবং নিচের কাঠ গুঁড়িয়ে যায়। দু’জন যোদ্ধা তাদের রণকুঠার দিয়ে একজন মানুষ প্রবেশের মত একটা বড় ফোকড় তৈরি করে।
বাবর আর তার লোকেরা কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে, অস্ত্রের ধার পরীক্ষা করে। সে নিশ্চিত যে কোনো মুহূর্তে হারেম রক্ষা করতে এগিয়ে আসা যোদ্ধার হুঙ্কার তারা শুনতে পাবে কিংবা ভেতর থেকে নিক্ষিপ্ত তীরের কারণে বাধ্য হবে ফাঁকা স্থানটা থেকে সরে দাঁড়াতে। তার বদলে কেবল নিরবতাই বিরাজ করে। আর চন্দনকাঠের ভারী মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসে যা তাকে শেষবার মায়ের কাছে বসে থাকার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। গন্ধটা তাদের চারপাশে ঘুরপাক খায়, ঘামের সাথে মিশে একটা আলাদা গন্ধের জন্ম দেয়।
তার লোকদের চুপ করে থাকার ইঙ্গিত দিয়ে, বাবর দরজার ফোকরের দিকে এগিয়ে যায়, সে আবার পণ করেছে প্রথমে সেই ভিতরে প্রবেশ করবে। “না। সুলতান।” নিষেধাজ্ঞা জ্ঞাপন করা ওয়াজির খানের হাত তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। “প্রথমে আমাকে ভেতরে প্রবেশ করার অনুমতি দেন।”
বাবর ভাবে, আমি তার কাছে ঋণী। হতাশা লুকিয়ে রেখে সে ওয়াজির খান আর তার দু’জন যোদ্ধাকে অস্ত্র হাতে সতর্কতার সাথে ভেতরে প্রবেশ করতে দেখে। কিছুক্ষণ পরেই সে শুনতে পায় ওয়াজির খান বলছে, “সুলতান, আপনি এবার ভিতরে আসতে পারেন।”
বাবর দরজার ফোকড় গলে ভেতরে প্রবেশ করে নরম রেশমের গালিচায় পা রাখে। এমন কোমলতা সে জীবনেও অনুভব করেনি। তাদের ফারগানা গালিচাগুলোকে এর তুলনায় জীর্ণ কম্বল মনে হয়।
ওয়াজির খান ইশারায় তাকে সতর্ক থাকতে বলে। তার বাকি লোকেরা পেছন থেকে চাপ প্রয়োগ করতে, বাবর সামনে এগিয়ে যায়, বিশাল কক্ষের প্রতিটা আনাচে কানাচে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়, যেকোন আক্রমণ প্রতিহত করতে প্রস্তুত। কাঁচ লাগান কুলুঙ্গিতে প্রজ্জ্বলিত শত শত মোমবাতির আলোতে কক্ষটা আলোকিত। স্বচ্ছ হলুদাভ আলো দেয়ালে ঝোলান হাতে বোনা পর্দায় ফুটিয়ে তোলা টিউলিপ, সোলোমী আর সমরকন্দের অন্যান্য ফুল, এবং চকচকে স্যাটিন বা মখমলের পুরু তাকিয়ার উপরে খেলা করছে। অপেক্ষাকৃত ছোট ছয়টা রূপার দরজা একেকপাশে। তিনটা করে, বাবর অনুমান করে সেগুলোর পেছনে মেয়েদের ব্যক্তিগত কামরা রয়েছে। ঠিক নাক বরাবর সামনে আরেকটা দরজা, এটা সোনার পাত দিয়ে মোড়ান। আর তার উপরে সমরকন্দের বাঘের প্রতিরূপ খোদাই করা রয়েছে।
তার লোকেরা আবারও তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে টের পেয়ে, বাবর কেশে উঠে গলা পরিষ্কার করে। “উজির!” সোনায় মোড়ান দরজার দিকে লক্ষ্য করে সে বলে, তার কণ্ঠস্বর হতে পারে এখনও পুরুষালী হয়নি কিন্তু পরিষ্কার এবং দৃঢ়। “আপনি নিজেকে বাঁচাতে পারবেন না, কিন্তু নিজের মৃত্যু দ্রুত আর সম্মানজনক করতে পারেন।” দরজার পেছনে একটা মৃদু নড়াচড়ার শব্দ মনে হয় সে শুনতে পায় কিন্তু তারপরেই আবার সব আগের মত নিরব হয়ে যায়। “উজির, আপনার কি লজ্জা বা সম্মানবোধ বলে কিছু নেই?” বাবর অনড় ভঙ্গিতে বলে।
এইবার নিশ্চিতভাবেই একটা ধ্বস্তাধ্বস্তির আওয়াজ আর ক্রুদ্ধ কণ্ঠের চিৎকার শোনা যায়। সহসা সোনালী দরজাটা খুলে যেতে সেখানে গ্রান্ড উজিরের দু’জন দেহরক্ষীকে দেখা যায়, একজনের গালে আড়াআড়ি একটা তরবারির আঘাতের চিহ্ন। তাদের প্রতিবাদ করতে থাকা প্রভুর হাত ধরে টেনে আনছে, তার উজ্জ্বল সবুজ রঙের জরির কাজ করা আলখাল্লা পেছনে ঢেউয়ের মত দুলছে। কোনো রকমের ভণিতা না করে তারা গ্রান্ড উজিরকে বাবরের পায়ের কাছে ছুঁড়ে দেয়, তারপরে নিজেরা তার সামনে বশ্যতা স্বীকারের ভঙ্গিতে নতজানু হয়। অন্য দেহরক্ষীরা, অনিশ্চিত ভঙ্গিতে নিজেদের প্রণত করে। ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে বাবর পুরো নাটকটা দেখে। “বাইসানগার সবাইকে নিরস্ত্র কর।”
বাইসানগারের লোকেরা দ্রুত আদেশ পালন শুরু করতে, মলিন নীল রঙের রেশমের পোশাক পরিহিত এক কিশোরী সোনালী দরজা দিয়ে ছুটে বের হয়ে এসে, বাইসানগারের লোকদের নাগাল এড়িয়ে সোজা গ্রান্ড উজিরের দিকে ছুটে যায়। তার পাশে হাঁটু ভেঙে বসে বেচারী তাকে জড়িয়ে ধরতে চেষ্টা করে কিন্তু একটা প্রতিজ্ঞার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে সে তার তন্বী দেহটা এক ঝটকায় দূরে সরিয়ে দেয়। মেয়েটা সুস্থির হয়ে সরাসরি বাবরের চোখের দিকে তাকায়। সে দেখে একটা ডিম্বাকৃতি মুখ এবং চোখ যা কান্নায় ভরাক্রান্ত হলেও সুন্দর। “আমার বাবাকে ছেড়ে দাও। তিনি একজন বৃদ্ধ মানুষ।” ভয়হীন কণ্ঠে মেয়েটা কথাগুলো বলে, যদিও রণ ক্লান্ত একদল যোদ্ধার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, যাদের কাছ থেকে সে নিশ্চয়ই জানে যে সে সামান্যই সহানুভূতি বা করুণা প্রত্যাশা করতে পারে।
“তার বাঁচার কোনো অধিকার নেই। তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা তার যোগ্যতার সীমা ছাড়িয়েছে।” বাবর কাঠখোট্টাভাবে উত্তর দেয়। “অন্য মেয়েরা কোথায়?”
মেয়েটা প্রথমে ইতস্তত করে তারপরে বলে, “সবাই নিজ নিজ কামরায় রয়েছে।” সে ছয়টা ছোট দরজা ইশারায় দেখায়। বাবর ওয়াজির খানের উদ্দেশ্যে মাথা নাড়ে। “সবগুলো তল্লাশি করেন। কোনো সৈন্য যেন সেখানে লুকিয়ে না থাকতে পারে। তারপরে মেয়েদের সেখানেই আটকে রাখেন আমরা যতক্ষণ তাদের দিকে মনোযোগ দেবার সময় না পাই।” ওয়াজির খান দ্রুত তার লোকদের দরজা ভাঙার নির্দেশ দেয়। প্রায় সাথে সাথে বাবর হারেমের ভেতর থেকে প্রতিবাদ আর বিলাপের সুর ভেসে আসতে শুনে। কিন্তু সে জানে তার আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালিত হবে। মেয়েদের ভয় পাওয়া থেকে সে তাদের বিরত রাখতে পারবে না, কিন্তু তাদের কেউ অপমানও করবে না।
উজিরের কন্যা এখন তার দিকে সরাসরি তাকিয়ে রয়েছে, তার বাদামী চোখে গর্বিত অভিব্যক্তি। সে তার অভিযুক্ত চাহনী থেকে ঘুরে দাঁড়ায়। “তাকে ব্যক্তিগত কামরায় নিয়ে যাও এবং তালাবন্ধ করে রাখো।” উজিরকে ছেড়ে দেবার কোনো অভিপ্রায় তার নেই। কিন্তু বুঝতে মেয়েটাকে তার বাবার মৃত্যুদণ্ড দেখা থেকে সে বিরত রাখতে চাইতে। মেয়েটাকে কেউ ধরার আগেই, সে নিজে থেকেই উঠে দাঁড়ায় এবং পেলব গলার উপরে গর্বিত মাথা উঁচু করে রেখে একটা দরজা দিয়ে ঢুকে ভেতরে হারিয়ে যায়, যাবার সময়ে কোনো অনুরোধ বা ঘাড় ঘুরিয়ে একবারও ফিরে তাকায় না। বাবর পেছন থেকে তার দিকে তাকিয়ে থাকে, কল্পনা করে এমন সম্মান প্রদর্শন করতে তাকে কি মূল্য দিতে হয়েছে।
“বেশ, উজির দেখা যাচ্ছে আপনার মেয়ে আপনার দেহরক্ষীদের চেয়ে সাহসী আর অনেক বেশি বিশ্বস্ত। এমন সম্মান পাবার যোগ্য আপনি নন।” বাবর বুঝতে পারে সবার সামনে মেয়েটাকে তার বাবা এভাবে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে অপমান করায় সে নিজেই ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছে।
“সমরকন্দের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হবার কোনো অধিকার তোমার নেই।” গ্রান্ড উজির নিজেকে টেনে তুলে বসার আসনে নিয়ে আসেন এবং বাবরের দিকে গুটিবসন্তে ক্ষতবিক্ষত, চওড়া-চোয়াল বিশিষ্ট মুখে অশুভ অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তাকিয়ে থাকেন, আসন্ন মৃত্যুর সম্ভাবনা সম্পর্কে তাকে আপাতদৃষ্টিতে নিরুদ্বিগ্ন দেখায়। “আমার ধমনীতে তৈমূরের রক্ত বইছে, শেষ সুলতানের আমি ভাস্তে। আমার চেয়ে আর কার দাবি জোরাল?”
গ্রান্ড উজির তার রক্তজবার মত চোখ কুচকে তাকায়। “তুমি হয়ত ভাবছে সমরকন্দ দখল করেছে, কিন্তু জেনে রাখো তুমি কখনও এটা নিজের অধিকারে রাখতে পারবে না, সে ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলে। “পাহাড়ী জঞ্জাল, কথাটা চিন্তা করে দেখো। ফারগানায় নিজেদের নোংরা ভেড়ার পালের কাছে ফিরে যাও। সম্ভবত তাদের ভিতরেই তুমি নিজের যোগ্য স্ত্রী খুঁজে পাবে- আমি শুনেছি তোমরা বিশেষ কোন…”।
“অনেক হয়েছে!” বাবর কাঁপতে থাকে যা সে বুঝতে পারে বয়ঃসন্ধিক্ষণের উত্তেজনা, কিন্তু আশা করে তার লোকেরা যেন সেটাকে রাজকীয় ক্রোধ বলে মনে করে। “বাইসানগার,” সে নাটকীয় ভঙ্গিতে চেঁচিয়ে উঠে।
সেনা অধিপতি তার দিকে এগিয়ে আসে। “সুলতান?”
“অন্যায়ভাবে সিংহাসন অধিকার করা ছাড়াও শেষ সুলতানের শেষ আদেশ পালন করার জন্য এই লোকটা তোমার সাথে নির্মম জুলুম করেছে।” বাবর লক্ষ্য করে বাইসানগার তার ডান হাত যেখানে থাকবার কথা ছিল সেদিকে চকিতে তাকায়। “পরবর্তী জীবনের পাওনা বুঝে নেবার জন্য এই পাপীকে সেখানে পাঠাবার ভার তোমাকে দেয়া হল। নিচের প্রাঙ্গণে তার ভবলীলা সাঙ্গ করবে এবং তার কন্যার সাহসিকতার জন্য খেয়াল রাখবে পুরো ব্যাপারটা যেন দ্রুত নিষ্পন্ন হয়। তারপরে তার দেহটা সবুজাভ-নীল তোরণদ্বার থেকে শিকল দিয়ে ঝুলিয়ে দেবে, যেন লোকেরা দেখতে পায় যে লোকটার উচ্চাশা আর ধনলিপ্সা তাদের অভাব আর কষ্টে ফেলেছিল তাকে আমি কিভাবে সাজা দিয়েছি। তার দেহরক্ষীর দল যদি আমাকে তাদের সুলতান হিসাবে মেনে নিয়ে আনুগত্যের শপথ নেয় তবে তারা প্রাণে বেঁচে যাবে।”
বাইসানগারের লোকেরা উজিরকে টানতে টানতে নিয়ে যেতে, সহসা ক্লান্তি এসে বাবরকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। এক মুহূর্তের জন্য সে চোখ বন্ধ করে এবং রেশমী কোমল গালিচাটা স্পর্শ করার জন্য ঝুঁকে যা আগামীকাল গুটিয়ে নিয়ে তার মায়ের কাছে উপহার হিসাবে পাঠাবার আদেশ দেবে বলে ঠিক করেছে। “সমরকন্দ,” সে নিজেকে ফিসফিস করে শোনায়। “এখন আমার।”
১.৬ একশ দিবসের রাজত্বকাল
০৬. একশ দিবসের রাজত্বকাল
নীল, সবুজ আর সোনালী টালির উজ্জ্বলতায় সূর্যের আলো ঠিকরে যেতে সবুজাভ নীল তোরণদ্বার ঝিকমিক করতে থাকে। সমরকন্দে আনুষ্ঠানিক প্রবেশের উদ্দেশ্যে তোরণদ্বারের দিকে এগিয়ে যাবার সময়ে বাবরের মনে হয় সে বুঝি সূর্যের কেন্দ্রে ঘোড়ায় চেপে এগিয়ে চলেছে। মৃদু বাতাসে তার পরণের রেশমের সবুজ আলখাল্লা চারপাশে আন্দোলিত হতে থাকে। ক্রুদ্ধ গর্জনরত বাঘের প্রতিকৃতি খচিত তৈমূরের সোনার আংটি তার আঙ্গুলে জ্বলজ্বল করছে, এবং আকাটা পান্নার তৈরি গলার হার তার নিঃশ্বাসের সাথে বুকের উপরে উঠছে আর নামছে। সহস্র চোখ তাকে খুটিয়ে দেখছে, সে বিষয়ে সচেতন। বাবর জোর করে চোখেমুখে একটা কঠোর অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তোলে, যদিও তার ইচ্ছে করে মাথাটা পেছন দিকে হেলিয়ে দিয়ে আকাশের পানে তাকিয়ে বুকের সবটুকু বাতাস বের করে দিয়ে চিৎকার করে উঠে।
অধীনস্ত গোত্রপতি আর সেনাপতিরা তার ঠিক পেছনেই ঘোড়ার চড়ে তাকে অনুসরণ করছে। ফারগানা থেকে তাদের সাথে আগত উপজাতি চাষাভূষোদের দিয়ে গত দুদিনে ওয়াজির খান একটা চলনসই সেনাবাহিনী দাঁড় করিয়েছেন যারা। শহরের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাবার সময়ে সবাই ঈর্ষান্বিত চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে থেকেছে। কোক-সরাইয়ের বন্ধ প্রকোষ্ঠগুলোতে যথেষ্ট পোশাক পরিচ্ছদ তারা খুঁজে পেয়েছিল যা দিয়ে তার শিরস্ত্রাণ আর কেবল বর্ম পরিহিত রুক্ষ, যাযাবর যোদ্ধার দলকে, নিজের লোকদের কষ্টে রেখে গ্রান্ড উজিরের জমিয়ে রাখা উজ্জ্বল রেশমের পোশাকে সজ্জিত করা হয়েছে।
বাবর মনে মনে শপথ নেয়, এই মহান শহরের সমৃদ্ধি সে আবার ফিরিয়ে আনবে, তূর্যধ্বনি আর টানটান চামড়া দিয়ে বাঁধান রণদামামার গুরুগম্ভীর প্রতিধ্বনির মাঝে, সে যে তোরণদ্বার দিয়ে শহরে প্রবেশ করে তার চূড়ো থেকে উজিরের কবন্ধ দেহ। লোহার খাঁচায় ঝুলছে। সূর্যের তাপে যা ইতিমধ্যেই কালো হতে শুরু করেছে। সে সামনের দিকে এগিয়ে গেলে শহরের নীল গম্বুজ আর মিনার দেখতে পায়। শীঘ্রই সে একটা বিশাল বাজারের ভিতর দিয়ে এগিয়ে যায়, যার দুপাশে ভ্রাম্যমাণ বণিকদের আশ্রয় দেয়ার জন্য নির্মিত হয়েছে সারি সারি সরাইখানা। তার মরহুম আব্বাজান প্রায়ই তৈমূরের সময়ের প্রাচুর্যময় কাফেলার কথা বলতেন- হেলেদুলে নাক ঝাড়তে ঝাড়তে এগিয়ে যাওয়া উটের সারিবদ্ধ দল আর ক্ষিপ্রগামী খচ্চরের বহর যারা পশ্চিম থেকে পশম, চামড়া আর মসৃণ কাপড়, পূর্ব থেকে নিয়ে আসত চিনামাটির বাসনকোসন, সোনা রূপার কারুকাজ করা রেশমী বস্ত্র আর তীব্র গন্ধযুক্ত কস্তুরি, এবং সিন্ধু নদী অতিক্রম করে দূরবর্তী অঞ্চল থেকে সুগন্ধি জায়ফল, লবঙ্গ, দারুচিনি আর উজ্জ্বল রত্নপাথর নিয়ে আসত।
সড়কের দু’পাশে দাঁড়িয়ে থাকা জনগণকে সতর্ক কিন্তু মোটেই বিরূপ মনে হয় না। প্রশস্ত রেজিস্তান চত্বরে, ঘোড়ায় উপবিষ্ট অবস্থায় প্রবেশের সময়ে বাবর তাদের কৌতূহল অনুভব করে, যেখানে ডোরাকাটা সবুজ রেশমের চাঁদোয়ার নিচে একটা মার্বেলের মঞ্চ রয়েছে। তার প্রয়াত চাচাজানের পারিষদবর্গ আর সমরকন্দের অভিজাত ব্যক্তিরা মঞ্চের সামনে বশংবদের ন্যায় নতমুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
বাবর ঘোড়া থেকে সরাসরি মঞ্চের উপরে নামে এবং এর কেন্দ্রের দিকে এগিয়ে যায়, যেখানে বাঘের পায়াযুক্ত সোনার গিল্টি করা সিংহাসন অপেক্ষা করছে। সে যেন সহসাই তাকে পর্যবেক্ষণ করতে থাকা দৃষ্টি সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠে। আর তার ঢাউস আলখাল্লা সামলে নিয়ে তার পক্ষে যতটা সম্ভব ভারিক্কী দেখিয়ে সে সিংহাসনে উপবিষ্ট হয়। সে এখনও কিশোর বয়স পুরোপুরি চৌদ্দও হয়নি। জনগণ তাদের সামনে উপবিষ্ট একটা বালকের ভিতরে কি দেখতে চায়? কিন্তু সে নিজেকে প্রবোধ দেয়, সমরকন্দ তার উত্তরাধিকার সূত্রে এবং বিজয় গৌরবে। সে তার চিবুক উঁচু করে এবং গর্বিত ভঙ্গিতে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকে।
জমকালো সিংহাসনে আড়ষ্ঠ ভঙ্গিতে উপবিষ্ট অবস্থায়, সে তার নতুন প্রজাদের আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করে এবং বিনিময়ে তাদের খেলাত প্রদান করে আর গ্রান্ড উজিরের সঞ্চিত ধনসম্পদ বিলিয়ে দেয়। লোকজন সারিবদ্ধভাবে নিজেদের তার সামনে প্রণত করে কিন্তু সে খুব ভালভাবেই জানে যে এদের কেউই তার বিশ্বাসের যোগ্য নয়। চিন্তাটা মাথায় আসতেই সে সংযত হয় আর গ্রান্ড উজিরের ক্রুদ্ধ উক্তিগুলো আবার তার মনে পড়ে যায়: “তুমি কখনও সমরকন্দ দখলে রাখতে পারবে না।”
জনগণকে সে দেখিয়ে দেবে শাসক হবার যোগ্যতা তার আছে। সে কি ইতিমধ্যে যথেষ্ট করুণা আর উদারতা প্রদর্শন করেনি? যারা তার কর্তৃত্ব মেনে নিয়েছে সে তাদের সবাইকে অকাতরে ক্ষমা করেছে। গ্রান্ড উজিরের হারেমের রমণীকুল, বিজয়ের প্রথম মুহূর্তে বলাৎকারের শিকার হবার বদলে, যথাযথ সময়ে, বাবরের গোত্রপতিদের কাছে ঠাই পাবে। আর উজিরকন্যা, সে ইতিমধ্যে তাকে কুন্দুজে তার চাচাতভাই শাহজাদা মাহমুদের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে। সে যাবার বিষয়ে কোনো ধরণের অনীহা প্রদর্শন করেনি। বস্তুতপক্ষে, মেয়েটার বরং খুশি হওয়া উচিত। সে যে কেবল তৈমূরের সাক্ষাৎ বংশধরের এক শাহজাদার স্ত্রী হবে তাই না, এই মাহমুদই তাকে মাত্র দু’বছর আগে দস্যুদের হাতে সম্ভ্রমহানির হাত থেকে বাঁচিয়েছিল। সে তার প্রেমে এতটাই মজেছিল যে তাকে পাবার জন্য সমরকন্দ পর্যন্ত অবরোধ করেছিলো।
হ্যাঁ, বাবর ভেবে দেখে, সে ভালমতই উতরে গেছে। জনগণের তাকে ভয় পাবার কোনো কারণই নেই বরং তাদের তাকে শ্রদ্ধা করা উচিত। তারপরেও, গ্রান্ড উজিরের কথা তাকে ঘুণপোকার মত কুরে কুরে খেতে থাকে…
সহসা বাবর ওয়াজির খানকে ঘোষণা করতে শোনে, “সমরকন্দের সুলতান, মির্জা বাবর, জিন্দাবাদ!” ঘোষণাটা নিমেষে সহস্র কণ্ঠে ধ্বনিত হলে পুরো প্রাঙ্গন গমগম করে আর বাবরের চিন্তাজাল ছিন্ন হয়। একজন মৃত মানুষ যার কবন্ধ লাশ এখন খাঁচায় ঝুলছে তার কথার কারণে নিজেকে কষ্ট দেয়াটা বোকামী। এই অনুষ্ঠানের যখন আয়োজন করা হয় তখন ওয়াজির খানের সাথে তার যে কথা হয়েছিলো, সেই অনুসারে বাবর এই জয়ধ্বনির খেই ধরে। সে উঠে দাঁড়ায় এবং ধীরে ধীরে মঞ্চের চারপাশে সমবেত হওয়া জনগণের দিকে তাকায়, তাদের নতুন সুলতানকে এক নজর ভাল করে দেখার সুযোগ দেয়। তারপরে সে জনতার উদ্দেশ্যে বলে, “সমরকন্দের প্রতিটা মানুষ আমার শাসনকালে শান্তি আর সমৃদ্ধি লাভ করবে। আমার সদিচ্ছার স্মারক হিসাবে, শহরের বাজার থেকে এক মাস কোনো ধরণের কর আদায় করা হবে না।”
উপস্থিত জনগণ উৎফুল্ল কণ্ঠে তাদের সম্মতি জানায়। তার নিজের অভিব্যক্তি যদিও নির্বিকার থাকে, তার ভেতরটা আবারও বিজয়ানন্দে মেতে উঠে। তৈমূর যখন সমরকন্দ দখল করেন তখন তার বয়স ছিল একত্রিশ বছর, তার এখনকার চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি। এটাই ছিল তার প্রথম গুরুত্বপূর্ণ বিজয়, যা পরবর্তীতে একটা বিশাল সাম্রাজ্যের ভিত্তি হিসাবে কাজ করেছে। বাবরের ক্ষেত্রেও ঠিক একই ঘটনা ঘটবে।
আজ রাতে তার উদারতার আরেকটা নমুনা হিসাবে অবরোধকালীন দুর্ভোগ প্রশমিত করার উদ্দেশ্যে সে সারা শহরে খাবার বিতরণ করবে। তার আর তার লোকদের জন্য ভোজের আয়োজন করা হবে, এবং এই একটা ক্ষেত্রে সে ইতিমধ্যে তৈমূরকে ম্লান করে দিয়েছে, যার পছন্দ ছিল একেবারেই অনাড়ম্বর নিরাভরণ: ঝলসানো ঘোড়ার মাংস, সিদ্ধ ভেড়া আর ফুটানো চাল। বাইরের তৃণভূমি থেকে নিরন্ন শহরে নধর ভেড়ার পাল ধরে আনা হয়েছে যা তাদের রসনা নিবৃত্ত করবে এবং ইতিমধ্যে বেচারীদের শিকে গাথা অবস্থায় আগুনে ঝলসানোও শুরু হয়ে গেছে। তিতির আর বনমোরগ, তেঁতুল আর ডালিমের রসে ডুবিয়ে ফোঁটান হচ্ছে। মধুর মত মিষ্টি রসে টইটুম্বুর করতে থাকা তরমুজ আর বেগুনী আঙ্গুরের সতেজ থোকা কারুকার্যখচিত ধাতুর ট্রেতে স্তূপাকারে রাখা। বাবরের খিদে পেয়ে যায়।
আনুষ্ঠানিকতা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে কিন্তু বিজয় উদযাপন শুরু হবার আগে। বাবরকে আরেকটা কাজ করতে হবে। সে ধীরে ধীরে মঞ্চ থেকে নেমে আসে এবং ঘোড়ায় উপবিষ্ট হয়। ওয়াজির খান আর তার রক্ষীদের অনুসরণের ইঙ্গিত দিয়ে, সে প্রাঙ্গণ থেকে বের হয়ে গুর এমিরের দিকে রওয়ানা হয়। নীল টালিতে আবৃত খাঁজকাটা, ডিম্বাকৃতি গম্বুজ আর দুটো সুঠাম মিনার যেখানে তৈমূরকে চিরশয্যায় শায়িত করা হয়েছে।
বাবর, দেয়াল দিয়ে ঘেরা সমাধিভবনের লম্বা, খিলানাকৃতি দ্বারের কাছে পৌঁছালে, লাফ দিয়ে ঘোড়া থেকে নামে। ব্যাখ্যার অতীত কোনো অজানা কারণে, সে কিছুক্ষণ একা থাকতে চায়। ওয়াজির খান আর তার রক্ষীদের অপেক্ষা করতে বলে, তারপরে সে ভিতরে প্রবেশ করে। সে একটা আঙ্গিনা অতিক্রম করে যেখানে উঁত গাছের ডালে অসংখ্য চড়ুই পাখি কিচিরমিচির করছে, প্রথা অনুযায়ী পায়ের কারুকাজ করা বুট জুতা খুলে সে ভেতরের সমাধিকক্ষে প্রবেশ করে।
ভেতরে বাইরের উজ্জ্বল আলোর বিপরীত অবস্থা বিরাজ করায় তার দেখতে কষ্ট হয় এবং চোখ পিটপিট করতে করতে সে একটা অষ্টাভূজাকৃতি কামরায় প্রবেশ করে। ধনুকাকৃতি খিলানের উপরের নকশা কাটা জাফরির ভিতর দিয়ে প্রবেশ করা আলোর ধারায় বিষণ্ণ বৈভব দেখে তার শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসে। মার্বেলের উপরে সবুজ অ্যালাব্যাস্টার বসান এবং মাথার উচ্চতায় অধিরোপিত সোনালী টালির দেয়ালে সে আনমনে আঙ্গুল বোলায়। তার উপরে, নীল আর সোনালী কাগজের বোর্ড দিয়ে দেয়ালে নানান নকশা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এবং চারপাশে প্যানেলের ভিতরে অপরূপ সুন্দর লিপিকলায় পবিত্র কোরানের নানা আয়াত উত্তীর্ণ করা রয়েছে। সে গলা উঁচু করে গম্বুজের ছাদে অঙ্কিত সোনালী তারকারাজিকে তাদের নিজস্ব ভূবনে বাড়াবাড়ি রকমের বিন্যস্ত অবস্থায় দেখে।
গম্বুজের সরাসরি নিচে মার্বেলের সমতল পাটাতনে একটা শবাধার দেখা যায়। শবাধারটা প্রায় ছয় ফিট লম্বা এর উপরে সবুজ জেড পাথরের মেরাপ যা এতটাই সবুজ যে প্রায় কালো বলে মনে হয় তৈমূরের উপযুক্ত সমাধিসৌধ, কিন্তু বাবর এখনও জানে না, সে কোথায় শায়িত হবে। সমাধিকক্ষের একপাশে, খিলানাকতি একটা পথ ঢালু হয়ে নেমে নিচের ভূগর্ভস্থ কক্ষে চলে গেছে। কয়েক মুহূর্ত পরে, বাবর সেখানে প্রবেশ করে। করিডোরটা এতটাই সরু যে দু’পাশের দেয়ালে তার কাঁধ ঘষা খায় যখন সে ধীরে ধীরে নিচে নামতে থাকে- খালি পা পাথরের মসৃণ মেঝেতে পিছলে যেতে চায়- একটা অনেক ছোট কক্ষে এসে সে উপস্থিত হয়। একটা ছোট মার্বেলের তিরস্করণী পর্দা দেয়ালের উঁচুতে স্থাপিত আর সেটাতে মৌচাকের মত জাফরি কাটা নকশা কক্ষটার একমাত্র আলোর উৎস, সেখান থেকে হাল্কা আলোর ধারা এসে অলংকৃত সাদা মার্বেলের শবাধারে পড়ছে, যেখানে তৈমূরের মৃতদেহ শায়িত রয়েছে।
চীনের উদ্দেশ্যে অভিযানে যাত্রা করার পরে যখন তৈমূর অকস্মাৎ মৃত্যুবরণ করলে, তার অনুচরেরা গৌরবের সাথে তাকে সমরকন্দে ফিরিয়ে এনে সমাধিস্থ করার পূর্বে গোলাপজল, কর্পূর আর মৃগনাভি দিয়ে তার মরদেহ সংরক্ষিত করে। আড়ম্বরপূর্ণ অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠিত হওয়া সত্ত্বেও, বলা হয়ে থাকে মহান এই বীর কবরে প্রথমে শান্তি পাননি। রাতের পরে রাত তার শবাধার থেকে আক্রোশপূর্ণ চিৎকার ভেসে এসে সমরকন্দের লোকদের ভীতসন্ত্রস্ত করে তুলত। মৃত সম্রাট আপাত দৃষ্টিতে অন্তিম শয়ানে শায়িত হতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন। এই ক্রোধান্বিত যন্ত্রণাদগ্ধ চিৎকার এক বছর স্থায়ী হলে শহরের লোকেরা মরীয়া হয়ে তৈমূরের ছেলের কাছে ধর্ণা দেয়। তার সামনে হাঁটু ভেঙে বসে তারা, তৈমূর তার যুদ্ধযাত্রার সময়ে যেসব বন্দিদের বিশেষ করে বিভিন্ন শিল্পে দক্ষ কারিগরদের সমরকন্দে নিয়ে এসেছিলেন এর সৌন্দর্যবর্ধনের উদ্দেশ্যে তাদের মুক্তি দিতে অনুরোধ করে। যাতে লোকগুলো তাদের নিজের মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে পারে। তৈমূরও তাহলে অবশেষে তার মহাপ্রয়ানের পথে রওয়ানা হতে পারবেন। প্রজাদের ভীতসন্ত্রস্ত আর বিহ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে তৈমূরের ছেলে তাদের কথা শোনেন। বন্দিদের মুক্তি দিয়ে দেশে ফিরে যাবার ব্যবস্থা করা হয় আর এরপরে তৈমূরের আর্তনাদ আর শোনা যায়নি।
নানী- দাদীর গল্প, বাবর মনে মনে ভাবে। কিন্তু আরেকটা কাহিনী আছে যা সে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে বলা হয়ে থাকে তৈমূরের শবাধারের মেরাপের নিচে একটা সমাধিলিপি খোদাই করা রয়েছে: “আমি যদি আমার সমাধি থেকে উঠে আসি তাহলে পৃথিবী প্রকম্পিত হবে।”
বাবর বিনম্রচিত্তে শবাধারের দিকে এগিয়ে যায়। প্রায় ভীতচকিত ভঙ্গিতে, সে হাত বাড়ায় মেরাপটা স্পর্শ করতে যার উপরিভাগে তৈমূরের বংশ পরিচয় বয়ান করা রয়েছে। বাবর ভাবে, আমারও বংশ পরিচয়। আমার রক্ত। সে মাথা নিচু করে শীতল পাথরের গায়ে চুমু খায়। “আমি তোমার যোগ্য উত্তরসূরী হব,” সে ফিসফিস করে বলে। মহান তৈমূর আর আব্বাজানের কাছে এটা তার প্রতিশ্রুতি। তারচেয়েও বড় কথা এটা তার নিজের কাছে নিজের প্রতিশ্রুতি।
***
তৈমূরের হৃদয় প্রশান্ত করা উদ্যান, বাগ-ই-দিলকুশার কামরার মুক্তার মিহি জালের তৈরি কারুকাজ করা পর্দা ভোরের বাতাসে আলোড়িত হয় যেখানে সমরকন্দে বিজয়ীর বেশে প্রবেশের দুমাস পরে- বাবর ঘুমিয়ে রয়েছে। সমরকন্দের চারপাশের এলাকা আর তৃণভূমিতে তৈমূর যতগুলো উদ্যান নির্মাণ করেছিলেন, এটা বাবরের সবচেয়ে প্রিয়। আগের দিন সন্ধ্যাবেলা, সূর্য যখন অস্ত যেতে বসেছে, হঠাৎ খেয়ালের বশে সে ওয়াজির খান আর তার দেহরক্ষীদের তলব করে। সবুজাভ-নীল তোরণদ্বার দিয়ে তারা বের হয়ে এসে দু’মাইল লম্বা বাতাসে আন্দোলিত রাজকীয়, মার্জিত পপলার গাছে শোভিত রাজপথ ধরে এগিয়ে এখানে এসে উপস্থিত হয়েছিলো। ঘোড়া ছুটিয়ে তারা যখন সদর দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে ততক্ষণে রাত নেমে এসেছে। বাবর তার ভেতরেই তৈমূরের গম্বুজযুক্ত, সমব্যবধানে স্থাপিত স্তম্ভযুক্ত গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ আর তার চারপাশের খোলামেলা ভবনের আবছা অবয়ব অন্ধকার গাছের মাঝে মুক্তার মত চমকাতে দেখে।
বাবর ঠিক করে সে, ছিপছিপে গাঢ় সবুজ বর্ণের সাইপ্রেস, চিনার আর দেবদারু ঘেরা এবং মার্বেলের স্তম্ভের উপরে চীনা পোর্সেলিনের কারুকাজ করা প্রশস্ত ভবনের একটায় রাত কাটাবে। সে জানে, তৈমূরও বাগানে রাত কাটাতে পছন্দ করতো। সে দুটো নহরের সঙ্গমস্থলের উপরে স্থাপিত একটা মঞ্চে নিজের সিংহাসন স্থাপনের মত নির্দেশও দিয়েছিলো। বহমান চারটা ধারা জীবনের চারটে নদীর স্মারক আর ভূগোলকের চারপ্রান্তে তার আধিপত্যের উপস্থাপক।
বাবর তৈমূরের কথা যতই ভাবছে ততই শ্বাসরুদ্ধকর বলে প্রতিয়মান হয় তার দৃষ্টিভঙ্গি আর আকাঙ্ক্ষা। নিজেকে তৈমূরের উত্তরাধিকারী বলাটা সহজ, কিন্তু যখন সে এর দ্যোতনার কথা বিবেচনা করে, সে একাধারে উল্লসিত আর অকিঞ্চিৎকর বোধ করে।
কিছু একটা সম্ভবত তিতিরের ডাক- তাকে স্বপ্ন থেকে জাগিয়ে তোলে। সে চমকে উঠে বসে এবং চারপাশে তাকায়। এই বিলাসিতা- মেঝেতে ধূসর গজদন্ত আর কালো আবলুস কাঠের কারুকাজ, মার্বেলের ভাস্কর্য, সোনার পানপাত্রে পান্না, ফিরোজা আর চুনির কারুকাজ- এসব অবাস্তব বলে মনে হয়। সোনার সুতার কাজ করা গোলাপী রঙের যে রেশমের চাদরে সে শুয়ে আছে সেটায় হাত বুলিয়ে দেখে। গোলাপী পাথরের কারুকাজ সংবলিত রূপা আর সোনার জলে সূক্ষ গিল্টি করা অন্তঃপট তার আর পরিচারকদের দৃষ্টির মাঝে একটা আড়ালের জন্ম দিয়েছে।
গ্রান্ড উজির যত অপরাধই করে থাকুক, সে অন্তত তৈমূরের গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদের ভালই যত্ন নিয়েছিলেন। গোলমালের প্রাথমিক আভাস পাবার সাথে সাথেই তিনি সব মূল্যবান গালিচা, ঝালর আর ফুলদানী এবং পাত্রসমূহ সমরকন্দে নিয়ে যাবার আদেশ দিয়েছিলেন, যা তিনি সেখানের দূর্গপ্রাসাদের ভূগর্ভস্থ কোষাগারে গোপনে সংরক্ষণ করেছিলেন। উজিরের পারিষদবর্গ নতুন শাসকের কাছে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণের অভিপ্রায়ে দ্রুত এসব কিছুর অবস্থান বাবরের লোকদের কাছে প্রকাশ করেছে। যদিও প্রাসাদের অনেক মূল্যবান অলংকরণ কুপিয়ে তুলে ফেলা হয়েছে আর অবরোধেরকালে কাঠের তৈরি কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ ভবন জ্বালানী কাঠের জন্য ভেঙে ফেলা হয়েছে, বাবর ভেবে দেখে প্রাসাদের আসল সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনতে খুব একটা বেশি খাটাখাটনির প্রয়োজন হবে না।
শহরটা নিরাপদ হলে সে যখন তার আম্মাজান, আর বোনকে এখানে ডেকে আনবে, তখন তারা কি বলবে সেটা ভেবে বাবর নিজের মনেই হেসে উঠে। সমরকন্দের প্রসিদ্ধ পুরু কাগজে লেখা তার চিঠিগুলোতে শহরের ইতিহাস, মহিমা কিংবা বিশালতার প্রতি সে মোটেই সুবিচার করতে পারেনি। এই শহরটা আর যাই হোক আঠারশ বছর আগে সোনালী চুলের, নীল চোখের দিগ্বিজয়ী বীর আলেকজান্ডার কর্তৃক স্থাপিত। যিনি সুদূর পশ্চিম থেকে তার সেনাবাহিনী নিয়ে তৈমূরের মতই সব প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করে এসেছিলেন। চওড়া র্যামপার্টযুক্ত সমরকন্দের বাইরের দেয়াল বাবর মেপে দেখতে বললে দেখা যায় একজন প্রাপ্তবয়স্ক লোকের পুরো চারপাশটা ঘুরে আসতে এগার হাজার পা হাঁটতে হয়। তৈমূর তার শহরের নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রতি আসলেই লক্ষ্য রেখেছিলেন- অবশ্য বাবরের প্রথম রাজকীয় আদেশ ছিল যে সুড়ঙ্গ পথে সে ভেতরে প্রবেশ করেছিলো সেটার মুখ পাথর দিয়ে বন্ধ করে দেয়া। সে চায় না অন্যরা- এবং যাদের সংখ্যা অনেক যারা সমরকন্দের দিকে শকুনের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে- আক্ষরিক অর্থে তার পদচিহ্ন অনুসরণ করুক। সে আরও কোনো সুড়ঙ্গ আছে কি না সেটা তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখবারও আদেশ দেয়।
বাবর আবার তার মাথার চাপে দেবে বসে থাকা বালিশে শুয়ে পড়ে। গত কয়েক সপ্তাহের দৃশ্যপট আর অভিজ্ঞতা এতটাই সমৃদ্ধ যে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় এত অল্প সময় অতিবাহিত হয়েছে। কাছে লেখা তার চিঠিগুলো, যিনি এসব বিষয়ে দারুণ আগ্রহী, সে শহরের বাইরে কোহাক টিলায় অবস্থিত তিনতলা বিশিষ্ট বৃত্তাকার মানমন্দির প্রথমবারের মত দেখে তার বিস্ময়ের কথা চিঠিতে ফুটিয়ে তুলতে চায়, যেখানে তৈমূরের নাতি উলুঘ বেগ সৌর আর চন্দ্র বর্ষপঞ্জি নিয়ে গবেষণা করতেন। বাবর হতবাক হয়ে, উলুঘ বেগের সেক্সট্যান্টের ইটের তৈরি মার্বেলের আস্তরণ দেয়া নিখুঁত বৃত্তচাপটা দেখে, প্রায় দুইশ ফিট লম্বা এবং একশ ত্রিশ ফিট তার ব্যাসার্ধ আর রাশিচক্রের বিভিন্ন চিহ্ন দ্বারা অলংকৃত। সেক্সট্যান্টের উভয় পার্শ্বে ধাতব রেলের উপরে স্থাপিত এ্যাস্ট্রোলোব ব্যবহার করে উলুঘ বেগ তার পর্যবেক্ষণ করতেন।
সবুজ মাঠের উপর দিয়ে পঙ্গপালের মত একটা ধ্বংসের মেঘের ন্যায় বিচরণ করে তৈমূরের যোদ্ধারা যদি পৃথিবী জয় করে থাকে, তবে তার উত্তরসুরী উলুঘ বেগ স্বর্গ দখল করেছেন। সমরকন্দের জ্যোতিষবিদরা এখনও তার তৈরি করা রাজকীয় জ্যোতিষবিদ্যার চার্ট ব্যবহার করে। বাবর তার পর্যবেক্ষণ আরও বেশি করে পাঠ করতে চায় কিন্তু তারপরেও মানমন্দিরের পরিশীলিত সূক্ষ মাত্রা তার ভিতরে নিজের পূর্বপুরুষ সম্পর্কে এক ধরণের গর্বের জন্ম দেয়। উলুঘ বেগের নিজের ছেলে, বাবার জ্ঞান আর বীক্ষার প্রতি এই সাধনায় অস্বস্তিবোধ নিজের করে এবং ধর্মান্ধ মৌলবাদী মোল্লাদের প্ররোচণায়, যারা ভয় পেয়েছিল হয়ত এর ফলে তাদের রহস্যের মূল উন্মোচিত হয়ে পড়বে আর তাদের ধর্মমত প্রশ্নের সম্মুখীন হবে, নিজের পিতাকে খুন করে।
উলুঘ বেগের নির্মিত মাদ্রাসা বাবর পরিদর্শন করেছে। রেজিস্তান প্রাঙ্গনের একপাশে সেটা অবস্থিত এবং আকাশী আর সবুজাভ-নীল টালিতে শোভিত, এর নকশা এতটাই জটিল যে লোকেরা একে হাজারবাফ “সহস্র-স্রোত” বলে থাকে। শহরের একেবারে কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত বিবি খানম মসজিদ তাকে পুরোপুরি অভিভূত করে। মসজিদটা তার ফারগানার দূর্গের আড়ম্বরহীন, সাদামাটা মসজিদের থেকে একেবারেই আলাদা, যেখানে পূর্ণিমার আলোয় গোত্রপতিরা তার প্রতি অনুগত থাকবার শপথ নিয়েছিল, আজ ঘটনাটাকে মনে হয় যেন বহুযুগ আগের কোনো কথা।
