আমার অনুমান যে ঠিক, খানিক পরেই বুঝতে পারলাম।
বাবাগো, খেয়ে ফেলল গো! বলে চিৎকার করতে করতে ঝোঁপঝাড় ভেঙে ছুটে এল একজন লোক। পেছনে ঘেউ ঘেউ করে তাড়া করেছে একটা কুকুর।
আমার ঝোঁপের সামনে দিয়েই ছুটে গেল লোকটা। পায়ের কাছে লেগে রয়েছে কুকুরটা। দু-জনকেই চিনতে পারলাম–বদু আর কালু। অতবড় লোকটা যে কুকুরকে এ রকম ভয় পায়, না দেখলে বিশ্বাস হবে না। পড়িমরি করে নদীর দিকে চলে গেল সে। পেছনে কালু। হঠাৎ করেই যেন দুঃসাহসী হয়ে পড়েছে কাপুরুষ কুকুরটা।
হাসি পেল আমার। কিন্তু শব্দ শুনে ফেলার ভয়ে চেপে গেলাম।
আরেকটু পর আমার আর কালুর নাম ধরে ডাক শোনা গেল। মুসা ডাকছে আমাকে, আর আক্কেল আলী কালুকে।
ফিরে এল কুকুরটা। আমার ঝোঁপের সামনে এসে থমকে দাঁড়াল। নাক উঁচু করে কুঁই কুঁই করতে লাগল। তারপর ছোট্ট একটা হাঁক ছাড়ল, খেক!
বুঝলাম আমার অস্তিত্ব ফাঁস হয়ে গেছে। হেসে বললাম, দাঁড়া, বেরোচ্ছি।
কালুর পেছন পেছন চললাম। অন্ধকারে বনের মধ্যে পথ হারিয়েছি, বুঝতে পারলাম। কুকুরটার সাহায্য না পেলে এখন পথ চিনে মন্দিরের কাছে যাওয়া দুঃসাধ্য হয়ে পড়ত।
গাছের ফাঁকফোকর দিয়ে টর্চের আলো দেখা গেল। আমাকেই খুঁজতে আসছে কিশোররা।
আমাকে দেখেই বলে উঠল কিশোর, এই যে, আছ ঠিকঠাক? জিনিসগুলো আছে?
আছে, জবাব দিলাম।
শুনলাম, আমি দৌড় দেয়ার পর মানিক আমার পিছু নিতে যাচ্ছিল, টর্চ দিয়ে তার মাথায় বাড়ি মারে কিশোর। দুই দুইবার বাড়ি খেয়ে কাহিল হয়ে পড়ে মানিক। বদুর সঙ্গে লড়তে থাকে মুসা। এই সময় আমাদের খুঁজতে খুঁজতে এসে হাজির হয় আক্কেল আলী। কুকুরকে সাংঘাতিক ভয় পায় বদু দেখেই মারে দৌড়। তাকে তাড়া করে কালু। তিনজনের সঙ্গে পারবে না বুঝে মানিকও আর দাঁড়ায়নি, পিঠটান দিয়েছে।
বাড়ি রওনা হলাম আমরা। সাবধান থাকলাম, যাতে রাস্তায় আর কোন আচমকা আক্রমণের শিকার না হতে হয়।
বড় রাস্তায় উঠে কিশোর বলল, জিনিসগুলো বাড়ি নিয়ে যাওয়া নিরাপদ নয়।
জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় রাখবে?
থানায় চলো।
ওই অবস্থায় আমাদের দেখে অবাক হয়ে গেলেন ফাড়ির ডিউটি অফিসার। আমাদের পরিচয় দিয়ে সব কথা তাকে বললাম। জিজ্ঞেস করলাম, ফারুক সাহেব কোথায়। তিনি জানালেন, বাইরে একটা জরুরী তদন্তের কাজে গেছেন, চলে আসবেন শীঘ্রি।
আমরা বসলাম।
আধঘণ্টা পরেই চলে এলেন ফারুক হোসেন। আমাদের অত রাতে ওই অবস্থায় দেখে তিনিও অবাক। জিজ্ঞেস করলেন, কি ব্যাপার?
সব শুনে তিনি বললেন, সাংঘাতিক কাণ্ড করে এসেছ। পুলিশ যা পারেনি সেটাই করে বসে আছ! তোমরা যে এতবড় গোয়েন্দা, কল্পনাই করতে পারিনি!
