মুসা বলল, শোনো, প্রধান, আমার প্ল্যানটা বলি। তুমি আর আমি যদি সাঁতার কেটে ওই জেটিতে গিয়ে বোটে উঠতে পারি, তা হলে অপ্রস্তুত গার্ডকে কাবু করা খুব কঠিন হবে না। ওটাকে পানিতে ফেলে হ্যাচ খুলে আঙ্কেলকে বের করে আনতে আধ মিনিটও লাগবে না। ইচ্ছে করলে ওদের বোটটা দখল করে নিয়ে আমরা…
দাঁড়াও, দাঁড়াও, হাত তুলল কিশোর। এক-এক করে ভেবে দেখা যাক সমস্যাগুলো নিয়ে। তোমার প্ল্যানটা খুবই ভালো। তবে এখনও আমরা জানি না ওই বোটে আঙ্কেল ডিক আছেন কি না। আর এমন হওয়া খুবই সম্ভব যে, গার্ডকে কাবু করতে পারলাম না আমরা। যদি একাধিক গার্ড থাকে তা হলে তো একেবারে সাড়ে-সর্বনাশ। আমাদের আক্রমণটা ব্যর্থ হয়ে যাবে। কাজেই প্রথমে আমাদের বুঝে নিতে হবে কোন প্ল্যানটা খাটবে এখানে।
কীভাবে বুঝবে সেটা? প্রশ্ন রবিনের।
মুসার প্ল্যান অনুযায়ী আমি আর ও নিঃশব্দে সাঁতার কেটে পৌঁছব ওই ডকে। আলোর আওতার বাইরে কোথাও উঠে প্রথমে ভালো করে চারপাশের অবস্থাটা বুঝে নেব। তারপর যা ভালো বুঝব, করব। রবিন আর জিনার কাজ ভাগ করে দিল ও এবার। তোমরা দুজন সাবধানে বোটটা ঘুরিয়ে সমুদ্রের দিকে মুখ করে রাখবে, কিন্তু নোঙর ফেলবে না। তারপর একজন বোট যেন অন্য দিকে সরে না যায় সেদিকে খেয়াল রাখবে, আর অন্যজন তৈরি হয়ে থাকবে মুহূর্তের নোটিসে ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে রওনা হওয়ার জন্যে। ঠিক আছে?
এই শুরু হতে চলেছে অ্যাকশন। উত্তেজনা, বিপদের আশঙ্কা, সেই সঙ্গে যা করতে এসেছে সেটা করবার দৃঢ় সঙ্কল্প ফুটে ওঠায় চেহারা অন্যরকম হয়ে। গেছে ওদের। জ্বলজ্বল করছে চোখগুলো।
আর একটি কথাও হলো না। কিকো আর সখা-সখিকে জিনা ও রবিনের জিম্মায় রেখে ধীরে-সুস্থে কাপড় ছাড়ল কিশোর ও মুসা। তারপর খালি গায়ে শুধু হাফপ্যান্ট পরে আস্তে করে নেমে গেল ঠাণ্ডা পানিতে। হাত-পা পানির উপরে না তুলে ব্রেস্টস্ট্রোক সাঁতার কেটে নিঃশব্দে এগিয়ে চলল ওরা জেটির দিকে। কাছে গিয়ে আরও পরিষ্কার শোনা গেল বাজনা। কিশোর ভাবল, এ পর্যন্ত ভাগ্যের সহায়তা পাওয়া যাচ্ছে প্রতি পদে। ভালো। আর অল্প কিছু সময় সহায়তা বজায় থাকলে কেল্লা ফতে করে বেরিয়ে যেতে পারব।
সযত্নে আলো পরিহার করে উঠে পড়ল ওরা জেটিতে। বোটটা সরাসরি আলোর নীচে নয় বলে ধন্যবাদ দিল ভাগ্যকে। মুসার হাতে একটা ফুট তিনেক লম্বা মোটাসোটা লাঠি দেখে ভুরু নাচাল কিশোর। ওর কানের কাছে মুখ এনে মুসা বলল, পানি থেকে উঠবার সময় পেয়েছে ওটা, ভাসছিল তীরের কাছে।