এক মোল্লা বাবরকে বলেছে, কিভাবে তৈমূরের প্রিয় স্ত্রী, বিবি খানম, গজদন্তের মত দেহের তৃক বিশিষ্ট চীনা রাজকুমারী যার দীপ্ত সৌন্দর্য অবলোকন করে তৈমূরের চোখে জল চলে আসত, কোনো একটা অভিযান থেকে ফিরে আসবার পরে তৈমূরকে একটা চমক দেবার জন্য মসজিদটা তৈরি করেছিলেন। কিন্তু পারস্য থেকে মসজিদটা নির্মাণের জন্য রাণীর ডেকে আনা স্থপতি, মুহূর্তের স্বেচ্ছাচারী আবেগেতাড়িত হয়ে, তাকে আলিঙ্গন করে গলায় একটা কামড়ের দাগ বসিয়ে দেয়। এই ঘটনার মাত্র কয়েকদিন পরেই তৈমূর তার অভিযান থেকে ফিরে এসে তার স্ত্রীর আপাত খুঁতহীন ত্বকে দাগটা লক্ষ্য করে এবং খালুমের কাছে পুরো ঘটনাটা শুনে সেই বেয়াদপ স্থপতিকে ধরে আনবার জন্য লোক পাঠালে, সে ভয়তরাসে তার সদ্য তৈরি করা আকাশ-স্পর্শী মিনারের একটার উপর থেকে লাফিয়ে পড়ে। কাহিনীটার সারবত্ত্বা যাই হোক, লম্বা অভিজাত প্রবেশ পথের দু’পাশে দেড়শ ফুটের বেশি উঁচু মিনার আর তার চেয়েও উঁচুতে অবস্থিত মসজিদটার গম্বুজ- মোজাইকের দ্বারা অলংকৃত- দেখে বাবরের ভিতরে একটা ভয় জাগান সমবোধ জেগে উঠে।
বাবর হাই তুলে এবং আড়মোড়া ভাঙে। তার আম্মিজান যখন সমরকন্দে পৌঁছাবে তিনি আনন্দিত আর পুলকিত হবেন এবং খানজাদা কৌতূহল আর উত্তেজনায় কেমন একটা ঘোরের ভেতরে থাকবে। কিন্তু এসান দৌলতের ব্যাপারটা সে ঠিক অনুধাবন করতে পারে না। তার খুশি করাটা খুব কঠিন একটা কাজ। সে কল্পনার চোখে দেখতে পায়, বলিরেখায় জর্জরিত মুখের সঙ্কটা মোকাবেলায় প্রস্তুত কালো কালো খুদে দুই চোখে তাকিয়ে তিনি মাথা নাড়ছেন এবং সাফল্যের কারণে বেশি উৎফুল্ল না হয়ে তাকে ভাবতে বলছেন এরপরে কি অপেক্ষা করছে।
বাবর ভাবে, সে যাই হোক তারপরেও সে তার অধিকার আদায় করে নিয়েছে। নিয়তির বাড়িয়ে দেয়া সুযোগ সে অকুণ্ঠ চিত্তে গ্রহণ করেছে। সে হাততালি দিতে একজন পরিচারক সাথে সাথে একটা বিশাল রূপার পাত্র যা এক জগ গোলাপজল মেশান উষ্ণ পানি দিয়ে পূর্ণ নিয়ে হাজির হয়। পাত্রটা সাবধানে নিয়ে সে বাবরের দিকে এগিয়ে আসে, হাতে ধরা একটা কাপড় দিয়ে তাকে পরিষ্কার করার উদ্দেশ্যে। কিন্তু সে হাত নেড়ে তাকে বিদায় করে। তার সব কাজ অন্য কেউ করে দেবে এখনও সে পুরো এই ব্যবস্থার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারেনি এবং পরিচারককে সে তার বিছানার পাশে রাখা ছোট টেবিলে কাপড় আর পানির পাত্রটা রেখে যেতে বলে। পানির সমতল পৃষ্ঠে ভেসে উঠা নিজের অবয়বের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ফারগানার কোনো একটা পাহাড়ী ঝর্ণার শীতল পানিতে মাথা ডোবানোর একটা অপ্রত্যাশিত ইচ্ছা তাকে পেয়ে বসে।
কিন্তু তার এই ভাবনার রেশ সদ্য তৈরি করা রুটি আর পরিজের মন মাতান গন্ধে বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। বেহেশতে বাস করার সময়ে সে যদি বাড়ির কথা ভেবে বা অন্য কারণে মন খারাপ করে তাহলে তাকে আহাম্মক বলতে হবে। তার লোকদেরও আপাতভাবে সন্তুষ্ট মনে হয়- যা একটা বিরল ব্যাপার, গলা আর কাঁধ ডলে পরিষ্কার করতে করতে সে ভাবে। অবশ্য, সে তাদের তার প্রতিশ্রুতিমত বা তার চেয়েও বেশি পুরস্কৃত করেছে। সমরকন্দের মোহরে ঠাসা সিন্দুক তাকে উদার হতে এক্ষেত্রে যথেষ্ট সহায়তা করেছে। সে তার সব গোত্রপতিকে একশটা করে সোনার আশরফি আর তাদের অধিনস্ত লোকদের আশাতীত রকমের রৌপ্যমুদ্রা দিয়েছে। বাবর অবশ্য প্রাপ্ত ধনসম্পদের একটা ভাল অংশ ফারগানায় তার প্রতিনিধি কাশিম আর তার অনুসারীদের পুরস্কৃত করতে আর আশেপাশের ঝামেলাবাজ গোত্রগুলোর আনুগত্য যাতে সে বজায় রাখতে পারে সেজন্য পাঠাতে ভুল করেনি। বাবরের অনেক লোকই নতুন দ্বার পরিগ্রহ করেছে। সে যেমনটা আশা করেছিলো, গ্রান্ড উজিরের হারেমের তরুণীর দল অনেকটা আগ্রহের সাথেই তার লোকদের সাথে গিয়েছে। টাকার থলে ভর্তি বিজয়ী যোদ্ধার আবেদন ছোট করে দেখার উপায় নেই।
তার এখন পোশাক পরার সময় হয়েছে। নিজের অসহিষ্ণুতা চেপে রেখে সে তার অনুচরদের মোসাহেবের ভঙ্গিতে তাকে ঘিরে ধরে, নরম হরিণের চামড়া দিয়ে তৈরি পাজামা আর সাদা রেশমের কাফতানে তাকে সুসজ্জিত করে তোলার অনুমতি দেয়, তারপরে তাদের বাড়িয়ে রাখা রেশমের একাধিক কারুকাজ করা টিউনিক থেকে একটা- তার নতুন প্রজাদের মন রক্ষার্থে উজ্জ্বল সবুজ রঙের যাতে তার ফারগানার হলুদ ডোরাকাটা রয়েছে সাথে ইস্পাতের বকলেস- সে পছন্দ করে। ফারগানার রুক্ষ কাপড় আর যেনতেন প্রকারে হরিণের চামড়া থেকে তৈরি পোশাকের চেয়ে সমরকন্দের দর্জির নিখুঁত সেলাই করা পোশাক একদম আলাদা মনে হয়। এক পরিচারক তার কোমরে একটা সঞ্জাবযুক্ত পরিকর গাণিতিক নিপূণতায় পরিয়ে দেয়। আরেকজন পায়ের কাছে বসে হাঁটু পর্যন্ত লম্বা সোনার সুতা দিয়ে কারুকাজ করা বুট পরতে সাহায্য করে। তারপরে চন্দনকাঠের একটা বাক্স থেকে বাবর কিছু অলঙ্কার পছন্দ করে। গয়নার প্রতি তার কোনো বিশেষ আগ্রহ নেই কিন্তু আজ বিবি খানম মসজিদে তাকে লোকজনের সাথে নামাজ পড়তে হবে আর উৎসুক জনতার চোখে তাকে যেন পুরোদস্তুর একজন সুলতানের মত দেখায়, যার প্রাচুর্য– আর একই সাথে তার উদারতা- সতত পরিবর্তনশীল মৈত্রী আর আনুগত্যের দুনিয়ায় যেন অফুরন্ত।
সামনে রাজদণ্ড-বহনকারী আর পেছনে লম্বা চারজন দেহরক্ষী নিয়ে বাবর মার্বেল মোড়া পথের উপর দিয়ে হেঁটে বাগানের দিকে আসে, যেখানে ফুল লতা পাতা শোভিত চাদোয়ার নিচে বিছান গালিচায় তার পারিষদবর্গ আসনপিড়ি হয়ে বসে তার অপেক্ষা করছে। এইসব দীর্ঘ বৈঠক বাবরের বিরক্ত লাগে কিন্তু এখনও অনেক কাজ বাকী রয়েছে। তার চাচাজানের মৃত্যুর পরে উদ্ভূত অনিশ্চয়তা আর দ্বন্দ্ব এবং তারপরে তার অবরোধে অনেক ক্ষতি সাধিত হয়েছে। সমরকন্দের চারপাশের ক্ষেত আর তৃণভূমি যথেষ্ট উর্বর, কিন্তু কৃষকরা ভয়ে চাষই করেনি এবং এ বছরের ফসলের অনেকটাই নষ্ট হয়েছে। ফারগানা থেকে নিজেদের রসদের জন্য আনা শস্যবীজ আগামী বসন্তে চাষীরা যাতে চাষের কাজে ব্যবহার করতে পারে সেজন্য তাদের মাঝে বন্টনের আদেশ দিয়েছে বাবর। আর এছাড়া পশুপালকদের অনেকেই যুদ্ধের হাঙ্গামা থেকে দূরে পশ্চিমের নিজেদের গৃহপালিত পশুর পাল নিয়ে পালিয়ে গেছে। তাদেরও অভয় দিয়ে ফিরিয়ে আনার বন্দোবস্ত করতে হবে।
বাবর ভাবে, তাকে সাহায্য করার জন্য যোগ্য লোক অন্তত তার পাশে আছে। ওয়াজির খান, তার ইচকিসের, পারিষদবর্গের ভিতরে অন্যতম। এছাড়াও বাইসানগার আছে, সমরকন্দের সৈন্যরা তাকে প্রচণ্ড শ্রদ্ধা করে। শহরের পতনের পরেই কেবল বাবর বুঝতে পেরেছে বাইসানগারের স্তোকবাক্য, নাশকতামূলক তৎপরতা, আর ঘুষের কারণে তাকে এত দুর্বল প্রতিপক্ষ মোকাবেলা করতে হয়েছে। তার প্রতি কৃতজ্ঞতাবশত, সমরকন্দের পুরো নিরাপত্তার দায়িত্ব বাবর বাইসানগারের উপরে অর্পণ করেছে।
আলি মজিদ বেগের পোড় খাওয়া মুখের উপরে তার দৃষ্টি আপতিত হয়। তাকে পারিষদবর্গের অন্তর্ভূক্ত করে সে বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছে। অনেকটা অতীত আনুগত্যের কারণে পুরষ্কার যে কয়েকজন গোত্রপতি শুরু থেকে দ্ব্যর্থহীনভাবে শুরু থেকে বাবরকে সমর্থন জানিয়ে এসেছে, সে তাদের অন্যতম। কিন্তু এর ভেতরেও বিচক্ষণতার মারপ্যাঁচ রয়েছে। আলি মজিদ বেগ ফারগানার অন্যতম প্রভাবশালী গোত্রপতি। সমরকন্দে সে যে বাবরের সাথে অবস্থান করছে এটা অনেককেই প্রভাবিত করেছে- বাবরের ধারণা যাদের ভিতরে অনেকেই এই মুহূর্তেই ফারগানায় ফিরে যেতে চায়- থাকতে।
কিন্তু, অনেকেই অবশ্য ফিরে গিয়েছে। তারা এই অভিযানে এসেছিলো লুট করতে আর একবার সেটা পাবার পরে বাড়ি ফিরে যাবার জন্য তারা অধীর হয়ে উঠেছে। বুনো আর উচ্ছঙ্খল চকরাস, নিষ্ঠুরতা আর বিশ্বাসঘাতকতা যেখানে নৈমিত্তিক ব্যাপার সেখানেও তারা তাদের সতত পরিবর্তনশীল মনোভাব আর নির্মমতার জন্য বিখ্যাত। তাদের দুর্গম পাহাড়ী আশ্রয়ের উদ্দেশ্যে সটকে পড়তে শুরু করেছে এবং শরৎ কাল এসে পড়ার কারণে প্রতিদিনই আরও বেশি সংখ্যক লোক চলে যাচ্ছে। বাবরের পারিষদগণ সে এগিয়ে আসতে নতজানু হয়। কিন্তু সে হাতের ইশারায় তাদের উঠে দাঁড়াবার ইঙ্গিত দেয়। দিনের কাজ শুরু করার জন্য সে উদগ্রীব হয়ে আছে। সে ইতিমধ্যে একটা কথা হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছে যে, একজন সুলতানকে বড় বড় ব্যাপারেই মাথা ঘামালে কেবল চলবে না। মাত্র গতকালের ঘটনা, শকুনের মত দেখতে দুই গালিচা ব্যবসায়ীর ভিতরে উদ্ভূত ঝগড়ার মধ্যস্থতা তাকে করতে হয়েছে। সুদূর পারস্যের তিবরিজ থেকে আনা লাল, গোলাপী আর নীলরঙের গালিচার মূল্য নিয়ে দুজনেই বালখিল্যসুলভ বিবাদে লিপ্ত হয়েছিলো। সেই জানে। কিভাবে সে হাসি চেপে রেখেছিলো।
“সুলতান, এগুলো আজকের দিনের আর্জি।” তার পরিচারক হাতের রূপার ট্রের দিকে ইঙ্গিত করে। সেখানে একতাড়া কাগজ। বাতাসে যাতে উড়ে না যায় সেজন্য একটা পিতলের ওজন দিয়ে চেপে রাখা আছে।
উপরের আর্জিতে লেখা বিবরণীর দিকে তাকিয়ে বাবরের মন হতাশায় ভরে ওঠে। সম্ভবত কারো ছাগল বা ভেড়া হারিয়ে গেছে বা পাহাড়ের বিরান জমিতে পশুচারণের অধিকার চেয়ে কোনো আর্জি। “আমি ওগুলো পরে দেখবো।” এসবের চেয়ে শিকারে যাবার জন্য তার ভেতরটা ছটফট করে। সে হাতের ইশারায় তার পারিষদবর্গকে বসতে বলে এবং কাঠের নিচু মঞ্চের উপরে তার জন্য নির্দিষ্ট গজদন্তের কারুকাজ করা টুলে উপবেশন করে। তাদের মতো নিচে আসনপিড়ি হয়ে বসা অনেক বেশি কষ্টকর।
“শহরের নিরাপত্তার পর্যালোচনা কবে নাগাদ শেষ হবে?” সে বাইসানগারকে জিজ্ঞেস করে।
“সুলতান, প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। অস্ত্রাগারে অস্ত্রের মজুদের চুড়ান্ত হিসাব সম্পন্ন হয়েছে। তবে রাজমিস্ত্রীরা এখনও শহর রক্ষাকারী দেয়াল আর র্যামপার্টের অবস্থা খুঁটিয়ে দেখছে। তারা বলেছে দু’বছর আগের ভূমিকম্পে দেয়ালের কয়েক জায়গার ভিতে ক্ষতি হয়েছে যা মেরামত করতে হবে।”
বাবর মাথা নেড়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে। “মেরামত যা কিছু করার, সব দ্রুত শেষ করতে হবে। এতো সহজে সমরকন্দের পতন হয়েছে যে ব্যাপারটা আরো অনেকের মনোযোগ আকর্ষণ করবে। ওয়াজির খান, সাইবানি খান আর তার হায়েনাদের কি খবর?”
“তাদের ফিরে আসবার জন্য আমরা সর্বদা সতর্ক রয়েছি। কিন্তু আমাদের সীমান্তে টহল দেয়া সৈন্যরা এখনও উজবেক আক্রমণকারীদের কোনো আনাগোনা লক্ষ্য করেনি। সাইবানি খান জানে শীতকালের আগে আক্রমণ করার জন্য তার হাতে অল্প সময় আছে।”
“কিন্তু সে অবশ্যই আসবে।” চিন্তিত কণ্ঠে বাবর বলে। সাইবানি খান ইতিমধ্যে সমরকন্দের একজন সুলতানকে হত্যা করেছে: আরেকজনকে বিশেষ করে কিশোর আর সদ্য সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়েছে এমন একজনকে হত্যা করতে তার ইতস্তত করার কোনো সঙ্গত কারণ নেই।
“হ্যাঁ, সুলতান, আমি জানি সেটা। আমরা সবাই জানি। কিন্তু বসন্তের আগে সে এখানে আসবে না। আমরা ততোদিনে তাকে আর তার বদমায়েশ শিষ্যগুলোকে একটা ভালো শিক্ষা দেবার জন্য প্রস্তুত থাকবো।” ওয়াজির খানের আত্মবিশ্বাস বাবরকে সামান্য হলেও স্বস্তি দেয়।
সহসা অনেকগুলোর কণ্ঠস্বর শুনে তারা সবাই চারপাশে তাকায়। উদ্যানের বিপরীত দিকে কমলা রঙের ম্যারিগোল্ড আর গোলাপী রঙের গোলাপের বাগিচার অপরপাশে, বাবর একজন প্রহরীর সাথে ঝুঁকেপড়া ক্ষুদে একটা অবয়বকে তাদের দিকে হেঁটে আসতে দেখে। লোকটার পরণে ভ্রমণের পোশাক এবং সে কাছে এসে রাস্তার ধূলো থেকে বাঁচবার জন্য মুখের চারপাশে জড়িয়ে রাখা বেগুনী রঙের গলবস্ত্র খুলতে বাবর তার দাদীজানের বয়োবৃদ্ধ খিদমতগার, ওয়ালিদ বাট্টের, বলিরেখায় পূর্ণ মুখমণ্ডল আর পাতলা হয়ে আসা সাদা চুল চিনতে পারে। তাকে দেখে বাবরের কেমন যেনো বিপর্যস্ত মনে হয়, আর সেটার কারণ ঘোড়ায় চড়ে দীর্ঘপত্র পরিক্রমা না- তার বয়সী লোকের জন্য অবশ্য সেটাই যথেষ্ট উপলক্ষ- বরং সে সাথে করে যে লেফাফা নিয়ে এসেছে সেটা।
এক মুহূর্তের জন্য, গ্রীষ্মকালের সন্ধ্যাবেলা সত্ত্বেও বাবর টের পায় একটা শিরশিরে অনুভূতি তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। এসান দৌলত কি তবে মৃত? দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে সে মঞ্চ থেকে নেমে বৃদ্ধ লোকটার কাঁধ জড়িয়ে ধরে। “খিদমতগার কি হয়েছে খুলে বলো? কি সংবাদ তুমি নিয়ে এসেছো?”
ওয়ালিদ বাট্ট ইতস্তত করে, যেনো বুঝতে পারে না কোথা থেকে শুরু করবে। বাবরের ইচ্ছা করে এক ধমকে তার ইতস্ততভাব ঘুচিয়ে দেয়। কিন্তু জন্মের পর থেকে দেখে আসা লোকটার প্রতি তার শ্রদ্ধাবোধের কথা স্মরণ রেখে সে নিজের অসহিষ্ণুতা দমন করে।
“সুলতান, আপনার কাছে এভাবে হাজির হয়েছি বলে আমার অপরাধ মার্জনা করবেন কিন্তু আমাকে দ্রুত আসতে হয়েছে।” খিদমতগার আলখাল্লার ভিতর থেকে একটা চামড়ার থলে বের করে যা একটা ছোট দড়ির সাহায্যে তার গলা থেকে ঝুলছিল এবং সেটার ভেতর থেকে সে ফারগানার রাজকীয় সিলমোহর করা একটা চিঠি বের করে।
বাবর চিঠিটা নিয়ে দ্রুত সেটা খুলে পড়তে শুরু করে। হাতের লেখা দেখে সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে কিন্তু তার মানসিক প্রশান্তি অচিরেই বাষ্পীভূত হয়। এসান দৌলতের লেখা শব্দগুলো তার চোখের সামনে যেনো নাচতে শুরু করে। “তুমি যদি আমাদের বিপর্যয়ে সাড়া না দাও তবে আমরা নিশ্চিত ধ্বংসের মুখোমুখি হবো।” পুরো চিঠিটা সে দ্রুত পড়া শেষ করে, কথা পুরোপুরি আত্মস্থ করতে পেরে তার হতভম্বভাবটা আরো বেড়ে যায়।
“কি হয়েছে, সুলতান?” ওয়াজির খান জানতে চায়।
“আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে। আমার জারজ সৎ-ভাই জাহাঙ্গীরকে ফারগানার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করা হয়েছে- একটা বাচ্চা পুতুল যাকে নিয়ে খেলছে আমার রক্তসম্পর্কীয় ভাই তামবাল। উপজাতি গোত্রপতিদের বখশিশের লোভ দেখিয়ে সে দলে টেনেছে…নিজের সুবিধার্থে সে জাহাঙ্গীরকে ব্যবহার করছে…” বাবরের আঙ্গুলের ফাঁক গলে চিঠিটা মাটিতে পড়ে গেলে বাতাস সেটাকে উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে গোলাপ ঝাড়ে আটকে দেয়। সে ভাবে আমার জন্মভূমির মসনদ আমি হারিয়েছি।
ওয়াজির খান চিঠিটা তুলে নিয়ে দ্রুত পড়তে থাকলে আরেকটা আরো ভয়ঙ্কর সম্ভাবনা বাবরের মাথায় উঁকি দেয়। আবার সে ওয়ালিদ বাট্টের কাঁধ চেপে ধরে। এবার এতোটাই জোরে যে কবুতরের মতো পলকা বৃদ্ধ লোকটা ব্যাথায় গুঙিয়ে উঠে। আমার মা, বোন আর নানীকে তুমি শেষবার কখন দেখেছো? তারা কোথায় আছে? তারা কি নিরাপদ আছে?”
ওয়ালিদ বাট্ট অসহায় দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। “দূর্গে আপনার উজির কাশিম আর তাদের সবাইকে বন্দি করে রাখা হয়েছে। আপনার নানীজান অনেক কষ্টে এই চিঠিটা আমাকে দিয়ে বলেছেন আপনার কাছে পৌঁছে দিতে। কিন্তু আমি বলতে পারবো না তারা জীবিত না মৃত। আমি জানি না। গত দু’সপ্তাহ আমার রাস্তাতেই কেটেছে।” তার কণ্ঠস্বর ভেঙে আসে।
সে সহসা টের পায় বুড়ো লোকটাকে ব্যাথা দিচ্ছে, বাবর তার মুঠো আলগা করে। “খিদমতগার, তুমি তোমার দায়িত্ব পালন করেছে। এখন খেয়েদেয়ে বিশ্রাম নাও। তোমার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।” পেছন থেকে ওয়ালিদ বাট্টের দিকে তাকিয়ে তার মনে হয় বাতাস একটু জোরে বইলে বেচারার ক্ষীণকায় দেহ বোধহয় উড়েই যাবে।
বাবর বিচলিত বোধ করে। তার প্রারম্ভিক অবিশ্বাসের জায়গায় জলোচ্ছাসের মত ক্রোধ এসে ভর করে। তামবালের এত বড় আস্পর্ধা তার সালতানাত দখল করে তারই পরিবারকে অন্তরীণ করেছে…? কিন্তু সে নিজের মনোভাব নিয়ন্ত্রণ করতে চেষ্টা করে। সে এখন যে সিদ্ধান্ত নেবে তার উপরেই সবকিছু নির্ভর করছে। তার দিকে উদগ্রীব চোখে তাকিয়ে থাকা পারিষদবর্গের দিকে তাকিয়ে সে একটা গভীর শ্বাস নেয়।
“ওয়াজির খান, আমার দেহরক্ষী বাহিনীকে প্রস্তুত করেন। আমরা এই মুহূর্তেই ফারগানার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবো। বাইসানগার একটা বাহিনী প্রস্তুত করেন। আমার অধীনস্ত গোত্রপতি আর তাদের লোকদের ডেকে পাঠান- তামবাল আর তার অনুগত উপজাতীয় বাহিনীকে শায়েস্তা করতে হলে দু’হাজার লোকের বাহিনীই যথেষ্ট হবে। আমার ধারণা একবার আকশি পৌঁছালে ফারগানার বেশিরভাগ লোকই তাদের ন্যায়সঙ্গত সুলতানের পক্ষ সমর্থন করবে। যাই হোক, সাইবানি খান আসলে যাতে নিরাশ না হয়, সেজন্য এখানে যথেষ্ট সেনা মোতায়েন রাখেন এবং এক সপ্তাহের ভিতরে আমাদের অনুসরণ করবেন। আর হ্যাঁ, দুরমুজ আর অবরোধ যন্ত্র এবং নিক্ষেপক প্রস্তুত রাখবেন, যেনো আমি নির্দেশ পাঠালে সাথে সাথে পাঠাতে পারেন। আলি মজিদ বেগ আমার অনুপস্থিতিতে আপনি সমরকন্দের রাজপ্রতিনিধি হিসাবে দায়িত্বপালন করবেন। ঠিকমতো পাহারা দেবেন আশা করি।”
তিন বয়স্ক লোক মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। বাবর তার অলংকার খুলতে খুলতে ঘুরে দাঁড়ায় এবং তার ঘোড়সওয়ারের পোশাক আর হাতিয়ার আনতে আদেশ দেয়।
***
ওয়াজির খানের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সে গ্রীষ্মের দাবদাহে এখনও তৃণহীন চারণভূমির উপর দিয়ে ঘোড়া হাকিয়ে যায়। বাবরের মনে নিদারুণ যন্ত্রণার ঝড় বয়ে চলে। নিজের পরিবারের জন্য অপরাধবোধ আর ভয় এবং যারা নয় বছরের এক বালকের সাহায্যে তাকে তার সালতানাত থেকে উচ্ছেদ করতে পারবে বলে ভেবেছে তাদের জন্য তার ভেতরে ক্রোধের দাবাগ্নি ধিকিধিকি জ্বলতে থাকে। গত কয়েক সপ্তাহ সে মূখের স্বর্গে বাস করেছে। স্বপ্নহতের মত সমরকন্দের চারপাশে বিচরণ করে বেড়িয়েছে, নিজের পরিবারকে কিভাবে এই রূপকথার শহর দেখাবে তার পরিকল্পনা করেছে।
ঔদ্ধত্যের সাথে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টাই সে এড়িয়ে গেছে। ভেবেছে ফারগানায় সবাই তাকে বীরের চোখে দেখবে আর বিদ্রোহের কথা কল্পনাও করবে না। তামবাল আর তার সমর্থকেরা নেকড়ের মতো পশুপালকের পিঠ ঘুরিয়ে নেয়া পর্যন্ত ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করেছে। যাতে তারা নিশ্চিন্তে ভেড়ার পালের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। আর ব্যাটারা অবশ্যই ধূর্ত, নতুবা তার নানীজান, আম্মিজান অথবা কাশিম ঠিকই কিছু একটা গোলমালের আভাস আঁচ করে এবং বাবরকে আগেই সতর্ক করতো। তার পরিবারের মেয়েদের যদি কিছু হয়…রোক্সানা যদি ফারগানার নতুন সুলতানের মা হিসাবে তার প্রতিপক্ষ আর শত্রুদের বিনাশ করতে চায়… সে বিষয়টা নিয়ে আর চিন্তা করতে চায় না।
প্রতি রাতে ঘোড়ার পিঠে বহু ঘণ্টা কাটিয়ে তারা যখন ক্লান্ত হয়ে হয়ে অস্থায়ী ছাউনি ফেলে, তখনও বাবর দুচোখের পাতা এক করতে পারে না। পূর্বদিকে না এগিয়ে বৃথা বিশ্রামে কাটানো প্রতিটা মুহূর্ত তার কাছে বিষবৎ মনে হয় এবং তাকে বিশ্রাম নিতে অনুরোধ করায় সে খামোখাই ওয়াজির খানের উপরে ক্ষেপে উঠে। কিন্তু চতুর্থ রাত্রে ঘুমাবার কোনো প্রশ্নই উঠে না। মাটিতে পাতা বিছানায় পিঠ দেয়া মাত্র সে কাঁপতে থাকে এবং তার কপাল ঘামে ভিজে উঠে। সকাল নাগাদ তার দাঁতে দাঁত লেগে এমন ঠকঠক করতে থাকে যে, সে কোনো কথাই বলতে পারে না। সে যখন উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করে তার পা দেহের ভার নিতে অস্বীকার করায় সে অসহায়ের মতো আবার মাটিতে শুয়ে পড়ে। ওয়াজির খান নিমেষে তার পাশে এসে উপস্থিত হয়, নাড়ী দেখে চোখের পাতা টেনে ধরে মণি দেখতে। “সুলতান আজ আপনি অশ্বারোহন করতে পারবেন না।”
এই প্রথম বাবর তর্ক করার মত শক্তি খুঁজে পায় না। সে টের পায় ওয়াজির খান তার দেহ ভারী উলের কম্বল দিয়ে মুড়ে দিচ্ছে। কিন্তু চোখ তুলে তার দিকে তাকাতে গেলে তার চোখের সামনে পুরো পৃথিবীটা দুলে উঠে এবং আঁধার হয়ে আসে। তারপরে পুরোটা অন্ধকারে ছেয়ে যায়।
***
জ্বরের উত্তাপে শুকিয়ে যাওয়া ঠোঁটের ফাঁকে ফোঁটা ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে। বাবরের জিহ্বা তালুতে অর্ধেক আটকে ছিলো, এখন খুলে এসে আগ্রহের সাথে পানির স্পর্শ গ্রহণ করে। তার কোনো ধারণাই নেই সে কোথায় আছে। মূল্যবান আর্দ্রতা লাভ করাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। অবশেষে কেঁপে উঠে তার চোখের পাতা খুলে যায়। ওয়াজির খানের চিরবিশ্বস্ত অবয়ব তার দিকে ঝুঁকে আছে। এক হাতে একটা লম্বা সুতির কাপড়ের টুকরো ধরে রয়েছে। তার অন্য হাতে একটা পানির বোতল। বাবরকে জ্ঞান ফিরে পেতে দেখে সেগুলো মাটিতে নামিয়ে রেখে সে হাঁটু মুড়ে বসে অপেক্ষা করে।
পিপাসায় বাবরের বুক শুকিয়ে কাঠ হয়ে রয়েছে। আরো পানি।” সে বলতে চেষ্টা করে, কিন্তু শুকনো ঠোঁটের ফাঁক গলে কেবল একটা কর্কশ আর্তনাদ বের হয়। ওয়াজির খান বুঝতে পারে। কাপড়ের টুকরোর একটা প্রান্ত সে বাবরের ঠোঁটের মাঝে স্থাপন করে এবং বাবরের অজান্তে গত এক ঘণ্টা ধরে সে যা করে আসছিলো সেটাই করতে থাকে: কাপড়টাতে পানির একটা ক্ষীণ ধারা ঢালতে থাকে, যাতে বাবরের মুখে কয়েক ফোঁটার বেশি পানি গড়িয়ে না পৌঁছে।
অনেকক্ষণ পরে, বাবর শ্বাসরুদ্ধ হয়ে পানি ছিটকে ফেলে এবং কোনোমতে উঠে বসে। ওয়াজির খান কাপড় আর পানির বোতলটা আবার একপাশে সরিয়ে রাখে এবং তার কপালে হাত রেখে উত্তাপ অনুভব করে। “সুলতান, আপনার জ্বর অবশেষে কমতে শুরু করেছে।”
চারপাশে তাকিয়ে বাবর দেখে তারা একটা ছোট গুহার ভেতরে রয়েছে, যার কেন্দ্রে আগুন জ্বলছে। তার মাথা আবার ঘুরতে শুরু করলে সে চোখ বন্ধ করে ফেলে। “আমি কতদিন ধরে অসুস্থ?”
“সুলতান, চারদিন হয়ে গেছে। আজ পঞ্চমদিনের দুপুরবেলা।”
“কি হয়েছিলো? নিশ্চয়ই বিষের ক্রিয়া না…?”
ওয়াজির খান অসম্মতির ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে। “না। কেবল জ্বর- খুব সম্ভবত ভেড়ার আঁটুলির দংশন।”
বাবর প্রায় হেসে ফেলে- এই সময়ে ভেড়ার আঁটুলির দংশন!
“কে আছে, সুরুয়া নিয়ে এসো।” ওয়াজির খান তার এক লোককে উদ্দেশ্য করে বলে। যবের আটার তৈরি সুরুয়া ভর্তি পাত্রটা নিয়ে আসলে সে বাবরের পাশে হাঁটু ভেঙে বসে এক হাতে পাত্রটা তার মুখের কাছে তুলে ধরে। অন্য হাতে তার মাথাটা। ধরে। উষ্ণ তরলটার স্বাদ ভালই, কিন্তু সামান্য খাবার পরেই তার পাকস্থলী মোচড় দিয়ে উঠলে সে পাত্রটা একপাশে সরিয়ে দেয়।
“সমরকন্দ থেকে কোনো সংবাদ এসেছে? বাইসানগারের সেনাবাহিনী নিয়ে এতদিনে পৌঁছে যাবার কথা।”
“না, সুলতান। কোনো সংবাদ আসেনি।”
“আর ফারগানার কি খবর?” এভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ার জন্য বাবর নিরবে ভাগ্যকে অভিশাপ দেয়। কপাল ভালো হলে এতদিনে ফারগানা তাদের দৃষ্টিসীমায় পৌঁছে যাওয়া উচিত ছিলো।
ওয়াজির খান আবার মাথা নাড়ে। “আমি কোনো সংবাদের প্রত্যাশা করিনি। আমি আমার কোনো লোককে রেকী করতেও পাঠাইনি। আমার একমাত্র অভিপ্রায় ছিলো সুস্থ হয়ে উঠা পর্যন্ত আপনাকে লুকিয়ে রাখা। ফারগানা আর এখানে অনেক গুপ্তচর রয়েছে। আপনার অসুস্থতার সংবাদ ফারগানায় পৌঁছালে-…”
সে বাক্যটা শেষ না করলেও বাবর ঠিকই বুঝতে পারে। বালক সুলতানের পেছনের কুশীলবরা যদি একবার ভেবে নেয় যে সে মারা গেছে তবে তার পরিবারের জেনানারা পরের দিনের সূর্যোদয় দেখার জন্য বেঁচে থাকবে না।
“ধন্যবাদ, ওয়াজির খান। আরো একবার আমার দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে, এমন সব কিছুর প্রতি আপনি লক্ষ্য রেখেছেন।” ওয়াজির খানের কথা শুনে নিজের দুর্দশার কথা তার আবার মনে পড়ে যায়। বাবর আধশোয়া হয়, আশা করে তার দেহে আবার শক্তি ফিরে আসবে। কিন্তু এই মুহূর্তে নিজের দুর্বলতার ব্যাপারে সে পুরোপুরি সচেতন। আজ বাকি দিনটা আমি বিশ্রাম নেবো, কিন্তু কাল থেকে আমরা আবার যাত্রা শুরু করছি।”
“হ্যাঁ, সুলতান আপনার স্বাস্থ্য যদি আমাদের সে অনুমতি দেয়।”
“আমি ঠিকই পিরবো।” বাবর পুনরায় চোখ বন্ধ করে মনে মনে দোয়া করে তার কথাই যেনো ঠিক হয়।
পুরো দিনটা আর রাতের বাকি সময়টা সে ঘুমিয়ে কাটায়। কিন্তু পরের দিন সকালের আলো গুটিগুটি পায়ে গুহার ভিতরে প্রবেশ করতেই তার ঘুম ভেঙে যায়। সতর্কতার সাথে উঠে বসে সে দেখে, মাথা আগের চেয়ে পরিষ্কার লাগছে এবং দুর্বল বোধ করলেও কারো সাহায্য ছাড়াই সে উঠে দাঁড়াতে পারে। গুহার শৈবালের প্রলেপযুক্ত দেয়ালের গায়ে হাত রেখে সে আড়ষ্ঠ ভঙ্গিতে হেঁটে এর মুখের দিকে এগিয়ে আসে এবং মাথা নিচু করে বাইরে বের হয়। ভেড়ার চর্বি দিয়ে জ্বালানো উজ্জ্বল আলোর চারপাশে ওয়াজির খান আর তার কয়েকজন দেহরক্ষী আসনপিড়ি হয়ে বসে রয়েছে। একটা অস্থায়ী কাঠামো থেকে আগুনের উপরে একটা পেতলের কেতলি ঝুলছে।
ওয়াজির খান মাটির কাপে ধোঁয়ার গন্ধযুক্ত একটা উষ্ণ পানীয় আর একটুকরো শুকনো রুটি তার হাতে ধরিয়ে দিলে সে চিবোতে শুরু করে। সে চারপাশে তাকিয়ে লক্ষ্য করে ঘোড়ার পাল দড়ি দিয়ে লতা ঝোঁপের সাথে বেঁধে রাখা হলেও ইতিমধ্যে তাদের পিঠে মালপত্র আর পর্যাণ চাপান শেষ। বরাবরের মতোই ওয়াজির খান সবকিছু ঠিকমতো গুছিয়ে রেখেছে। আধঘণ্টার ভেতরেই তারা নিভুনিভু আগুনের উপরে মাটি চাপা দিয়ে কাছের ঝর্ণা থেকে চামড়ার পানির বোতলগুলো ভরে নিয়ে ঘোড়ায় চেপে বসে।
বাবর তার চিরাচরিত ক্ষিপ্রতা ছাড়াই ঘোড়ার পিঠে উঠে বসলে টের পায় কেবল ওয়াজির খান না, তার দলের বাকি সবাই তাকিয়ে আছে। এক মুহূর্তের জন্য ইতস্তত করে সে সূর্যোদয় আর ফারগানার উদ্দেশ্যে ঘোড়া হাঁকায়।
***
জাক্সারটাস নদী আর তার বাড়ি দূর থেকে চোখে পড়তে বাবরের হৃৎপিণ্ডের গতি দ্রুত হয়ে উঠে। নদীর উপরের চূড়োর অর্ধেকটা নিয়ে নির্মিত দুর্ভেদ্য আকশি দূর্গে তার বাল্যকালের সবচেয়ে মধুর সময় কেটেছে। এই মুহূর্তে সমরকন্দ বিজয়ের গৌরবও তুচ্ছ মনে হয় এবং সে টের পায় তার চোখে অশ্রু জমে উঠছে।
“সুলতান, আজ রাতে আর এগোনো বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।” ওয়াজির খানের। চোখেও অশ্রু টলমল করে। “তারা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আমাদের অগ্রগামী বাহিনী পাঠানো পর্যন্ত আমরা আত্মগোপন করে থাকবো।”
ঘোড়া হাঁকিয়ে দূর্গের ফটকে গিয়ে বাবরের ইচ্ছা করে ভেতরে প্রবেশ করতে। কিন্তু ওয়াজির খানের কথাই ঠিক। টলোমলো ভঙ্গিতে সে ঘোড়ার পিঠ থেকে নামে এবং হাতেপায়ে জ্বরের পরের ব্যাথা অনুভব করে, এবং শুনতে পায় ওয়াজির খান নিজের দুইজন শ্রেষ্ঠ আর দ্রুতগামী ঘোড়সওয়াড়কে সামনে গিয়ে রেকী করে আসবার জন্য আদেশ দিচ্ছে।
দূর্গ এখান থেকে কমপক্ষে একঘণ্টার দূরত্বে অবস্থিত। ক্রমশ ঘনিয়ে আসা। অন্ধকারে আর অগ্রগামী দলটাকে সতর্ক থাকতে হবে সম্ভবত আরও বেশি যেনো কেউ তাদের দেখতে না পায়। তাদের ফিরে আসতে বেশ সময় লাগবে। পাহাড়ের শীর্ষভাগে বাবর আর তার লোকেরা যেভাবে অবস্থান করছে আর ঢালে ফিরে যেতে অনিচ্ছুক সেখানে নিজেদের উষ্ণ রাখতে বা খাবার রান্না করার জন্য আগুন জ্বালানোটা বোকামীর নামান্তর হবে। অবশ্য এমন না যে, তাদের সাথে পর্যাপ্ত রসদ রয়েছে। বাবর আরোগ্য লাভ করার পরের ছয় দিন তারা শিকারের অন্বেষণে এতটুকুও সময় নষ্ট করেনি বরং সমরকন্দ থেকে নিয়ে আসা শুকনো ফল, আপেল, পনির আর প্রায় গুড়ো হয়ে আসা রুটির উপরে নির্ভর করে কাটিয়েছে। বাবর একটা কম্বলে নিজেকে ভালমতো জড়িয়ে নিয়ে একটা শুকনো তরমুজের ফালি চিবুতে থাকে। ফালিটার মিষ্টত্ব তাকে রীতিমত বিরক্ত করে এবং সে সেটা মুখ থেকে ফেলে পানির বোতলে বড় একটা চুমুক দিয়ে মিষ্টির কারণে সৃষ্ট মুখের অরুচি দূর করতে চেষ্টা করে।
ভোর হবার দু’ঘণ্টা আগে তাদের পাঠানো রেকী ফিরে আসে। আর বাবর যেমনটা আশা করেছিলো পরিস্থিতি ঠিক ততোটাই খারাপ। দূর্গের ফটক বন্ধ আর প্রচুর পাহারার ব্যবস্থা করা হয়েছে। নদীর পাশের তৃণভূমিতে আগুন পোহাতে থাকা এক পশুপালক আর তার দু’ছেলেকে পেয়েছিল তার স্কাউটরা, বেচারা তাদের দেখে এতটাই ভড়তে গিয়েছিলো যে গড়গড় করে তারা যা জানতে চেয়েছিলো সব বলে দিয়েছে। যাযাবর গোষ্ঠীর অনেক নেতাই বাবরের সৎ-ভাইকে সমর্থন দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সমরকন্দের বাইরে কৃষকের স্ত্রীকে ধর্ষণ আর তার শস্য চুরির অপরাধে যে গোত্রপতির লোকদের সে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলো তারা বিদ্রোহীদের সাথে যোগ দিয়েছে জানতে পেরে বাবর মোটেই অবাক হয় না। আর জাহাঙ্গীরের দাদাও তার সাথে রয়েছে। রোক্সানা আর তার ছেলেকে দূর্গে নিয়ে এসেছিলো যে আপাত নির্বিরোধী বুড়ো লোকটা বাবর তার কথা ভাবে। তাদের আশ্রয় দেয়াটাই তার ভুল হয়েছিলো। কিন্তু এছাড়া তার আর কিইবা করার ছিলো? জাহাঙ্গীর তার সৎ-ভাই। রক্ত রক্তই।
ইউসুফ, তার বাবার সময়ের সেই মোটাসোটা কোষাধক্ষ্য, সাথে বাবা কাশকা, শাহী বাজারসরকার, এবং তার খর্বকায় অস্থিরচিত্ত শাহী জ্যোতিষী বাকী বেগও তার সৎ-ভাইয়ের সাথে যোগ দিয়েছে শুনতে পেয়ে সে মোটেই অবাক হয় না- বাবর যদিও তাদের প্রাণে বাঁচিয়ে দিয়েছিলো। কিন্তু তাদের বাধ্য করেছিলো লাভজনক শাহী পদ থেকে ইস্তফা দিতে।
বোন, আম্মিজান আর কথা তার মনে ভিড় করে। অগ্রগামী দল তাদের কোনো খবর জানতে পারেনি। নিজের অক্ষমতাকে সে অভিশাপ দেয়। সে নিজে আর সাথের দু’ডজন দেহরক্ষী আর কিইবা করতে পারে? তার মূল বাহিনী এসে পড়া পর্যন্ত তাকে অপেক্ষা করতেই হবে।
সূর্য উঠতে বেশতর পাহাড়ের শীর্ষদেশে জমে থাকা বরফ স্ফটিকের মত চমকাতে থাকলে বাবর তার আলখাল্লা ভালো করে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে ইশারায় সে একা থাকতে চায় বলে তারা যেখানে ছাউনি ফেলেছে সেই টিলা বেয়ে উঠতে শুরু করে। তার পায়ের নিচের শিশির সিক্ত পান্না সবুজ ঘাস বেশ পিচ্ছিল। বেশ তাজা আর মিষ্টি একটা গন্ধ। কিন্তু অচিরেই শীত নামবে আর এই ঢাল তখন জমে শক্ত আর সাদা হয়ে উঠবে। ভাবনাটা তাকে বিচলিত করে তোলে। শীতকালে সে কিভাবে অভিযান পরিচালনা করবে?
