পাহাড়ের ধারে সুন্দর একটা লেগুন, দেখেই পছন্দ হলো কিশোরের। বলল, আঙ্কেল, মোটর-বোটটা ওখানকার চেয়ে এখানে অনেক নিরাপদে থাকবে মনে হয়। ঝড়-তুফানে সাগরে ঢেউ উঠলে দুপাশের পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে চুরমার হওয়ার ভয় নেই এখানে।
ঠিক বলেছ, কিশোর! লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালেন আঙ্কেল ডিক। কিছুতেই স্বস্তি হচ্ছিল না ওখানে রেখে, কেমন যেন করছিল মনের ভেতরটা। এখন বুঝতে পারছি, কেন। ওখানে বোট রাখা ঠিক হয়নি। আমি এখনই গিয়ে নিয়ে আসছি ওটা। এখান থেকে মাল-সামান নামাতেও অনেক সুবিধে হবে। বলেই পিছন ফিরে হাঁটা ধরলেন তিনি। সঙ্গে আসবে কি না জিজ্ঞেস করায় হাত নেড়ে বারণ করলেন মুসাকে। মেসেজ পাঠাবার কাজটাও সেরে নেব এই ফাঁকে। তোমরা বিশ্রাম নাও, আধঘণ্টার মধ্যে আসছি আমি।
.
বোটটা বালির সঙ্গে ঘষা খেয়ে ঘ্যাঁশশ করে থামতেই তীরে গিয়ে দাঁড়াল তিন গোয়েন্দা।
নোঙরটা ছুঁড়ে দেন, আঙ্কেল, বলল মুসা।
ঝপাৎ করে হাঁটুপানিতে পড়ল নোঙর। মুসা গিয়ে তুলে আনল ওটা উপরে। এদিকে বালিতে বেশ গভীর একটা গর্ত তৈরি করে ফেলেছে কিশোর ও রবিন। নোঙরটা ওর ভিতর ফেলে চারপাশ থেকে বালি টেনে ভরল গর্তটা, তারপর পা দিয়ে চেপে চেপে শক্ত ভাবে আটকাল।
ব্যস, ব্যস, হয়েছে, বললেন আঙ্কেল বোটের উপর থেকে। এবার আমি। দরকারি মালপত্রগুলো একে-একে নামিয়ে দিচ্ছি, ধরো তোমরা।
প্রথমে এল তাঁবু। মুসা ওটা নিয়ে তুলে দিল পারে দাঁড়ানো কিশোরের হাতে, কিশোর দিল মাঝামাঝি অবস্থানে দাঁড়ানো রবিনকে, রবিন রেখে এল পাহাড়ের ধারে জিনার কাছে। এইভাবে খুব অল্প সময়েই বিছানা-বালিশ, নীচে বিছাবার প্ল্যাস্টিক শীট আর হরেক রকম খাবার ভরা শতখানেক ক্যান, কিছু তৈজসপত্র, একটা পোর্টেবল চুলো হাতে হাতে চলে এল জিনার কাছে; ব্যস্ত হাতে কার্নিশের নীচে সেগুলো গুছিয়ে রাখছে জিনা।
সবাইকে কাজ করতে দেখে কিকোও ঠোঁটে করে তাঁবু টাঙাবার গোটা কয়েক কাঠের গোজ এনে দিল জিনাকে। অবাক হয়ে ওর কাজ দেখছে। পাফিনগুলো, তাই দেখে গর্বের সঙ্গে সন্তুষ্টচিত্তে ডাক ছাড়ল কিকো, অররররররর, অ, অররর, ককক!
তবুটা টাঙানো হলো কার্নিশের ঠিক সামনে।
চার
সবকিছু গুছিয়ে রেখে, সবার বিছানা পাতা সারা হতে হতে বিকেল হয়ে গেল। ঘেমে নেয়ে উঠেছে তিন গোয়েন্দা। মুসা প্রস্তাব দিল, চলো, কয়টা ডুব দিয়ে আসি ঠাণ্ডা পানিতে।
চলো, বলল কিশোর, উফ, মনে হচ্ছে যেন চুলোর মধ্যে আছি!
