আয়েসী ভঙ্গিতে গাছের গোড়ায় বসে ছুরি দিয়ে কেটে আম খেতে খেতে গল্প করতে লাগলাম আমরা। দারুণ টেস্ট, আমের মত এত স্বাদ পৃথিবীর আর কম ফলেরই আছে। গাড়ির শব্দে উড়ে গিয়েছিল, একটা দুটো করে আবার উঠানে নেমেছে আট-দশটা ঘুঘু আর পায়রা।
ঘণ্টাখানেক পর চলে গেল মেহমানরা। তাঁদের সঙ্গে গেলেন মতিদাদা। আরেকটু পরে দাদীকে দেখলাম পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে দীঘির শান বাধানো ঘাটে বসলেন। ওটাই হীরামতির দীঘি। পাথরে তৈরি সোফার মত আসনে বসে তাকিয়ে রইলেন পানির দিকে, সাদা শাপলাগুলো যেদিকে ফুটেছে সেদিকে মুখ। চুপচাপ বসে রইলেন তিনি।
আমের রসে হাত ভরে গেছে। ধোয়ার জন্যে চললাম দীঘির দিকে। ঘাটের কাছে এসেই থমকে দাঁড়ালাম। এ-কি! দাদী কাঁদছেন! গাল বেয়ে নেমেছে পানির ধারা। কি হয়েছে তার?
আমার সাড়া পেয়েই তাড়াতাড়ি শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে ফিরে তাকালেন। জোর করে হেসে বললেন, ও, রবিন! কি রে, খুব গরম?
না, হাত ধুতে এসেছি। দাদী, তুমি কাঁদছ কেন?
কই? চোখে কি যেন পড়ল…
মিথ্যে কথা বোলো না। আমি তোমাকে স্পষ্ট কাঁদতে দেখলাম।
দ্বিধা করলেন একবার দাদী। তারপর হাত দিয়ে তার পাশের জায়গাটা চাপড়ে দিয়ে বললেন, আয়, বোস।
বসলাম তার পাশে।
একটু আগে লোকটা এল না, গাড়িতে করে, দেখেছিস নিশ্চয়?
তিনি তোমাকে কিছু বলেছেন?
না, বলেনি, তবে কাদিয়েছে। ও এই বাড়ি কিনতে চায়। আমাকে আর তোর দাদাকে চিরকালের জন্যে চলে যেতে হবে এখান থেকে। ভাবলেই বুক ফেটে যায় আমার!
কেন দাদী, চলে যেতে হবে কেন? এতটাই অভাবে পড়ে গেছ তোমরা?
বসে খেলে রাজার ভাণ্ডারও ফুরায়, রবিন। জমিদারের ছেলে কাজকর্ম তো কিছু শেখেনি, টাকার দরকার হলেই জমি বেচেছে। এ বাড়ির আশেপাশে যত জমি আছে সব এককালে সরকারদের ছিল। শত শত একর। আজ আর এক বিযেও অবশিষ্ট নেই, শুধু এই বাড়িটা বাদে। দুর্ভাগ্যের সূচনা সেদিন থেকেই, যেদিন সরকারদের সৌভাগ্য হারিয়ে গেল!
সরকারদের সৌভাগ্য মানে! পেছন থেকে বলে উঠল কিলোর। আমাদেরকে একান্তে কথা বলতে দেখে কৌতূহলী হয়ে সে আর মুসাও চলে এসেছে।
আয়, বোস, দু-জনকে বসতে বললেন দাদী।
দীঘির পানিতে ডোবাডুবি করছে দুটো পানকৌড়ি। সেদিক তাকিয়ে আছে মুসা। শিকারীর দৃষ্টি। একটা বন্দুক হাতে পেলেই এখন গুলি করে বসত।
তার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে দাদীকে জিজ্ঞেস করলাম, কোনও জিনিসের কথা বলছ?।
হ্যাঁ, অনেক দামী কিছু জিনিস, আমাদের আগ্রহ দেখে মুচকি হাসলেন দাদী। প্রায় দুশো বছর আগে, ইংরেজ আমলে এ বাড়ির প্রতিষ্ঠাতা আইন উদ্দিন। সরকারকে ওগুলো উপহার দিয়েছিলেন আগরতলার এক মহারাজা।
কি কি জিনিস ছিল? আগ্রহে বকের মত গলা বাড়িয়ে দিয়েছে কিশোর।
মুক্তার হার, হীরার জড়োয়া সেট, চুণি-পান্না বসানো সোনার একটা পানপাত্র, আর আরও নানা রকম জিনিস।
কিন্তু হারাল কি করে ওগুলো?
