দেয়ালে হাত বুলালাম, এবার বাহু থেকে কাঁধ অবধি ঢুকিয়ে দিলাম ভিতরে।
দেখেছ? এখানে এক ধরনের ওপেনিং আছে, বললাম।
কিশোর আর রবিনের চোখ ছানাবড়া।
কোথায় ওপেনিং? রবিনের প্রশ্ন।
আমার ধারণা এটা চলে গেছে আত্মাদের জগতে-মানে ওপারে।
কিছু দেখতে পাচ্ছ? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
আগে কেন ভাবিনি জানি না, কিন্তু আমি মাথা গলিয়ে দিলাম ফাঁকটার মধ্য দিয়ে। কিন্তু ওপাশে কী আছে বলতে পারার আগেই ধপাস করে পড়ে গেলাম। আর পড়েছি আত্মাদের পৃথিবীতে। সে
অন্যপাশে নিজেকে আবিষ্কার করলাম আমি। কিন্তু ফিরে যাওয়ার পথ খুঁজে পেলাম না। আতঙ্কিত হয়ে চারধারে নজর বুলালাম। বহুদূর থেকে প্রতিধ্বনির মত কানে আসছে কিশোর আর রবিনের ডাক।
মুসা, কোথায় তুমি? মুসা! আমার নাম ধরে ডাকছে।
ভয়ে আর ঠাণ্ডায় হাত-পা জমে যাওয়ার দশা। খোলা জায়গাটা খুঁজে পেলে আবারও ক্লজিটে ফিরে যেতে পারতাম কিন্তু কোথায় সেই ওপেনিং? কানে আসছে শুধু দূরাগত ডাক। হারিয়ে গেছি আমি।
আমি, মুসা আমান, ওপারে-জীবিত-এবং-নিখোঁজ।
সাত
কোন কিছুতে হোঁচট খাইনি আমি, তারপরও পড়ে গেছি ফোকরটা দিয়ে। মনে হচ্ছে ভ্যাকিউম ক্লিনারের মাধ্যমে আমাকে শুষে নেওয়া হয়েছে।
ভীত আর বোকা-বোকা লাগছে। হাত দিয়ে চারধার চাপড়াচ্ছি। মার বাগানের মত স্যাঁতসেঁতে ভাব আর ধুলোর গন্ধ এখানে। মনে হচ্ছে ভেজা মাটিতে বসে আছি। ঠাণ্ডাটা অনুভব করতে পারছি। অন্ধকার সত্ত্বেও হলদেটে আকাশ দেখতে পাচ্ছি। পেটের ভিতরটা হঠাই গুলিয়ে উঠল।
এবার একটা আলো দেখতে পেলাম। মনে হলো একটা গাড়ি। আলোটা কাছিয়ে এলে ভাল করে দেখা গেল। চারধারে নজর বুলালাম। খাইছে, বাড়িগুলো কোথায়? আর রাস্তাটাই কেন ধুলোয় ভরা? এবার চাকার কাঁচকোচ শব্দ শুনতে পেলাম। ক্যারিজ বয়ে দুলকিচালে আমার দিকে ছুটে আসছে এক ঘোড়া। আজব কাণ্ড, ভাবলাম। কেউ তো আজকাল ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে না। এ শহরের কেউ না। এ শতাব্দীরই কেউ না…
আরি! ক্যারিজটার পথ থেকে ঝট করে পা সরিয়ে নিলাম। চালকের দিকে মুখ তুলে চাইলাম। হাস্যকর পোশাক তার পরনে। লোকটার মুখের দিকে চাইতেই আঁতকে উঠলাম।
ফ্যাকাসে মুখে চোখ নেই, শূন্য কোটর!
কিশোর, রবিন, তোমরা কোথায়? আর্তনাদ ছাড়লাম।
গাড়ির হেডলাইট নয়, ওয়াগনের এক পোল থেকে একটা লণ্ঠন ঝুলছে। চোখ সরু করে চাইলাম। ক্যারিজের পিছনে বসে এক মহিলা। এ-ও ফ্যাকাসে। ছোট এক বনেট পরা। খাইছে, এরও চোখ নেই।
তারমানে গোরস্থানে পৌঁছে গেছি আমি! দুপাশ হাতড়ালাম। ঘাস, শুকনো পাতা, আর একটা হেডস্টোন। সভয়ে হাত সরালাম। আঠাল ভাব! এটা গোরস্থান ঠিকই-তবে ১৬৯০ সালের! মনে হচ্ছে দুঃস্বপ্ন। দেখছি, কিন্তু আসলে তা না। ক্লজিট থেকে এখানে এলাম কীভাবে?
