সত্যিই আপনি জানেন না ওরা কী চোরাচালান করছে? জিজ্ঞেস করল রবিন।
চোরাচালান করছে…তাই তো জানি না! অবাক হয়ে রবিনের মুখের দিকে চাইলেন আঙ্কেল। আমি শুধু জানি বে-আইনী কিছু করছে। প্রচুর টাকা কামাচ্ছে। আন্দাজ করেছিঃ সম্ভবত অস্ত্র। কিন্তু তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে, তোমরা আমার চেয়ে অনেক বেশি জানো। এবার তোমাদের গল্প শোনাও দেখি।
আপনারটা আগে শেষ হোক, বলল রবিন। আইনস্টাইন গিয়ে আমাদের নামে কী বলল?
আর বোলো না! এপাশ-ওপাশ, মাথা দোলালেন আঙ্কেল। প্রথমে তো বুঝতেই পারছিলাম না কী ব্যাপার। আমার সহযোগী হিসেবে তোমাদের না এনে এমন একজন লোককে ধরে নিয়ে এসেছে, যাকে জীবনে দেখিনি কোনদিন। আমরা দুজন যত অবাক হই ওরা ততই মুচকি হাসে। তারপর ধীরে ধীরে জানা গেল, কয়েকটা অসম্ভব পাজি বদমাশ ছেলেমেয়ের পাল্লায় পড়েছিল সে পাফিন-দ্বীপে। বুঝলাম কাদের কথা বলছে, কিন্তু মুখ বন্ধ রাখলাম। আস্ত পিশাচ হিসেবে বর্ণনা করল ও তোমাদের। এমন ছেলেমেয়ে নাকি সে জীবনে দেখেনি।
লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করল মুসা।
আসলে ভুল হয়েছিল আমাদের। আমরা ধরেই নিয়েছিলাম উনি শত্রুপক্ষের লোক, মিথ্যেকথা বলে আমাদের ভুলিয়ে-ভালিয়ে নিয়ে গিয়ে বন্দি করার জন্যে পাঠানো হয়েছে ওঁকে।
কাজেই আমরাই বন্দি করেছি ওঁকে, বলল জিনা। ল্যাঙ মেরে ফেলেছি। একটা গর্তে…
তারপর ওঠার চেষ্টা করলেই খটাং করে লাঠির বাড়ি মেরেছি ওর চাঁদিতে, তাই না? বললেন আঙ্কেল ডিক। আমি কল্পনাও করতে পারি না তোমাদের পক্ষে এমন রক্তপিপাসু পিশাচ হয়ে ওঠা সম্ভব। উনি বললেন মেয়েটাই নাকি মেরেছে বেশি!
হায়, খোদা! একেবারে আসমান থেকে পড়ল জিনা। কী মিথ্যুক! বিশ্বাস করেন, আঙ্কেল, আমরা কেউ ওকে একটা টোকাও দিইনি। হ্যাঁ, ভয় দেখিয়েছি, তাও আমি না, মুসা। কিন্তু…
ছেলেরা শত্রু মনে করে একটা-দুটো ঘা লাগালে আমি অবাক হতাম না, কিন্তু তুমি মেরেছ শুনে আমি তো তাজ্জব। যাই হোক, ওর ভাষ্য হলো: ওকে মেরে-ধরে গর্তে আটকে ওকে ডাকাতের হাতে ফেলে দিয়ে তোমরা ওর বোট নিয়ে পালিয়ে গেছ। সত্যি কথা বলতে কী, ওর সব কথা শুনে হাসি চাপতে পারিনি আমি। মানতেই হবে, গাটস আছে তোমাদের।
শত্রুরা ওর একটা কথা বিশ্বাস করেনি, সোজা ধরে নিয়ে এসেছে। এখানে। এখনও ওদের বিশ্বাস: ও ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চের জাদরেল কোনও অফিসার, ছদ্মবেশে আছে।
লোকটা একে মিথ্যুক, ভীতু, কাপুরুষ; তার ওপর বুন্ধু! খেপে গেছে জিনা। এই লোক পাশ করে প্রফেসর হলো কী করে? আমি হলে তো ওকে দশে তিন নম্বরও দিতাম না!