পূর্ব থেকে বয়ে আসা বাতাসে শীতের কাঁপন স্পষ্ট। একটা পাথরের আড়ালে বসে বাবর তীক্ষ্ণ চোখে সামনের ভূখণ্ডের দিকে তাকিয়ে থাকে, যার প্রতিটা ঢাল সে এতো ভালো করে চেনে যে সেগুলোকে তার নিজের দেহের একেকটা অংশ বলে মনে হয় সবুজ তৃণভূমির প্রতিটা বিস্তার, প্রতিটা খাড়া ঢাল বিশিষ্ট উপত্যকার ধূসর পাথরের বিন্যাস, পর্বতের আঁকাবাঁকা চূড়া আর জাক্সারটাসের বাঁক। সর্বস্ব হারাবার বেদনা তাকে উদ্বেল করে তুললে সে মাথা নিচু করে বসে থাকে।
নির্মেঘ, উজ্জ্বল আকাশের অনেক উঁচুতে সূর্য উঠে আসবার পরে বাবর পশ্চিম থেকে ঘোড়ার অস্পষ্ট পায়ের শব্দ ভেসে আসতে শুনে। দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে সে ঘুরে পেছনে তাকায় এবং অশ্বারোহী বাহিনীর একটা লম্বা সারিকে দূর থেকে উপত্যকার ভিতর দিয়ে এগিয়ে আসতে দেখে। চোখ কুঁচকে তাকিয়ে, সে গুনতে চেষ্টা করে সম্ভবত দুইশো হয়তো আরো বেশি এবং সবুজ নিশানের একটা ঝলক সে দেখতে পায়। নিঃসন্দেহে এটা বাইসানগারের পাঠান অগ্রগামী দল।
নিজের ভেতরে নতুন শক্তির একটা স্ফুরণ অনুভব করে। হতাশা ঝেড়ে ফেলে সে ঘুরে দাঁড়ায় এবং পাহাড়ের পাদদেশে স্থাপিত অস্থায়ী ছাউনির দিকে হোঁচট খেতে খেতে নেমে আসে। “ওয়াজির খান, আমাদের বাহিনী এসে পৌঁছেছে।” ছাউনিতে দৌড়ে প্রবেশের ফাঁকে সে চিৎকার করে ঘোষণা করে।
“আপনি নিশ্চিত তারা আমাদেরই লোক?”
“আমি নিশ্চিত। সমরকন্দের সবুজ নিশান তারা বহন করছে।”
“সুলতান, আমি পথ দেখিয়ে তাদের এখানে নিয়ে আসবার জন্য একটা অভ্যর্থনা বাহিনী পাঠাচ্ছি।”
কম্পিত হৃদয়ে বাবর তার লোকদের একটা অংশকে এগিয়ে যেতে দেখে। এবার দূর্গ থেকে অপদার্থ নচ্ছাড়গুলোকে তাড়িয়ে দেবো। তামবাল তার বিশ্বাসঘাতকতার জন্য পস্তাবে এবং তার সাথে বাকি সবাই… বাবর পর্যাণ থেকে তার আব্বাজানের তরবারিটা বের করে আনে। খাপ থেকে সেটা বের করতে বটের চুনি সূর্যের আলোতে ঝলসে উঠে। হাতে নিয়ে তরবারিটার ওজন পরখ করতে তার ভালোই লাগে এবং মানসপটে সে তামবালের ভোলা ঘাড়ে সেটা সে এককোপে নামিয়ে আনতে দেখে, ফারগানা শাসনের প্রথম দিনে সে কামবার আলির ঘাড়ে যেভাবে এটা নামিয়ে এনেছিলো।
অচিরেই বাইসানগারকে সামনে নিয়ে অভ্যর্থনাকারী বাহিনী ফিরে আসে।
বাবর সামনে এগিয়ে যায়। শিরোস্ত্রাণের নিচে বাইসানগারকে বিধ্বস্ত দেখায়। “মূল বাহিনী কখন এসে পৌঁছাবে? তারা কি অনেক দূরে রয়েছে?”
উত্তর দেবার আগে বাইসানগার এক মুহূর্ত ইতস্তত করে। “সুলতান, মূল বাহিনী। বলে কিছু আর অবশিষ্ট নেই।”
বাবরের চোখের আশার আলো যেন দপ করে নিভে যায়। “কি বলতে চাইছো?”
“আপনার চাচাতো ভাই, কুন্দুজের মাহমুদ, সমরকন্দ অবরোধ করেছিলো। তামবালের সাথে সে নিশ্চয়ই আগেই পরিকল্পনা করেছিলো এবং নিজের বাহিনীকে সেভাবে প্রস্তুত রেখেছিলো। অগ্রগামী বাহিনীকে সাথে নিয়ে আমি শহর ত্যাগ করা পর্যন্ত সে অপেক্ষা করেছে। তারপরেই আক্রমণ শানিয়েছে। গ্রান্ড উজিরের কয়েকজন প্রাক্তন পারিষদ যাদের উজিরের কন্যা, মাহমুদের স্ত্রী, বার্তাবাহকদের মাধ্যমে প্রচুর বখশিশের লোভ দেখিয়ে দলে টেনেছিল, তারা তাকে ভেতর থেকে সাহায্য করেছে। আমরা পাঁচদিন পথ চলার পরেই কেবল বার্তাবাহক সমরকন্দ পতনের সংবাদ নিয়ে আমার কাছে পৌঁছে। আমি দুঃখিত সুলতান। আমি আমার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছি।”
“মাহমুদ…” বাইসানগারের কথা যেনো বাবর বিশ্বাস করতে পারে না। তার সারা জীবনের পরিচিত, যাকে সে বন্ধু মনে করতো, তার সেই ভাই- যাবো স্ত্রীকে সেই তাকে উপহার হিসাবে পাঠিয়েছে। এভাবে তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে এটা যে অবিশ্বাস্য। “আলি মজিদ বেগের কি অবস্থা?”
“সুলতান তিনি মৃত। সবুজাভ তোরণদ্বারে এখন উজিরের বদলে তার মৃতদেহ ঝুলছে এবং তার সাথে আপনার প্রতি বিশ্বস্ত আরো অনেকেই মারা গিয়েছে।” বাবর ঘুরে দাঁড়ায়, চাচাত ভাইয়ের প্রতি বিতৃষ্ণা এবং অনুগত আলী মজিদ বেগের মৃত্যু তাকে বিপর্যস্ত করে ফেলেছে। একই সাথে অন্য আরেকটা ব্যাপারে তার মন ধাতস্থ হতে চায় তার এই সর্বস্ব হারাবার ব্যাপকতা। সমরকন্দ সে ঠিক কতোদিন শাসন করেছিলো। একশ দিন…? আর এখন সে সালতানাহীন এক সুলতান, ফারগানাও তার হাতছাড়া হয়েছে। তার মরহুম আব্বাজানের তরবারি এখনও সে হাতে ধরে রেখেছে এবং বাঁটের নিরেট অনুভূতি তাকে কিছুটা হলেও স্বস্তি দেয়। বাঁটটা আরো শক্ত করে ধরে সে নিজেকে প্রতিশ্রুতি দেয় এটা তার নিয়তি হতে পারে না। এটা সে কিছুতেই হতে দেবে না। যতো সময়ই লাগুক, যতো রক্তপাত প্রয়োজন হোক, সে নিজের অধিকার আবার আদায় করে নেবে। তাকে যারা অপমানিত করেছে সবাইকে তার মূল্য শোধ করতে হবে।
২.১ দ্বিতীয় খণ্ড – সালতানাৎবিহীন এক সুলতান
দ্বিতীয় খণ্ড – সালতানাৎবিহীন এক সুলতান
০৭. আয়োধন আর অন্তর্ধান
বৃষ্টি আর তুষারপাতের মিশ্রণের প্রকোপ বাবরের ভেড়ার চামড়ার প্রলেপ দেয়া ভারী জ্যাকেটের আবরণও আটকাতে ব্যর্থ হয়। ফারগানার উত্তরে উঁচু পর্বতমালার অভ্যন্তরে এক প্রত্যন্ত উপত্যকার ভিতর দিয়ে বয়ে যাওয়া একটা ক্ষুদ্র স্রোতস্বিনীর তীরের প্রায় কাদা হয়ে থাকা বরফের ভিতর দিয়ে তার অবশিষ্ট লোকদের সামনে থেকে ঘোড়া নিয়ে এগিয়ে চলেছে, বৃষ্টি আর তুষারপাতের হাত থেকে বাঁচতে মাথা নিচু করে রাখা।
নিজের দুটো সালতানাই হারিয়েছে এটা অনুধাবন করার পরের প্রথম দিকের মুশকিল দিনগুলোতে, বাবর আকশি দূর্গের আশেপাশেই থাকবে বলে ভেবেছিলো আশা করেছিলো সব কিছু বাজি রেখে হলেও সে তার পরিবারকে মুক্ত করতে পারবে। ওয়াজির খান অনেক কষ্টে তাকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে, তার শত্রুরাও এমনই একটা মরীয়া প্রচেষ্টা আশা করছে আর তারা সেজন্য পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে রয়েছে। ওয়াজির খান, তার চিরাচরিত পিতৃসুলভ ভঙ্গিতে তাকে আশ্বস্ত করে পরামর্শ দিয়েছে, “আপনি যদি আপনার আম্মিজান, নানীজান আর বোনকে বাঁচাতে চান তাহলে নিজেকে বিপদের মুখে না ফেলে বরং শত্রুদের তটস্থ করে তুলেন, যাতে তারা আপনার নাম শুনলেই ভয় পায়। আর সেটা করতে হলে তাদের চাপের ভিতরে রাখেন। এখানে সেখানে তাদের আক্রমণ করে, আপনার বিরুদ্ধে সৈন্য সমাবেশ করবার আগেই সেখান থেকে সরে আসেন। ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে সবসময়ে একটা ভীতির সঞ্চার করতে থাকেন। আপনার শত্রুরা যাতে শান্তিতে ঘুমাতে না পারে। আর এটা করতে পারলেই সুলতান, তারা আপনার পরিবারের ক্ষতি করার কথা চিন্তাও করতে পারবে না।”
বাবর ওয়াজির খানের বক্তব্য মোটের উপরে বুঝতে পারে। সাবধানে বিবেচনা করে, সে একটা পরিকল্পনার কথা বলে। আমাদের একটা নিরাপদ আশ্রয়স্থল চাই। যেখানে আমরা শীতকালটা কাটাতে পারবো এবং প্রথম হামলার ছক কষতে পারবো। আমার মনে আছে যে প্রতিবার গ্রীষ্মের সময়ে সামরিক প্রশিক্ষণের অংশ হিসাবে আপনি একবার আমাকে উত্তরের পার্বত্য অঞ্চলে একটা অভিযানে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং উপত্যকার কেন্দ্রস্থলে একটা মাটির দূর্গে আমরা অবস্থান করেছিলাম। তামবালের অনুগত এক জায়গীরদার সেই নগণ্য সেনাছাউনির প্রধানের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলো। সেই দূর্গটা আমাদের জন্য চমৎকার আশ্রয়স্থল হিসাবে প্রতিপন্ন হতে পারে। কারো মাথাতেই বিষয়টা আসবে না। আপনি কি বলেন?”
“জায়গার কথা আমার মনে আছে। বাস্তবিকই প্রত্যন্ত অঞ্চলে দূর্গটা অবস্থিত, আর আমাদের উদ্দেশও হাসিল হবে।”
আর সে জন্যই সে ওয়াজির খানকে নিয়ে পাহাড়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেছিলো। তাদের সাথে কেবল দুশো লোক ছিলো। ওয়াজির খানের সাহায্যে বাবর অনেক যত্ন নিয়ে তাদের বাছাই করেছে, সে কেবল তাদেরই বাছাই করেছে যাদের বয়স অল্প আর কোনো পারিবারিক পিছুটান নেই বা বাইসানগারের মতো যারা তার বিশ্বস্ত অন্তরঙ্গ। বাকি সবাইকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে, তার ডাকের অপেক্ষা করতে বলেছে, যা তারা নিশ্চিতভাবেই পাবে। তাদের যাত্রার দ্বিতীয় সপ্তাহে তুষারপাত শুরু হয় এবং উচ্চতা বাড়বার সাথে সাথে তুষারের স্তর বৃদ্ধি পেয়ে তাদের যাত্রাকে শ্লথ করে তুলেছে।
“ওয়াজির খান, আপনার কি মনে হয় আমরা দূর্গ থেকে কতোটা দূরে অবস্থান করছি?”
“সুলতান, আবহাওয়া যদি এতোটা বিরূপ না হতো, আমরা তাহলে দূর্গটা এতক্ষণে দেখতে পেতাম। অবশ্য সুবিধাও হয়েছে, দূর্গের নিরাপত্তা রক্ষীরা আমাদের আগে থেকে দেখতে পাবে না। দূরের ঐ গাছগুলোর আড়ালে আমরা অবস্থান নেবো আর সামনেটা রেকী করার জন্য গুপ্তদূত পাঠিয়ে আমরা পর্যাণে যেটুকু শুকনো মাংস রয়েছে সেটা দিয়ে আহার সেরে নেবো।”
তাদের পাঠানো গুপ্তদূতেরা রেকী করে ফিরতে যে নব্বই মিনিট সময় লাগে তার পুরোটা সময়ই অবিশ্রান্তভাবে তুষারপাত হয়। কখনও ভারী বা কখনও হাল্কাভাবে। তার লোকেরা ফিরে আসতে দেখা যায়, ঘোড়া আর তার আরোহী তুষারে পুরো ঢেকে গেছে এবং গুপ্তদূতদের দলনেতা ঠাণ্ডায় নীল হয়ে আসা ঠোঁটে কোনোমতে কথা বলে। “এখান দু’মাইল দূরে একটা বাকের পরেই দূর্গটা অবস্থিত। দূর্গের বাইরে আমরা কোনো ঘোড়ার বা পায়ের ছাপ দেখতে পাইনি যাতে বোঝা যায়, আজ ভেতর থেকে কেউ টহল দিতে বা পর্যবেক্ষণ-ফাঁড়িতে যায়নি। আমরা যখন ঘোড়া থেকে নেমে দূর্গের কাছে এগিয়ে যাই, দূর্গের এক অংশ থেকে আমরা ধোয়া উঠতে দেখেছি- সম্ভবত রসুইখানা- কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো দূর্গের মূল ফটক তখন ভোলা ছিলো। স্পষ্টতই এই আবহাওয়ায় কেউ আক্রমণ করতে পারে সেই ব্যাপারটা তাদের মাথাতেও নেই।”
“চমৎকার, শীঘ্রই তাদের এই নিশ্চয়তা নরকে পরিণত হতে চলেছে। ওয়াজির খান, এটা ইতস্তত করার সময় না, সবাইকে এই মুহূর্তে প্রস্তুত হতে বলুন এবং তুষারপাতের মাঝে আমরা আত্মগোপন করে গুপ্তদূতদের সহায়তায় দূর্গে পৌঁছাবার পথের শেষ বাঁকে দ্রুত আর নিরবে গিয়ে হাজির হবো। সেখান থেকে মূল ফটকের উদ্দেশ্যে ঘোড়া দাবড়ে যাবো।”
ওয়াজির খান মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় এবং পাঁচ মিনিট পরে অশ্বারোহী বাহিনীর একটা সারিকে মন্থর গতিতে পাহাড়ী পথ বেয়ে উপরের দিকে উঠে যেতে দেখা যায়। তুষারাবৃত প্রেক্ষাপটের মাঝ দিয়ে প্রায় দু’মাইল এগিয়ে যায়। তুষারপাত এখন আগের চেয়ে অনেক কমে এসেছে। বাবরের চোখের সামনে একটা পাথুরে অবয়ব ভেসে ওঠে। দূর্গটা আর মাত্র হাজারখানেক গজ সামনে অবস্থিত। এখান। থেকে দূর্গ পর্যন্ত রাস্তাটা বেশ প্রশস্ত।
“আমরা এখান থেকেই আক্রমণ শুরু করবো। লোকদের বলেন অপ্রয়োজনীয় সবকিছু এখানে পাথরের আড়ালে রেখে কেবল হাতিয়ার নিয়ে প্রস্তুত হতে। যাতে বরফের উপর দিয়ে যতোটা সম্ভব দ্রুত ঘোড়া দাবড়ে আমরা দূর্গে পৌঁছাতে পারি।” তার লোকেরা নিরবে প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। কিন্তু তারা প্রস্তুত হতে হতে তুষারপাত একেবারে বন্ধ হয়ে যায় এবং সামনে- সাদা প্রেক্ষাপটের মাঝে একটা কালো আকৃতির মত দূর্গটা ভেসে উঠে।
“যারা প্রস্তুত, ঘোড়ায় আরোহন করো! কারো চোখে পড়ে যাবার আগেই আমাদের আক্রমণ করতে হবে!” বাবর চিৎকার করে কথাটা বলার ফাঁকে ময়ান থেকে আলমগীর বের করে আনে। সে লাফিয়ে জিনের উপরে উঠে বসে এবং তার বিশাল কালো ঘোড়াটাকে দূর্গের দিকে এগোতে বলে পেটে খোঁচা দেয় যার ফটক সে খোলা দেখতে পেয়েছে। দশজন যোদ্ধা পরিবেষ্টিত অবস্থায় এবং বাকীরা তার পেছনে সারিবদ্ধভাবে বিন্যস্ত। ঘোড়ার কাধ ধরে ঝুঁকে ছুটে যাবার সময়ে বাবর টের পায় তার কানে রক্তের চাপ বৃদ্ধি পেয়েছে। দূর্গের ফটক থেকে সে যখন মাত্র দুশো গজ দূরে, তখন ভেতর থেকে একটা চিৎকার তার কানে ভেসে আসে- শত্রুরা তাদের দেখে ফেলেছে। ভেতরের লোকেরা বিপদ টের পায়। তারা ফটকের পাল্লা বন্ধ করার চেষ্টা করতে সেটা কেঁপে উঠে। কিন্তু নতুন জমা বরফ পাল্লা নড়তে বাধা দেয়। দু’জন লোক বাইরে ছুটে আসে, বরফের স্তূপে লাথি দেয় এবং বৃথাই চেষ্টা করে পাল্লাটা বরফের উপর দিয়ে সরাতে।
“ব্যাটাদের পেড়ে ফেলো!” বাবর হুঙ্কার দিয়ে বলে। কিন্তু ঘোড়ার গতি বিন্দুমাত্র হ্রাস করে না। নিমেষের ভিতরে সে একজনকে মাটিতে পড়ে যেতে দেখে, একটা তীর তার গলায় বিদ্ধ হয়েছে। একই সাথে সে নিজেও দূর্গের তোরণদ্বারের কাছে পৌঁছে যায়। দ্বিতীয় লোকটাকে সে আলমগীর দিয়ে একটা কোপ বসিয়ে দেয়। টের পায় তার তরবারি জায়গা মতোই নরম মাংসপেশীতে কামড় বসিয়েছে। কিন্তু কোথায় সেটা দেখবার জন্য সে ঘোড়ার গতি একটুও হ্রাস করে না। তার বদলে, সে তার হাতে ধরা লাগামে একটা ঝাঁকি দিয়ে ঘোড়ার মাথা তখনও আংশিক খোলা ফটকের দিকে ঘুরিয়ে দেয়। বিশাল কালো ঘোড়াটা নাক দিয়ে একটা শব্দ করে এবং বাবর টের পায় ঘোড়াটার একটা পা পিছলে গেছে কিন্তু কালো পাহাড় ঠিকই ঘুরে দাঁড়ায়। একই সাথে তার পেছনে তিনজন যোদ্ধা এসে হাজির হয়।
কিন্তু চতুর্থজন ঢুকতে ব্যর্থ হয়। ভেতরে প্রবেশপথ আটকে ঘোড়া আর তার আরোহীর ভূপাতিত হবার শব্দ বাবর শুনতে পায়। সে দূর্গের ভিতরে প্রবেশ করেছে বটে। কিন্তু তাকে সহায়তা করবার জন্য মাত্র তিনজন যোদ্ধা তার সাথে রয়েছে। চারপাশে তাকালে সে সারি সারি স্থাপিত উঁচু দরজার পেছন, সম্ভবত দূর্গের প্রধান সেনানিবাস থেকে পিলপিল করে লোকজনকে বের হয়ে আসতে দেখে। কেউ কেউ ইস্পাতের বর্ম গায়ে চাপাতে ব্যস্ত। আর বাকিরা ইতিমধ্যে অস্ত্রধারণ করেছে।
“আমার সাথে এসো! এখনই আক্রমণ করতে হবে!” বাবর পেটে খোঁচা দিয়ে পুনরায় তার ঘোড়ার গতি বৃদ্ধি করে। আর একটু পরেই তাকে তার তিনজন সহযোদ্ধাকে নিয়ে আতঙ্কিত লোকগুলোকে কচুকাটা করতে দেখা যায়। সহসা একটা লম্বা লোক বাবরের নজর কাড়ে, যাকে দেখে সেনাপতিদের একজন বলে মনে হয়। ব্যাটকে মাথা নিচু করে পুনরায় ঘরের ভিতরে প্রবেশ করতে দেখলে সেও ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে সেদিকে এগিয়ে যায়। কাঠের সরদলের নিচে দিয়ে ঝুঁকে পার হয়ে সে ভেতরের আধো অন্ধকারে চোখ পিটপিট করে প্রবেশ করতে যে বিশ ত্রিশজন সেখান থেকে বের হয়ে এসেছে, বুঝতে হবে সেটাই এই দূর্গের মোট জনবল। কেবল সেনাপতিগোছের লোকটাই এখন ভেতরে রয়েছে। লোকটা দৌড়ে একটা অস্ত্র সজ্জিত তাকের দিকে ছুটে গিয়ে সেখান থেকে একটা বর্শা আর ঢাল তুলে নিয়ে বাবরের দিকে ঘুরে দাঁড়ায়।
“ফারগানার ন্যায়সঙ্গত সুলতান, আমি বাবর তোমাকে আদেশ দিচ্ছি অস্ত্র নামিয়ে রাখো।”
“আমি আত্মসমর্পন করবো না। তোমাকে আমি সুলতান বলে মানি না। আমার নাম হানিফ খান। আমি তামবালের প্রতি অনুগত, সেই এখন পুরো এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে। পারলে সম্মুখ যুদ্ধে আমাকে পরাস্ত করো।”
বাবর তার কালা পাহাড়ের উপর থেকে লাফিয়ে নামে এবং আলমগীর হাতে ধরা অবস্থায় হানিফ খানের দিকে এগিয়ে যায়। যে তক্কে তক্কে ছিলো বাবর তার। কাছাকাছি যেতেই হাতের বর্শা দিয়ে সে বাবরকে আঘাতের চেষ্টা করে। বাবর লাফিয়ে একপাশে সরে যায়। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে অর্ধভুক্ত খাবারে ভর্তি একটা নিচু টেবিলের পায়ার সাথে তার বাম পা আটকে যায়। বেকায়দা ভঙ্গিতে সে টেবিলের উপরে আছড়ে পড়ে। টেবিলের উপরে থাকা কাঠের পেয়ালা আর তার ভেতরের খাবার ছিটকে ফেলে। মাংসের সুরুয়া অর্ধেকটা ভর্তি একটা বিশাল ধাতব পাত্রের মুখে তার তরবারি ধরা হাতের কব্জি আটকে যেতে, আলমগীর তার মুঠো থেকে ছুটে যায়।
হানিফ খান বাবরের অসহায় অবস্থার সুযোগে তাকে একেবারে শেষ করে দেবার জন্য ছুটে আসে। তার বর্শাটা দু’হাতে মাথার উপরে তুলে বাবরের উন্মুক্ত গলায় সেটা সর্বশক্তিতে নামিয়ে আনবে। বাবর একটা কাঠের বড় বারকোশ তখন তুলে নিয়ে সেটাকে ঢালের মত ব্যবহার করে। বর্শা বারকোশে বিদ্ধ হয়। তবে সেটাকে ছিন্ন করতে পারে না। ছিটকে পড়া খাবারের উষ্ণ চটচটে সুরুয়ার ভিতরে গড়িয়ে একপাশে সরে যাবার সময়ে সে বারকোশটা ফেলে দিয়ে বর্শার হাতল ধরে মোচড় দেয় এবং হানিফ খানের হাত থেকে সেটা টেনে নেয়।
বিন্দুমাত্র দমে না গিয়ে হানিফ খান, লাফিয়ে পেছনে সরে গিয়ে কোমরের পরিকর থেকে একটা সরু খঞ্জর টেনে বের করে। আলমগীর কোথায় পড়েছে সেটা দেখার সময় নেই বাবরের, হাতের বর্শাটা দিয়ে সে লোকটাকে সজোরে আঘাত করলে ফলার মাথায় আটকানো বারকোশটা খুলে পড়ে। আর একই সময়ে, নিজের গালে সে একটা তীক্ষ্ণ ব্যাথা অনুভব করে। হানিফ খান বাবরের গলা লক্ষ্য করে খঞ্জরটা চালিয়েছিলো কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে। বাবর এবার বশার ফলাটা সজোরে তাকে লক্ষ্য করে আঘাত করে হানিফ খান একপাশে ঘুরে আঘাতটা এড়াতে চেষ্টা করে। কিন্তু ফলাটা তাকে বামদিকে স্পর্শ করলে সে টেবিলের পাশে রাখা শক্ত কুশনের উপরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। বাবর এবার বর্শাটা মোচড় দেয় এবং মুহূর্ত মাত্র চিন্তা না করে প্রতিপক্ষের কণ্ঠনালী লক্ষ্য করে সজোরে বর্শাটা নামিয়ে এনে গালিচার উপরে তাকে গেথে ফেলে। যা অচিরেই ফিনকি দিয়ে রক্তে ভিজে লাল হয়ে যায়।
ইতিমধ্যে ওয়াজির খান, বাইসানগার আর বাকী লোকেরা এসে তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে তার সাহসিকতার জন্য তাকে শুভেচ্ছা জানায়। দূর্গটা এখন তাদের দখলে। ফারগানা উদ্ধারের বন্ধুর পথে সে মাত্র প্রথম পদক্ষেপটা সাফল্যের সাথে রেখেছে। বাইরে বের হয়ে এসে বাবর দেখে আবার তুষারপাত শুরু হয়েছে। শত্রুর পড়ে থাকা দেহের চারপাশের লাল রঙ ইতিমধ্যে অনেকটাই ঢাকা পড়েছে। একটু আগে তামবালের চামচার ভবলীলা সে যেভাবে সাঙ্গ করেছে, সেভাবে পালের গোদাটাকে কখন মুঠোর ভেতরে পাবে সেই মুহূর্তটার জন্য সে অধীর হয়ে রয়েছে।
*
আর এভাবেই পুরো ঘটনাটার সূচনা হয়। বাবর একজন হানাদারে পরিণত হন। ঝটিকাবেগে আক্রমণ করেন এবং ফিরে যাবার সময় প্রতিবারই মৃত শত্রুর কারো একজনের মুখে রক্ত দিয়ে নিজের নাম লেখা একটা কাগজ গুঁজে দিয়ে যান। আর তার সাফল্য ক্রমশ বাড়তে থাকে। তার বাহিনীর সংখ্যা, মিষ্টি কথা আর মধুর প্রতিশ্রুতি, সেই সাথে শক্তি বা তার অভিযানে প্রাপ্ত সম্পদের বিচক্ষণ ব্যবহার নতুন সমর্থকদের আকৃষ্ট করে এবং প্রতিপক্ষকে দলে টেনে, ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায়। মাটির দূর্গ দখলের বিশ মাসের মধ্যে, নিষ্ঠা আর একাগ্রতার সাথে একটার পরে একটা ছোট দূর্গ আর গ্রামের পর গ্রাম দখল করে ফারগানার পশ্চিমাঞ্চলের অধিকাংশই সে দখল করে নেয়। তার কৌশল কার্যকরী বলে প্রতীয়মান হয়। তামবাল আকশির উত্তর বা পশ্চিমে বাবরের শক্ত ঘাঁটির দিকে বেশিদূর অগ্রসর হবার মতো সাহস দেখায় না। আর বাবরও মনে করে এবার সময় হয়েছে নিজের দাবির কথা প্রকাশ করবার।
প্রথম দাবিটা সে ছয়মাস আগে জানায় এবং তারপরে প্রায়শই তার পুনরাবৃত্তি করেছিলো তার আম্মিজান, নানীজান আর বোনের মুক্তির বদলে এক বছর আকশি দূর্গ আক্রমণ না করবার প্রতিশ্রুতি। তিনমাস আগে তামবাল এক বার্তাবাহকের মাধ্যমে প্রেরিত এক চিঠিতে অনেক মধুর ভাষায় জানায় এসান দৌলত, খুতলাঘ নিগার আর খানজাদা প্রত্যেকেই সুস্থ আছে এবং শাহী পরিবারের উপযুক্ত ব্যবহারই করা হচ্ছে তাদের সাথে। কিন্তু চিঠিতে সে তাদের মুক্তি দেবার তার কোনো অভিপ্রায়ের কথা উল্লেখ করেনি।
বাবর এখন পূর্বদিকে পঞ্চাশ মাইল দূরে অবস্থিত শহর গাভার দিকে অগ্রসর হচ্ছে কিছুদিন আগে তামবাল ভাড়াটে চকরাখ যোদ্ধাদের সহায়তায় সেখানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছে। সেখানে একটা হিসাব মেলানো এখনও বাকি আছে। সেখানকার দূর্গের চাকরাখ সর্দার তার সৎভাই আর তামবালকে শাহী প্রতিনিধি হিসাবে মেনে নিয়ে প্রথম আনুগত্য প্রদর্শনকারীদের অন্যতম। শহরটা দখল করলে তামবালকে আরেকটা জোরালো সঙ্কেত পাঠানো হবে যে, সময় হয়েছে বাবরের কাছে তার পরিবারকে ফেরত পাঠাবার।
এক ক্ষুদ্র নহরের পাশে সাময়িক যাত্রাবিরতি করে বাবর আর তার লোকেরা ঘোড়াগুলোকে পানি পান করার সুযোগ দেয়। ঘোড়ার দুধ থেকে তৈরি টক পনির কোনোক্রমে গলধঃকরণের ফাঁকে বাবর তাকিয়ে দেখে তার এক গুপ্তদূত ঘোড়ায় চড়ে এগিয়ে আসছে। বাবর চমকে উঠে দেখে তার পর্যানে একটা দেহ আড়াআড়িভাবে বাঁধা রয়েছে। লোকটার দিকে দৌড়ে গিয়ে বাবর চিৎকার করে জানতে চায়, “কি হয়েছিলো? এই লোকটা কে?”
“লোকটা একটা ব্যবসায়ী। পথের পাশে পেটে তরবারির আঘাত নিয়ে নিজেরই রক্তে অর্ধচেতন অবস্থায় পড়ে থাকার সময়ে তাকে আমি খুঁজে পেয়েছি। আমি তাকে আমার ঘোড়ার পিঠে তুলে নেবার কিছুক্ষণ পরেই বেচারা মারা যায়। অবশ্য মারা যাবার আগে সে আমাকে বলেছে যে আরও তিনজন ব্যবসায়ীর সাথে সে। এখান থেকে দশ মাইল দূরে একটা ছোট সরাইখানার উদ্দেশ্যে যাবার পথে তারা চকরাখ হানাদারদের হামলার শিকার হয়। তার তিন সঙ্গীকে হত্যা করে তাকেও মৃত ভেবে তাদের সব মালপত্র নিয়ে তারা চলে গেছে।”
“চকরাখ হানাদারদের অবশ্যই খুঁজে বের করে তার হত্যার আমরা বদলা নেবো। তোমার অধীনস্ত কয়েকজন গুপ্তদূতকে হত্যাকারীদের খুঁজতে পাঠাও।”
“সুলতান, আমার মনে হয় না তার কোনো দরকার আছে। বণিক লোকটা মারা যাবার আগে আমাকে বলেছে যে, সে চকরাখদের বলতে শুনেছে তারা সরাইখানায় যাচ্ছে, সেখানে আরও শিকার যদি তারা খুঁজে পায়…”
“তাহলে আমরা প্রথমে সরাইখানায় যাবো।”
***
গানের সুর বন্য আর কর্কশ চকরাখদের নিজেদের মতোই অনেকটা। মদের নেশায় চুরচুর হয়ে থাকা পুরুষদের কণ্ঠস্বর নতুন মাত্রায় উঠে এমন সব অশ্লীল ক্রিয়াকলাপের বর্ণনায় মেতেছে যা একাধারে শারিরীকভাবে অসম্ভব আর মোটাদাগের যে বাবর চেষ্টা করেও হাসি চাপতে পারে না। সে আড়চোখে ওয়াজির খানের দিকে তাকিয়ে দেখে সেও হাসছে।
লম্বা ঘাসের আড়ালে বাবর তার চারপাশে শুয়ে থাকা লোকদের ইশারা করে। সবাই। তারমতো পেটের উপরে ভর দিয়ে শুয়ে আছে, লুকিয়ে অপেক্ষা করছে। তারপরে সে গুঁড়ি মেরে মাটির ইট দিয়ে তৈরি একতলা সরাইখানার দিকে এগিয়ে যায় যেটা ফারগানার অন্যতম খরস্রোতা একটা নদীর অগভীর অংশের পাড়ে অবস্থিত। যেখানে হল্লাবাজেরা মচ্ছবে মেতেছে। নূপুরের নিক্কন ধ্বনি ভেসে আসতে বোঝা যায় ভেতরে বাইজি মেয়েরাও আছে। সেই সাথে কুপিত নারী কণ্ঠের সহসা একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার আর তার সঙ্গে ভেসে আসে- পুরুষ কণ্ঠের অট্টহাসি।
দুপুর মাত্র অতিক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু বিশজন বা তার কিছু বেশি চাকরাখরা ইতিমধ্যেই বেহেড মাতাল হয়ে পড়েছে। তারা এমনকি তাদের ঘোড়াগুলিকে ঠিকমতো বাঁধার কষ্টও করেনি এবং কিছু ঘোড়া, যাদের কেশর পুরু আর লেজ এতো লম্বা যে মাটিতে ঘষা খাচ্ছে, ইতিমধ্যেই ছুটে পালিয়েছে। চারো ব্যবসায়ীর কাছ থেকে লুট করা মালামালও তারা ভিতরে নিয়ে যাবার গরজ দেখায়নি। বণিকদের মালবাহী ধুসর খচ্চরগুলো দড়ি দিয়ে একত্রে বাঁধা এবং মনোযোগ দিয়ে চরে বেড়াচ্ছে। তাদের পিঠে আটকানো বেতের ঝুড়িগুলো দেখে মনে হয় এখনও চামড়া আর লোমে ঠাসা। চাকরাখরা মনে হয় কেবল মদের পিপে নিয়ে সরাইখানার ভিতরে প্রবেশ করেছে।
বর্বর অসভ্য, বাবর ভাবে। তাদের কপালে আজ কি লেখা আছে সেটা এখনই ব্যাটারা টের পাবে। আর এই ভাবনাটা তাদের উৎফুল্ল করে তোলে। লম্বা ঘাসের উপরে মাথা তুলে বাবর চারপাশে তাকায়। কিন্তু কাউকে দেখতে পায় না। সে ঠিক যেমনটা ভেবেছিলো, ঘোড়া বা মালামাল দেখার জন্য বাইরে কোনো বাচ্চাকে রাখার কথা ব্যাটাদের মাথাতেই আসেনি। সে এবার উঠে দাঁড়িয়ে, গুটিগুটি পায়ে সরাইখানার নীচু প্রবেশদ্বারের ডান দিকে মোটা দেয়ালের গায়ে জানালার মতো দেখতে একটা ফাঁকা জায়গার দিকে এগিয়ে গিয়ে ভেতরে সতর্কতার সাথে উঁকি দেয়। ঘরটা প্রায় খালি, কেবল ভেতরের দেয়ালের গায়ে ঠেকানো অবস্থায় একটা লম্বা কাঠের টেবিল দেখা যায়। কয়েকটা তেপায়া টুল আর একটা আধ ভাঙা বেঞ্চি দেখা যায়। ঘরের মাঝে মোটাসোটা, বোচা-নাকের একটা মেয়ে পরনে রঙচটা হলুদ রঙের ঢোলা সালোয়ারের উপরে লাল ফুলের ছাপ দেয়া একটা আঁটোসাঁটো কামিজ, পায়ে আর হাতের কব্জিতে ঘুঙুর বাঁধা। নীল সালোয়ার কামিজ পরিহিত লম্বা আরেকটা মেয়ে তার নোংরা হাতে একটা খঞ্জনী, বর্গাকার পাথরের মেঝের উপরে খালি পায়ে সজোরে পদাঘাত করে বৃত্তাকারে আবর্তিত হচ্ছে। সে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই চকরাখদের কয়েকজন, ভেড়ার চামড়ার তৈরি টুপির নিচে তাদের গোলাকার মুখ ঘামে ভিজে আছে, টলোমলো পায়ে মেয়েদের বুকে পাছায় বৃথা চেষ্টা করে থাবা দিতে এবং মুখ থুবড়ে মাটিতে আছড়ে পড়লে তাদের সঙ্গীসাথীদের উদ্দীপনা আরও বেড়ে যায়।
এক কোণে ধোঁয়া উঠতে থাকা অগ্নিকুণ্ডের উপরে বিশাল একটা কেতলি ঝুলতে দেখা যায়। আরেক কোণে, বাবর এক চকরাখ দুবৃত্তকে কাপড় খুলে ব্যস্ত ভঙ্গিতে হাল্কা হতে দেখে, দুর্গন্ধে তার সঙ্গীসাথীদের আপাতভাবে কোনো অসুবিধা হয় না। আরেক বদমাশ উঠে দাঁড়িয়ে হলুদ বমি বৃত্তচাপ তৈরি করে ছুঁড়ে ফেলে আবার বসে পড়ে আর মনোযোগ দিয়ে জামার হাতায় পড়া বমির ফোঁটা বড়বড় নখ দিয়ে টুসকি দেয়। বাবর পুনরায় মাথা নামিয়ে নেয়। সে যা দেখার তা দেখে নিয়েছে।
মাটিতে গুঁড়ি দিয়ে সে পুনরায় ওয়াজির খান যেখানে আছে সেখানে ফিরে আসে। “মদ্যপ আহাম্মকগুলো আমাদের হাতে মারা যাবার জন্য মুখিয়ে রয়েছে। ব্যাটারা তাদের তরবারি আর ঢাল পর্যন্ত দরজার কাছে স্তূপ করে রেখেছে।”
ওয়াজির খানের একটা ক্ৰ উপরে উঠে যায়। “সুলতান, এখনই?”
