দরজা খুলে আমাদের নিয়ে চলে এল সিঁড়ির নিচে। জালের মত ঢাকনাটার কাছে এসে কিশোর বলল, দেখো, এইটাকে যদি জাল ধরে নিই, তাহলে এর নিচে কি আছে?
কয়লা, নিরীহ স্বরে জবাব দিল মুসা।
আমি চেঁচিয়ে উঠলাম, অন্ধকার!
হ্যাঁ, অন্ধকার, মাথা ঝাঁকাল কিলোর, মানে, আঁধার। জালের নিচে আঁধার খুঁজতে বলা হয়েছে। চলো, সেটাই এখন খুঁজি।
একটানে ঢাকনাটা খুলে নিয়ে সবার আগে নেমে পড়ল মুসা। আমি আর কিশোর নামলাম তার পেছনে। দেয়াল ঠুকে ঠুকে পরীক্ষা করলাম আমরা। মেঝে পরীক্ষা করলাম–জায়গায় জায়গায় ছাল-চামড়া ওঠা, মেরামত করার কথাও আর মনে হয়নি কারও। এখানে নামেই না কেউ। প্রায়োজন পড়ে না। কোথাও কোন ফাপা শব্দ হলো না। ঘরে কোন জানালা দরজা নেই, আলো আসার পথ নেই, ঢোকার একমাত্র পথ ওই জালিকাটা ঢাকনাটা।
সিন্দুকটা আছে কোথায়? প্রশ্নটা আমাদের সবারই মনে।
এককোণে অযত্নে ফেলে রাখা হয়েছে কিছু কয়লা, ছোট একটা ভূপ। সেদিকে তাকিয়ে নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটতে লাগল কিশোর।
বাইরে কালুর ঘেউ ঘেউ শোনা গেল। সে যে উত্তেজিত হয়ে ডাকছে, গুপ্তধনের চিন্তা আমাদের মাথায় না থাকলে হয়তো বুঝতে পারতাম। কিন্তু এ-মুহূর্তে কোন গুরুত্বই দিলাম না ডাকটাকে।
কয়লার স্তূপের দিকে হাত তুলল কিশোর, ওর নিচে দেখতে হবে।
মরচে পড়া একটা বেলচা পড়ে আছে। সেটা তুলে নিল মুসা।
কয়লা সরাতে দেরি হলো না। মেঝেতে দেখা গেল খানিকটা জায়গার প্লাস্টার নেই। ইট বেরিয়ে আছে। ওরকম ইট ঘরের অনেক জায়গাতেই বেরিয়ে আছে। আলাদা কিছু না। খুব একটা আশা করতে পারলাম না।
শাবল দিয়ে চাড় মেরে সেগুলো তোলার পরই কিন্তু বেরিয়ে পড়ল একটা খুদে আয়রন সেফ। চিত করে শোয়ানো। ডালা এবং হাতল ওপরের দিকে করা।
উত্তেজনায় প্রায় কাঁপছি আমি। মুসার অবস্থাও আমারই মত।
আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসল কিশোর। বলল, জালের নিচে আঁধার খোজো, সিন্দুক আছে তাহার ভেতর। এটুকু মিলে গেল। এবার পরের লাইন–সাত তিন পাঁচ মিলিয়ে দেখো। এটা সহজ, নিজেই যেন নিজেকে বোঝাচ্ছে সে, লক কম্বিনেশন। চাবির ফুটোয় চাবি ঢুকিয়ে মোচড় দিল। ঘুরল না। নব ধরে কম্বিনেশন মেলাতে শুরু করল-সাত…তিন…পাঁচ। কট করে একটা আওয়াজ হলো। আবার চাবিতে মোচড় দিতেই খুলে গেল তালা।
হাতল ধরে বাঁকা করে চাপ দিয়ে টেনে ডালা খুলল কিশোর।
হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম আমরা। টর্চের আলোয় যেন জ্বলতে লাগল সোনা আর পাথরে তৈরি মহামূল্যবান জিনিসগুলো।
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে থাকার পর নীরবতা ভাঙল মুসা, খাইছে, কি জিনিসরে বাবা! দাম কত হবে?
