কিশোর বলল, শ্মশান ছাড়া থাকে না। এমন করে পুরো শরীরটাকে পুড়িয়ে ফেলা হয়, ছাই ছাড়া আর কিছুই থাকে না। কাঁকড়া খুঁজতেই গেছে শেয়ালগুলো।
এ সব আলোচনাও এখন ভয় ধরাচ্ছে মনে। সারা আসে না কেন? মনে হতে লাগল, অনন্তকাল ধরে অনুপস্থিত ওরা।
অথচ বেশি সময় কিন্তু লাগল না ওদের। রবিগুণ্ডার ব্যাপারে সতর্ক হয়েই আছে পুলিশ। খবর শুনে একটা মুহূর্তও আর দেরি করলেন না সাব ইন্সপেক্টর ফারুক হোসেন। দলবল নিয়ে হাজির হয়ে গেলেন। গাড়ির শব্দ শুনলে সাবধান হয়ে গিয়ে পালানোর চেষ্টা করতে পারে চোরটা, সেজন্যে খেতের কিনারে গাড়ি রেখে এতদূর হেঁটে এসেছেন।
সামান্যতম বাধা দিতে পারল না রবিগুণ্ডা, কল্পনাই করেনি তার পিছু নিয়ে এখানে এসে হাজির হয়েছি আমরা। ও বোধহয় ভেবেছিল, আমরা তাকে চিনতে পারিনি।
তাকে নিয়ে যাওয়ার সময় কিশোর অনুরোধ করল ফারুক সাহেবকে, স্যার, নিয়ে গিয়ে তো নিশ্চয় কথা আদায়ের চেষ্টা করবেন। কি বলল না বলল আমাদের জানাবেন?
নিশ্চয় জানাব। পুলিশকে অনেক সাহায্য করেছ তোমরা। ধন্যবাদ। এক কাজ কোরো, কাল সকালে চলে এসো। আমার ডিউটি থাকবে তখন।
সুতরাং পরদিন সকালে উঠেই থানায় গিয়ে হাজির হলাম আমরা।
আমাদের বসতে দিলেন ফারুক সাহেব। চা-বিস্কুট আনালেন। কোন খবর আছে কিনা জানতে চাইল কিশোর।
মাথা নাড়লেন তিনি। মহাপাজী। স্বীকার কি আর করে। অনেক চেষ্টা করেছি। একটা কথাই স্বীকার করেছে, পিস্তলটা তার, ওটা দেখিয়ে তোমাদের হুমকি দিয়েছে–না করে পারেনি, তার কারণ পিস্তলে তার আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে। কিন্তু গুপ্তধনের কথা কিছুই বলেনি সে। সেফের তালা ভেঙে সে নাকি নেয়নি।
মন্দিরের ভেতরটা ভালমত খুঁজে দেখা দরকার ছিল, কিশোর বলল।
হাসলেন সাব ইন্সপেক্টর। দেখিনি মনে করেছ? আজ ভোরে উঠেই দু-জন লোক পাঠিয়েছি। তন্ন তন্ন করে খুঁজেছে সব। কিচ্ছু পায়নি।
হতাশ হলাম।
আমাদের মুখ দেখে সান্তনা দেয়ার জন্যে বললেন তিনি, ধরা যখন পড়েছে, স্বীকার ওকে করতেই হবে। সরকার সাহেবকে বোলো, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওগুলো বের করে তাকে ফেরত দেয়ার চেষ্টা করব।
হাসপাতালে দাদার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম আমরা। সব জানালাম তাকে, আর কিছু গোপন করলাম না। দাদা-দাদী দু-জনেই খুব বকলেন আমাদের, ওসব ভয়ঙ্কর চোর-ডাকাতের সঙ্গে লাগতে গিয়েছি বলে। শেষে দাদা বললেন, খবরদার, ওসবের মধ্যে আর যাবিনে। পুলিশ কিছু করতে পারে ভাল, না পারে নেই, টাকা লাগবে না আমার। তোদের যে কোন ক্ষতি হয়নি এতেই আমি খুশি।
