আরও বিশ মিনিট অপেক্ষার পর পুরু লেন্সের চশমা পরা, পাকা দাড়িওয়ালা বুড়ো এক স্বাস্থ্যবান লোক এগিয়ে এসে দাঁড়াল ওদের কাছে। হাঁটু পর্যন্ত লম্বা এক কোট পরে আছে, পিঠে ঝুলছে একটা দামি ফিল্ডগ্লাস, মাথায় ফেল্ট ক্যাপ। গলার আওয়াজ শুনে জানে পানি এল ওদের সবার।
এই যে! ছেলেমেয়েরা ঠিক সময় মত পৌঁছে গেছ দেখছি! ভেরি গুড, ভেরি গুড!
গুড আফটারনুন, ডক্টর ওয়াল্টার, গলাটা একটু চড়িয়ে বলল কিশোর। কেমন আছেন, সার? আমরা সবাই তৈরি।
সবার সঙ্গে হাত মেলালেন তিনি। তারপর বললেন, এবার রওনা হব আমরা। এসো আমার সঙ্গে। এই যে এদিকে।
আশপাশ থেকে যারা কথাগুলো শুনল তারা বুঝে নিল, বুড়ো প্রফেসর কানে একটু কম শোনেন। তারই তত্ত্বাবধানে কোনও স্টাডি টুরে চলেছে কয়েকটা ছেলেমেয়ে।
এই যে! পোর্টারকে ডাক দিলেন ডিক কার্টার। তোমার বারোতে এই ব্যাগগুলোও তুলে নাও তো, বাছা। দেড়টার গাড়িতে আমাদের রির্ভেশন আছে, কম্পার্টমেন্টটা খুঁজে বের করে মালগুলো তুলে দাও ওতে। ঠিক আছে?
পোর্টার ওদেরকে রিযার্ভ করা কামরায় তুলে দিয়ে মজুরির সঙ্গে মোটা বখশিশ পেয়ে খুশি মনে বিদায় নিল। সবকিছু গুছিয়ে রেখে ডাইনিং কারে গিয়ে লাঞ্চ সেরে এল ওরা। তারপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল আঙ্কেলের আনা ম্যাপের উপর। দ্বীপ তো অনেক, অ্যানাকোপা, সান্তাক্র্য, সান্তা রোযা, স্যান মিগুয়েল হিল; আবার প্রতিটি বড় দ্বীপের আশপাশে অসংখ্য ছোট-ছোট দ্বীপ রয়েছে। এমনও কিছু আছে, যেখানে কোনদিন মানুষের পা পড়েনি। ম্যাপ দেখতে গিয়ে বুকের ভিতরটা শিউরে শিউরে উঠছে রবিনের-মন ভরে পাখি দেখা যাবে এবার। মুসা ভাবছে, এক-আধটা পাফিনের সঙ্গে যদি ভাব করা যেত, তা হলে দারুণ মজা হোত। কিশোর স্বপ্ন দেখছে, নীল সাগরের স্বচ্ছ জলের উপর মাথা। জাগানো ছোট্ট কোনও দ্বীপে তাঁবুতে বসে গল্পের বই পড়ছে ও, মাথার উপর দিয়ে উড়ে চলে যাচ্ছে একের পর এক সাদা মেঘের ভেলা, বিশাল আকাশটা পার হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে আরও দূরে কোথাও।
কেউ ওর দিকে খেয়াল দিচ্ছে না দেখে কিকো বলল, দূরো!
কার্পিনটেরিয়া দুই ঘণ্টার পথ।
দুই
বেশ বড়সড় বন্দর-শহর কার্পিন্টেরিয়া।
ট্রেন থেকে নেমেই মোটর বোট তৈরি আছে কি না দেখতে ট্যাক্সি নিয়ে। চলে এল সবাই হারবারে। সাগরের ধারে জোর হাওয়া, জিনার চুল আর আঙ্কেলের নকল দাড়ি ওড়াচ্ছে। মুসাকে দরজা বন্ধ করতে বলে ওর কাঁধে ঘুরে বাতাসের দিকে মুখ করে বসল কিকো। পালক এলোমেলো হয়ে যাওয়া একেবারেই পছন্দ করে না ও।
হ্যাঁ, পৌঁছে গেছে। নাম: সীগাল। সহকর্মী যিনি বোটটা চালিয়ে নিয়ে এসেছেন, তার জানা আছে কী ছদ্মবেশ নিয়ে চলেছেন ডিক কাটার। হাসি মুখে এগিয়ে এসে অভ্যর্থনা জানালেন।
গুড আফটারনুন, ডক্টর ওয়াল্টার! সবাইকে শুনিয়ে জোরে জোরে বললেন। তিনি। কেমন আছেন, সার? ভালো? সমুদ্রযাত্রার জন্যে আবহাওয়াটা কী চমৎকার না? ট্রেনে কোনও কষ্ট হয়নি তো, সার?
