আমি সেটা মানতে পারলাম না। লোকটাকে পরিচিত মনে হয়েছে আমারও। নিচু গলায় বললাম, রবিগুণ্ডা নয় তো? ছদ্মবেশে আছে?
উঠে দাঁড়াল কিশোর। এগিয়ে গেল লোকটার দিকে। আমিও এগোলাম তার সঙ্গে।
চানাচুর কেনার ছুতোয় লোকটাকে ভালমত দেখলাম আমরা। চুল কেটে, গোঁফ কামিয়ে, মুখে রঙ মেখে অনেক পরিবর্তন করে ফেলেছে চেহারার, কিন্তু কিশোরের তীক্ষ্ণ চোখকে ফাঁকি দিতে পারল না।
সরে এসে ফিসফিস করে আমাকে বলল সে, রবিগুণ্ডাই, কোন সন্দেহ নেই।
কি করব? পুলিশকে খবর দেব?
না, চোখ রাখতে হবে। বাজারের পর সে কোথায় যায় দেখব।
আক্কেল আলীকে লাগিয়ে রাখলাম তার পেছনে। আমরা লাগলে সন্দেহ করবে। সে ছদ্মবেশে থাকা সত্ত্বেও আমরা যখন তাকে চিনেছি, আমাদেরকেও নি চিনে ফেলেছে।
সন্ধ্যা হয়ে এল। বড় বড় কুপি বাতি জ্বেলে নিতে লাগল দোকানিরা, বাইরে যারা বসেছে। তবে আর বেশিক্ষণ চলল না হাট। ভেঙে গেল দ্রুত। বাজার থেকে বেরিয়ে একটা পায়েচলা মেঠোপথ ধরে রওনা হলো চানাচুরওলা। পিছু নিল আক্কেল আলী। তার সঙ্গে বেশ খানিকটা দূরত্ব রেখে অনুসরণ করলাম আমরা তিনজন।
শুরুতে পিছু নেয়াটা খুব একটা কঠিন হলো না, কারণ হাটফেরতা প্রচুর লোক চলেছে, তাদের সঙ্গে মিশে গেলাম আমরা। আকাশে চাঁদ আছে বটে, তবে চারু পাঁচদিনের। আলো যা আছে তাতে রাস্তা দেখা যায়, কিন্তু কয়েক গজ দূর থেকেও মানুষ চেনা যায় না। চানাচুরওলাকে চেনা যাচ্ছে তার বিচিত্র পোশাকের জন্যে, বিশেষ করে মাথার চূড়াওয়ালা টুপিটাই তার অস্তিত্ব ফাঁস করে দিচ্ছে।
এক জায়গায় এসে দু-ভাগ হয়ে গেছে রাস্তাটা। মূল পথটা চলে গেছে গায়ের দিকে, লোকজন সব সে-দিকে চলে গেল। রবি চলল অন্য পথটা ধরে নদীর দিকে। ভাগ্যিস এখানে চষা খেত আর নেই, ঝোঁপঝাড়ের ভেতর দিয়ে এগিয়েছে পথ, নইলে আমাদেরকে দেখে ফেলত সে। মাথা নুইয়ে ঝোঁপঝাড়ে গা ঢেকে নিঃশব্দে এগোলাম আমরা।
বেশ কাছে থেকেই তাকে অনুসরণ করে চলেছে আক্কেল আলী। কাজটায় ভয় যেমন লাগছে তার, মজাও পাচ্ছে। চমৎকার রোমাঞ্চ বোধ করেছে তার অনুভূতির কথা পরে সব বলেছে আমাদের।
হঠাৎ কি যেন ভেবে পেছন ফিরে তাকাল চোরটা। ঝট করে একটা ঝোঁপের পাশে বসে পড়ল আক্কেল আলী। তাকে আর দেখল না রবিগুণ্ডা।
এ কোথায় চলেছে সে?-অবাক হয়ে ভাবল আক্কেল আলী। ভাব দেখে তো মনে হচ্ছে নদীর পাড়ের শোনের দিকে চলেছে। সর্বনাশ! লোকটার কি ভয়ডর বলে কিছু নেই? ওখানেই তো আছে ভয়ঙ্কর এক কালী মন্দির, পারতপক্ষে ওদিকে ঘেষে না লোকে। এমনকি গরু চরাতেও যায় না রাখালরা। নেহায়েত বাধ্য হলে কোন কারণে দিনের বেলায়ও লোকে ওটার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দোয়া-দরূদ পড়ে বুকে ফুঁ দিতে দিতে যায়।
বিশাল এক নারকেল-সুপারির বাগানে ঢুকে গেছে পথটা। বাগানটার দুই পাশে বিরাট জঙ্গল। আম-কাঁঠাল-জাম ছাড়াও আরও নানা রকম গাছ আছে, মাঝে মাঝে বাশঝাড়। ভয়ানক জায়গা।
আক্কেল আলীকে অবাক করে দিয়ে একেবারে ওই কালী মন্দিরের সামনেই গিয়ে দাঁড়াল রবিগুণ্ডা। আরেক বার পেছনে তাকিয়ে দেখে নিশ্চিত হয়ে নিল কেউ পিছু নিয়েছে কিনা। কাউকে না দেখে ভাবল, নেয়নি। সেজন্যেই চোঙাটা নামিয়ে রেখে পকেট থেকে মোম আর দেশলাই বের করে ধরাল। আলো হাতে ঢুকে পড়ল মন্দিরের ভেতর।
পিছিয়ে এল আক্কেল আলী। ভয় পেয়েছে সে। দুই হাতে বাজারের ব্যাগ নিয়ে আরেকটু হলেই পড়েছিল আমাদের গায়ের ওপর।
কি হলো? জানতে চাইল কিশোর।
কা-কা-কালী মন্দিরে ঢুকল লোকটা!
