সঙ্গে সঙ্গে রাখলে, বললাম।
ঠিক। তুড়ি বাজাল কিশোর। রবিগুণ্ডার পকেটে ছিল না জিনিসগুলো। তাহলে কোথায়…
প্রায় চিৎকার করে উঠলাম, চানাচুরের বাক্স!
হেসে মাথা ঝাঁকাল কিশোর, হ্যাঁ। চলো, বের করে নিই।
বাক্সের ওপরের ডালাটা আলগা। সেটা সরাতেই দেখা গেল বাটা কানায়। কানায় ভরা ডালভাজা আর বাদামভাজায়। ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দিল কিশোর। বের। করে আনল পানপাত্রটা। বলল, আর দেখার দরকার আছে? সব আছে এর মধ্যে।
কিশোর, তুমি একটা জিনিয়াস! না বলে পারল না মুসা।
নাও, চানাচুরওয়ালা সাজো এখন, হেসে মুসাকে বলল কিশোর। বাক্সটা গলায় ঝোলাও। রাত হয়েছে অনেক, বাড়ি যেতে হবে।
কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য তখনও কাটেনি। মন্দিরের দরজায় বেরোতেই দেখলাম দুই পাশে দুই প্রহরীর মত দাঁড়িয়ে আছে দুই চোর।
আমাদের দেখেই খিকখিক করে হেসে বলে উঠল মানিক, কি বদু বলেছিলাম না, ছেলেগুলো বোকা নয়। ওরা ঠিক বুঝেছে কোথায় আছে মাল। আমাদের চেয়ে অনেক চালাক। তুই তো বিশ্বাসই করতে চাস না। ফিরে না এলে কি হত, ভাব।
রইব্বাটাও কম চালাক না, ঘোঁৎ-ঘোৎ করে বলল বদু। অমন একটা চানাচুরের বাক্সের মধ্যে রেখে দেবে, কে ভাবতে পেরেছিল! আমরা তো আমরা, পুলিশই ধোকা খেয়েছে…কিন্তু এ তিনটেকে এখন কি করি?
কি আর করব। আটকে রেখে যাব মন্দিরের মধ্যে। মালগুলো দরকার ছিল আমাদের, পেয়েছি, ব্যস। যাওয়ার আগে একটা ধন্যবাদও দিয়ে যাব ওদের। আমাদের অনেক ঝামেলা বাঁচিয়ে দিল বলে। আবার খিকখিক করে হাসল মানিক। পকেট থেকে বের করল বড় একটা ছুরি। ফলা ধরে টানতেই কিটকিট শব্দ করে খুলে গেল ওটা। ঝিক করে উঠল চাঁদের আলোয়।
হাত বাড়াল সে, দাও, এবার বাক্সটা দিয়ে দাও দেখি। গোলমাল করলে ভূড়ি ফাঁসিয়ে দেব।
এই গুপ্তধন নিয়ে অনেক ঝামেলা সহ্য করেছি আমরা। বার বার উদ্ধার করছি, শেষ মুহূর্তে কেউ না কেউ এসে ছিনিয়ে নিচ্ছে। আর হাতছাড়া করতে রাজি নই আমরা কেউই।
কিশোর চুপ।
মুসাও চুপ। বারটা দেয়ার কোন লক্ষণ দেখাল না।
দাও বলছি! ধমক দিয়ে বলল মানিক।
চুপ করে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বহু। আমরা কেউ গোলমাল করলেই হাত তুলবে, ভঙ্গি দেখে বোঝা যাচ্ছে।
কিশোরের দিকে একবার তাকিয়ে আস্তে করে গলা থেকে বাক্স ঝোলানোর কাপড়টা খুলে নিল মুসা। এক পা বাড়াল মানিকের দিকে, ওটা দেয়ার ভঙ্গিতে।
ছুরিটা বাঁ হাতে নিয়ে মানিকও হাত বাড়াল।
কাপড়টা দুই হাতে চেপে ধরে মানিকের মাথা সই করে আচমকা ঘুরিয়ে বাড়ি মারল মুসা। প্রচুর জিনিসপত্র বোঝাই থাকায় ভারি হয়ে আছে বাক্স। ডাল, বাদাম, তেল-মরিচ-পেঁয়াজ সব ঝরে পড়ল বৃষ্টির মত। প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে ডালাটা খুলে উড়ে গিয়ে পড়ল কয়েক হাত দূরে।