“হ্যা!”
বাবর আর ওয়াজির খান উঠে দাঁড়িয়ে তাদের লোকদেরকেও উঠে দাঁড়াবার ইশারা করে। তারা এই কাজটা আগে এতোবার করেছে যে, মৌখিক আদেশের আর কোনো প্রয়োজন হয় না। ঠোঁটের উপরে আঙ্গুল চেপে, ওয়াজির খান ইশারায় ঘুরে কয়েকজনকে সরাইখানার পেছনে যেতে বলে। যদি সেখান দিয়ে পালাবার কোনো পথ থেকে থাকে। তারপরেই কেবল বাবর তার প্রিয় রণহুঙ্কারে চারপাশ প্রকম্পিত করে: “ফারগানা!”
বাবর একেবারে সামনে থেকে তার লোকদের নেতৃত্ব দেয়। মদের নেশায় মাতাল আর বিস্ময়ে আড়ষ্ঠ চকরাখরা সামান্যই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। বাবর আর তার লোকেরা নির্মমভাবে প্রতিপক্ষের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়লে বোঁচা-নাকের সেই মেয়েটার কাছ থেকেই কেবল বলার মতো প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। মেয়েটা তার কাচুলির ভিতর থেকে একটা খঞ্জর বের করে এবং বাবরের বাহুতে সেটা মরিয়া ভঙ্গিতে গেথে দিতে চাইলে, বাবর অনায়াসে তার ঘুঙুর পরা হাতের কব্জি ধরে এবং তাকে ঘুরিয়ে দিয়ে তার নধর নিতম্বে বুট দিয়ে একটা সপাট লাথি বসিয়ে দিতে বেচারী ছিটকে দূরে গিয়ে পড়ে।
কয়েক মিনিটের ভিতরে সবকিছু শেষ হয় এবং বাবরের লোকদের হাঁপিয়ে ওঠার আগেই নিজেদের তরবারির ফলা পরিষ্কার করে কোষবদ্ধ করতে দেখা যায়। তার লোকদের গায়ে একটা আঁচড়ও লাগেনি। অবশ্য তার লোকদের সবাই পোড়খাওয়া যোদ্ধা, এসব মদ্যপ মাতালদের চেয়ে অনেক দক্ষ লোকদের সাথে তারা আগে লড়াই করেছে। “লাশগুলো বাইরে নিয়ে যাও দেখা যাক আমরা কাদের হত্যা করেছি,” বাবর আদেশটা দিয়ে কৃতজ্ঞচিত্তে দ্রুত পূতিগন্ধময়, ধোঁয়াটে ঘরটা থেকে বাইরের খোলা বাতাসে বের হয়ে আসে।
তার লোকেরা চকরাখদের লাশগুলি তাদের বুট-পরা পা ধরে হেঁচড়ে বাইরে এনে সারিবদ্ধভাবে সাজালে, বাবর লাশগুলো শুনে দেখে। মোট পনেরটা লাশ। কারো গলা দুভাগ হয়ে আছে, কোনোটা আবার কবন্ধ। তার লোকেরা অবশ্য কাটাপড়া মাথাগুলো সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছে। কোনোটার মাথায় তখনও ভেড়ার চামড়ার টুপি রয়েছে। কাটা মুণ্ডগুলোর দিকে তাকিয়ে যখন বাবর একটা বিশেষ মুখ চিনতে পারে, তখন তার মুখ থেকে সন্তুষ্টিসূচক একটা শব্দ ধ্বনিত হয়। তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে এমন সব চকরাখকে সে হত্যা করবে বলে মনস্থ করেছে। এবং প্রতিটা হত্যাযজ্ঞ যা তাকে তার লক্ষ্যের নিকটবর্তী করছে প্রচণ্ড তৃপ্তিদায়ক।
তারস্বরের চিৎকার শুনে বাবর ঘুরে তাকায়। তার দু’জন যোদ্ধা বাইজি মেয়েদের ধরে তাদের টেনে সরাইখানার বাইরে বের করে আনে। “তাদের উপরে বল প্রয়োগ করবে না। আমার আদেশ তোমরা জানেনা। অর্থের বিনিময়ে যদি তারা স্বেচ্ছায় তোমাদের সঙ্গ দিতে রাজি হয় তবে সেটা আলাদা কথা।” কথাটা বলে বাবর আবার ঘুরে দাঁড়ায়।
দেখা যায় মেয়েগুলো আদতেই ব্যবসায়ী এবং কয়েক মুহূর্তের দ্রুত আলোচনার পরে, সরাইখানার পেছনের এক আপেল বাগিচায় তারা তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়। বাবর ধারণা করে বাইজি দু’জন সরাইখানার শকুনের মতো দেখতে মালিকের মেয়ে হবে। যে ঝামেলার গন্ধ পাওয়া মাত্র সেই যে টেবিলের তলায় গিয়ে ঢুকেছে তারপরে আর বের হবার কথা চিন্তাও করেনি। আপেল বাগিচায় শীঘ্রই বাবরের লোকদের দল বেঁধে আসা যাওয়া করতে দেখা যায়। বাগান থেকে হাসিমুখে তাদের বের হয়ে আসা দেখে বোঝা যায় মেয়ে দু’জন তাদের বাবার সরাইখানায় আসা। অতিথিদের খেদমত করতে ভালোই অভ্যস্ত।
ওয়াজির খান ইতিমধ্যে চকরাখদের পালিয়ে যাওয়া ঘোড়াগুলো ধরে আনবার বন্দোবস্ত করেছেন এবং বণিকদের কাছ থেকে লুট করা মালপত্রগুলো পর্যবেক্ষণ। করছেন। “সুলতান, দেখেন,” দুটো উজ্জ্বল বর্ণের গালিচা বের করে সে বাবরের। দৃষ্টি সেদিকে আকর্ষণ করে। গালিচা দুটোর জেল্লা দেখে বোঝা যায় তন্তুবায়ের দল। সেটা বুননের সময়ে রেশমের সাথে উলের মিশ্রণ ঘটিয়েছে আর গালিচাগুলোর নকশাও অপরিচিত- বণিকের দলটা সম্ভবত পূর্বের, কাশগর থেকে এসেছিল। যেখানের তাঁতিরা এ ধরণের গালিচা তৈরিতে দক্ষ। উল আর চামড়া বেচে ভালো অর্থই পাওয়া যাবে, বাবর ভাবে, যা দিয়ে তার লোকদের সে বকেয়া বেতন দিতে পারবে।
তার যোদ্ধাদের জন্য একটা ভোজসভার আয়োজন করলে মন্দ হয় না। তারা ভালো। কাজ দেখিয়েছে এবং তারও উচিত এর মূল্যায়ন করা। পশ্চিমে, শাহরুখিয়ায় ফিরে যাওয়া মাত্রই সে এই ভোজসভার ঘোষণা দেবে। সেখানে, ছয়মাস আগে। তামবালের কাছ থেকে সে দূৰ্গটা ছিনিয়ে নিয়েছে এবং নিজের ঘাঁটিতে পরিণত করেছে। সমরকন্দে খুন হবার আগে শাহরুখিয়ার সর্দার আলি মজিদ বেগের পূণ্য স্মৃতির প্রতি তারা তাদের শ্রদ্ধা জানাবে। তারা তার উপযুক্ত সন্তানের আত্মার মাগফেরাত কামনা করবে। যে তামবালের চকরাখ যোদ্ধাদের হাত থেকে দূর্গটা রক্ষা করতে গিয়ে শহীদ হয়েছে। আলি মজিদ বেগের নিহত হবার সংবাদ ফারগানায় পৌঁছানো মাত্র তামবাল দূর্গটা দখল করতে তাদের পাঠিয়েছিলো।
নিজের বিশ্বস্ত সর্দারের কথা মনে পড়তে বাবরের ভাবনা বিষণ্ণ হয়ে উঠে। আজকাল তার প্রায়ই এমন হচ্ছে। সবুজাভ-নীল তোরণদ্বারে আলি মজিদ বেগের মৃতদেহ প্রদর্শিত হবার পরের দু’বছরে সে কি অর্জন করেছে? নিজের পরিবারকে মুক্ত করার ব্যাপারে বা ফারগানা পুনরায় অধিকার করার ব্যাপারে সে কতটা অগ্রসর হয়েছে, সমরকন্দের কথা না হয় সে বাদই দিল? আর কতদিন তাকে সালতানাৎবিহীন একজন সুলতান হিসাবে দিন কাটাতে হবে? আকশি আক্রমণ করে তার পরিবারকে মুক্ত করে সিংহাসন পুনরুদ্ধার করার মতো একটা সেনাবাহিনী গঠন করা একটা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। আর সমরকন্দ, সেখানে শাসক হিসাবে কাটানো কয়েকটা দিন এখন কেবল ধূসর স্মৃতি। মাঝে মাঝে তার বিশ্বাস করতেই কষ্ট হয় যে এমন কিছু আসলেই ঘটেছিলো। গ্রান্ড উজিরের কথাই শেষ পর্যন্ত সত্যি হলো।
ভাবনাটা বাবরকে ক্রুদ্ধ করে তোলে। সে তার পায়ের কাছে পড়ে থাকা একটা কর্তিত মস্তকে লাথি বসিয়ে দিলে সেটা ছিটকে দূরে গিয়ে পড়ে। তার লোকদের যেমন, তারও বিনোদনের দরকার আছে। কয়েকটা ডাল কেটে পোলো খেলার লাঠি তৈরি করো।” সে চিৎকার করে বলে। “এইসব দুবৃত্তদের মাথা দিয়ে পোলো খেলা যাক। গোলপোস্ট হবে ঐ দূরের গাছগুলো।”
পুরো একটা ঘণ্টার জন্য, উদ্দাম খেলায় বাবর নিজেকে ডুবিয়ে রাখে। চকরাখদের ক্ষিপ্রগামী টাটুঘোড়ার একটা নিয়ে সে একেবেঁকে দাবড়ে বেড়ায় এবং শাখাপ্রশাখা ছেটে ফেলা গাছের ডাল দিয়ে ছিন্ন মস্তকগুলোকে সজোরে আঘাত করে। যাতে ঘাসের উপর দিয়ে লাফাতে লাফাতে সেগুলো গড়িয়ে যায়। শীঘ্রই সেগুলোকে আর কাটা মাথা বলে চেনার কোনো উপায় থাকে না- নাক, কান গুঁড়িয়ে যায়, অক্ষিকোটর থেকে অক্ষিগোলক বের হয়ে আসে এবং বাবর আর তার ঘর্মাক্ত সাথী খেলোয়াড়েরা আর সেই সাথে তাদের সবার ঘোড়া, রক্তের ফুটকিতে চিত্রিত হয়ে উঠে।
অবশেষে খেলাটার প্রতি তার বিরক্তি জন্মায় কিন্তু ভেতরের জমে ওঠা হতাশা আর ক্ষোভ নিঃসৃত হওয়ায়, বাবর ঘামে ভিজে ওঠা ঘোড়াটাকে অবশেষে রেহাই দেয়। চারপাশে তাকাতে সে দেখে ওয়াজির খান তার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। এই প্রথম সে তার চোখে বিরক্তি দেখতে পায়। কিন্তু বাবর তাতে বিন্দুমাত্র লজ্জি বোধ করে না। জীবিত বা মৃত, সে তার শত্রুদের সাথে তাদের প্রাপ্য ব্যবহারই করেছে।
“চলো এবার যাওয়া যাক।” সে আদেশ দেয়। “গাভা এখনও অনেক দূরে, আর আমাদের গৃহকর্তাকে অপেক্ষা করিয়ে রাখাটা ঠিক হবে না।” বাবর ঘোড়ার পাঁজরে এত জোরে খোঁচা দেয় যে সেটা ছুটতে শুরু করে। বাবর সরাইখানা থেকে সোজা নদীর অগভীর অংশের দিকে এগিয়ে যায়।একবারও পেছনে ফিরে তাকায় না। আঙ্গিনায় পড়ে থাকা রক্তাক্ত মাথাগুলোকে ইতিমধ্যে কাকের দল ঠোকরাতে শুরু করেছে এবং সরাইখান মেয়ে দুটো পা ঈষৎ ধনুকের মত ফাঁক করে এগিয়ে গিয়ে চকরাখদের লাশগুলো হাতিয়ে দেখে যে বাবরের লোকেরা ভুলে কিছু রেখে। গেছে নাকি, যা তাদের বেশ্যাবৃত্তির পাওনার উপরি বলে বিবেচিত হতে পারে।
***
তিন সপ্তাহ পরে। উঁচু পাহাড়ী এলাকার তৃণভূমির উজ্জ্বল সবুজ ঘাসের মাঝে মাঝে ফুটে থাকা হলুদ গোলাপী আর সাদা ফুলের মাঝ দিয়ে বাবর আর তার লোকেরা দুলকি চালে ঘোড়া দাবড়ে শাহরুখিয়ার দিকে এগিয়ে যায়। গাভার অভিযানে ক্ষয়ক্ষতি হলেও তারাই জয়ী হয়েছে। তিনশ গজ দূরে ঘোড়ার পিঠে বসে থাকা অবস্থায় বাবর নিজে তীর ছুঁড়ে দূর্গের সেনাপতিকে হত্যা করেছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তার নিজের ব্যবহৃত ছোট নিখুঁতভাবে বাঁকানো ধনুক দিয়ে তীর ছোঁড়ার অভ্যাসে কাজ হয়েছে। ত্রিশটা শর ভর্তি তূণীর সে এক মিনিটের ভিতরে খালি করে ফেলতে পারে।
সেনাপতি মারা যাবার পরে, প্রতিরোধকারীদের মনোবল ভেঙে যায়। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সেনানিবাসের সৈন্যরা কেবল আত্মসমর্পনই করেনি, নিজেদের লুটের মাল পুরো তাদের হাতে তুলে দিয়েছে। যা বাবর আর তার লোকদের ঘোড়ার পিঠে ঝোলানো চামড়ার থলির উপচে পড়া আকৃতি সাক্ষ্য দিচ্ছে।
ওয়াজির খান খুব খুশি হবে। এবারের অভিযান বাবরকে তার বুড়ো বন্ধুটির সহায়তা ছাড়াই পরিচালনা করতে হয়েছে। সরাইখানা আক্রমণ করার পরের দিন ওয়াজির খানের ঘোড়া সাপের ভয়ে বেমাক্কা লাফিয়ে উঠতে সে পড়ে গিয়ে উরুতে ব্যথা পেয়েছিলো। বাবরের সনির্বন্ধ অনুরোধে তিনি শাহরুখিয়ায় ফিরে যেতে রাজি হন বাইসানগারের সাথে যোগ দিতে, যাকে তারা সেখানের নিরাপত্তার দায়িত্ব দিয়ে এসেছে।
আজ রাতে তারা বিজয় উদযাপন করবে। সে তার লোকদের সম্মান জানাতে তাদের মাঝে উলুশ বিতরণ করবে। যোদ্ধাদের ভিতরে যারা সবচেয়ে সাহসিকতা আর বীরত্ব প্রদর্শন করেছে প্রথা অনুযায়ী আজ সে ভোজসভার শেষে তাদের মাঝে লুটের মালের সিংহভাগ বিলিয়ে দেবে এবং বাইসানগার আর ওয়াজির খানকে গাভা আক্রমণের কাহিনী শোনাবে। তার গল্প শুনে ওয়াজির খান সম্ভবত হেসে অস্থির হবেন এবং সদা গম্ভীর বাইসানগারের মুখেও সে আজ হয়তো হাসির আভাস দেখতে পাবে।
পাথরের তৈরি দূর্গের অভ্যন্তরস্থ প্রাঙ্গনে প্রবেশের সাথে সাথে, বাবর তার ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফিয়ে নেমে তাদের খোঁজে আশেপাশে তাকায়। বাইসানগারকে সে কোথাও খুঁজে পায় না। কিন্তু ওয়াজির খানকে আস্তাবলের সামনে দাঁড়িয়ে ঘোড়ার খুরের উপরের আর পেছনের অংশের কেশগুচ্ছ পর্যবেক্ষণ করতে দেখে। তার বুড়ো বান্ধবকে সামান্য খোঁড়াতে খোঁড়াতে তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখলে: বাবর ভ্রূ কোঁচকায়। তারপরে সে তাকিয়ে দেখে ওয়াজির খানের মুখ আনন্দে আলোকিত হয়ে রয়েছে।
“সুলতান, দারুণ সুখবর আছে! সত্যিই চমকে দেবার মত সুখবর!”
“কি হয়েছে?”
“এক সপ্তাহ আগে আকশি থেকে এক বার্তাবাহক এসেছে। আপনার সৎ-ভাই জাহাঙ্গীরের পক্ষে তামবালের বাণী নিয়ে সে এসেছে। অন্তত বার্তাবাহকের তাই ভাষ্য এবং সে বলেছে তারা আপনার আম্মিজান, নানীজান আর আপনার বোনকে আপনার কাছে পাঠাতে সম্মত আছেন।”
“সে কি এর বিনিময়ে কিছু দাবি করেছে?”
“সুলতান, প্রকাশ্যে তারা কিছু দাবি করেনি। আপনাকে সে কতোটা শ্রদ্ধা করে কেবল সে সম্পর্কে কিছু মধুর বাক্য ছাড়া।”
বাবরের হৃৎপিণ্ড আনন্দে নেচে উঠে। তার পরিবার শীঘ্রই তার সাথে মিলিত হবে। এই খবরটা আবার তাকে আবেগতাড়িত করে তোলে।
“তারা এখানে কবে নাগাদ পৌঁছাবে?”
“সবকিছু ঠিক থাকলে আগামীকাল সূর্যাস্ত নাগাদ তাদের এখানে পৌঁছাবার কথা।”
পরের দিন সন্ধ্যাবেলা, গোধূলির অস্তমিত আলোয় বাবরকে দূর্গের প্রকারবেষ্টিত সমতল ছাদে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। আজকের দিনের অধিকাংশ সময় সে এখানেই কাটিয়েছে। অস্থিরচিত্তে রাস্তাটা যেখানে একটা গিরিখাদের দিকে বাঁক নিয়েছে, সেদিকে চোখ কুঁচকে তাকিয়ে রয়েছে। ঘনায়মান আধো-অন্ধকারের ভিতর থেকে সে পিঠের দুপাশে ঝুড়ি ঝুলছে উটের এমন একটা তরঙ্গায়িত সারিকে বাঁক ঘুরে এগিয়ে আসতে দেখে। তাদের ঠিক পেছনেই রয়েছে যাত্রার শেষ পর্যায়ে মেয়েদের অভ্যর্থনা জানাতে। আর তাদের নিরাপদে দূর্গে নিয়ে আসবার জন্য, ওয়াজির খানের পরামর্শে, বাইসানগারের অধীনে পাঠানো সৈন্যবাহিনীর একটা চৌকষ দল।
বাবর এতদূর থেকে ঝুড়িতে ভ্রমণকারীদের চেহারা দেখতে পায় না। নিজেকে আর সামলে রাখতে না পেরে, এবং দেহরক্ষীদের কাউকে ডাকবার বা ঘোড়ার পিঠে জিন চাপাবার মতো ধৈর্যের মারাত্মক অভাব দেখা দেয়ায়, সে লাফিয়ে একটা খালি ঘোড়ার পিঠে চেপে বসে এবং সবুজ ঘাসে আচ্ছাদিত তৃণভূমির উপর দিয়ে ছোট কাফেলাটার দিকে ছুটে যায়।
তার রোদে পোড়া গাল বেয়ে দরদর করে কান্না ঝরতে থাকে। কিন্তু সেসব সে মোটেই পরোয়া করে না। আশেপাশে কেউ নেই তার কান্না দেখবার মতো এবং তার চেয়েও বড় কথা, দেখলে দেখুক সে থোড়াই পরোয়া করে। দুর্বলতার না, আজ এটা আনন্দের অশ্রু। এক হাতে ঘোড়ার কেশর আঁকড়ে ধরে সে অন্য হাতে গাল থেকে কান্না মুছে। বাবর ঘোড়াটার কানে কানে তাকে এমন গতিতে ছুটতে বলে, যাতে মনে হয় হঠাৎ তার পাখা গজিয়েছে।
কাফেলাটাকে পাহারা দিয়ে নিয়ে আনা সৈন্যদের থেকে চারজন সহসা আলাদা হয়ে বর্শা নিচু করে তার দিকে এগিয়ে আসে। যদিও বাইসানগার সম্ভবত ধারণা করতে পেরেছিলো খালি ঘোড়ার পিঠে এমন উদ্দাম ভঙ্গিতে কে তাদের দিকে ছুটে আসছে। কিন্তু তার মত অভিজ্ঞ পোড়খাওয়া যোদ্ধা তার কাছে এটাই প্রত্যাশিত যে সে নিজের লোকদের আদেশ দিয়েছে তার পরিচয় নিশ্চিত করতে। অশ্বারোহী দল নিকটবর্তী হতে, বাবর জোর করে নিজের ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে তাকে থমকে দাঁড়িয়ে পড়তে বাধ্য করে। ঘামে জবজব করতে থাকা দেহে নাক ঝেড়ে নিজের বিরক্তি প্রকাশ করে ঘোড়াটা।
বাবর মাথাটা পেছনে হেলিয়ে দিয়ে তার পূর্বপুরুষের রণহুঙ্কার কণ্ঠে তুলে নেয়। “ফারগানা!”
অশ্বারোহী দল এখন আরো কাছে চলে আসায় তারা তাকে চিনতে পেরে অভিবাদন জানায়। বাবর কোনোমতে তাদের অভিবাদনের জবাব দিয়ে উটের কাফেলা যেখানে যাত্রা বিরতি করেছে সেদিকে ঘোড়া ছোটায়। তার হৃদয় যদি আবেগে ভারাক্রান্ত না থাকত অন্যসময় হলে তাহলে সে হয়তো বাজারে নিয়ে যাওয়া মুরগীর মতো ভীরু ভঙ্গিতে বেতের ঝুড়ির ভিতর থেকে এসান দৌলতের উঁকি দেবার হাস্যকর ভঙ্গি দেখে হয়তো হেসেই ফেলতো। তার ওজন এতোটাই হাল্কা যে অন্যপাশের ঝুড়িতে ভারসাম্য রক্ষার জন্য বাঁধাকপির চেয়ে ভারী কিছু রাখতে হয়নি। আর তার বীণা ঝুড়ির বাইরে চামড়ার ফালি দিয়ে আটকানো রয়েছে। একটা বিশাল পুরু লোমের দুধসাদা রঙের উট যা বাবরকে এগোতে দেখে পচাৎ করে থুতু ফেলে সেটার দু’পাশে দুটো ঝুড়িতে খুতলাঘ নিগার আর খানজাদা আরোহন করেছেন। উটের পেছনে বাবর তার আম্মিজানের পরিচারিকা দলের কয়েকজন পরিচিত সদস্য, যাদের ভিতরে ফাতিমাও রয়েছে আর তার উজির কাশিমকে দেখতে পায়।
উটের চালকরা লাফিয়ে নেমে, উটের গ্রন্থিযুক্ত হাঁটুতে তাদের হাতের লাঠি দিয়ে আঘাত করে উটগুলোকে বাধ্য করে মাটিতে বসতে। বয়োবৃদ্ধ হবার কারণে, বাবর দৌড়ে প্রথমে এসান দৌলতের কাছে যায় এবং হাঁটু মুড়ে বসে তাকে আলতো করে ঝুড়ি থেকে তুলে আনে। বাবর কোনো কথা খুঁজে পায় না, আর এই প্রথমবারেরমতো মুখরা এসান দৌলতও বাক্যহারা হয়ে পড়েন। সে টের পায় নানীজান তার মাথা আলতো স্পর্শ করেন। সে উঠে দাঁড়িয়ে তার ছোট ছোট উজ্জ্বল চোখের দিকে তাকালে সেখানে তার পুরানো সত্ত্বার ঝলক দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। নানীজানকে এখন তিনি বরাবর যার জন্য গর্ব করেন,সেই খামের- চেঙ্গিস খানের রক্তের উত্তরসুরী এক নারীর মতোই দেখাচ্ছে।
সে এবার ঘুরে দাঁড়িয়ে তার আম্মিজানকে ঝুড়ি থেকে তুলে মাটিতে নামিয়ে দেয় এবং তাকে জড়িয়ে ধরে তার আশৈশব পরিচিত চন্দনকাঠের উষ্ণ সুগন্ধে বুক ভরে শ্বাস নেয়। সে তার আলিঙ্গন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে তাকিয়ে দেখে আম্মিজানের চোখে অশ্রু টলটল করছে। “বাছা তোমাকে আবার দেখতে পেয়ে খুশি হলাম,” কোনো রকমের আবেগ না দেখিয়ে তিনি বলেন, এবং তার মুখে একটা হাসির আভাস ফুটে উঠে যা বাবরের যেমনটা মনে আছে তার চেয়েও ম্লান এবং বলিরেখায় আকীর্ণ।
খানজাদা ইতিমধ্যে তাকে বহনকারী ঝুড়ি থেকে নিজেই ধড়ফড় করে নেমে এসেছে। এবং সে সোজা ভাইকে লক্ষ্য করে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তার পোষা বেজী যেটা সে বামহাতে ধরে রেখেছে, কুইকুই করে প্রতিবাদ জানায়। শেষবার বাবর তার বোনকে দেখেছিলো হাড্ডিসার একটা মেয়ে, যার মুখে কয়েকটা দাগ রয়েছে। খানজাদা এখন রীতিমত একজন মহিলাতে পরিণত হয়েছে, তার দেহে ভরা নদীর জোয়ার বইছে। মুখ আগের চেয়ে অনেক দাগহীন আর সুন্দর। কিন্তু ফিচেল হাসি আগের মতোই আছে দেখে সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। সে তাকে জড়িয়ে ধরে এবং তারপরে ছেড়ে দিয়ে এক পা পিছিয়ে আসে ভালো করে তাকে দেখবে বলে।
খানজাদাও কম যায় না সেও ভাইকে জরিপ করে। “তুমি লম্বা হয়েছে।” সে বলে, “আর তোমার কাঁধ আগের চেয়ে চওড়া হয়েছে। কিন্তু একি চেহারা হয়েছে। তোমার থুতনিতে ছাগলের মত দাড়ি আর চুলের অবস্থা যাচ্ছেতাই- তোমার চুল দেখছি আমার মত লম্বা! আর নখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না- কালো হয়ে আছে।”
বাবর পেছন থেকে, খানজাদার নাক কোঁচকানো বিশেষণগুলোর সমর্থনে এসান দৌলতকে জিহ্বা আর টাকরার সাহায্যে একটা শব্দ করতে শোনে এবং সে হেসে ফেলে। অবশেষে তার প্রিয়জনেরা তার কাছে এসেছে এবং সবকিছু যেমনটা থাকার কথা তেমনই রয়েছে। তাদের সাথে সে পরে কথা বলবে এবং শুনবে বিগত দিনগুলো তাদের কেমন কেটেছে। কিন্তু এখনকার মতো এই যথেষ্ট।
তারা দূর্গের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। অবশেষে মুক্তি লাভ করা ফারগানার শাহী রমণীদের অভ্যর্থনা জানাতে তূর্যনিনাদ আর রণভেরী গমগম আওয়াজে বেজে উঠে- অন্তত এখনকার জন্য হলেও তারা নিরাপদ।
দূর্গের উপরের তলায় প্রস্তুত রাখা জেনানামহলে মেয়েদের পৌঁছে দিয়ে, বাবর তার বঁধুনিকে ডেকে পাঠায়। তার পরিকল্পিত ভোজসভার সব আয়োজন কি অবস্থায় আছে তা জানতে। এখানের ভোজসভা সমরকন্দের মতো জাঁকজমকপূর্ণ হবে না। যেভাবে সে তাদের অভ্যর্থনা জানাতে চেয়েছিলো। অবশ্য, তাহলেও বিশটা ভেড়া জবাই করা হয়েছে আর আঙ্গিনায় সেগুলোকে আগুনে ঝলসানো হচ্ছে। মুরগীর পালক ছাড়িয়ে, আখরোট আর খুবানির সাথে মাখন দিয়ে সিদ্ধ করা হচ্ছে। আস্ত আপেল ঘন সোনালী বর্ণের মধু আর লাল রসে ভরা ডালিমের দানার সাথে কাঠবাদাম আর পেস্তার মিশ্রণে চিকচিক করছে। তাদের কোনো এক অভিযানে তার লোকদের লুট করা রূপালি বর্ণের কাঠবাদামের স্তূপের দিকে সে বিশেষ সন্তুষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে। এসান দৌলত অন্য যে কোনো মিষ্টির চেয়ে এগুলো বেশি পছন্দ করেন।
নির্মেঘ, তারা-শোভিত আকাশে চাঁদ উঠলে, এবং কোনো আকষ্মিক হামলা থেকে আগেই সাবধান করতে দূর্গপ্রাকারে সৈন্য মোতায়েন করে ভোজসভা শুরু হয়। বাবর আর তার লোকেরা নিচুলার একটা নিচু, লম্বা কামরায় আহার সারে। যখন উপরে নিজেদের কামরায় মেয়েদের তাদের পছন্দের অংশ পরিবেশন করা হয়। মোমবাতির কাঁপা আলোতে বাবরের লোকেরা উদাত্ত কণ্ঠে গান শুরু করে। বাকীরা যে নিচু কাঠের টেবিলের চারপাশে আসনসিঁড়ি হয়ে বসে আছে তাতে চাকুর বাট দিয়ে আঘাত করে তাল দেয়। বাবর ভাবে, তার লোকেরা খুশি হয়েছে। মেয়েদের মুক্তিতে তারাও প্রীত হয়েছে। তার সাথে সাথে তার লোকদেরও এটা সম্মানহানির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো- যেনো মেয়েদের মুক্ত করার সামর্থ্য তাদের নেই।
বাবর খেতে চেষ্টা করে কিন্তু কিছুই খেতে পারে না। তার ইচ্ছা করে এখান থেকে উঠে যায় এবং তার আম্মিজান, খানজাদা আর এসান দৌলতের সাথে নিভৃতে সময় কাটায়। কিন্তু তার অনুসারীদের প্রতি সৌজন্যতাবশত তাকে আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। গানের মাত্রা ধীরে ধীরে চড়তে শুরু করে এবং ক্রমশ কর্কশ হয়ে উঠে। যোদ্ধার দল উচ্চকণ্ঠে নিজেদের পূর্বপুরুষের বীরত্বের কথা বয়ান করতে থাকে এবং বাবরও এবার তাদের সাথে কণ্ঠ মেলায়। কিন্তু অবশেষে, কেউ কেউ টেবিলের উপরে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ে। আর অন্যেরা ঝাপসা চোখে টলোমলো পায়ে কামরা থেকে বের হয়ে বাইরের আঙ্গিনায় নিজেদের হাল্কা করতে শুরু করলে, বাবর তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পাথরের বাঁকানো সিঁড়ি বেয়ে জেনানামহলের দিকে রওয়ানা দেয়।
খুতলাঘ নিগার দু’হাত বাড়িয়ে দিয়ে তাকে স্বাগত জানায় এবং সে ভিতরে প্রবেশ করে গালিচা পাতা মেঝেতে তার পাশে এসে বসে। তাদের সামনের পিতলের থালায় পড়ে থাকা খাবারের অবশিষ্টাংশ দেখে সে বুঝতে পারে মেয়েরা ভালমতোই খেয়েছে। কিন্তু তারপরেও সে এখন যখন তাদের মুখের দিকে তাকায় সেখানে সে একটা টানটান অভিব্যক্তি লক্ষ্য করে। তাদের তিনজনকেই ফ্যাকাশে আর বিবর্ণ দেখায়। যেনো বহুকাল সূর্যের আলোর উষ্ণতা অনুভব করেনি বা তাজা বাতাসে তারা শ্বাস নেয়নি। কাউকে না কাউকে অবশ্যই এর মূল্য দিতে হবে- রক্ত দিয়ে। কিন্তু মেয়েদের খাতিরে আপাতত সে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করে না। তারা যাই বলুক তাকে, সে অবশ্যই সব কিছু শান্ত ভঙ্গিতে শুনবে।
কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ বসে থাকে। প্রাথমিক উত্তেজনা প্রশমিত হতে, কেউই বুঝতে পারে না কোথা থেকে শুরু করা উচিত।
অবশেষে এসান দৌলত শুরু করেন: “বাবর তুমি তাহলে সরমকল দখল করেছিলে।” তার বিচক্ষণ মুখে বিরল একটা হাসির আভাস ফুটে উঠে।
“অধিকার করেছিলাম বটে, কিন্তু দখলে রাখতে পারিনি।” বাবর তার মাথা নিচু করে। এমন কিছু কথা আছে যা তাকে বলতেই হবে। “নানীজান, আমি আপনাকে হতাশ করেছি। আপনি আমার সাহায্য চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছিলেন এবং আমি সাহায্য করতে ব্যর্থ হয়েছি। আমার আসতে বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছিল আর লোকজন ছিল অনেক অল্প।”
“আমাদের তুমি মোটেই হতাশ করনি। আর জেনে রেখো, আমাদের কারণেই তুমি সমরকন্দ হারিয়েছে। আমাদের সাহায্য করার জন্য তুমি সাথে সাথে যাত্রা করেছিলে। তুমি এরচেয়ে বেশি আর কিইবা করতে পারতে?”
বাবর আক্ষেপের সাথে মাথা নাড়ে। “ফারগানা আর আপনারা ছিলেন আমার প্রধান দায়িত্ব। সমরকন্দে আমি নতুন কোনো খেলনা হাতে পাওয়া শিশুর মতো আচরণ করেছিলাম। আমার তখন অন্য কিছু সম্বন্ধে ভাববার সামান্যই অবকাশ ছিলো। আপনাদের আর ফারগানার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আমার উচিত ছিলো ওয়াজির খানকে পাঠিয়ে দেয়া।” সে তার মায়ের গায়ে হেলান দেয় এবং বরাবরের মতোই মায়ের আঙ্গুল তার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে টের পায়। এতে সে কিছুটা শান্ত হয়।
“কিছু কিছু বিষয় তামবাল আমাদের কাছে কখনও গোপন করেনি।” খুতলাঘ নিগার বলেন। “আমার মনে হয় এতে সে আনন্দই পেতো। আমরা, তোমার চাচাতো ভাই মাহমুদের বিশ্বাসঘাতকতার কথা অবশ্যই জানি- আমরা জানি সেই সমরকন্দ তোমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে। বাছা, সে আর তামবাল মিলে তোমার জন্য একটা ফাঁদ পেতেছিলো। তারা দু’জনে মিলে ঠিক করেছিলো, ফারগানায় সে তোমাকে মসনদ থেকে সরিয়ে দিয়ে জাহাঙ্গীরকে তোমার স্থলাভিষিক্ত করবে। তারা জানতো এর ফলে তুমি বাধ্য হবে- তোমার বেশিরভাগ সৈন্য নিয়ে ফারগানায় ফিরে আসতে। আর মাহমুদ এর ফলে তার কাঙ্ক্ষিত সুযোগ পায়। তুমি তখন সদ্য সমরকন্দের সুলতান হয়েছে। তারা বলেছে যে সেখানকার অভিজাত ব্যক্তিরা তোমার প্রতি তেমন একটা আনুগত্য বোধ না করায়, মাহমুদ আর তার কলহপ্রিয় স্ত্রী, গ্রান্ড উজিরের কন্যা সহজেই ঘুষ দিয়ে তাদের কিনতে পেরেছে।”
নিজের সবচেয়ে জঘন্য সন্দেহটা প্রমাণিত হতে বাবর চোখ বন্ধ করে ফেলে। কি আহাম্মকই না সে ছিলো।
“তোমার এটাও জেনে রাখা উচিত, মাহমুদের স্ত্রীর কারণে সে গো ধরায় আলি মজিদ বেগকে হত্যা করা হয়েছিলো।” এসান দৌলতের কণ্ঠস্বর তিক্ত শোনায়। নিহত গোত্রপতির মা ছিলো তার বান্ধবী আর তিনি নিজেও তাকে পছন্দই করতেন। “সে নাকি বলেছে তোমার শিরোচ্ছেদ করতে না পারায়, তাকে শিরোচ্ছেদ করলেই আপাতত চলবে- তার বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ হিসাবে। মাহমুদ তার কথা ফেলতে পারেনি। সবাই বলে সেই আসলে সমরকন্দের নতুন শাসক। নিজের বাবার চেয়েও সে বেশি লোভী আর প্রতিহিংসাপরায়ণ।”
বাবর বিস্ময়ে চোখ পিটপিট করে। সে ভাবতেও পারেনি সেই সুঠামদেহী তরুণী, যে এমন সাহসিকতার সাথে গ্রান্ড উজিরের প্রাণ ভিক্ষা চেয়েছিলো কিভাবে এতো অনুভূতিহীন নিষ্ঠুর আর নির্মম হতে পারে। একদিন তাকে অবশ্যই তার এই স্পর্ধার জন্য জবাবদিহি করতে হবে। কিন্তু সেটা পরেও হতে পারে। তার আগে তাকে অন্য অনেক বিষয় জানতে হবে এবং সেগুলো মেনে নিতে হবে।
সে আলতো করে দু’হাতের মাঝে মায়ের হাত জড়িয়ে ধরে। “আমাকে তোমাদের কথা বলল। তোমরা বন্দি থাকা অবস্থায় কেমন আচরণ করছে তারা তোমাদের সাথে?”
