অদ্ভুত জায়গা, চারধারে চেয়ে মন্তব্য করল কিশোর।
ভয় পাচ্ছ?
না, তুমি তো ঠিকমতই ফিরে গিয়েছিলে।
হ্যাঁ, এসো ওদেরকে খুঁজে নিয়ে এখান থেকে জলদি সটকে পড়ি।
ফ্ল্যাশলাইট চেপে ধরলাম আমরা। আমার শার্ট ধরে থাকল কিশোর, আমরা যাতে আঁধারে আলাদা হয়ে না যাই।
কিশোর, মুসা! রবিনের গলা।
নোড়ো না! আমরা এখুনি আসছি, অভয় দিয়ে বললাম।
সামনেটা হাতড়াচ্ছি, সামনে-পিছনে ফ্ল্যাশলাইট বুলাচ্ছি। ঠিকমত দৃষ্টি চলছে না।
কিশোর, মুসা! আমাদের বাঁচাও। আমরা- ফের রবিনের কণ্ঠ।
বাঁচাও, মুসা! আমি হারিয়ে যাচ্ছি! ককিয়ে উঠল ডুগি। রবিন! রবিন!
তোমরা একসাথে আছ? চেঁচালাম আমি।
ছিলাম, কিন্তু রবিন একটা গর্তে পড়ে গেছে! হায়, খোদা, ওটা একটা কবর! খোলা এক কবরে আটকা পড়েছে ও! চেঁচাল ডুগি। কী বিপদেই না পড়া গেছে। কি আরেকটু সামনে বেড়ে হাতড়াতে লাগলাম অন্ধের মতন। ফ্ল্যাশলাইটের আলো ক্রমেই ঝাপসা হয়ে আসছে। ভোলা কোন কবরে পড়ে গেলে মহাবিপদ হয়ে যাবে! আমি এখনই কবরে যেতে চাই না।
শেষমেশ ধাক্কা খেলাম ডুগির সঙ্গে।
মুসা! থ্যাঙ্ক গড! এটা কোন্ জায়গা? কুঁপিয়ে উঠল ও।
এটা ওপারের ভুবন, ডুগি, বললাম।
কিন্তু তারমানে এরা সব ভূত! আর আমরাও ভূত হয়ে যাচ্ছি। বাপ রে, আমি বাড়ি যাব!
সাহস হারিয়ো না। একটা ওপেনিং খুঁজে পেলেই ফিরে যেতে পারব আমরা। রবিনকেও উদ্ধার করতে হবে। তুমি শান্ত থাকো।
বুক ভরে শ্বাস টানল ও।
ঠিক আছে, বলল। কিন্তু হঠাই এক হাত তুলে চোখ ঢাকল ডুগি। অপর হাতে নির্দেশ করছে অন্য কিছু একটা। মুসা, ওরা কারা?
মুসা! ওরা আমাদের দিকেই আসছে! পিছন থেকে চেঁচাল কিশোর।
একদল ছায়ামূর্তিকে আমাদের উদ্দেশে আসতে দেখলাম।
খাইছে, কারা ওরা? কী ওরা?
মিস্টার ম্যাকয়, আর্তনাদ ছাড়লাম। আমাদের বাঁচান! শুনতে পাবেন কিনা জানি না, কিন্তু চেঁচাতেই লাগলাম।
কিশোর, ডুগি আর আমি পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে রয়েছি। নিস্পন্দ। ছায়ামূর্তিগুলোকে আমাদের দিকে ভেসে আসতে দেখলাম। ক্রমেই কাছিয়ে আসছে। মুখ দেখতে পাচ্ছি-ফ্যাকাসে, চোখ নেই। ওরা সব ওপারের জীব!
মুসা, আমাকে এখান থেকে বের করো! গর্তের ভিতর থেকে চেঁচিয়ে উঠল রবিন।
হ্যাং অন পাল্টা চেঁচালাম। হাল ছেড়ো না!
এসময় রক্ত হিম করা এক গোঙানির শব্দ কানে এল। পরক্ষণে ওদের ফ্যাকাসে, চোখহীন মুখগুলোকে কাছিয়ে আসতে দেখলাম। হাঁ করা মুখ থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে।
আআহহহহ, চোয়াল ঝুলিয়ে গুঙিয়ে উঠল ওরা। বীভৎস দৃশ্য। টিভি শো হলে সুইচ অফ করে দিতাম।
আআহহহহ!
