পারে, মাথা ঝাঁকাল কিলোর।
আমার মনে হয়, মুসা বলল, ছবিটার নিচে কোন গোপন দরজা আছে। ফ্রেমটা কত বড় দেখেছ?
সেটাও সম্ভব। চলো, বরং দেখেই আসি।
শূন্য হলঘর। দাদা-দাদী শোবার ঘরে চলে গেছেন। আক্কেল আলী থাকে বাইরের একটা ঘরে, আগে মালী থাকত ওঘরে। সেটার দরজাও বন্ধ, তার মানে আক্কেল আলীও শুয়ে পড়েছে। বাড়ির বাইরে বাগানে পাহারা দিচ্ছে কালু। আমরা টর্চের আলো ফেলতেই এগিয়ে এল লেজ নাড়তে নাড়তে।
গুপ্তধন খোঁজার এটা চমৎকার সময়। আবার হলঘরে ফিরে এলাম আমরা। আমিন উদ্দিন সরকারের ছবিটার সামনে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। আসল না নকল, নিচে আরও ছবি আঁকা আছে কিনা বোঝার উপায় নেই।
এ ভাবে দেখে কিছু বুঝব না, কিশোর বলল। বুঝতে হলে ল্যাবরেটরিতে পাঠাতে হবে।
নিচে পথ আছে কিনা দেখে ফেলি না কেন? মুসা বলল।
বেশ শক্ত করে দেয়ালে লাগানো আছে ভীষণ ভারি ফ্রেমটা। খুলে সরাতে যথেষ্ট বেগ পেতে হলো।
সরিয়ে আবারও হতাশ হলাম। কোন ফঁক-ফোকর নেই। একেবারে নিরেট দেয়াল। দেয়ালে ঠুকে ঠুকে দেখলাম, একটা ইঞ্চি জায়গাও পেলাম না যেখান থেকে ফাপা আওয়াজ বেরোয়।
কি আর করব। ছবিটা আবার আগের জায়গায় বসিয়ে রাখলাম।
আগতত আর কিছু করার নেই এখানে। তদন্তের কাজ রাতের মত স্থগিত রেখে ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ার প্রস্তাব দিল মুসা। সানন্দে রাজি হলাম আমি। তবে কিশোরের যাওয়ার ইচ্ছে নেই। সে জানাল, কিছু থাকলে এই ঘরটাতেই আছে। আমার মন বলছে!
থাকলে সেটা সকালেও বের করা যাবে, বললাম আমি। চলো, গিয়ে শুয়ে পড়ি। ঘুমিয়ে মাথা ঠাণ্ডা করি আগে।
০৬.
উত্তেজনায় ভাল ঘুম হলো না সে রাতে। দুঃস্বপ্ন দেখলাম। পাহাড়ের গুহায় আলিবাবার রত্ন খুঁজে পেয়েছি যেন আমরা, কিন্তু বের করে আনার আগেই কেড়ে নিল চল্লিশ ডাকাত। আমাদের ধরে বেঁধে ফেলল। মুসাকে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করাল পাথরের বেদিতে। তার মুণ্ডু কাটবে। হাউমাউ করে চিৎকার করতে লাগল মুসা। আরেক ডাকাত এসে আমার কাধ চেপে ধরে ঝাঁকাতে লাগল।
ভেঙে গেল ঘুম। দেখি, ওঠার জন্যে আমার কাঁধ ঝাঁকাচ্ছে কিশোর।
নাস্তা সেরে দাদা চলে গেলেন শহরে, দাদী রান্নাঘরে। আমরা চলে এলাম হলঘরে। আগের রাতের অসমাপ্ত কাজটা শেষ করার জন্যে। কিশোরের ধারণা, রহস্যের সমাধান রয়েছে আমিন উদ্দিন সরকারের ছবিটাতে। গুপ্তধনের চাবিকাঠি ওটাই।
কিন্তু তাকিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে চোখ ব্যথা করে ফেললাম। অাভাবিক কিছুই বের করতে পারলাম না ছবিটার। নিরেট কাঠে তৈরি ফ্রেম, ফাপাও নয় যে তার ভেতর কোন নকশা জাতীয় কিছু ভরে রাখা যাবে।
কিন্তু কিশোর হাল ছাড়ল না। সামনে এগিয়ে, পিছিয়ে গিয়ে, মাথা এপাশে কাত করে, ওপাশে কাত করে দেখতে লাগল। সেই সঙ্গে চলল তার নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটা।
আচমকা আনমনে বলে উঠল, ব্যাপারটা অদ্ভুত!