“কয়েকজন মাত্র পরিচারকসহ আমাদের একটা ছোট জায়গায় আটকে রাখা হয়েছিলো কিন্তু আমাদের বংশ গৌরব আর মর্যাদার কারণে তারা বাধ্য হয়েছিলো আমাদের যথাযথ সম্মান দেখাতে। তামবাল আমাদের অপমান বা হুমকি দেয়নি।” তার মা বলে, “আর সম্প্রতি- সম্ভবত তোমার সাফল্যের কথা যখন সে জানতে পারে- আমাদের বড় একটা মহলে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো।”
“আর সে রোক্সানাকে আমাদের গহনা কেড়ে নিতে দেয়নি। অবশ্য অন্যদের মুখে শুনেছি সে ক্রুদ্ধ হয়ে চেঁচামেচি করেছে, যদিও সে তামবালের অঙ্কশায়িনী ছিলো।” এসান দৌলত কুপিত কণ্ঠে কথাগুলো বলেন।
“আর আমার সৎ-ভাই জাহাঙ্গীর? এসবে তার ভূমিকা কতটুকু?” বাবর প্রায়ই তার স্থান দখল করে নেয়া বালকটার কথা ভাবে যাকে সে কখনও দেখেনি। শেষবার আকশি থেকে আসবার সময়ে, সমরকন্দ অবরোধের প্রস্তুতি নেবার সময়ে, ছোঁড়া অসুস্থ ছিলো।
“বেচারা পরিস্থিতির শিকার, আর প্রায়ই অসুস্থ থাকে। তামবালের পুরো শরীরে কয়েক চামচ পরিমাণ রাজরক্ত থাকায় সে কখনও নিজে সিংহাসন দাবি করতে পারবে না। অন্য গোত্রপতিরা সেটা তাকে করতেও দেবে না। কিন্তু জাহাঙ্গীরের রাজপ্রতিভূ হিসাবে যে ক্ষমতার জন্য সে লালায়িত সেটা অর্জন করতে পারবে।” এসান দৌলত ভাবাবেগশূন্য কণ্ঠে কথাগুলো বলেন। “সে এখন তোমাকে ভয় পায়। সে যদি তোমাকে খুশি করতে না চাইতো, তাহলে আমাদের এতো সহজে মুক্তি দিতো না?”
সুলতান হিসাবে বাবর নিজের প্রথম দিনগুলোর কথা ভাবে, তার মনে পড়ে তামবাল তখন কিভাবে অন্য নেতাদের মনে সন্দেহের বীজ বপনের চেষ্টা করেছে। সব সময়ে সে নিজের উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিবৃত্ত করার চেষ্টারত ছিলো। কী সাংঘাতিক সুবিধাবাদি এক লোক- কামবার আলীর ষড়যন্ত্রে যোগ দেবার ব্যাপারে ভীষণ বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে সঠিক সময়ের জন্য ধৈর্যসহকারে অপেক্ষা করেছে। এজন্যই কি সমরকন্দ দুবার অবরোধ করতে সে তাকে প্ররোচিত করেছিলো? বাইসানগার যখন তৈমূরের অঙ্গুরীয় নিয়ে এসেছিল তখন আগ্রহে চকচক করতে থাকা তামবালের চেহারা তার এখনও মনে আছে। তার আরো মনে আছে, সমরকন্দ অধিকার করার পরে কি রকম তাড়াহুড়ো করে সে ফারগানা ফিরে এসেছিলো।
“আমাদের জন্য সবচেয়ে কঠিন সময় ছিলো প্রথম কয়েক মাস, যখন আমরা জানতাম না তোমার ভাগ্যে কি ঘটেছে। ফাতিমা- তুমি জান সে কেমন গপ্পোবাজ সে একবার একটা কথা শুনে আসে- একটা গুজব কিন্তু সেটাই আমাদের আতঙ্কিত করে তোলার জন্য যথেষ্ট ছিলো- যে তুমি ফারগানায় ফিরে আসার সময়ে পথে অসুস্থ হয়ে মারা গিয়েছে। তার মায়ের কণ্ঠস্বর কেঁপে যায়। কিন্তু তারপরেই আমরা শুনতে পাই যে তুমি সুস্থ আছো, আর পাহাড়ে আত্মগোপন করে রয়েছে। আমরা জানতাম না কোনটা সত্যি। যতদিন না তামবাল ক্রুদ্ধ হয়ে আমাদের কাছে আসে…সে আমাদের বলে তুমি গ্রামের পর গ্রাম আক্রমণ করে, সবকিছু জ্বালিয়ে দিচ্ছ, তছনচ করে দিচ্ছ এবং নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছো, কাউকে রেয়াত না দিয়ে।”
“তামবাল যা বলেছে, সেটাই তাহলে সত্যি, তাই না বাবর? যে তুমি একজন সাধারণ দস্যু আর গরু-চোরে পরিণত হয়েছো?” এসান দৌলত প্রশ্রয়ের কণ্ঠে বলেন।
বাবর সম্মতি প্রকাশ করে মাথা নাড়ে এবং মুহূর্ত পরে নানীজানের দিকে তাকিয়ে সেঁতো হাসি হাসে। তার মা আর নানী তার সম্বন্ধে কি ভাববে সেটা নিয়ে সে প্রায়ই দুশ্চিন্তা করতো। তারা কি কখনও বুঝতে পারবে কেনো একজন শাহজাদা পাহাড়ী দুৰ্বত্তের জীবন গ্রহণ বাস্তবিক পক্ষে উপভোগ করতে পারে।”
“বাবর, আমাদের সেসব কথা বল।”
পশুর চর্বি দিয়ে তৈরি মোমবাতির দপদপ করতে থাকা শিখা নিভু নিভু হয়ে আসতে, বাবর তার সময় কিভাবে কেটেছে সেটা তাদের কাছে বর্ণনা করতে চেষ্টা করে। দুইশ কি তিনশ অভিযাত্রীর একটা বাহিনী নিয়ে, পাহাড়ের উপর থেকে ধেয়ে আসবার উত্তেজনাই আলাদা। রাতের বেলা তামবালের অনুগত বাহিনীর দূর্গ ঝটিকা আক্রমণের উল্লাস। আর তার পরে রাতের আঁধারে হারিয়ে যাবার, তার পর্যাণে বাধা শিকারের ছিন্নমস্তক থেকে টপটপ করে ঝরে পড়া রক্তের ধারার অনুপ্রেরণা। প্রাচীন মোঙ্গল প্রণালী অনুসরণে তার দলের এক লোক। ঘোড়ার দুধ গজিয়ে যে খভাস তৈরি করতো সেটা পান করার কারণে মাথা ঘুরতে থাকলে সারা রাত ধরে পানোন্মত্ত অবস্থায় ফুর্তি করা। চকরাখদের ছিন্নমস্তক দিয়ে উদ্দাম পোলো খেলার কথা সে কেবল এড়িয়ে যায়। যদিও খানজাদাকে হয়তো পরে সে সেটাও বলবে। তার কথা বলার সময়ে খানজাদার চোখ চকচক করতে থাকে। তার হাতের মুঠি খোলে আর বন্ধ হয়, যেনো সে নিজে সেখানে ছিলো। তার সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছে। এসান দৌলতও মগ্ন হয়ে শোনেন। কিন্তু সে খেয়াল করে মৃত্যুর করাল থাবার হাত থেকে অল্পের জন্য বেঁচে যাবার ঘটনাগুলো শোনার সময়ে তার মায়ের ভ্রু কুঁচকে উঠে।
“আমি কিন্তু কেবল যারা আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে তাদেরই আক্রমণ করেছি। আর আমি কখনও তোমাদের কথা ভুলে যাইনি। তোমাদের স্বাধীনতা আমার মসনদের চেয়েও বেশি কাম্য ছিল আমার কাছে।” চারপাশে তাকিয়ে, বাবর দেখে গবাক্ষের সরু ফাঁক দিয়ে ফ্যাকাশে, ধুসর আলোর একটা ধারা লুকিয়ে কখন যেন কামরায় প্রবেশ করেছে। প্রায় সকাল হয়ে এসেছে।
“তুমি এটা অর্জন করেছে। কিন্তু যা হয়ে গেছে তা হয়ে গেছে। এখন আমাদের ভবিষ্যতের দিকে তাকাতে হবে।” এসান দৌলতের কণ্ঠে একটা সতেজতা ফুটে থাকে এবং তার দৃষ্টি বাবর নিজের উপরে অনুভব করলে সে অস্বস্তিবোধ করে, যেন কোনো বাচ্চা ছেলে এখনই তার ওস্তাদের কাছে ধমক খাবে। “বাবর, তুমি এই ক’দিনে কি শিখেছো?” নানীজান তার দিকে ঝুঁকে এসে তার কব্জি আঁকড়ে ধরে। “ তোমার কথা অনুযায়ী মসনদহীন দিনগুলো থেকে তুমি কি শিখেছো?”
যুক্তিসঙ্গত একটা প্রশ্ন। এই বিপজ্জনক, মরীয়া সময় তাকে কি শিক্ষা দিয়েছে? “বিশ্বস্ত বন্ধু আর মিত্রের গুরুত্ব,” সে অবশেষে কথা খুঁজে পেয়ে বলে, “এবং তাদের যোগ্যতা অনুসারে প্রতিদান দেয়া। এছাড়া পরিষ্কার উদ্দেশ্য, একাগ্রচিত্ত কৌশল আর সেটা অর্জনের পথে কোনো কিছুকে বাধা হিসাবে গণ্য না করার প্রয়োজনীয়তা।”
এসান দৌলত সন্তুষ্টির মাথা নাড়েন। “অবশ্যই। এবং এছাড়া আর কি?”
“আমি শিখেছি একজন সুলতানের পক্ষে সবসময়ে উদারতা দেখান সম্ভব না, শ্রদ্ধা অর্জনের জন্য তাকে কঠোর হতে হবে- কখনও নির্মম। অন্যথায় তাকে দুর্বল মনে হবে। নেতৃত্ব দেবার বদলে সবার ভালবাসার পাত্রে পরিণত হবার ঝুঁকি দেখা দিতে পারে। আর সেই সাথে মিষ্টিভাষী ষড়যন্ত্রকারীর ফাঁদে পা দিয়ে বসতে পারে। আমি শিখেছিঃ আনুগত্য অর্জন করতে হলে কেবল কৃতজ্ঞতা আর সম্ভ্রম উদ্রেক করলেই চলবে না। এর সাথে সামান্য ভয়েরও মিশেল থাকতে হবে। আমি প্রথমবার ফারগানার শাসক হবার পরে বাকী বেগ, বাবা কাশক, আর ইউসুফকে প্রাণদণ্ড দেয়া উচিত ছিলো। তার বদলে আমি কেবল তাদের শাহী দায়িত্বপালন থেকে অব্যাহতি দিয়েছিলোম এবং জীবন ধারণের জন্য কোনো বাধা না দিয়ে বরং মনের ভিতরে তাদের তিক্ততা পোষণের সুযোগ দিয়েছি। এছাড়া, সমরকন্দ দখল করার পরে গ্রান্ড উজিরের কতিপয় সমর্থককেও কড়কে দেয়া উচিত ছিলো।
“তারচেয়েও বড় কথা, আমার নিয়তির প্রতি আমি আর কখনও অবহেলা প্রদর্শন করবো না। আমাদের সাথে আমার সাথে যা ঘটেছে তারপরেই কেবল আমি হাল্কা হাল্কা বুঝতে পারছি মানুষ তৈমূর লোক হিসাবে কেমন ছিলেন। মাঝে মাঝে তার নিজেকে কেমন একা মনে হয়েছে- নিজের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজ করতে গিয়ে তাকে কেমন অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়েছিলো। আর তাছাড়া, তাদের সব দায়দায়িত্ব পরে বহুবছর ধরে তাকে নিজের কাঁধে বহন করতে হয়েছিলো… আমি নেতৃত্ব দেবার মতো সাহসও অর্জন করেছি…ওয়াজির খানের মতো আমার যতো দক্ষ পারিষদ থাকুক আমার নিয়তি কেবল আমিই নির্ধারণ করতে পারি।
বাবর মুখ তুলে তার নানীজানের দিকে তাকায়। “দেখে নিয়ে, আমি ঠিক তৈমূরের মতই বীর হবো। আমি শপথ করে বলছি…”
“কথাগুলো সত্যিই শুনতে ভাল লাগে।” এসান দৌলত মন্তব্য করেন। “চলো আমাদের অনেক কাজ এখনও বাকি আছে। একটা নতুন দিনের প্রভাত হচ্ছে।”
দ্বিতীয় খণ্ড – সালতানাৎবিহীন এক সুলতান
০৭. আয়োধন আর অন্তর্ধান
বৃষ্টি আর তুষারপাতের মিশ্রণের প্রকোপ বাবরের ভেড়ার চামড়ার প্রলেপ দেয়া ভারী জ্যাকেটের আবরণও আটকাতে ব্যর্থ হয়। ফারগানার উত্তরে উঁচু পর্বতমালার অভ্যন্তরে এক প্রত্যন্ত উপত্যকার ভিতর দিয়ে বয়ে যাওয়া একটা ক্ষুদ্র স্রোতস্বিনীর তীরের প্রায় কাদা হয়ে থাকা বরফের ভিতর দিয়ে তার অবশিষ্ট লোকদের সামনে থেকে ঘোড়া নিয়ে এগিয়ে চলেছে, বৃষ্টি আর তুষারপাতের হাত থেকে বাঁচতে মাথা নিচু করে রাখা।
নিজের দুটো সালতানাই হারিয়েছে এটা অনুধাবন করার পরের প্রথম দিকের মুশকিল দিনগুলোতে, বাবর আকশি দূর্গের আশেপাশেই থাকবে বলে ভেবেছিলো আশা করেছিলো সব কিছু বাজি রেখে হলেও সে তার পরিবারকে মুক্ত করতে পারবে। ওয়াজির খান অনেক কষ্টে তাকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে, তার শত্রুরাও এমনই একটা মরীয়া প্রচেষ্টা আশা করছে আর তারা সেজন্য পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে রয়েছে। ওয়াজির খান, তার চিরাচরিত পিতৃসুলভ ভঙ্গিতে তাকে আশ্বস্ত করে পরামর্শ দিয়েছে, “আপনি যদি আপনার আম্মিজান, নানীজান আর বোনকে বাঁচাতে চান তাহলে নিজেকে বিপদের মুখে না ফেলে বরং শত্রুদের তটস্থ করে তুলেন, যাতে তারা আপনার নাম শুনলেই ভয় পায়। আর সেটা করতে হলে তাদের চাপের ভিতরে রাখেন। এখানে সেখানে তাদের আক্রমণ করে, আপনার বিরুদ্ধে সৈন্য সমাবেশ করবার আগেই সেখান থেকে সরে আসেন। ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে সবসময়ে একটা ভীতির সঞ্চার করতে থাকেন। আপনার শত্রুরা যাতে শান্তিতে ঘুমাতে না পারে। আর এটা করতে পারলেই সুলতান, তারা আপনার পরিবারের ক্ষতি করার কথা চিন্তাও করতে পারবে না।”
বাবর ওয়াজির খানের বক্তব্য মোটের উপরে বুঝতে পারে। সাবধানে বিবেচনা করে, সে একটা পরিকল্পনার কথা বলে। আমাদের একটা নিরাপদ আশ্রয়স্থল চাই। যেখানে আমরা শীতকালটা কাটাতে পারবো এবং প্রথম হামলার ছক কষতে পারবো। আমার মনে আছে যে প্রতিবার গ্রীষ্মের সময়ে সামরিক প্রশিক্ষণের অংশ হিসাবে আপনি একবার আমাকে উত্তরের পার্বত্য অঞ্চলে একটা অভিযানে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং উপত্যকার কেন্দ্রস্থলে একটা মাটির দূর্গে আমরা অবস্থান করেছিলাম। তামবালের অনুগত এক জায়গীরদার সেই নগণ্য সেনাছাউনির প্রধানের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলো। সেই দূর্গটা আমাদের জন্য চমৎকার আশ্রয়স্থল হিসাবে প্রতিপন্ন হতে পারে। কারো মাথাতেই বিষয়টা আসবে না। আপনি কি বলেন?”
“জায়গার কথা আমার মনে আছে। বাস্তবিকই প্রত্যন্ত অঞ্চলে দূর্গটা অবস্থিত, আর আমাদের উদ্দেশও হাসিল হবে।”
আর সে জন্যই সে ওয়াজির খানকে নিয়ে পাহাড়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেছিলো। তাদের সাথে কেবল দুশো লোক ছিলো। ওয়াজির খানের সাহায্যে বাবর অনেক যত্ন নিয়ে তাদের বাছাই করেছে, সে কেবল তাদেরই বাছাই করেছে যাদের বয়স অল্প আর কোনো পারিবারিক পিছুটান নেই বা বাইসানগারের মতো যারা তার বিশ্বস্ত অন্তরঙ্গ। বাকি সবাইকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে, তার ডাকের অপেক্ষা করতে বলেছে, যা তারা নিশ্চিতভাবেই পাবে। তাদের যাত্রার দ্বিতীয় সপ্তাহে তুষারপাত শুরু হয় এবং উচ্চতা বাড়বার সাথে সাথে তুষারের স্তর বৃদ্ধি পেয়ে তাদের যাত্রাকে শ্লথ করে তুলেছে।
“ওয়াজির খান, আপনার কি মনে হয় আমরা দূর্গ থেকে কতোটা দূরে অবস্থান করছি?”
“সুলতান, আবহাওয়া যদি এতোটা বিরূপ না হতো, আমরা তাহলে দূর্গটা এতক্ষণে দেখতে পেতাম। অবশ্য সুবিধাও হয়েছে, দূর্গের নিরাপত্তা রক্ষীরা আমাদের আগে থেকে দেখতে পাবে না। দূরের ঐ গাছগুলোর আড়ালে আমরা অবস্থান নেবো আর সামনেটা রেকী করার জন্য গুপ্তদূত পাঠিয়ে আমরা পর্যাণে যেটুকু শুকনো মাংস রয়েছে সেটা দিয়ে আহার সেরে নেবো।”
তাদের পাঠানো গুপ্তদূতেরা রেকী করে ফিরতে যে নব্বই মিনিট সময় লাগে তার পুরোটা সময়ই অবিশ্রান্তভাবে তুষারপাত হয়। কখনও ভারী বা কখনও হাল্কাভাবে। তার লোকেরা ফিরে আসতে দেখা যায়, ঘোড়া আর তার আরোহী তুষারে পুরো ঢেকে গেছে এবং গুপ্তদূতদের দলনেতা ঠাণ্ডায় নীল হয়ে আসা ঠোঁটে কোনোমতে কথা বলে। “এখান দু’মাইল দূরে একটা বাকের পরেই দূর্গটা অবস্থিত। দূর্গের বাইরে আমরা কোনো ঘোড়ার বা পায়ের ছাপ দেখতে পাইনি যাতে বোঝা যায়, আজ ভেতর থেকে কেউ টহল দিতে বা পর্যবেক্ষণ-ফাঁড়িতে যায়নি। আমরা যখন ঘোড়া থেকে নেমে দূর্গের কাছে এগিয়ে যাই, দূর্গের এক অংশ থেকে আমরা ধোয়া উঠতে দেখেছি- সম্ভবত রসুইখানা- কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো দূর্গের মূল ফটক তখন ভোলা ছিলো। স্পষ্টতই এই আবহাওয়ায় কেউ আক্রমণ করতে পারে সেই ব্যাপারটা তাদের মাথাতেও নেই।”
“চমৎকার, শীঘ্রই তাদের এই নিশ্চয়তা নরকে পরিণত হতে চলেছে। ওয়াজির খান, এটা ইতস্তত করার সময় না, সবাইকে এই মুহূর্তে প্রস্তুত হতে বলুন এবং তুষারপাতের মাঝে আমরা আত্মগোপন করে গুপ্তদূতদের সহায়তায় দূর্গে পৌঁছাবার পথের শেষ বাঁকে দ্রুত আর নিরবে গিয়ে হাজির হবো। সেখান থেকে মূল ফটকের উদ্দেশ্যে ঘোড়া দাবড়ে যাবো।”
ওয়াজির খান মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় এবং পাঁচ মিনিট পরে অশ্বারোহী বাহিনীর একটা সারিকে মন্থর গতিতে পাহাড়ী পথ বেয়ে উপরের দিকে উঠে যেতে দেখা যায়। তুষারাবৃত প্রেক্ষাপটের মাঝ দিয়ে প্রায় দু’মাইল এগিয়ে যায়। তুষারপাত এখন আগের চেয়ে অনেক কমে এসেছে। বাবরের চোখের সামনে একটা পাথুরে অবয়ব ভেসে ওঠে। দূর্গটা আর মাত্র হাজারখানেক গজ সামনে অবস্থিত। এখান। থেকে দূর্গ পর্যন্ত রাস্তাটা বেশ প্রশস্ত।
“আমরা এখান থেকেই আক্রমণ শুরু করবো। লোকদের বলেন অপ্রয়োজনীয় সবকিছু এখানে পাথরের আড়ালে রেখে কেবল হাতিয়ার নিয়ে প্রস্তুত হতে। যাতে বরফের উপর দিয়ে যতোটা সম্ভব দ্রুত ঘোড়া দাবড়ে আমরা দূর্গে পৌঁছাতে পারি।” তার লোকেরা নিরবে প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। কিন্তু তারা প্রস্তুত হতে হতে তুষারপাত একেবারে বন্ধ হয়ে যায় এবং সামনে- সাদা প্রেক্ষাপটের মাঝে একটা কালো আকৃতির মত দূর্গটা ভেসে উঠে।
“যারা প্রস্তুত, ঘোড়ায় আরোহন করো! কারো চোখে পড়ে যাবার আগেই আমাদের আক্রমণ করতে হবে!” বাবর চিৎকার করে কথাটা বলার ফাঁকে ময়ান থেকে আলমগীর বের করে আনে। সে লাফিয়ে জিনের উপরে উঠে বসে এবং তার বিশাল কালো ঘোড়াটাকে দূর্গের দিকে এগোতে বলে পেটে খোঁচা দেয় যার ফটক সে খোলা দেখতে পেয়েছে। দশজন যোদ্ধা পরিবেষ্টিত অবস্থায় এবং বাকীরা তার পেছনে সারিবদ্ধভাবে বিন্যস্ত। ঘোড়ার কাধ ধরে ঝুঁকে ছুটে যাবার সময়ে বাবর টের পায় তার কানে রক্তের চাপ বৃদ্ধি পেয়েছে। দূর্গের ফটক থেকে সে যখন মাত্র দুশো গজ দূরে, তখন ভেতর থেকে একটা চিৎকার তার কানে ভেসে আসে- শত্রুরা তাদের দেখে ফেলেছে। ভেতরের লোকেরা বিপদ টের পায়। তারা ফটকের পাল্লা বন্ধ করার চেষ্টা করতে সেটা কেঁপে উঠে। কিন্তু নতুন জমা বরফ পাল্লা নড়তে বাধা দেয়। দু’জন লোক বাইরে ছুটে আসে, বরফের স্তূপে লাথি দেয় এবং বৃথাই চেষ্টা করে পাল্লাটা বরফের উপর দিয়ে সরাতে।
“ব্যাটাদের পেড়ে ফেলো!” বাবর হুঙ্কার দিয়ে বলে। কিন্তু ঘোড়ার গতি বিন্দুমাত্র হ্রাস করে না। নিমেষের ভিতরে সে একজনকে মাটিতে পড়ে যেতে দেখে, একটা তীর তার গলায় বিদ্ধ হয়েছে। একই সাথে সে নিজেও দূর্গের তোরণদ্বারের কাছে পৌঁছে যায়। দ্বিতীয় লোকটাকে সে আলমগীর দিয়ে একটা কোপ বসিয়ে দেয়। টের পায় তার তরবারি জায়গা মতোই নরম মাংসপেশীতে কামড় বসিয়েছে। কিন্তু কোথায় সেটা দেখবার জন্য সে ঘোড়ার গতি একটুও হ্রাস করে না। তার বদলে, সে তার হাতে ধরা লাগামে একটা ঝাঁকি দিয়ে ঘোড়ার মাথা তখনও আংশিক খোলা ফটকের দিকে ঘুরিয়ে দেয়। বিশাল কালো ঘোড়াটা নাক দিয়ে একটা শব্দ করে এবং বাবর টের পায় ঘোড়াটার একটা পা পিছলে গেছে কিন্তু কালো পাহাড় ঠিকই ঘুরে দাঁড়ায়। একই সাথে তার পেছনে তিনজন যোদ্ধা এসে হাজির হয়।
কিন্তু চতুর্থজন ঢুকতে ব্যর্থ হয়। ভেতরে প্রবেশপথ আটকে ঘোড়া আর তার আরোহীর ভূপাতিত হবার শব্দ বাবর শুনতে পায়। সে দূর্গের ভিতরে প্রবেশ করেছে বটে। কিন্তু তাকে সহায়তা করবার জন্য মাত্র তিনজন যোদ্ধা তার সাথে রয়েছে। চারপাশে তাকালে সে সারি সারি স্থাপিত উঁচু দরজার পেছন, সম্ভবত দূর্গের প্রধান সেনানিবাস থেকে পিলপিল করে লোকজনকে বের হয়ে আসতে দেখে। কেউ কেউ ইস্পাতের বর্ম গায়ে চাপাতে ব্যস্ত। আর বাকিরা ইতিমধ্যে অস্ত্রধারণ করেছে।
“আমার সাথে এসো! এখনই আক্রমণ করতে হবে!” বাবর পেটে খোঁচা দিয়ে পুনরায় তার ঘোড়ার গতি বৃদ্ধি করে। আর একটু পরেই তাকে তার তিনজন সহযোদ্ধাকে নিয়ে আতঙ্কিত লোকগুলোকে কচুকাটা করতে দেখা যায়। সহসা একটা লম্বা লোক বাবরের নজর কাড়ে, যাকে দেখে সেনাপতিদের একজন বলে মনে হয়। ব্যাটকে মাথা নিচু করে পুনরায় ঘরের ভিতরে প্রবেশ করতে দেখলে সেও ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে সেদিকে এগিয়ে যায়। কাঠের সরদলের নিচে দিয়ে ঝুঁকে পার হয়ে সে ভেতরের আধো অন্ধকারে চোখ পিটপিট করে প্রবেশ করতে যে বিশ ত্রিশজন সেখান থেকে বের হয়ে এসেছে, বুঝতে হবে সেটাই এই দূর্গের মোট জনবল। কেবল সেনাপতিগোছের লোকটাই এখন ভেতরে রয়েছে। লোকটা দৌড়ে একটা অস্ত্র সজ্জিত তাকের দিকে ছুটে গিয়ে সেখান থেকে একটা বর্শা আর ঢাল তুলে নিয়ে বাবরের দিকে ঘুরে দাঁড়ায়।
“ফারগানার ন্যায়সঙ্গত সুলতান, আমি বাবর তোমাকে আদেশ দিচ্ছি অস্ত্র নামিয়ে রাখো।”
“আমি আত্মসমর্পন করবো না। তোমাকে আমি সুলতান বলে মানি না। আমার নাম হানিফ খান। আমি তামবালের প্রতি অনুগত, সেই এখন পুরো এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে। পারলে সম্মুখ যুদ্ধে আমাকে পরাস্ত করো।”
বাবর তার কালা পাহাড়ের উপর থেকে লাফিয়ে নামে এবং আলমগীর হাতে ধরা অবস্থায় হানিফ খানের দিকে এগিয়ে যায়। যে তক্কে তক্কে ছিলো বাবর তার। কাছাকাছি যেতেই হাতের বর্শা দিয়ে সে বাবরকে আঘাতের চেষ্টা করে। বাবর লাফিয়ে একপাশে সরে যায়। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে অর্ধভুক্ত খাবারে ভর্তি একটা নিচু টেবিলের পায়ার সাথে তার বাম পা আটকে যায়। বেকায়দা ভঙ্গিতে সে টেবিলের উপরে আছড়ে পড়ে। টেবিলের উপরে থাকা কাঠের পেয়ালা আর তার ভেতরের খাবার ছিটকে ফেলে। মাংসের সুরুয়া অর্ধেকটা ভর্তি একটা বিশাল ধাতব পাত্রের মুখে তার তরবারি ধরা হাতের কব্জি আটকে যেতে, আলমগীর তার মুঠো থেকে ছুটে যায়।
হানিফ খান বাবরের অসহায় অবস্থার সুযোগে তাকে একেবারে শেষ করে দেবার জন্য ছুটে আসে। তার বর্শাটা দু’হাতে মাথার উপরে তুলে বাবরের উন্মুক্ত গলায় সেটা সর্বশক্তিতে নামিয়ে আনবে। বাবর একটা কাঠের বড় বারকোশ তখন তুলে নিয়ে সেটাকে ঢালের মত ব্যবহার করে। বর্শা বারকোশে বিদ্ধ হয়। তবে সেটাকে ছিন্ন করতে পারে না। ছিটকে পড়া খাবারের উষ্ণ চটচটে সুরুয়ার ভিতরে গড়িয়ে একপাশে সরে যাবার সময়ে সে বারকোশটা ফেলে দিয়ে বর্শার হাতল ধরে মোচড় দেয় এবং হানিফ খানের হাত থেকে সেটা টেনে নেয়।
বিন্দুমাত্র দমে না গিয়ে হানিফ খান, লাফিয়ে পেছনে সরে গিয়ে কোমরের পরিকর থেকে একটা সরু খঞ্জর টেনে বের করে। আলমগীর কোথায় পড়েছে সেটা দেখার সময় নেই বাবরের, হাতের বর্শাটা দিয়ে সে লোকটাকে সজোরে আঘাত করলে ফলার মাথায় আটকানো বারকোশটা খুলে পড়ে। আর একই সময়ে, নিজের গালে সে একটা তীক্ষ্ণ ব্যাথা অনুভব করে। হানিফ খান বাবরের গলা লক্ষ্য করে খঞ্জরটা চালিয়েছিলো কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে। বাবর এবার বশার ফলাটা সজোরে তাকে লক্ষ্য করে আঘাত করে হানিফ খান একপাশে ঘুরে আঘাতটা এড়াতে চেষ্টা করে। কিন্তু ফলাটা তাকে বামদিকে স্পর্শ করলে সে টেবিলের পাশে রাখা শক্ত কুশনের উপরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। বাবর এবার বর্শাটা মোচড় দেয় এবং মুহূর্ত মাত্র চিন্তা না করে প্রতিপক্ষের কণ্ঠনালী লক্ষ্য করে সজোরে বর্শাটা নামিয়ে এনে গালিচার উপরে তাকে গেথে ফেলে। যা অচিরেই ফিনকি দিয়ে রক্তে ভিজে লাল হয়ে যায়।
ইতিমধ্যে ওয়াজির খান, বাইসানগার আর বাকী লোকেরা এসে তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে তার সাহসিকতার জন্য তাকে শুভেচ্ছা জানায়। দূর্গটা এখন তাদের দখলে। ফারগানা উদ্ধারের বন্ধুর পথে সে মাত্র প্রথম পদক্ষেপটা সাফল্যের সাথে রেখেছে। বাইরে বের হয়ে এসে বাবর দেখে আবার তুষারপাত শুরু হয়েছে। শত্রুর পড়ে থাকা দেহের চারপাশের লাল রঙ ইতিমধ্যে অনেকটাই ঢাকা পড়েছে। একটু আগে তামবালের চামচার ভবলীলা সে যেভাবে সাঙ্গ করেছে, সেভাবে পালের গোদাটাকে কখন মুঠোর ভেতরে পাবে সেই মুহূর্তটার জন্য সে অধীর হয়ে রয়েছে।
*
আর এভাবেই পুরো ঘটনাটার সূচনা হয়। বাবর একজন হানাদারে পরিণত হন। ঝটিকাবেগে আক্রমণ করেন এবং ফিরে যাবার সময় প্রতিবারই মৃত শত্রুর কারো একজনের মুখে রক্ত দিয়ে নিজের নাম লেখা একটা কাগজ গুঁজে দিয়ে যান। আর তার সাফল্য ক্রমশ বাড়তে থাকে। তার বাহিনীর সংখ্যা, মিষ্টি কথা আর মধুর প্রতিশ্রুতি, সেই সাথে শক্তি বা তার অভিযানে প্রাপ্ত সম্পদের বিচক্ষণ ব্যবহার নতুন সমর্থকদের আকৃষ্ট করে এবং প্রতিপক্ষকে দলে টেনে, ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায়। মাটির দূর্গ দখলের বিশ মাসের মধ্যে, নিষ্ঠা আর একাগ্রতার সাথে একটার পরে একটা ছোট দূর্গ আর গ্রামের পর গ্রাম দখল করে ফারগানার পশ্চিমাঞ্চলের অধিকাংশই সে দখল করে নেয়। তার কৌশল কার্যকরী বলে প্রতীয়মান হয়। তামবাল আকশির উত্তর বা পশ্চিমে বাবরের শক্ত ঘাঁটির দিকে বেশিদূর অগ্রসর হবার মতো সাহস দেখায় না। আর বাবরও মনে করে এবার সময় হয়েছে নিজের দাবির কথা প্রকাশ করবার।
প্রথম দাবিটা সে ছয়মাস আগে জানায় এবং তারপরে প্রায়শই তার পুনরাবৃত্তি করেছিলো তার আম্মিজান, নানীজান আর বোনের মুক্তির বদলে এক বছর আকশি দূর্গ আক্রমণ না করবার প্রতিশ্রুতি। তিনমাস আগে তামবাল এক বার্তাবাহকের মাধ্যমে প্রেরিত এক চিঠিতে অনেক মধুর ভাষায় জানায় এসান দৌলত, খুতলাঘ নিগার আর খানজাদা প্রত্যেকেই সুস্থ আছে এবং শাহী পরিবারের উপযুক্ত ব্যবহারই করা হচ্ছে তাদের সাথে। কিন্তু চিঠিতে সে তাদের মুক্তি দেবার তার কোনো অভিপ্রায়ের কথা উল্লেখ করেনি।
বাবর এখন পূর্বদিকে পঞ্চাশ মাইল দূরে অবস্থিত শহর গাভার দিকে অগ্রসর হচ্ছে কিছুদিন আগে তামবাল ভাড়াটে চকরাখ যোদ্ধাদের সহায়তায় সেখানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছে। সেখানে একটা হিসাব মেলানো এখনও বাকি আছে। সেখানকার দূর্গের চাকরাখ সর্দার তার সৎভাই আর তামবালকে শাহী প্রতিনিধি হিসাবে মেনে নিয়ে প্রথম আনুগত্য প্রদর্শনকারীদের অন্যতম। শহরটা দখল করলে তামবালকে আরেকটা জোরালো সঙ্কেত পাঠানো হবে যে, সময় হয়েছে বাবরের কাছে তার পরিবারকে ফেরত পাঠাবার।
এক ক্ষুদ্র নহরের পাশে সাময়িক যাত্রাবিরতি করে বাবর আর তার লোকেরা ঘোড়াগুলোকে পানি পান করার সুযোগ দেয়। ঘোড়ার দুধ থেকে তৈরি টক পনির কোনোক্রমে গলধঃকরণের ফাঁকে বাবর তাকিয়ে দেখে তার এক গুপ্তদূত ঘোড়ায় চড়ে এগিয়ে আসছে। বাবর চমকে উঠে দেখে তার পর্যানে একটা দেহ আড়াআড়িভাবে বাঁধা রয়েছে। লোকটার দিকে দৌড়ে গিয়ে বাবর চিৎকার করে জানতে চায়, “কি হয়েছিলো? এই লোকটা কে?”
“লোকটা একটা ব্যবসায়ী। পথের পাশে পেটে তরবারির আঘাত নিয়ে নিজেরই রক্তে অর্ধচেতন অবস্থায় পড়ে থাকার সময়ে তাকে আমি খুঁজে পেয়েছি। আমি তাকে আমার ঘোড়ার পিঠে তুলে নেবার কিছুক্ষণ পরেই বেচারা মারা যায়। অবশ্য মারা যাবার আগে সে আমাকে বলেছে যে আরও তিনজন ব্যবসায়ীর সাথে সে। এখান থেকে দশ মাইল দূরে একটা ছোট সরাইখানার উদ্দেশ্যে যাবার পথে তারা চকরাখ হানাদারদের হামলার শিকার হয়। তার তিন সঙ্গীকে হত্যা করে তাকেও মৃত ভেবে তাদের সব মালপত্র নিয়ে তারা চলে গেছে।”
“চকরাখ হানাদারদের অবশ্যই খুঁজে বের করে তার হত্যার আমরা বদলা নেবো। তোমার অধীনস্ত কয়েকজন গুপ্তদূতকে হত্যাকারীদের খুঁজতে পাঠাও।”
“সুলতান, আমার মনে হয় না তার কোনো দরকার আছে। বণিক লোকটা মারা যাবার আগে আমাকে বলেছে যে, সে চকরাখদের বলতে শুনেছে তারা সরাইখানায় যাচ্ছে, সেখানে আরও শিকার যদি তারা খুঁজে পায়…”
“তাহলে আমরা প্রথমে সরাইখানায় যাবো।”
***
গানের সুর বন্য আর কর্কশ চকরাখদের নিজেদের মতোই অনেকটা। মদের নেশায় চুরচুর হয়ে থাকা পুরুষদের কণ্ঠস্বর নতুন মাত্রায় উঠে এমন সব অশ্লীল ক্রিয়াকলাপের বর্ণনায় মেতেছে যা একাধারে শারিরীকভাবে অসম্ভব আর মোটাদাগের যে বাবর চেষ্টা করেও হাসি চাপতে পারে না। সে আড়চোখে ওয়াজির খানের দিকে তাকিয়ে দেখে সেও হাসছে।
লম্বা ঘাসের আড়ালে বাবর তার চারপাশে শুয়ে থাকা লোকদের ইশারা করে। সবাই। তারমতো পেটের উপরে ভর দিয়ে শুয়ে আছে, লুকিয়ে অপেক্ষা করছে। তারপরে সে গুঁড়ি মেরে মাটির ইট দিয়ে তৈরি একতলা সরাইখানার দিকে এগিয়ে যায় যেটা ফারগানার অন্যতম খরস্রোতা একটা নদীর অগভীর অংশের পাড়ে অবস্থিত। যেখানে হল্লাবাজেরা মচ্ছবে মেতেছে। নূপুরের নিক্কন ধ্বনি ভেসে আসতে বোঝা যায় ভেতরে বাইজি মেয়েরাও আছে। সেই সাথে কুপিত নারী কণ্ঠের সহসা একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার আর তার সঙ্গে ভেসে আসে- পুরুষ কণ্ঠের অট্টহাসি।
দুপুর মাত্র অতিক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু বিশজন বা তার কিছু বেশি চাকরাখরা ইতিমধ্যেই বেহেড মাতাল হয়ে পড়েছে। তারা এমনকি তাদের ঘোড়াগুলিকে ঠিকমতো বাঁধার কষ্টও করেনি এবং কিছু ঘোড়া, যাদের কেশর পুরু আর লেজ এতো লম্বা যে মাটিতে ঘষা খাচ্ছে, ইতিমধ্যেই ছুটে পালিয়েছে। চারো ব্যবসায়ীর কাছ থেকে লুট করা মালামালও তারা ভিতরে নিয়ে যাবার গরজ দেখায়নি। বণিকদের মালবাহী ধুসর খচ্চরগুলো দড়ি দিয়ে একত্রে বাঁধা এবং মনোযোগ দিয়ে চরে বেড়াচ্ছে। তাদের পিঠে আটকানো বেতের ঝুড়িগুলো দেখে মনে হয় এখনও চামড়া আর লোমে ঠাসা। চাকরাখরা মনে হয় কেবল মদের পিপে নিয়ে সরাইখানার ভিতরে প্রবেশ করেছে।
বর্বর অসভ্য, বাবর ভাবে। তাদের কপালে আজ কি লেখা আছে সেটা এখনই ব্যাটারা টের পাবে। আর এই ভাবনাটা তাদের উৎফুল্ল করে তোলে। লম্বা ঘাসের উপরে মাথা তুলে বাবর চারপাশে তাকায়। কিন্তু কাউকে দেখতে পায় না। সে ঠিক যেমনটা ভেবেছিলো, ঘোড়া বা মালামাল দেখার জন্য বাইরে কোনো বাচ্চাকে রাখার কথা ব্যাটাদের মাথাতেই আসেনি। সে এবার উঠে দাঁড়িয়ে, গুটিগুটি পায়ে সরাইখানার নীচু প্রবেশদ্বারের ডান দিকে মোটা দেয়ালের গায়ে জানালার মতো দেখতে একটা ফাঁকা জায়গার দিকে এগিয়ে গিয়ে ভেতরে সতর্কতার সাথে উঁকি দেয়। ঘরটা প্রায় খালি, কেবল ভেতরের দেয়ালের গায়ে ঠেকানো অবস্থায় একটা লম্বা কাঠের টেবিল দেখা যায়। কয়েকটা তেপায়া টুল আর একটা আধ ভাঙা বেঞ্চি দেখা যায়। ঘরের মাঝে মোটাসোটা, বোচা-নাকের একটা মেয়ে পরনে রঙচটা হলুদ রঙের ঢোলা সালোয়ারের উপরে লাল ফুলের ছাপ দেয়া একটা আঁটোসাঁটো কামিজ, পায়ে আর হাতের কব্জিতে ঘুঙুর বাঁধা। নীল সালোয়ার কামিজ পরিহিত লম্বা আরেকটা মেয়ে তার নোংরা হাতে একটা খঞ্জনী, বর্গাকার পাথরের মেঝের উপরে খালি পায়ে সজোরে পদাঘাত করে বৃত্তাকারে আবর্তিত হচ্ছে। সে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই চকরাখদের কয়েকজন, ভেড়ার চামড়ার তৈরি টুপির নিচে তাদের গোলাকার মুখ ঘামে ভিজে আছে, টলোমলো পায়ে মেয়েদের বুকে পাছায় বৃথা চেষ্টা করে থাবা দিতে এবং মুখ থুবড়ে মাটিতে আছড়ে পড়লে তাদের সঙ্গীসাথীদের উদ্দীপনা আরও বেড়ে যায়।
এক কোণে ধোঁয়া উঠতে থাকা অগ্নিকুণ্ডের উপরে বিশাল একটা কেতলি ঝুলতে দেখা যায়। আরেক কোণে, বাবর এক চকরাখ দুবৃত্তকে কাপড় খুলে ব্যস্ত ভঙ্গিতে হাল্কা হতে দেখে, দুর্গন্ধে তার সঙ্গীসাথীদের আপাতভাবে কোনো অসুবিধা হয় না। আরেক বদমাশ উঠে দাঁড়িয়ে হলুদ বমি বৃত্তচাপ তৈরি করে ছুঁড়ে ফেলে আবার বসে পড়ে আর মনোযোগ দিয়ে জামার হাতায় পড়া বমির ফোঁটা বড়বড় নখ দিয়ে টুসকি দেয়। বাবর পুনরায় মাথা নামিয়ে নেয়। সে যা দেখার তা দেখে নিয়েছে।
মাটিতে গুঁড়ি দিয়ে সে পুনরায় ওয়াজির খান যেখানে আছে সেখানে ফিরে আসে। “মদ্যপ আহাম্মকগুলো আমাদের হাতে মারা যাবার জন্য মুখিয়ে রয়েছে। ব্যাটারা তাদের তরবারি আর ঢাল পর্যন্ত দরজার কাছে স্তূপ করে রেখেছে।”
ওয়াজির খানের একটা ক্ৰ উপরে উঠে যায়। “সুলতান, এখনই?”
