আকাশ পরিষ্কার। দিগন্তবিস্তৃত স্বচ্ছ, নীল প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে বিন্দুর মতই ছোট ওরা। চারপাশে কেউ নেই, কিছু নেই। মনের মধ্যে বাঁধন কেটে বেরিয়ে পড়বার উল্লাস। খুশিতে শিউরে উঠল তিন গোয়েন্দা আর জিনা। সবাই বুঝল সবার মনের অবস্থা, হাসল একসঙ্গে।
খাইছে! বলল মুসা, পুকুরটা বেশ বড় তো!
পাঁচ মিনিটেই ফিরে এলেন আঙ্কেল ডিক তার ঝকঝকে টাক আর গালভরা হাসি নিয়ে। সাবধান করলেন সবাইকে, কোট খুলেছ, ঠিক আছে; কিন্তু ভুলেও কেউ রোদ লাগিয়ো না গায়ে। বাতাস যদিও ঠাণ্ডা, রোদটা ভীষণ কড়া: জ্বালিয়ে দেবে চামড়া, একেবারে ফোস্কা ফেলে দেবে!
সামনে যতদূর দেখা যায় সুনীল সাগর। অলস ভঙ্গিতে আকাশ পাড়ি দিচ্ছে সাদা মেঘ, যেতে যেতে পাল্টাচ্ছে আকার-আকৃতি-ভালুক হয়ে যাচ্ছে। গণ্ডার, কিংবা হাতি; তারপর হয়তো দাড়িসহ সান্তা ক্লজ বা আব্রাহাম লিঙ্কন।
শোনো, গোয়েন্দাসকল! বক্তৃতার ঢঙে শুরু করলেন ডিক কার্টার। হাওয়ায় ফুলে আছে তার সাদা শার্টের পিঠ। মনে রাখবে, ছুটি কাটাতে এসেছি আমরা এবার এখানে, গা শিউরানো কোনও রোমহর্ষক রহস্যের খোঁজে নয়। ঠিক আছে? রহস্য-রোমাঞ্চ অনেক হয়েছে। গত তিন-তিনবার যখনই। আমরা একসঙ্গে হয়েছি, ঘাড়ে চেপে গেছে বিপদ আর ভয়ঙ্কর সব অভিজ্ঞতা। এইবার অন্তত আমরা ছুটিটা কাটাতে চাই শান্তিতে। ঠিক আছে?
হিয়ার, হিয়ার! বলল রবিন। আমরাও তাই চাই। সবসময়ে তাই চেয়েছি। কিন্তু আমাদের রাশির দোষ, কী করে যে বিপদ-আপদ এসে জোটে…
দ্বীপ কোথায়? জিজ্ঞেস করল জিনা। কাছে-পিঠে একটাও তো দেখা যাচ্ছে না।
কাল সকালে উঠে দেখবে দ্বীপের অভাব নেই, বললেন আঙ্কেল। কোটায় উঠতে চাও, সিদ্ধান্ত নেবে তোমরাই।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো, তারপর সঁঝ হয়-হয়। রঙের ছোপ লাগতে শুরু করেছে সাদা মেঘের গায়ে। রাতের খাবার খেয়ে নিল ওরা একটু সকাল সকালই। ক্যাবিনের স্টোরে টাটকা পাউরুটি পাওয়া গেল, সেই সঙ্গে রয়েছে। বড়সড় একটা চকোলেট কেক আর স্ট্রবেরি জ্যামের শিশি।
কাল বাসি হয়ে যাবে, বললেন আঙ্কেল, পাউরুটি আর কেক আজই শেষ করে ফেলো। এখানে কোনও দ্বীপে কোনও ফার্মহাউস আছে কি না জানি, থাকলেও সেখানে টাটকা রুটি পাওয়া যাবে কি না কে জানে। না পেলেও অবশ্য কিছু এসে যায় না, আমাদের স্টোরে, বিস্কিটের টিনের অভাব নেই। তবে ধরে নিতে পারো, দুই সপ্তাহের মধ্যে চকোলেট কেক আর মিলছে না।
জিনা টোস্ট করে নিয়ে এল পাউরুটি, সবাই মিলে মজা করে খেল জেলি। আর মাখন লাগিয়ে নিয়ে। ভেড়ার মাংসের দুটো টিন খুলে নিয়ে সেটাও চলল পাশাপাশি। পেট পুরে খেল সবাই। আরও টিন খোলা হবে কি না জানতে চাইলে সবার আগে হাত জোড় করল মুসাই-আর জায়গা নেই পেটে। তারপর একগ্লাস পানি খেয়ে চা করে আনল সে সবার জন্য।
সোনালী আলোয় বিশ্ব-চরাচর রাঙিয়ে দিয়ে অস্ত গেল সূর্য। পশ্চিম সাগরটাকে মনে হচ্ছে তরল সোনা। কিশোরের হাতে হুইল দিয়ে ম্যাপ খুললেন ডিক। এই হচ্ছে সান্তা রোযা। এর পরেই দেখা যাচ্ছে একটা পাথুরে দ্বীপ। ছোট একটা জেটিও আছে। কিছু লোকজনও আছে এখানে। আমরা আজকের মত এখানেই বোট ভিড়াতে পারি। তাঁবু আছে সঙ্গে, রাতটা ডাঙায়। কাটিয়ে কাল সকালে মনের মত দ্বীপের খোঁজে বেরিয়ে পড়া যাবে। কী বলো তোমরা?
