পানিতে নেমেই ক্লান্তি দূর হয়ে গেল আঙ্কেলের। তাড়া করলেন তিন গোয়েন্দাকে। ওরাও তিন দিক থেকে পানি ছিটিয়ে তাকে ঘায়েল করবার চেষ্টা করে যখন দেখল পারছে না, তখন ডুব দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। একটু পরেই দেখা গেল শূন্যে উঠে যাচ্ছেন ডিক, তারপর ঝপাৎ করে পড়লেন পানিতে-কিশোর ও মুসা দুজন দুপাশ থেকে তার দুই পা ধরে টেনে তোলায় ভারসাম্য হারিয়েছেন।
দূর থেকে ওদের চিৎকার চেঁচামেচি শুনে মুচকি হাসল জিনা। এখনও ছেলেমানুষ রয়ে গেছেন আঙ্কেল ডিক। খেলছেন তিন গোয়েন্দার সঙ্গে সমানে। সমান! একটা কাঠের গুঁড়ির উপর কাপড় কাঁচতে কাঁচতে হঠাৎ ঘাড় কাত করল ও। কী রে? কীসের শব্দ? আবার সেই প্লেন না তো!
উঠে দাঁড়িয়ে পশ্চিমে তাকিয়েই দেখতে পেল জিনা প্লেনটা। দূর থেকে খুব ছোট লাগছে। কী যেন পড়ল নীচে প্লেন থেকে। কী ওটা? প্যারাশুট? কোনও বিপদে পড়ল না কি আবার? কিন্তু প্লেনের চলায় কোনরকম অস্বাভাবিক কিছু দেখা গেল না, একই ভঙ্গিতে চলতে চলতে এক সময়ে মিলিয়ে গেল দূরে। শব্দ মিলিয়ে গেছে আগেই।
গোসল সেরে তাঁবুতে ফিরে গ্রাউন্ডশীট বিছিয়ে সুবার বিছানা রেডি করে ফেলল জিনা। অতিরিক্ত গরম পড়েছে বলে তাঁবুর ফ্ল্যাপদুটো তুলে দিল ও। একটু পরেই গল্প করতে করতে ফিরে এল ছেলেরা। ঘুমাবার সব আয়োজন একদম তৈরি দেখে থমকে দাঁড়ালেন আঙ্কেল তাঁবুর সামনে।
ওয়ান্ডারফুল! বললেন তিনি। ভারি লক্ষ্মী মেয়ে তো তুমি, জিনা! সবকিছু গোছানো-বিছানো সারা! এ-ই তো চাই! ভেরি গুড, ভেরি গুড!
প্রশংসা পেয়ে খুশিতে লাল হয়ে উঠল জিনার মুখ। সেটা ঢাকবার জন্য প্লেনের প্রসঙ্গ তুলল।
প্লেনটা দেখলেন, আঙ্কেল?
হায় খোদা! না তো! কীসের প্লেন? অবাক হলেন ডিক।
ওই যেটা দেখলে আপনার মুখটা শুকিয়ে যায়, বলল জিনা।
কই, আমরা তো কোনও আওয়াজ পাইনি?
আমরা যেরকম হই-চই করছিলাম, বলল রবিন, শুনতে না পাওয়ারই তো কথা।
ওটা থেকে কী যেন নীচে পড়ল দেখলাম। সাদা মত।
সত্যিই কালো হয়ে গেল আঙ্কেলের মুখটা। হাসি মিলিয়ে গেছে, কুঁচকে গেছে ভুরু জোড়া। প্যারাশুট?
ঠিক বোঝা গেল না। অনেক বেশি দূরে ছিল। প্যারাশুট হতে পারে, আবার ধোয়াও হতে পারে। মনে হলো, কী যেন নামছে ধীরে ধীরে। আপনি এমন করছেন কেন, ব্যাপারটা কি খুবই অস্বাভাবিক?
হ্যাঁ-মানে, না। প্লেনের ব্যাপারটা কেমন একটু গোলমেলেই ঠেকছে আমার কাছে। মানে, গোলমেলে হতেও পারে। তোমরা দুশ্চিন্তা কোরো না। তবে এখুনি একবার বোটে যেতে হবে আমাকে। রেডিওতে একটা মেসেজ পাঠানো দরকার। এটা হয়তো কিছুই না-কিন্তু আবার গুরুত্বপূর্ণ কিছু হতেও পারে।
.