“হ্যা!”
বাবর আর ওয়াজির খান উঠে দাঁড়িয়ে তাদের লোকদেরকেও উঠে দাঁড়াবার ইশারা করে। তারা এই কাজটা আগে এতোবার করেছে যে, মৌখিক আদেশের আর কোনো প্রয়োজন হয় না। ঠোঁটের উপরে আঙ্গুল চেপে, ওয়াজির খান ইশারায় ঘুরে কয়েকজনকে সরাইখানার পেছনে যেতে বলে। যদি সেখান দিয়ে পালাবার কোনো পথ থেকে থাকে। তারপরেই কেবল বাবর তার প্রিয় রণহুঙ্কারে চারপাশ প্রকম্পিত করে: “ফারগানা!”
বাবর একেবারে সামনে থেকে তার লোকদের নেতৃত্ব দেয়। মদের নেশায় মাতাল আর বিস্ময়ে আড়ষ্ঠ চকরাখরা সামান্যই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। বাবর আর তার লোকেরা নির্মমভাবে প্রতিপক্ষের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়লে বোঁচা-নাকের সেই মেয়েটার কাছ থেকেই কেবল বলার মতো প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। মেয়েটা তার কাচুলির ভিতর থেকে একটা খঞ্জর বের করে এবং বাবরের বাহুতে সেটা মরিয়া ভঙ্গিতে গেথে দিতে চাইলে, বাবর অনায়াসে তার ঘুঙুর পরা হাতের কব্জি ধরে এবং তাকে ঘুরিয়ে দিয়ে তার নধর নিতম্বে বুট দিয়ে একটা সপাট লাথি বসিয়ে দিতে বেচারী ছিটকে দূরে গিয়ে পড়ে।
কয়েক মিনিটের ভিতরে সবকিছু শেষ হয় এবং বাবরের লোকদের হাঁপিয়ে ওঠার আগেই নিজেদের তরবারির ফলা পরিষ্কার করে কোষবদ্ধ করতে দেখা যায়। তার লোকদের গায়ে একটা আঁচড়ও লাগেনি। অবশ্য তার লোকদের সবাই পোড়খাওয়া যোদ্ধা, এসব মদ্যপ মাতালদের চেয়ে অনেক দক্ষ লোকদের সাথে তারা আগে লড়াই করেছে। “লাশগুলো বাইরে নিয়ে যাও দেখা যাক আমরা কাদের হত্যা করেছি,” বাবর আদেশটা দিয়ে কৃতজ্ঞচিত্তে দ্রুত পূতিগন্ধময়, ধোঁয়াটে ঘরটা থেকে বাইরের খোলা বাতাসে বের হয়ে আসে।
তার লোকেরা চকরাখদের লাশগুলি তাদের বুট-পরা পা ধরে হেঁচড়ে বাইরে এনে সারিবদ্ধভাবে সাজালে, বাবর লাশগুলো শুনে দেখে। মোট পনেরটা লাশ। কারো গলা দুভাগ হয়ে আছে, কোনোটা আবার কবন্ধ। তার লোকেরা অবশ্য কাটাপড়া মাথাগুলো সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছে। কোনোটার মাথায় তখনও ভেড়ার চামড়ার টুপি রয়েছে। কাটা মুণ্ডগুলোর দিকে তাকিয়ে যখন বাবর একটা বিশেষ মুখ চিনতে পারে, তখন তার মুখ থেকে সন্তুষ্টিসূচক একটা শব্দ ধ্বনিত হয়। তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে এমন সব চকরাখকে সে হত্যা করবে বলে মনস্থ করেছে। এবং প্রতিটা হত্যাযজ্ঞ যা তাকে তার লক্ষ্যের নিকটবর্তী করছে প্রচণ্ড তৃপ্তিদায়ক।
তারস্বরের চিৎকার শুনে বাবর ঘুরে তাকায়। তার দু’জন যোদ্ধা বাইজি মেয়েদের ধরে তাদের টেনে সরাইখানার বাইরে বের করে আনে। “তাদের উপরে বল প্রয়োগ করবে না। আমার আদেশ তোমরা জানেনা। অর্থের বিনিময়ে যদি তারা স্বেচ্ছায় তোমাদের সঙ্গ দিতে রাজি হয় তবে সেটা আলাদা কথা।” কথাটা বলে বাবর আবার ঘুরে দাঁড়ায়।
দেখা যায় মেয়েগুলো আদতেই ব্যবসায়ী এবং কয়েক মুহূর্তের দ্রুত আলোচনার পরে, সরাইখানার পেছনের এক আপেল বাগিচায় তারা তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়। বাবর ধারণা করে বাইজি দু’জন সরাইখানার শকুনের মতো দেখতে মালিকের মেয়ে হবে। যে ঝামেলার গন্ধ পাওয়া মাত্র সেই যে টেবিলের তলায় গিয়ে ঢুকেছে তারপরে আর বের হবার কথা চিন্তাও করেনি। আপেল বাগিচায় শীঘ্রই বাবরের লোকদের দল বেঁধে আসা যাওয়া করতে দেখা যায়। বাগান থেকে হাসিমুখে তাদের বের হয়ে আসা দেখে বোঝা যায় মেয়ে দু’জন তাদের বাবার সরাইখানায় আসা। অতিথিদের খেদমত করতে ভালোই অভ্যস্ত।
ওয়াজির খান ইতিমধ্যে চকরাখদের পালিয়ে যাওয়া ঘোড়াগুলো ধরে আনবার বন্দোবস্ত করেছেন এবং বণিকদের কাছ থেকে লুট করা মালপত্রগুলো পর্যবেক্ষণ। করছেন। “সুলতান, দেখেন,” দুটো উজ্জ্বল বর্ণের গালিচা বের করে সে বাবরের। দৃষ্টি সেদিকে আকর্ষণ করে। গালিচা দুটোর জেল্লা দেখে বোঝা যায় তন্তুবায়ের দল। সেটা বুননের সময়ে রেশমের সাথে উলের মিশ্রণ ঘটিয়েছে আর গালিচাগুলোর নকশাও অপরিচিত- বণিকের দলটা সম্ভবত পূর্বের, কাশগর থেকে এসেছিল। যেখানের তাঁতিরা এ ধরণের গালিচা তৈরিতে দক্ষ। উল আর চামড়া বেচে ভালো অর্থই পাওয়া যাবে, বাবর ভাবে, যা দিয়ে তার লোকদের সে বকেয়া বেতন দিতে পারবে।
তার যোদ্ধাদের জন্য একটা ভোজসভার আয়োজন করলে মন্দ হয় না। তারা ভালো। কাজ দেখিয়েছে এবং তারও উচিত এর মূল্যায়ন করা। পশ্চিমে, শাহরুখিয়ায় ফিরে যাওয়া মাত্রই সে এই ভোজসভার ঘোষণা দেবে। সেখানে, ছয়মাস আগে। তামবালের কাছ থেকে সে দূৰ্গটা ছিনিয়ে নিয়েছে এবং নিজের ঘাঁটিতে পরিণত করেছে। সমরকন্দে খুন হবার আগে শাহরুখিয়ার সর্দার আলি মজিদ বেগের পূণ্য স্মৃতির প্রতি তারা তাদের শ্রদ্ধা জানাবে। তারা তার উপযুক্ত সন্তানের আত্মার মাগফেরাত কামনা করবে। যে তামবালের চকরাখ যোদ্ধাদের হাত থেকে দূর্গটা রক্ষা করতে গিয়ে শহীদ হয়েছে। আলি মজিদ বেগের নিহত হবার সংবাদ ফারগানায় পৌঁছানো মাত্র তামবাল দূর্গটা দখল করতে তাদের পাঠিয়েছিলো।
নিজের বিশ্বস্ত সর্দারের কথা মনে পড়তে বাবরের ভাবনা বিষণ্ণ হয়ে উঠে। আজকাল তার প্রায়ই এমন হচ্ছে। সবুজাভ-নীল তোরণদ্বারে আলি মজিদ বেগের মৃতদেহ প্রদর্শিত হবার পরের দু’বছরে সে কি অর্জন করেছে? নিজের পরিবারকে মুক্ত করার ব্যাপারে বা ফারগানা পুনরায় অধিকার করার ব্যাপারে সে কতটা অগ্রসর হয়েছে, সমরকন্দের কথা না হয় সে বাদই দিল? আর কতদিন তাকে সালতানাৎবিহীন একজন সুলতান হিসাবে দিন কাটাতে হবে? আকশি আক্রমণ করে তার পরিবারকে মুক্ত করে সিংহাসন পুনরুদ্ধার করার মতো একটা সেনাবাহিনী গঠন করা একটা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। আর সমরকন্দ, সেখানে শাসক হিসাবে কাটানো কয়েকটা দিন এখন কেবল ধূসর স্মৃতি। মাঝে মাঝে তার বিশ্বাস করতেই কষ্ট হয় যে এমন কিছু আসলেই ঘটেছিলো। গ্রান্ড উজিরের কথাই শেষ পর্যন্ত সত্যি হলো।
ভাবনাটা বাবরকে ক্রুদ্ধ করে তোলে। সে তার পায়ের কাছে পড়ে থাকা একটা কর্তিত মস্তকে লাথি বসিয়ে দিলে সেটা ছিটকে দূরে গিয়ে পড়ে। তার লোকদের যেমন, তারও বিনোদনের দরকার আছে। কয়েকটা ডাল কেটে পোলো খেলার লাঠি তৈরি করো।” সে চিৎকার করে বলে। “এইসব দুবৃত্তদের মাথা দিয়ে পোলো খেলা যাক। গোলপোস্ট হবে ঐ দূরের গাছগুলো।”
পুরো একটা ঘণ্টার জন্য, উদ্দাম খেলায় বাবর নিজেকে ডুবিয়ে রাখে। চকরাখদের ক্ষিপ্রগামী টাটুঘোড়ার একটা নিয়ে সে একেবেঁকে দাবড়ে বেড়ায় এবং শাখাপ্রশাখা ছেটে ফেলা গাছের ডাল দিয়ে ছিন্ন মস্তকগুলোকে সজোরে আঘাত করে। যাতে ঘাসের উপর দিয়ে লাফাতে লাফাতে সেগুলো গড়িয়ে যায়। শীঘ্রই সেগুলোকে আর কাটা মাথা বলে চেনার কোনো উপায় থাকে না- নাক, কান গুঁড়িয়ে যায়, অক্ষিকোটর থেকে অক্ষিগোলক বের হয়ে আসে এবং বাবর আর তার ঘর্মাক্ত সাথী খেলোয়াড়েরা আর সেই সাথে তাদের সবার ঘোড়া, রক্তের ফুটকিতে চিত্রিত হয়ে উঠে।
অবশেষে খেলাটার প্রতি তার বিরক্তি জন্মায় কিন্তু ভেতরের জমে ওঠা হতাশা আর ক্ষোভ নিঃসৃত হওয়ায়, বাবর ঘামে ভিজে ওঠা ঘোড়াটাকে অবশেষে রেহাই দেয়। চারপাশে তাকাতে সে দেখে ওয়াজির খান তার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। এই প্রথম সে তার চোখে বিরক্তি দেখতে পায়। কিন্তু বাবর তাতে বিন্দুমাত্র লজ্জি বোধ করে না। জীবিত বা মৃত, সে তার শত্রুদের সাথে তাদের প্রাপ্য ব্যবহারই করেছে।
“চলো এবার যাওয়া যাক।” সে আদেশ দেয়। “গাভা এখনও অনেক দূরে, আর আমাদের গৃহকর্তাকে অপেক্ষা করিয়ে রাখাটা ঠিক হবে না।” বাবর ঘোড়ার পাঁজরে এত জোরে খোঁচা দেয় যে সেটা ছুটতে শুরু করে। বাবর সরাইখানা থেকে সোজা নদীর অগভীর অংশের দিকে এগিয়ে যায়।একবারও পেছনে ফিরে তাকায় না। আঙ্গিনায় পড়ে থাকা রক্তাক্ত মাথাগুলোকে ইতিমধ্যে কাকের দল ঠোকরাতে শুরু করেছে এবং সরাইখান মেয়ে দুটো পা ঈষৎ ধনুকের মত ফাঁক করে এগিয়ে গিয়ে চকরাখদের লাশগুলো হাতিয়ে দেখে যে বাবরের লোকেরা ভুলে কিছু রেখে। গেছে নাকি, যা তাদের বেশ্যাবৃত্তির পাওনার উপরি বলে বিবেচিত হতে পারে।
***
তিন সপ্তাহ পরে। উঁচু পাহাড়ী এলাকার তৃণভূমির উজ্জ্বল সবুজ ঘাসের মাঝে মাঝে ফুটে থাকা হলুদ গোলাপী আর সাদা ফুলের মাঝ দিয়ে বাবর আর তার লোকেরা দুলকি চালে ঘোড়া দাবড়ে শাহরুখিয়ার দিকে এগিয়ে যায়। গাভার অভিযানে ক্ষয়ক্ষতি হলেও তারাই জয়ী হয়েছে। তিনশ গজ দূরে ঘোড়ার পিঠে বসে থাকা অবস্থায় বাবর নিজে তীর ছুঁড়ে দূর্গের সেনাপতিকে হত্যা করেছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তার নিজের ব্যবহৃত ছোট নিখুঁতভাবে বাঁকানো ধনুক দিয়ে তীর ছোঁড়ার অভ্যাসে কাজ হয়েছে। ত্রিশটা শর ভর্তি তূণীর সে এক মিনিটের ভিতরে খালি করে ফেলতে পারে।
সেনাপতি মারা যাবার পরে, প্রতিরোধকারীদের মনোবল ভেঙে যায়। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সেনানিবাসের সৈন্যরা কেবল আত্মসমর্পনই করেনি, নিজেদের লুটের মাল পুরো তাদের হাতে তুলে দিয়েছে। যা বাবর আর তার লোকদের ঘোড়ার পিঠে ঝোলানো চামড়ার থলির উপচে পড়া আকৃতি সাক্ষ্য দিচ্ছে।
ওয়াজির খান খুব খুশি হবে। এবারের অভিযান বাবরকে তার বুড়ো বন্ধুটির সহায়তা ছাড়াই পরিচালনা করতে হয়েছে। সরাইখানা আক্রমণ করার পরের দিন ওয়াজির খানের ঘোড়া সাপের ভয়ে বেমাক্কা লাফিয়ে উঠতে সে পড়ে গিয়ে উরুতে ব্যথা পেয়েছিলো। বাবরের সনির্বন্ধ অনুরোধে তিনি শাহরুখিয়ায় ফিরে যেতে রাজি হন বাইসানগারের সাথে যোগ দিতে, যাকে তারা সেখানের নিরাপত্তার দায়িত্ব দিয়ে এসেছে।
আজ রাতে তারা বিজয় উদযাপন করবে। সে তার লোকদের সম্মান জানাতে তাদের মাঝে উলুশ বিতরণ করবে। যোদ্ধাদের ভিতরে যারা সবচেয়ে সাহসিকতা আর বীরত্ব প্রদর্শন করেছে প্রথা অনুযায়ী আজ সে ভোজসভার শেষে তাদের মাঝে লুটের মালের সিংহভাগ বিলিয়ে দেবে এবং বাইসানগার আর ওয়াজির খানকে গাভা আক্রমণের কাহিনী শোনাবে। তার গল্প শুনে ওয়াজির খান সম্ভবত হেসে অস্থির হবেন এবং সদা গম্ভীর বাইসানগারের মুখেও সে আজ হয়তো হাসির আভাস দেখতে পাবে।
পাথরের তৈরি দূর্গের অভ্যন্তরস্থ প্রাঙ্গনে প্রবেশের সাথে সাথে, বাবর তার ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফিয়ে নেমে তাদের খোঁজে আশেপাশে তাকায়। বাইসানগারকে সে কোথাও খুঁজে পায় না। কিন্তু ওয়াজির খানকে আস্তাবলের সামনে দাঁড়িয়ে ঘোড়ার খুরের উপরের আর পেছনের অংশের কেশগুচ্ছ পর্যবেক্ষণ করতে দেখে। তার বুড়ো বান্ধবকে সামান্য খোঁড়াতে খোঁড়াতে তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখলে: বাবর ভ্রূ কোঁচকায়। তারপরে সে তাকিয়ে দেখে ওয়াজির খানের মুখ আনন্দে আলোকিত হয়ে রয়েছে।
“সুলতান, দারুণ সুখবর আছে! সত্যিই চমকে দেবার মত সুখবর!”
“কি হয়েছে?”
“এক সপ্তাহ আগে আকশি থেকে এক বার্তাবাহক এসেছে। আপনার সৎ-ভাই জাহাঙ্গীরের পক্ষে তামবালের বাণী নিয়ে সে এসেছে। অন্তত বার্তাবাহকের তাই ভাষ্য এবং সে বলেছে তারা আপনার আম্মিজান, নানীজান আর আপনার বোনকে আপনার কাছে পাঠাতে সম্মত আছেন।”
“সে কি এর বিনিময়ে কিছু দাবি করেছে?”
“সুলতান, প্রকাশ্যে তারা কিছু দাবি করেনি। আপনাকে সে কতোটা শ্রদ্ধা করে কেবল সে সম্পর্কে কিছু মধুর বাক্য ছাড়া।”
বাবরের হৃৎপিণ্ড আনন্দে নেচে উঠে। তার পরিবার শীঘ্রই তার সাথে মিলিত হবে। এই খবরটা আবার তাকে আবেগতাড়িত করে তোলে।
“তারা এখানে কবে নাগাদ পৌঁছাবে?”
“সবকিছু ঠিক থাকলে আগামীকাল সূর্যাস্ত নাগাদ তাদের এখানে পৌঁছাবার কথা।”
পরের দিন সন্ধ্যাবেলা, গোধূলির অস্তমিত আলোয় বাবরকে দূর্গের প্রকারবেষ্টিত সমতল ছাদে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। আজকের দিনের অধিকাংশ সময় সে এখানেই কাটিয়েছে। অস্থিরচিত্তে রাস্তাটা যেখানে একটা গিরিখাদের দিকে বাঁক নিয়েছে, সেদিকে চোখ কুঁচকে তাকিয়ে রয়েছে। ঘনায়মান আধো-অন্ধকারের ভিতর থেকে সে পিঠের দুপাশে ঝুড়ি ঝুলছে উটের এমন একটা তরঙ্গায়িত সারিকে বাঁক ঘুরে এগিয়ে আসতে দেখে। তাদের ঠিক পেছনেই রয়েছে যাত্রার শেষ পর্যায়ে মেয়েদের অভ্যর্থনা জানাতে। আর তাদের নিরাপদে দূর্গে নিয়ে আসবার জন্য, ওয়াজির খানের পরামর্শে, বাইসানগারের অধীনে পাঠানো সৈন্যবাহিনীর একটা চৌকষ দল।
বাবর এতদূর থেকে ঝুড়িতে ভ্রমণকারীদের চেহারা দেখতে পায় না। নিজেকে আর সামলে রাখতে না পেরে, এবং দেহরক্ষীদের কাউকে ডাকবার বা ঘোড়ার পিঠে জিন চাপাবার মতো ধৈর্যের মারাত্মক অভাব দেখা দেয়ায়, সে লাফিয়ে একটা খালি ঘোড়ার পিঠে চেপে বসে এবং সবুজ ঘাসে আচ্ছাদিত তৃণভূমির উপর দিয়ে ছোট কাফেলাটার দিকে ছুটে যায়।
তার রোদে পোড়া গাল বেয়ে দরদর করে কান্না ঝরতে থাকে। কিন্তু সেসব সে মোটেই পরোয়া করে না। আশেপাশে কেউ নেই তার কান্না দেখবার মতো এবং তার চেয়েও বড় কথা, দেখলে দেখুক সে থোড়াই পরোয়া করে। দুর্বলতার না, আজ এটা আনন্দের অশ্রু। এক হাতে ঘোড়ার কেশর আঁকড়ে ধরে সে অন্য হাতে গাল থেকে কান্না মুছে। বাবর ঘোড়াটার কানে কানে তাকে এমন গতিতে ছুটতে বলে, যাতে মনে হয় হঠাৎ তার পাখা গজিয়েছে।
কাফেলাটাকে পাহারা দিয়ে নিয়ে আনা সৈন্যদের থেকে চারজন সহসা আলাদা হয়ে বর্শা নিচু করে তার দিকে এগিয়ে আসে। যদিও বাইসানগার সম্ভবত ধারণা করতে পেরেছিলো খালি ঘোড়ার পিঠে এমন উদ্দাম ভঙ্গিতে কে তাদের দিকে ছুটে আসছে। কিন্তু তার মত অভিজ্ঞ পোড়খাওয়া যোদ্ধা তার কাছে এটাই প্রত্যাশিত যে সে নিজের লোকদের আদেশ দিয়েছে তার পরিচয় নিশ্চিত করতে। অশ্বারোহী দল নিকটবর্তী হতে, বাবর জোর করে নিজের ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে তাকে থমকে দাঁড়িয়ে পড়তে বাধ্য করে। ঘামে জবজব করতে থাকা দেহে নাক ঝেড়ে নিজের বিরক্তি প্রকাশ করে ঘোড়াটা।
বাবর মাথাটা পেছনে হেলিয়ে দিয়ে তার পূর্বপুরুষের রণহুঙ্কার কণ্ঠে তুলে নেয়। “ফারগানা!”
অশ্বারোহী দল এখন আরো কাছে চলে আসায় তারা তাকে চিনতে পেরে অভিবাদন জানায়। বাবর কোনোমতে তাদের অভিবাদনের জবাব দিয়ে উটের কাফেলা যেখানে যাত্রা বিরতি করেছে সেদিকে ঘোড়া ছোটায়। তার হৃদয় যদি আবেগে ভারাক্রান্ত না থাকত অন্যসময় হলে তাহলে সে হয়তো বাজারে নিয়ে যাওয়া মুরগীর মতো ভীরু ভঙ্গিতে বেতের ঝুড়ির ভিতর থেকে এসান দৌলতের উঁকি দেবার হাস্যকর ভঙ্গি দেখে হয়তো হেসেই ফেলতো। তার ওজন এতোটাই হাল্কা যে অন্যপাশের ঝুড়িতে ভারসাম্য রক্ষার জন্য বাঁধাকপির চেয়ে ভারী কিছু রাখতে হয়নি। আর তার বীণা ঝুড়ির বাইরে চামড়ার ফালি দিয়ে আটকানো রয়েছে। একটা বিশাল পুরু লোমের দুধসাদা রঙের উট যা বাবরকে এগোতে দেখে পচাৎ করে থুতু ফেলে সেটার দু’পাশে দুটো ঝুড়িতে খুতলাঘ নিগার আর খানজাদা আরোহন করেছেন। উটের পেছনে বাবর তার আম্মিজানের পরিচারিকা দলের কয়েকজন পরিচিত সদস্য, যাদের ভিতরে ফাতিমাও রয়েছে আর তার উজির কাশিমকে দেখতে পায়।
উটের চালকরা লাফিয়ে নেমে, উটের গ্রন্থিযুক্ত হাঁটুতে তাদের হাতের লাঠি দিয়ে আঘাত করে উটগুলোকে বাধ্য করে মাটিতে বসতে। বয়োবৃদ্ধ হবার কারণে, বাবর দৌড়ে প্রথমে এসান দৌলতের কাছে যায় এবং হাঁটু মুড়ে বসে তাকে আলতো করে ঝুড়ি থেকে তুলে আনে। বাবর কোনো কথা খুঁজে পায় না, আর এই প্রথমবারেরমতো মুখরা এসান দৌলতও বাক্যহারা হয়ে পড়েন। সে টের পায় নানীজান তার মাথা আলতো স্পর্শ করেন। সে উঠে দাঁড়িয়ে তার ছোট ছোট উজ্জ্বল চোখের দিকে তাকালে সেখানে তার পুরানো সত্ত্বার ঝলক দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। নানীজানকে এখন তিনি বরাবর যার জন্য গর্ব করেন,সেই খামের- চেঙ্গিস খানের রক্তের উত্তরসুরী এক নারীর মতোই দেখাচ্ছে।
সে এবার ঘুরে দাঁড়িয়ে তার আম্মিজানকে ঝুড়ি থেকে তুলে মাটিতে নামিয়ে দেয় এবং তাকে জড়িয়ে ধরে তার আশৈশব পরিচিত চন্দনকাঠের উষ্ণ সুগন্ধে বুক ভরে শ্বাস নেয়। সে তার আলিঙ্গন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে তাকিয়ে দেখে আম্মিজানের চোখে অশ্রু টলটল করছে। “বাছা তোমাকে আবার দেখতে পেয়ে খুশি হলাম,” কোনো রকমের আবেগ না দেখিয়ে তিনি বলেন, এবং তার মুখে একটা হাসির আভাস ফুটে উঠে যা বাবরের যেমনটা মনে আছে তার চেয়েও ম্লান এবং বলিরেখায় আকীর্ণ।
খানজাদা ইতিমধ্যে তাকে বহনকারী ঝুড়ি থেকে নিজেই ধড়ফড় করে নেমে এসেছে। এবং সে সোজা ভাইকে লক্ষ্য করে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তার পোষা বেজী যেটা সে বামহাতে ধরে রেখেছে, কুইকুই করে প্রতিবাদ জানায়। শেষবার বাবর তার বোনকে দেখেছিলো হাড্ডিসার একটা মেয়ে, যার মুখে কয়েকটা দাগ রয়েছে। খানজাদা এখন রীতিমত একজন মহিলাতে পরিণত হয়েছে, তার দেহে ভরা নদীর জোয়ার বইছে। মুখ আগের চেয়ে অনেক দাগহীন আর সুন্দর। কিন্তু ফিচেল হাসি আগের মতোই আছে দেখে সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। সে তাকে জড়িয়ে ধরে এবং তারপরে ছেড়ে দিয়ে এক পা পিছিয়ে আসে ভালো করে তাকে দেখবে বলে।
খানজাদাও কম যায় না সেও ভাইকে জরিপ করে। “তুমি লম্বা হয়েছে।” সে বলে, “আর তোমার কাঁধ আগের চেয়ে চওড়া হয়েছে। কিন্তু একি চেহারা হয়েছে। তোমার থুতনিতে ছাগলের মত দাড়ি আর চুলের অবস্থা যাচ্ছেতাই- তোমার চুল দেখছি আমার মত লম্বা! আর নখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না- কালো হয়ে আছে।”
বাবর পেছন থেকে, খানজাদার নাক কোঁচকানো বিশেষণগুলোর সমর্থনে এসান দৌলতকে জিহ্বা আর টাকরার সাহায্যে একটা শব্দ করতে শোনে এবং সে হেসে ফেলে। অবশেষে তার প্রিয়জনেরা তার কাছে এসেছে এবং সবকিছু যেমনটা থাকার কথা তেমনই রয়েছে। তাদের সাথে সে পরে কথা বলবে এবং শুনবে বিগত দিনগুলো তাদের কেমন কেটেছে। কিন্তু এখনকার মতো এই যথেষ্ট।
তারা দূর্গের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। অবশেষে মুক্তি লাভ করা ফারগানার শাহী রমণীদের অভ্যর্থনা জানাতে তূর্যনিনাদ আর রণভেরী গমগম আওয়াজে বেজে উঠে- অন্তত এখনকার জন্য হলেও তারা নিরাপদ।
দূর্গের উপরের তলায় প্রস্তুত রাখা জেনানামহলে মেয়েদের পৌঁছে দিয়ে, বাবর তার বঁধুনিকে ডেকে পাঠায়। তার পরিকল্পিত ভোজসভার সব আয়োজন কি অবস্থায় আছে তা জানতে। এখানের ভোজসভা সমরকন্দের মতো জাঁকজমকপূর্ণ হবে না। যেভাবে সে তাদের অভ্যর্থনা জানাতে চেয়েছিলো। অবশ্য, তাহলেও বিশটা ভেড়া জবাই করা হয়েছে আর আঙ্গিনায় সেগুলোকে আগুনে ঝলসানো হচ্ছে। মুরগীর পালক ছাড়িয়ে, আখরোট আর খুবানির সাথে মাখন দিয়ে সিদ্ধ করা হচ্ছে। আস্ত আপেল ঘন সোনালী বর্ণের মধু আর লাল রসে ভরা ডালিমের দানার সাথে কাঠবাদাম আর পেস্তার মিশ্রণে চিকচিক করছে। তাদের কোনো এক অভিযানে তার লোকদের লুট করা রূপালি বর্ণের কাঠবাদামের স্তূপের দিকে সে বিশেষ সন্তুষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে। এসান দৌলত অন্য যে কোনো মিষ্টির চেয়ে এগুলো বেশি পছন্দ করেন।
নির্মেঘ, তারা-শোভিত আকাশে চাঁদ উঠলে, এবং কোনো আকষ্মিক হামলা থেকে আগেই সাবধান করতে দূর্গপ্রাকারে সৈন্য মোতায়েন করে ভোজসভা শুরু হয়। বাবর আর তার লোকেরা নিচুলার একটা নিচু, লম্বা কামরায় আহার সারে। যখন উপরে নিজেদের কামরায় মেয়েদের তাদের পছন্দের অংশ পরিবেশন করা হয়। মোমবাতির কাঁপা আলোতে বাবরের লোকেরা উদাত্ত কণ্ঠে গান শুরু করে। বাকীরা যে নিচু কাঠের টেবিলের চারপাশে আসনসিঁড়ি হয়ে বসে আছে তাতে চাকুর বাট দিয়ে আঘাত করে তাল দেয়। বাবর ভাবে, তার লোকেরা খুশি হয়েছে। মেয়েদের মুক্তিতে তারাও প্রীত হয়েছে। তার সাথে সাথে তার লোকদেরও এটা সম্মানহানির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো- যেনো মেয়েদের মুক্ত করার সামর্থ্য তাদের নেই।
বাবর খেতে চেষ্টা করে কিন্তু কিছুই খেতে পারে না। তার ইচ্ছা করে এখান থেকে উঠে যায় এবং তার আম্মিজান, খানজাদা আর এসান দৌলতের সাথে নিভৃতে সময় কাটায়। কিন্তু তার অনুসারীদের প্রতি সৌজন্যতাবশত তাকে আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। গানের মাত্রা ধীরে ধীরে চড়তে শুরু করে এবং ক্রমশ কর্কশ হয়ে উঠে। যোদ্ধার দল উচ্চকণ্ঠে নিজেদের পূর্বপুরুষের বীরত্বের কথা বয়ান করতে থাকে এবং বাবরও এবার তাদের সাথে কণ্ঠ মেলায়। কিন্তু অবশেষে, কেউ কেউ টেবিলের উপরে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ে। আর অন্যেরা ঝাপসা চোখে টলোমলো পায়ে কামরা থেকে বের হয়ে বাইরের আঙ্গিনায় নিজেদের হাল্কা করতে শুরু করলে, বাবর তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পাথরের বাঁকানো সিঁড়ি বেয়ে জেনানামহলের দিকে রওয়ানা দেয়।
খুতলাঘ নিগার দু’হাত বাড়িয়ে দিয়ে তাকে স্বাগত জানায় এবং সে ভিতরে প্রবেশ করে গালিচা পাতা মেঝেতে তার পাশে এসে বসে। তাদের সামনের পিতলের থালায় পড়ে থাকা খাবারের অবশিষ্টাংশ দেখে সে বুঝতে পারে মেয়েরা ভালমতোই খেয়েছে। কিন্তু তারপরেও সে এখন যখন তাদের মুখের দিকে তাকায় সেখানে সে একটা টানটান অভিব্যক্তি লক্ষ্য করে। তাদের তিনজনকেই ফ্যাকাশে আর বিবর্ণ দেখায়। যেনো বহুকাল সূর্যের আলোর উষ্ণতা অনুভব করেনি বা তাজা বাতাসে তারা শ্বাস নেয়নি। কাউকে না কাউকে অবশ্যই এর মূল্য দিতে হবে- রক্ত দিয়ে। কিন্তু মেয়েদের খাতিরে আপাতত সে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করে না। তারা যাই বলুক তাকে, সে অবশ্যই সব কিছু শান্ত ভঙ্গিতে শুনবে।
কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ বসে থাকে। প্রাথমিক উত্তেজনা প্রশমিত হতে, কেউই বুঝতে পারে না কোথা থেকে শুরু করা উচিত।
অবশেষে এসান দৌলত শুরু করেন: “বাবর তুমি তাহলে সরমকল দখল করেছিলে।” তার বিচক্ষণ মুখে বিরল একটা হাসির আভাস ফুটে উঠে।
“অধিকার করেছিলাম বটে, কিন্তু দখলে রাখতে পারিনি।” বাবর তার মাথা নিচু করে। এমন কিছু কথা আছে যা তাকে বলতেই হবে। “নানীজান, আমি আপনাকে হতাশ করেছি। আপনি আমার সাহায্য চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছিলেন এবং আমি সাহায্য করতে ব্যর্থ হয়েছি। আমার আসতে বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছিল আর লোকজন ছিল অনেক অল্প।”
“আমাদের তুমি মোটেই হতাশ করনি। আর জেনে রেখো, আমাদের কারণেই তুমি সমরকন্দ হারিয়েছে। আমাদের সাহায্য করার জন্য তুমি সাথে সাথে যাত্রা করেছিলে। তুমি এরচেয়ে বেশি আর কিইবা করতে পারতে?”
বাবর আক্ষেপের সাথে মাথা নাড়ে। “ফারগানা আর আপনারা ছিলেন আমার প্রধান দায়িত্ব। সমরকন্দে আমি নতুন কোনো খেলনা হাতে পাওয়া শিশুর মতো আচরণ করেছিলাম। আমার তখন অন্য কিছু সম্বন্ধে ভাববার সামান্যই অবকাশ ছিলো। আপনাদের আর ফারগানার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আমার উচিত ছিলো ওয়াজির খানকে পাঠিয়ে দেয়া।” সে তার মায়ের গায়ে হেলান দেয় এবং বরাবরের মতোই মায়ের আঙ্গুল তার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে টের পায়। এতে সে কিছুটা শান্ত হয়।
“কিছু কিছু বিষয় তামবাল আমাদের কাছে কখনও গোপন করেনি।” খুতলাঘ নিগার বলেন। “আমার মনে হয় এতে সে আনন্দই পেতো। আমরা, তোমার চাচাতো ভাই মাহমুদের বিশ্বাসঘাতকতার কথা অবশ্যই জানি- আমরা জানি সেই সমরকন্দ তোমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে। বাছা, সে আর তামবাল মিলে তোমার জন্য একটা ফাঁদ পেতেছিলো। তারা দু’জনে মিলে ঠিক করেছিলো, ফারগানায় সে তোমাকে মসনদ থেকে সরিয়ে দিয়ে জাহাঙ্গীরকে তোমার স্থলাভিষিক্ত করবে। তারা জানতো এর ফলে তুমি বাধ্য হবে- তোমার বেশিরভাগ সৈন্য নিয়ে ফারগানায় ফিরে আসতে। আর মাহমুদ এর ফলে তার কাঙ্ক্ষিত সুযোগ পায়। তুমি তখন সদ্য সমরকন্দের সুলতান হয়েছে। তারা বলেছে যে সেখানকার অভিজাত ব্যক্তিরা তোমার প্রতি তেমন একটা আনুগত্য বোধ না করায়, মাহমুদ আর তার কলহপ্রিয় স্ত্রী, গ্রান্ড উজিরের কন্যা সহজেই ঘুষ দিয়ে তাদের কিনতে পেরেছে।”
নিজের সবচেয়ে জঘন্য সন্দেহটা প্রমাণিত হতে বাবর চোখ বন্ধ করে ফেলে। কি আহাম্মকই না সে ছিলো।
“তোমার এটাও জেনে রাখা উচিত, মাহমুদের স্ত্রীর কারণে সে গো ধরায় আলি মজিদ বেগকে হত্যা করা হয়েছিলো।” এসান দৌলতের কণ্ঠস্বর তিক্ত শোনায়। নিহত গোত্রপতির মা ছিলো তার বান্ধবী আর তিনি নিজেও তাকে পছন্দই করতেন। “সে নাকি বলেছে তোমার শিরোচ্ছেদ করতে না পারায়, তাকে শিরোচ্ছেদ করলেই আপাতত চলবে- তার বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ হিসাবে। মাহমুদ তার কথা ফেলতে পারেনি। সবাই বলে সেই আসলে সমরকন্দের নতুন শাসক। নিজের বাবার চেয়েও সে বেশি লোভী আর প্রতিহিংসাপরায়ণ।”
বাবর বিস্ময়ে চোখ পিটপিট করে। সে ভাবতেও পারেনি সেই সুঠামদেহী তরুণী, যে এমন সাহসিকতার সাথে গ্রান্ড উজিরের প্রাণ ভিক্ষা চেয়েছিলো কিভাবে এতো অনুভূতিহীন নিষ্ঠুর আর নির্মম হতে পারে। একদিন তাকে অবশ্যই তার এই স্পর্ধার জন্য জবাবদিহি করতে হবে। কিন্তু সেটা পরেও হতে পারে। তার আগে তাকে অন্য অনেক বিষয় জানতে হবে এবং সেগুলো মেনে নিতে হবে।
সে আলতো করে দু’হাতের মাঝে মায়ের হাত জড়িয়ে ধরে। “আমাকে তোমাদের কথা বলল। তোমরা বন্দি থাকা অবস্থায় কেমন আচরণ করছে তারা তোমাদের সাথে?”
“কয়েকজন মাত্র পরিচারকসহ আমাদের একটা ছোট জায়গায় আটকে রাখা হয়েছিলো কিন্তু আমাদের বংশ গৌরব আর মর্যাদার কারণে তারা বাধ্য হয়েছিলো আমাদের যথাযথ সম্মান দেখাতে। তামবাল আমাদের অপমান বা হুমকি দেয়নি।” তার মা বলে, “আর সম্প্রতি- সম্ভবত তোমার সাফল্যের কথা যখন সে জানতে পারে- আমাদের বড় একটা মহলে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো।”
“আর সে রোক্সানাকে আমাদের গহনা কেড়ে নিতে দেয়নি। অবশ্য অন্যদের মুখে শুনেছি সে ক্রুদ্ধ হয়ে চেঁচামেচি করেছে, যদিও সে তামবালের অঙ্কশায়িনী ছিলো।” এসান দৌলত কুপিত কণ্ঠে কথাগুলো বলেন।
“আর আমার সৎ-ভাই জাহাঙ্গীর? এসবে তার ভূমিকা কতটুকু?” বাবর প্রায়ই তার স্থান দখল করে নেয়া বালকটার কথা ভাবে যাকে সে কখনও দেখেনি। শেষবার আকশি থেকে আসবার সময়ে, সমরকন্দ অবরোধের প্রস্তুতি নেবার সময়ে, ছোঁড়া অসুস্থ ছিলো।
“বেচারা পরিস্থিতির শিকার, আর প্রায়ই অসুস্থ থাকে। তামবালের পুরো শরীরে কয়েক চামচ পরিমাণ রাজরক্ত থাকায় সে কখনও নিজে সিংহাসন দাবি করতে পারবে না। অন্য গোত্রপতিরা সেটা তাকে করতেও দেবে না। কিন্তু জাহাঙ্গীরের রাজপ্রতিভূ হিসাবে যে ক্ষমতার জন্য সে লালায়িত সেটা অর্জন করতে পারবে।” এসান দৌলত ভাবাবেগশূন্য কণ্ঠে কথাগুলো বলেন। “সে এখন তোমাকে ভয় পায়। সে যদি তোমাকে খুশি করতে না চাইতো, তাহলে আমাদের এতো সহজে মুক্তি দিতো না?”
