তুমি লাঠি হাতে ঘুমন্ত লোকটার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে থাকো গিয়ে, আমি দেখছি এই দিকটা! ওকে আগেই মেরে বোসো না, যদি কোনও কারণে জেগে গিয়ে উঠে বসতে যায় তা হলে আবার ঘুম পাড়িয়ে দেবে। ভেতরে শত্রুপক্ষের লোক আছে কি না জানি না আমরা। আঙ্কেল বেরিয়ে আসার আগেই যদি কেউ চেঁচিয়ে উঠে ওর ঘুম ভাঙিয়ে দেয়, মুশকিল হতে পারে। বুঝতে পেরেছ?
মাথা ঝাঁকিয়ে ঘুমন্ত লোকটার মাথার কাছে গিয়ে দাঁড়াল মুসা। হ্যাঁচের বোল্ট খুলতে গিয়ে কিশোর খেয়াল করল থরথর করে কাঁপছে ওর হাত। ভয় পেয়েছিল, হ্যাচ-কাভার তুলতে গেলে কাঁচ-কাঁচ আওয়াজ হবে বুঝি, কিন্তু হাতল ধরে টান দিতেই নিঃশব্দে খুলে গেল ওটা। নীচ থেকে একরাশ আলো ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর উপর।
হ্যাচ খুলবার সামান্য খুট-খাট শব্দ কানে যেতেই উপর দিকে চাইল। ক্যাবিনের লোক দুজন। ঠিকই আন্দাজ করেছিল ওরা-একজন আঙ্কেল ডিক, অপরজন প্রফেসর ওয়েনস্টেইন। কিশোরকে উঁকি দিতে দেখেই লাফিয়ে উঠে। দাঁড়ালেন আঙ্কেল ডিক, বিস্ময়ে দুই চোখ বিস্ফারিত। কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু কিশোর ঠোঁটের উপর তর্জনী রাখল। তাই দেখে চট করে গিলে ফেললেন কথাটা।
বেরিয়ে আসেন, আঙ্কেল! ফিসফিস করে বলল কিশোর। জলদি! গার্ডটাকে সামলাতে হবে!
ভাগ্যের সহায়তায় চমৎকার মসৃণ ভাবে এগোচ্ছিল সবকিছু, কিন্তু শেষ মুহূর্তে সব গুবলেট করে দিলেন প্রফেসর আইনস্টাইন। কিশোরকে চিনতে পেরেই লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। এরাই তাঁকে মাটির নীচে বন্দি করে তার বোট নিয়ে পালিয়েছিল! হেঁড়ে গলায় জোরে চিৎকার করে উঠলেন তিনি, ধরো, ধরো! এই ঘোড়াগুলোর কথাই বলেছিলাম! ধরো ওকে!
চোদ্দো
আস্তে! চুপ, চুপ! চুপ করেন! ধমকে উঠল কিশোর। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। লাফিয়ে উঠে বসেছে গার্ড লোকটা। হ্যাঁচের গর্ত দিয়ে উজ্জ্বল আলো আসছে দেখে ধড়মড়িয়ে উঠে দাঁড়াতে গেল। ওর মাথা লক্ষ্য করে গায়ের জোরে লাঠি চালাল মুসা। কিন্তু কপাল মন্দ, দীর্ঘদিন পানিতে ভিজে পচে গেছে কাঠ, মচাৎ শব্দে দু-টুকরো হয়ে গেল ওটা।
মুসার লাঠির বাড়ি টেরও পায়নি লোকটা, দিশেহারার মত চেঁচিয়ে উঠল সে, কে! কী! কী হচ্ছে এসব? হ্যাচ-কাভার খুলল কে?