নরম মাটিতে পায়ের গভীর ছাপ ফেলে চলে গেলেন ডিক কার্টার।
কী হতে পারে, কিশোর? জিজ্ঞেস করল– মুসা। আবার একটা রোমাঞ্চকর ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছি নাকি? তোমার কী মনে হয়? এই পাখির রাজ্যে কী করছে প্লেনটা?
কী জানি! দুই হাতের তালু চিত করল কিশোর। কিশোর নড়ে উঠতেই ওর পায়ে ঠেস দিয়ে ঘুমিয়ে পড়া সখা পড়ে যাচ্ছিল তাল হারিয়ে, কোনওমতে সামলে নিল। আরে, এরা তো পিছু ছাড়ে না! রাতে আবার এই তাঁবুতে থাকার বায়না ধরবে নাকি?
যেন সমস্যাটা বুঝতে পেরেছে, এমনি ভঙ্গিতে দুজন দুজনের দিকে তাকাল সখা-সখি, তারপর হেলেদুলে বেরিয়ে গেল তবু ছেড়ে। কিন্তু বাইরে গিয়েই তাঁবুর পাশে গর্ত খুঁড়তে লেগে গেল। দূরে যাবে না, কিশোরের কাছাকাছিই থাকবে ওরা।
পায়ে হেঁটে বেরিয়ে গেল কিকোও, যেন দেখবে ওদের কাজ ঠিকমত হচ্ছে কি না। বালি ও মাটি ছিটে এসে পড়ল ওর গায়ে। রেগে গিয়ে ধমক দিল ও, অরররররররর!
নরম গলায় সবিনয়ে উত্তর দিল ওরা, অররররররর, ককক! কিন্তু কাজ বন্ধ করল না।
আধঘণ্টার মধ্যেই ফিরে এলেন ডিক কার্টার।
শুয়ে পড়েছে সবাই, তবে জেগেই আছে।
মেসেজ গেল? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
হ্যাঁ।
ঢলে পড়ল সবাই গভীর ঘুমে।
.
পরদিন সকালে উঠে দেখা গেল, গতকালকের সেই ভ্যাপসা ভাবটা আর নেই। মনে হয়, ঝড়টা আসতে আসতেও ঘুরে গেছে অন্য কোনও দিকে। চনমনে। রোদ উঠেছে। সবাইকে হাসতে শুনে ঘাড় ফিরিয়ে দেখল কিশোর, মাথার কাছে বসে রয়েছে ওর দুই বন্ধু-সখা ও সখি।
ঘাড়ে ভোয়ালে ফেলে ছুটল তিন গোয়েন্দা সাগরের দিকে। ওদের মাথার উপর দিয়ে উড়ে আগেই পৌঁছে গেল পাফিন জুটি। মস্ত চঞ্চু নিয়ে ঢেউয়ের সঙ্গে উঠছে-নামছে জোকারের ভঙ্গিতে। তারপর ডুব দিল। পাখা ঝাঁপটে অত্যন্ত দ্রুত ছুটল ওরা পানির নীচ দিয়ে। একটু পরেই উঠে এল ঠোঁটে করে মাছ নিয়ে।
আমাদের একটা মাছ দিলে ভেজে খাওয়া যেত নাস্তার সময়, বলে সখার ঠোঁটে ধরা মাছটা নেওয়ার চেষ্টা করল মুসা। কিন্তু ছাড়ল না সখা, ঠোঁটজোড়া উপর দিকে তুলে কোত করে গিলে ফেলল আস্ত মাছটা।
এদেরকে আমাদের জন্যে মাছ ধরা শেখাতে পারলে কিন্তু মন্দ হোত না, বলল রবিন। তা হলে টাটকা প্রোটিন পাওয়া যেত অঢেল।
কয়েকটা ডুব দিয়েই ফিরে এল ওরা ক্যাম্পে। নাস্তা খেতে খেতে আলোচনা চলল দিনটা কীভাবে কাটাবে।
চলো, গোটা দ্বীপটা, আজ ঘুরেফিরে দেখা যাক কোথায় কী আছে, প্রস্তাব দিল জিনা। রবিন ছবি তুলতে পারবে যত খুশি। কী বলো? সবাই একবাক্যে রাজি দেখে ফিরল ডিক কার্টারের দিকে। আপনি কী করবেন, আঙ্কেল? আমাদের সঙ্গে দ্বীপ ঘুরে দেখতে যাবেন, না কি বিশ্রাম?