ব্যাঙটা যেখানে বসে ছিল সেখানে তাকাতেই একটা অদ্ভুত জিনিস দেখলাম। একটা চৌকোণা পাথর। ফুটখানেক পানির নিচে আরও একটা। কাত হয়ে আছে। শ্যাওলায় ছাওয়া। পিচ্ছিল যে হয়ে আছে বোঝার জন্যে পা রাখার দরকার নেই, দেখেই বোঝা যায়। পা দিলেই আছাড় খেয়ে পড়তে হবে পানিতে।
আশ্চর্য! ভুরু কুঁচকে পানির নিচে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বলল কিশোর, এখানে সিঁড়ি বানাল কে?
সিঁড়ি নাকি? সিন্দুকের ভয় ভুলে এগিয়ে গিয়ে ঝুঁকে তাকাল মুসা।
তা ছাড়া আর কি?
তাই তো। পুকুরে তো সিঁড়ি বানায় মানুষ ঘাটলা তৈরি করলে। নেমে গোসল করার জন্যে।
কিংবা ঘাটলার সিঁড়িতে বসে আয়েশ করার জন্যে।
তাহলে কে সেই আয়েশী লোক?
নিশ্চয় সরকারদের কেউ। দেখো, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, কাছাকাছি ঘরবাড়ি আছে। বাগানবাড়ি থাকলেও অবাক হব না।
এদিক ওদিক তাকাতে শুরু করল কিশোর। ঘাটের কাছ থেকে গজ পঞ্চাশেক দূরে বিশাল এক বেতের ঝাড়। সেটার দিকে চোখ আটকে গেল তার। আনমনে হাত নেড়ে আমাদের বলল, চলো তো, দেখি!
বেত গাছের সাংঘাতিক কাটা। লম্বা লম্বা লতা হয়, তাতে আঁকশির মত কাটা, ছোঁয়া লাগলেই চামড়া ছড়ে গিয়ে রক্ত বেরিয়ে যায়।
পড়ে থাকা একটা মরা ডাল খুঁজে আনল মুসা। সেটা দিয়ে কোনমতে বেত ফাঁক করে করে ভেতরে তাকাল। চোখে পড়ল একটা দেয়াল। আর কোন সন্দেহ নেই। সত্যিই একটা বাড়ি আছে এখানে।
ভেতরে কি আছে দেখতে হয়, কিশোর বলল।
এখানে গুপ্তধন আছে ভাবছ নাকি? জিজ্ঞেস করল। গরমের ছুটি
সম্ভাবনা কম। তাহলে পেয়ে যেত লোকে। তবু দেখতে চাই কি আছে।
ঢুকবে কি করে? জিজ্ঞেস করলাম। যা বেতের বেত, চোখের পলকে ছিলেছুলে দেবে।
বাড়ি গিয়ে দা এনে কাটতে হবে। চলো, আক্কেল আলীর কাছ থেকে নিয়ে আসি।
সব শুনে আক্কেল আলী বলল, তোমাদের না ওদিকে যেতে মানা করেছি, তা ও গেলে…
আরে দূর, হাত নেড়ে উড়িয়ে দিল কিশোর, গেলে কি হয়? এর চেয়ে অনেক গভীর আর বিপজ্জনক জঙ্গলে ঢুকেছি আমরা। দুটো দা দাও। ভেতরে ঢুকব।
সাপের কামড় খেয়ে মরার ইচ্ছে হয়েছে আরকি। চলো, আমিও যাব। একলা ছেড়ে দিলে মা বকবেন।
তোমার আর যাওয়ার দরকার নেই, মুসা বলল, আমরাই কাটতে পারব।
তাহলে মা-কে বলে যেতে হবে। নইলে আমিই বলে দেব। তোমাদের কিছু হলে শেষে মা আমাকে আস্ত রাখবেন না।
দাদীকে বলতে গেলে বাধা দিয়ে বসতে পারেন, এই ভয়ে আক্কেল আলীর কথার আর প্রতিবাদ করলাম না। তাকে সঙ্গে নিয়ে রওনা হতে যাব, এই সময় বারান্দায় বেরোলেন দাদী। এসেছিস তোরা? এ-কি, এখনও গোসলই করিসনি। যা যা, জলদি যা। আমার রান্না হয়ে গেছে।
মুগডাল দিয়ে রুইমাছের মাথার মুড়িঘন্ট, রুইমাছ ভাজা, চালকুমড়া ভাজি আর ডাল দিয়ে গলা পর্যন্ত গিললাম। তারপর যখন ক্ষীরের মত ঘন দুধ আর শহর থেকে কিনে আনা ফজলি আম নিয়ে এলেন দাদী, করুণ চোখে ওগুলোর দিকে তাকাতে লাগলাম। কারণ আমার আর একটা দানা গেলারও সামর্থ্য নেই। তবে মুসা ছাড়ল না। ইয়া বড় বড় দুটো ফজলি আম আর বড় এক বাটি দুধ মেরে দিল অনায়াসে। কম করে হলেও এক হাজার বার আউড়াল-এর চেয়ে সুস্বাদু খাবার পৃথিবীর আর কোন দেশে নেই।
ভরপেট খেয়ে তক্ষুণি আর বেরোতে পারলাম না। আধঘণ্টা মত গড়াগড়ি দিয়ে নিলাম বিছানায়। তারপর উঠে আক্কেল আলীকে সঙ্গে করে দা নিয়ে রওনা হলাম মজা পুকুরের পাড়ে।
.