শার্টের বুকে হাত মুছলাম। নিজের দিকে চাইলাম।
এ হতে পারে না! চেঁচিয়ে উঠলাম। হাত-শরীর ভেদ করে মাটি অবধি দেখতে পাচ্ছি। ভূত হয়ে গেছি আমিও!
মুসা, আমি তোমার সাথে আছি, হঠাই এক লোকের কণ্ঠস্বর বলে উঠল। ঝট করে ঘুরে দাঁড়ালাম কণ্ঠটা লক্ষ্য করে। অস্পষ্ট, কুয়াশাচ্ছন্ন বাতাস ভেদ করে মিটমিট করে চাইলাম, ভাল করে দেখতে চেষ্টা করছি। একণ্ঠটা আগেও শুনেছি।
দাঁড়ানোর চেষ্টা করো, কণ্ঠটা বলল। কেউ একজন আমার হাত ধরে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করল। হাতটা অসম্ভব হালকা। এরমানে ___।
মিস্টার ম্যাকয়? ককিয়ে উঠলাম, মুখে কথা ফুটছে না। ___ থেকে দেখলাম। মি. ম্যাকয়। মা ঠিকই বলেছিল। এটা অন্য ভুবন। মি. ম্যাকয় আসলেই ভূত! এবং তাঁর সঙ্গে অন্যান্য ভূতেরা আছে!
মিস্টার ম্যাকয়? আমি এখান থেকে ফিরে যেতে চাই। আমাকে সাহায্য করুন, জড়ানো গলায় বললাম। আমি বাড়ি যাব!
চিন্তা কোরো না, মৃদু হেসে শান্ত স্বরে বললেন মি. ম্যাকয়।
ভয়ের কিছু নেই। শুধু দরজাটা খুঁজে নিতে হবে। ওটা কাছেপিঠেই, আছে।
একটু স্বস্তিবোধ করলাম। আশ্বাস পেয়েছি মি. ম্যায়ের কথায়।
কিন্তু দরজাটা কীসের? জিজ্ঞেস না করে পারলাম না।
যেটা দিয়ে আমরা এক জগৎ থেকে অন্য জগতে যাই, জবাব পেলাম।
আমরা বলতে কারা?
হেসে উঠলেন মি. ম্যাকয়।
সবাই, মুসা, প্রত্যেকে।
আপনি আমাকে শিগগির পার করে দিন, মিস্টার ম্যাকয়, অধৈর্য হয়ে বললাম। আগামী সপ্তাহে আমার স্কুল। তা ছাড়া সাঁতারের দলে নাম লিখিয়েছি আমি।
আবারও হেসে উঠলেন মি. ম্যাকয়।
ঘাবড়িয়ো না। চারপাশটা একটু ঘুরে দেখি এসো।
কী জন্যে?
দরজাটা খুঁজব না? ওটা মনে হয় এপাশেই আছে। বাতাসে হাত খ. চালালেন মি. ম্যাকয়। ভঙ্গিটা দেখে মনে হলো মাকড়সার জাল সরাচ্ছেন। একবার, দুবার, তিনবার চেষ্টা করলেন।
মিয়া এবার সহসাই ওঁর হাত ও কব্জি অদৃশ্য হয়ে গেল। ঠিক আমার ক্লজিটের গর্তটার মত একটা ফাঁক। হাতটা টেনে বের করে আবারও বাড়িয়ে দিলেন। ফের উধাও হয়ে গেল ওটা। টি
ওটা এখানে, বললেন, আমার চোখে চোখ রাখলেন। শিউরে উঠলাম।
মুসা, মুসা, তুমি শুনতে পাচ্ছ? জবাব দাও! কিশোরের উদ্বিগ্ন কণ্ঠ এখনও দূরাগত প্রতিধ্বনির মত শোনাচ্ছে।
মি. ম্যাকয়ের দিকে চাইলাম।
জবাব দাও, বাছা। ওরা শুনতে পাবে, বললেন তিনি।
আমি এখানে! চেঁচালাম। দরজাটা খুঁজে পেয়েছি! এখুনি আসছি! মি. ম্যাকয়ের দিকে ঘুরে দাঁড়ালাম। আচ্ছা, মিশেলের ব্যাপারটা কী? আমরা ওর হেডস্টোন খুঁজে পেয়েছিলাম। তারপর থেকে ও আমার ক্লজিটে দেখা দিচ্ছে।