শুনেছি তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু কীসের শব্দ ছিল ওটা?
.
পরের কদিন ব্যস্ত হয়ে পড়লাম সাঁতার নিয়ে। ঝড়ের কথা মনেই থাকল না।
সেদিন সন্ধেয় পিত্যা খাওয়ার পর রাশেদ চাচা আমাদেরকে নিয়ে গেলেন সিডি ভাড়া করতে। আমরা ভূতের এক সিনেমা বাছলাম। ঠিক করলাম ঘর অন্ধকার করে তারপর দেখব। মজার ব্যাপার হলো, সিনেমাতেও ঝড় আর ভারী বৃষ্টির সিন রয়েছে। সেসঙ্গে বাতাসের শোঁ-শোঁ গর্জন। ঠিক আমাদের শহরের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঝড়টার মতন।
এবার ছবিতে কী যেন বাড়ি খেতে লাগল।
অ্যাই, তোমরা জোরাল কোন শব্দ শুনতে পাচ্ছ? কাল রাতের ঝড়ের মতন? বলে উঠলাম আমি।
কই না তো, বলল কিশোর।
বন্ধুদেরকে সে রাতের শব্দটার কথা জানালাম। আরও বললাম, আমি ছাড়া আর কেউ শব্দটা শোনেনি।
আমিও শুনিনি, রবিন বলল।
এবার হঠাৎই জমে গেলাম আমরা। ছবির দড়াম-দড়াম শব্দটা জোরাল হয়েছে। এক মহিলা শুয়ে রয়েছে প্রাচীন এক পোডড়া বাড়িতে। ব্ল্যাঙ্কেট ক্রমেই টেনে তুলেছে চিবুক পর্যন্ত। ঘরের বিশাল কাঠের দরজাটা দেখা গেল। কাছ থেকে দেখাচ্ছে। খুব শক্তিশালী কেউ একজন বাড়ি দিচ্ছে দরজায়। ফলে, কাঠ ভেঙে ছিটকে পড়ছে। এবার ডোরনবটা মোচড় খেল!
খাইছে!
দরজা খুলতেই দেখা গেল বাইরে কেউ নেই। তা হলে বাড়ি দিচ্ছিল কে?
ছবি শেষ হলে বাড়ি চলে এলাম।
.
রাতে ঘুমিয়ে পড়েছি। অন্তত ঘণ্টা দুয়েক ঘুমিয়েছি। তবে নিশ্চিত নই। হঠাই ঘুম ভেঙে গেল। কটা বাজে কে জানে। বিছানা ছেড়ে জানালার কাছে গেলাম। বিদ্যুৎ নেই। ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে না, তা হলে পাওয়ার অফ কেন? বিরক্তি বোধ করলাম।
ফ্ল্যাশলাইটটা তুলে নিয়ে হল ধরে দ্রুত পায়ে এগোলাম। কী ঘটছে দেখতে চাই। বাবা-মা ঘুমোচ্ছে। গোটা বাড়ি শান্ত। স্ট্রীটলাইটের নীল আলোয় লিভিং রুমে কেমন এক ভুতুড়ে আভা। অদ্ভুত তো, ভাবলাম। কারেন্ট না থাকলে রাস্তার আলো জ্বলছে কীভাবে?
বাবার প্রকাণ্ড গ্র্যাণ্ডফাদার ঘড়িটা ক্রমাগত টিকটিক করে চলেছে। নিস্তব্ধ পরিবেশে বড্ড কানে লাগছে শব্দটা। পেটের ভিতরে শিরশিরে অনুভূতি হচ্ছে।
ঢং! আঁতকে উঠলাম। ঘড়িটা ঘণ্টা দিচ্ছে। আবার, তারপর আবার। তিনটে বাজে। মাঝরাত। এজন্যই সব কিছু কেমন ভুতুড়ে লাগছে। বুক ধড়ফড়ানি কমে শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক হতে খানিক সময় লাগল।
এবার দেখতে পেলাম ওটাকে-গ্রীনহাউসে যে ম্লান আলোটাকে জ্বলতে দেখেছিলাম। আলোটা যেন ভাসছে। মার স্কার্ফ বাতাসে ছেড়ে দিলে যেভাবে ধীরে ধীরে নীচে নেমে আসে ঠিক সেরকম। বুকের ভিতরে ধড়াস করে উঠল।
আলোটা জ্বলছে হেডস্টোনটা যেখানে ছিল সেখানে!
