অমন আবহাওয়ার মধ্যে কারা এল, মাথা নেড়ে বলল মা।
অনেকেই বোঝে না জিনিসগুলো কত দামী, এগুলোর যে ঐতিহাসিক মূল্য আছে, বললেন মি. ম্যাকয়। এলাকার অনেকেরই পূর্বপুরুষদের কবর আছে এখানে। এখন মুশকিল হচ্ছে, যেভাবে নাড়াচাড়া করা হয়েছে, আবার ঠিক জায়গামত সেট করা যাবে কিনা সন্দেহ। এত বছর পর কোন্টা কার কবর বুঝব কী করে?
মা ইতোমধ্যে কবরগুলোর মাঝখান দিয়ে হাঁটতে শুরু করেছে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পাথরগুলো দেখছে আর প্যাডে কী সব টুকছে।
কিছু ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটেছে, মাটির দিকে চেয়ে হিজিবিজি করে নোট নিচ্ছে। দুএকটা পাথর ভেঙে দুআধখানা করা হয়েছে।
মি. ম্যাকয় বিষণ্ণ ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকালেন।
আমি জানি, বললেন।
কিছু কিছু পাথর মেরামত করা যাবে, মা বলল। গ্রীনহিলস ইউনিভার্সিটির ল্যাবে নিয়ে যাওয়া দরকার।
তা হলে তো খুবই ভাল হয়, বললেন মি. ম্যাকয়। আশ্বস্ত দেখাচ্ছে তাকে। আমরা কৃতজ্ঞ থাকব।
আমরা কোথায়? ভাবলাম। আশপাশে তো ওঁকে ছাড়া আর কাউকে দেখছি না।
আমি একটা ভ্যানের ব্যবস্থা করব, মা বলল।
বিমর্ষ দেখাল মি. ম্যাকয়ের চোখজোড়া।
কিন্তু কবরগুলোর কী হবে? প্রশ্ন করলেন। পাথরগুলোকে ঠিকঠাকমত বসাব কীভাবে?
আপনি শুনলে আশ্চর্য হবেন, মা বলল। এগুলোর রেকর্ড আছে। কোন কোন ডকুমেন্ট তিনশো বছরের পুরানো। প্রাচীন ভিলেজ রেকর্ড ঘাঁটলে অনেক কিছু জানা যাবে। সবগুলো পাথর রিপ্লেস করতে না পারলেও বংশের নাম এবং এ ধরনের ব্যাপারগুলো জানতে পারব।
মি. ম্যাকয় আমাদের সঙ্গে গাড়ি পর্যন্ত হেঁটে এলেন। লিকলিকে লোকটা সামান্য ঝুঁকে পড়েছেন। এক মাথা তুষারশুভ্র চুল। ওঁকে ভাল লেগেছে আমার।
আমি বিকেলে লোকজন নিয়ে ফিরব, মা বলল। গাড়ি চলতে শুরু করলে মি. ম্যাকয় হাত তুলে আমাদের উদ্দেশে নাড়লেন। মুহূর্তের জন্য অন্যদিকে চেয়েছিলাম, এবার গোরস্থানের উদ্দেশে তাকাতেই দেখি মি. ম্যাকয় নেই। খাইছে, অথচ অত্যন্ত ধীরে হাঁটেন ভদ্রলোক।
.
