আম-জাম-লিচু-কাঁঠাল খাই আমরা, রাতে আর দুপুরে খাই দাদীর চমৎকার রান্না, সকালে নানা রকম পিঠা। বনে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়াই, রাতে কখনও বসি দীঘির ঘাটে, অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করি, কখনও গিয়ে বসি মজা পুকুরের পাড়ের সেই ঘরটার বারান্দায়।
উড়ে যাচ্ছে যেন আমাদের দিনগুলো। কিন্তু যাদের জন্যে উৎসুক হয়ে থাকি রোজই বিকেলের পর থেকে, তাদের আর সাড়াশব্দ নেই। তিন দিন গিয়ে যখন চারদিন পড়ল, সন্দেহ হতে লাগল আমার, আর আসবে না।
তবে সেদিনই এল ওরা। কিংবা বলা যায় সেই রাতে। জানানটা দিল কাল। দীঘির ঘাটলায় বসে আছি আমরা তিনজন। দাদা-দাদী বেডরুমে চলে গেছেন। আক্কেল আলী গেছে তার ঘরে। গল্প করছি, এই সময় একটা আমগাছের নিচ থেকে চাপা গরগর করে উঠল কুকুরটা।
লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল কিলোর। চাপা কণ্ঠে বলল, এসে গেছে।
আগেই প্ল্যান করে রেখেছি আমরা, ওরা এলে কি করব। গাছপালার আড়ালে গা ঢেকে মুসা আর কিশোর এগিয়ে গেল কালুর দিকে। আমি গেলাম মালীর ঘরের দিকে, আক্কেল আলীকে ডাকতে।
ঘুমায়নি সে। আগে থেকেই জানা ছিল তারও, এ রকম জরুরী অবস্থা হতে পারে। একবার ডাকতেই দরজা খুলে উঁকি দিল, ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, কি?
মনে হয় এসে গেছে। বেরোও।
নিঃশব্দে বেরিয়ে এল সে। পা টিপে টিপে আমরাও এগোলাম কিশোররা যেদিকে গেছে সেদিকে।
একটা আম গাছের গোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে কিশোর আর মুসা। কালুর গলার কেন্ট ধরে রেখেছে মুসা, শান্ত থাকতে বলছে কুকুরটাকে। ইঙ্গিতটা বুঝতে পেরেছে কালু, চুপ করেই আছে। গাছের গায়ে গা মিশিয়ে দাঁড়ালাম আমরা।
চাঁদের আলোয় দুটো ছায়ামূর্তিকে বেরোতে দেখলাম গাছের ছায়া থেকে। চেহারা বোঝা না গেলেও আকৃতিতেই চিনলাম বদু আর মানিককে।
বাড়ির সদর দরজার দিকে তাকিয়ে চুপচাপ প্রায় দশ মিনিট দাঁড়িয়ে রইল ওরা।
আমরাও চুপ। কালুকে নিয়েই ভয়, কখন চিৎকার করে ওঠে।
কেউ জেগে নেই বাড়ির ভেতর, বোধহয় এ-ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েই অবশেষে বদুকে রেখে পা বাড়াল মানিক। সদর দরজার দিকে এগোল।
নড়ে উঠল মুসাও। আগেই আন্দাজ করে রেখেছে কিশোর, ওরা এলে কোনপথে কোথায় ঢুকবে। চানাচুরের বাক্সটা কয়লার ঘরে রেখে দিয়েছে সে। তার ধারণা, চোরগুলো ওই জায়গাটাতেই খুঁজবে আগে।
কালুর বেল্টটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে গাছের আড়ালে আড়ালে দ্রুত এগোল মুসা, অদৃশ্য হয়ে গেল। বাড়ির পেছন দিকের একটা জানালা খোলা রেখে দিয়েছি আমরা এ রকম জরুরী মুহূর্তের কথা ভেবেই। সেদিক দিয়ে ঘরে ঢুকে যাবে সে।
