দাদা-দাদী নিশ্চয় লোকটার সঙ্গে হলঘরে আছে, ওখানে বসে বাক্স খোলা নিরাপদ নয়, তাই ডাইনিং রুমে চলে এলাম আমরা। টেবিলে বসেই বাক্সটা খোলায় মন দিল কিশোর। বাক্সের গায়ে হালকা একটা রেখা চোখে পড়ল। বোঝা গেল, ওটাই জোড়া, কিংবা ঢাকনার কিনারা। ঘর থেকে গিয়ে তার ব্যাগ থেকে ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা এনে দেয়ার অনুরোধ করল আমাকে।
এনে দিলাম।
গ্লাস দিয়ে দেখে নিশ্চিত হলো সে, ঢাকনা কোনটা। সূক্ষ্ম ফাঁকটায় ছুরির মাথা ঢুকিয়ে চাড় দিতে লাগল। সামান্যতম নড়ল না ঢাকনাটা। আরও জোরে ছাড় দিতেই সামান্য ফাঁক হলো মনে হলো। জোরে জোরে চাড় দিতে লাগল তখন।
অবশেষে খুলে গেল ঢাকনা। মনে হলো, কোন ধরনের আঠা মাখিয়ে তারপর চেপে বসিয়ে দেয়া হয়েছিল ওটা, সে জন্যেই খুলতে অত কষ্ট হয়েছে।
ভেতরে কি আছে দেখার জন্যে আগ্রহে সামনে ঝুঁকে পড়লাম আমরা তিনজন।
হতাশ হতে হলো। কিছুই নেই! কিচ্ছু না! একটা সোনার মোহর কিংবা একটা সাধারণ আঙটিও নেই। গুপ্তধন তো দূরের কথা।
বাক্সটা টেবিলে রেখে দিয়ে নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটতে শুরু করল কিশোর।
খালি বাক্স হাতে নিয়ে আবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল কিছুক্ষণ মুসা। তারপর নিরাশ ভঙ্গিতে রেখে দিয়ে বলল, দূর, খামোকা সময় নষ্ট!
আমি হাতে তুলে নিলাম বাক্সটা। ব্যাপারটা আমার চোখেই পড়ল প্রথম। বাইরের দিকটা যত বড়, ভেতরের দিকটা তার চেয়ে অনেকটাই ছোট, বিশেষ করে নিচের দিক। অতটা তো হওয়ার কথা নয়! অত পুরু নয় কাঠ। তাহলে? কিশোরকে বললাম আমার সন্দেহের কথাটা।
থাবা দিয়ে আমার হাত থেকে বাক্সটা কেড়ে নিয়ে একবার তাকিয়েই বলে উঠল কিশোর, তাই তো! ফলস বটম আছে।
বাক্সের নিচে বসানো চোরা কুঠরিটা খোলার চেষ্টা করতে করতে ঘেমে গেল সে, কিন্তু লাভ হলো না। খুলতে পারল না। শেষে রেগে গিয়ে মারল এক আছাড়। ভেঙে ফেলতে চায়। আর তাতেই হয়ে গেল কাজ। প্রচণ্ড আঘাতে ছুটে গেল ভেতরের স্প্রিঙ, খুলে গেল কুঠুরির ঢাকনা।
হুমড়ি খেয়ে পড়লাম আমরা তিনজন। ভেতরে রয়েছে একটা পুরানো খাম।
ছোঁ মেরে তুলে নিল কিশোর। খামের ভেতর থেকে বেরোল একটা অনেক পুরানো চাবি, আর এক তা ভাজ করা কাগজ। চাবিটা নিশ্চয় সিন্দুক কিংবা আলমারির, ভাবলাম, আর কাগজটা শুপ্তধন কোথায় আছে তার নকশা। দুরুদুরু বুকে অপেক্ষা করতে লাগলাম।
চাবিটা পকেটে রেখে ভাঁজ করা কাগজটা মেলল কিশোর।
আরেকবার হতাশ হতে হলো আমাদেরকে। কোন নকশা-টকশা নেই, কলম দিয়ে আঁকা একজন মানুষের ছবি। বিশেষত্ব একটাই, কয়েক রঙে আঁকা হয়েছে ছবিটা, একই কলম ব্যবহার করে, ভিন্ন ভিন্ন রঙের কালি দিয়ে। নিখুঁত করে আঁকা। কার ছবি চিনতে পারলাম। হলঘরে দেখেছি। জমিদার আমিন উদ্দিন সরকারের।
মানে কি এর? বিড়বিড় করল কিশোর।
ঘোড়ার ডিম! রেগে গেছে মুসা।
হতে পারে ওই ছবিটাই খুব দামী… বলতে গিয়ে থেমে গেলাম। চোখের কোণ দিয়ে চোখে পড়ল একজন মানুষ। নিঃশব্দে কখন এসে দাঁড়িয়েছেন ঘরে, উত্তেজনায় খেয়াল করিনি।
মুখ তুলে তাকালাম। গভীর আগ্রহে ছবিটার দিকে তাকিয়ে আছেন সেই ভদ্রলোক, যিনি বাড়ি কিনতে চান। আমরা তাকাতেই জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় পেয়েছ এটা?
