সখা-সখি আবার ব্যস্ত হয়ে পড়ল মাছ ধরায়।
মাথার উপর থেকে শৈবাল সরাতেই ক্ষোভে ফেটে পড়ল কিকো, বলি, কী হচ্ছে এসব! অ্যাঁ? এসব কী? আহা রে, কিকো! আহা রে বেচারী কিকো! হ্যাঁচ্চো, হ্যাঁচ্চো! মরুকগে ডাক্তার, দূরো!
তীরে উঠে বড় একটা পাথরের আড়াল থেকে নজর রাখল ওরা বোটটার উপর। নাক বরাবর সোজা শত্রুদ্বীপের দিকে চলেছে বোট! জেটিতে গিয়ে নোঙর না ফেলা পর্যন্ত তাকিয়েই থাকল ওরা। তারপর ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল সবাই একসঙ্গে।
একে অপরের দিকে চাইল ওরা, তারপর প্রশ্ন করল একই সঙ্গে, এইবার?
কিশোর কী বলে শুনবে বলে সবাই তাকাল ওর মুখের দিকে।
মহা বিপদ এখন আঙ্কেলের, বলল কিশোর। কাউকে খবর দেওয়ার উপায় নেই, কাউকে জানাবার উপায় নেই কিচ্ছ। যা করবার আমাদেরই করতে হবে।
যেমন? কী করার কথা ভাবছ? প্রশ্ন করল রবিন।
এখন যখন নিঃসন্দেহে জানতে পারলাম, সামনের ওই দ্বীপেই বন্দি হয়ে আছেন আঙ্কেল, ওখানেই যাব আমরা তাকে উদ্ধার করতে।
কীভাবে? প্রশ্ন করল জিনা। আমাদের, মানে, আইনস্টাইনের বোট নিয়ে গেলে ওরা দেখে বা শুনে ফেলবে না?
রাতে যাব আমরা, বলল কিশোর। আর শেষ এক মাইল যাব বৈঠা বেয়ে। চলো, গুহায় ফিরে গিয়ে আলোচনা করে দেখি ভালো কোনও প্ল্যান বেরোয় কি না।
হ্যাঁ, বলল জিনা। এখানে নিরাপদ বোধ করছি না। বোটটা এখনও আছে দেখতে পেলে শান্তি পাব কিছুটা।
রবিনের পিছু নিয়ে পাহাড় বেয়ে উঠল ওরা, তারপর নেমে গেল উপত্যকায়। ওখান থেকেই দেখা গেল বোটটা। জোয়ারের পানি সরে যাওয়ায় বালু আর নুড়ি পাথরের উপর উঠে আছে নাকটা। টিলা থেকে দৌড়ে নেমে গেল ওরা বোটের কাছে। বোট থেকে ভেজা কাপড় বদলে, পছন্দ মত খাবারের, টিন বাছাই করে নিয়ে চলে এল ওরা টিলার সেই গুহায়।
ভরপেট খেয়ে নিল ওরা সাতজন। সখার দেখাদেখি সখিও আজকাল এক আধটা ক্যাড় সার্ডিন গিলে নেয়-তবে বোঝা যায়, কাঁচা মাছের মত অতটা মজা লাগছে না ওর, সম্ভব হলে খাওয়ার সময় দুই আঙুলে টিপে ধরে রাখত নাক।
খাওয়ার সময় হাসিখুশি একটা ভাব বজায় রাখবার চেষ্টা করল মুসা, কিন্তু তেমন সাড়া মিলল না কারও কাছ থেকে। লেগুনে অস্ত্রের সন্ধান পাওয়া, আর ডিক কার্টারের খুন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা–এই দুটো ব্যাপার গভীর ছাপ ফেলেছে ওদের মনের উপর। সেই সঙ্গে বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়বার আগে মানসিক প্রস্তুতিরও প্রয়োজন রয়েছে। খাওয়ার সময় জমল না কোনও গল্প, ধরতে গেলে মুখ বুজেই খেয়ে উঠল ওরা দুপুরের খাবার।
অনেকক্ষণ চুপ করে থাকবার পর কথা বলল জিনা।
আমার মনে হয়, সন্ধে লাগার সাথে সাথেই আমাদের রওনা হয়ে যাওয়া। উচিত। বেশি দেরি হয়ে গেলে… কথাটা আর শেষ করল না ও। সহজ স্বীকারোক্তি দিল, বুক কাঁপছে আমার।
সে তো আমাদের সবারই কাঁপছে, বলল কিশোর। তার পরেও, আমরা ছেলেমানুষ, আঙ্কেলকে উদ্ধার করবার জন্যে যাব বলে যে মনস্থির করেছি, এ-ই তো বেশি। সফল হব কি বিফল হব, কেউ বলতে পারে না। তবে ঠিকই বলেছ, বেশি দেরি করা চলবে না।
আচ্ছা, ওই অ্যালবার্ট আইনস্টাইন সম্বন্ধে কী মনে হয়? প্রশ্ন করল রবিন।
খোদা! এক প্যাঁচ ঘুরল মুসার চোখ দুটো। মনে তো হচ্ছে, এই ভদ্রলোকের ব্যাপারে আমাদের মস্ত ভুল হয়ে গেছে। সত্যিই হয়তো উনি একজন পক্ষিবিশারদ প্রফেসর। ভাগ্যিস বাড়িটা লাগিয়ে দিইনি!
