সকাল থেকে চুপচাপ আছেন ডিক। মাথা নিচু করে নাস্তা খাচ্ছিলেন, জিনার প্রশ্ন শুনে মুখ তুললেন।
তোমরা তো দেখতে পাচ্ছি সারাদিনের কাজ জুটিয়েই ফেলেছ। আমি ভাবছি, আজ বোটটা নিয়ে আশপাশের দ্বীপগুলো একটু ঘুরে দেখে আসব।
আমাদের না নিয়েই? অবাক হলো জিনা। আপনার সঙ্গে আমরাও যেতে পারি। কাল না হয় এই দ্বীপ ঘুরে দেখা যাবে।
প্রথমবার আমি একাই যেতে চাই, বললেন ডিক। গম্ভীর। তোমাদের নিয়ে দ্বীপে-দ্বীপে ঘুরতে বেরোব আরেকদিন। আজ আমি একা যাব।
কী ব্যাপার, আঙ্কেল? জিজ্ঞেস করল মুসা। কিছু একটা ঘটেছে মনে হচ্ছে? কী সেটা?
কই, না, বললেন ডিক, কিছুই ঘটেনি। তোমাদের নিয়ে যাওয়ার আগে আমি নিজে আশপাশটা একটু দেখে নিতে চাই। তা হলে ভালো ভালো জায়গা তোমাদের ঘুরিয়ে দেখাতে পারব।
মোটর-বোট নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন ডিক কার্টার। ইঞ্জিনের শব্দ মিলিয়ে যেতেই বড় করে একটা শ্বাস ছাড়ল মুসা। বলল, মনে হয়, ওই অ্যারোপ্লেনের রহস্য ভেদ করতে গেলেন আঙ্কেল। কী যেন লুকাচ্ছেন আমাদের কাছে।
ভালোয় ভালোয় এখন ফিরে এলে বাঁচা যায়, বলল জিনা। নইলে আটকা পড়ব আমরা এই নির্জন দ্বীপে। কেউ জানবে না কোথায় আটকে আছি।
দিনটা আনন্দেই কাটল। উপত্যকার পাফিন কলোনি তো দেখলই, পাহাড়ে উঠে কাছ থেকে হরেক রকম পাখির প্রচুর ছবি তুলল রবিন। পুব পাহাড়ের মত পশ্চিম পাহাড়ের গায়েও কয়েকটা কার্নিশের নীচে গর্ত মত জায়গা দেখাল ওদের মুসা। বলল, ঝড় পশ্চিম থেকে এলে আমাদের আস্তানার চেয়ে এই জায়গাটা অনেক বেশি নিরাপদ। অসুবিধে একটাই-পানি
সারাদিন ওদের সঙ্গে সঙ্গে থাকল সখা-সখি। ওরা ডাঙায় হাঁটলে খানিক হেঁটে, খানিক উড়ে ওদের সঙ্গ দেয়; পানিতে নামলে ঝপাং করে পাশে নেমে সাঁতার কাটে, ডুব দেয়।
কিকো বুঝে নিয়েছে, কিশোরের সঙ্গেই পাখি দুটোর যত আহ্লাদ আর ঘেঁষাঘেঁষি; মুসার প্রতি তেমন আগ্রহ নেই-তাই অনিচ্ছাসত্ত্বেও মেনে নিয়েছে ওদের উপস্থিতি। মুসার দিকে আসতে দেখলে কড়া ভাষায় তার পেটেন্ট ধমক মারে: নাক ঝাড়ো, গাধা কোথাকার! রুমাল কোথায় তোমার? অথবাঃ কতবার বলেছি তোমাকে পা মুছে ঘরে ঢুকতে? ব্যাড বয়! কিংবাঃ চুপ, একদম চুপ! চোপরাও! দূরো!
