দুটো গ্লাস দেখতে পেলাম টেবিলে।
কিশোর বলল, শেষবার যারা ঢুকেছিল এখানে, কথা বলেছিল বসে, তারা নিশ্চয় এই গ্লাসে করে কিছু খেয়েছিল। দু-জন লোক।
আক্কেল আলী বলল কিছুটা ক্ষোভের সঙ্গেই, কি আর খাবে! মদ খেয়েছিল আরকি! এ বাড়িতে তো এক সময় রীতিই ছিল, পুরুষমানুষের মদ খেতে হবে।
একটা গ্লাস তুলে নিয়ে দেখতে দেখতে কিশোর বলল, এ রকম গ্লাস রান্নাঘরের আলমারিতেও দেখেছি।
খাটো খাটো গ্লাস, খুব ভারি কাঁচে তৈরি, ইংল্যান্ডের একটা কোম্পানির নাম ছাপ দিয়ে লেখা রয়েছে তলায়।
অনেক খোঁজাখুঁজি করেও ঘরগুলোতে আর কোন জিনিস পেলাম না। গুপ্তধনের কোন চিহ্ন না পেয়ে কিছুটা নিরাশই হলাম।
রাতে খাবার টেবিলে বসে পোড়ো বাড়িতে ঢোকার খবরটা জানালাম আমরা।
গ্লাস দুটো পেয়ে খুশি হলো দাদী।
মতিদাদা বললেন, ঘরটা সুন্দর। তোমাদের বয়েসে চাঁদনী রাতে, বৃষ্টির দিনে, কতদিন গিয়ে একা একা বসে থেকেছি ওখানে। বন দেখতে খুব ভাল লাগত। বিশেষ করে পুকুরটা। শাপলায় ভরা, চাঁদের আলোয় রহস্যময় হয়ে উঠত। মুষলধারে বৃষ্টি যখন হত, তখন লাগত আবার আরেক রকম। শাপলাপাতায় বৃষ্টির নাচন দেখেছ? দুর্দান্ত!
চাঁদনী রাতে সিন্দুকেরা নিশ্চয় ছানাপোনা নিয়ে বেরোত! মুসা বলে উঠল। উঠে আসত পানি থেকে। ধাড়িটা থাকত আগে আগে, তার পেছনে মাদীটা, আর তাদের পেছনে ছানার দল। হেলেদুলে এগোচ্ছে বড় দুটো, আর পিচ্চিগুলো নাচানাচি করছে। ছবি তুলে রাখতে পারলে কোটিপতি হয়ে যাওয়া যেত!
ভুরু কুঁচকালেন দাদা। কারা বেরোত?
মুসার ভূতুড়ে সিন্দুকের কথা বুঝিয়ে বলল কিশোর।
হা-হা করে হাসলেন দাদা। বললেন, তাহলে একদিন গিয়ে রাতে থেকেই দেখো, বেরোয় কিনা?
থাক থাক, তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন দাদী, ছেলেগুলোকে আর কুবুদ্ধি দিয়ো না। সাপখোপের আড্ডা, শেষে কামড় খেয়ে মরবে।
কিন্তু কুবুদ্ধিটা কিশোরের মাথায় ঠিকই ঢুকে গেল। ঘরে ফিরে এসে শলা পরামর্শ করতে লাগল আমাদের সঙ্গে, ঘরটা পরিষ্কার করে ওখানে রাত কাটালে মন্দ হয় না। আমরা না করলাম না। একবার যখন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে সে, সেটা করবেই, আর তাকে ফেরানো যাবে না। তা ছাড়া ভয় ভয় করলেও ওখানে থাকতে আমাদের যে একেবারেই ইচ্ছে করছিল না, তা নয়।
সুতরাং পরদিন থেকেই দাদীকে না জানিয়ে কাজ শুরু করে দিলাম আমরা। ধুয়ে মুছে ঝকঝকে তকতকে করে ফেললাম বাড়িটাকে। আশপাশের জঙ্গল সাফ করলাম। জানালা খুলে দেয়া গেল। আরেকটা চমৎকার জিনিস বেরোল, একট। অ্যাকোয়ারিয়াম। মাটিতে বেশ বড় একটা ট্যাংক বানিয়ে, চারপাশ পাকা করে দেয়া হয়েছে। নালা কেটে পুকুর থেকে পানি ঢোকার ব্যবস্থা আছে। তাতে কিছু জলজ উদ্ভিদ লাগিয়ে দেয়া হয়েছে এমন করে, যাতে মাছের আগ্রহ জন্মায়। ওই অ্যাকোয়ারিয়ামে এসে ঢোকে ওরা। বহু দিন পরিষ্কার করা হয় না বলে ময়লা হয়ে আছে এখন ট্যাংকটার পানি, গাদা গাদা পাতা পড়ে পচে আছে তলায়। ওই পানিতেই কয়েকটা পুঁটি আর একটা টাকি মাছকে ঘুরতে দেখলাম।
দু-দিন লাগল সব ঠিকঠাক করতে।
তৃতীয় দিনের দিন বিকেলে ওই বাড়িতে বসেই চা খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা। খাবার আর চায়ের কেটলি গুছিয়ে নিয়ে রওনা হলাম।
ঘরের দাওয়ায় বসে বসে প্রকৃতি দেখতে লাগলাম আমরা।..