লিভিংরুম থেকে বেরিয়ে এলাম। আতঙ্কিত। একটা টুলে হোঁচট খেয়ে আরেকটু হলে পড়েই যেতাম। হাত কাঁপছে, শক্ত করে ফ্ল্যাশলাইটটা চেপে ধরে রেখেছি। একইসঙ্গে ওটাকে জ্বেলে রেখে পিছাতে চাইছি।
হেডস্টোনটা যেখানে রাখা হয়েছিল। কিন্তু মা তো মিশেলকে কদিন আগেই পৌঁছে দিয়েছে ইউনিভার্সিটিতে এবং বাইরে থেকে প্রতিফলিত করার মত যথেষ্ট আলো জ্বলছে না, মিশেল যদি এখনও ওখানে থেকেও থাকে।
নিঃশব্দে দরজাটা বন্ধ করে উড়ে গিয়ে বিছানায় পড়লাম। থরথর করে কাঁপছি। বোঝার চেষ্টা করছি ঘটনাটা কী। গ্রীনহাউসে কিছু একটা ছিল, এবং সেটা সামান্য একটা আলো নয়। এমন কিছু জ্বলছিল আগে যেটা ওখানে ছিল না।
ঘড়ির দিকে চাইলাম। পিটপিট করছে। তারমানে কারেন্ট এসেছে। ল্যাম্প জ্বেলে রাতের টেবিলে খুঁজে পেলাম ঘড়িটাকে। তিনটা দশ। ঘড়িটাকে রিসেট করলাম। এবার বিছানায় শুয়ে স্বস্তির শ্বাস ফেললাম। আশা করছি সব আবার স্বাভাবিক হয়ে যাবে।\
স্বস্তির ভাবটা বেশিক্ষণ থাকল না। বালিশটা ঠিকঠাক করে মাথা রাখতে যাব এসময় কানে এল শব্দটা। দুম! দুম! তড়াক করে সিধে হয়ে বসলাম। চোখ বিস্ফারিত। শব্দটা এবার আর বাইরে থেকে নয়, কাছ থেকে আসছে। ঠিক আমাদের ভাড়া করা সিনেমার হানাবাড়িটার মতন।
ঘরের অপর প্রান্তের উদ্দেশে ভীতিমাখা চোখে চেয়ে রয়েছি আমি। শ্বাস নিতেও ভুলে গেছি যেন। শব্দটা আসছে বাড়ির ভিতর থেকে! ঢোক গিলোম। আসলে শব্দটা আসছে আমার ক্লজিট থেকে!
চার
পরদিন সকালে টলতে টলতে কিচেনে গিয়ে ঢুকলাম। প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে। রোদ ঝলসাতে দেখে বুকে সাহস পেলাম। মা ফোনে কথা বলছে।
কিন্তু এটা কী করে হয়, গ্রীনহাউস থেকে তাকে বলতে শুনলাম।
আমরা ওঁর সাথে কথা বলেছি, গোরস্থানটা একসাথে ঘুরে বেড়িয়েছি। মিস্টার ম্যাকয়। সাদাচুলো বয়স্ক ভদ্রলোক। ১ ক্যাবিনেটে হাতড়ালাম সিরিয়ালের খোঁজে। মা কিছুক্ষণের জন্য চুপ হয়ে গেল।
একটু কুঁজো মত মানুষটা। চমৎকার ব্যবহার। কালো সুট পরা ছিল। না, টাক্সেডো নয়। আমরা ওঁকে মিনিস্টার-টিনিস্টার কিছু ভেবেছিলাম, মা বলে চলেছে।
সিরিয়ালের বাটি নিয়ে গ্রীনহাউসের দিকে এগিয়ে গেলাম, যাতে মার কথা-বার্তা শুনতে পাই। মাকে বিস্মিত শোনাচ্ছে। দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে সিরিয়াল খাচ্ছি আমি। রাতে যা-ই দেখি না কেন, এখন সব কিছু স্বাভাবিক।
হ্যাঁ, মেরামতের কাজ ভালভাবে এগোচ্ছে, মা বলে চলেছে।
আমি মিস্টার ম্যাকয়কে নিজের মুখে বলতে চেয়েছিলাম কথাটা। হেডস্টোনগুলোর ব্যাপারে ভীষণ উদ্বিগ্ন ছিলেন ভদ্রলোক।