কি অদ্ভুত? জানতে চাইলাম আমি আর মুসা।
আমিন উদ্দিন সরকারের বাবরি চুল।
চুলে আবার কি করল? বুঝতে পারলাম না।
হয়তো কোন ফকির কিংবা পীরের মুরিদ ছিলেন, মন্তব্য করল মুসা। এ দেশে অনেককেই তো ও-রকম রাখতে দেখি, যেন মুরিদ হলে বাবরি না রাখলে চলে না।
পীরের অনুকরণ করে আরকি, কিশোর বলল। আমিন উদ্দিন সরকার কেন ও রকম চুল রেখেছিলেন, সেটা তার ব্যাপার, আমাদের মাথাব্যথা নেই। আমার প্রশ্ন হলো, বাক্সের ছবিটাতে খাটো করে ছাঁটা চুল এঁকেছেন কেন তিনি?
আঁকার সময় হয়তো তার ছোট চুল ছিল।
সেই কথাটাই ভাবছি। কি করে জানব? দীর্ঘ একটা মুহূর্ত আবার ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইল কিশোর। দু-বার চিমটি কাটল নিচের ঠোঁটে। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, রবিন, ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা নিয়ে আসবে? ছবিটাও নিয়ে এসো।
ঘর থেকে ওগুলো এনে দিলাম তাকে।
দুটো ছবি মিলিয়ে মিলিয়ে দেখতে লাগল সে।
বাবরির ওপর ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা ধরে রাখল দীর্ঘক্ষণ। ধীরে ধীরে হাসি ফুটল তার মুখে। মাথা দুলিয়ে বলল, ই, বুঝেছি! এত্তো সহজ, অথচ…
কি বুঝেছ! প্রায় চিৎকার করে উঠলাম আমি আর মুসা।
কিন্তু কিশোর জবাব দেয়ার আগেই ঝটকা দিয়ে খুলে গেল সদর দরজা। ছুটে ঘরে ঢুকল আক্কেল আলী। ভীষণ উত্তেজিত। চিৎকার করে ডাকতে লাগল, মা, ও মা, জলদি বেরোন! সাংঘাতিক কাণ্ড হয়ে গেছে! মা-আ!
রান্নাঘর থেকে তাড়াহুড়ো করে বেরোলেন দাদী। আঁচলে হাত মুছতে মুছতে জিজ্ঞেস করলেন, কি হয়েছে রে! অত চিৎকার করছিস কেন?
সর্বনাশ হয়ে গেছে, মা! সাহেব অ্যাক্সিডেন্ট করেছেন। লোক এসে খবর দিল, এখুনি হাসপাতালে যেতে হবে আপনাকে!
কিসের গুপ্তধন খোঁজা, আর কিসের ছবি-রহস্যের সমাধান, দল বেঁধে হাসপাতালে ছুটলাম আমরা।
খুব ব্যথা পেয়েছেন মতিদাদা। সারা গায়ে ছোট-বড় ব্যান্ডেজ, বা পায়ে প্লাস্টার। হাড় ভেঙে গেছে। তবে হুঁশ আছে তার। আমাদের দেখে মলিন হাসি হাসলেন। প্রথমেই দাদীকে সাবধান করে দিলেন চিৎকার করে কান্নাকাটি না করতে।
তাঁর মুখেই জানলাম, রঙ সাইড থেকে একটা ট্রাক এসে গুঁতো মেরেছিল তার গাড়িকে। ভাগ্যিস তিনি আস্তে চালাচ্ছিলেন, তাই অনেকটা সামলে নিতে পেরেছেন। নয়তো মুখোমুখি সংঘর্ষেই ভর্তা হয়ে যেত গাড়িটা। রাস্তার পাশের খাদে উল্টে পড়াও বিচিত্র ছিল না। যা-ই ঘটুক না কেন, এ কাহিনী বলার জন্যে আর বেঁচে থাকতেন না তাহলে। ট্রাকের নম্বর রাখতে পারেননি তিনি। তবে একটা ব্যাপার তার মনে হয়েছে, ইচ্ছে করেই এসে তো লাগিয়েছে ট্রাকটা। যেন মারার জন্যেই রাস্তার মোড়ে ওত পেতে বসে ছিল।