এত কীসের? বলল সে। অর্ধেকও তো দাম হয় না এই সামান্য জিনিসের। তা ছাড়া, বাড়ির তৈরি জিনিস, মাছগুলো আমার নিজের ধরা। এত টাকা তো নিতে পারব না, বাছা!
সব তোমাকে কে দিচ্ছে, মুরুব্বি? বললেন আঙ্কেল। তোমার গিন্নির খাটনির জন্যে বাকি অর্ধেক। যাও এখন, রওনা হওয়ার সময় গোলমাল কোরো না তো!
বোট ছেড়ে দিল ওরা। তীরে দাঁড়িয়ে হাত নাড়ল জেলে-বুড়ো, মুখে। হাসি। দু-ঘণ্টা চলবার পর দূরে দেখা গেল ছড়ানো ছিটানো অনেকগুলো দ্বীপ। ওগুলোর উপর উড়ছে হরেক জাতের পাখি। চোখে বিনকিউলার তুলল রবিন।
বাতাসটা আজ আর ঠাণ্ডা নয়, রোদের তেজ টের পাওয়া গেল কিছুক্ষণ পরেই। কেমন একটা ভ্যাপসা গরম। আঙ্কেলকে বারবার আকাশের দিকে চাইতে দেখে তিন গোয়েন্দা বুঝল, ঝড়-তুফানের ভয় করছেন তিনি।
চওড়া ব্রিমের একটা হ্যাট মাথায় দিয়ে বোটের কিনারে বসে একহাত পানিতে ডুবিয়ে রেখেছে জিনা। মাঝে মাঝে হাত তুলে মুখে পানির ছিটে দিচ্ছে। তাই দেখে মুসা বলল, চারদিকে চোখ-কান খোলা রেখো, জিনা। আশপাশে হাঙর থাকলে কখন কুচ করে কেটে নেবে হাতটা, টেরও পাবে না।
সড়াৎ করে হাত তুলে নিল জিনা। তাকাল আঙ্কেল ডিকের মুখের দিকে। তাকে হাসিমুখে মাথা নাড়তে দেখে মুসার উদ্দেশে একবার ভ্রুকুটি করে আবার হাত দিল পানিতে। দিয়েই সঙ্গে সঙ্গে তুলে নিল আবার।
কী যেন ঠেকল হাতে! বলে ঘাড় ফিরিয়ে দেখল, পানিতে ভাসতে ভাসতে চলে যাচ্ছে একটা কমলার খোসা। জেলিফিশ মনে করে ভয় পেয়েছিল। হেসে দৃষ্টি আকর্ষণ করল আঙ্কেলের, আঙুল তুলে দেখাল খোসাটার দিকে।
খোসাটা দেখে হাসলেন না আঙ্কেল।
আরে! এখানে, সাগরের মাঝখানে, এটা আসে কী করে! নিশ্চয়ই জেলেরা কমলা নিয়ে আসবে না মাছ ধরতে? আরও কেউ কি এসেছে এদিকে পাখি দেখতে? একটু যেন চিন্তায় পড়লেন আঙ্কেল। নাহ, তারা কমলার মত ভারী ফল বইতে যাবে কেন?
কমলার খোসাটা বেশ অনেকক্ষণ ভাবাল ডিক কার্টারকে।
পাখির রাজ্যে চলে এসেছে ওরা। এখন কেবল পছন্দমত একটা দ্বীপ বাছাই করা।
দেখা গেল, ওদেরকে মোটেও ভয় পাচ্ছে না পাখিগুলো। বরং কৌতূহলী হয়ে কাছে এসে ভালো করে দেখছে। পাগল হওয়ার দশা হলো রবিনের। বিনকিউলার আর নামাচ্ছে না চোখ থেকে। পটাপট নাম বলছে, এই যে, এটা রেযারবিল; ওই দেখো, লিটল অক; আরে…আরে, একটা শ্যাগ ডাইভ দিয়ে। পড়ল পানিতে, দেখো, দেখো পানির নীচেও পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে ওটাকে, এই ধরল মাছ! উঠে আসছে এবার!
সবাই হাসছে ওর কাণ্ড দেখে। শক্তিশালী বিনকিউলার দিয়ে ও যা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে, খালি চোখে আর সবাই সেটা দেখবে কী করে!