ডিউটি অফিসারও আমাদের অনেক প্রশংসা করলেন। দু-জন পুলিশ অফিসারের এই উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় লজ্জাই লাগতে লাগল আমার।
কিশোর বলল ফারুক সাহেবকে, স্যার, জিনিসগুলো বাড়ি নিয়ে যেতে ভরসা পাচ্ছি না। এত রাতে তো ব্যাংক খোলা পাব না, নিরাপদ আর কোন জায়গার কথাও জানা নেই। থানায় রেখে যেতে চাই।
একমুহূর্ত চিন্তা করে নিলেন সাব ইন্সপেক্টর। তারপর মাথা ঝাঁকালেন, বেশ, রেখে যাও। রিসিট দিয়ে দিচ্ছি। যখন ইচ্ছে নিয়ে যেয়ো।
.
১৩.
রাতটা নিরাপদে কাটল। পরদিন সকালে আক্কেল আলীর সঙ্গে হাসপাতালে রওনা হলাম।
গিয়েই শুনলাম, দাদাকে রিলিজ করে দেয়া হবে সেদিনই।
আমাদের অ্যাডভেঞ্চারের কথা জানালাম দাদা-দাদীকে। আমরা ছুরি মারামারি করেছি, এ কথা শুনে দাদী তো বাকহারাই হয়ে গেলেন। দাদা দিলেন বকা। আমাদের ওভাবে মন্দিরে যেতে দিয়েছে বলে আক্কেল আলীকেও বকতে লাগলেন।
চুপ করে রইলাম। বকে বকুক, আমাদের কাজ তো সারা।
দাদা-দাদীকে হাসপাতাল থেকে নিয়েই সেদিন বাড়ি ফিরলাম আমরা।
গুপ্তধনগুলো ফাঁড়িতেই রইল। কিশোরের ধারণা, এখনও বাড়িতে আনা নিরাপদ নয়। তবে চানাচুরের বাক্সটা নিয়ে এসেছে। অকারণে কিছু করে না সে। জিজ্ঞেস করলাম কেন এনেছে।
সে বলল, এটা এমন জায়গায় রেখে দেব যাতে বাড়িতে ঢুকলে সহজেই চোখে পড়ে। কেউ খুঁজতে এলে দেখে ফেলে। আমার বিশ্বাস, ওই দুই চোর আবার আসবে জিনিসগুলোর খোঁজে। ওদের বস্ ওদেরকে ছাড়বে না, পাঠাবেই।
মুসা জানতে চাইল, তাহলে এরপর আমাদের কাজ কি?
বাক্সের টোপটা রেখে দিলাম, কিশোর বলল, দেখা যাক ফাঁদে ধরা দেয় কিনা। দিলে বদু আর মানিককেও পাকড়াও করব। তারপর পুলিশে ধরে ভালমত ধোলাই দিলেই সুড়সুড় করে বলে দেবে বসের নাম। পালের গোদাটাকেও ধরতে পারবে তখন পুলিশ। এখন থেকে আমাদের কাজ হবে, নজর রাখা। বাড়ির কাছাকাছি অচেনা কাউকে দেখলেই চোখ রাখব।
একটা কথা কয়েক দিন ধরেই মনে হচ্ছে আমার, জিজ্ঞেস করার কথা ভুলে যাই, এখন করলাম, কিশোর, দাদার অ্যাক্সিডেন্টের পর ওই ভদ্রলোককে কিন্তু আর একবারও দেখিনি।
আমিও ভেবেছি কথাটা। চলো দাদাকে জিজ্ঞেস করে দেখি, হাসপাতালে দেখা করেছে কিনা।
দাদা জানালেন, একদিন দেখা করতে গেছে। ব্যস, ওই পর্যন্তই। বাড়ি কেনার ব্যাপারে আর তেমন আগ্রহ দেখায়নি। বরং বার বার গুপ্তধনের কথা জানতে চেয়েছে।
তার নাম কি জানতে চাইল কিশোর।
দাদা জানালেন, শফিকুর রহমান।
সন্দেহটা পাকাপোক্ত হলো আমাদের, ওই লোকই চোরেদের বস। কারণ, সেদিন মানিক আর বদু আলোচনা করার সময়ও শফিক সাহেব নামটা বলেছিল।