কিন্তু আমরা খুশি হতে পারলাম না। এত কষ্ট করে জিনিসগুলো উদ্ধার করলাম আমরা, আর সেটা কেড়ে নিয়ে যাবে একটা চিকে চোর, কিছুতেই মেনে নিতে পারলাম না।
কিশোর তো আরও পারল না। বাড়ি ফিরেই তার প্রথম কথা হলো, দাদুরা আসবেন পরশুদিন। তার আগেই বের করতে হবে গুপ্তধনগুলো।
কি করে? জানতে চাইল মুসা।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ওই কালী মন্দিরের কাছেই কোথাও আছে ওগুলো। ওখানে থেকেছে রবিগুণ্ডা, জিনিসগুলো দূরে কোথাও রাখবে না। চোখে চোখে রাখতে চাইবে, এটাই স্বাভাবিক।
সুতরাং সেদিন দুপুরের খাওয়ার পর আবার গেলাম আমরা শ্মশানে। দিনের বেলা অতটা ভয় লাগে না জায়গাটাকে। তবে মানুষজনের আনাগোনা মোটেও নেই। পাখির ছড়াছড়ি। এত ঘুঘু দেখা গেল, এয়ারগানটা কেন নিয়ে এল না, সে জন্যে আফসোসের সীমা রইল না মুসার।
মন্দিরের কাছে এসে আশপাশের বনের ওপর চোখ বোলাল মুসা। কোথায় থাকতে পারে, বলো তো?
আছে এখানেই কোথাও, জবাব দিল কিশোর। মন্দিরের ভেতরে নেই, তাহলে পেয়ে যেত পুলিশ। তারমানে বাইরে রেখেছে। মাটিতে পুঁতেও রাখতে পারে।
তাহলে বের করতে বুলডোজার লাগবে… আচমকা থেমে গেল মুসা। কান পাতল। কণ্ঠস্বর খাদে নামিয়ে বলল, এই, মন্দিরের ভেতর লোক আছে! কথা শুনলাম!
মুসার কানের ওপর ভরসা আছে আমাদের। তাড়াতাড়ি লুকিয়ে পড়লাম ঝোঁপের ভেতর।
চুপ করে বসে রইলাম পুরো একটা মিনিট। তারপর উঠে দাঁড়াল মুসা, তোমরা থাকো এখানে। আমি দেখে আসি।
পা টিপে টিপে মন্দিরের দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল সে। কান পেতে শুনল কয়েক মিনিট। ফিরে এসে বলল, দু-জন লোক। গুপ্তধন খুঁজতে এসেছে। রবিগুণ্ডার দলের। সে নাকি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে ওদের সঙ্গে। শফিক সাহেব বলে একজন লোকের কথা বলছে, ওই লোক ওদের বস্। ভয়ানক খেপে গেছে নাকি সে। রবিউলকে ধরতে পারলে চামড়া ছাড়াত, পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে বলে রক্ষা।
আরও কয়েক মিনিট পর খালিহাতে বেরিয়ে এল লোকগুলো। খুব রেগেছে, চেহারা দেখেই আন্দাজ করা যায়। একজনের রোমশ শরীর, মুখটা শিম্পাঞ্জীর মত। আরেকজন রোগা-পটকা, খাটো। মুখে বসন্তের দাগ। পান-ধাওয়া কালো দাঁত। মুখটা ছুঁচোর মত।
অহেতুক এখানে সময় নষ্ট করছি, মাইনকা, গরিলা বলল। রইব্বা হারামজাদাটা যে এত্তবড় শয়তান জানতাম না!
জানাজানি রাদ দিয়ে আরও ঘেঁজ, ছুঁচো, অর্থাৎ মানিক বলল। খালিহাতে গেলে যত ঝাল আমাদের ওপর ঝাড়বে শফিক সাহেব।
আমরা কি করব, না পেলে?
রইব্বাটা আমাদেরও ফাঁসিয়ে দিয়ে গেল। খালিহাতে গেলে শফিক সাহেব ভাববে, আমরাও মিছে কথা বলছি। বেঈমানী করছি, ক্ষোভের সঙ্গে বলল মানিক।