বাক্সের মধ্যে, জবাব দিয়ে দিল মুসা।
বাক্সটা কোথায় পেলে?
কিশোরের বার বার চোখ টেপা সত্ত্বেও খেয়াল করল না মুসা, বলে দিল, পোড়োবাড়িতে। মজা পুকুরের ধারে বেতবন আছে না, সেখানে।
একটু দেখতে পারি ছবিটা? হাত বাড়ালেন ভদ্রলোক।
এই সময় ঘরে ঢুকলেন মতিদাদা। জিজ্ঞেস করলেন, কিসের ছবি?…এ-কি, এ তো আমার দাদার! কোথায় পেলে?
জানানো হলো তাকে।
লক্ষ করলাম, ছবিটার দিকে তাকিয়ে চকচক করতে লাগল ভদ্রলোকের চোখ, যিনি বাড়ি কিনতে এসেছেন। ছবিটা রেখে ভোলা বাক্সটাও হাতে নিয়ে দেখলেন। তারপর টেবিলে রেখে ঘুরে তাকালেন দাদুর দিকে, বললেন, হ্যাঁ, বাকি ঘরগুলো দেখার আর দরকার নেই আজ। রাতের বেলা না দেখে অন্যদিন এসে দিনের বেলা দেখব।
কিন্তু আপনিই তো দেখার জন্যে চাপাচাপি করলেন! ভদ্রলোকের এই হঠাৎ মত পরিবর্তনে যেন কিছুটা অবাকই হয়েছেন দাদা।
তা বলেছি। এখন বুঝতে পারছি, ঠিকই বলেছেন, রাতের বেলা ভালমত দেখা যায় না সব।
বেরিয়ে গেলেন আবার দু-জনে।
রাতের বেলা খাবার টেবিলে ছবিটা নিয়ে আলোচনা হলো। দাদু বললেন, আমার দাদু কিছুটা পাগলাটে স্বভাবের ছিলেন। ধাঁধা আর রহস্যের প্রতি বেজায় ঝোঁক ছিল তাঁর। নিজে নিজে অনেক ধাঁধা তৈরি করেছেন। ছবিও ভাল আঁকতে পারতেন।
তোমার কি মনে হয়, জিজ্ঞেস করল কিশোর, এই ছবিটাও কোন ধরনের ধাঁধা? গুপ্তধন কোথায় আছে তার ইঙ্গিত?
তার দিকে তাকিয়ে হাসলেন দাদা। তোর মাথায়ও দেখি উদ্ভট সব ভাবনা খেলে বেড়ায়। দাদার সঙ্গে মিলত ভাল। হাহ্ হাহ্!
তুমি গুরুত্ব দিচ্ছ না? তাহলে বাক্সটার মধ্যে অত যত্ন করে উঠিয়ে চালার খাপে ভরে রাখলেন কেন?
ওটাও আরেক পাগলামি।
কিন্তু মেনে নিতে পারল না কিশোর, তার মুখ দেখেই বোঝা গেল।
খাওয়ার পর ঘরে এসে চাবিটা দরজার চৌকাঠের নিচের একটা ফোকরে লুকিয়ে রাখল কিশোর। বলল, সাবধানের মার নেই।
ডাইনিং রুমে তখন যে কথাটা শেষ করতে পারিনি, সেই কথাটাই তুললাম আবার, ছবিটা দামী কোন ছবি নয় তো? হয়তো আমিন উদ্দিন সরকারের ছবির নিচে আঁকা আছে অনেক দামী কোন শিল্পীর ছবি। হতে পারে না?