কোথায় সরাবে?
দেখি গিয়ে। জায়গা একটা পেয়েই যাব। এতবড় বাড়িতে লুকানোর জায়গার অভাব হবে না।
আক্কেল আলীকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম আমরা। দেখি, গাছেই বাধা রয়েছে। কালু। আমরা বেরোনোর সময় ওকে ছেড়ে দিতে ভুলে গিয়েছিলাম। আমাদের দেখে কুঁই কুঁই শুরু করল।
রাগ করে মুসা বলল, ঠিক হয়েছে! তোর মত একটা অপদার্থ গর্দভের ওরকম শাস্তিই হওয়া উচিত। গলায় দড়ি বেঁধে থাকতে কেমন লাগল?
গুপ্তধনগুলো দেখার জন্যে ভেতরে ভেতরে তড়পাচ্ছে আক্কেল আলী। বাড়ি এসে আর থাকতে পারল না। বলল, চলুন না, জিনিসগুলো দেখি।
তাকে নিয়ে কয়লা রাখার ঘরে ঢুকলাম আমরা। ঢুকেই চক্ষু স্থির। আয়রন সেফের ঢাকনা হাঁ হয়ে খুলে আছে। ভেতরে নেই জিনিসগুলো।
তাড়াতাড়ি গিয়ে হুমড়ি খেয়ে বসে পরীক্ষা করতে লাগল কিশোর। মুখ না তুলেই বলল, কোন ধরনের এক্সপ্লোসিভ দিয়ে তালা ভেঙে খোলা হয়েছে!
তারমানে অহেতুকই এত কষ্ট করলাম আমরা! তিক্তকণ্ঠে বলল মুসা। গেল জিনিসগুলো! আর পাওয়া যাবে না!
বাতাসে বারুদের কড়া গন্ধ। নাক উঁচু করে শুঁকতে শুঁকতে কিশোর বলল, বেশিক্ষণ হয়নি গেছে।
তাতে কি? ধরা তো আর যাবে না।
তবু এখুনি গিয়ে পুলিশকে জানানো দরকার।
থানায় গিয়ে সেই সাব ইন্সপেক্টরকে পাওয়া গেল-ফারুক হোসেন, তাঁর ডিউটি শেষ হয়নি। এইবার সব কথা, অর্থাৎ গুপ্তধনের কথাটাও খুলে বলতে হলো। মৃদু অনুযোগ করলেন তিনি, তখন জিনিসগুলোর কথা তাকে না জানানোয়। তাহলে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে পারতেন। ভুল যে হয়ে গেছে, স্বীকার করতেই হলো আমাদের।
ওয়্যারলেসে আশপাশের সমস্ত ফাঁড়িতে খবরটা জানিয়ে দিলেন তিনি। রেলস্টেশন, বাস স্টেশন আর যেদিকে যে-কটা মহাসড়ক বেরিয়ে গেছে, সবগুলোতে কড়া পাহারার ব্যবস্থা হলো। রবিগুণ্ডার চেহারার বর্ণনা দিয়ে দেয়া হলো। ওরকম চেহারার লোকের ব্যাপারে সতর্ক থাকবে পুলিশ।
দু-জন কনস্টেবলকে সঙ্গে করে নিয়ে এসে সরেজমিনে তদন্ত করে দেখে গরমের ছুটি গেলেন সাব ইন্সপেক্টর। বললেন, চোরটার কোন খবর পেলে আমাদের জানামো হবে।
আক্কেল আলী হাসপাতালে গিয়ে দাদাকে খবরটা জানানোর কথা বলল। কিশোর রাজি হলো না। অসুস্থ অবস্থায় তাকে সুখবর দেয়া যায়, কিন্তু দুঃসংবাদ জানানোটা উচিত নয়।
.
১০.