সুলতান হিসাবে বাবর নিজের প্রথম দিনগুলোর কথা ভাবে, তার মনে পড়ে তামবাল তখন কিভাবে অন্য নেতাদের মনে সন্দেহের বীজ বপনের চেষ্টা করেছে। সব সময়ে সে নিজের উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিবৃত্ত করার চেষ্টারত ছিলো। কী সাংঘাতিক সুবিধাবাদি এক লোক- কামবার আলীর ষড়যন্ত্রে যোগ দেবার ব্যাপারে ভীষণ বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে সঠিক সময়ের জন্য ধৈর্যসহকারে অপেক্ষা করেছে। এজন্যই কি সমরকন্দ দুবার অবরোধ করতে সে তাকে প্ররোচিত করেছিলো? বাইসানগার যখন তৈমূরের অঙ্গুরীয় নিয়ে এসেছিল তখন আগ্রহে চকচক করতে থাকা তামবালের চেহারা তার এখনও মনে আছে। তার আরো মনে আছে, সমরকন্দ অধিকার করার পরে কি রকম তাড়াহুড়ো করে সে ফারগানা ফিরে এসেছিলো।
“আমাদের জন্য সবচেয়ে কঠিন সময় ছিলো প্রথম কয়েক মাস, যখন আমরা জানতাম না তোমার ভাগ্যে কি ঘটেছে। ফাতিমা- তুমি জান সে কেমন গপ্পোবাজ সে একবার একটা কথা শুনে আসে- একটা গুজব কিন্তু সেটাই আমাদের আতঙ্কিত করে তোলার জন্য যথেষ্ট ছিলো- যে তুমি ফারগানায় ফিরে আসার সময়ে পথে অসুস্থ হয়ে মারা গিয়েছে। তার মায়ের কণ্ঠস্বর কেঁপে যায়। কিন্তু তারপরেই আমরা শুনতে পাই যে তুমি সুস্থ আছো, আর পাহাড়ে আত্মগোপন করে রয়েছে। আমরা জানতাম না কোনটা সত্যি। যতদিন না তামবাল ক্রুদ্ধ হয়ে আমাদের কাছে আসে…সে আমাদের বলে তুমি গ্রামের পর গ্রাম আক্রমণ করে, সবকিছু জ্বালিয়ে দিচ্ছ, তছনচ করে দিচ্ছ এবং নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছো, কাউকে রেয়াত না দিয়ে।”
“তামবাল যা বলেছে, সেটাই তাহলে সত্যি, তাই না বাবর? যে তুমি একজন সাধারণ দস্যু আর গরু-চোরে পরিণত হয়েছো?” এসান দৌলত প্রশ্রয়ের কণ্ঠে বলেন।
বাবর সম্মতি প্রকাশ করে মাথা নাড়ে এবং মুহূর্ত পরে নানীজানের দিকে তাকিয়ে সেঁতো হাসি হাসে। তার মা আর নানী তার সম্বন্ধে কি ভাববে সেটা নিয়ে সে প্রায়ই দুশ্চিন্তা করতো। তারা কি কখনও বুঝতে পারবে কেনো একজন শাহজাদা পাহাড়ী দুৰ্বত্তের জীবন গ্রহণ বাস্তবিক পক্ষে উপভোগ করতে পারে।”
“বাবর, আমাদের সেসব কথা বল।”
পশুর চর্বি দিয়ে তৈরি মোমবাতির দপদপ করতে থাকা শিখা নিভু নিভু হয়ে আসতে, বাবর তার সময় কিভাবে কেটেছে সেটা তাদের কাছে বর্ণনা করতে চেষ্টা করে। দুইশ কি তিনশ অভিযাত্রীর একটা বাহিনী নিয়ে, পাহাড়ের উপর থেকে ধেয়ে আসবার উত্তেজনাই আলাদা। রাতের বেলা তামবালের অনুগত বাহিনীর দূর্গ ঝটিকা আক্রমণের উল্লাস। আর তার পরে রাতের আঁধারে হারিয়ে যাবার, তার পর্যাণে বাধা শিকারের ছিন্নমস্তক থেকে টপটপ করে ঝরে পড়া রক্তের ধারার অনুপ্রেরণা। প্রাচীন মোঙ্গল প্রণালী অনুসরণে তার দলের এক লোক। ঘোড়ার দুধ গজিয়ে যে খভাস তৈরি করতো সেটা পান করার কারণে মাথা ঘুরতে থাকলে সারা রাত ধরে পানোন্মত্ত অবস্থায় ফুর্তি করা। চকরাখদের ছিন্নমস্তক দিয়ে উদ্দাম পোলো খেলার কথা সে কেবল এড়িয়ে যায়। যদিও খানজাদাকে হয়তো পরে সে সেটাও বলবে। তার কথা বলার সময়ে খানজাদার চোখ চকচক করতে থাকে। তার হাতের মুঠি খোলে আর বন্ধ হয়, যেনো সে নিজে সেখানে ছিলো। তার সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছে। এসান দৌলতও মগ্ন হয়ে শোনেন। কিন্তু সে খেয়াল করে মৃত্যুর করাল থাবার হাত থেকে অল্পের জন্য বেঁচে যাবার ঘটনাগুলো শোনার সময়ে তার মায়ের ভ্রু কুঁচকে উঠে।
“আমি কিন্তু কেবল যারা আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে তাদেরই আক্রমণ করেছি। আর আমি কখনও তোমাদের কথা ভুলে যাইনি। তোমাদের স্বাধীনতা আমার মসনদের চেয়েও বেশি কাম্য ছিল আমার কাছে।” চারপাশে তাকিয়ে, বাবর দেখে গবাক্ষের সরু ফাঁক দিয়ে ফ্যাকাশে, ধুসর আলোর একটা ধারা লুকিয়ে কখন যেন কামরায় প্রবেশ করেছে। প্রায় সকাল হয়ে এসেছে।
“তুমি এটা অর্জন করেছে। কিন্তু যা হয়ে গেছে তা হয়ে গেছে। এখন আমাদের ভবিষ্যতের দিকে তাকাতে হবে।” এসান দৌলতের কণ্ঠে একটা সতেজতা ফুটে থাকে এবং তার দৃষ্টি বাবর নিজের উপরে অনুভব করলে সে অস্বস্তিবোধ করে, যেন কোনো বাচ্চা ছেলে এখনই তার ওস্তাদের কাছে ধমক খাবে। “বাবর, তুমি এই ক’দিনে কি শিখেছো?” নানীজান তার দিকে ঝুঁকে এসে তার কব্জি আঁকড়ে ধরে। “ তোমার কথা অনুযায়ী মসনদহীন দিনগুলো থেকে তুমি কি শিখেছো?”
যুক্তিসঙ্গত একটা প্রশ্ন। এই বিপজ্জনক, মরীয়া সময় তাকে কি শিক্ষা দিয়েছে? “বিশ্বস্ত বন্ধু আর মিত্রের গুরুত্ব,” সে অবশেষে কথা খুঁজে পেয়ে বলে, “এবং তাদের যোগ্যতা অনুসারে প্রতিদান দেয়া। এছাড়া পরিষ্কার উদ্দেশ্য, একাগ্রচিত্ত কৌশল আর সেটা অর্জনের পথে কোনো কিছুকে বাধা হিসাবে গণ্য না করার প্রয়োজনীয়তা।”
এসান দৌলত সন্তুষ্টির মাথা নাড়েন। “অবশ্যই। এবং এছাড়া আর কি?”
“আমি শিখেছি একজন সুলতানের পক্ষে সবসময়ে উদারতা দেখান সম্ভব না, শ্রদ্ধা অর্জনের জন্য তাকে কঠোর হতে হবে- কখনও নির্মম। অন্যথায় তাকে দুর্বল মনে হবে। নেতৃত্ব দেবার বদলে সবার ভালবাসার পাত্রে পরিণত হবার ঝুঁকি দেখা দিতে পারে। আর সেই সাথে মিষ্টিভাষী ষড়যন্ত্রকারীর ফাঁদে পা দিয়ে বসতে পারে। আমি শিখেছিঃ আনুগত্য অর্জন করতে হলে কেবল কৃতজ্ঞতা আর সম্ভ্রম উদ্রেক করলেই চলবে না। এর সাথে সামান্য ভয়েরও মিশেল থাকতে হবে। আমি প্রথমবার ফারগানার শাসক হবার পরে বাকী বেগ, বাবা কাশক, আর ইউসুফকে প্রাণদণ্ড দেয়া উচিত ছিলো। তার বদলে আমি কেবল তাদের শাহী দায়িত্বপালন থেকে অব্যাহতি দিয়েছিলোম এবং জীবন ধারণের জন্য কোনো বাধা না দিয়ে বরং মনের ভিতরে তাদের তিক্ততা পোষণের সুযোগ দিয়েছি। এছাড়া, সমরকন্দ দখল করার পরে গ্রান্ড উজিরের কতিপয় সমর্থককেও কড়কে দেয়া উচিত ছিলো।
“তারচেয়েও বড় কথা, আমার নিয়তির প্রতি আমি আর কখনও অবহেলা প্রদর্শন করবো না। আমাদের সাথে আমার সাথে যা ঘটেছে তারপরেই কেবল আমি হাল্কা হাল্কা বুঝতে পারছি মানুষ তৈমূর লোক হিসাবে কেমন ছিলেন। মাঝে মাঝে তার নিজেকে কেমন একা মনে হয়েছে- নিজের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজ করতে গিয়ে তাকে কেমন অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়েছিলো। আর তাছাড়া, তাদের সব দায়দায়িত্ব পরে বহুবছর ধরে তাকে নিজের কাঁধে বহন করতে হয়েছিলো… আমি নেতৃত্ব দেবার মতো সাহসও অর্জন করেছি…ওয়াজির খানের মতো আমার যতো দক্ষ পারিষদ থাকুক আমার নিয়তি কেবল আমিই নির্ধারণ করতে পারি।
বাবর মুখ তুলে তার নানীজানের দিকে তাকায়। “দেখে নিয়ে, আমি ঠিক তৈমূরের মতই বীর হবো। আমি শপথ করে বলছি…”
“কথাগুলো সত্যিই শুনতে ভাল লাগে।” এসান দৌলত মন্তব্য করেন। “চলো আমাদের অনেক কাজ এখনও বাকি আছে। একটা নতুন দিনের প্রভাত হচ্ছে।”
দ্বিতীয় খণ্ড – সালতানাৎবিহীন এক সুলতান
০৭. আয়োধন আর অন্তর্ধান
বৃষ্টি আর তুষারপাতের মিশ্রণের প্রকোপ বাবরের ভেড়ার চামড়ার প্রলেপ দেয়া ভারী জ্যাকেটের আবরণও আটকাতে ব্যর্থ হয়। ফারগানার উত্তরে উঁচু পর্বতমালার অভ্যন্তরে এক প্রত্যন্ত উপত্যকার ভিতর দিয়ে বয়ে যাওয়া একটা ক্ষুদ্র স্রোতস্বিনীর তীরের প্রায় কাদা হয়ে থাকা বরফের ভিতর দিয়ে তার অবশিষ্ট লোকদের সামনে থেকে ঘোড়া নিয়ে এগিয়ে চলেছে, বৃষ্টি আর তুষারপাতের হাত থেকে বাঁচতে মাথা নিচু করে রাখা।
নিজের দুটো সালতানাই হারিয়েছে এটা অনুধাবন করার পরের প্রথম দিকের মুশকিল দিনগুলোতে, বাবর আকশি দূর্গের আশেপাশেই থাকবে বলে ভেবেছিলো আশা করেছিলো সব কিছু বাজি রেখে হলেও সে তার পরিবারকে মুক্ত করতে পারবে। ওয়াজির খান অনেক কষ্টে তাকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে, তার শত্রুরাও এমনই একটা মরীয়া প্রচেষ্টা আশা করছে আর তারা সেজন্য পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে রয়েছে। ওয়াজির খান, তার চিরাচরিত পিতৃসুলভ ভঙ্গিতে তাকে আশ্বস্ত করে পরামর্শ দিয়েছে, “আপনি যদি আপনার আম্মিজান, নানীজান আর বোনকে বাঁচাতে চান তাহলে নিজেকে বিপদের মুখে না ফেলে বরং শত্রুদের তটস্থ করে তুলেন, যাতে তারা আপনার নাম শুনলেই ভয় পায়। আর সেটা করতে হলে তাদের চাপের ভিতরে রাখেন। এখানে সেখানে তাদের আক্রমণ করে, আপনার বিরুদ্ধে সৈন্য সমাবেশ করবার আগেই সেখান থেকে সরে আসেন। ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে সবসময়ে একটা ভীতির সঞ্চার করতে থাকেন। আপনার শত্রুরা যাতে শান্তিতে ঘুমাতে না পারে। আর এটা করতে পারলেই সুলতান, তারা আপনার পরিবারের ক্ষতি করার কথা চিন্তাও করতে পারবে না।”
বাবর ওয়াজির খানের বক্তব্য মোটের উপরে বুঝতে পারে। সাবধানে বিবেচনা করে, সে একটা পরিকল্পনার কথা বলে। আমাদের একটা নিরাপদ আশ্রয়স্থল চাই। যেখানে আমরা শীতকালটা কাটাতে পারবো এবং প্রথম হামলার ছক কষতে পারবো। আমার মনে আছে যে প্রতিবার গ্রীষ্মের সময়ে সামরিক প্রশিক্ষণের অংশ হিসাবে আপনি একবার আমাকে উত্তরের পার্বত্য অঞ্চলে একটা অভিযানে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং উপত্যকার কেন্দ্রস্থলে একটা মাটির দূর্গে আমরা অবস্থান করেছিলাম। তামবালের অনুগত এক জায়গীরদার সেই নগণ্য সেনাছাউনির প্রধানের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলো। সেই দূর্গটা আমাদের জন্য চমৎকার আশ্রয়স্থল হিসাবে প্রতিপন্ন হতে পারে। কারো মাথাতেই বিষয়টা আসবে না। আপনি কি বলেন?”
“জায়গার কথা আমার মনে আছে। বাস্তবিকই প্রত্যন্ত অঞ্চলে দূর্গটা অবস্থিত, আর আমাদের উদ্দেশও হাসিল হবে।”
আর সে জন্যই সে ওয়াজির খানকে নিয়ে পাহাড়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেছিলো। তাদের সাথে কেবল দুশো লোক ছিলো। ওয়াজির খানের সাহায্যে বাবর অনেক যত্ন নিয়ে তাদের বাছাই করেছে, সে কেবল তাদেরই বাছাই করেছে যাদের বয়স অল্প আর কোনো পারিবারিক পিছুটান নেই বা বাইসানগারের মতো যারা তার বিশ্বস্ত অন্তরঙ্গ। বাকি সবাইকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে, তার ডাকের অপেক্ষা করতে বলেছে, যা তারা নিশ্চিতভাবেই পাবে। তাদের যাত্রার দ্বিতীয় সপ্তাহে তুষারপাত শুরু হয় এবং উচ্চতা বাড়বার সাথে সাথে তুষারের স্তর বৃদ্ধি পেয়ে তাদের যাত্রাকে শ্লথ করে তুলেছে।
“ওয়াজির খান, আপনার কি মনে হয় আমরা দূর্গ থেকে কতোটা দূরে অবস্থান করছি?”
“সুলতান, আবহাওয়া যদি এতোটা বিরূপ না হতো, আমরা তাহলে দূর্গটা এতক্ষণে দেখতে পেতাম। অবশ্য সুবিধাও হয়েছে, দূর্গের নিরাপত্তা রক্ষীরা আমাদের আগে থেকে দেখতে পাবে না। দূরের ঐ গাছগুলোর আড়ালে আমরা অবস্থান নেবো আর সামনেটা রেকী করার জন্য গুপ্তদূত পাঠিয়ে আমরা পর্যাণে যেটুকু শুকনো মাংস রয়েছে সেটা দিয়ে আহার সেরে নেবো।”
তাদের পাঠানো গুপ্তদূতেরা রেকী করে ফিরতে যে নব্বই মিনিট সময় লাগে তার পুরোটা সময়ই অবিশ্রান্তভাবে তুষারপাত হয়। কখনও ভারী বা কখনও হাল্কাভাবে। তার লোকেরা ফিরে আসতে দেখা যায়, ঘোড়া আর তার আরোহী তুষারে পুরো ঢেকে গেছে এবং গুপ্তদূতদের দলনেতা ঠাণ্ডায় নীল হয়ে আসা ঠোঁটে কোনোমতে কথা বলে। “এখান দু’মাইল দূরে একটা বাকের পরেই দূর্গটা অবস্থিত। দূর্গের বাইরে আমরা কোনো ঘোড়ার বা পায়ের ছাপ দেখতে পাইনি যাতে বোঝা যায়, আজ ভেতর থেকে কেউ টহল দিতে বা পর্যবেক্ষণ-ফাঁড়িতে যায়নি। আমরা যখন ঘোড়া থেকে নেমে দূর্গের কাছে এগিয়ে যাই, দূর্গের এক অংশ থেকে আমরা ধোয়া উঠতে দেখেছি- সম্ভবত রসুইখানা- কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো দূর্গের মূল ফটক তখন ভোলা ছিলো। স্পষ্টতই এই আবহাওয়ায় কেউ আক্রমণ করতে পারে সেই ব্যাপারটা তাদের মাথাতেও নেই।”
“চমৎকার, শীঘ্রই তাদের এই নিশ্চয়তা নরকে পরিণত হতে চলেছে। ওয়াজির খান, এটা ইতস্তত করার সময় না, সবাইকে এই মুহূর্তে প্রস্তুত হতে বলুন এবং তুষারপাতের মাঝে আমরা আত্মগোপন করে গুপ্তদূতদের সহায়তায় দূর্গে পৌঁছাবার পথের শেষ বাঁকে দ্রুত আর নিরবে গিয়ে হাজির হবো। সেখান থেকে মূল ফটকের উদ্দেশ্যে ঘোড়া দাবড়ে যাবো।”
ওয়াজির খান মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় এবং পাঁচ মিনিট পরে অশ্বারোহী বাহিনীর একটা সারিকে মন্থর গতিতে পাহাড়ী পথ বেয়ে উপরের দিকে উঠে যেতে দেখা যায়। তুষারাবৃত প্রেক্ষাপটের মাঝ দিয়ে প্রায় দু’মাইল এগিয়ে যায়। তুষারপাত এখন আগের চেয়ে অনেক কমে এসেছে। বাবরের চোখের সামনে একটা পাথুরে অবয়ব ভেসে ওঠে। দূর্গটা আর মাত্র হাজারখানেক গজ সামনে অবস্থিত। এখান। থেকে দূর্গ পর্যন্ত রাস্তাটা বেশ প্রশস্ত।
“আমরা এখান থেকেই আক্রমণ শুরু করবো। লোকদের বলেন অপ্রয়োজনীয় সবকিছু এখানে পাথরের আড়ালে রেখে কেবল হাতিয়ার নিয়ে প্রস্তুত হতে। যাতে বরফের উপর দিয়ে যতোটা সম্ভব দ্রুত ঘোড়া দাবড়ে আমরা দূর্গে পৌঁছাতে পারি।” তার লোকেরা নিরবে প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। কিন্তু তারা প্রস্তুত হতে হতে তুষারপাত একেবারে বন্ধ হয়ে যায় এবং সামনে- সাদা প্রেক্ষাপটের মাঝে একটা কালো আকৃতির মত দূর্গটা ভেসে উঠে।
“যারা প্রস্তুত, ঘোড়ায় আরোহন করো! কারো চোখে পড়ে যাবার আগেই আমাদের আক্রমণ করতে হবে!” বাবর চিৎকার করে কথাটা বলার ফাঁকে ময়ান থেকে আলমগীর বের করে আনে। সে লাফিয়ে জিনের উপরে উঠে বসে এবং তার বিশাল কালো ঘোড়াটাকে দূর্গের দিকে এগোতে বলে পেটে খোঁচা দেয় যার ফটক সে খোলা দেখতে পেয়েছে। দশজন যোদ্ধা পরিবেষ্টিত অবস্থায় এবং বাকীরা তার পেছনে সারিবদ্ধভাবে বিন্যস্ত। ঘোড়ার কাধ ধরে ঝুঁকে ছুটে যাবার সময়ে বাবর টের পায় তার কানে রক্তের চাপ বৃদ্ধি পেয়েছে। দূর্গের ফটক থেকে সে যখন মাত্র দুশো গজ দূরে, তখন ভেতর থেকে একটা চিৎকার তার কানে ভেসে আসে- শত্রুরা তাদের দেখে ফেলেছে। ভেতরের লোকেরা বিপদ টের পায়। তারা ফটকের পাল্লা বন্ধ করার চেষ্টা করতে সেটা কেঁপে উঠে। কিন্তু নতুন জমা বরফ পাল্লা নড়তে বাধা দেয়। দু’জন লোক বাইরে ছুটে আসে, বরফের স্তূপে লাথি দেয় এবং বৃথাই চেষ্টা করে পাল্লাটা বরফের উপর দিয়ে সরাতে।
“ব্যাটাদের পেড়ে ফেলো!” বাবর হুঙ্কার দিয়ে বলে। কিন্তু ঘোড়ার গতি বিন্দুমাত্র হ্রাস করে না। নিমেষের ভিতরে সে একজনকে মাটিতে পড়ে যেতে দেখে, একটা তীর তার গলায় বিদ্ধ হয়েছে। একই সাথে সে নিজেও দূর্গের তোরণদ্বারের কাছে পৌঁছে যায়। দ্বিতীয় লোকটাকে সে আলমগীর দিয়ে একটা কোপ বসিয়ে দেয়। টের পায় তার তরবারি জায়গা মতোই নরম মাংসপেশীতে কামড় বসিয়েছে। কিন্তু কোথায় সেটা দেখবার জন্য সে ঘোড়ার গতি একটুও হ্রাস করে না। তার বদলে, সে তার হাতে ধরা লাগামে একটা ঝাঁকি দিয়ে ঘোড়ার মাথা তখনও আংশিক খোলা ফটকের দিকে ঘুরিয়ে দেয়। বিশাল কালো ঘোড়াটা নাক দিয়ে একটা শব্দ করে এবং বাবর টের পায় ঘোড়াটার একটা পা পিছলে গেছে কিন্তু কালো পাহাড় ঠিকই ঘুরে দাঁড়ায়। একই সাথে তার পেছনে তিনজন যোদ্ধা এসে হাজির হয়।
কিন্তু চতুর্থজন ঢুকতে ব্যর্থ হয়। ভেতরে প্রবেশপথ আটকে ঘোড়া আর তার আরোহীর ভূপাতিত হবার শব্দ বাবর শুনতে পায়। সে দূর্গের ভিতরে প্রবেশ করেছে বটে। কিন্তু তাকে সহায়তা করবার জন্য মাত্র তিনজন যোদ্ধা তার সাথে রয়েছে। চারপাশে তাকালে সে সারি সারি স্থাপিত উঁচু দরজার পেছন, সম্ভবত দূর্গের প্রধান সেনানিবাস থেকে পিলপিল করে লোকজনকে বের হয়ে আসতে দেখে। কেউ কেউ ইস্পাতের বর্ম গায়ে চাপাতে ব্যস্ত। আর বাকিরা ইতিমধ্যে অস্ত্রধারণ করেছে।
“আমার সাথে এসো! এখনই আক্রমণ করতে হবে!” বাবর পেটে খোঁচা দিয়ে পুনরায় তার ঘোড়ার গতি বৃদ্ধি করে। আর একটু পরেই তাকে তার তিনজন সহযোদ্ধাকে নিয়ে আতঙ্কিত লোকগুলোকে কচুকাটা করতে দেখা যায়। সহসা একটা লম্বা লোক বাবরের নজর কাড়ে, যাকে দেখে সেনাপতিদের একজন বলে মনে হয়। ব্যাটকে মাথা নিচু করে পুনরায় ঘরের ভিতরে প্রবেশ করতে দেখলে সেও ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে সেদিকে এগিয়ে যায়। কাঠের সরদলের নিচে দিয়ে ঝুঁকে পার হয়ে সে ভেতরের আধো অন্ধকারে চোখ পিটপিট করে প্রবেশ করতে যে বিশ ত্রিশজন সেখান থেকে বের হয়ে এসেছে, বুঝতে হবে সেটাই এই দূর্গের মোট জনবল। কেবল সেনাপতিগোছের লোকটাই এখন ভেতরে রয়েছে। লোকটা দৌড়ে একটা অস্ত্র সজ্জিত তাকের দিকে ছুটে গিয়ে সেখান থেকে একটা বর্শা আর ঢাল তুলে নিয়ে বাবরের দিকে ঘুরে দাঁড়ায়।
“ফারগানার ন্যায়সঙ্গত সুলতান, আমি বাবর তোমাকে আদেশ দিচ্ছি অস্ত্র নামিয়ে রাখো।”
“আমি আত্মসমর্পন করবো না। তোমাকে আমি সুলতান বলে মানি না। আমার নাম হানিফ খান। আমি তামবালের প্রতি অনুগত, সেই এখন পুরো এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে। পারলে সম্মুখ যুদ্ধে আমাকে পরাস্ত করো।”
বাবর তার কালা পাহাড়ের উপর থেকে লাফিয়ে নামে এবং আলমগীর হাতে ধরা অবস্থায় হানিফ খানের দিকে এগিয়ে যায়। যে তক্কে তক্কে ছিলো বাবর তার। কাছাকাছি যেতেই হাতের বর্শা দিয়ে সে বাবরকে আঘাতের চেষ্টা করে। বাবর লাফিয়ে একপাশে সরে যায়। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে অর্ধভুক্ত খাবারে ভর্তি একটা নিচু টেবিলের পায়ার সাথে তার বাম পা আটকে যায়। বেকায়দা ভঙ্গিতে সে টেবিলের উপরে আছড়ে পড়ে। টেবিলের উপরে থাকা কাঠের পেয়ালা আর তার ভেতরের খাবার ছিটকে ফেলে। মাংসের সুরুয়া অর্ধেকটা ভর্তি একটা বিশাল ধাতব পাত্রের মুখে তার তরবারি ধরা হাতের কব্জি আটকে যেতে, আলমগীর তার মুঠো থেকে ছুটে যায়।
হানিফ খান বাবরের অসহায় অবস্থার সুযোগে তাকে একেবারে শেষ করে দেবার জন্য ছুটে আসে। তার বর্শাটা দু’হাতে মাথার উপরে তুলে বাবরের উন্মুক্ত গলায় সেটা সর্বশক্তিতে নামিয়ে আনবে। বাবর একটা কাঠের বড় বারকোশ তখন তুলে নিয়ে সেটাকে ঢালের মত ব্যবহার করে। বর্শা বারকোশে বিদ্ধ হয়। তবে সেটাকে ছিন্ন করতে পারে না। ছিটকে পড়া খাবারের উষ্ণ চটচটে সুরুয়ার ভিতরে গড়িয়ে একপাশে সরে যাবার সময়ে সে বারকোশটা ফেলে দিয়ে বর্শার হাতল ধরে মোচড় দেয় এবং হানিফ খানের হাত থেকে সেটা টেনে নেয়।
বিন্দুমাত্র দমে না গিয়ে হানিফ খান, লাফিয়ে পেছনে সরে গিয়ে কোমরের পরিকর থেকে একটা সরু খঞ্জর টেনে বের করে। আলমগীর কোথায় পড়েছে সেটা দেখার সময় নেই বাবরের, হাতের বর্শাটা দিয়ে সে লোকটাকে সজোরে আঘাত করলে ফলার মাথায় আটকানো বারকোশটা খুলে পড়ে। আর একই সময়ে, নিজের গালে সে একটা তীক্ষ্ণ ব্যাথা অনুভব করে। হানিফ খান বাবরের গলা লক্ষ্য করে খঞ্জরটা চালিয়েছিলো কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে। বাবর এবার বশার ফলাটা সজোরে তাকে লক্ষ্য করে আঘাত করে হানিফ খান একপাশে ঘুরে আঘাতটা এড়াতে চেষ্টা করে। কিন্তু ফলাটা তাকে বামদিকে স্পর্শ করলে সে টেবিলের পাশে রাখা শক্ত কুশনের উপরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। বাবর এবার বর্শাটা মোচড় দেয় এবং মুহূর্ত মাত্র চিন্তা না করে প্রতিপক্ষের কণ্ঠনালী লক্ষ্য করে সজোরে বর্শাটা নামিয়ে এনে গালিচার উপরে তাকে গেথে ফেলে। যা অচিরেই ফিনকি দিয়ে রক্তে ভিজে লাল হয়ে যায়।
ইতিমধ্যে ওয়াজির খান, বাইসানগার আর বাকী লোকেরা এসে তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে তার সাহসিকতার জন্য তাকে শুভেচ্ছা জানায়। দূর্গটা এখন তাদের দখলে। ফারগানা উদ্ধারের বন্ধুর পথে সে মাত্র প্রথম পদক্ষেপটা সাফল্যের সাথে রেখেছে। বাইরে বের হয়ে এসে বাবর দেখে আবার তুষারপাত শুরু হয়েছে। শত্রুর পড়ে থাকা দেহের চারপাশের লাল রঙ ইতিমধ্যে অনেকটাই ঢাকা পড়েছে। একটু আগে তামবালের চামচার ভবলীলা সে যেভাবে সাঙ্গ করেছে, সেভাবে পালের গোদাটাকে কখন মুঠোর ভেতরে পাবে সেই মুহূর্তটার জন্য সে অধীর হয়ে রয়েছে।
*
আর এভাবেই পুরো ঘটনাটার সূচনা হয়। বাবর একজন হানাদারে পরিণত হন। ঝটিকাবেগে আক্রমণ করেন এবং ফিরে যাবার সময় প্রতিবারই মৃত শত্রুর কারো একজনের মুখে রক্ত দিয়ে নিজের নাম লেখা একটা কাগজ গুঁজে দিয়ে যান। আর তার সাফল্য ক্রমশ বাড়তে থাকে। তার বাহিনীর সংখ্যা, মিষ্টি কথা আর মধুর প্রতিশ্রুতি, সেই সাথে শক্তি বা তার অভিযানে প্রাপ্ত সম্পদের বিচক্ষণ ব্যবহার নতুন সমর্থকদের আকৃষ্ট করে এবং প্রতিপক্ষকে দলে টেনে, ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায়। মাটির দূর্গ দখলের বিশ মাসের মধ্যে, নিষ্ঠা আর একাগ্রতার সাথে একটার পরে একটা ছোট দূর্গ আর গ্রামের পর গ্রাম দখল করে ফারগানার পশ্চিমাঞ্চলের অধিকাংশই সে দখল করে নেয়। তার কৌশল কার্যকরী বলে প্রতীয়মান হয়। তামবাল আকশির উত্তর বা পশ্চিমে বাবরের শক্ত ঘাঁটির দিকে বেশিদূর অগ্রসর হবার মতো সাহস দেখায় না। আর বাবরও মনে করে এবার সময় হয়েছে নিজের দাবির কথা প্রকাশ করবার।
প্রথম দাবিটা সে ছয়মাস আগে জানায় এবং তারপরে প্রায়শই তার পুনরাবৃত্তি করেছিলো তার আম্মিজান, নানীজান আর বোনের মুক্তির বদলে এক বছর আকশি দূর্গ আক্রমণ না করবার প্রতিশ্রুতি। তিনমাস আগে তামবাল এক বার্তাবাহকের মাধ্যমে প্রেরিত এক চিঠিতে অনেক মধুর ভাষায় জানায় এসান দৌলত, খুতলাঘ নিগার আর খানজাদা প্রত্যেকেই সুস্থ আছে এবং শাহী পরিবারের উপযুক্ত ব্যবহারই করা হচ্ছে তাদের সাথে। কিন্তু চিঠিতে সে তাদের মুক্তি দেবার তার কোনো অভিপ্রায়ের কথা উল্লেখ করেনি।
বাবর এখন পূর্বদিকে পঞ্চাশ মাইল দূরে অবস্থিত শহর গাভার দিকে অগ্রসর হচ্ছে কিছুদিন আগে তামবাল ভাড়াটে চকরাখ যোদ্ধাদের সহায়তায় সেখানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছে। সেখানে একটা হিসাব মেলানো এখনও বাকি আছে। সেখানকার দূর্গের চাকরাখ সর্দার তার সৎভাই আর তামবালকে শাহী প্রতিনিধি হিসাবে মেনে নিয়ে প্রথম আনুগত্য প্রদর্শনকারীদের অন্যতম। শহরটা দখল করলে তামবালকে আরেকটা জোরালো সঙ্কেত পাঠানো হবে যে, সময় হয়েছে বাবরের কাছে তার পরিবারকে ফেরত পাঠাবার।
এক ক্ষুদ্র নহরের পাশে সাময়িক যাত্রাবিরতি করে বাবর আর তার লোকেরা ঘোড়াগুলোকে পানি পান করার সুযোগ দেয়। ঘোড়ার দুধ থেকে তৈরি টক পনির কোনোক্রমে গলধঃকরণের ফাঁকে বাবর তাকিয়ে দেখে তার এক গুপ্তদূত ঘোড়ায় চড়ে এগিয়ে আসছে। বাবর চমকে উঠে দেখে তার পর্যানে একটা দেহ আড়াআড়িভাবে বাঁধা রয়েছে। লোকটার দিকে দৌড়ে গিয়ে বাবর চিৎকার করে জানতে চায়, “কি হয়েছিলো? এই লোকটা কে?”
“লোকটা একটা ব্যবসায়ী। পথের পাশে পেটে তরবারির আঘাত নিয়ে নিজেরই রক্তে অর্ধচেতন অবস্থায় পড়ে থাকার সময়ে তাকে আমি খুঁজে পেয়েছি। আমি তাকে আমার ঘোড়ার পিঠে তুলে নেবার কিছুক্ষণ পরেই বেচারা মারা যায়। অবশ্য মারা যাবার আগে সে আমাকে বলেছে যে আরও তিনজন ব্যবসায়ীর সাথে সে। এখান থেকে দশ মাইল দূরে একটা ছোট সরাইখানার উদ্দেশ্যে যাবার পথে তারা চকরাখ হানাদারদের হামলার শিকার হয়। তার তিন সঙ্গীকে হত্যা করে তাকেও মৃত ভেবে তাদের সব মালপত্র নিয়ে তারা চলে গেছে।”
“চকরাখ হানাদারদের অবশ্যই খুঁজে বের করে তার হত্যার আমরা বদলা নেবো। তোমার অধীনস্ত কয়েকজন গুপ্তদূতকে হত্যাকারীদের খুঁজতে পাঠাও।”
“সুলতান, আমার মনে হয় না তার কোনো দরকার আছে। বণিক লোকটা মারা যাবার আগে আমাকে বলেছে যে, সে চকরাখদের বলতে শুনেছে তারা সরাইখানায় যাচ্ছে, সেখানে আরও শিকার যদি তারা খুঁজে পায়…”
“তাহলে আমরা প্রথমে সরাইখানায় যাবো।”
***
গানের সুর বন্য আর কর্কশ চকরাখদের নিজেদের মতোই অনেকটা। মদের নেশায় চুরচুর হয়ে থাকা পুরুষদের কণ্ঠস্বর নতুন মাত্রায় উঠে এমন সব অশ্লীল ক্রিয়াকলাপের বর্ণনায় মেতেছে যা একাধারে শারিরীকভাবে অসম্ভব আর মোটাদাগের যে বাবর চেষ্টা করেও হাসি চাপতে পারে না। সে আড়চোখে ওয়াজির খানের দিকে তাকিয়ে দেখে সেও হাসছে।
লম্বা ঘাসের আড়ালে বাবর তার চারপাশে শুয়ে থাকা লোকদের ইশারা করে। সবাই। তারমতো পেটের উপরে ভর দিয়ে শুয়ে আছে, লুকিয়ে অপেক্ষা করছে। তারপরে সে গুঁড়ি মেরে মাটির ইট দিয়ে তৈরি একতলা সরাইখানার দিকে এগিয়ে যায় যেটা ফারগানার অন্যতম খরস্রোতা একটা নদীর অগভীর অংশের পাড়ে অবস্থিত। যেখানে হল্লাবাজেরা মচ্ছবে মেতেছে। নূপুরের নিক্কন ধ্বনি ভেসে আসতে বোঝা যায় ভেতরে বাইজি মেয়েরাও আছে। সেই সাথে কুপিত নারী কণ্ঠের সহসা একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার আর তার সঙ্গে ভেসে আসে- পুরুষ কণ্ঠের অট্টহাসি।
দুপুর মাত্র অতিক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু বিশজন বা তার কিছু বেশি চাকরাখরা ইতিমধ্যেই বেহেড মাতাল হয়ে পড়েছে। তারা এমনকি তাদের ঘোড়াগুলিকে ঠিকমতো বাঁধার কষ্টও করেনি এবং কিছু ঘোড়া, যাদের কেশর পুরু আর লেজ এতো লম্বা যে মাটিতে ঘষা খাচ্ছে, ইতিমধ্যেই ছুটে পালিয়েছে। চারো ব্যবসায়ীর কাছ থেকে লুট করা মালামালও তারা ভিতরে নিয়ে যাবার গরজ দেখায়নি। বণিকদের মালবাহী ধুসর খচ্চরগুলো দড়ি দিয়ে একত্রে বাঁধা এবং মনোযোগ দিয়ে চরে বেড়াচ্ছে। তাদের পিঠে আটকানো বেতের ঝুড়িগুলো দেখে মনে হয় এখনও চামড়া আর লোমে ঠাসা। চাকরাখরা মনে হয় কেবল মদের পিপে নিয়ে সরাইখানার ভিতরে প্রবেশ করেছে।
বর্বর অসভ্য, বাবর ভাবে। তাদের কপালে আজ কি লেখা আছে সেটা এখনই ব্যাটারা টের পাবে। আর এই ভাবনাটা তাদের উৎফুল্ল করে তোলে। লম্বা ঘাসের উপরে মাথা তুলে বাবর চারপাশে তাকায়। কিন্তু কাউকে দেখতে পায় না। সে ঠিক যেমনটা ভেবেছিলো, ঘোড়া বা মালামাল দেখার জন্য বাইরে কোনো বাচ্চাকে রাখার কথা ব্যাটাদের মাথাতেই আসেনি। সে এবার উঠে দাঁড়িয়ে, গুটিগুটি পায়ে সরাইখানার নীচু প্রবেশদ্বারের ডান দিকে মোটা দেয়ালের গায়ে জানালার মতো দেখতে একটা ফাঁকা জায়গার দিকে এগিয়ে গিয়ে ভেতরে সতর্কতার সাথে উঁকি দেয়। ঘরটা প্রায় খালি, কেবল ভেতরের দেয়ালের গায়ে ঠেকানো অবস্থায় একটা লম্বা কাঠের টেবিল দেখা যায়। কয়েকটা তেপায়া টুল আর একটা আধ ভাঙা বেঞ্চি দেখা যায়। ঘরের মাঝে মোটাসোটা, বোচা-নাকের একটা মেয়ে পরনে রঙচটা হলুদ রঙের ঢোলা সালোয়ারের উপরে লাল ফুলের ছাপ দেয়া একটা আঁটোসাঁটো কামিজ, পায়ে আর হাতের কব্জিতে ঘুঙুর বাঁধা। নীল সালোয়ার কামিজ পরিহিত লম্বা আরেকটা মেয়ে তার নোংরা হাতে একটা খঞ্জনী, বর্গাকার পাথরের মেঝের উপরে খালি পায়ে সজোরে পদাঘাত করে বৃত্তাকারে আবর্তিত হচ্ছে। সে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই চকরাখদের কয়েকজন, ভেড়ার চামড়ার তৈরি টুপির নিচে তাদের গোলাকার মুখ ঘামে ভিজে আছে, টলোমলো পায়ে মেয়েদের বুকে পাছায় বৃথা চেষ্টা করে থাবা দিতে এবং মুখ থুবড়ে মাটিতে আছড়ে পড়লে তাদের সঙ্গীসাথীদের উদ্দীপনা আরও বেড়ে যায়।
এক কোণে ধোঁয়া উঠতে থাকা অগ্নিকুণ্ডের উপরে বিশাল একটা কেতলি ঝুলতে দেখা যায়। আরেক কোণে, বাবর এক চকরাখ দুবৃত্তকে কাপড় খুলে ব্যস্ত ভঙ্গিতে হাল্কা হতে দেখে, দুর্গন্ধে তার সঙ্গীসাথীদের আপাতভাবে কোনো অসুবিধা হয় না। আরেক বদমাশ উঠে দাঁড়িয়ে হলুদ বমি বৃত্তচাপ তৈরি করে ছুঁড়ে ফেলে আবার বসে পড়ে আর মনোযোগ দিয়ে জামার হাতায় পড়া বমির ফোঁটা বড়বড় নখ দিয়ে টুসকি দেয়। বাবর পুনরায় মাথা নামিয়ে নেয়। সে যা দেখার তা দেখে নিয়েছে।
মাটিতে গুঁড়ি দিয়ে সে পুনরায় ওয়াজির খান যেখানে আছে সেখানে ফিরে আসে। “মদ্যপ আহাম্মকগুলো আমাদের হাতে মারা যাবার জন্য মুখিয়ে রয়েছে। ব্যাটারা তাদের তরবারি আর ঢাল পর্যন্ত দরজার কাছে স্তূপ করে রেখেছে।”
ওয়াজির খানের একটা ক্ৰ উপরে উঠে যায়। “সুলতান, এখনই?”
“হ্যা!”
