ব্যাপারটা রহস্যময় মনে হলো আমার কাছে। প্রশ্ন জাগল, এই দুর্ঘটনার সঙ্গে গুপ্তধনের কোন সম্পর্ক নেই তো? কিন্তু আমরা যে গুপ্তধন খুঁজছি কে জানে? কারও তো জানার কথা নয়!
হাসপাতালের ভিজিটিং আওয়ার শেষ হলো। বাড়ি ফিরে যেতে হবে। দাদাকে দেখাশোনার জন্যে তাঁর কাছে রয়ে গেলেন দাদী। বার বার দুঃখ প্রকাশ করলেন, আমাদের খুব অসুবিধে হয়ে যাবে। কিন্তু আমরা সে-কথা উড়িয়ে দিয়ে বললাম, কোন অসুবিধে হবে না। আক্কেল আলী থাকলেই যথেষ্ট। সে না থাকলেও অসুবিধে নেই, আমরাই রান্না করে খেতে পারব। বাড়িটা খালি হয়ে যাওয়ায় মনে মনে খুশি হলো বরং কিশোর–পরে বলেছে আমাকে আর মুসাকে, রহস্যটার সমাধান করতে সুবিধে হবে।
সকালে চমৎকার রোদ ছিল, কিন্তু হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এখন দেখি কেমন যেন মুখ গোমড়া করে রেখেছে আকাশ। গুমোট গরম, বাতাস স্তব্ধ। আকাশের ঈষাণ কোণে একটুকরো সুরমা রঙের মেঘ যেন গ্যাট হয়ে বসে আছে। ভাবেসাবে। মনে হলো, কোন কারণে যেন রেগে গেছে প্রকৃতি, ফেটে পড়ার অপেক্ষায় আছে। সন্দেহ হলো, কালবোশেখি আসছে না তো?
বাড়ি ফিরে উঠানে ঘুঘুর পালকে দানা খুঁটতে দেখলাম না। কবুতরগুলো গিয়ে বসেছে ছাতের কার্নিশে, বকবকম নেই, চুপ করে থাকার মধ্যেও যেন কি এক ধরনের অস্থিরতা। বিপদের আশঙ্কা করছে বোঝা গেল।
যাই হোক, খাওয়া-দাওয়া সেরে আর কোন কাজ না থাকায় কিশোরের উৎসাহে ছবি-রহস্য সমাধানের কাজে লেগে গেলাম আমরা। দাদার এখন অনেক টাকা দরকার। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গুপ্তধনগুলো উদ্ধার করা গেলে ভাল।
যে কথাটা তখন বলতে গিয়ে বলতে পারেনি কিশোর, দাদার অ্যাক্সিডেন্টের কথায় থেমে যেতে হয়েছিল, সেটাই বলল, বাক্সে পাওয়া ছবির চুলের ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছ? খাটো করে আঁকা-ই হয়েছে দেয়ালে ঝোলানো ছবিটার বাবরি চোখে পড়ানোর জন্যে। আর এর মধ্যেই করে রাখা হয়েছে কারসাজি। ভাল করে দেখো আরেকবার, তোমরাও বুঝতে পারবে।
দেখলাম, যতভাবে সম্ভব। সেই আগের মতই অন্ধকারে রইলাম। মুসা বলল, দেখো, পারলে আগেই পেরে ফেলতাম; ঝুলিয়ে না রেখে বলেই ফেলো না ছাই!
কিশোর বলল, যত কারসাজি চুলের মধ্যে করে রাখা হয়েছে। দেখো, ভিন্ন ভিন্ন রঙে অতি খুদে খুদে অক্ষর আর নম্বর লেখা।
প্রায় ছোঁ মেরে কিশোরের হাত থেকে ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা কেড়ে নিলাম। সত্যিই তো! খুব সরু নিবের কলম দিয়ে এমন করে আঁকা হয়েছে ওগুলো, মিশে রয়েছে কোঁকড়া চুলের মধ্যে। জানা না থাকলে মনে হবে চুলের অলঙ্করণ করার জন্যে ওসব এঁকেছে আর্টিস্ট। ভাল বুদ্ধি করেছিলেন আমিন উদ্দিন সরকার।
নিশ্চয় কোন তথ্য দিয়েছেন! মুসা বলল। গুপ্তধনের খোঁজ!
