সুযোগটা কাজে লাগাল বদু। আমরা তার কাছে পৌঁছার আগেই লাফিয়ে উঠে। আবার দিল দৌড়।
ঘেউ ঘেউ করে আবার তার পিছু নিল কালু।
কোন দিকে যাচ্ছে হুশ নেই দুর। সামনে যে জলাভূমি সে খেয়াল করল না। বরং আরেকটু এগিয়ে সামনে পানি চিকচিক করতে দেখে কুকুরের হাত থেকে বাঁচার জন্যে সোজা নেমে গেল সেটাতে। ছোপ ছোপ করে কাদা-পানি ভেঙে এগোতে লাগল।
কিন্তু কয়েক কদমের বেশি যেতে পারল না। হঠাৎ দেখলাম হাঁটু পর্যন্ত কাদায় ডুবে গেছে। পা যতই তোলার চেষ্টা করছে, আরও দেবে যাচ্ছে। আতঙ্কিত হয়ে পড়ল সে। মরে যাওয়ার ভয়ে বিকট চিৎকার করে উঠল।
জলাভূমির কিনারে দাঁড়িয়ে চিৎকার করতে লাগল কালু। আমরাও এসে দাঁড়ালাম। তাকে বাঁচানোর জন্যে আমাদেরকে অনুরোধ করতে লাগল বদু।
কয়েক মিনিট পর সেখানে এসে হাজির হলো মুসা আর কিশোর। বদুর দুরবস্থা দেখে হেসেই অস্থির মুসা। ওরা কি করেছে জিজ্ঞেস করলাম আমি। কিশোর জানাল, মানিককে নিয়ে গণ্ডগোল হয়নি। কয়লার ঘরে তালা দিয়ে রেখে এসেছে।
ডালটা নিয়ে কাদায় নেমে গেল মুসা। তার একটা হাত শক্ত করে ধরে রাখলাম আমি আর কিশোর। ডালটা বদুর দিকে বাড়িয়ে দিল মুসা। চেপে ধরতে বলল।
ধরল বদু।
মুসা বলল, এইবার আস্তে আস্তে উঠে এসো। তাড়াহুড়ো করলে কিন্তু ডাল ছেড়ে দেব।
সামান্যতম গোলমাল করল না বদু। যা নির্দেশ দেয়া হলো, নীরবে পালন করল।
তাকে তুলে আনলাম কাদা থেকে।
মুসার হাত থেকে ডালটা নিয়ে লাঠির মত বাগিয়ে ধরল আক্কেল আলী। বন্দুকে হুমকি দিল, তেড়িবেড়ি করলেই দেবে মাথায় বসিয়ে।
তবে আর কিছু করল না বদ। এক কালুর ভয়েই সে কাবু হয়ে আছে। বাকি চারজনের সঙ্গে মারপিটের ঝুঁকি নিতে চাইল না।
বদুকেও এনে কয়লার ঘরে ভরলাম আমরা।
চেঁচামেচিতে দাদা-দাদীও জেগে গেছেন। দাদী দেখতে এলেন কি হয়েছে।
সেই রাতেই আক্কেল আলীকে পুলিশের কাছে পাঠানো হলো, দুই চোরকে ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্যে।
.
