যাত্রার আগে দুই হাত আসমানের দিকে তুলল মুসা।
অ্যায়, খোদা! একজন বন্ধুকে দুষ্ট লোকের কবল থেকে মুক্ত করতে চলেছি আমরা। আমরা দুর্বল, তুমি আমাদের সাহায্য করো। আমরা ছোট্ট এই কজন যেন শত্রুকে ড্যাম ডিফিট দিয়ে আমাদের প্রিয় আঙ্কেল ডিক আর ওই আইনস্টাইনটাকে ছিনিয়ে এনে নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পারি। আমেন!
স্টার্ট হয়ে গেল ইঞ্জিন। ডেক রেইলের পাশে বসে আছে সখা-সখি। মুসার কাঁধে ওর শুভাকাঙ্ক্ষী কিকো।
রওনা হয়ে গেল বোট শক্ৰদ্বীপের উদ্দেশে।
তেরো
উজ্জ্বল একটা তারাকে গাইড হিসাবে ধরে নিয়েছে কিশোর। অন্ধকার ভেদ করে এগিয়ে চলেছে ওদের বোট। বাতি নেভানো।
আধঘণ্টা পর কিশোরের বাহু স্পর্শ করল মুসার হাত।
ওই যে আলোটা দেখতে পাচ্ছ? উ-উ-ই যে! সিগনাল বাতির মত জোরালো না। তবে ওই দ্বীপেই জ্বলছে আলোটা।
মাথা ঝকাল কিশোর। হুইলটা সামান্য ঘুরিয়ে কোর্স ঠিক করে নিল। তারপর বলল, এবার কিকোকে একটু সামলে রেখো, সেকেন্ড। এখন যদি হেসে ওঠে বা জোরে কথা বলে পানির ওপর দিয়ে ভেসে সোজা ওদের কানে। পৌঁছে যাবে সেটা। ইঞ্জিন বন্ধ করছি আমি।
কিকো কোনও শব্দ করবে না, বলল মুসা।
শ্শ্শ্শ্শ্শ্! বলে উঠল কিকো।
ঠিক, বলল মুসা। গুড বয়-কিকো! শ্শ্শ্শ্শ্শ্!
বন্ধ হয়ে গেল ইঞ্জিন। কিছুক্ষণ চলবার পর থেমে দাঁড়াল বোটটা। সরে যাচ্ছে স্রোতের টানে।
চোখে বিনকিউলার তুলল মুসা। আমার মনে হয় ওটা জেটির বাতি, বলল ও। নড়ে না। আবছা ভাবে কয়েকটা বোটও দেখতে পাচ্ছি।
এইবার তা হলে দাঁড় বেয়ে এগোনো যাক, বলেই একটা বৈঠা তলে নিয়ে বসে পড়ল কিশোর। বাকি তিনজনও হাতে তুলে নিল বৈঠা। চারজন একসঙ্গে বাইছে বলে ভালোই গতি পেল ভারী বোটটা। ভূতের মত নিঃশব্দে এগোল ওরা শক্ৰদ্বীপের দিকে। বৈঠা বাওয়ার মৃদু শব্দ চাপা পড়েছে বোটের গায়ে ছোট-ছোট ঢেউ ভাঙার লপ-লপ শব্দে।
বাজে কয়টা? ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল কিশোর মুসার কানে কানে। কারণ মুসার রিস্টওয়াচে আছে লুমিনাস ডায়াল।
তেরো-চোদ্দোটা! একই রকম ফিসফিস করে জবাব দিল কিকো। ও ভেবেছে ওকে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে।
কিকো, চুপ করে থাকো, বলল মুসা। কিশোরকে বলল, নটা পঁয়ত্রিশ।
সাড়ে দশটা নাগাদ পৌঁছে যাবে ওরা-ভাবল কিশোর। এসব নির্জন, নিঝুম এলাকায় সাড়ে দশটা মানে গভীর রাত। আশা করা যায় পাহারাদার ছাড়া ঘুমিয়ে থাকবে বাকি সবাই। বেশি চোখ খোলা থাকলে মুশকিল।
কী যেন আমার পায়ে ঘষা খেল! হঠাৎ বলে উঠল জিনা।
কিছু না, বলল রবিন। ডেকময় ঘুরে বেড়াচ্ছে সখা-সখি। একটু আগে আমার পা ঘেঁষে গেছে।
নিজেদের নাম শুনে ডেক-রেলের পাশ থেকে ঘড়ঘড়ে গলায় সাড়া দিল একজন, অররররর!
