মন্দিরের বাইরেও খুঁজতে শুরু করল ওরা। দেখছে, কোনখানে মাটি খোঁড়া হয়েছে কিনা। মন্দিরের দেয়ালের ফাঁকফোকরও বাদ দিল না। যেখানেই কোন জিনিস লুকানোর মত জায়গা দেখছে, তার ভেতরে হাত ঢুকিয়ে কিংবা উঁকি দিয়ে দেখছে। কথা বলছে। বেশির ভাগই রবিগুণ্ডাকে গালাগাল, আর নিজেদের ভাগ্যকে দোষারোপ। শিম্পাঞ্জীর মত লোকটার নামও জানতে পারলাম, বদু।
খুঁজতে খুঁজতে আমাদের কাছাকাছি চলে এল দু-জনে। ঠিক এই সময় মুসার পেল হাঁচি। কিছুতেই চেপে রাখতে পারল না, হ্যাঁচচো করে উঠল প্রচণ্ড জোরে।
.
১২.
দৌড়ে এল দুই চোর।
ঝোঁপ থেকে প্রায় টেনে-হিঁচড়ে বের করল আমাদের। চিনে ফেলল। নিশ্চয় রবিগুণ্ডার কাছে আমাদের কথা শুনেছে। বার বার জিজ্ঞেস করতে লাগল, কেন এখানে এসেছি।
রোমাঞ্চকর এক গল্প ফেঁদে বসল কিশোর, বদুটাকে প্রায় বিশ্বাসও করিয়ে ফেলেছিল, কিন্তু মানিককে ফাঁকি দেয়া গেল না। সে বলল, ওসব ধানাই-পানাই করে লাভ নেই। তোমরাই গুপ্তধনগুলো খুঁজে বের করেছ, শুনেছি। একবার যখন পেরেছ, আবারও পারবে। আর সেগুলো খুঁজতেই এসেছ তোমরা। ভালই হলো। খোজো, বের করে দাও। ছেড়ে দেব।
কি আর করা? কিশোর বলল, মন্দিরের ভেতর থেকে শুরু করব।
ওখানে কি দেখবে? বদু বলল। পুলিশ দেখেছে। আমরাও দেখেছি। কিছুই নেই।
তবু দেখব। বলা যায় না, আপনাদের চোখ এড়িয়েও গিয়ে থাকতে পারে।
আমার মনে হলো, ফাঁকি দিতে চাইছে কিশোর। খামোকাই এখানে ওখানে খুঁজবে, কিছু না পেলে শেষে বিরক্ত হয়ে আমাদের ছেড়ে দিয়ে চলে যাবে লোকগুলো; তারপর গিয়ে আসল জায়গায় খুঁজব আমরা-এমন কিছু হয়তো ভাবছে সে।
কি যেন ভাবল মানিক। দ্বিধা করল একবার। তারপর বলল, বেশ, খোঁজা। এসো।
আমাদের সঙ্গে আবার মন্দিরে ঢুকল ওরাও।
ভেতরটা আবছা অন্ধকার। কেমন একটা ধোয়াটে গন্ধ। মাকড়সার জাল ঝুলছে যেখানে সেখানে। একধারে বেদীতে কালীমূর্তি। লাল জিভ বের করা, গলায় মাটির তৈরি নরমুণ্ডের মালা। একহাতে খাড়া। ভয়ানক চেহারা।
মুসা তো দেখে আঁতকেই উঠল।
গুপ্তধন লুকানোর মত জায়গা তেমন নেই। এককোণে পড়ে আছে চানাচুরওয়ালার পুরানো টিনের বাক্স আর চোঙটা। বাক্সটায় তেল চিটচিটে ময়লা একটা কাপড় বাধা, গলায় ঝোলানোর জন্যে। বাক্সের ওপরে ছড়ানো গোল বারান্দামত জায়গাটায় অনেকগুলো খুপরি, তাতে তেল-মশলার শিশি। খোপে খোপে ডাল ভাজা, বাদাম ভাজা, পেঁয়াজ-মরিচ, আর চানাচুর বানানোর অন্যান্য উপকরণ সাজিয়ে রাখা।
অনেক খোঁজাখুঁজি করলাম আমরা সবাই মিলে। মূর্তির পেছন দিকটা ভাঙা, ভেতরের খড়গুলো টেনে টেনে বের করা হয়েছে।
কিশোর জানতে চাইল, কে বের করেছে এগুলো? আপনারা?