অবশ্য ছোট্ট একটু ভালো দিকও আছে এর, মৃদু হেসে বলল কিশোর। এই বোটটা শত্রুপক্ষের নয় জানার পর এবার হয়তো আমরা ওর ট্রান্সমিটারটা ব্যবহারের চেষ্টা করে দেখতে পারব।
কোন ওয়েভলেংথে মেসেজ পাঠাতে হবে তা কি জানা আছে আমাদের? প্রশ্ন তুলল জিনা।
না, জানা নেই, বলল কিশোর। একটু ভেবে আবার বলল, ঠিকই বলেছ, জিনা। না জেনে ওটা ঘাটাঘাটি করতে যাওয়া ঠিক হবে না। শত্রুপক্ষ টের পেয়ে গেলে বিপদ হতে পারে।
সন্ধের একটু আগে গুহার সামনে বসে গল্প করছে ওরা, এই সময় উত্তর পুব দিক থেকে এল প্রচণ্ড জোর আওয়াজ। আকাশের দিকে চোখ গেল সবার। দেখা গেল মস্ত এক সী-প্লেন আসছে এদিকে। আধমাইল দূর থেকেই নীচে নামা শুরু হলো ওটার। একটু পরেই হারিয়ে গেল পাহাড়ের আড়ালে। পরিষ্কার বোঝা গেল কোথায় নামতে যাচ্ছে প্লেনটা। লেগুন! অস্ত্র সরানোর কাজ শুরু হয়ে গেল ওদের!
অদম্য কৌতূহল চাপতে না পেরে রওনা হয়ে গেল ওরা কী হচ্ছে দেখবে বলে। পাহাড়ের মাথায় উঠে পরিষ্কার দেখা গেল, বিশাল সী-প্লেনটা ভাসছে মাঝ লেগুনে। বাতি জ্বেলে কাজ করছে ওরা। ঘড়ঘড় শব্দ হচ্ছে উইঞ্চের। প্যারাশুটে হুক বাধিয়ে তুলে আনা হচ্ছে প্যাকেটগুলো।
বিরাট গ্যাং! ভাবল কিশোর। কয়েকটা মোটর-বোট আছে, প্লেন আছে, সী-প্লেন আছে; এ ছাড়া অস্ত্র-শস্ত্র আর বিশাল নেট-ওঅর্ক তো আছেই। এত বড় প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে আমরা নিরস্ত্র চারটে ছেলে-মেয়ে তো কিছুই না! আমাদের অছে কেবল আইনস্টাইনের কাছ থেকে চুরি করা ছোট্ট একটা মোটর-বোট আর চারটে বুক ভরা সাহস। চেষ্টার ত্রুটি করব না আমরা, কিন্তু কী হতে যাচ্ছে কে জানে!
ফিরে গেল ওরা ওদের বোটের কাছে। জোয়ার এসে যাওয়ায় মনে হচ্ছে তীর থেকে কিছুটা দূরে সরে গেছে। এই কথা ভেবে আগেই লম্বা একটা রশি দিয়ে বড় একখানা পাথরের সঙ্গে বেঁধে রেখেছে মুসা বোটটাকে। এখন রশি ধরে টান দিতেই সুড়সুড় করে কাছে চলে এল বোট। উঠে পড়ল ওরা।