দেশ বিভাগের সময় হিন্দু-মুসলমানে যখন দাঙ্গা লাগল, এই এলাকায় তখন হিন্দুদের আধিপত্য। সেই সময় হঠাৎ করে মারা গেলেন তোর মতিদাদার দাদা আমিন উদ্দিন সরকার। সেই থেকে গায়েব হয়েছে জিনিসগুলো।
কি করে মারা গেলেন?
সেটাও এক রহস্য। একদিন দীঘির ওই পাড়ের ঘাটলার কাছে তাকে মরে পড়ে থাকতে দেখা গেল। অভিশপ্ত এই দীঘি। কত মানুষকে যে নিল!
খুন করেনি তো?
কেউ কেউ সে রকম সন্দেহ করেছে। তাদের ধারণা ছিল, জিনিসগুলোর লোভে খুন করা হয়েছিল মানুষটাকে! যাই হোক, ওগুলো আর পাওয়া গেল না। তাকে খুন করে হয়তো জিনিসগুলো নিয়ে গিয়েছিল কেউ। কিংবা সেই লোকের হাতে পড়ার আগেই তিনি কোথাও লুকিয়ে ফেলেছিলেন ওগুলো। আর তা করে থাকলে এখন এ বাড়িরই কোনখানে আছে। কারণ দাঙ্গা শুরুর পর আর একটি দিনের জন্যেও বাড়ির সীমানার বাইরে যাননি আমিন উদ্দিন সরকার।
এ বাড়িতেই আছে বলছ? আনমনে বলল কিশোর, নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটা শুরু হয়ে গেছে তার। কি ভাবছে সে, পরিষ্কার বুঝতে পারছি আমি।
থাকতেও পারে। তবে আমার বিশ্বাস, নেই।
নেই মনে হওয়ার কারণ? জানতে চাইল কিশোর।
কারণ ওগুলোকে সরকারদের সৌভাগ্য নাম দিয়েছিলেন আইন উদ্দিন সরকার। যতদিন ছিল, রমরমা অবস্থা ছিল সরকারদের, যেই গেল, অমনি শুরু হলো পতন।
এ সব কুসংস্কার। জমিদারী বিলুপ্তির পর টাকা রোজগারের অন্য কোন উপায় করেনি বলেই আসলে ফকির হয়েছে ওরা।
একেবারে ভুল বলিসনি কথাটা। অকর্মা বলেই তো এখন শেষ সম্বল বাড়িটাও বিক্রি করতে হচ্ছে। দাদীর কণ্ঠে ক্ষোভ।
বাড়ি বিক্রি মানে? কিশোর শোনেনি খবরটা।
তাকে আর মুসাকে আবার সব খুলে বললেন দাদী। এখান থেকে চিরতরে চলে যাওয়ার কথা বলতে গিয়ে আবার গলা ধরে এল তার।
খানিকক্ষণ চুপ থেকে ঘনঘন কয়েকবার নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল কিশোর। তারপর মুখ তুলল, বাড়িটা বাঁচানোর এখন একটাই উপায়, একসঙ্গে অনেকগুলো টাকা পেয়ে যাওয়া।
মলিন হাসি হাসলেন দাদী। একটা কানাকড়িও নেই আর তোর দাদার কাছে। অনেক টাকা কোথায় পাবেন?
আছে, উপায় আছে। গুপ্তধনগুলো খুঁজে বের করতে পারলেই আর টাকার অভাব হবে না তোমাদের।
সে আশার গুড়ে বালি। অনেকেই খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়েছে, পায়নি। তার মানে নেই এখানে। আমিন উদ্দিন সরকারকে খুন করে কেউ নিয়ে গেছে ওগুলো। কে নিয়েছে, তা-ও জানি। তার এক মুন্সী ছিল। তিনি যেদিন মারা গেলেন, সেদিন থেকেই ওই লোকটাও নিখোঁজ হলো। আর তাকে দেখা যায়নি।