আয়, ঘরে আয়, ডাকলেন দাদী। আমি জানি, তাঁর ডাকনাম হীরা, অবশ্যই রাশেদ আংকেলের কাছে জেনেছি। এই নামটার জন্যেই আইন উদ্দিন সরকারের বাবা কনেকে বেশি পছন্দ করেছেন, কারণ তাঁর ছেলের ডাকনামও তিনি রেখেছিলেন মতি। সুযোগ পাওয়ামাত্র মিলিয়ে দিলেন হীরামতিকে। হীরামতির বাগ নামটাকে সার্থক করার জন্যেই যেন।
উঠানের কোণ থেকে উঠে বার দুই ঘাউ! ঘাউ! করে হাঁক ছেড়ে এগিয়ে এল একটা নেড়ি কুকুর। নেড়ি হলেও স্বাস্থ্য বেশ ভাল, খাবারের অভাব হয় না।
ও আমাদের কালু, হেসে পরিচয় করিয়ে দিলেন দাদী। আদর করে একবার ডাকলেই হয়, ভাব হয়ে যাবে।
সবার আগে মুসার সঙ্গে ভাব করে নিল কুকুরটা। আমাদেরও অবজ্ঞা করল না।
দোতলায় আমাদের থাকার ঘর গুছিয়ে রেখেছেন দাদী। দেখিয়ে দিলেন। বললেন, হাতমুখ ধুয়ে আয়, আমি নাস্তা দিচ্ছি।
ঘরটা দেখার মত। দেয়াল, ছাত, কড়ি-বরগাগুলো মোটেও মসৃণ নয়, দমকা বাতাসে পুকুরের শান্ত পানিতে যেমন কুচি কুচি ঢেউ ওঠে অনেকটা তেমনি, তার ওপর বিচিত্র অলঙ্করণ। অনেক বড় বড় জানালা। বাইরে বাগান। প্রজাপতি, ফড়িঙ আর পাখির ভিড় সেখানে। আমার মনে হতে লাগল আমি বাস্তবে নেই, পরীর রাজ্যে এসে পড়েছি।
মুখহাত ধুয়ে, কাপড় পাল্টে ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে নিচতলায় নেমে এলাম মস্ত হলঘরে। বাবুর্চিখানা, চাকরদের ঘর, খাবার ঘর আর রান্নাঘরে ঢোকা যায় সে ঘর থেকে। রান্নাঘর থেকে আরেকটা ছোট ঘরে চলে যাওয়া যায় উল্টোদিকের একটা দরজা দিয়ে, পরে জেনেছি। ওই ঘরটা কোন কাজে লাগে না, তবে অনেকটা সিঁড়িঘর হিসেবেই ব্যবহার হয়। মেঝেতে একটা লোহার শিকের জালিকাটা ঢাকনা, তার নিচে কয়লার ঘর। এককালে রান্নাঘরের চুলায় কয়লা ব্যবহার হত, এখন গ্যাস আসায় বাতিল হয়ে গেছে ওসব চুলা। কয়লা জমিয়ে রাখারও আর প্রয়োজন হয় না। রান্নাঘর দিয়ে ছাড়াও ওই সিঁড়িঘরে ঢোকার আরও একটা পথ আছে, আমাদের শোবার ঘর থেকে। একটা আলমারি আছে দেয়াল ঘেঁষে, প্রথম দেখে তাই মনে হয়েছিল। পরে দেখে অবাক হয়েছি, ওটা আলমারি নয়, একটা গোপন দরজা, অন্য পাশে সরু একটা অন্ধকার সিঁড়ি নেমে গেছে। দেখে খুব রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম। যাই হোক, সে-সব কথায় পরে আসছি।
হলঘরের দেয়ালে ঝোলানো বিরাট বিরাট ছবি, বেশির ভাগই হাতে আঁকা, ফ্রেমে বাঁধানো। সরকার পরিবারের পূর্বপুরুষদের ছবি। আধুনিক ছবি অর্থাৎ ফটোগ্রাফ আছে একটাই, হীরাদাদু আর মতিদাদার যুগল ছবি, দু-জনেই বিয়ের সাজে সজ্জিত, বর আর কনে। অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম ছবিটা। খুব সুন্দর।
খাবার ঘরে খেতে বসে কিশোর জানতে চাইল মতিদাদা কোথায়।