সবাই একবাক্যে রাজি।
বাতাস ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। সবাই কোট চড়াল গায়ে। সাগরের নীল রঙটা এখন বদলে সবজে-ধূসর হয়ে গেছে। ম্যাপের সেই পাথুরে দ্বীপটা দেখা দিল এই সময়ে। দশ মিনিটের মধ্যে দ্বীপের পাথুরে জেটিতে গিয়ে ভিড়ল মোটর বোট। জেটিতে দেখা হলো এক বৃদ্ধ জেলের সঙ্গে। এই অসময়ে বোট ভিড়তে দেখে বিস্ময়ে বিস্ফারিত হয়ে গেছে তার চোখ। অল্প কথায় তাকে বুঝিয়ে বলল আঙ্কেল তাদের উদ্দেশ্য। স্বস্তির ভাব ফুটল জুেলের চেহারায়।
ও, তাই বলেন। পাখ-পাখালি দেখতে এসেছেন। আঙুল তুলল সে, উ উ-ই যে, ওদিকে হাজার-হাজার, না, লাখ-লাখ পাখি দেখতে পাবেন। তা, আজ রাতে থাকবেন কোথায়? আমার বাড়িতে এত লোকের জায়গা হবে না।
তাঁবু আছে আমাদের কাছে, বললেন আঙ্কেল। ডিনারও সেরে নিয়েছি সাগরে। তুমি যদি কাল সকালে খানিকটা খাঁটি দুধের ব্যবস্থা করতে পার, তা-ই আমাদের বিরাট উপকার হবে। মালাই আর টাটকা মাখনও নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে তোমাদের এখানে, তাই না? এ প্রচর, প্রচর, বলল জেলে। আমি গিয়ে বউটাকে বলি। কাল সকাল সাতটার মধ্যে পেলে চলবে তো?
চলবে। আমরা এবার তা হলে ঘুমাবার ব্যবস্থা করে ফেলি। ঠিক কোথায়। তাঁবু গাড়লে ভালো হয়, বলো তো, মুরুব্বি?।
জায়গা দেখিয়ে দিল বৃদ্ধ জেলে। তারপর ছুটল বাড়ির দিকে।
তিন
পরদিন সকালে জেলে-বউয়ের পাঠানো পুরু করে সর দেওয়া পরিজ, বিশটা হাত-রুটির সঙ্গে গোটা দশেক গরমাগরম ভাজা রূপচান্দা মাছ, সের দুইয়েক ভেড়ার মাংসের সিককাবাব, এক জগ ভর্তি খাঁটি গরুর দুধ, আর প্ল্যাস্টিকের দুটো ঠোঙায় ঘরে তৈরি মাখন ও পনির নিয়ে হাজির হলো বুড়ো। পাঁচজনে পেট পুরে খাওয়ার পরেও বেঁচে গেল অনেক। জিনা সেগুলো তুলে রাখল বোটের ফ্রিজে।
তাঁবু খুলে বিছানা-বালিশ মোটর-বোটে উঠিয়ে ফেলল তিন গোয়েন্দা। রওনা হওয়ার আগে বুড়োর হাতে টাকা দিতেই চমকে উঠল সে। অর্ধেকটা বাড়িয়ে ধরল ফেরত দেবে বলে।