সদর দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল মানিক। পাকা চোর সে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ভেতর থেকে বন্ধ করে রাখা দরজাটা খুলে ফেলল। ফিরে তাকাল একবার। লুকিয়ে থাকা বদর উদ্দেশে হাত নাড়ল, তারপর ঢুকে গেল ঘরের মধ্যে।
অপেক্ষা করতে লাগলাম আমরা। মুসার কাজটা সহজ। জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকবে, রান্নাঘরে লুকিয়ে থাকবে মানিকের অপেক্ষায়। সে কয়লার ঘরে নেমে গেলেই ওপরের ঢাকনাটা নামিয়ে তালা লাগিয়ে দেবে।
অস্থির হয়ে উঠেছে কাল। আর চুপ থাকতে চাইছে না। রাফি কিংবা চিতার মত ট্রেনিং পাওয়া শিক্ষিত কুকুর নয় সে, অতি সাধারণ নেড়ি কুত্তা। এতক্ষণ যে কথা। শুনেছে এইই বেশি। হয়তো আরও শুনত, কিন্তু ভজকট করে দিল একটা শেয়াল। ঝোঁপের ভেতর থেকে মাথা বের করল হঠাৎ। আমরা না দেখলেও কালু দেখে ফেলল। আর যায় কোথায়। চুপ থাকার কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে গলা ফাটিয়ে ঘেউ ঘেউ করে উঠল।
মশায় কামড়াচ্ছে। চুলকাতে গিয়ে সামান্য অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলাম, ঢিল পড়ল কুকুরটার গলার কলারে, এক ঝটকায় আমার হাত থেকে সেটা ছাড়িয়ে নিয়ে শেয়ালকে তাড়া করার জন্যে লাফ মারল সে।
কিন্তু শেয়াল কি আর দাঁড়ায়। কুকুরের ডাক শুনেই পলকে অদৃশ্য হয়ে গেল আবার ঝোঁপের মধ্যে।
বদু ভাবল, তাকে দেখেই খেপে গেছে কুকুরটা। বাবাগো, খেয়ে ফেলল গো! বলেই ঘুরে মারল দৌড়। কালুর নজর সরে গেল শেয়ালের দিক থেকে। বন্দুকেও দু চোখে দেখতে পারে না সে। শেয়ালের চেয়ে তাকে তাড়া করাটাই ভাল মনে করল বোধহয়, বদুর পায়ের গোছায় কামড়ে দেয়ার লোভেই যেন ঘেউ ঘেউ করতে করতে ছুটে গেল তার পেছনে।
ক্ষণিকের জন্যে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম আমরা। আমাদের প্ল্যান মত ঘটল না সব কিছু। সবার আগে সামলে নিল কিশোর। চিৎকার করে বলল, তুমি আর আক্কেল আলী বহুকে ধরো, আমি মুসার কাছে যাচ্ছি!
কালুর পেছনে দৌড় দিলাম আমি।
একটা শুকনো ডাল কুড়িয়ে নিয়ে আমার পেছন পেছন এল আক্কেল আলী।
দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ঝোঁপঝাড় ভেঙে ছুটছে বদু। কিন্তু যত জোরেই ছুটুক, কুকুরের সঙ্গে পাল্লায় পারার কথা নয়। বুঝতে পারল, ধরা পড়ে যাবে সে। থামল না তবু। কিন্তু কপাল খারাপ তার। একটা শেকড়ে পা বেধে উড়ে গিয়ে পড়ল ধুড়স করে।
তার গায়ের ওপর উঠে পড়ল কালু। কামড়ানোর জন্যে জায়গা বাছাই করছে যেন।
বাবাগো, আমি শেষ! বলে চিৎকার করে এলোপাতাড়ি ঘুসি মারতে লাগল বদু। একটা লাগল কালুর নাকেমুখে। ওটাও আরেক ভীতু। ব্যথা লাগতেই কেউ করে লাফিয়ে নেমে গেল বদুর ওপর থেকে। ফ্যালফ্যাল করে তাকাতে লাগল। আবার কামড়াতে যাওয়ার সাহস সঞ্চয় করছে।