ওটাই ওদের ডুব-সাঁতার, বলল রবিন। দারুণ না? পা ব্যবহার করে কেবল পানির ওপরে সাঁতার কাটবার সময়। দ্বীপে নেমে…
আগে খেয়ে নেয়া যাক, বললেন ডিক কার্টার। তারপর একপাক ঘুরে দেখা যাবে বোট রাখার উপযোগী ভালো জায়গা পাওয়া যায় কি না।
অল্প পানিতে নোঙর ফেলে খেয়ে নিল ওরা দুপুরের খাবার। ভ্যাপসা গরমে ঘামছে সবাই। হঠাৎ কান খাড়া করল মুসা। কীসের আওয়াজ!
একটা প্লেনের শব্দ পাচ্ছি যেন? বলল মুসা আপন মনে।
চট করে উঠে দাঁড়ালেন ডিক কার্টার। বহুদূরে ঝিলিক দিল প্লেনের গা। ইঞ্জিনের ক্ষীণ শব্দটা এবার শুনতে পেল সবাই।
আশ্চর্য! এখানে প্লেন! বললেন ডিক। এদিকে তো প্লেন চলাচলের কোনও রুট নেই, এখানে কী করছে ওটা?
.
আঙ্কেলকে এত অবাক হতে দেখে সবাই তাকাল তার মুখের দিকে। রবিনের বিনকিউলারটা চেয়ে নিয়ে চোখে তুললেন ডিক। কিন্তু ততক্ষণে মেঘের আড়ালে চলে গেছে উড়োজাহাজ, দেখা গেল না।
সী প্লেন, না কি সাধারণডাঙার? নিজেকেই যেন প্রশ্ন করলেন ডিক। সত্যিই আশ্চর্য!
কেন? আশ্চর্য কেন? প্রশ্ন তুলল জিনা। আজকাল তো প্লেন সবখানেই যাচ্ছে।
জবাব দিলেন না ডিক কার্টার। বিনকিউলার ফেরত দিলেন রবিনকে। দ্বীপটার চারপাশে পুরো একপাক ঘুরবার আগেই পশ্চিম পাশে বোট রাখবার মত একটা জায়গা পাওয়া গেল। সরু একটা চ্যানেল। পাথুরে দুই পাড়ের মাঝে অনায়াসে একটা বোট ঢুকবার মত চওড়া ফাটল। পানি যথেষ্ট গভীর। দেখামাত্র জায়গাটার নাম রেখে দিল ওরা গোপন চ্যানেল।
এখানে রাখলে বাতাসের পুব-পশ্চিম দুদিকের ঝাঁপটা থেকেই রক্ষা পাবে বোট, বললেন আঙ্কেল। তা ছাড়া পানিতে নামবার ঝামেলা নেই, ডেক থেকে পা বাড়ালেই পাহাড়ের ওই তাকটা ডিঙিয়েই ওঠা যাচ্ছে দ্বীপে।
পাহাড়ি দ্বীপ, কিন্তু পুবদিকে ঢালু হয়ে ক্রমে প্রায়-সমতল হয়ে গেছে। তারপর আবার একটা মাঝারি আকারের পাহাড়। একটা অগভীর ঝরনাও দেখা গেল, সামনের পাহাড় থেকে নেমে সাগরে গিয়ে পড়েছে।
বোটটাকে দুপাশের দুটো পাথরের সঙ্গে কষে বেঁধে নাক কুঁচকালেন আঙ্কেল। বাপরে-বাপ! ভয়ানক দুর্গন্ধ তো! পুব-দক্ষিণে চলো, দেখি দুর্গন্ধমুক্ত এলাকা পাওয়া যায় কি না। নইলে টেকা যাবে না, পালাতে হবে এখান থেকে।
সামনে পা বাড়াতেই উপরের কোনও তাক থেকে ঠাস করে ডিম পড়ল একটা আঙ্কেলের পায়ের কাছে, জুতোয় ভরল হলুদ কুসুম! উঁচু তাকের উপর জায়গার দখল নিয়ে ঝগড়া চলছে গ্যানিট আর গিলিমটের মধ্যে। তারই ফলশ্রুতিতে এই বোমাবর্ষণ। উপর দিকে মুখ তুলে চেঁচিয়ে প্রশংসা করলেন আঙ্কেল, গুড শট, মম্!