এগোচ্ছে ওরা বোটের দিকে, এমনি সময়ে উঁচু পর্দায় নেকড়ের মত টানা লম্বা একটা ডাক শুনে থমকে দাঁড়াল। হাই তুলেছে গার্ড। পরমুহূর্তে নব ঘুরিয়ে বন্ধ করে দিল রেডিওটা। নীরব হয়ে গেল সব কিছু।
চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল ওরা। না সামনে, না পিছনে কোনও দিকে যেতে পারছে না। দশ মিনিট পর দেখা গেল জ্বলন্ত সিগারেটের টুকরো ডেক থেকে ছিটকে গিয়ে পড়ল সাগরের পানিতে, কিন্তু নতুন আরেকটা ধরাল না লোকটা। নড়েচড়ে আরাম করে শুতে গিয়ে মুখ দিয়ে গোটাকয়েক বিচিত্র কাতর ধ্বনি বের করল সে, তারপর আর একবার ডেকে উঠল নেকড়ের ডাক।
ধৈর্যের প্রতিমূর্তি হয়ে চুপচাপ ছায়ায় দাঁড়িয়ে রয়েছে ওরা। ঠাণ্ডায় কাঁপছে শরীর। তারপর একসময় কাক্ষিত শব্দটা ভেসে এল কানে। নাক ডাকছে লোকটার।
এর সঙ্গে আর কেউ নেই তো? কিশোরের কানের কাছে মুখ নিয়ে চাপা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল মুসা।
মনে হয় না, নিচু গলায় জবাব দিল কিশোর। থাকলে কথা বলত। চলে এসো।
পা টিপে এগোল ওরা। ছায়ায় ছায়ায় এগিয়ে উঠে পড়ল বোটের ডেকে। খালি পায়ে থাকায় সামান্যতম শব্দও হলো না। ঘুমন্ত গার্ডের দিকে ভয়ে ভয়ে তাকাল ওরা, তারপর ওকে ছাড়িয়ে এগিয়ে গেল হ্যাঁচের কাছে।
মানুষের গলার আওয়াজ পেয়ে আবার থমকে দাঁড়াল কিশোর। এবার শব্দটা এসেছে ডেকের নীচ থেকে। এক হাতে মুসার বাহু চেপে ধরতেই চমকে উঠল ও, লাফিয়ে উঠতে গিয়েও সামলে নিল নিজেকে। আঙুল দিয়ে নীচের দিকে দেখাল কিশোর। কান পাতল দুজনে।
নীচের হোল্ডে কথা বলছে কারা যেন। কারা? আঙ্কেল আর ওয়েনস্টেইন? নিশ্চিত হওয়ার উপায় কী? কে জানে, হয়তো দস্যুদলের লোকজন তাস পিটছে আর গল্প করছে। হ্যাচ খুলে যদি দেখা যায় শত্রুপক্ষের লোক, তা হলে ধরা পড়া আর এড়ানো যাবে না। ওরা চেঁচিয়ে উঠলেই জেগে যাবে গার্ড, পাশে। শোয়ানো রাইফেলটা তাক করে অ্যারেস্ট করবে ওদের।
আগে শুনে দেখি কী বলছে ওরা! মুসার কানে কানে বলল কিশোর। হ্যাঁচের সরু ফাঁক দিয়ে আলো আসছে ভিতর থেকে। উবু হয়ে কান ঠেকাল ওরা ওখানে। কিন্তু গলার আওয়াজ পাওয়া গেলেও কথা বোঝা গেল না একটাও।
হতাশ হয়ে উঠে পড়তে যাচ্ছিল ওরা, এমনি সময়ে একজন খুক করে কেশে গলা পরিষ্কার করল। মুহূর্তে বুঝে ফেলল ওরা কে রয়েছে নীচে। ওটা আঙ্কেলের কাশি। কোনও সন্দেহ নেই, নীচের এই হোল্ডেই আটকে রাখা হয়েছে আঙ্কেল ডিককে। তিনিই কথা বলছিলেন এতক্ষণ। ঝিরঝিরে একটা স্বস্তির পরশ অনুভব করল ওরা শরীরে। এখন আঙ্কেলকে নীচের ক্যাবিন থেকে বের করতে পারলেই আর কোনও চিন্তা নেই-তিনিই দায়িত্ব তুলে নেবেন নিজের কাঁধে। আবার মুসার কানে ঠোঁট ঠেকাল কিশোর।