খড়খড়ে গলায় জবাব এল ওপরের ঢাকনার কাছ থেকে, অনেক! কোটিখানেক টাকা হলেও অবাক হব না। অনেক ধন্যবাদ তোমাদেরকে, খুঁজে বের করার জন্যে।
ঝট করে ফিরে তাকালাম আমরা। অপরিচিত একটা লোক। হাতে পিস্তল। ধীরপায়ে সরু সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসতে শুরু করল সে।
কয়লার ঘরের মেঝেতে এসে দাঁড়াল লোকটা।
কে আপনি? কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে কিশোর, বুঝতে পারছি।
বললেই কি আর চিনবে? খড়খড়ে গলায় বলল লোকটা, আমার নাম রবিউল। কিন্তু অনেকেই আমাকে দেখতে পারে না, বলে রবিগুণ্ডা। তাতে অবশ্য আমি কিছু মনে করি না, আড়ালে বলে তো। সামনে বলার সাহস কারও নেই।
কি চান?
সেটা আবার বলে দিতে হবে নাকি? হাতে করে আনা একটা চটের ব্যাগ ছুঁড়ে দিয়ে বলল রবিগুণ্ডা, অনেক করেছ, ছোট্ট আরেকটা কাজ করো, জিনিসগুলো ভরে দাও, নিয়ে বিদেয় হই।
তারমানে আপনিই লেগেছিলেন পেছনে। ছবি চুরি করেছেন, খালি বাড়িতে এসে কালুকে মালীর ঘরে ভরে রেখে অনুসন্ধান চালিয়েছেন…
কালু কি কুত্তাটার নাম নাকি? ভীষণ পাজি। এখন ও তো ঢুকতেই দেবে না। শেষে মাথায় বাড়ি দিয়ে বেহুশ করে ফেলে রেখে আসতে হলো।
মতিদাদার গাড়িতেও আপনিই ধাক্কা লাগিয়েছিলেন নাকি?
খিক খিক করে হাসল রবিগুণ্ডা। না, আমি না, আমার এক দোস্ত।
ও। একটা মুহূর্ত চুপ করে রইল কিশোর। গালে হাত ডলল। তারপর বলল, তার মানে একা কাজ করছেন না আপনি। দলে আরও লোক আছে। আপনাদের বস কে?
হাসি হাসি ভাবটা দূর হয়ে গেল রবিগুণ্ডার মুখ থেকে। আচমকা খেঁকিয়ে উঠল, এত কথা জিজ্ঞেস করো কেন! যা বলছি, করো, জিনিসগুলো ব্যাগে ভরে দাও গুলি খেতে না চাইলে! জলদি!
আচ্ছা আচ্ছা, যাচ্ছি! তাড়াতাড়ি বলল কিশোর। গুলি করবেন না!
এক ধমকেই কাবু হয়ে গেল! এটা তো তার স্বভাব না। কোন চালাকি করছে না তো? পরস্পরের দিকে তাকালাম আমি আর মুসা।
আড়চোখে দেখলাম, সেটার কাছে গিয়ে আবার বসে পড়ল কিশোর। লোকটার দিকে পেছন করে। হাঁ হয়ে খুলে থাকা ডালার নিচে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে বের করে আনল চাবিটা, আলগোছে ফেলে দিল বুক পকেটে, লোকটার অলক্ষে। তারপর এক ঝটকায় ডালাটা আবার লাগিয়ে দিয়ে কম্বিনেশনের নব ঘুরিয়ে সব নম্বর দিল এলোমেলো করে।
অ্যাই, কি করো, কি করো! বলে চিৎকার করে উঠল লোকটা।
হাত ঝাড়তে ঝাড়তে উঠে দাঁড়াল কিলোর। ডালাটা বন্ধ করে দিলাম।
খোলো, নইলে গুলি করব!।
পা বাড়াতে গেল মুসা। ঝট করে তার দিকে পিস্তল ঘুরিয়ে ধমক দিল রবিগুণ্ডা, খবরদার!
থেমে গেল মুসা।
কঠিন কঠে বলল লোকটা, এক থেকে তিন পর্যন্ত শুনব। এর মধ্যে না খুললে প্রথমে পায়ে গুলি করব, তারার… কি করবে পিস্তল নাচিয়ে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিল সে।