সবার আগে ঘাড়ে তোয়ালে ফেলে উঠে দাঁড়ালেন আঙ্কেল। জিনা পানিতে নামল না, কিন্তু তীরে এসে দাঁড়াল কিকোকে নিয়ে। আধঘণ্টা মহানন্দে গোসল করে ক্লান্তি দূর হলো। পানি থেকে উঠে তাঁবুর বাইরে খেতে বসল সবাই।
খেতে খেতে গল্প করছে ওরা। হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল জিনা, আরে, আরে! দেখো কাণ্ড! সবাই তাকিয়ে দেখল, কাছের একটা গর্ত থেকে বেরিয়ে হেলেদুলে ওদের দিকে এগিয়ে আসছে একটা পাফিন। মনে হচ্ছে, টেবিলে। সাপার দিয়ে খেতে ডাকা হয়েছে!
অররররররর! জবাব দিল পাফিন।
হেসে উঠল সবাই। সোজা এসে থামল পাফিন অপ্রস্তুত, বিব্রত কিশোরের হাঁটুর কাছে। মাথা তুলে একদৃষ্টে চেয়ে রয়েছে ওর মুখের দিকে। বেরসিক কিশোরের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চায়।
লজ্জা পেলেও পাখিটার যেন অসম্মান না হয়, তাই ভেবে ওর ঘাড় চুলকে দিল কিশোর। অররররররর! বলে সন্তুষ্টি প্রকাশ করল পাফিন। কী করবে বুঝতে না পেরে একটুকরো স্যান্ডউইচ এগিয়ে দিল কিশোর ওর দিকে। কপ করে ওটা গিলে নিয়ে আর একটু কাছ ঘেঁষে এল সে। আরও চায়।
কিশোরের অবস্থা দেখে হেসে উঠল সবাই। রবিনও এবার একটুকরো মাংস এগিয়ে দিল, কিন্তু না, সবার কাছ থেকে খাবে কেন সে? রবিনের হাত থেকে নিয়ে কিশোর যখন এগিয়ে দিল, গিলে নিল বিনা দ্বিধায়। ওর নাম রেখে দিল জিনা-সখা। নামটা পছন্দ হলো সবারই। নিজেই চলে এসেছে সে বন্ধু হবে বলে, তাই ওর নাম সখা।
কিশোরের হাঁটুতে গা ঠেকিয়ে বসে থাকল সখা কিছুক্ষণ, তারপর কী মনে করে হেলেদুলে চলে গেল নিজের বাসায়। পরমুহূর্তে গর্ত থেকে বেরিয়ে এল সে তার বিবিসাহেবাকে নিয়ে। বিবিটা আকারে সামান্য ছোট, তবে ঠোঁটজোড়া অনেক বেশি রঙচঙে। কিশোরের গা ঘেঁষে বসল ওরা দুজন স্বভাবসুলভ গাম্ভীর্য বজায় রেখে। বিবিসাহেবার নাম রেখে দিল মুসা-সখি।
সবার মনোযোগ নবাগতদের দিকে বুঝতে পেরে বিরক্ত বোধ করল কিকো। মাথাটা একপাশে কাত করে কড়া চোখে তাকাল সে পাফিন-জোড়ার দিকে, হাতমুখ ধুয়ে আসতে বলল। নির্বিকার ভঙ্গিতে চেয়ে রইল ওরা। ওদের কাছে পাত্তা না পেয়ে অন্যদিকে ঘাড় ফিরিয়ে হাই তুলবার মত আওয়াজ করল কিকো।
দেখাদেখি হাই তুললেন আঙ্কেলও। অস্তগামী সূর্যের দিকে চেয়ে বললেন, সন্ধে হয়ে এল। নাহ! ক্লান্তি লাগছে তো খুব। বহুত খাটনি গেছে আজ। তোমরা জাগলে জাগো, আমি শুয়ে পড়লাম।
গরম লাগছে, আঙ্কেল, বলল মুসা। আমরা আর একটা ডুব দিয়ে আসি ঠাণ্ডা পানিতে।
আমারও তো লাগছে! বলে উঠে পড়লেন আঙ্কেল ডিকও। চলো, আমিও যাব।
জিনা রয়ে গেল। ঝরনার ধারে কটা কাপড় ধুয়ে ওখানেই স্নান সেরে নেবে। পাফিন জোড়া কিছুটা হেঁটে, কিছুটা উড়ে অনুসরণ করল ছেলেদের, এই শেষবিকেলে আর পানিতে নামল না, শান্ত ভঙ্গিতে তীরে বসে দেখছে ওদের কাজ-কারবার।