না, মাথা নাড়ল মানিক। আমার মনে হয়, প্রথমে এর মধ্যেই জিনিসগুলো লুকিয়েছিল রইব্বা, তারপর বের করে আবার অন্য কোথাও রেখেছে।
ভাঙা ফোকরটার দিকে তাকিয়ে আছে কিশোর। চিন্তিত মনে হলো তাকে। কোমরে ঝোলানো টর্চ খুলে নিয়ে মূর্তির ভেতরে আলো ফেলে ফাপা জায়গাটা দেখল। আরও কিছু খড় বাদে আর কিছুই নেই ভেতরে।
মন্দিরের ভেতরে পাওয়া গেল না জিনিসগুলো।
গজগজ করতে লাগল বদু বলেছি না নেই, শুধু শুধু সময় নষ্ট!
বিরক্ত হয়ে ধমক দিল মানিক, আহ, থাম তো তুই! ওদের কাজ ওদেরকে করতে দে!
বাইরে এসে আবার খোঁজা হলো। মন্দিরের চারপাশে বেশ অনেকখানি জায়গার মাটি পরীক্ষা করা হলো। কোথাও নতুন খোঁড়া কোন গর্ত পাওয়া গেল না। গাছের কোটরও বাদ দেয়া হলো না। কিন্তু কোথায় যে গুপ্তধনগুলো লুকিয়েছে রবিগুণ্ডা, তার কোন হসিদই পাওয়া গেল না।
নিতান্ত নিরাশ হয়েই আমাদের ছেড়ে দিল দুই চোর। শাসিয়ে দিল, ওদের পিছু নেয়ার চেষ্টা করলে ভাল হবে না।
হাঁটতে লাগল ওরা। একটাই রাস্তা। সুতরাং ওদের পিছু নেয়া ছাড়া উপায় থাকল না আমাদের। ওরাও জানে, কিছুদূর এগিয়ে দুটো রাস্তা দুদিকে চলে গেছে। তাই আমরা পিছে পিছে হাঁটায় কিছু বলল না।
কথা বলতে বলতে চলেছে বদ আর মানিক, আমাদের আগে আগে। দ্রুত হাঁটছে ওরা। ফিরেও তাকাল না আমাদের দিকে। নারকেল বাগানের বাইরে বেরিয়ে ওরা চলে গেল একপথে, আমরা আরেক পথে।
খেত পেরিয়ে বড় রাস্তায় উঠতে উঠতেই সন্ধ্যা হয়ে গেল। গাঁয়ের মসজিদ থেকে আজান শোনা যাচ্ছে। হঠাৎ আমার হাত চেপে ধরল কিশোর। দাঁড়াও। বাড়ি যাব না আমরা!
তাহলে কোথায় যাবে? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
গুপ্তধনগুলো আনতে।
খাইছে! বলো কি? মুসাও আমার মতই অবাক হয়েছে। জানো নাকি কোথায় আছে ওগুলো? তাহলে বের করলে না যে?
বের করলেই তো নিয়ে যেত ওই দুই চোর।
কোথায় আছে? জানতে চাইলাম আমি।
চলো, গেলেই দেখবে।
আকাশে চাঁদ আছে। পথ দেখে চলতে অসুবিধে হলো না। আবার এসে ঢুকলাম নারকেল বাগানে। সোজা মন্দিরের দিকে এগোল কিশোর। টর্চ আছে তার কাছে। কোমর থেকে খুলে নিয়ে জালল।
আমাদের নিয়ে আবার মন্দিরে ঢুকল সে। হেসে জিজ্ঞেস করল, বলো তো, কোথায় থাকতে পারে?
সাফ মানা করে দিল মুসা, জানি না। হাজার বছর একনাগাড়ে ভাবলেও আন্দাজ করতে পারব না!
বেশ, সূত্র দিচ্ছি, দেখো বুঝতে পারো কিনা। ধরো, অনেক দামী কিছু জিনিস আছে তোমার কাছে। ওগুলো সবচেয়ে বেশি নিরাপদ কোন জায়গায় থাকলে? এমন কোথাও, যেখানে রাখলে তোমার অজান্তে কেউ খুঁজে পাবে না, তোমাকে না জানিয়ে নিতে পারবে না কিছুতেই…