লোকটা যদি চিৎকার না দিত, বলল কিশোর, তা হলে আজ আমরা এই বিপদে পড়তাম না। দিব্যি শত্রুপক্ষের বোট নিয়ে এতক্ষণে পেরিয়ে যেতে পারতাম অর্ধেক পথ। ও-ও বাচত, আমরাও বাঁচতাম।
ঠিক। এবার বলো শুনি তোমরা কী কী করলে।
রবিনকে কনুই দিয়ে গুঁতো দিল জিনা। শুরু করল রবিন।
শুনতে শুনতে ছানাবড়া হয়ে গেল আঙ্কেলের চোখ। লেগুনে অস্ত্র লুকানোর কথা শুনে রীতিমত উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। চোরাচালানীদের গোটা অপারেশনটা পরিষ্কার হয়ে গেল তার কাছে।
ইশ্শ্! একটা মেসেজ যদি পাঠাতে পারতাম এখন হেড-অফিসে! মাল সহ হাতে-নাতে ধরে ফেলতাম সব কটাকে! যাই হোক, তোমাদের সত্যি তুলনা হয় না! কেবল ভালো বলে প্রশংসা করলে অর্ধেকও বলা হয় না–সেই সঙ্গে তোমরা বুদ্ধিমান আর দুর্দান্ত সাহসী!
গোটা ব্যাপারটায় আমরা যেমন রোমাঞ্চ অনুভব করেছি, বলল কিশোর, তেমনি একেক সময় ভয়ও পেয়েছি সাঙ্ঘাতিক।
রীতিমত গর্ব বোধ করছি আমি তোমাদের জন্যে, বললেন আঙ্কেল ডিক। আমার মৃত্যু যখন নিশ্চিত, কারও ঠেকাবার উপায় নেই, আমিও হাল ছেড়ে দিয়ে অবধারিত নিয়তিকে মেনে নিয়েছি, ঠিক সেই সময়ে তোমরা গিয়ে শত্রুর হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে এলে আমাকে। গলার স্বর হঠাৎ কোমল হয়ে এল আঙ্কেলের। একটা কথা সত্যি করে বলবে, কিশোর? ব্যাপারটা কিছুতেই মাথায় ঢুকছে না আমার। ওয়েনস্টেইনের বোটটা দখল করেই তোমরা নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে না ছুটে বিপদ মাথায় নিয়ে এদিকেই ঘুরঘুর করছিলে কেন?
আসলে আমাদের সামনে দুটো রাস্তাই খোলা ছিল, আঙ্কেল, বলল কিশোর। নিজেরা পালিয়ে যাওয়া, অথবা আপনাকে সঙ্গে নিয়ে পালানো। সবাই মিলে আমরা শেষেরটাই বেছে নিলাম।
কিছুক্ষণ চুপচাপ। ভাবাবেগ সামলাবার চেষ্টা করে বিফল হলেন তিনি। ডিক কার্টারের বিশাল দুই বাহু একই সঙ্গে বুকে জড়িয়ে ধরল ওদের চারজনকে।
এ কী বলব জানি না, ধরা গলায় বললেন তিনি। তোমরা ছোট মানুষ, কিন্তু তোমাদের মত অকৃত্রিম বন্ধু পাওয়া যে-কোনও বড় মানুষের জন্যেও যে কতবড় সৌভাগ্য! ভয়কে জয় করে বন্ধুর বিপদে প্রাণ বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়া। যে কতবড় মহৎ কাজ, কত বড় সাহসের কাজ…কত বড়… বলতে বলতে হাউ-মাউ করে কেঁদে উঠলেন আঙ্কেল ডিক। থরথর করে কাঁপছেন তিনি। টপটপ করে কয়েক ফোঁটা চোখের পানি পড়ল ছেলেমেয়েদের মাথায় পরম আশীর্বাদের মত।
ষোলো
অনেক রাতে গল্প শেষ করে ঘুমে ঢলে পড়েছিল সবাই। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই পুবদিকের আকাশটা প্রথমে ফরসা হয়ে এল, তারপর সোনালী আভা দেখা দিল ওখানে-রঙ ধরছে দিগন্তের কাছাকাছি মেঘের গায়ে। কালো সাগরটা,