না, হয়নি। থ্যাঙ্কিউ। যথেষ্ট পরিমাণ খাবার তোলা হয়েছে তো, মারফি? সবকিছু রেডি?
সব রেডি, সার। ছয়মাস নিশ্চিন্তে চলবে। উঠে পড়ন, সার। তিন গোয়েন্দা ও জিনার দিকে চেয়ে হাসলেন তিনি, তোমরাও ব্যাগ-ব্যাগেজ নিয়ে।
উঠে পড়ো। আবার ফিরলেন ডিক কার্টারের দিকে, আপনাদেরকে খোলা সাগরে ছেড়ে দিয়ে আমি ডিঙ্গি নিয়ে ফিরে আসব।
সবাই দেখতে পেল, মোটর-বোটের পিছনে বাঁধা ছোট্ট একটা ডিঙ্গি দুলছে ঢেউয়ে। উঠে পড়ল ওরা সীগালে। একনজরেই ওদের পছন্দ হয়ে গেল নতুন রং করা ঝকঝকে বোটটা। সামনের দিকে ছোট্ট একটা ক্যাবিন। খাবারের স্টক দেখে খুশিতে চকচক করে উঠল মুসার চোখ। টিনের পর টিন সাজানো রয়েছে, হরেক রকম খাবারে ভর্তি। ছোট একটা রিফ্রিজারেটরেও খাবার ঠাসা। খোলা আসমানের নীচে সাগরের নির্মল হাওয়ায় কী রকম খিদে লাগে জানা আছে ওর। আর সেই সময় এই সব খাবার খেতে কী যে মজা লাগবে!
দক্ষ হাতে বন্দর থেকে বের করে খোলা সাগরে নিয়ে এলেন মারফি ওদের। তারপর স্যালিউট করে নেমে গেলেন দাঁড় টানা বোটে।
গুড লাক, সার, একগাল হাসলেন তিনি। ওয়ায়্যারলেস সেটটা ব্র্যান্ড নিউ, সার। ওটা নিয়মিত ব্যবহার করতে বলে দিয়েছেন বস। আপনি ঠিক আছেন কি না জানতে চান তিনি –প্রতিদিন অন্তত একবার। এক্সট্রা ব্যাটারি, আর নতুন এক সেট রিপেয়ার কিটও রয়েছে ওর সঙ্গে। আশাকরি কোনও সমস্যা হবে না। হপ্তা দুয়েক পর ছেলেমেয়েদের নিতে আসব। হাত নাড়লেন হাসিখুশি মানুষটা সবার উদ্দেশে, গুড টাইম অ্যান্ড গুড লাক!
ছপাৎ-ছপাৎ দাঁড় বেয়ে ফিরে চললেন তিনি বন্দরে। দূরত্ব বাড়ছে দুই বোটের। ছোট হতে হতে বিন্দু হয়ে মিলিয়ে গেল বোটটা। সোজা দক্ষিণ
পশ্চিম দিক বরাবর ছুটছে ওদের বোট।
বাপস! বিরাট একটা হাঁফ ছেড়ে বললেন আঙ্কেল। রওনা হলাম তা হলে! এখানে আর কারও চোখে ধরা পড়বার ভয় নেই। এই জঘন্য দাড়ি, ভারী চশমা আর এই বিটকেল কোটের কবল থেকে বাঁচতে হবে এবার! মুসা, হুইলটা কিছুক্ষণ ধরতে পারবে না? পাঁচ মিনিট লাগবে আমার স্বমূর্তি ধারণ করতে।
খুশি মনে হুইলের পিছনে গিয়ে দাঁড়াল মুসা। ঘণ্টায় দশ নট গতিতে ছুটছে মোটর-বোট। এই গতিতে চললে পাঁচ-কি-ছয় ঘণ্টায় পৌঁছে যাবে ওরা অ্যানাকোপা, সান্তা ক্রু, সান্তা রোযা ছাড়িয়ে স্যান মিগুয়েল হিল দ্বীপের কাছাকাছি। সন্ধের আগেই অবশ্য ছোট একটা দ্বীপ বেছে নিয়ে বোট ভিড়াতে হবে তীরে। কাল সকালে আবার চলা, মনের মতন দ্বীপ খোঁজা।