মার সঙ্গে আবারও গোরস্থানে এসেছি আমি। ভ্যানে হেডস্টোনগুলো বোঝাই দেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে নেওয়া হচ্ছে মেরামতের জন্য। এক প্রফেসরকেও মা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে। শক্তসমর্থ কিছু ছাত্রও হাজির হয়েছে।
ভ্যান নিয়ে লোকজন চলে গেলে, আমি আর মা আরেকবার ঘুরে দেখলাম গোরস্থানটা।
মিস্টার ম্যাকয় কোথায় গেলেন? চারধারে নজর বুলিয়ে বলল মা। অদ্ভুত ব্যাপার। আমি ভেবেছিলাম বিকেলে উনি থাকবেন। ঝুঁকে পড়ে কাছ থেকে কিছু একটা দেখছে। মুসা, দেখ, হাতছানি দিয়ে ডাকল আমাকে।
কাছিয়ে গেলাম। ছোট এক হেডস্টোন, ঘাসের উপর পড়ে। ওতে খোদাই করা: মিশেল রবার্টস। জন্ম আগস্ট ১২, ১৯৮৭। মৃত্যু ডিসেম্বর ৬, ১৯৯৬।
মাত্র নবছর বয়স ছিল ওর, মা বলল। ব্যথিত দেখাচ্ছে তাকে। ভ্যানে তোলার সময় এটা মনে হয় চোখ এড়িয়ে গেছে। পাথরে একটা আঙুল ছোঁয়াল মা। আমরা মিশেলকে এখানে ফেলে রাখতে পারি না।
এ-ই হচ্ছে আমার মা, মনে মনে বললাম। একটা হেডস্টোনকে মিশেল বলে ডাকছে।
এটা গাড়িতে তুলতে তোর হেল্প দরকার, বলল মা।
আমার সোয়েটশার্টে মুড়ে গাড়ির পিছনের সিটের মেঝেতে হেডস্টোনটা নামিয়ে রাখলাম আমরা।
অনেক দেরি হয়ে গেছে। এখন আর ওখানে যাওয়া যাবে না। তোর বাবাকে বলেছি রাতে স্প্যাঘেটি আর মিটবল করব। এখন পর্যন্ত বাজারই করা হয়নি! মা গাড়ি চালানোর সময় চিন্তামগ্ন হলো। আগে বাসায় যাব। নইলে আমরা যখন মার্কেটে থাকব মিশেলকে কেউ গাড়ি থেকে চুরি করে নিয়ে যেতে পারে।
হেডস্টোনটাকে আমরা গ্রীনহাউসে বয়ে নিয়ে গেলাম।
তুই আমার সাথে শপিঙে যাবি? মা প্রশ্ন করল।
যাব, মা। এখুনি আসছি। মিনিট খানেক গ্রীনহাউসে থাকলাম আমি। হেডস্টোনটা টানছে আমাকে। কাছ থেকে পাথরটা দেখছি, ভাবছি খোদাই করা লেখাগুলো কতই না পুরানো, এসময় গ্রীনহাউসের ভিতর দিয়ে বয়ে গেল এক ঝলক ঠাণ্ডা বাতাস-এক সেকেণ্ডের জন্য। কাঁচের দেয়াল ভেদ করে চাইলাম। একখণ্ড মেঘ ভেসে যেতেই মুহূর্তের জন্য কালো হয়ে গেল আকাশ। ঠাণ্ডায় শিউরে উঠলাম।
তিন
কাল রাতের ঝড়টা কেমন হলো, বাবা? সন্ধেয় ডিনারে বসে প্রশ্ন করলাম।
ঝড়? কীসের ঝড়? আমাকে জ্বালানোর জন্য বলল বাবা। মিটবলগুলো দারুণ হয়েছে। আরেকটু স্প্যাঘেটি নিবি, মুসা?
মাথা নাড়লাম।
কাল রাতের ঝড়ের সময় একটা শব্দ শুনেছ?
কই না তো। শুধু বাতাসের শব্দ শুনেছি, বলল বাবা। কীগো, তুমি শুনেছ? মার উদ্দেশে জানতে চাইল। পরক্ষণে আবার আমার দিকে চোখ ফেরাল।
বাতাসের শব্দে ঘুম আসছিল না। তারপর তোমরা শুতে যাওয়ার পর দড়াম দড়াম করে শাটার বাড়ি খাওয়ার মত শব্দ হচ্ছিল, বললাম।
এখানে তো শাটার নেই। হয়তো পাশের বাড়িতে শব্দ হয়েছে, বলল বাবা।
পরদিন পাশের বাসায় গিয়ে জানালাগুলো পরখ করলাম। শাটার নেই। এবার আমার সত্যিই অবাক হওয়ার পালা। তবে কি গাছের ডালের শব্দ ছিল ওটা? সি আমাদের পিছনের উঠনে চলে এলাম, আমার বেডরুমের জানালাগুলো যেখানে। ছাদের দিকে চাইলাম। অস্বাভাবিক কিছুই চোখে পড়ল না। বাড়ি, জানালার ধারি সব খুঁটিয়ে লক্ষ করলাম। কোনও ডাল-পালা চোখে পড়ল না, কিংবা বাড়ির এমন কোন জায়গা যেখানে বাড়ি খেতে পারে গাছের ডাল। তা হলে?