কিন্তু কিছুতেই সাগরে ঝাঁপিয়ে পড়বার সাহস সঞ্চয় করতে পারলেন না ওয়েনস্টেইন। তার উপর চারদিক থেকে টর্চ হাতে এগিয়ে আসছে সশস্ত্র শক্র। কুঁকড়ে সরে গেলেন তিনি দূরে।
আর অপেক্ষা করা যায় না। একসঙ্গে ডাইভ দিয়ে পানিতে পড়ল তিনজন। গোপনীয়তার তোয়াক্কা না করে ফ্রী-স্টাইল সাঁতার কেটে দ্রুতবেগে ছুটল ওরা বোটের দিকে। হাত বাড়িয়ে ডেকে উঠতে সাহায্য করল ওদেরকে রবিন ও জিনা।
ওদিকে হই-হল্লা করতে করতে ঘাটে লাগানো বোটের ডেকে উঠে এল দশ-পনেরো জন লোক। গার্ডের নাম ধরে ডাকছে ওরা। কী ঘটেছে জানে না। এখনও। দমাদম হ্যাচ-কাভার পিটাচ্ছে গার্ড, কিন্তু সেদিকে খেয়াল না দিয়ে প্রথমে ওরা ধরল ভয়ে কুঁকড়ে জড়সড় হয়ে থাকা ওয়েনস্টেইনকে।
এখন কি ইঞ্জিন চালু করা ঠিক হবে? আওয়াজ হলেই তো ওরা টের পেয়ে–
রবিনের পিঠ চাপড়ে দিলেন ডিক। উপায় নেই। টের পেলেও কিছুই করার নেই আমাদের। তাড়া করবে ওরা। ওদের থেকে যতটুকু এগিয়ে থাকতে পারি ততটুকুই লাভ।
বলতে না বলতেই ইঞ্জিন চালু করল জিনা। জেটির হই-চই থেমে গেল কয়েক মুহূর্তের জন্য। সব কটা লোক ঘাড় ফিরিয়ে চাইল এদিকে। ওরা ভেবেছিল ওদের হাত থেকে পালিয়ে গিয়ে আশপাশেই কোথাও লুকিয়ে আছেন। ডিক কার্টার, কিংবা সাঁতরে পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করছেন প্রশান্ত মহাসাগর-ধরা পড়া কেবল সময়ের ব্যাপার। আরেকটা বোটের অস্তিত্ব সম্পর্কে কিছুই জানত না। কয়েক মুহূর্তের জন্য ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেও বেশ দ্রুতই টের পেয়ে গেল ওরা পরিস্থিতিটা। হুড়োহুড়ি পড়ে গেল ওদের মধ্যে। যেমন করে হোক, ঠেকাতে হবে ওই বোট! কিছুতেই পালাতে দেওয়া যাবে না ওটাকে!
ক্র্যাক!
প্রথমে একটা রাইফেল গর্জে উঠল, তারপর যার হাতে যে অস্ত্র আছে সে তাই দাগতে শুরু করল আন্দাজের উপর ইঞ্জিনের শব্দ লক্ষ্য করে।
শুয়ে পড়ো! বললেন ডিক। জলদি!
ডৈকের উপর শুয়ে পড়ল তিন গোয়েন্দা ও জিনা। নিজেও যতটা পারা যায় নিচু হয়ে হুইল ধরলেন আঙ্কেল। কয়েকটা গুলি খুব কাছ দিয়ে চলে গেল। খোলা সমুদ্রের দিকে। দুয়েকটা গাঁথল বোটের গায়ে, তবে ক্ষতি হলো না। কারও। তার পরেই আর্তনাদ করে উঠল কিকো, এবং চেঁচাতেই থাকল।
লাফিয়ে উঠে বসল মুসা।
শুয়ে পড়ো, মুসা! বললেন আঙ্কেল।
কিন্তু কিকো…
খারাপ কিছু হলে এখন পর্যন্ত চেঁচাচ্ছে কী করে? যা বলছি তাই করো, মুসা। শুয়ে পড়ো। একটু পরেই রেঞ্জের বাইরে চলে যাব আমরা, তখন দেখা যাবে কী হয়েছে।
সত্যিই, খানিক পরেই গোলাগুলি বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু স্বস্তি বোধ করবার আগেই হালকা ভাবে আরেকটা শব্দ কানে এল ওদের। শক্রদ্বীপের জেটিতে স্টার্ট নিয়েছে একটা মোটর-বোটের ইঞ্জিন। বোটটা ঘুরিয়ে নিয়ে এইবার শুরু হবে ধাওয়া!