০৪.
আক্কেল আলীকে সঙ্গে এনে খুব ভাল করেছি। খানিক পরেই বুঝলাম, সে না এলে ওই বেত কেটে ভেতরে ঢোকার সাধ্য আমাদের হত না। সাংঘাতিক শক্ত গোড়। সারা গায়ে বড় বড় কাঁটা। বেতগাছ কাটতে হলে একটা বিশেষ কায়দায় কাঁটা বাঁচিয়ে কোপ দিতে হয়। সামান্য এদিক ওদিক হলেই কনুই থেকে হাতের নিচের অংশের চামড়া আর থাকবে না, ফালাফালা হয়ে যাবে কাঁটার আঘাতে। আক্কেল আলীর বক্তব্য, পাগল না হলে এই বেত কেটে ওই পোড়াবাড়িতে ঢোকার কথা ভাবে না কেউ। অর্থাৎ তার ধারণায়, আমরা তিনজনই পাগল।
বাড়িটা যে আছে ওখানে, জানা ছিল তার। বানিয়েছিলেন এখানকার প্রথম জমিদার, আইন উদ্দিন সরকার। এতটাই পোড়ো, ঢুকে দেখার কথা মনে হয়নি কখনও আক্কেল আলীর। পঁয়তিরিশ বছর আগে সে যখন এসেছিল, তখনও এমনই কাটা ছিল এখানটায়। তার মনে হয়েছিল-কি আর আছে এর মধ্যে দেখার মত, সাপ আর ইঁদুর-শজারু ছাড়া? শুধু ওসব দেখার জন্যে কাটার খোঁচা খেয়ে ঢোকার কষ্ট কে করে।
শেষ পর্যন্ত আক্কেল আলীর চেষ্টাতেই ঘরে ঢোকা সম্ভব হলো। দুই কামরার বাড়ি, বাগানবাড়ি নয়, তবে প্রচণ্ড গরমের সময়, কিংবা মন ভাল না লাগলে এসে একাকী কাটানোর জন্যে একটা চমৎকার জায়গা ছিল এটা একসময়। সামনে পুকুর, বন-জঙ্গল, গরমের দিনে চাঁদনী রাতে নিশ্চয় অপরূপ দৃশ্য হয়।
ভেতরে মাকড়সার জালের ছড়াছড়ি, পা বাড়ালেই হাতে, মুখে লাগে। সঙ্গে করে আনা ছোট একটা ডাল দিয়ে সামনের জালগুলো ছিঁড়ে সরিয়ে টর্চের আলো ফেলল কিশোর। জানালা আছে দুটো, কিন্তু বাইরে থেকে লতাপাতায় এমন করে জড়িয়ে আটকে রেখেছে, ঠেলে খোলা মুশকিল।
ভেতরের দিকের ঘরে দেয়ালের কাছে বহু পুরানো একটা বেঞ্চ রাখা, তাতে পুরু হয়ে ধুলো জমে আছে। টেবিলও আছে একটা, তাতেও ধুলো। আরেকটু কাছে এগোল কিশোর। আমরা রইলাম তার পেছনে।