হেসে উঠল সবাই। সামনে এগোল ওরা। উঠে গেল পাহাড়ের চড়ায়। ওখানে দাঁড়িয়ে দূরে দূরে ছড়ানো ছিটানো অনেকগুলো দ্বীপ দেখা গেল। উঁচুতে থাকায় চারপাশটা দেখেশুনে দিক বাছাই করতে সুবিধে হলো। ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করেই দুই পাহাড়ের মাঝখানের সী-পিঙ্ক আর হিদারের ঝোপে ছাওয়া উপত্যকায় পাফিনদের বাসা দেখতে পেল ওরা। হাজার হাজার গর্ত খুঁড়ে মাটির নীচে কলোনি বানিয়েছে ওরা।
ঠোঁটগুলো খেয়াল করেছ? জিনা বলল, দেখার মত না?
বিরাট, বলল মুসা। কিছুটা কিকোর মত।
সেজন্যেই এদের আরেকু নাম সী-প্যারট, বলল রবিন। দেখেছো, একটু ভয় পাচ্ছে না মানুষ দেখে!
কিংবা আমাদের মানুষ বলে গণ্য করছে না! টিপ্পনি কাটল মুসা। প্যাটপ্যাট করে চেয়ে রয়েছে কেমন, দেখো? আর দুলে দুলে হাঁটারই বা কী স্টাইল!
আর এই যে, দেখো, দেখো, বলল জিনা। ইনি হচ্ছেন পাফিনদের মুসা আমান, খিদে লেগেই আছে পেটে-চললেন সাগরে মাছ ধরে খেতে।
কয়েকটা পাফিনকে দেখা গেল, ব্যস্ত ভঙ্গিতে পা দিয়ে মাটি আঁচড়াচ্ছে, বাসা বানাবে মাটির নীচে। ফোয়ারার মত মাটি ও বালুকণা ছিটকে পড়ছে পিছন দিকে।
আমার মনে হয় গোটা দ্বীপটাই ফোঁপড়া করে দিয়েছে ওরা বাসা বানিয়ে বানিয়ে, বললেন ডিক। সাবধানে পা না ফেললে গর্তে পড়ে পা মচকাবে।
অররররররর, অ, অররর, ককক!
গম্ভীর, মোটা, কর্কশ গলায় ডাকছে ওরা। মুসার কাঁধে বসে অবিকল একই সুরে জবাব দিল কিকো। কয়েকটা পাফিন ঘাড় বাঁকিয়ে অবাক, নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে দেখল কিকোকে। ওদের এগোতে দেখে একটা পাফিনও নিজের জায়গা ছেড়ে নড়ল না। এঁকেবেঁকে সাবধানে চলতে হচ্ছে ওদের, পাছে কারও গায়ে পা লেগে বেয়াদবি হয়ে যায়!
কিন্তু বেয়াদবি হয়েই গেল। চলতে চলতে হঠাৎ হাত-খানেক সেঁধিয়ে গেল মুসার পা, মুহূর্তমাত্র দেরি না করে ঠোকর দিল ভিতরে বিশ্রামরত ক্রুদ্ধ পাফিন।
ওরেব্বাপ! গেছি রে! বলে সড়াৎ করে পা বের করে নিল ও। লাল হয়ে গেছে জায়গাটা। সাবধানে এগোল সে এবার।
চারদিকে শুধু নানান সুরে অররররররর, অরর, ককক! শব্দ। গর্তের। ভিতরে, বাইরে, আকাশে, সাগরে-সবখানে এই একই আওয়াজ। নিচু, মোটা গলায় ডেকে চলেছে হাজার-হাজার পাফিন।
উপত্যকা পেরিয়ে দ্বীপের পুব দিকে আরেক পাহাড়ের কাছে চলে এল ওরা, খুঁজছে ক্যাম্প করবার মত উপযুক্ত জায়গা। ঝরনার ধারে পাহাড়ের গা। ঘেঁষে একটা জায়গা পছন্দ হলো জিনার। সবাই বসে পড়ল ওখানে। ঠিক হলো, এখানেই তাঁবু টাঙাবে ওরা। পাহাড়ের গা থেকে চওড়া একটা কাশি বেরিয়ে থাকায় নীচটা স্টোর হিসাবে ব্যবহার করা যাবে। তা ছাড়া পুব দিক থেকে ঝড়-বৃষ্টি এলে পৌঁছবে না ওখানে। চমৎকার আশ্রয় পাওয়া যাবে।