এরপর কয়েক দিন কেটে গেল। আর কোন ঘটনা ঘটল না। জমিদার বাড়িতে আছি আমরা। খাইদাই, ঘুরে বেড়াই আর গুপ্তধনগুলো পেয়েও হাতছাড়া হয়ে গেল বলে দুঃখ করি। ওগুলো উদ্ধারের আর কোন ব্যবস্থা করতে পারিনি।
দাদার অবস্থা ভাল হয়ে আসছে। পায়ের হাড় জোড়া লাগতে আরও দেরি হবে। তবে সে-জন্যে হাসপাতালে আর থাকার প্রয়োজন পড়বে না। শুনলাম, শথ্রি তাকে ছেড়ে দেয়া হবে।
রবিগুণ্ডা ধরা পড়েনি। তার কোন হদিসই করতে পারেনি পুলিশ। হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে যেন সে।
আমাদেরই খুঁজে বের করতে হবে ওকে, একদিন বলল কিশোর।
কি করে? মুসার প্রশ্ন। কোন সূত্র নেই আমাদের হাতে। কোথায় খুঁজব? পুলিশই যেখানে বিফল হয়েছে, আমরা কি করতে পারি?
তা জানি না। তবে কিছু একটা করা দরকার।
কোন ব্যাপারেই সহজে নিরাশ হওয়া কিশোরের ধাতে নেই।
যাই হোক, সুত্রটা হঠাৎ করেই পেয়ে গেলাম। কিংবা বলা যায় সূত্রের মালিককেই পাওয়া হয়ে গেল। সেদিন হাটের দিন। দুপুরের পর আক্কেল আলী কল, হাটে যাবে। আমরাও রওনা হলাম তার সঙ্গে।
বিরাট হাট বসেছে ময়নামতি বাজারের আশপাশ জুড়ে। ঘুরে ঘুরে সওদা করতে শুরু করল আক্কেল আলী! সব পাওয়া যাচ্ছে এখানে–মাছ, তরিতরকারি, ডিম, নানা রকম ফল। খুবই ভাল লাগত আমাদের, কিন্তু মজা অনেকখানি নষ্ট করে দিল আমাদের প্রতি মানুষের অস্বাভাবিক কৌতূহল। বিদেশী দেখলেই বোধহয় এ রকম করে ওরা। দল বেঁধে শুধু যে ছোট ছেলেরা পেছনে লাগল, তা নয়, অনেক বড় মানুষও আমাদের পিছে পিছে ঘুরতে লাগল। কোথায় যাই, কি করি, দেখে। শেষে ধমক দিয়ে ওদের সরাতে হলো আক্কেল আলীকে। তা-ও কি আর পুরোপুরি সরে। কয়েকটা ছেলে লেগেই রইল, এমন ভাবভঙ্গি ওদের, আমরা যেন চিড়িয়াখানার জীব, কিংবা ভিনগ্রহ থেকে নেমেছি।
এক জায়গায় গরম গরম জিলিপি ভাজা হচ্ছে দেখে লোভ সামলাতে পারল না মুসা, খেতে বসে গেল। আমি আর কিশোরও বসলাম। লোকের কৌতূহলী নজর আমাদের দিকে মুহূর্তের জন্যেও যেন সরাতে ইচ্ছে করছে না ওদের। আড়ষ্ট বোধ করতেন রকম ফুল মানুষের অস্থাটি করতে লাগলাম আমি। তবে মুসা ওসব কেয়ার করল না। কুড়মুড় করে খেয়েই চলল। দেখতে দেখতে সাবাড় করে দিল কেজিখানেক।
হঠাৎ এক চানাচুরওয়ালার ওপর চোখ পড়ল আমাদের। রঙিন বিচিত্র পোশক পরনে, মাথায় লম্বা চোখা টুপি, মুখে চোঙ। সেটাতে ফুঁ দিয়ে বো বো আওয়াজ করছে, অদ্ভুত ভঙ্গিতে কথা বলছে। যেন সার্কাসের সঙ। তার চোখও আমাদের ওপর। আমরা তাকাতেই দ্বিধা করল, চোখ নামিয়ে নিল, তারপর সরে চলে গেল আরেক দিকে।
লোকটাকে চেনা চেনা লাগল না? লোকটার পেছনটা দেখা যাচ্ছে, সেদিকে তাকিয়ে আছে কিশোর।
কিসের চেনা, জিলিপির আমেজে রয়েছে এখনও মুসা। পাশের দোকানে কদমা বিক্রি হচ্ছে। কদমার স্তূপের দিকে খেয়াল এখন তার। এখানে ওরকম সাজ সেজেই চানাচুর বিক্রি করে তো, পোশাকের জন্যে সবাইকেই এক রকম দেখা যায়।