এই যে, মই নামিয়ে রবিনের উদ্দেশে বললেন, এটা দিয়ে উঠে এসো, বাছা!
মই বেয়ে হাঁচড়েপাঁচড়ে উঠে এল রবিন। ও পুরোটা উঠতে পারার আগেই কিশোর, ডুগি আর আমি মিলে টেনে তুললাম ওকে।
জলদি করো! হাতে সময় নেই! দরজাগুলো বন্ধ হয়ে যাবে! তাগাদা দিয়ে বললাম।
কী বললে? রবিন কিছুই বুঝতে পারছে না।
চলে এসো! বললাম।
তাড়াহুড়ো করতে হবে, তারপরও পৌঁছতে পারব কিনা জানি না। দরজাগুলো খুঁজে পাওয়া কঠিন। নতুন দরজা প্রতিনিয়ত খুলছে আর পুরানোগুলো বুজে যাচ্ছে। বাবা-মার জন্য ভয় পাচ্ছি। তারা হয়তো কাল সকালে ঘুম থেকে উঠে নিজেদেরকে আবিষ্কার করবে সপ্তদশ শতাব্দীতে।
মিস্টার ম্যাকয়, সবচেয়ে কাছের দরজাটা কোথায়? আমরা রেডি! চেঁচিয়ে বললাম।
পরমুহূর্তে আমার পাশে উদয় হলেন তিনি।
এদিকে, ইঙ্গিত করে অনুসরণ করতে বললেন। গোরস্থানের মাঝামাঝি পৌঁছে হাত উপরে-নীচে নাড়তে লাগলেন। আমার ধারণা এটা তোমার বেডরুম।
রবিন আতঙ্কিত।
যদি না হয়? বলল। মি. ম্যাকয়কে অনুসরণ করতে রাজি নয় ও।
আমাদের এখন যেতে হবে, তাড়া দিলাম। জলদি করো!
হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে মি. ম্যাকয়, আমরা অনুগমন করব বলে অপেক্ষা করছেন।
এসো, হাতে সময় কম, বললেন তিনি।
রবিন দ্বিধা না করলে এতক্ষণে বাড়ি পৌঁছে যেতাম আমরা। ওকে অনুরোধ-উপরোধ করছি, কিন্তু বান্দা নড়বে না। বিরাট ভুল। দু সেকেণ্ডের মধ্যে ঠাণ্ডা বাতাস আর পচা দুর্গন্ধ অনুভব করলাম আমরা।
ওই দেখো, ওরা আমাদের দিকেই আসছে, চেঁচিয়ে উঠল ডুগি।
লাথি মেরে কবরস্থানের মাটি ছিটিয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে।
দুর্গন্ধময় প্রেতাত্মারা। আমরা সরে যাওয়ার আগেই আমাদের গায়ের উপর এসে পড়ল। আমাদেরকে ফেলে দিল মাটিতে। চারদিক অন্ধকার। দুর্গন্ধে প্রাণ ওষ্ঠাগত।
হাঁচড়েপাঁচড়ে উঠে দাঁড়িয়ে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলাম। আমি এখন বলতে গেলে অদৃশ্য। এতটাই স্বচ্ছ, মিলিয়ে গেছি প্রায়!
আর দেরি কোরো না। এখানে থাকলে আমরাও ভূত হয়ে যাব! চিৎকার ছাড়লাম বন্ধুদের উদ্দেশে।
ডুগির হাত আর রবিনের বাহু চেপে ধরলাম। ওদেরকে যে ধরেছি টেরই পেলাম না প্রায়। ওরাও অদৃশ্য মত হয়ে গেছে। কিন্তু কিশোর কোথায়? হঠাৎ ওর চাপা গোঙানি কানে এল।
বাঁচাও! ভূতগুলো আমাকে ধরে ফেলেছে! নড়তে পারছি না আমি!
এগারো
আমরা আর বাড়ি ফিরে যেতে পারব না, হাহাকার করে উঠল রবিন। ডুগি নিপ। ঘটনার আকস্মিকতায় স্তব্ধ।
তোমরা এখান থেকে নোডড়া না, ওদেরকে বললাম। কিশোরকে উদ্ধার করতে হবে। ওকে আমিই টেনে এনেছি এসবের মধ্যে।
প্রেতাত্মাদের হাত থেকে ওকে বাঁচাব কীভাবে জানি না, কিন্তু যা করার দ্রুত করতে হবে এটা জানি। দরজার কাছে মি. ম্যাকয় আর কতক্ষণ অপেক্ষা করবেন?
