অরররররর! ভারী, গম্ভীর গলায় উত্তর এল খুব কাছ থেকে। চমকে লাফিয়ে উঠলেন আঙ্কেল, তারপর হেসে ফেললেন।
হায় খোদা! এখনও সখা-সখি তোমাদের সঙ্গে?
বলতে না বলতেই জোরে হাঁচি দিল একটা, তারপর বার কয়েক খ-খক কেশে উঠে বন্ধ হয়ে গেল বোটের ইঞ্জিন।
তেল শেষ, বললেন, ডিক কার্টার তিক্ত কণ্ঠে। তা তো হবেই, এটা ওয়েনস্টেইনের বোট না! এবার কী করা, গোয়েন্দা-প্রধান?
বৈঠা, বলল কিশোর। আপনি হুইলটা ধরে রাখেন, আঙ্কেল, আমরা। চারজন বৈঠা বাইব।
জিনা, লক্ষ্মী মেয়ে, তুমি উঠে এসে হুইলটা ধরো তো! বললেন আঙ্কেল ডিক, আমি এই তিন গোয়েন্দাকে দেখিয়ে দিই বৈঠা বাওয়া কাকে বলে!
পনেরো
ছপ-ছপ দাঁড়ের মৃদু শব্দ তুলে এগিয়ে চলেছে বোট। দূরে আবছা মত দেখা গেল, তারপর ক্রমে বড় হতে থাকল দ্বীপ।
পাথরে ধাক্কা লেগে তলা ভাঙবে না তো আবার? জিজ্ঞেস করলেন আঙ্কেল।
না, বলল মুসা। চলেন না, দেখাচ্ছি। বালি আর নুড়ি-পাথরের চমৎকার সৈকত আছে দ্বীপের অপর পাশে।
চমৎকার সৈকতে পৌঁছবার আগেই জোর এক ঝাঁকি খেল মোটর-বোট। খড়মড় আওয়াজ এল তলা থেকে, মনে হলো ভেঙেচুরে সর্বনাশ হয়ে গেল। বুঝি। চেষ্টা করেও বোট নড়ানো গেল না এক ইঞ্চি।
পাথরে উঠে পড়েছে, বললেন ডিক কার্টার। এখন আর সাধাসাধি করেও নড়াতে পারবে না। জোয়ার এলে তখন আপনিই ভেসে উঠবে। মনে হচ্ছে, রাতটা এখানেই কাটাতে হবে। দাঁড়াও, আগে দেখি, তলাটা ফেঁসেছে কি না। টর্চ আছে না তোমাদের?
রবিন এগিয়ে দিল টর্চ। আলো জ্বেলে পুরো বোট ভালো মত পরীক্ষা। করলেন আঙ্কেল, তারপর বিরাট একটা নিঃশ্বাস ছাড়লেন স্বস্তির। যাক, বাবা! বাঁচা গেল। কিন্তু শীতে যে একেবারে কাবু করে ফেলল, কিশোর! তোমাদের সমান হলে না হয় তোমাদের একটা শুকনো কাপড় ধার করা যেত, এখন কী করি বলো তো?
সমাধান আছে আমার কাছে, বলল জিনা। পাফিন দ্বীপ ছেড়ে আসার সময় আপনার ব্যাগটাও এনেছি আমরা সঙ্গে করে।
হিহি-হিহি-হিহি-হিহি! বাবা রে! জলদি করো, জিনা!
এতক্ষণে কিশোর আর মুসারও শীত লাগতে শুরু করেছে। ভেজা কাপড় ছাড়বার সময় পায়নি ওরাও। ঝটপট কাপড় পাল্টে নিল সবাই। নিজের জামা কাপড় ফিরে পেয়ে আঙ্কেল যার পর নাই খুশি। শার্টের উপর একটা জাম্পার চাপিয়ে আরাম করে বসলেন তিনি সবার মধ্যমণি হয়ে।
এবার অল্প-সামান্য খেয়ে নিলে কেমন হয়? বলল মুসা।
আছে কিছু? সাগ্রহে জিনার দিকে চাইলেন আঙ্কেল।
জিনাকে খাবারের আয়োজন করতে দেখে খুশি হয়ে কাছে সরে এল সখা সখি। কিকো নড়েচড়ে বসল মুসার কাঁধে।
খাওয়া-দাওয়ার পর ডেকের উপর গ্রাউন্ড-শীট বিছিয়ে আঙ্কেলকে ঘিরে বসে পড়ল ওরা। জিনা বলল, আজ এত কাণ্ডের পর কিছুতেই ঘুমাতে পারব না।
শুনে সবাই বলল, ঠিক, ঠিক!