দাদী জানালেন, আক্কেল আলীকে নিয়ে শহরে গেছেন কাজে। জানা গেল, আক্কেল আলী এ বাড়ির একমাত্র কাজের লোক। টাকার অভাবে একজনের বেশি নোক রাখার ক্ষমতা নেই আর এখন রেহান উদ্দিনের। অথচ দাদুর যখন বিয়ে হয়, প্রথম আসেন এ বাড়িতে, তখনও অনেক চাকর-বাকর ছিল। আর তার আগে তো কথাই নেই, গিজগিজ করত নাকি মানুষে।
সন্ধ্যার মুখে শহর থেকে ফিরলেন দাদা। পুরানো, ঝরঝরে একটা মোটরগাড়িতে করে। আমরা তখন বাগানে। ছবির মানুষটারই মত আছেন এখনও, কেবল চুলগুলো সব সাদা হয়ে গেছে, এবং চোখের কোণে আর গলার নিচে ভাজ।
গাড়ি থেকে নেমেই আমাদের দেখলেন। ঋজু ভঙ্গিতে এগিয়ে এলেন আমাদের দিকে। এসে গেছ তাহলে। ভেরি গুড।
বিশাল থাবা দিয়ে চেপে ধরলেন আমার হাতটা। ঝাঁকিয়ে দিলেন আন্তরিক ভঙ্গিতে।
.
০২.
পরের দু-তিনটে দিন কালুকে নিয়ে দারুণ কাটল আমাদের। ফলগাছের অভাব নেই বাড়িটাতে। আম, জাম, লিচু, কাঁঠাল তো আছেই, আরও নানা রকম ফলের ছড়াছড়ি। বনের মধ্যে ঘুরে বেড়াই আমরা, ফল খেয়ে পেট ভরে থাকে, ভাত খাওয়ার আর জায়গা থাকে না। আমেরিকা থেকে এসে আমরা ভাত খাই শুনে নিশ্চয় অবাক লাগছে তোমাদের। কিন্তু সত্যি বলছি, এখানে এসে রুটির চেয়ে ভাতই বেশি প্রিয় হয়ে উঠেছে আমার। বোধহয় আবহাওয়াটা এমন যে এই খাবারই ভাল লাগে।
কালু ছাড়াও আরও একটা প্রাণী আছে এ বাড়িতে, অনেক বড় একটা কালো হুলো বেড়াল, টিক্কা খান। নামটা আক্কেল আলীর দেয়া। বেড়ালটার বড় বড় গোফ দেখলেই নাকি পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর নেতা জেনারেল টিক্কা খানের কথা মনে পড়ে যায় তার। বেড়ালটাকে পাখিরাও পছন্দ করে না, সে উঠানে নামলেই চমকে যায় পায়রা আর ঘুঘুর দল, নিমেষে ডানা ঝাঁপটে উড়ে পালায়।
আক্কেল আলী নিজেও একটা চরিত্র বটে। সেই ছেলেবেলায় সাত-আট বছর বয়েসে সে ঢুকেছে এ বাড়িতে, তারপর আর যায়নি। সবাই চলে গেছে একে একে, সে রয়ে গেছে। এখন চাকর-মালী থেকে শুরু করে মতিদাদার শোফারের কাজ, সব সে একা করে। হালকা-পাতলা খাটো শরীর, কুচকুচে কালো গায়ের রঙ, বসে যাওয়া চোয়াল দেখে বোঝার উপায় নেই তার আসল বয়েস কত।
মাত্র কয়েকটা দিনেই বাড়িটার প্রতি ভীষণ মায়া পড়ে গেছে আমার। মনে হতে থাকে, সহজেই সারা জীবন কাটিয়ে দিতে পারি এখানে।
তিন দিনের দিন সকালে সামনের বাগানে আমগাছের ছায়ায় বসে আছি, এই সময় গাড়ির শব্দ কানে এল। গাড়িপথে ঢুকল একটা চকচকে গাড়ি। গাড়ি বারান্দায় থামিয়ে নেমে গিয়ে পেছনের দরজা খুলে দিল শোফার। নামলেন বেশ সভ্রান্ত পোশাক পরা একজন বয়স্ক ভদ্রলোক। বয়েস মতিদাদার সমানই প্রায় হবে। ছুটে গিয়ে হলঘরের দরজা খুলে দিল আক্কেল আলী। দুজনকে নিয়ে ভেতরে চলে গেল।