হুঁ! সহজে নিরাশ হতে জানে না কিশোর পাশা। তবু, একবার যখন গুপ্তধনের গন্ধ পেয়েছি, সহজে হাল ছাড়ছি না আমি। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, দাদী, এ বাড়িতে থাকলে আমরা ওগুলো খুঁজে বের করবই!
.
০৩.
সেইদিন থেকেই গুপ্তধন খোঁজায় লেগে গেলাম আমরা। কিন্তু কিশোর পাশাও বেকায়দায় পড়ে গেল। কোন সূত্রই নেই হাতে, কিসের সাহায্যে খুজবে? তেমন কোন সূত্রই দিতে পারলেন না দাদী। আক্কেল আলীকে জেরা করেও কিছু জানা গেল না। প্রায় পয়তিরিশ বছর ধরে আছে এ বাড়িতে, অনেক ইতিহাস জানে এখানকার, কিন্তু গুপ্তধন উদ্ধারের ব্যাপারে সে-ও কোন সাহায্য করতে পারল না।
পরদিন সকালে উঠে নাস্তা খেয়ে আবার বাড়ির মধ্যে ঘুরে বেড়াতে শুরু করল কিশোর। গোপন দরজা কিংবা গোপন কুঠুরি আছে কিনা খুঁজছে। দাদী বললেন, একটা গোপন সিঁড়িই আছে জানি, যেটার দরজা আলমারির মত, যেটা দিয়ে তোদের ঘরে চলে যাওয়া যায়। আর কিছু নেই।
আসলেও মনে হলো নেই। কারণ অনেক খোঁজাখুঁজি করেও কিছু পেলাম না আমরা। নিরাশই হয়ে গেলাম। আমাদের অবস্থা দেখে শেষে দাদী বললেন, দেখ, বেড়াতে এসেছিস, বেড়িয়ে যা। ওসব গুপ্তধন খোঁজা বাদ দে। ওগুলো নেই এখানে। থাকলে অনেক আগেই পেয়ে যেত লোকে।
কিন্তু… তর্ক করতে গেল কিশোর।
তাকে থামিয়ে দিয়ে দাদী বললেন, ওসব কিন্তু-ফিন্তু বাদ দিয়ে বনের ভেতর থেকে ঘুরে আয়গে, যা। ভাল লাগবে। অনেক কিছু দেখার আছে। যা।
প্রায় জোর করেই আমাদেরকে ঘর থেকে ঠেলে বের করে দিলেন তিনি।
ভোর বেলা উঠেই শহরে চলে গেছেন দাদা, বোধহয় বাড়ি বিক্রির কাজেই। আমরা ঘুম থেকে উঠে দেখিনি তাঁকে। বাগানে দেখা হয়ে গেল আক্কেল আলীর সঙ্গে। গাছের গোড়ায় নিড়ানি দিচ্ছে। হেসে জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাচ্ছ?
জানালাম।
কোথায় গেলে কি দেখতে পাব, বলে দিল সে। একটা জায়গায় যেতে নিষেধ করল, বনের ভেতরে একটা মজা পুকুর। জায়গাটা নাকি ভাল না।
সঙ্গে সঙ্গে মুসা ধরল, কি ভাল না? ভূত আছে নাকি?
আবার হাসল আক্কেল আলী, তা জানি না। তবে বড় বড় সাপ আছে। এই তো, আর বছরই তো একটা বিরাট কেউটে মারলাম। জাম পাড়তে গিয়েছিলাম, দেখি গাছের গোড়া বেড় দিয়ে পড়ে আছে।
বেড় দিয়ে পড়ে থাকে! এত্তোবড়!