মাথার একপাশে বাড়ি লেগেছে মানিকের। উহ করে মাথা চেপে ধরে বসে পড়ল সে। ছুরিটা ছেড়ে দিয়েছে হাত থেকে। কিশোরের টর্চের আলোয় পলকের জন্যে দেখলাম, মানিকের আঙুলের ফাঁকে রক্ত।
বাক্সের কাপড়টা হাত থেকে ছেড়ে দিল মুসা। মাটিতে পড়ে ঝনঝন করে উঠল বাক্স। তাকানও না সে। প্রায় ডাইভ দিয়ে পড়ে মাটি থেকে তুলে নিল মানিকের ছুরিটা।
নড়ে উঠল বদু। ঠেকানোর জন্যে এগিয়ে এল। ধরতে চাইল মুসাকে।
কিন্তু ততক্ষণে লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে সে। বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে ছুরি চালাল বদুর হাত সই করে। এফেঁড় ওফোড় করে দিল তালু।
মাগোহ! বলে চিৎকার করে উঠল বদু।
বিমূঢ় হয়ে গেছে দু-জনেই। মুসা যে এই কাণ্ড করে বসবে কল্পনাই করতে পারেনি। ওরা ভেবেছিল, তিনজনেই আমরা ছেলেমানুষ, ছুরি দেখিয়ে ধমক দিলেই পেসাব করে দেব।
এত দ্রুত ঘটে গেল ঘটনাটা, আমি বা কিশোরও স্তব্ধ হয়ে রইলাম একটা মুহূর্ত।
হাত বাড়াচ্ছে মানিক, মুসাকে ধরার জন্যে নয়, বাক্সটার দিকে।
আর একটা সেকেন্ডও দেরি করলাম না আমি। নিচু হয়ে এক থাবায় কাপড়টা ধরে হ্যাঁচকা টানে বাক্সটা তুলে নিয়েই দৌড় দিলাম বনের দিকে।
ধরো! ধরো! বলে চিৎকার করে উঠল মানিক।
পেছনে না তাকিয়েও বুঝতে পারলাম আলো নিভিয়ে দিয়েছে কিশোর। মুসাকে সাহায্য করতে হাত লাগিয়েছে।
কোন দিকে তাকালাম না। সোজা দৌড় দিলাম অন্ধকার বনের মধ্যে দিয়ে। আশা করলাম, পেছনে পায়ের শব্দ শুনতে পাব–বদু কিংবা মানিক, কোন একজন আমাকে তাড়া করে আসবেই।
কিন্তু এল না ওরা। মুসা আর কিশোর আটকে রেখেছে নিশ্চয় ওদের।
একটা ঘন ঝোঁপের মধ্যে ঢুকে পড়লাম। বাক্সটা দু-হাতে ধরে বসে বসে হাঁপাতে লাগলাম। কান খাড়া রেখেছি কেউ আসে কিনা শোনার জন্যে। প্রতিজ্ঞা করে ফেলেছি, যা হয় হবে, গুপ্তধনগুলো আর চোরের হাতে পড়তে দেব না।
লড়াইয়ের শব্দ কানে আসছে। এখনও মুসা আর কিশোরকে পরাজিত করতে পারেনি দুই চোর। সহজে পারবে বলেও মনে হয় না।
আমি ঠিক করলাম, পারুক আর না পারুক, আমি এই ঝোঁপ থেকে বেরোচ্ছি না।
এই সময় হঠাৎ করেই কানে এল কুকুরের ডাক। এগিয়ে আসছে।
রাতের বেলা এই জঙ্গলের মধ্যে গায়ের নেড়িকুত্তাগুলোরও একলা আসার কথা নয়। তারমানে সঙ্গে লোক আছে। কে?
ধক করে উঠল বুক! আক্কেল আলী না তো! আসার সময় তাকে বলে এসেছিলাম, মন্দিরে যাচ্ছি আমরা। আমাদের দেরি দেখে হয়তো কালুকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে।