প্রথমে ধূসর হলো, তারপর অল্পক্ষণেই হয়ে উঠল তরল সোনা।
হঠাৎ করেই অসংখ্য পাখির কলকাকলিতে ভরে উঠল চারপাশ। গিলিমট, করমর্যান্ট, গ্যানিট, পাফিন আর সীগাল বেরিয়ে এল যার-যার বাসা থেকে। গলা ফাটিয়ে চেঁচাচ্ছে, আর ঝপাঝপ নামছে পানিতে। নেমেই ডুব। খিদে নাস্তা দরকার!
অবাক হলো রবিন। এত পাখি তো ছিল না গতকাল! উঠে বসেই তাজ্জব হয়ে গেল সে।
আরে! এ কোথায় আছি আমরা? এটা তো সেই লেগুন-দ্বীপ না! ভুল দ্বীপের ডুবো-পাথরের ওপর চড়ে বসে আছি! আমাদের ন্যাভিগেটর সাহেব গেল কোথায়?
তাই তো! উঠে বসল মুসা। রাতে মনে হচ্ছিল শহরের রাস্তাঘাট সব চেনা হয়ে গেছে আমার। এখন দেখছি সম্পূর্ণ ভুল শহরে নিয়ে এসেছি বোট!
নাহ, ঝালাপালা করে দিল কান! এই চেঁচামেচিতে ঘুমানো যাবে না! বলে উঠে পড়লেন ডিক কার্টার। বোটটা কোথায় ঠিক কীভাবে আটকাল দেখে ফিরে এলেন ডেকে। বললেন, ক্ষতি হয়নি বোটের। তবে ভালো মতই ফেঁসেছে, জোয়ার না আসা পর্যন্ত বসে থাকতে হবে এখানেই। অবশ্য জোয়ার এলেই বা কী লাভ? দাঁড় বেয়ে তো আর সাগর পাড়ি দেয়া যায় না।
অথচ ওরা আমাদের খোঁজে বোট বা প্লেন পাঠানোর আগেই একটা কিছু করা দরকার, বলল মুসা।
কী সেটা? প্রশ্ন রবিনের।
চোখ মেলল কিশোর। বলল, কী আবার! ভালো করে খুঁজে দেখা। ফিরে যাওয়ার মতো যথেষ্ট পরিমাণে তেল না নিয়ে সমুদ্রযাত্রায় বেরিয়ে পড়েছেন আইনস্টাইন, তা হতেই পারে না। নিশ্চয়ই কোথাও লুকানো আছে তেল।
ঠিক বলেছ, কিশোর, এক লাফে উঠে দাঁড়াল রবিন ও জিনা। তেল না থেকেই পারে না!
সবাই মিলে খুঁজতে গিয়ে ডেকের দুটো তক্তা তুলে চারটে তেলের টিন পেল মুসা, আর ডিক কার্টার পেলেন আইনস্টাইনের ট্রান্সমিটারটা। এমন জোরে চেঁচিয়ে উঠলেন যে, সবাই ভয় পেল: এই বুঝি এসে পড়ল শত্রুপক্ষের বোট।
এটা তোমাদের চোখে পড়েনি, কিশোর?
পড়েছে তো, বলল কিশোর। জিনা খুঁজে বের করেছিল ওটা। কিন্তু ঘাটাঘাটি করতে সাহস পাইনি। যদি ভুল করে শত্রুদের আস্তানাতেই মেসেজ পাঠিয়ে বসি! তারপর স্রেফ ভুলে গেছি ওটার কথা।
আচ্ছা। এবার এটার এরিয়ালটা খুঁজে বের করো দেখি। ওটা পেলে চেষ্টা করে দেখা যেত কোনও মেসেজ পাঠানো যায় কি না। কারও চোখে পড়েছে, ছয়-সাত ফুট লম্বা রডের মতো দেখতে…
ওই তো, পিছনের ওই শেলফে দেখেছি আমি ও-রকম একটা জিনিস, বলল জিনা। রডটা বের করে আনল ও। ওটা দেখেই একগাল হাসি ফুটল আঙ্কেল ডিকের মুখে।
দেখা যাক এটা দিয়ে কাজ হয় কি না, বলে ট্রান্সমিটার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন ডিক কার্টার।
অল্পক্ষণেই ভুরু জোড়া কুঁচকে গেল তার। কিছু একটা গোলমাল আছে যন্ত্রটায়। খড়খড় আওয়াজ করল, লাল-নীল-সবুজ বাতি জ্বলল এখানে-ওখানে, কিন্তু না কোনও মেসেজ গেল, না এল। অনেক ভাবে চেষ্টা করলেন তিনি। নিজের কোড নাম্বার জানিয়ে বার বার মেসেজ পাঠালেন, লোকেশন দিলেন, উত্তরের জন্য অপেক্ষা করলেন, কিন্তু কোনও সাড়া মিলল না। রেডিওটা খারাপ, না কি ট্রান্সমিটার-রেডিও দুটোই খারাপ বোঝা গেল না। সকাল থেকে দশটা পর্যন্ত চেষ্টা করে শেষে হাল ছেড়ে দিলেন তিনি।
বেলা এগারোটার দিকে এল জোয়ারের প্রথম ঢেউ। ততক্ষণে চার টিন তেল থেকে দুই টিন ঢালা হয়ে গেছে ট্যাঙ্কে। ডেকে উঠে এসে বিনকিউলারটা চোখে তুলেই চমকে গেল রবিন। বহুদূরে ছোট্ট একটা বিন্দুর মত দেখা যাচ্ছে। কী যেন।
মুসা! ডাকল ও আতঙ্কিত কণ্ঠে, দেখো তো কী ওটা?
ছুটে এসে বিনকিউলার চোখে তুলল মুসা। ফোকাস অ্যাডজাস্টা করে বলল, একটা বোটের মতই তো দেখা যাচ্ছে মনে হয়!
দেখি, আমাকে দাও, বলে মুসার কাছ থেকে নিয়ে চোখে তুললেন ডিক কার্টার। পরমুহূর্তে রক্ত সরে গেল তার মুখ থেকে। সেরেছে! এইদিকেই তো আসছে সোজা!
জোয়ারের চতুর্থ ঢেউয়ের সঙ্গে দুলে উঠল ওদের বোট, পঞ্চম ঢেউটা আসতেই আলগা হয়ে ভেসে উঠল পাথরের উপর থেকে। সঙ্গে সঙ্গে ইঞ্জিন। চালু করল কিশোর, রিভার্স গিয়ার দিয়ে কয়েক গজ পিছিয়ে নিল বোট। তারপর নাকটা ঘুরিয়ে নিয়ে ছুট লাগাল যেদিক থেকে শত্রুপক্ষের বোট আসছে তার উল্টো দিকে। যতক্ষণ ওদের নাগালের বাইরে থাকা যায়–সেই চেষ্টা ছাড়া আর কিছু করবার নেই এখন ওদের। যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ।
দুপুর সাড়ে-বারোটার দিকে দুইশো গজের মধ্যে চলে এল পিছনের মোটর-বোট। ঠিক তখনই এলো প্রথম গুলিটা। রাইফেল চালাচ্ছে ওরা পলায়নপর বোট লক্ষ্য করে।
সবাইকে ডেকের উপর শুয়ে পড়বার নির্দেশ দিয়ে হুইল ধরলেন আঙ্কেল নিজে। যতটা সম্ভব নিচু হয়ে রয়েছেন তিনি গুলি এড়াবার জন্য। ওদেরকে লক্ষ্যভ্রষ্ট করবার উদ্দেশ্যে এঁকেবেঁকে বোট চালাচ্ছেন তিনি এখন। বেলা একটার দিকে একশো গজের মধ্যে এসে গেল পিছনের বোট। গুলিগুলো খুব কাছ দিয়ে পাশ কাটাচ্ছে এবার। দু-একটা খট শব্দে লাগছে এসে বোটের গায়ে।
এমনি সময়ে আরেকটা জোরালো শব্দে আকাশের দিকে চোখ তুলে তাকাল ওরা চারজন। পুব দিক থেকে উড়ে আসছে বিরাট এক সী-প্লেন!
দপ করে নিভে গেল ওদের সব আশা-ভরসা। এক রামে রক্ষে নেই, সুগ্রীব দোসর! পিছনে চেয়ে অবাক হলো ওরা, বেশ অনেকটা পিছিয়ে পড়েছে শক্রদের মোটর-বোট। মাথার উপর জোর আওয়াজ তুলে একটা পাক দিল সী-প্লেন, তারপর নেমে পড়ল সাগরে। জিনার মনে হলো, গতকালকের অস্ত্র উদ্ধারকারী সী-প্লেনটাকে এবার লাগানো হয়েছে ওদের পিছনে।