সাগরের তীর ধরে পুরো দ্বীপটা ঘুরে দেখে ফিরে এল ওরা নিজেদের আস্তানায়। সন্ধের আগেই সাপার খেয়ে নিল। আশা করছে এই বুঝি এসে পড়লেন আঙ্কেল। কিন্তু সূর্য ডুবে গেল, গোধূলির সব রঙ মুছে গেল পশ্চিমের আকাশ থেকে; ডিক কার্টারের দেখা নেই। তারা ফুটল আকাশে, তারপর চাঁদ উঠল-সাগরের পানিতে তৈরি হলো লম্বা এক ঝিলমিলে রুপালি আলোর পথ; তবু দেখা নেই ডিক কার্টারের।
সারাদিনের ঘোরাফেরায় ক্লান্ত শরীর, শুয়ে পড়ল ওরা যে-যার বিছানায়, কিন্তু চোখের পাতা এক করতে পারল না কেউই। রাত নয়টার দিকে বোটের আওয়াজ পেল প্রথমে মুসা, তার একমিনিট পর আর সবাই। টর্চ নিয়ে ছুট দিল ওরা লেগুনের দিকে।
আমরা তো ভাবলাম বুঝি পথ হারিয়ে ফেলেছেন! বলল জিনা অনুযোগের সুরে।
চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলে, তাই না? হাসল আঙ্কেল। না, পথ হারাইনি। আসলে দিনের বেলায় এই দ্বীপের কাছে আসতে সাহস পাইনি, পাছে অ্যারোপ্লেনওয়ালাদের কেউ দেখে ফেলে। আমি জানতাম, তোমরা চিন্তা করবে; কিন্তু উপায় ছিল না। তবে ফিরে তো এসেছি, তাই না?
কী লুকাচ্ছেন, আঙ্কেল? সরাসরি প্রশ্ন করল কিশোর। দিনে আসতে সাহস পাননি কেন? কেউ দেখে ফেললে কী ক্ষতি হোত?
একটু আমতা আমতা করে বললেন আঙ্কেল ডিক, ঠিক কী তা বলতে পারব না, কিশোর। তবে আমার ধারণা, গোলমেলে কিছু একটা চলছে এই দ্বীপের আশপাশে কোথাও। ভেবেছিলাম, পাখি দেখার ছলে এখানে-ওখানে টু মারলে, সারাদিন দ্বীপগুলোর কাছাকাছি ঘোরাফেরা করলে কিছু হয়তো চোখে পড়বে। কিন্তু কিছুই পড়ল না।
আপনার চোখে পড়েনি কিছু, বলল জিনা। কিন্তু আপনি নিজে কারও চোখে পড়েননি তো? কোনও দ্বীপ থেকে লুকিয়ে কেউ দেখেনি তো আপনার সন্দেহজনক ঘোরাফেরা?
কথাটা ঠিকই বলেছ, জিনা। একটু ঝুঁকি তো ছিলই। যদিও এই বিরান এলাকায় কেউ এসে ওদের গোপন কার্যকলাপে ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারে, এই সম্ভাবনার কথা একটি বারের জন্যে ওদের কারও মাথায় খেলবে, আমার তা মনে হয় না। নজর রাখার জন্যে লোক বসানোর প্রশ্নই ওঠে না।
তার পরেও আমার মনে হয়, আপনার এই ঝুঁকি নেয়া উচিত হয়নি, নিজের বক্তব্য থেকে নড়ল না জিনা। আপনি ইতিমধ্যেই একটা বিপদে আছেন। আপনার কিছু সন্দেহ হয়ে থাকলে কী জানতে হবে বুঝিয়ে দিয়ে আমাদেরকে পাঠাতে পারতেন। কারও কোনও সন্দেহ না জাগিয়ে আমরাই ঘুরেফিরে দেখে আসতে পারতাম।
একটু ইতস্তত করে কিশোরের দিকে ফিরলেন আঙ্কেল ডিক।
তোমার কী মনে হয়, কিশোর?
আমার মনে হয় জিনা যা বলেছে, ঠিকই বলেছে, সংক্ষেপে জবাব দিল। কিশোর।
আমারও তাই মনে হয়, মুসা বলল আরও কম কথায়।
যদিও এর আগে আমরা এ নিয়ে নিজেদের মধ্যে একটি শব্দও উচ্চারণ করিনি, বলল রবিন, আমারও তাই মত।
তা হলে তো দেখছি ভুলই হয়ে গেছে! বললেন ডিক কার্টার। আমার ভুলে তোমাদেরকেও বিপদে ফেলে দিলাম কি না ভাবছি এখন। যাই হোক, যা হবে মোকাবিলা করব। কী বলো?
সবাই একমত হলো এই ব্যাপারে। আঙ্কেলের খাওয়া হয়ে যেতেই শুয়ে পড়ল সবাই। আবহাওয়ায় আবার ফিরে এসেছে সেই গুমোট ভাবটা।
পাঁচ
পরদিন রোদ উঠল কড়া। একটুও বাতাস না থাকায় ভ্যাপসা, গুমোট ভাব বাড়ল অনেক।