চোখ ঢেকে আর্তনাদ ছাড়লাম আমরা।
হল ধারাল নখ বাগিয়ে আমাদের দিকে দুহাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসছে কুৎসিত মূর্তিগুলো। ওদের ফ্যাকাসে, হাড্ডিসার মুখের চেহারা কাছ থেকে দেখতে পাচ্ছি। টলতে টলতে আরও খানিকটা এগিয়ে এল। চোখের কোটর থেকেও পচা গন্ধ বেরোচ্ছে নরকের জীবগুলোর। মি. ম্যাকয় আর মিশেলকে দেখলে ভয় করে না, অথচ এরা যে কী ভয়ঙ্কর বলে বোঝানো যাবে না!
প্রেতাত্মাগুলো এগিয়ে আসছে, চোখ বুজে দাঁড়িয়ে রইলাম আমরা পরস্পরকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে। এবার হঠাই পিছন থেকে চেনা এক কণ্ঠ কানে এল।
তোমরা এক পাশে সরে যাও, বাছারা, মি. ম্যাকয় বললেন। ভাগ্যিস উনি আমার ডাক শুনতে পেয়েছেন। ওরা চটপটে না। এসো আমার সাথে।
না! চেঁচিয়ে উঠল ডুগি। আপনার সাথে কেন যাব? আপনি কে না কে।
উনি আমার পরিচিত, ডুগি, বলে ওর বাহু ধরে টানলাম। বন্ধু মানুষ।
আমাদেরকে ধরতে যাবে এসময় আমরা ছায়ামূর্তিগুলোর হাত এড়ালাম। সামনে হাত বাড়িয়ে, গোঙাতে গোঙাতে চলে গেল ওরা, মুখ-চোখ থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। দুর্গন্ধে টেকা দায়।
ওরা কোথায় যাচ্ছে? ওরা এত কুৎসিত কেন? মি. ম্যাকয়কে প্রশ্ন করলাম।
এরা স্রেফ ঘুরে বেড়ায়। বেঁচে থাকতে এরা চোর-ডাকাত জলদস্যু ছিল। তাই এখানে এসে শান্তি পায়নি। অস্থির হয়ে ঘুরে বেড়ায় আর অন্যদেরকেও দলে টানতে চায়। কাজেই ওদেরকে দেখলে পথ ছেড়ে দৌড়ে সরে দাঁড়াবে।
শিউরে উঠলাম। কুৎসিত জীবগুলো যখন আমাদেরকে ধরতে আসছিল তখন ফ্ল্যাশলাইট হারিয়ে ফেলেছি কিশোর আর আমি।
এসো, তোমাদের বন্ধুকে সাহায্য করতে হবে, মি. ম্যাকয় বললেন।
আমাদের বন্ধু একটা কবরে পড়ে গেছে। ওকে বের করে নিয়ে বাড়ি ফিরতে চাই, মি. ম্যাকয়কে বললাম।
তা হলে দেরি করা যাবে না, গম্ভীর দেখাল মি. ম্যাকয়কে।
পেট মুচড়ে উঠল।
কেন?
দরজাগুলো শীঘ্রিই বন্ধ হয়ে যাবে, কেন বলতে পারব না। তোমরা যদি আজ রাতে ফিরে যেতে না পারো তবে আমাদের সাথে, থেকে যেতে হবে। চিরদিনের জন্যে।
দশ
এবার আসল কথা জানা গেল! ভয়ে অন্তরাত্মা শুকিয়ে গেল। মি. ম্যাকয় কখনোই বলেননি দরজাগুলো বন্ধ হওয়ার কথা…বলেননি আমরা চিরজীবনের জন্য আটকা পড়তে পারি ওপারের ভুবনে!
একথা আগে বলেননি কেন? পা চালিয়ে তাঁর নাগাল ধরে প্রশ্ন করলাম আমি।
তোমরা ভয় পাবে বলে, বললেন মি. ম্যাকয়। এক জগৎ থেকে অন্য জগতে চলাচলের সময় মনটাকে স্বচ্ছ রাখতে হয়।
কিশোর! মুসা! জলদি এসো! এখানে ভীষণ ঠাণ্ডা! রবিনের চিৎকার।
মি. ম্যাকয় অদৃশ্য হয়ে গেলেন মুহূর্তের মত, তারপর ফিরে এলেন একটা মই নিয়ে। খাইছে, ঠিক একজন জীবিত মানুষের মত লাগছে এখন তাঁকে।