কাজেই এবার পাফিন-দ্বীপে আলাদা হয়ে যাওয়ার পর থেকে কী-কী ঘটল শোনাতে পারি আমরা একে অপরকে, বললেন আঙ্কেল।
আপনার গল্পটা আগে শুনি, আঙ্কেল, আবদার ধরল জিনা। উহ, আপনাকে ফিরে পেয়ে কী যে ভালো লাগছে না! ক্যাবিনের মেঝের ওপর রক্তের দাগ, ইঞ্জিন-রেডিও চুরমার হয়ে গেছে এসব দেখে আমরা কী যে সাংঘাতিক ভয় পেয়েছিলাম!
হ্যাঁ। ভাঙচুরের কথা ওরা বলেছে আমাকে, বললেন ডিক কার্টার। ওদের কথাবার্তায় বুঝলাম, দ্বীপে যে তোমরা আছ সেকথা ওরা জানে না, কাজেই আমিও কিছু বললাম না। অল্পক্ষণ চুপ করে থাকলেন তিনি, তারপর বললেন, সত্যি বলতে কী, বলার আমার তেমন কিছুই নেই। হেড-অফিসে একটা মেসেজ পাঠাবার চেষ্টা করছিলাম, একটা মেসেজ আসারও কথা ছিল-এমনি সময়ে মাথায় ডাণ্ডা মেরে আমাকে ঠাণ্ডা করে দিল কে যেন। হাত পা বাঁধা অবস্থায় জ্ঞান ফিরল আমার অচেনা এক দ্বীপে। অসংখ্য প্রশ্ন করা হলো আমাকে। আশ্চর্যের ব্যাপার, দেখলাম, যাদের রোষ থেকে বাঁচবার জন্যে আমাকে গা-ঢাকা দিতে বলা হয়েছিল, এতদূর সরে আসার পরেও ঠিক তাদেরই সঙ্গে ধাক্কা লেগে গেছে আমার। আমি জানতাম না, এদিকেই কোথাও আস্তানা গেড়েছে ওরা, এদিকেই বে-আইনী তৎপরতা চালাচ্ছে। আমার ধারণা ছিল ফ্লোরিডার ওদিকে আস্তানা ওদের। সেই রকম একটা ভুল ধারণা ওরাই। ঢুকিয়েছিল আমার মাথায়।
আর আপনিও, পড়বি তো পড় মালীর ঘাড়ে! বেড়াতে এসে ঠিক ওদের খপ্পরেই পড়েছেন! কিশোরের কাছে শোনা কাজী নজরুল ইসলামের লিচু চোর কবিতার সেই মালীর কথা বলল রবিন। ওরা নিশ্চয়ই ধরে নিয়েছে, ওদের গন্ধ শুঁকে শুঁকেই এখানে এসে হাজির হয়েছেন আপনি?
হ্যাঁ, বললেন ডিক কার্টার। এর আগে এই দলের কয়েকটা অপারেশন আমি বানচাল করে দিই। স্বভাবতই, ওদের মধ্যে সামান্যতম জনপ্রিয়তা নেই আমার। চুনোপুঁটি কয়েকজন ধরা পড়ে, কিন্তু রাঘব বোয়ালদের ধরার আগেই ডুব দেয় ওরা গভীর জলে। ওখান থেকে ঘোষণা করেছে আমার মৃত্যু পরোয়ানা। দলের সবার ওপর নির্দেশ আছে আমাকে দেখা মাত্র খুন করতে হবে। তবে সম্ভব হলে খুন করবার আগে জেনে নিতে হবে দলের কোন লোকটা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।
যতই বোঝাতে চেষ্টা করি যে আমি কিছুই জানি না, ততই সন্দেহ গাঢ় হয় ওদের। ওদের বদ্ধমূল ধারণা, ওদেরই কেউ জানিয়ে দিয়েছে আমাকে দলের গোপন কর্মকাণ্ড আর আস্তানার কথা। সেই লোকটার নামটা বের করবার জন্যেই আমাকে ধরার সঙ্গে সঙ্গে মেরে না ফেলে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করেছে ওরা এই কদিন: আমি কতটা জানি, কে বলেছে আমাকে আর কতটা জানিয়েছি আমি আমার হেড-অফিসে। আসলে তো তেমন কিছুই জানি না আমি, যেটুকু জেনেছি নিজের থেকেই জেনেছি, কেউ বলেনি আমাকে। কাজেই কী বলব? ওদের সন্তুষ্ট করা সম্ভব হয়নি আমার পক্ষে। শেষে হাল ছেড়ে দিয়ে আজ রাতেই আমাকে শেষ করে দেবে বলে স্থির করেছিল। তোমরা গিয়ে ভজকট করে দিলে ওদের প্ল্যানটা!