করুণ গলায় টেনে টেনে বিলাপ করছে ঘুঘু। মাঝে মাঝে অলস ভঙ্গিতে শিস দিচ্ছে দোয়েল। পুকুরের পানিতে শাপলার ফাঁকে ফাঁকে পোকা আর ছোট মাছ খুঁজে বেড়াচ্ছে দুটো জলমুরগী।
পশ্চিমে যতই ঢলতে লাগল সূর্য, বনতলে লম্বা হতে লাগল গাছের ছায়া।
চা খাওয়া শেষ করলাম আমরা।
হঠাৎ মাথার ওপর কর্কশ গলায় ডেকে উঠল একটা পেঁচা। চমকে চোখ তুলে তাকালাম। চালার খাপে বাসা ওটার। দিন শেষ হয়ে রাত আসছে, জেগে উঠছে বনের নিশাচরেরা। খানিক আগেই উঁকি দিয়ে গেছে একজোড়া শেয়াল।
বাসাটার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বলে উঠল কিশোর, ওটা কি?
উঠে দাঁড়াল সে।
আমি আর মুসাও তাকালাম।
কোথায়? জিজ্ঞেস করলাম।
বাসাটার পাশে দেখো। বাক্সের কোণা মনে হচ্ছে না?
খাইছে! তাই তো!
মোটেও দেরি করল না মুসা। খাপের ফাঁকে খুঁজে রাখা ছোট কাঠের বাক্সটা বের করে আনল। প্রায় দুশো বছরের পুরানো বাক্স, সারা গায়ে পিতলের পাত বসিয়ে নকশা করা। নিশ্চয় কারও শখের জিনিস ছিল এটা। বেশ ভারি।
এর মধ্যে গুপ্তধন নেই তো? কানের কাছে নিয়ে বাক্সটা ঝাঁকি দিয়ে ভেতরে কি আছে বোঝার চেষ্টা করল মুসা।
না, বেশি ছোট, কিশোর জবাব দিল। ভাবছি, খাপের মধ্যে গেল কি করে? পাখিতে নিতে পারেনি। এটা তোলার সাধ্য হবে না কোন পাখিরই। তাহলে কেউ রেখেছে। মানুষ।
আছে কি এর মধ্যে? জিজ্ঞেস করলাম।
খুলেই দেখা যাক না, মুসার হাত থেকে বাক্সটা নিয়ে ডালা খোলার চেষ্টা করল কিশোর। কিন্তু ডালাটা যে কোন দিকে, কোটা ওপর আর কোটা নিচ, সেটাই বোঝা গেল না। বেশ কায়দা করে তৈরি বাক্সটা।
অন্ধকার হয়ে গেছে। আলোয় না দেখে বাক্সটা খোলা যাবে না বুঝতে পেরে সেই চেষ্টা আর করলাম না আমরা। ওটা নিয়ে বাড়ি ফিরে চললাম।
.
০৫.
গাড়ি-বারান্দায় সেই গাড়িটাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম আবার বাড়ি কিনতে চায় যে লোকটা, তার। ঘনঘন আসা-যাওয়া করছে, কিনেই ছাড়বে। খুব তাড়াতাড়ি গুপ্তধনগুলো আমরা উদ্ধার করতে না পারলে বাঁচানো যাবে হীরাদাদীর এত সাধের এই জমিদার বাড়ি।