ঝাঁপিয়ে পড়ে কিল-ঘুসি মেরে ওকে পানিতে ফেলবার চেষ্টা করল মুসা, কিন্তু প্রচণ্ড শক্তি লোকটার গায়ে, খপ করে ধরে ফেলল মুসার হাত, মুচড়ে নিয়ে গেল ওর পিঠের কাছে।
ছুটে এসে লাথি চালাল কিশোর লোকটার তলপেট লক্ষ্য করে। উহ! বলে সামান্য একটু বাকা হলো গার্ড, কিন্তু কাবু হলো না। বামহাতে চেপে ধরল সে কিশোরের চুলের মুঠি, তারপর হ্যাচকা টানে ফেলে দিল ওকে ডেকের উপর।
অরররররর! পায়ের কাছে বিদঘুঁটে আওয়াজ শুনে লাফিয়ে উঠল গার্ড। পায়ে সখার ভারী ঠোঁটের জোরালো কয়েকটা ঠোকর খেয়ে গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠল সে। পরমুহূর্তে বজ্জাত কোথাকার! দাঁড়া আসছি! বলে। কোত্থেকে উড়ে এসে ওর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল কিকো। নাকে-মুখে কিকোর নখের খামচি এবং কপালে ও চোখের পাশে তীক্ষ্ণ ঠোঁটের খটাখট কয়েকটা ঠোকর খেয়ে মরণ চিৎকার ছাড়ল সে।
এদিকে হোল্ডের বাতি অফ করে দিয়ে তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে উঠে এসেছেন ডিক কার্টার। মুসার বেকায়দা অবস্থা দেখে একলাফে এগিয়ে এসে প্রচণ্ড এক ঘুসি মেরে ফেলে দিলেন গার্ডকে ডেকের উপর, তারপর ওর একটা হাত ধরে হিড়হিড় করে ডেকের উপর দিয়ে হেঁচড়ে টেনে নিয়ে গেলেন হোল্ডে ঢুকবার গর্তের কাছে। আরেকটা চিৎকার দেওয়ার সুযোগ পেল গার্ড, তারপর ওকে ভিতরে ছুঁড়ে দিয়ে খটাশ করে লাগিয়ে দিলেন ডিক হ্যাচ-কাভার, তারপর হ্যাচ-বোল্ট।
ওই বে-আক্কেল লোকটা গেল কোথায়? জিজ্ঞেস করলেন তিনি এবার, ওয়েনস্টেইন না কী যেন নাম? সব গুবলেট করে দিয়েছে ব্যাটা চেঁচিয়ে উঠে! একটু সরে দাঁড়িয়ে হাঁ করে দেখছেন ওয়েনস্টেইন ওদের কাণ্ড-কারখানা, কোনও জবাব না দিয়ে গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন। ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে। কিশোর। ওর দিকে ফিরে আঙ্কেল বললেন, তোমরা নিশ্চই ওই লোকটার বোট নিয়ে এসেছ? চলো, দেখি, এটাকে দখল করা গেলে ওরটা ওকে ফেরত দিয়ে এটা নিয়েই রওনা হব আমরা।
এই আঁধারে ইঞ্জিনটা চালু করব কী করে! বলল মুসা।
চলো তো আগে, দেখি কী করা যায়।
প্রাণপণে চেঁচাচ্ছে, আর দমাদম আওয়াজ করছে গার্ড হ্যাচ-কাভারের গায়ে। অন্ধকার হাতড়ে হুইলের কাছে পৌঁছল ওরা। কিন্তু দ্বীপে আকাশ ভেঙে পড়েছে ততক্ষণে।
অনেকগুলো জোরালো বাতি জ্বলে উঠল তীরে। লোকজনের দৌড়-ঝাঁপ আর চেঁচামেচির আওয়াজ শোনা গেল। একদল লোক এগিয়ে আসছে জেটির দিকে।
নাহ, বললেন ডিক কার্টার, এটার আশা ছাড়তেই হচ্ছে। নোঙর তুলে, জেটির বাধন খুলে রওনা হওয়ার আগেই এসে যাবে লোকজন। তোমাদের বোট কোথায়, কিশোর?
কাছেই। সাঁতার কেটে যেতে হবে। জিনা আর রবিন আছে ওতে। আমরা পৌঁছলেই স্টার্ট দেবে ইঞ্জিন।
ভেরি গুড! চলো তা হলে ঝাঁপ দিই। ওয়েনস্টেইন! কোথায় আপনি? আপনি আসবেন আমাদের সঙ্গে?
আমি সা-সা-সা-সাঁতার জানি না, তোতলাতে শুরু করলেন পক্ষিপ্রেমিক।
বেশ তো, আমরা তিনজন নাহয় সাহায্য করব, বললেন ডিক কার্টার। নির্ভয়ে ঝাঁপ দিতে পারেন আপনি।