বাবর আর ওয়াজির খান উঠে দাঁড়িয়ে তাদের লোকদেরকেও উঠে দাঁড়াবার ইশারা করে। তারা এই কাজটা আগে এতোবার করেছে যে, মৌখিক আদেশের আর কোনো প্রয়োজন হয় না। ঠোঁটের উপরে আঙ্গুল চেপে, ওয়াজির খান ইশারায় ঘুরে কয়েকজনকে সরাইখানার পেছনে যেতে বলে। যদি সেখান দিয়ে পালাবার কোনো পথ থেকে থাকে। তারপরেই কেবল বাবর তার প্রিয় রণহুঙ্কারে চারপাশ প্রকম্পিত করে: “ফারগানা!”
বাবর একেবারে সামনে থেকে তার লোকদের নেতৃত্ব দেয়। মদের নেশায় মাতাল আর বিস্ময়ে আড়ষ্ঠ চকরাখরা সামান্যই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। বাবর আর তার লোকেরা নির্মমভাবে প্রতিপক্ষের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়লে বোঁচা-নাকের সেই মেয়েটার কাছ থেকেই কেবল বলার মতো প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। মেয়েটা তার কাচুলির ভিতর থেকে একটা খঞ্জর বের করে এবং বাবরের বাহুতে সেটা মরিয়া ভঙ্গিতে গেথে দিতে চাইলে, বাবর অনায়াসে তার ঘুঙুর পরা হাতের কব্জি ধরে এবং তাকে ঘুরিয়ে দিয়ে তার নধর নিতম্বে বুট দিয়ে একটা সপাট লাথি বসিয়ে দিতে বেচারী ছিটকে দূরে গিয়ে পড়ে।
কয়েক মিনিটের ভিতরে সবকিছু শেষ হয় এবং বাবরের লোকদের হাঁপিয়ে ওঠার আগেই নিজেদের তরবারির ফলা পরিষ্কার করে কোষবদ্ধ করতে দেখা যায়। তার লোকদের গায়ে একটা আঁচড়ও লাগেনি। অবশ্য তার লোকদের সবাই পোড়খাওয়া যোদ্ধা, এসব মদ্যপ মাতালদের চেয়ে অনেক দক্ষ লোকদের সাথে তারা আগে লড়াই করেছে। “লাশগুলো বাইরে নিয়ে যাও দেখা যাক আমরা কাদের হত্যা করেছি,” বাবর আদেশটা দিয়ে কৃতজ্ঞচিত্তে দ্রুত পূতিগন্ধময়, ধোঁয়াটে ঘরটা থেকে বাইরের খোলা বাতাসে বের হয়ে আসে।
তার লোকেরা চকরাখদের লাশগুলি তাদের বুট-পরা পা ধরে হেঁচড়ে বাইরে এনে সারিবদ্ধভাবে সাজালে, বাবর লাশগুলো শুনে দেখে। মোট পনেরটা লাশ। কারো গলা দুভাগ হয়ে আছে, কোনোটা আবার কবন্ধ। তার লোকেরা অবশ্য কাটাপড়া মাথাগুলো সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছে। কোনোটার মাথায় তখনও ভেড়ার চামড়ার টুপি রয়েছে। কাটা মুণ্ডগুলোর দিকে তাকিয়ে যখন বাবর একটা বিশেষ মুখ চিনতে পারে, তখন তার মুখ থেকে সন্তুষ্টিসূচক একটা শব্দ ধ্বনিত হয়। তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে এমন সব চকরাখকে সে হত্যা করবে বলে মনস্থ করেছে। এবং প্রতিটা হত্যাযজ্ঞ যা তাকে তার লক্ষ্যের নিকটবর্তী করছে প্রচণ্ড তৃপ্তিদায়ক।
তারস্বরের চিৎকার শুনে বাবর ঘুরে তাকায়। তার দু’জন যোদ্ধা বাইজি মেয়েদের ধরে তাদের টেনে সরাইখানার বাইরে বের করে আনে। “তাদের উপরে বল প্রয়োগ করবে না। আমার আদেশ তোমরা জানেনা। অর্থের বিনিময়ে যদি তারা স্বেচ্ছায় তোমাদের সঙ্গ দিতে রাজি হয় তবে সেটা আলাদা কথা।” কথাটা বলে বাবর আবার ঘুরে দাঁড়ায়।
দেখা যায় মেয়েগুলো আদতেই ব্যবসায়ী এবং কয়েক মুহূর্তের দ্রুত আলোচনার পরে, সরাইখানার পেছনের এক আপেল বাগিচায় তারা তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়। বাবর ধারণা করে বাইজি দু’জন সরাইখানার শকুনের মতো দেখতে মালিকের মেয়ে হবে। যে ঝামেলার গন্ধ পাওয়া মাত্র সেই যে টেবিলের তলায় গিয়ে ঢুকেছে তারপরে আর বের হবার কথা চিন্তাও করেনি। আপেল বাগিচায় শীঘ্রই বাবরের লোকদের দল বেঁধে আসা যাওয়া করতে দেখা যায়। বাগান থেকে হাসিমুখে তাদের বের হয়ে আসা দেখে বোঝা যায় মেয়ে দু’জন তাদের বাবার সরাইখানায় আসা। অতিথিদের খেদমত করতে ভালোই অভ্যস্ত।
ওয়াজির খান ইতিমধ্যে চকরাখদের পালিয়ে যাওয়া ঘোড়াগুলো ধরে আনবার বন্দোবস্ত করেছেন এবং বণিকদের কাছ থেকে লুট করা মালপত্রগুলো পর্যবেক্ষণ। করছেন। “সুলতান, দেখেন,” দুটো উজ্জ্বল বর্ণের গালিচা বের করে সে বাবরের। দৃষ্টি সেদিকে আকর্ষণ করে। গালিচা দুটোর জেল্লা দেখে বোঝা যায় তন্তুবায়ের দল। সেটা বুননের সময়ে রেশমের সাথে উলের মিশ্রণ ঘটিয়েছে আর গালিচাগুলোর নকশাও অপরিচিত- বণিকের দলটা সম্ভবত পূর্বের, কাশগর থেকে এসেছিল। যেখানের তাঁতিরা এ ধরণের গালিচা তৈরিতে দক্ষ। উল আর চামড়া বেচে ভালো অর্থই পাওয়া যাবে, বাবর ভাবে, যা দিয়ে তার লোকদের সে বকেয়া বেতন দিতে পারবে।
তার যোদ্ধাদের জন্য একটা ভোজসভার আয়োজন করলে মন্দ হয় না। তারা ভালো। কাজ দেখিয়েছে এবং তারও উচিত এর মূল্যায়ন করা। পশ্চিমে, শাহরুখিয়ায় ফিরে যাওয়া মাত্রই সে এই ভোজসভার ঘোষণা দেবে। সেখানে, ছয়মাস আগে। তামবালের কাছ থেকে সে দূৰ্গটা ছিনিয়ে নিয়েছে এবং নিজের ঘাঁটিতে পরিণত করেছে। সমরকন্দে খুন হবার আগে শাহরুখিয়ার সর্দার আলি মজিদ বেগের পূণ্য স্মৃতির প্রতি তারা তাদের শ্রদ্ধা জানাবে। তারা তার উপযুক্ত সন্তানের আত্মার মাগফেরাত কামনা করবে। যে তামবালের চকরাখ যোদ্ধাদের হাত থেকে দূর্গটা রক্ষা করতে গিয়ে শহীদ হয়েছে। আলি মজিদ বেগের নিহত হবার সংবাদ ফারগানায় পৌঁছানো মাত্র তামবাল দূর্গটা দখল করতে তাদের পাঠিয়েছিলো।
নিজের বিশ্বস্ত সর্দারের কথা মনে পড়তে বাবরের ভাবনা বিষণ্ণ হয়ে উঠে। আজকাল তার প্রায়ই এমন হচ্ছে। সবুজাভ-নীল তোরণদ্বারে আলি মজিদ বেগের মৃতদেহ প্রদর্শিত হবার পরের দু’বছরে সে কি অর্জন করেছে? নিজের পরিবারকে মুক্ত করার ব্যাপারে বা ফারগানা পুনরায় অধিকার করার ব্যাপারে সে কতটা অগ্রসর হয়েছে, সমরকন্দের কথা না হয় সে বাদই দিল? আর কতদিন তাকে সালতানাৎবিহীন একজন সুলতান হিসাবে দিন কাটাতে হবে? আকশি আক্রমণ করে তার পরিবারকে মুক্ত করে সিংহাসন পুনরুদ্ধার করার মতো একটা সেনাবাহিনী গঠন করা একটা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। আর সমরকন্দ, সেখানে শাসক হিসাবে কাটানো কয়েকটা দিন এখন কেবল ধূসর স্মৃতি। মাঝে মাঝে তার বিশ্বাস করতেই কষ্ট হয় যে এমন কিছু আসলেই ঘটেছিলো। গ্রান্ড উজিরের কথাই শেষ পর্যন্ত সত্যি হলো।
ভাবনাটা বাবরকে ক্রুদ্ধ করে তোলে। সে তার পায়ের কাছে পড়ে থাকা একটা কর্তিত মস্তকে লাথি বসিয়ে দিলে সেটা ছিটকে দূরে গিয়ে পড়ে। তার লোকদের যেমন, তারও বিনোদনের দরকার আছে। কয়েকটা ডাল কেটে পোলো খেলার লাঠি তৈরি করো।” সে চিৎকার করে বলে। “এইসব দুবৃত্তদের মাথা দিয়ে পোলো খেলা যাক। গোলপোস্ট হবে ঐ দূরের গাছগুলো।”
পুরো একটা ঘণ্টার জন্য, উদ্দাম খেলায় বাবর নিজেকে ডুবিয়ে রাখে। চকরাখদের ক্ষিপ্রগামী টাটুঘোড়ার একটা নিয়ে সে একেবেঁকে দাবড়ে বেড়ায় এবং শাখাপ্রশাখা ছেটে ফেলা গাছের ডাল দিয়ে ছিন্ন মস্তকগুলোকে সজোরে আঘাত করে। যাতে ঘাসের উপর দিয়ে লাফাতে লাফাতে সেগুলো গড়িয়ে যায়। শীঘ্রই সেগুলোকে আর কাটা মাথা বলে চেনার কোনো উপায় থাকে না- নাক, কান গুঁড়িয়ে যায়, অক্ষিকোটর থেকে অক্ষিগোলক বের হয়ে আসে এবং বাবর আর তার ঘর্মাক্ত সাথী খেলোয়াড়েরা আর সেই সাথে তাদের সবার ঘোড়া, রক্তের ফুটকিতে চিত্রিত হয়ে উঠে।
অবশেষে খেলাটার প্রতি তার বিরক্তি জন্মায় কিন্তু ভেতরের জমে ওঠা হতাশা আর ক্ষোভ নিঃসৃত হওয়ায়, বাবর ঘামে ভিজে ওঠা ঘোড়াটাকে অবশেষে রেহাই দেয়। চারপাশে তাকাতে সে দেখে ওয়াজির খান তার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। এই প্রথম সে তার চোখে বিরক্তি দেখতে পায়। কিন্তু বাবর তাতে বিন্দুমাত্র লজ্জি বোধ করে না। জীবিত বা মৃত, সে তার শত্রুদের সাথে তাদের প্রাপ্য ব্যবহারই করেছে।
“চলো এবার যাওয়া যাক।” সে আদেশ দেয়। “গাভা এখনও অনেক দূরে, আর আমাদের গৃহকর্তাকে অপেক্ষা করিয়ে রাখাটা ঠিক হবে না।” বাবর ঘোড়ার পাঁজরে এত জোরে খোঁচা দেয় যে সেটা ছুটতে শুরু করে। বাবর সরাইখানা থেকে সোজা নদীর অগভীর অংশের দিকে এগিয়ে যায়।একবারও পেছনে ফিরে তাকায় না। আঙ্গিনায় পড়ে থাকা রক্তাক্ত মাথাগুলোকে ইতিমধ্যে কাকের দল ঠোকরাতে শুরু করেছে এবং সরাইখান মেয়ে দুটো পা ঈষৎ ধনুকের মত ফাঁক করে এগিয়ে গিয়ে চকরাখদের লাশগুলো হাতিয়ে দেখে যে বাবরের লোকেরা ভুলে কিছু রেখে। গেছে নাকি, যা তাদের বেশ্যাবৃত্তির পাওনার উপরি বলে বিবেচিত হতে পারে।
***
তিন সপ্তাহ পরে। উঁচু পাহাড়ী এলাকার তৃণভূমির উজ্জ্বল সবুজ ঘাসের মাঝে মাঝে ফুটে থাকা হলুদ গোলাপী আর সাদা ফুলের মাঝ দিয়ে বাবর আর তার লোকেরা দুলকি চালে ঘোড়া দাবড়ে শাহরুখিয়ার দিকে এগিয়ে যায়। গাভার অভিযানে ক্ষয়ক্ষতি হলেও তারাই জয়ী হয়েছে। তিনশ গজ দূরে ঘোড়ার পিঠে বসে থাকা অবস্থায় বাবর নিজে তীর ছুঁড়ে দূর্গের সেনাপতিকে হত্যা করেছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তার নিজের ব্যবহৃত ছোট নিখুঁতভাবে বাঁকানো ধনুক দিয়ে তীর ছোঁড়ার অভ্যাসে কাজ হয়েছে। ত্রিশটা শর ভর্তি তূণীর সে এক মিনিটের ভিতরে খালি করে ফেলতে পারে।
সেনাপতি মারা যাবার পরে, প্রতিরোধকারীদের মনোবল ভেঙে যায়। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সেনানিবাসের সৈন্যরা কেবল আত্মসমর্পনই করেনি, নিজেদের লুটের মাল পুরো তাদের হাতে তুলে দিয়েছে। যা বাবর আর তার লোকদের ঘোড়ার পিঠে ঝোলানো চামড়ার থলির উপচে পড়া আকৃতি সাক্ষ্য দিচ্ছে।
ওয়াজির খান খুব খুশি হবে। এবারের অভিযান বাবরকে তার বুড়ো বন্ধুটির সহায়তা ছাড়াই পরিচালনা করতে হয়েছে। সরাইখানা আক্রমণ করার পরের দিন ওয়াজির খানের ঘোড়া সাপের ভয়ে বেমাক্কা লাফিয়ে উঠতে সে পড়ে গিয়ে উরুতে ব্যথা পেয়েছিলো। বাবরের সনির্বন্ধ অনুরোধে তিনি শাহরুখিয়ায় ফিরে যেতে রাজি হন বাইসানগারের সাথে যোগ দিতে, যাকে তারা সেখানের নিরাপত্তার দায়িত্ব দিয়ে এসেছে।
আজ রাতে তারা বিজয় উদযাপন করবে। সে তার লোকদের সম্মান জানাতে তাদের মাঝে উলুশ বিতরণ করবে। যোদ্ধাদের ভিতরে যারা সবচেয়ে সাহসিকতা আর বীরত্ব প্রদর্শন করেছে প্রথা অনুযায়ী আজ সে ভোজসভার শেষে তাদের মাঝে লুটের মালের সিংহভাগ বিলিয়ে দেবে এবং বাইসানগার আর ওয়াজির খানকে গাভা আক্রমণের কাহিনী শোনাবে। তার গল্প শুনে ওয়াজির খান সম্ভবত হেসে অস্থির হবেন এবং সদা গম্ভীর বাইসানগারের মুখেও সে আজ হয়তো হাসির আভাস দেখতে পাবে।
পাথরের তৈরি দূর্গের অভ্যন্তরস্থ প্রাঙ্গনে প্রবেশের সাথে সাথে, বাবর তার ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফিয়ে নেমে তাদের খোঁজে আশেপাশে তাকায়। বাইসানগারকে সে কোথাও খুঁজে পায় না। কিন্তু ওয়াজির খানকে আস্তাবলের সামনে দাঁড়িয়ে ঘোড়ার খুরের উপরের আর পেছনের অংশের কেশগুচ্ছ পর্যবেক্ষণ করতে দেখে। তার বুড়ো বান্ধবকে সামান্য খোঁড়াতে খোঁড়াতে তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখলে: বাবর ভ্রূ কোঁচকায়। তারপরে সে তাকিয়ে দেখে ওয়াজির খানের মুখ আনন্দে আলোকিত হয়ে রয়েছে।
“সুলতান, দারুণ সুখবর আছে! সত্যিই চমকে দেবার মত সুখবর!”
“কি হয়েছে?”
“এক সপ্তাহ আগে আকশি থেকে এক বার্তাবাহক এসেছে। আপনার সৎ-ভাই জাহাঙ্গীরের পক্ষে তামবালের বাণী নিয়ে সে এসেছে। অন্তত বার্তাবাহকের তাই ভাষ্য এবং সে বলেছে তারা আপনার আম্মিজান, নানীজান আর আপনার বোনকে আপনার কাছে পাঠাতে সম্মত আছেন।”
“সে কি এর বিনিময়ে কিছু দাবি করেছে?”
“সুলতান, প্রকাশ্যে তারা কিছু দাবি করেনি। আপনাকে সে কতোটা শ্রদ্ধা করে কেবল সে সম্পর্কে কিছু মধুর বাক্য ছাড়া।”
বাবরের হৃৎপিণ্ড আনন্দে নেচে উঠে। তার পরিবার শীঘ্রই তার সাথে মিলিত হবে। এই খবরটা আবার তাকে আবেগতাড়িত করে তোলে।
“তারা এখানে কবে নাগাদ পৌঁছাবে?”
“সবকিছু ঠিক থাকলে আগামীকাল সূর্যাস্ত নাগাদ তাদের এখানে পৌঁছাবার কথা।”
পরের দিন সন্ধ্যাবেলা, গোধূলির অস্তমিত আলোয় বাবরকে দূর্গের প্রকারবেষ্টিত সমতল ছাদে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। আজকের দিনের অধিকাংশ সময় সে এখানেই কাটিয়েছে। অস্থিরচিত্তে রাস্তাটা যেখানে একটা গিরিখাদের দিকে বাঁক নিয়েছে, সেদিকে চোখ কুঁচকে তাকিয়ে রয়েছে। ঘনায়মান আধো-অন্ধকারের ভিতর থেকে সে পিঠের দুপাশে ঝুড়ি ঝুলছে উটের এমন একটা তরঙ্গায়িত সারিকে বাঁক ঘুরে এগিয়ে আসতে দেখে। তাদের ঠিক পেছনেই রয়েছে যাত্রার শেষ পর্যায়ে মেয়েদের অভ্যর্থনা জানাতে। আর তাদের নিরাপদে দূর্গে নিয়ে আসবার জন্য, ওয়াজির খানের পরামর্শে, বাইসানগারের অধীনে পাঠানো সৈন্যবাহিনীর একটা চৌকষ দল।
বাবর এতদূর থেকে ঝুড়িতে ভ্রমণকারীদের চেহারা দেখতে পায় না। নিজেকে আর সামলে রাখতে না পেরে, এবং দেহরক্ষীদের কাউকে ডাকবার বা ঘোড়ার পিঠে জিন চাপাবার মতো ধৈর্যের মারাত্মক অভাব দেখা দেয়ায়, সে লাফিয়ে একটা খালি ঘোড়ার পিঠে চেপে বসে এবং সবুজ ঘাসে আচ্ছাদিত তৃণভূমির উপর দিয়ে ছোট কাফেলাটার দিকে ছুটে যায়।
তার রোদে পোড়া গাল বেয়ে দরদর করে কান্না ঝরতে থাকে। কিন্তু সেসব সে মোটেই পরোয়া করে না। আশেপাশে কেউ নেই তার কান্না দেখবার মতো এবং তার চেয়েও বড় কথা, দেখলে দেখুক সে থোড়াই পরোয়া করে। দুর্বলতার না, আজ এটা আনন্দের অশ্রু। এক হাতে ঘোড়ার কেশর আঁকড়ে ধরে সে অন্য হাতে গাল থেকে কান্না মুছে। বাবর ঘোড়াটার কানে কানে তাকে এমন গতিতে ছুটতে বলে, যাতে মনে হয় হঠাৎ তার পাখা গজিয়েছে।
কাফেলাটাকে পাহারা দিয়ে নিয়ে আনা সৈন্যদের থেকে চারজন সহসা আলাদা হয়ে বর্শা নিচু করে তার দিকে এগিয়ে আসে। যদিও বাইসানগার সম্ভবত ধারণা করতে পেরেছিলো খালি ঘোড়ার পিঠে এমন উদ্দাম ভঙ্গিতে কে তাদের দিকে ছুটে আসছে। কিন্তু তার মত অভিজ্ঞ পোড়খাওয়া যোদ্ধা তার কাছে এটাই প্রত্যাশিত যে সে নিজের লোকদের আদেশ দিয়েছে তার পরিচয় নিশ্চিত করতে। অশ্বারোহী দল নিকটবর্তী হতে, বাবর জোর করে নিজের ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে তাকে থমকে দাঁড়িয়ে পড়তে বাধ্য করে। ঘামে জবজব করতে থাকা দেহে নাক ঝেড়ে নিজের বিরক্তি প্রকাশ করে ঘোড়াটা।
বাবর মাথাটা পেছনে হেলিয়ে দিয়ে তার পূর্বপুরুষের রণহুঙ্কার কণ্ঠে তুলে নেয়। “ফারগানা!”
অশ্বারোহী দল এখন আরো কাছে চলে আসায় তারা তাকে চিনতে পেরে অভিবাদন জানায়। বাবর কোনোমতে তাদের অভিবাদনের জবাব দিয়ে উটের কাফেলা যেখানে যাত্রা বিরতি করেছে সেদিকে ঘোড়া ছোটায়। তার হৃদয় যদি আবেগে ভারাক্রান্ত না থাকত অন্যসময় হলে তাহলে সে হয়তো বাজারে নিয়ে যাওয়া মুরগীর মতো ভীরু ভঙ্গিতে বেতের ঝুড়ির ভিতর থেকে এসান দৌলতের উঁকি দেবার হাস্যকর ভঙ্গি দেখে হয়তো হেসেই ফেলতো। তার ওজন এতোটাই হাল্কা যে অন্যপাশের ঝুড়িতে ভারসাম্য রক্ষার জন্য বাঁধাকপির চেয়ে ভারী কিছু রাখতে হয়নি। আর তার বীণা ঝুড়ির বাইরে চামড়ার ফালি দিয়ে আটকানো রয়েছে। একটা বিশাল পুরু লোমের দুধসাদা রঙের উট যা বাবরকে এগোতে দেখে পচাৎ করে থুতু ফেলে সেটার দু’পাশে দুটো ঝুড়িতে খুতলাঘ নিগার আর খানজাদা আরোহন করেছেন। উটের পেছনে বাবর তার আম্মিজানের পরিচারিকা দলের কয়েকজন পরিচিত সদস্য, যাদের ভিতরে ফাতিমাও রয়েছে আর তার উজির কাশিমকে দেখতে পায়।
উটের চালকরা লাফিয়ে নেমে, উটের গ্রন্থিযুক্ত হাঁটুতে তাদের হাতের লাঠি দিয়ে আঘাত করে উটগুলোকে বাধ্য করে মাটিতে বসতে। বয়োবৃদ্ধ হবার কারণে, বাবর দৌড়ে প্রথমে এসান দৌলতের কাছে যায় এবং হাঁটু মুড়ে বসে তাকে আলতো করে ঝুড়ি থেকে তুলে আনে। বাবর কোনো কথা খুঁজে পায় না, আর এই প্রথমবারেরমতো মুখরা এসান দৌলতও বাক্যহারা হয়ে পড়েন। সে টের পায় নানীজান তার মাথা আলতো স্পর্শ করেন। সে উঠে দাঁড়িয়ে তার ছোট ছোট উজ্জ্বল চোখের দিকে তাকালে সেখানে তার পুরানো সত্ত্বার ঝলক দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। নানীজানকে এখন তিনি বরাবর যার জন্য গর্ব করেন,সেই খামের- চেঙ্গিস খানের রক্তের উত্তরসুরী এক নারীর মতোই দেখাচ্ছে।
সে এবার ঘুরে দাঁড়িয়ে তার আম্মিজানকে ঝুড়ি থেকে তুলে মাটিতে নামিয়ে দেয় এবং তাকে জড়িয়ে ধরে তার আশৈশব পরিচিত চন্দনকাঠের উষ্ণ সুগন্ধে বুক ভরে শ্বাস নেয়। সে তার আলিঙ্গন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে তাকিয়ে দেখে আম্মিজানের চোখে অশ্রু টলটল করছে। “বাছা তোমাকে আবার দেখতে পেয়ে খুশি হলাম,” কোনো রকমের আবেগ না দেখিয়ে তিনি বলেন, এবং তার মুখে একটা হাসির আভাস ফুটে উঠে যা বাবরের যেমনটা মনে আছে তার চেয়েও ম্লান এবং বলিরেখায় আকীর্ণ।
খানজাদা ইতিমধ্যে তাকে বহনকারী ঝুড়ি থেকে নিজেই ধড়ফড় করে নেমে এসেছে। এবং সে সোজা ভাইকে লক্ষ্য করে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তার পোষা বেজী যেটা সে বামহাতে ধরে রেখেছে, কুইকুই করে প্রতিবাদ জানায়। শেষবার বাবর তার বোনকে দেখেছিলো হাড্ডিসার একটা মেয়ে, যার মুখে কয়েকটা দাগ রয়েছে। খানজাদা এখন রীতিমত একজন মহিলাতে পরিণত হয়েছে, তার দেহে ভরা নদীর জোয়ার বইছে। মুখ আগের চেয়ে অনেক দাগহীন আর সুন্দর। কিন্তু ফিচেল হাসি আগের মতোই আছে দেখে সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। সে তাকে জড়িয়ে ধরে এবং তারপরে ছেড়ে দিয়ে এক পা পিছিয়ে আসে ভালো করে তাকে দেখবে বলে।
খানজাদাও কম যায় না সেও ভাইকে জরিপ করে। “তুমি লম্বা হয়েছে।” সে বলে, “আর তোমার কাঁধ আগের চেয়ে চওড়া হয়েছে। কিন্তু একি চেহারা হয়েছে। তোমার থুতনিতে ছাগলের মত দাড়ি আর চুলের অবস্থা যাচ্ছেতাই- তোমার চুল দেখছি আমার মত লম্বা! আর নখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না- কালো হয়ে আছে।”
বাবর পেছন থেকে, খানজাদার নাক কোঁচকানো বিশেষণগুলোর সমর্থনে এসান দৌলতকে জিহ্বা আর টাকরার সাহায্যে একটা শব্দ করতে শোনে এবং সে হেসে ফেলে। অবশেষে তার প্রিয়জনেরা তার কাছে এসেছে এবং সবকিছু যেমনটা থাকার কথা তেমনই রয়েছে। তাদের সাথে সে পরে কথা বলবে এবং শুনবে বিগত দিনগুলো তাদের কেমন কেটেছে। কিন্তু এখনকার মতো এই যথেষ্ট।
তারা দূর্গের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। অবশেষে মুক্তি লাভ করা ফারগানার শাহী রমণীদের অভ্যর্থনা জানাতে তূর্যনিনাদ আর রণভেরী গমগম আওয়াজে বেজে উঠে- অন্তত এখনকার জন্য হলেও তারা নিরাপদ।
দূর্গের উপরের তলায় প্রস্তুত রাখা জেনানামহলে মেয়েদের পৌঁছে দিয়ে, বাবর তার বঁধুনিকে ডেকে পাঠায়। তার পরিকল্পিত ভোজসভার সব আয়োজন কি অবস্থায় আছে তা জানতে। এখানের ভোজসভা সমরকন্দের মতো জাঁকজমকপূর্ণ হবে না। যেভাবে সে তাদের অভ্যর্থনা জানাতে চেয়েছিলো। অবশ্য, তাহলেও বিশটা ভেড়া জবাই করা হয়েছে আর আঙ্গিনায় সেগুলোকে আগুনে ঝলসানো হচ্ছে। মুরগীর পালক ছাড়িয়ে, আখরোট আর খুবানির সাথে মাখন দিয়ে সিদ্ধ করা হচ্ছে। আস্ত আপেল ঘন সোনালী বর্ণের মধু আর লাল রসে ভরা ডালিমের দানার সাথে কাঠবাদাম আর পেস্তার মিশ্রণে চিকচিক করছে। তাদের কোনো এক অভিযানে তার লোকদের লুট করা রূপালি বর্ণের কাঠবাদামের স্তূপের দিকে সে বিশেষ সন্তুষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে। এসান দৌলত অন্য যে কোনো মিষ্টির চেয়ে এগুলো বেশি পছন্দ করেন।
নির্মেঘ, তারা-শোভিত আকাশে চাঁদ উঠলে, এবং কোনো আকষ্মিক হামলা থেকে আগেই সাবধান করতে দূর্গপ্রাকারে সৈন্য মোতায়েন করে ভোজসভা শুরু হয়। বাবর আর তার লোকেরা নিচুলার একটা নিচু, লম্বা কামরায় আহার সারে। যখন উপরে নিজেদের কামরায় মেয়েদের তাদের পছন্দের অংশ পরিবেশন করা হয়। মোমবাতির কাঁপা আলোতে বাবরের লোকেরা উদাত্ত কণ্ঠে গান শুরু করে। বাকীরা যে নিচু কাঠের টেবিলের চারপাশে আসনসিঁড়ি হয়ে বসে আছে তাতে চাকুর বাট দিয়ে আঘাত করে তাল দেয়। বাবর ভাবে, তার লোকেরা খুশি হয়েছে। মেয়েদের মুক্তিতে তারাও প্রীত হয়েছে। তার সাথে সাথে তার লোকদেরও এটা সম্মানহানির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো- যেনো মেয়েদের মুক্ত করার সামর্থ্য তাদের নেই।
বাবর খেতে চেষ্টা করে কিন্তু কিছুই খেতে পারে না। তার ইচ্ছা করে এখান থেকে উঠে যায় এবং তার আম্মিজান, খানজাদা আর এসান দৌলতের সাথে নিভৃতে সময় কাটায়। কিন্তু তার অনুসারীদের প্রতি সৌজন্যতাবশত তাকে আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। গানের মাত্রা ধীরে ধীরে চড়তে শুরু করে এবং ক্রমশ কর্কশ হয়ে উঠে। যোদ্ধার দল উচ্চকণ্ঠে নিজেদের পূর্বপুরুষের বীরত্বের কথা বয়ান করতে থাকে এবং বাবরও এবার তাদের সাথে কণ্ঠ মেলায়। কিন্তু অবশেষে, কেউ কেউ টেবিলের উপরে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ে। আর অন্যেরা ঝাপসা চোখে টলোমলো পায়ে কামরা থেকে বের হয়ে বাইরের আঙ্গিনায় নিজেদের হাল্কা করতে শুরু করলে, বাবর তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পাথরের বাঁকানো সিঁড়ি বেয়ে জেনানামহলের দিকে রওয়ানা দেয়।
খুতলাঘ নিগার দু’হাত বাড়িয়ে দিয়ে তাকে স্বাগত জানায় এবং সে ভিতরে প্রবেশ করে গালিচা পাতা মেঝেতে তার পাশে এসে বসে। তাদের সামনের পিতলের থালায় পড়ে থাকা খাবারের অবশিষ্টাংশ দেখে সে বুঝতে পারে মেয়েরা ভালমতোই খেয়েছে। কিন্তু তারপরেও সে এখন যখন তাদের মুখের দিকে তাকায় সেখানে সে একটা টানটান অভিব্যক্তি লক্ষ্য করে। তাদের তিনজনকেই ফ্যাকাশে আর বিবর্ণ দেখায়। যেনো বহুকাল সূর্যের আলোর উষ্ণতা অনুভব করেনি বা তাজা বাতাসে তারা শ্বাস নেয়নি। কাউকে না কাউকে অবশ্যই এর মূল্য দিতে হবে- রক্ত দিয়ে। কিন্তু মেয়েদের খাতিরে আপাতত সে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করে না। তারা যাই বলুক তাকে, সে অবশ্যই সব কিছু শান্ত ভঙ্গিতে শুনবে।
কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ বসে থাকে। প্রাথমিক উত্তেজনা প্রশমিত হতে, কেউই বুঝতে পারে না কোথা থেকে শুরু করা উচিত।
অবশেষে এসান দৌলত শুরু করেন: “বাবর তুমি তাহলে সরমকল দখল করেছিলে।” তার বিচক্ষণ মুখে বিরল একটা হাসির আভাস ফুটে উঠে।
“অধিকার করেছিলাম বটে, কিন্তু দখলে রাখতে পারিনি।” বাবর তার মাথা নিচু করে। এমন কিছু কথা আছে যা তাকে বলতেই হবে। “নানীজান, আমি আপনাকে হতাশ করেছি। আপনি আমার সাহায্য চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছিলেন এবং আমি সাহায্য করতে ব্যর্থ হয়েছি। আমার আসতে বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছিল আর লোকজন ছিল অনেক অল্প।”
“আমাদের তুমি মোটেই হতাশ করনি। আর জেনে রেখো, আমাদের কারণেই তুমি সমরকন্দ হারিয়েছে। আমাদের সাহায্য করার জন্য তুমি সাথে সাথে যাত্রা করেছিলে। তুমি এরচেয়ে বেশি আর কিইবা করতে পারতে?”
বাবর আক্ষেপের সাথে মাথা নাড়ে। “ফারগানা আর আপনারা ছিলেন আমার প্রধান দায়িত্ব। সমরকন্দে আমি নতুন কোনো খেলনা হাতে পাওয়া শিশুর মতো আচরণ করেছিলাম। আমার তখন অন্য কিছু সম্বন্ধে ভাববার সামান্যই অবকাশ ছিলো। আপনাদের আর ফারগানার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আমার উচিত ছিলো ওয়াজির খানকে পাঠিয়ে দেয়া।” সে তার মায়ের গায়ে হেলান দেয় এবং বরাবরের মতোই মায়ের আঙ্গুল তার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে টের পায়। এতে সে কিছুটা শান্ত হয়।
“কিছু কিছু বিষয় তামবাল আমাদের কাছে কখনও গোপন করেনি।” খুতলাঘ নিগার বলেন। “আমার মনে হয় এতে সে আনন্দই পেতো। আমরা, তোমার চাচাতো ভাই মাহমুদের বিশ্বাসঘাতকতার কথা অবশ্যই জানি- আমরা জানি সেই সমরকন্দ তোমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে। বাছা, সে আর তামবাল মিলে তোমার জন্য একটা ফাঁদ পেতেছিলো। তারা দু’জনে মিলে ঠিক করেছিলো, ফারগানায় সে তোমাকে মসনদ থেকে সরিয়ে দিয়ে জাহাঙ্গীরকে তোমার স্থলাভিষিক্ত করবে। তারা জানতো এর ফলে তুমি বাধ্য হবে- তোমার বেশিরভাগ সৈন্য নিয়ে ফারগানায় ফিরে আসতে। আর মাহমুদ এর ফলে তার কাঙ্ক্ষিত সুযোগ পায়। তুমি তখন সদ্য সমরকন্দের সুলতান হয়েছে। তারা বলেছে যে সেখানকার অভিজাত ব্যক্তিরা তোমার প্রতি তেমন একটা আনুগত্য বোধ না করায়, মাহমুদ আর তার কলহপ্রিয় স্ত্রী, গ্রান্ড উজিরের কন্যা সহজেই ঘুষ দিয়ে তাদের কিনতে পেরেছে।”
নিজের সবচেয়ে জঘন্য সন্দেহটা প্রমাণিত হতে বাবর চোখ বন্ধ করে ফেলে। কি আহাম্মকই না সে ছিলো।
“তোমার এটাও জেনে রাখা উচিত, মাহমুদের স্ত্রীর কারণে সে গো ধরায় আলি মজিদ বেগকে হত্যা করা হয়েছিলো।” এসান দৌলতের কণ্ঠস্বর তিক্ত শোনায়। নিহত গোত্রপতির মা ছিলো তার বান্ধবী আর তিনি নিজেও তাকে পছন্দই করতেন। “সে নাকি বলেছে তোমার শিরোচ্ছেদ করতে না পারায়, তাকে শিরোচ্ছেদ করলেই আপাতত চলবে- তার বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ হিসাবে। মাহমুদ তার কথা ফেলতে পারেনি। সবাই বলে সেই আসলে সমরকন্দের নতুন শাসক। নিজের বাবার চেয়েও সে বেশি লোভী আর প্রতিহিংসাপরায়ণ।”
বাবর বিস্ময়ে চোখ পিটপিট করে। সে ভাবতেও পারেনি সেই সুঠামদেহী তরুণী, যে এমন সাহসিকতার সাথে গ্রান্ড উজিরের প্রাণ ভিক্ষা চেয়েছিলো কিভাবে এতো অনুভূতিহীন নিষ্ঠুর আর নির্মম হতে পারে। একদিন তাকে অবশ্যই তার এই স্পর্ধার জন্য জবাবদিহি করতে হবে। কিন্তু সেটা পরেও হতে পারে। তার আগে তাকে অন্য অনেক বিষয় জানতে হবে এবং সেগুলো মেনে নিতে হবে।
সে আলতো করে দু’হাতের মাঝে মায়ের হাত জড়িয়ে ধরে। “আমাকে তোমাদের কথা বলল। তোমরা বন্দি থাকা অবস্থায় কেমন আচরণ করছে তারা তোমাদের সাথে?”
“কয়েকজন মাত্র পরিচারকসহ আমাদের একটা ছোট জায়গায় আটকে রাখা হয়েছিলো কিন্তু আমাদের বংশ গৌরব আর মর্যাদার কারণে তারা বাধ্য হয়েছিলো আমাদের যথাযথ সম্মান দেখাতে। তামবাল আমাদের অপমান বা হুমকি দেয়নি।” তার মা বলে, “আর সম্প্রতি- সম্ভবত তোমার সাফল্যের কথা যখন সে জানতে পারে- আমাদের বড় একটা মহলে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো।”
“আর সে রোক্সানাকে আমাদের গহনা কেড়ে নিতে দেয়নি। অবশ্য অন্যদের মুখে শুনেছি সে ক্রুদ্ধ হয়ে চেঁচামেচি করেছে, যদিও সে তামবালের অঙ্কশায়িনী ছিলো।” এসান দৌলত কুপিত কণ্ঠে কথাগুলো বলেন।
“আর আমার সৎ-ভাই জাহাঙ্গীর? এসবে তার ভূমিকা কতটুকু?” বাবর প্রায়ই তার স্থান দখল করে নেয়া বালকটার কথা ভাবে যাকে সে কখনও দেখেনি। শেষবার আকশি থেকে আসবার সময়ে, সমরকন্দ অবরোধের প্রস্তুতি নেবার সময়ে, ছোঁড়া অসুস্থ ছিলো।
“বেচারা পরিস্থিতির শিকার, আর প্রায়ই অসুস্থ থাকে। তামবালের পুরো শরীরে কয়েক চামচ পরিমাণ রাজরক্ত থাকায় সে কখনও নিজে সিংহাসন দাবি করতে পারবে না। অন্য গোত্রপতিরা সেটা তাকে করতেও দেবে না। কিন্তু জাহাঙ্গীরের রাজপ্রতিভূ হিসাবে যে ক্ষমতার জন্য সে লালায়িত সেটা অর্জন করতে পারবে।” এসান দৌলত ভাবাবেগশূন্য কণ্ঠে কথাগুলো বলেন। “সে এখন তোমাকে ভয় পায়। সে যদি তোমাকে খুশি করতে না চাইতো, তাহলে আমাদের এতো সহজে মুক্তি দিতো না?”
সুলতান হিসাবে বাবর নিজের প্রথম দিনগুলোর কথা ভাবে, তার মনে পড়ে তামবাল তখন কিভাবে অন্য নেতাদের মনে সন্দেহের বীজ বপনের চেষ্টা করেছে। সব সময়ে সে নিজের উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিবৃত্ত করার চেষ্টারত ছিলো। কী সাংঘাতিক সুবিধাবাদি এক লোক- কামবার আলীর ষড়যন্ত্রে যোগ দেবার ব্যাপারে ভীষণ বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে সঠিক সময়ের জন্য ধৈর্যসহকারে অপেক্ষা করেছে। এজন্যই কি সমরকন্দ দুবার অবরোধ করতে সে তাকে প্ররোচিত করেছিলো? বাইসানগার যখন তৈমূরের অঙ্গুরীয় নিয়ে এসেছিল তখন আগ্রহে চকচক করতে থাকা তামবালের চেহারা তার এখনও মনে আছে। তার আরো মনে আছে, সমরকন্দ অধিকার করার পরে কি রকম তাড়াহুড়ো করে সে ফারগানা ফিরে এসেছিলো।
“আমাদের জন্য সবচেয়ে কঠিন সময় ছিলো প্রথম কয়েক মাস, যখন আমরা জানতাম না তোমার ভাগ্যে কি ঘটেছে। ফাতিমা- তুমি জান সে কেমন গপ্পোবাজ সে একবার একটা কথা শুনে আসে- একটা গুজব কিন্তু সেটাই আমাদের আতঙ্কিত করে তোলার জন্য যথেষ্ট ছিলো- যে তুমি ফারগানায় ফিরে আসার সময়ে পথে অসুস্থ হয়ে মারা গিয়েছে। তার মায়ের কণ্ঠস্বর কেঁপে যায়। কিন্তু তারপরেই আমরা শুনতে পাই যে তুমি সুস্থ আছো, আর পাহাড়ে আত্মগোপন করে রয়েছে। আমরা জানতাম না কোনটা সত্য