তাতে কি?
বুঝতে পারছেন না? কাছেই শ্মশান, মড়া পোড়ানো হয়। আর ওই মন্দিরে কালীদেবীর পূজা হয়। বছরে একবার। বাকি সময়টায় খালিই পড়ে থাকে। লোকে বলে, ওই শশ্মশানের যত ভূতের আড্ডা ওই মন্দিরে।
খাইছে! আক্কেল আলীর চেয়ে বেশি ভয় পেয়ে গেল মুসা। আমি যাই!
ঘুরতে গেল সে। খপ করে তার হাত চেপে ধরল কিশোর। দাঁড়াও! রবিগুণ্ডাকে যখন ভূতে কিছু করে না, আমাদেরও করবে না। চলো, দেখি।
আগে আগে চলল কিশোর। তার পেছনে আমি। আমাদের পেছনে ভয়ে ভয়ে আসতে লাগল মুসা আর আক্কেল আলী।
মন্দিরের ভাঙা দরজা দিয়ে ভেতরের মোমের আলো দেখতে পেলাম। গাছপালার আড়ালে লুকিয়ে রইলাম আমরা।
ফিসফিস করে কিশোর বলল, এখানেই কোথাও লুকিয়ে রেখেছে গুপ্তধনগুলো। বেরও করতে পারছে না পুলিশের ভয়ে, নিয়ে পালাতেও পারছে না। নিতে পারলে এতদিনে পালিয়ে যেত। পুলিশকে ফাঁকি দেয়ার জন্যেই চানাচুরওয়ালার ছদ্মবেশে থাকতে হচ্ছে।
কিন্তু এই ব্যাটা এখানে থাকে কি করে! সাংঘাতিক অবাক লাগছে মুসার, এই ভূতের আড্ডায়!
তার মানেই তো বোঝা যাচ্ছে ভূতফুত কিছু নেই এখানে। কেউ আসেও না, নিরাপদ ভেবেছে জায়গাটা।
কি করব এখন আমরা? জিজ্ঞেস করলাম। লোকটাকে ধরার চেষ্টা করব?
না। ভয়ানক লোক সে। আরও পিস্তল থাকতে পারে তার কাছে। গুলি খেতে যাওয়ার মানে হয় না। তার চেয়ে এক কাজ করা যাক, তুমি আর আমি এখানে থাকি, মুসা আর আক্কেল আলী গিয়ে পুলিশকে খবর দিক। এখানে থেকে চোরটার ওপর নজর রাখব আমরা। আর তাকে পালাতে দেয়া যাবে না।
১১.
মুসা আর আক্কেল আলী চলে গেল।
চুপ করে বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম আমরা। একে তো জঙ্গল, তার ওপর শ্মশান, ভূতে বিশ্বাস না থাকলেও গা ছমছম করতে লাগল আমার। পরিবেশটা খারাপ। সেটাকে আরও ঘোরাল করে ভোলার জন্যেই যেন পেঁচা ডেকে উঠছে কর্কশ স্বরে, শোনা যাচ্ছে শেয়ালের হুক্কাহুয়া। কি করছে প্রাণীগুলো? নদীর ধারে কাঁকড়া খুঁজছে, না মড়ার তালাশে আছে?