মুসার কথার জবাবে মাথা নাড়ল আক্কেল আলী। আরও একটা ব্যাপারে সাবধান করল আমাদের, জলার কাছে না যেতে। বেশ বড় একটা জলা আছে। তাতে নাকি পানির চেয়ে কাদা বেশি। পা পড়ে গেলে হড়াৎ করে একেবারে হাঁটু পর্যন্ত দেবে যায়।
পুকুরটা কোন দিকে আছে জেনে নিল কিশোর। সিংহ-দরজা দিয়ে বেরিয়ে সেদিকের পথই ধরল। আক্কেল আলী মানা করায় তার কৌতূহল বেড়ে গেছে।
আমাদের আগে আগে চলেছে কালু। অচেনা বনে-বাদাড়ে সঙ্গে কুকুর থাকলে অনেক সুবিধে।
বনে ঢুকে পড়লাম আমরা। ঘন হয়ে জন্মে আছে আম আর কাঁঠাল গাছ। বিরাট বিরাট কালোজামের গাছও আছে। মাঝে মাঝে বাঁশের ঝাড়। বনের মধ্যে এক ধরনের সবুজাভ আলো। গাছের মাথা দিয়ে যেন চুরি করে নেমে এসে মাটিতে পড়েছে রোদ, গোল গোল হয়ে পড়ে বনতলে সোনালি অলঙ্করণ করে দিয়েছে যেন।
প্রচুর শেয়ালের গর্ত দেখা গেল। আর আছে বেজি ও গোসাপ। প্রথম জানোয়ারটার দিকেই কালুর আগ্রহ বেশি দেখা গেল। গর্ত দেখলেই ছুটে যাচ্ছে সেদিকে, নাক নামিয়ে শুঁকছে। মাঝে মাঝে হাঁক ছাড়ছে ঘাউ ঘাউ করে, যেন বলতে চাইছে: বেরিয়ে আয় ব্যাটা শিয়ালের ছাও, হয়ে যাক একহাত! চুরি করে হাঁস-মুরগী খাওয়া তোমার আমি বের করব!
চলতে চলতে থমকে দাঁড়াল মুসা। তাকিয়ে আছে সামনের দিকে।
কিশোর জিজ্ঞেস করল, কী?
হাত তুলে দেখাল মুসা, ওই যে।
গাছের ফাঁক দিয়ে আমরাও দেখতে পেলাম পুকুরটা। কালচে-সবুজ পানি।
সুন্দর! বিড়বিড় করল কিশোর।
আমি বললাম, হ্যাঁ, খুব। শাপলা ফুটে আছে কেমন দেখছ? দারুণ!
লাল আর সাদা শাপলায় ছেয়ে আছে পুকুরটা।
তুলতে পারলে কাজ হত, বললাম। দাদীর জন্যে নিয়ে যেতে পারতাম।
হ্যাঁ, নামো, মাথা ঝাঁকিয়ে বলল মুসা, আর অমনি টুক করে সিন্দুকে টেনে নিয়ে যাক!
সিন্দুক? বুঝতে পারলাম না, সেটা আবার কি?
ও, জানো না এখনও। বাংলাদেশের অনেক পুকুরেই সিন্দুক থাকে। পুরানো দীঘি, পুরানো বড় আন্ধা পুকুর-যেগুলোর চারপাশে জংলা হয়ে থাকে, পানি কালো, সেগুলোতে বাস করে এই ভূতুড়ে সিন্দুক। বড় বড় শেকল থাকে। যেই পানিতে নামবে, আস্তে করে এসে পায়ে পেঁচিয়ে ধরবে। তারপর একটানে একেবারে মাঝপুকুরে, পানির তলায়।
হেসে জিজ্ঞেস করলাম, নিয়ে গিয়ে কি করে?
হাত উল্টে মুসা বলল, আমি কি জানি? হয় গোলাম বানিয়ে রাখে, নয়তো ভূতুড়ে সিন্দুক বানিয়ে নিজেদের দলভারি করে। কিছু তো একটা করেই, নইলে নেয় কেন?
কিশোরের মতই আমারও ভূতপ্রেতে তেমন বিশ্বাস নেই, কিন্তু পুকুরটার দিকে তাকিয়ে মনে হলো সত্যিই থাকতে পারে ও রকম ভূতুড়ে কিছু, শাপলা পাতায় ঢাকা কালো পানি দেখলে কেমন গা ছমছম করে।
পুকুরের একটা পাড়ে ঝোঁপঝাড় একটু হালকা, বাকি তিন পাড়ে ঘন জঙ্গল হয়ে আছে। বেতবন নেমে এসেছে একেবারে পানির ওপর। বেত গাছের গোড়া বিছুটি আর লজ্জাবতী গাছে ছাওয়া। গাঢ় গোলাপী রঙের ফুল ফুটে আছে।
যে পাড় হালকা, সেই পাড়ে এসে উঁড়ালাম আমরা। লাফ দিয়ে সরে গেল একটা ব্যাঙ। ছড়ছড় করে পানির ওপর দিয়ে পিছলে চলে গেল অনেক দূর।