পরদিন সকালে নাস্তা খেতে বসেছি। দাদাও বসেছেন আমাদের সঙ্গে। দাদী গরম গরম ভাপা পিঠে এনে দিচ্ছেন রান্নাঘর থেকে। খুব স্বাভাবিক ভাবেই উঠে পড়ল গুপ্তধন উদ্ধারের আলোচনা।
মুসা বলল, একটা কথা বুঝতে পারছি না, এতদিন বসে রইল কেন রবিউল। চানাচুরওলার ছদ্মবেশে সহজেই তো পালিয়ে যেতে পারত।
জবাব দিল কিশোর, আমার ধারণা, প্রথমে এই বুদ্ধি মাথায় আসেনি তার। কিংবা পালানোর সাহসই হয়নি। জিনিসগুলো নিয়ে গিয়ে মূর্তির মধ্যে ভরে রাখল। দুই শত্রু তখন তার। একদিকে পুলিশ, আরেক দিকে তার দলের লোক–তাদের সঙ্গেও বেঈমানী করেছে। ফলে লুকিয়ে থাকতে হলো তাকে মন্দিরের মধ্যে। কিন্তু নিরাপদ বোধ করল না ওখানে। যে কোন সময় ধরা পড়ে যেতে পারে। শেষে চানাচুরওলা সেজে বুঝতে চাইল, ফাঁকি দিয়ে পালাতে পারবে কিনা। বাজারে গেল সেটা বোঝার জন্যে। আরও একটা কারণে গিয়েছিল সে, পুলিশ আর তার দলের লোকের ব্যাপারে খোঁজখবর করার জন্যে…
কিন্তু বাদ সাধলে তোমরা, হেসে কথাটা শেষ করে দিলেন দাদা। একেবারে সময়মত গিয়ে হাজির হলে বাজারে। চিনে ফেললে তাকে। পালাতে যে পারবে না সে, প্রমাণ পেয়ে গেল হাতেনাতে।
হ্যাঁ, ব্যাটার কপালটাই খারাপ, হেসে মন্তব্য করল মুসা।
চুপচাপ খাওয়া চলল কিছুক্ষণ। একটা প্রশ্ন নিয়ে অনেক ভেবেছি আমি, জবাব খুঁজে পাচ্ছিলাম না-শফিকুর রহমান গুপ্তধনগুলোর লোভেই বাড়িটা কিনতে চায়নি তো? আর তাই যদি হয়ে থাকে, সে শিওর হলো কি ভাবে যে এই বাড়িতেই রয়েছে জিনিসগুলো, বের করে নিয়ে যেতে পারেনি আমিন উদ্দিন সরকারের মুন্সী?
প্রশ্নটা তুললাম।
দাদা বললেন, এর একটাই জবাব হতে পারে, কথাটা কোনভাবে মুন্সীদের কারও মুখেই জেনেছে শফিকুর রহমান। আমার কি সন্দেহ হচ্ছে জানো? এই শফিকুর রহমান মধু মুন্সীর ছেলে।
ছেলে! প্রায় একসঙ্গে বলে উঠলাম আমরা তিনজন।
হ্যাঁ। তার একটা ছেলে ছিল বলে শুনেছি। বাবার কাছে নিশ্চয় গুপ্তধনের কথা শুনেছে সে। বিদেশে চলে গিয়েছিল বলে এতদিন আসতে পারেনি। দেশে ফিরেই বাড়িটা কিনতে এসেছে।
বিদেশে গিয়েছিল কি করে জানলেন? জিজ্ঞেস করলাম।
শফিকুর রহমান নাকি অনেক দিন দেশের বাইরে ছিল, আমাকে বলেছে। তোমাদের বয়েসে জাহাজে চাকরি নিয়ে চলে গিয়েছিল, ফিরেছে এই কিছুদিন আগে। সে যে মধু মুন্সীর ছেলে, এটা আমার অনুমান। আগে কিছু সন্দেহ করিনি, এখন করছি।
খাওয়ার পর থানায় রওনা হলাম আমরা। ফারুক হোসেনকে পাওয়া গেল। তাকে বললাম শফিকুর রহমানের ব্যাপারটা। তিনি জানালেন, বদু মুখ খুলেছে। বলেছে, শফিক সাহেব নামে এক লোকই ওদের বস্, গুপ্তধনগুলো চুরি করার জন্যে টাকা দিয়েছিল ওদের।
আমাদের মুখ থেকে সব কথা শুনে আরও শিওর হলেন তিনি। শফিকুর রহমানের কাছে যাবেন বললেন।
তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে গুপ্তধনগুলো নিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম আমরা।
মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগলেন দাদা-দাদী।
গর্বের সঙ্গে দাদা বললেন দাদীকে, দেখেছ, কি জিনিস! পানপাত্রটা দেখো, কি সুন্দর কারুকাজ করা। আর পাথর কি! আজকাল এসব জিনিস কল্পনাই করা যায় না।
সুন্দর, স্বীকার করলেন দাদী, তবে কল্পনা করা যায় না কথাটা ঠিক না। টাকা খরচ করলে এখনও এমন বানানো যাবে।