ই-ই-উ-উ-উ! ই-ই-উ-উ-উ! মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে একটা গ্রেট গাল। পাখার বিস্তার কমপক্ষে চারফুট।
কিকোর শখ হলো ওটাকে একটু শাসন করবে। বিশ-পঁচিশ ফুট উঠে শূন্যে একটা ডিগবাজি খেয়েই ছেড়ে দিল মুখ। দরজা বন্ধ করা, পা মুছে ঘরে। ঢোকা থেকে শুরু করে চোপরাও, একদম চুপ পর্যন্ত বলে গেল। ঘাবড়ে গিয়ে আরও উপরে উঠে গেল গ্রেট গাল, ডেকে উঠল আবার, ই-ই-উ-উ-উ!
অবিকল নকল করল কিকো ডাকটা। তাই শুনে ছোট একটা চক্কর দিয়ে ভালো করে দেখবে বলে কিকোর দিকে এগিয়ে এল গালটা। অত বড় পাখিটা কাছে চলে আসছে দেখে ভয় পেল এবার কিকো। বাবারে, গেছি! বলে ডাইভ দিয়ে এসে মুসার কাঁধে বসে পড়ল। বিস্মিত গ্রেট গাল আর একপাক ঘুরে মাথা কাত করে দেখল কিকোকে, তারপর চলে গেল নিজের কাজে।
গাধা কোথাকার! বকা দিল ওকে মুসা। বাহাদুরি দেখাতে গিয়ে মরবি একদিন ওদের হাতে! যেদিন ছিঁড়ে কুটিকুটি…
তুই চুক কর্! পাল্টা ধমক মেরে থামিয়ে দিল সে মুসাকে। ডিক কার্টারের দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে বলল, আঙ্কেল, পড়তে বসো। কোনও কথা শুনতে চাই না আমি!
দ্বীপটার কাছাকাছি এসে পাখির কলরবে কান ঝালাপালা হওয়ার দশা হলো ওদের। পাথরের একটা টিলা ছেয়ে আছে হাজার হাজার পাখিতে। বেশির ভাগই ধবধবে সাদা গ্যানিট আর বাদামি গিলিমট। হাঁ করে চেয়ে দেখল ওরা পাখির আনাগোনা। দলে দলে ফিরে আসছে পাখি, দলে দলে চলে যাচ্ছে। সাগরে মাছ ধরতে।
এখানে ক্যাম্প করতে রাজি হলো না রবিন। ওর টার্গেট পাফিন। পাফিন কলোনিতে নেমে ওদের জীবনযাত্রা আর বিচিত্র কর্মকাণ্ডের ছবি তুলতে চায় ও কাছ থেকে।
একের পর এক অনেকগুলো দ্বীপ দেখল ওরা। একেক দ্বীপে একেক ধরনের পাখির আধিক্য। সূর্য যখন ঠিক মাথার উপর, তখন পাওয়া গেল পাফিনদের কলোনি।
মহা উত্তেজিত হয়ে উঠল রবিন। পারলে লাফিয়ে নেমে যায় বোট থেকে। আরি সর্বনাশ! দেখো, কিশোর, টাটেড আর হড়, দুরকম পাফিনই আছে! কপাল ভালো আমাদের। এত দক্ষিণে হর্নড পাফিন সাধারণত আসে না-ঠাণ্ডা এলাকা পছন্দ ওদের, অ্যাটলান্টিক পাফিনদের মত।
কোনটা টাফটেড আর কোনটা হর্নড? জিজ্ঞেস করল মুসা। চোখ টিপল কিশোরের দিকে চেয়ে।
টাফটেডগুলোর সারা গা কালো, শুধু মুখটা সাদা; উজ্জ্বল- হলুদ, লম্বা ঠোঁট, ঠোঁটের আগাটা লাল; চোখের চারপাশে হলদেটে চক্কর আঁকা। আর হর্নড় পাফিনের পিঠ কালো, কিন্তু বুক-পেট সাদা, ঠোঁটের রং প্রায় একই, তবে দুপাশে কিছুটা নীলচে ভাব আছে।
আরে! চেঁচিয়ে উঠল জিনা। পানির নীচে পাখা ঝাঁপটাচ্ছে কেন? মনে হচ্ছে উড়ছে!