আসছে ওরা, বললেন আঙ্কেল। কপাল ভালো, রাতটা অন্ধকার-চাঁদ নেই। ট্যাঙ্কে যতক্ষণ ডিজেল থাকবে, আমরা চলতেই থাকব; তারপর দেখা যাবে কী আছে ভাগ্যে।
তাড়া শুরু করেই জোরালো একটা সার্চলাইট জ্বালল পিছনের বোট সামনে বাম থেকে ডানে ঝাটা দেওয়ার ভঙ্গিতে ঘুরাচ্ছে আলোটা।
আলোর আওতা থেকে সামান্য একটু এগিয়ে আছি আমরা, বললেন আঙ্কেল। কিন্তু এই ছোট্ট বোট তো নড়তেই চায় না! কিকো, তুমি থামবে? কিছু হয়নি তোমার! চুপ করো!
উঠে বসল ওরা চারজন। কিকো এসে বসল মুসার কাঁধে। মুসা দেখল থরথর করে কাঁপছে কিকো। কোথাও লেগেছে কি না বুঝবার জন্য ওর সারা গায়ে হাত বুলাল ও, পা দেখল, ঠোঁট দেখল–কিন্তু কিছুই পেল না। তা হলে? তা হলে ওভাবে চিৎকার করছিল কেন? ভয়ে?
কোথাও কিছু হয়নি, বলল মুসা। অথচ এমন ভাব দেখিয়েছে যেন এখুনি ধড়ফড় করে মারা যাবে! ছিহ, কিকো, তোমার জন্যে লজ্জা হচ্ছে আমার!
আহা রে, বেচারি কিকো! ডাক্তার ডাকো, ডাক্তার!
ওর ঝুঁটিটা চুলকে দিতে গিয়ে চমকে উঠল মুসা। ঝুঁটির একটা অংশ গুলি লেগে ছিঁড়ে গেছে!
এ ও জানে টিকটিকির লেজের মত কাকাতুয়ার ঝুঁটি আবার গজায়। কিন্তু আর একটু নীচে লাগলে কী সর্বনাশ হোত ভাবতেই হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে এল মুসার। কিকো মারা গেছে এই কথাটা ভাবতেই পারে না ও।
নীচের ঠোঁটে চিমটি দিচ্ছিল কিশোর। বলল, সোজা না গিয়ে আমরা লেগুনের পাশের দ্বীপটায় ফিরে যাই না কেন? তা হলে হয়তো ওদের চোখ ফাঁকি দেয়া সম্ভব হতে পারে। আঙ্কেল! ওরা ধরেই নেবে, সোজা ছুটব আমরা। জান-প্রাণ নিয়ে। একটু বামে কাটেন। ওদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমরা পারব না।
বিতর্কে না গিয়ে সামান্য বামে ঘুরালেন ডিক বোটের নাকটা। তারপর প্রশ্ন করলেন, কতদূর সেই দ্বীপ?
আর ছয়-সাত মাইল, বলল মুসা।
ফিরে যাচ্ছ, তার মানে তোমরা কাছেই ওই লেগুন-দ্বীপে ছিলে? আমি তো মহা দুশ্চিন্তায় মরে যাচ্ছিলাম তোমাদের কথা ভেবে। বোকার মত আমি ওদের হাতে ধরা পড়ে গায়েব হয়ে যাওয়ার পর থেকে এই কদিন কী করলে তোমরা?
আর একটু বামে ঘোরান, আঙ্কেল, বলল মুসা। আমরাও আপনার কথা ভেবে খুব চিন্তায় পড়েছিলাম। দ্বীপে চলেন আগে, তারপর শুনবেন সব কথা, দেখবেন স্বচক্ষে।
ডিক কার্টারকে নিয়ে সামনে থেকে সরে গেছে বোটটা টের পেল না শত্রুপক্ষ। সোজা নাক বরাবর ছুটল ওরা, মাঝে মাঝে সার্চ লাইটের আলো ফেলে, দেখছে সাগরের উপরটা। আর কিছুক্ষণ এই ভাবে চললে হারিয়ে যাবে ওদের দৃষ্টি বা শ্রুতির আড়ালে। বড় করে একটা শ্বাস ফেললেন ডিক কার্টার। বললেন, যাক কিছুক্ষণের জন্যে হলেও, বাঁচা গেল!