তা দিয়েছেন, কিশোর বলল। তবে খুবই গোলমেলে জিনিস। সাঙ্কেতিক। সঙ্কেতের মানে বের করতে না পারলে বোঝা যাবে না কোথায় আছে।
তাহলে বসে আছো কেন? শুরু করে দাও না। আমরা যে পারব না, অন্তত আমি পারব না এ তো জানা কথাই।
আবার ম্যাগনিফাইং গ্লাস তুলে নিল কিশোর। দেখতে লাগল খুদে অক্ষর আর নম্বরগুলো।
দেখো, একটা নিয়ম মেনে চলা হয়েছে। চুলের দুটো করে ভাজের ফাঁকে, মাঝখানে একসারিতে রয়েছে অক্ষরগুলো। একেক সারির একেক রঙ। লালচে, ধূসর, বাদামী, ছাই রঙ…রঙের এই বিভিন্নতা কেন? একেকটা রঙ কি একেকটা বাক্য গঠন করেছে?
অক্ষরগুলো এত ছোট, ঠিকমত পড়া যায় না, বললাম।
ইচ্ছে করেই অত ছোট করেছে, নইলে তো যে কারোই চোখে পড়ে যেত। গ্লাস দিয়ে চেষ্টা করলে পড়া যাবে। এক কাজ করো, কাগজ কলম নিয়ে এসো।
নোটবুক আর পেন্সিল পকেটেই থাকে আমার। বের করে তৈরি হয়ে বসলাম।
বলা নেই কওয়া নেই, হঠাৎ বাজ পড়ল প্রচণ্ড শব্দে। ভীষণ চমকে গেলাম। ছুটে দরজার বাইরে বেরিয়ে এলাম আমি আর মুসা। তাজ্জব হয়ে দেখলাম আকাশের রূপ। সেই সুরমা রঙের মেঘের টুকরোটাই বিরাট-বিশাল হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে প্রায় আধখানা আকাশ জুড়ে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে তার ভেতর। আরও কিছু ছেঁড়া মেঘের টুকরো ছুটাছুটি করছে আকাশের ইতিউতি।
কালবোশেখি আসছে, পেছন থেকে বলে উঠল কিশোর।
মালীর ঘর থেকে বেরিয়ে এল আক্কেল আলী আর কালু। আক্কেল আলী বলল, ঘরে যান, ঝড়বৃষ্টি হবে।
আমি বললাম, আসুক। ঝড় দেখব আজ।
হাসল আক্কেল আলী। বলল, আম কুড়ানোর ইচ্ছে আছে নাকি?
আছে! লাফিয়ে উঠল মুসা। অসুবিধে হবে?
কিছু হবে না, যদি আসল ঝড়টা আসার আগেই ঘরে ঢুকে যান। বেশি ঝড়ে ডাল ভেঙে পড়ে, গাছ উপড়ায়, মাথায় পড়লে মরবেন।
শাই শাই একটা আওয়াজ কানে আসছিল, বুঝতে পারছিলাম না কিসের, গাছের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তেই বুঝলাম বাতাসের শব্দ শুনছিলাম। অনেক জায়গায় অনেক রকমের ঝড় দেখেছি, কিন্তু এর যেন তুলনা হয় না। স্তব্ধ হয়ে থাকা গাছের ডালপাতা আচমকা ভীষণ দুলতে আরম্ভ করল। প্রচণ্ড আঘাতে শুকনো পাতা উড়তে লাগল। টুপটাপ খসে পড়তে লাগল পাকা আম।
লাফ দিয়ে বারান্দা থেকে নেমে গেলাম আমরা তিনজন। পাকা আম কুড়াতে শুরু করলাম। কিন্তু কটা কুড়াব! দু-হাতে দুটো তুলে নিতে না নিতেই আশপাশে আরও দশ-বিশটা করে পড়ে। আম কুড়াতে যে এত মজা জানতাম না। মহাআনন্দে আমাদের সঙ্গে এসে যোগ দিল কালু। আম তো তুলতে পারে না, চারপাশে নাচানাচি আর ঘেউ ঘেউ জুড়ে দিল। খানিক দূরে দাঁড়িয়ে হাসছে আক্কেল আলী।