শ্শ্শ্শ্শশ! বকা দিল কিকো।
আধ ঘণ্টা পর অল্প একটু বিশ্রাম নিয়ে নেবে বলে থামল ওরা। আলোটা লণ্ঠন থেকে আসছে, বোঝা গেল। সম্ভবত আসতে বা যেতে নিজেদের বোটগুলোর সুবিধে হবে বলেই জ্বালে এটা রাতে। রবিন আর জিনাকে বৈঠা তুলে ফেলতে বলল কিশোর। এর পর কেবল দুইজন বাইরে।
শব্দ করছে না কেউ। প্রয়োজনে কানের কাছে মুখ নিয়ে অস্ফুট স্বরে কথা বলছে। অমঙ্গল আশঙ্কায় ধুকধুক করছে বুক। শ্বাস আটকে আসছে গলার কাছে। সবার মাথায় একই চিন্তা: যে বোটে আঙ্কেলকে রাখবার কথা বলল দ্বিতীয় লোকটা, সেটা খুঁজে পাবে তো ওরা? সত্যিই রাখা হয়েছে তো, না কি বদল হয়েছে পরিকল্পনা? কজন গার্ড আছে বোটে?
শত্রুদ্বীপের একেবারে গায়ের কাছে চলে এল ওরা। দূরত্ব আর একশো গজও নেই।
কীসের শব্দ? একটা আওয়াজ কানে আসতেই ছানাবড়া হয়ে গেল জিনার চোখ। কেমন যেন অদ্ভুত আওয়াজটা!
ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে মুসা বলল, ও কিছু না। রেডিও বাজছে। ব্যান্ড মিউজিক।
ভালোই হলো, চাপা গলায় বলল কিশোর। আমাদের বৈঠার শব্দ পাবে ওরা। ওই দেখো, মুসা!-আবছা ভাবে ছোট একটা জেটি দেখা যাচ্ছে লণ্ঠনের আলোয়। ওদের অজান্তে ওখানে আমাদের বোটটা ভিড়ানো যাবে বলে মনে হয়? আর ওই যে বাতির কাছাকাছি, একটা বোট না ওটা?
তাই তো মনে হচ্ছে! বলল মুসা চাপা গলায়। আবার ওর বিনকিউলারটা তুলল চোখে। হ্যাঁবোটই। বেশ বড়সড় একটা বোট। ওটায় করেই লেগুনে। গিয়েছিল ওরা দুপুরে। আমার বিশ্বাস ওটার হোল্ডেই হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পাওয়া যাবে আঙ্কেল আর আইনস্টাইনকে।
ব্যান্ডের আওয়াজ আসছে ডেকের ওপর থেকে, বলল রবিন। খুব সম্ভব পাহারাদারটা শুনছে বাজনা। ডেকের ওদিকটায় কিন্তু আলো নেই।
প্রশ্ন হলো, পাহারাদার-টা না কি–রা? প্রশ্ন তুলল কিশোর।
আমার ধারণা–টা, জবাব দিল মুসা। হ্যাচ বন্ধ করে দিলে নীচে দুজনকে আটকে রাখতে একজনের বেশি লোক লাগে না। ওই দেখো, শুয়ে শুয়ে সিগারেট ফুকছে ব্যাটা-আগুনের আভা দেখলাম।
রবিনও সমর্থন জানাল, হা, সিগারেটই।
তোমরা তো খালি কথাই বলছ, বলল জিনা কাঁপা গলায়। কিছু করবে কখন?
ভয়ে কাঁপছে জিনা। ওর কাঁধে একটা হাত রাখল কিশোর।
চিন্তা কোরো না, জিনা। কিছু করবার আগে অবস্থাটা ভালো করে বুঝে নিচ্ছি। কীভাবে কী করলে ঝুঁকি কম, অথচ সাফল্যের সম্ভাবনা বেশি। আলোচনা করে বুঝে নিচ্ছি আমরা। কারণ, ভুল হয়ে গেলে সেটা শুধরে নেবার সময় পাব না পরে আর। যখন কাজে নামব, দেখবে ঝটপট হয়ে গেল সব।