রবিন বেয়ে উঠেছিল সেই মইটা আঁকড়ে ধরলাম। ভূতের দল মেঘের মত ভেসে চলে যাচ্ছে। কিশোর ওদের আলখিল্লা কিংবা অন্য কোন কিছুর আড়াল থেকে সাহায্যের জন্য চেঁচাচ্ছে। ওর গলা পাচ্ছি, কিন্তু দেখতে পাচ্ছি না।
মইটা হিঁচড়ে ওদের পিছনে দৌড়ে গেলাম। নাগাল পেয়ে মইটা তুলে প্রেতেদের উপর নামিয়ে আনলাম। জিনিসটা ভারী হলেও আমি সর্বশক্তিতে আঘাত করেছি।
ভূতের দলকে ভেদ করে চলে গেল মইটা। ওরা যেন দুর্গন্ধময় মাকড়সার ঝুলের কালো এক মেঘ। কিন্তু এতে কাজ হলো! বিচ্ছিন্ন কুয়াশার মত ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ল ওরা। মইটা আবারও তুলে ধরলাম। আবারও কুয়াশার মত ছড়িয়ে গেল ভূতগুলো। এবার মাটিতে বসে থাকতে দেখলাম কিশোরকে। দুহাত দিয়ে মাথা ঢেকে রেখেছে। প্রকাণ্ড এক বুদ্বুদের মতন স্বচ্ছ দেখাচ্ছে ওকে। ভূতগুলো কোথায় হারিয়ে গেছে দেখার জন্য দাঁড়ালাম না।
দৌড়ে গেলাম ওর কাছে।
উঠে পড়ো! তুমি এখন ফ্রী! এসো! বাহু ধরে একটানে দাঁড় করিয়ে দিলাম। ওজনহীন মনে হলো ওকে।
এবার রবিন আর ডুগির কাছে দৌড়ে গেলাম।
জলদি করো! মি. ম্যাকয়ের ডাক কানে এল। কোন ভূতকে দেখে আগে কখনও এতটা স্বস্তি পাইনি। পরস্পরকে চেপে ধরে যথাসম্ভব দ্রুত টলতে টলতে তাঁর কাছে পৌঁছলাম।
এটাই কি দরজা? প্রশ্ন করলাম।
ঢুকে পড়ো, বাছা। দেরি কোরো না। ঢুকে পড়ো! ঢুকলেই বুঝতে পারবে কোথায় রয়েছে।
জন!
খাইছে! কণ্ঠটা চিনতে পারলাম। ঘুরে দাঁড়ালাম ধীরে ধীরে।
মিশেল! ভুলেই গিয়েছিলাম ওর কথা! মিশেল, ওর হেডস্টোন আর আমার ভূতশিকারি মা ছিল বলেই এই ভূতের রাজ্যে আটকা পড়েছি আমরা।
লম্বা ড্রেস পরে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে মেয়েটি, মুখের চেহারা বিষণ্ণ।
জন! আমাকে ছেড়ে যেয়ো না! প্লিজ! কেঁদে উঠল। ওর চোখজোড়া ছায়াময়, গভীর আর অতলস্পর্শী। ওর এখনও ধারণা আমি জন-ওর ভাই। ভাবনাটা ঘাবড়ে দিল আমাকে। ও ছোট হলে কী হবে ওকেও ভয় পাই আমি।
মিস্টার ম্যাকয়! অনুনয় করলাম। ওকে নিয়ে কী করব? আমি এখানে ওর সাথে থাকতে পারব না, আবার সাথে করে নিয়েও যেতে পারব না!
তুমি তোমার মত চলে যাও, মৃদু কণ্ঠে বললেন তিনি। আমরা মিশেলকে বাড়ি পৌঁছে দেব। তোমার মার কাজের ফলে মিশেলের মাকে খুঁজে বের করা গেছে। এখন এসো! হয়।
অদৃশ্য ফোকরের ভেতরে অলিম্পিক সাঁতারুদের মত করে ডাইভ দিলাম আমরা। জীবন-মৃত্যুর মধ্যে দৌড় প্রতিযোগিতা হচ্ছে আমাদের। এমনকী রবিনও এবার আর ইতস্তত করল না।